24 Dec জলসা সালানা ইউকে ২০১৭
জলসা সালানা ইউকে ২০১৭
ব্যক্তিগত ডায়েরী – ১ম পর্ব
আবিদ খান (বাংলা অনুবাদ)
ভুমিকা
২০১৬ সালের ইউকে জলসার সময় হযরত খলীফাতুল মসীহ খামেস(আইঃ) আমাকে তার কাছাকাছি দুই সপ্তাহ থাকার সুযোগ দেন। এ সময় আমি হুজুরের বিভিন্ন কর্মকান্ড লক্ষ্য করি এবং যারা হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের সাথে কথা বলি। আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে এবারও আমি এরকম সুযোগ পাব কিনা। এ বছরও অনেক মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমি এবারের জলসা সালানার কোন ডায়েরী লিখব কিনা। আমি তাদেরকে বলি যে আমি এজন্য হুজুরের দিক নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছি।
১২ জুলাই ২০১৭ তারিখে হুজুর আমাকে বলেন “তোমার এ বছরও জলসা সালানার ডায়েরী লেখা উচিৎ। তুমি এ সপ্তাহেই মসজিদ ফযল থেকে কাজ শুরু করবে এবং পরবর্তী সপ্তাহে জলসার সময়ও কাজ করবে। ”
এতে আমি স্বভাবতই অত্যন্ত আনন্দিত হই যে আমি আবারও হুজুরের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পাব। এবারও আমি হুজুরের দৈনন্দিন কাজের পরিধি দেখে আশ্চর্য হই। সারা বছরই হুজুর অত্যন্ত ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু জলসা সালানার সময় এই ব্যস্ততাই অনেক গুণ বৃদ্ধি পায়।
প্রতিবারের মতোই পুরো বিশ্ব থেকে আহমদীগণ লন্ডনে সমবেত হন। হুজুর ব্যক্তিগতভাবে তাদের অনেকের সাথেই সাক্ষাৎ করেন এবং জামাত কর্মকর্তাদের সাথেও কথা বলেন। হুজুর বিভিন্ন অতিথি ও মিডিয়ার সাথে কথা বলেন। বিভিন্ন দেশের জামাতী কর্মকর্তাদের সাথে মিটিং করেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ও বিভিন্ন বিষয়ে প্রজ্ঞার সাথে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।
এসব কাজের পাশাপাশি হুজুর জলসা সালানার জন্য তার বক্তব্য তৈরী করেন। হুজুর পুরো বিশ্ব থেকে আহমদীগণ যে চিঠি দেন সেগুলোর উত্তর দেন এবং জামাতী চিঠিপত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। হুজুর জলসা সালানার উদ্দেশ্যে আগত প্রত্যেক দলের খোজ খবর রাখেন। ব্যবস্হাপনায় কোন সমস্যা দেখা দিলে হুজুর সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেন ও দোয়া করেন।
আমি চেষ্টা করেছি আমার ডায়েরীর মাধ্যমে হুজুরের ব্যাপক কর্মকান্ডের একটি ধারণা পাঠকদের দিতে। কিন্তু লেখার মাধ্যমে এটি সম্পূর্ণভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। জলসায় আগত প্রত্যেক মানুষ ও যারা হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য লাভ করেছে তাদের অনুভূতিও প্রকৃতভাবে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
একটি জামাতী মোলাকাত
এ বছর ২৬ জুন ২০১৭ তারিখে ঈদ-উল-ফিতর হয়েছে। এর ফলে জলসা সালানার জন্য মাত্র এক মাস সময় পাওয়া যাবে। ঈদ এর পরদিন থেকেই বিভিন্ন স্হান থেকে লন্ডনে মানুষ আসতে শুরু করে। দিন দিন আগত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল।
আগত মানুষের মধ্যে একজন ছিলেন সাঈদ মোবাশশের আইয়াজ(৫৪ বছর) সাহেব। তিনি ২০১৫ সাল থেকে জামেআ আহমদীয়া রাবওয়ার প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করছেন।
সারা বছরই হুজুর বিভিন্ন জামাতী মিটিং করে থাকেন। সাধারণত সকালে মিটিং শুরু হয় এবং জোহরের নামায পর্যন্ত চলে। এসময় হুজুর বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। এসময় হুজুর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সকল সমস্যার সমাধান দেন।
আইয়াজ সাহেব বলেন “যখনই আমি জামাতী মিটিং এ হুজুরকে কোন বিষয় বলি; আমি মনে করি যে হয়ত হুজুরকে পুরো বিষয়টি বোঝাতে ৩০-৬০ মিনিট সময় লাগবে। কিন্তু আমি দেখেছি যে আল্লাহপাক খলীফাকে সাহায্য করেন এবং যেটি আমি ভেবেছিলাম ১ ঘন্টা সময় লাগবে সেটি ৩-৪ মিনিটেই হয়ে যায়। এরপর আমার আর কোন প্রশ্নই থাকে না। সামান্য সময়ে হুজুর আমার সকল সমস্যার সমাধান করে দেন।”
“মাঝেমাঝে আমার প্রশ্ন শেষ হয়ে যায় এবং এরপর হুজুর আমাকে বলেন আর কিছু বাকি আছে। এবার আমি ২০ টি প্রশ্ন নিয়ে হুজুরের কাছে যাই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি হুজুরের কাছ থেকে বরকতময় নির্দেশনা পাই যার ফলে জামাত অনেক দিন সুফল পাবে। হুজুরের অফিস থেকে বের হবার পর আমার মনে হল আমি এক নতুন জীবন লাভ করেছি। ”
আর একটি জিনিস আইয়াজ সাহেব বলেন যে কখনো হুজুর তার ধারনার বিপরীত দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তিনি বলেন “গত বছর আমি হুজুরকে বলি যে এমটিএ তে ফিকাহী মাসায়েল এর একটি বিষয়ে আমি মনে করি তারা ভুল বলেছে। আমি ধারণা করেছিলাম যে হুজুরও আমার সাথে একমত হবেন। কিন্তু হুজুরের উত্তর শুনে আমি বুঝি যে আমিই ভুল চিন্তা করছিলাম এবং হুজুর অত্যন্ত প্রজ্ঞা সম্পন্ন কথা বলেন। ”
“হুজুর অত্যন্ত ভালবাসার সাথে দিক নির্দেশনা ও শিক্ষা প্রদান করেন। তাই যখন আমাদের কোন ভুল হয় এবং হুজুর সেটি সংশোধনের জন্য বলেন তার ফলে হুজুরের প্রতি আমাদের ভালবাসা আরো বৃদ্ধি পায়। ”
আমি তাকে হুজুরের খিলাফতের পূর্বে কোন স্মরণীয় মুহুর্তের কথা জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন “খিলাফতের পূর্বে হুজুর অত্যন্ত কম কথা বলতেন। হুজুর যখন কোন জামাতী অনুষ্ঠানে যেতেন তখন পূর্ব থেকেই বলে রাখতেন যে তিনি কোন বক্তব্য রাখবেন না এবং কোন বুজুর্গ ব্যক্তি বক্তব্য দিবেন। এটি অত্যন্ত ঈমান উদ্দীপক ঘটনা যে একজন মানুষকে আল্লাহ যতক্ষন পর্যন্ত পুরো বিশ্বের সামনে কথা বলার নির্দেশ দেন নি ততদিন পর্যন্ত তিনি নীরব থাকাই পছন্দ করতেন। সেই মানুষই আজ যুগ খলীফা এবং তিনি পুরো বিশ্বকে আল্লাহর বাণী প্রচার করছেন। নিশ্চিতভাবেই যারা তার সতর্কবাণী শুনবে না তারা বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুক্ষীণ হবে। ”
আইয়াজ সাহেব বলেন “মোলাকাতের সময় আমি হুজুরকে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। হুজুর আমাকে তিনি যখন ঘানাতে ছিলেন সে সময়ের কথা বলেন। আমি জানতে পারি যে হুজুর অনেক সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি যা পেতেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন এবং কখনো কোন অভিযোগ করেননি। হুজুর আমাকে সাধারণভাবে চলতে উপদেশ দেন। কারণ জামেআ আহমদীয়ার প্রিন্সিপাল হিসেবে আমাকে ছাত্রদের জন্য নিজেকে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে জীবন যাপন করতে হবে।
আল্লাহর উপর বিশ্বাস
কিছুদিন পর আমি হুজুরকে আইয়াজ সাহেবের সাথে আমার কথোপকথনের বিষয়টি বলি। হুজুর তখন অনুগ্রহ করে আমাকেও তার আফ্রিকা থাকার সময়ের কিছু ঘটনা বলেন। এসব ঘটনা শুনে হুজুরের সাধারণ জীবন যাপন ও আল্লাহর উপর অগাধ বিশ্বাস লক্ষ্য করা যায়।
হুজুর বলেন “আমরা যখন আফ্রিকাতে থাকতাম তখন আমাদের বাচ্চারা ছোট ছিল। তাই তাদের খাবার জন্য দুধের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দুধ সবসময় পাওয়া যেত না। মাঝে মাঝে দুধ সংগ্রহ করার পূর্বেই শেষ হয়ে যেত। আমার মনে আছে একবার আমাদের দুধ শেষ হয়ে গেল এবং আমার স্ত্রী এজন্য অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্হ ছিলেন। কিন্তু আমি তাকে বলি যে আমরা কারো সাহায্য চাইব ন। বরং আমরা আল্লাহর কাছে ইসতেগফার করব কারণ এতে অনেক বরকত রয়েছে। বিষয়টি আমরা আল্লাহপাকের উপর ছেড়ে দিব। ”
হুজুরের কথা শুনে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। হুজুর ও তার স্ত্রী এমন পরিবেশে বাস করেছেন যেখানে তাদের সন্তানদের জন্য মৌলিক খাবার সংগ্রহ করাই কঠিন ছিল। কিন্তু একই সাথে এটিও লক্ষ্যণীয় যে হুজুর তরুণ বয়সে বিদেশের মাটিতে অনেক কষ্ট করেছেন কিন্তু কখনো ভয় পাননি বা কোন হতাশা প্রকাশ করেননি।
হুজুর আরো বলেন “আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া ও ইসতেগফারে রত থাকি। এসময় সন্ধ্যায় আমাদের দরজায় কেউ নক করে। দরজা খুলে আমি দেখি একজন আহমদী শিক্ষক। তিনি শত মাইলের রাস্তা অতিক্রম করে কুমাসি শহরে যাচ্ছেন। তিনি বলেন সফরের সময় তার মনে হল যে আমার বাচ্চাদের জন্য হয়ত দুধের প্রয়োজন হবে। তাই তিনি অত্যন্ত কঠিন রাস্তা অতিক্রম করে আমাদের জন্য এক কার্টন দুধ নিয়ে আসেন। যেটি আমাদের বাচ্চাদের কয়েকদিনের জন্য পর্যাপ্ত ছিল। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহপাক আমাদের দোয়া শুনেছেন।”
ঘানার সার্বিক পরিস্হিতি সম্বন্ধে হুজুর বলেন “আফ্রিকাতে খাবারের স্বল্পতা রয়েছে। তাই আমার স্ত্রী রান্নার মধ্যে বৈচিত্র আনার চেষ্টা করতেন। তাই আমরা মাঝেমাঝে কোন মাংস ও সবজি ছাড়াই তরকারী খেতাম। ”
হুজুর যখন আমাকে এসব বলছিলেন তখন তার মুখে হাসি ছিল। তিনি সেই কষ্টের সময়কে দুঃখের সাথে স্মরণ করেননি। বরং তিনি অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন যে কিভাবে আল্লাহপাক তাদের সকল প্রয়োজন মিটিয়েছেন।
আহমদীদের আবেগ
খিলাফতের একটি বিরাট বরকত হল প্রত্যেক আহমদীর হৃদয়েই খলীফা রয়েছেন। আমি সামির উদ দীন খান (৩৫ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। যিনি কয়েক বছর যাবৎ দুবাইয়ে রয়েছেন। জলসার কয়েকদিন পূর্বে হুজুরের সাথে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি আমাকে বলেন “সেদিনের মোলাকাতের পূর্বে আমি খুব বিচলিত ছিলাম। কারণ আমার জীবনের ব্যাপারে দুইটি প্রশ্ন ছিল যার জন্য আমি হুজুরের উপদেশ নিব। গত সাত মাস ধরেই আমি এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছি। কারণ এই সিদ্বান্ত আমার জীবনের উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। যখন আমি হুজুরকে এ ব্যাপারে বলি তখন হুজুর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অত্যন্ত সুন্দর উত্তর দেন এবং এর ফলে আমার মনে হল আমার কাধ থেকে একটি ভারী বোঝা সরে গেল। হুজুর অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে মুখে হাসি নিয়ে উত্তর দিয়ে থাকেন। কিন্তু তার পেছনে গভীর প্রজ্ঞা থাকে। ”
আমি নিউইয়র্কের একজন তরুন ছাত্র শাহরুখ খান(২৩ বছর) সাথে কথা বলি। তিনি গ্রীষ্মকালে অক্সফোর্ডে ইন্টার্নশিপ করেছেন। তিনি বলেন “ছোটবেলা থেকেই আমি হুজুরের খুৎবা শুনি এবং তাকে আমার আদর্শ বলে মনে করি। কিন্তু তার সাথে সামনাসামনি দেখা করে খলীফার প্রতি আমার ভালবাসা একটি নতুন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আমি একপ্রকার আধ্যাত্মিকতা অনুভব করি যেটি পূর্বে ছিলনা। আমার হৃদয়ে এক নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয় কারণ আমি বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র মানুষের সাথে দেখা করেছি। ”
“পশ্চিমা বিশ্বে বেড়ে উঠা অনেক কষ্টকর। আমাদের অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয় যেটি আমাদের ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু খিলাফত হল একপ্রকার ঢাল। যা আমাদের বোঝায় যে পার্থিব জিনিস হল সাময়িক এবং আমাদের ধর্মের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। হুজুর তরুণদের বোঝায় যে ইসলাম বাধা দেয় না বরং আমাদের আবেগকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করে আরো উন্নত হতে সাহায্য করে। যেমন আমি যখন হুজুরকে আমার ভবিষ্যত পড়াশোনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি হুজুর আমাকে বলেন যে আমার যেই বিষয় পড়তে ভাল লাগে আমি যেন সেই বিষয়েই পড়াশোনা করি। ”
আমি আমেরিকার নিউজার্সির ইউসুফ সাঈদ(৫১ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি পাঁচ বছর পর হুজুরের সাথে সাক্ষাত করেছেন। তিনি বলেন “হুজুরের সাথে দেখা করার পর আমি কথা বলতে ও নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। যেই নূর হুজুরের কাছ থেকে উৎসারিত হচ্ছিল সেটি আমি পূর্বে কখনো অনুভব করিনি। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে খিলাফত আমাকে উদ্ধার করেছে। আমি যদি আহমদী না হতাম তাহলে নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হতাম। এ বিষয়ে আমি রসিকতা করছি না। পৃথিবীতে অনেক সমস্যা রয়েছে। বিশেষত অভিবাসীরা অনেক হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আরো অনেক বিষয় রয়েছে যা একজনকে অস্হির করে তুলতে পারে এবং বিপথগামী করতে পারে। তাই আমি বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। কারণ খিলাফতে-আহমদীয়া আমাকে রক্ষা করেছে এবং সঠিক পথে চালিত করেছে।”
একটি ঈমান বর্ধক ঘটনা
আমি জলসায় আগত মাহমুদ আহমদ (২৭ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি জামেআ আহমদীয়া জার্মানী থেকে মোবাল্লেগ হিসেবে পাশ করেছেন। তিনি হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পূর্বে আমার সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন আমি গত ডায়েরীতে একজন মহিলার কথা উল্লেখ করেছিলাম যিনি তার সন্তানের জন্য হুজুরের দোয়া চেয়েছিলেন। আমি লিখেছিলাম যে হুজুর সেই মহিলাকে জানাতে বলেছেন যে হুজুর সারারাত তার জন্য দোয়া করেছেন। মাহমুদ সাহেব আমার কাছে জানতে চাইলেন যে তিনিও কি তার পরিবারের জন্য এভাবে দোয়া চাইতে পারেন কিনা।
আমি উত্তরে তাকে বলি “আমি হুজুরকে সরাসরি জিজ্ঞেস করিনি যে সারারাত উনার জন্য দোয়া করতে হুজুর কি বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়না যে হুজুর সারারাত কেবল উনার জন্যই দোয়া করেছেন। ”
মোলাকাতের পর আমি তার সাথে আবার কথা বলি। তিনি বলেন “আমি হুজুরকে সেভাবে দোয়ার জন্য অনুরোধ করি। হুজুর বলেন যে সারারাত ধরে দোয়া করেছি বলতে হুজুর বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তিনি রাতের বিভিন্ন অংশে তার জন্য দোয়া করেছেন। এরকম নয় যে সারারাত কেবল উনার জন্যই দোয়া করেছেন। ”
মাহমুদ সাহেব এরপর আমাকে তার জীবনের একটি ঈমান বর্ধক ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন “জামেআতে থাকার সময় আমার খুব কাছের বন্ধু আরসালান হুজুরের কাছে চিঠি লিখে সফলতার গোপন রহস্য জানতে চায়। উত্তরে হুজুর লিখে পাঠান সফলতার গোপন রহস্য হল নিয়মিতভাবে সময়মতো নামায আদায় করা। হুজুরের উত্তর পাবার পর আরসালান জামেআর সাত বছর মসজিদে যেয়ে নিয়মিত নামায আদায় করে। কয়েক বছর পর আমাদের জামেআ নতুন স্হানে পরিবর্তন করা হয়। উদ্বোধনের সময় হুজুর সেখানে আসেন। সেসময় সকল জামেআ ছাত্র ও শিক্ষক হুজুরের কাছাকাছি বসে ছিলেন। আমি আরসালানের পাশে বসেছিলাম। সেসময় আরসালান আল্লাহর কাছে দোয়া করে ‘হে আল্লাহ যদি তুমি সত্যই থেকে থাক তাহলে দয়া করে হুজুরকে আমার কথা স্মরণ করিয়ে দাও।’ এই দোয়া করার কয়েক সেকেন্ড পরই হুজুর তার স্হান থেকে জিজ্ঞেস করেন ‘আরসালান কোথায়?’ আরসালান অবাক হয়ে উঠে দাড়ায়। হুজুর তার দিকে দেখেন ও বসতে বলেন। আমি এই ঈমান উদ্দীপক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমি মনে করিনা অন্য যে কেউ এই দোয়া করলে আল্লাহ তা কবুল করতেন। আমার বন্ধু হুজুরের উপদেশ মতো নিয়মিত নামায আদায় করেছে। তাই আল্লাহপাক তাকে সেসময় তার দোয়া কবুল করে তাকে পুরস্কৃত করেছে। ”
ওয়েলশের বয়াতকারী আহমদী
আমি ওয়েলশের অ্যাশলে হাওয়েল টমাস(৭৭ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি ২০১৬ সালে বয়াত করেন। তিনি বলেন “আমি সবসময় নিজেকে ধার্মিক মানুষ বলেই বিবেচনা করতাম। আমি চার্চের কাজকর্মে সবসময় নিয়োজিত থাকতাম। কিন্তু ঈসা(আঃ) এর খোদা হবার বিষয়টি আমি কোনভাবেই বুঝতাম না। আমার বয়স যত বৃদ্ধি পেতে থাকে এ বিষয়ে সন্দেহ ততই বাড়তে থাকে।”
“কয়েক বছর আগে আমার কিছু আহমদীর সাথে দেখা হয়। তারা কার্ডিফে একটি স্টলে ইসলামের বাণী প্রচার করছিল। তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট হই। তারা সকল প্রকার ধর্মীয় ঘৃণার বিরোধী ছিল। পরবর্তী কয়েক মাস আমি ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা করি। আমি বুঝতে পারি যে ইসলাম সবদিক দিয়েই আদর্শ জীবন বিধান। যখন বিভিন্ন স্হানে ইসলামবিরোধী প্রচারণ চলছে তখন আমি মহানবী (সাঃ) এর জীবন বইটি পড়ি। আমি মহানবী(সাঃ) এর উত্তম চরিত্র পড়ে অত্যন্ত প্রভাবিত হই। আমি মনে মনে ইসলাম গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হই। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে ইসলামের এতগুলো দলের মধ্যে কোনটি সত্য। আমি দ্রুতই বুঝতে পারি যে আহমদীগণই সবচেয়ে সহনশীল এবং তাদের উত্তরগুলো যুক্তিসম্মত। বয়াত করার এক বছর পর আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে আমি সঠিক পথই বেছে নিয়েছি। ”
“আহমদীদের সাথে অন্যান্য মুসলমান দলগুলোর বিরোধিতা দেখে আমি হতাশ হয়েছি। একবার আমি ট্যাক্সির মুসলমান চালকের সাথে কথা বলছিলাম। তিনি আমার কাছে জানতে চান যে আমি কেন আহমদী মসজিদে যাচ্ছি। আমি তাকে বলি যে আমার উদ্দেশ্য হল আল্লাহকে মান্য করা এবং আমি বিশ্বাস করি মহানবী(সাঃ) আল্লাহর রাসূল। আমার উত্তর পেয়ে সে কিছুটা প্রসন্ন হয়। ”
হুজুরের সাথে প্রথম মোলাকাতের ব্যাপারে তিনি বলেন “হুজুরের উপস্হিতিতে আমি নিরাপদ বোধ করি। আমি তার বিনয় দেখে অবাক হয়েছি। আমি আরো খুশি হয়েছি কারণ আমি হুজুরের কাছে মুসলিম নামের জন্য অনুরোধ করেছিলাম এবং তিনি আমার নাম দিয়েছেন ‘নাসির’। এটি অত্যন্ত সুন্দর নাম এবং এই নাম নিয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।”
অষ্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্যের সাথে মিটিং
১৯ জুলাই ২০১৭ তারিখে হুজুর অষ্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্য কেভিন কনোলি ও তার স্ত্রীর সাথে মিটিং করেন। আমি হুজুরের একটি গুণ লক্ষ্য করেছি। সেটি হল তিনি কারো সামান্য আতিথেয়তাও ভুলে যান না। যেমন ২০১৫ সালে জাপান সফরের সময় জাপানিজ ব্যবসায়ী মিঃ সাটো, হুজুরের সম্মানে একটি দাওয়াতের আয়োজন করেছিলেন। কয়েক মাস পর হুজুর জানতে পারেন যে মিঃ সাটো লন্ডনে আছেন। তাই তখন তিনি তাকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানান।
একইভাবে ২০১৩ সালে হুজুরের অষ্ট্রেলিয়া সফরের সময় সংসদ সদস্য কেভিন কনোলি হুজুরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এয়ারপোর্টে উপস্হিত ছিলেন। হুজুর তাকে ধন্যবাদ জানান এত সকালে তার জন্য এভাবে অপেক্ষা করার জন্য।
কেভিন কনোলি যখন ফযল মসজিদে আসেন আমি তাকে অভ্যর্থনা জানাই এবং কয়েক মিনিট তার সাথে কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন যে তিনি ব্যক্তিগত ছুটিতে লন্ডন এসেছেন এবং কয়েক মিনিটের জন্য হলেও হুজুরের সাথে সাক্ষাত করতে চান। হুজুরের সাথে কথা বলার পর আমি আবার তার সাথে কথা বলি। তিনি আমাকে বলনে যে হুজুর তাকে ৪০ মিনিট সময় দেয়ায় তিনি আশ্চর্য হয়েছেন। কারণ তিনি ৫-১০ মিনিটের বেশি সময় আশা করেননি। আমি মনে করে মি: কেভিন সংসদ সদস্য এজন্য হুজুর তাকে এত সময় দেননি। বরং ২০১৩ সালে তিনি হুজুরের জন্য অনেক সকালে উঠে অপেক্ষা করেছিলেন এজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হুজুর তাকে এতটা সময় দিয়েছেন।
হুজুর তার সাথে বিশ্বে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বৃদ্ধি বিষয়ে কথা বলেন। লন্ডনে সাম্প্রতিক হামলা সম্বন্ধে হুজুর বলেন “সন্ত্রাসী হামলা সত্ত্বেও লন্ডনের পরিস্হিতি শান্তই রয়েছে। কিন্তু এখন আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যেখানে বিশ্বের কোন স্হানই সন্ত্রাসী হামলার বাইরে নয়। এমনকি অষ্ট্রেলিয়াও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাই আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে। ”
হুজুর বলেন যে আহমদীয়া জামাত ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রচার করে। তাই যেখানেই কোন সন্ত্রাসী হামলা হয় আমাদের তরুণরা ঘটনাস্হলে যায়, তাদের সমবেদনা জানায় এবং সন্ত্রাসী হামলার প্রতি নিন্দা জানায়।
মিঃ কেভিন বলেন যে সিডনীতে বায়তুল হুদা মসজিদের স্হানটি গত কয়েক বছরে অনেক উন্নত হয়েছে। হুজুর বলেন “এটি কেবল সিডনীর মসজিদের ক্ষেত্রেই নয় বরং যখন লন্ডনের মসজিদ ফযল তৈরী করা হয়েছিল তখন আমাদের মোবাল্লেগ দ্বিতীয় খলীফাকে লিখেছিলেন যে এটি লন্ডনের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে হয়ে যাচ্ছে। উত্তরে খলীফা লিখে পাঠান যে চিন্তা করবেন না, শহরই মসজিদের কাছে এসে যাবে। সেই কথাই সত্য হয়েছে। ”
মিঃ কেভিন জানান যে তিনি এখনো নিউ সাউথ ওয়েলসের সংসদ সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। হুজুর বলেন “আমাদের বিশ্বাস হল একবার যার সাথে বন্ধুত্ব হয় সারাজীবন সে বন্ধুত্ব থাকে। তাই আপনি সংসদ সদস্য থাকুন আর নাই থাকুন আমরা আপনাকে আমাদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাবো। ”
তিনি হুজুরের কাছে জানতে চান তার প্রধান কাজ কি? হুজুর বলেন “বর্তমানে আমরা এক কঠিন সময় পার করছি। যেখানে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। তাই আমাদের মূল লক্ষ্য হল বিশ্বের সামনে ইসলামের প্রকৃত শান্তিপূর্ণ শিক্ষা তুলে ধরা। ইসলাম নিয়ে অমুসলমানদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই কিছু ভীতি রয়েছে। কিন্তু তাদের এটিও মনে রাখতে হবে যে এসব সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু এবং বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলমানই শান্তিপ্রিয়। ”
মিঃ কেভিন বলেন “এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় যে আপনার নেতৃত্বে ইসলামের শান্তিপূর্ণ ও সন্ত্রাসবিরোধী শিক্ষা প্রচার হচ্ছে। আপনার জামাত দেখাচ্ছে যে ইসলাম একটি শান্তিপূর্ণ ধর্ম। এ সময় এই বার্তা বিশ্বের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ”
মিঃ কেভিন ইউএস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেন। হুজুর বলেন “আমার মনে হয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চিরাচরিত কূটনীতিতে বিশ্বাসী নন। ”
স্বাধীনতার ৭০ বছরপূর্তি
জলসার সময় আমি প্রতিদিন বিকেলে হুজুরের অফিসে তার সাথে দেখা করি। সেসময় হুজুর আমার যেসব প্রশ্ন থাকে তার উত্তর দেন। এক বিকেলে আমি হুজুরকে বলি যে কিছু সাংবাদিক আমাকে জিজ্ঞেস করে যে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতার ৭০ বছর হতে চলেছে। আহমদীরা পাকিস্তানে যেরকম অত্যাচারের সম্মুক্ষীণ হচ্ছে এতে কি তারা মনে করে যে দেশ ভাগের স্বিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।
উত্তরে হুজুর বলেন “এটি সঠিক যে পাকিস্তানে আমরা অবিচার ও অত্যাচারের সম্মুক্ষীণ হচ্ছি। কিন্তু আমরা এটিও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে এই অত্যাচার একসময় শেষ হবে। পাকিস্তানের জনক কায়েদ-এ-আজম আহমদীদের মুসলমান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এমন এক দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে সকল ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে। তাই হযরত মুসলেহ মাউদ(রাঃ) তাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু হযরত মুসলেহ মাউদ(রাঃ) তখনও জানতেন যে পাকিস্তানে আহমদীরা অত্যাচারের সম্মুক্ষীণ হতে পারে। কিন্তু এই ধারণা তার পাকিস্তান সৃষ্টির পথে সমর্থন দিতে বাধা প্রদান করেনি। বরং হযরত মুসলেহ মাউদ(রাঃ) চেয়েছিলেন যে সকল মুসলমান যেন তাদের স্বাধীনতা পায়। যদিও এতে আহমদীদের জন্য বিপদ রয়েছে। তাই আমরা কখনো এটি মনে করি না যে পাকিস্তান সৃষ্টি একটি ভুল স্বিদ্ধান্ত ছিল। আল্লাহর উপর আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে একদিন আহমদীরা পাকিস্তানে স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারবে।”
আমি অবাক হই যে হযরত মুসলেহ মাউদ(রাঃ) জানতেন পাকিস্তানে আহমদীদের উপর অত্যাচার হতে পারে। কিন্তু মুসলমানদের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য তিনি আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। একইভাবে হুজুরের মন্তব্য যে একদিন আহমদীরা স্বাধীনভাবে পাকিস্তানে ধর্ম পালনের সুযোগ পাবে; এতে আল্লাহতা’লার প্রতি তার পূর্ণ বিশ্বাস প্রকাশ পায়।
বন্ধুর সাথে কিছু মুহুর্ত
কয়েক বছর পূর্বে জোনাথন বাটারওর্থ(৩১ বছর) নামে একজন ইংরেজ আহমদীয়াত গ্রহণ করে। আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি এখন ইউকে ন্যাশনাল আমেলার সদস্য। তিনি নওমোবাঈন ও এমটিএর বোর্ড মেম্বার দের ট্রেনিং প্রদান করেন। ২২ জুলাই ২০১৭ তারিখে আমি তার সাথে এমটিএর অফিসে বসে কথা বলি। তিনি আমাকে তার আহমদীয়াত গ্রহণের কাহিনী বলেন। তিনি কিছুদিন পূর্বে দ্বিতীয় সন্তানের বাবা হয়েছেন। তিনি তার দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে হুজুরের সাথে মোলাকাত করেছেন।
আহমদীয়াত গ্রহনের কাহিনী বলার সময় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। একজন উচ্চ শিক্ষিত ব্রিটিশ নাগরিককে এভাবে ইসলামের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে যেতে দেখা একটি ঈমান বর্ধক ঘটনা। তিনি এমন এক সময় ইসলাম গ্রহণ করেন যখন বিশ্বে ইসলাম নিয়ে অনেক অপপ্রচার হচ্ছে এবং ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করাই প্রমাণ করে যে ইসলাম শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম।
জোনাথন আমাকে বলেন “আমার বাবা খৃষ্টান এবং মা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন। আমি স্কুলে প্রতি সপ্তাহে তিন বার চার্চে যেতাম কিন্তু আমার আল্লাহর উপর প্রকৃত বিশ্বাস স্হাপিত হয়নি। বয়স হবার পর আমার মনে হল যে আমার আধ্যাত্মিকতা অর্জনের চেষ্টা করা উচিৎ। তাই আমি প্রাথমিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মের দিকে অগ্রসর হই। ২০০৪ সালে লন্ডনের কিংস কলেজে পড়াশোনার সময় আমি কুদসী রাশেদ নামে একজন আহমদীর সাথে পরিচিত হই। তিনি আমাকে ইসলাম এবং আহমদীয়ার সম্বন্ধে বলেন। আমাদের বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পায় এবং সাথে সাথে ইসলামের প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। ”
“আমি ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো ইউকে সালানা জলসাতে যোগদান করি। জলসার অভিজ্ঞতা আমার উপর গভীর প্রভাব ফেলে। আমার মনে হয় সেসময়ই আমি আল্লাহর অস্তিত্বে প্রকৃতভাবে বিশ্বাস করি। এরপরে আমি বুঝতে পারি যে আমার চেষ্টা করা উচিৎ কিভাবে সৃষ্টিকর্তার আরো কাছে যাওয়া যায়। এটি ছিল আমার বিশ্বাসের প্রথম ধাপ। ”
“আমি দোয়া, কোরআন শরীফ, বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মীয় বই পড়তে থাকি। আমি প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর ইংরেজীতে অনুবাদকৃত বইও পড়তে শুরু করি। আমি তার বই থেকে জানতে পারি যে তিনি বলেছেন সকল ধর্মই আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। এই বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত সুন্দর লেগেছে। ”
“ডিসেম্বর ২০১০ সালে আমি বুঝতে পারি যে মোহাম্মদ(সাঃ) আল্লাহর সত্য রসূল এবং এটি ছিল আমার বিশ্বাসের দ্বিতীয় ধাপ। আমার বিশ্বাসের শেষ ধাপ সম্পন্ন হয় জুলাই ২০১১ সালে যখন আমি আহমদীয়াত গ্রহণ করি। প্রতিটি ধাপেই আমি বুঝতে পারি যে আল্লাহপাক আমার হৃদয়কে পরিবর্তন করে সঠিক পথে পরিচালিত করছেন। আমি সেসময় স্বপ্নও দেখেছি যা আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শনে সাহায্য করেছে।”
“আহমদীয়াত গ্রহণে আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল বয়াতের ১০ম শর্ত। আল্লাহর অনুসরণ করা এক বিষয় কিন্তু একজন মানুষের অনুসরণ করা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বয়াতের কিছুদিন পর আমি হুজুরের খুৎবা শুনছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল খলীফা ও আমার মধ্যে অনেক দূরত্ব। সেই খুৎবায় হুজুর কিছু নতুন বয়াতকারী আহমদীদের বয়াত গ্রহণের ঘটনা বলেন। প্রতিটি ঘটনা শোনার পর আমার মনে হল যে আমার হৃদয়ে কিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। তখন আমি আল্লাহর কাছে সিজদায় পড়ে দোয়া করি। আমার মনে হল খিলাফতের প্রতি ভালবাসা আমার হৃদয়ে ঢেউ এর মতো প্রবেশ করল। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে খিলাফত-এ-আহমদীয়াত একটি আধ্যাত্মিক জামাত। ”
“আমি অনেক ভাগ্যবান কারণ আমি অনেকবার হুজুরের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছি। আমি মাঝে মাঝে হুজুরের দোষ-ত্রুটি খোঁজার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমি সবসময়ই হুজুরকে নৈতিকতার উচ্চ মানদন্ডের উপরই প্রতিষ্ঠিত দেখেছি। খলীফার প্রতি আমার ভালবাসা কোন প্রকার শিরক নয়। আমরা জানি খলীফা একজন মানুষ। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আল্লাহপাকই খলীফাকে পাঠিয়েছেন মানুষের উপর আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়া এবং মানুষকে আল্লাহর আরো কাছে নিয়ে যাবার জন্য। বয়াত গ্রহণের পর হুজুরের সাথে প্রথম মোলাকাতের ঘটনাটি আমার মনে আছে। হুজুর আমাকে বলেছিলেন আমাদের ধর্ম হল অসীম সমুদ্রের মাঝে একটি অনন্ত সফরের মতো। তাই সবময়ই আল্লাহর আরো কাছে যাবার সুযোগ রয়েছে। ”
“আমি আহমদী হবার পর মসজিদের সামনের দিকে বসতাম। যখন হুজুর আমাকে দেখতেন আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসতাম। মোলাকাতের সময় হুজুর বলেন যে তিনি সবসময়ই আমার হাসি দেখতে পান। কিন্তু তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন কারণ তিনি মসজিদের মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য আমার হাসির জবাবে হাসতে পারেননি। তিনি আশা করেন আমি যেন ভবিষ্যতেও তার দিকে তাকিয়ে হাসি। হুজুরের এই মন্তব্যে আমার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে যায়। ”
বিবাহ সম্বন্ধীয় উপদেশ
জোনাথন একজন স্প্যানিশ মহিলা মারিয়া সাহিবাকে বিবাহ করেন। তিনিও বয়াতকারী আহমদী। হুজুর দয়া করে তাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্হিত ছিলেন। সেসময় হুজুর জোনাথনের বাম পাশে ও তার বাবা ডান পাশে বসেছিলেন। তিনি সেমসয় খুব নার্ভাস ছিলেন যেন সবকিছু ঠিকভাবে সম্পন্ন হয়। তার বাবা তাকে বলেন “তুমি কি খলীফাকে জিজ্ঞেস করবে যে সফল বিবাহের মূলমন্ত্র কি? কারণ একজন ফ্রেঞ্চ দার্শনিক বলেছেন যে সফল বিবাহের চাবিকাঠি হল স্বামীকে অন্ধ, বধির ও বোকা হতে হবে। ”
আমি ভাবলাম যে হুজুরকে প্রশ্নের প্রথম অংশটি জিজ্ঞেস করব। ফ্রেঞ্চ দার্শনিকের কথাটি না বলাই ভাল। জোনাথন হুজুরকে সফল বিবাহের মূলমন্ত্র কি তা জিজ্ঞেস করে। হুজুর হাসেন ও বলেন “সফল বিবাহের চাবিকাঠি হল স্বামী ও স্ত্রী দুইজনকেই অন্ধ ও বধির হতে হবে।”
জোনাথন বলেন “হুজুরের উত্তর শোনার পর আমি বলি আলহামদুলিল্লাহ। হুজুর আমার ও বাবার কথোপকথনটি শুনেননি। আমি যখন আমার বাবাকে হুজুরের উত্তরটি বলি তখন তিনিও অবাক হয়ে যান। আমি চিন্তিত ছিলাম যে আমার বাবা এসব কথা বলে আমার জন্য পরিস্হিতি সহজ করতে চাইছেন। কিন্তু হুজুরের মন্তব্যের পর আমি বুঝতে পারলাম যে হাসি-তামাশা ও পরিস্হিত হালকা করা কোন দোষের কিছু নয়। হুজুরের মন্তব্যের পর আমি কিছুটা সাহস ফিরে পাই। এতে আমি বুঝি হুজুর যে কোন পরিস্হিতিই সামাল দিতে পারেন। পরবর্তীতে আমার বাবা আমাকে বলেন যে ‘জোনাথন তুমি সবসময় এত গম্ভীর হয়ে থাক কেন? তুমি তোমার খলীফার মতো হবার চেষ্টা কেন করো না, দেখ না তিনি সবসময় হাস্যোজ্জ্বল থাকেন। ’ ”
“আহমদীয়াত গ্রহণের পূর্বে আমি কিছুই ছিলাম না। এখনো আমি কিছুই নই। কিন্তু এখন আমার জীবনের একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। পূর্বে আমি অ্যাধ্যাত্মিকভাবে মৃত ছিলাম। আমাদের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান আমাদের খলীফার কাছে রয়েছে। হুজুর আমাদের জন্য উজ্জ্বল নক্ষত্র। খিলাফতের প্রতি ভালবাসা একটি সুনামির মতো। এটি কখনো কমবে না বরং দিন দিন আরো ছড়িয়ে পড়বে ও বৃদ্ধি পাবে।”
ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার
জলসা সালানার কিছুদিন পূর্বে হুজুরের ১৯৯০ সালে উঠানো একটি ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিটি ইউকের ইসলামাবাদে আরো কয়েকজন মানুষের সাথে হুজুরের একটি সুন্দর ছবি। কিন্তু এটি হুজুরের ব্যক্তিগত ছবি এবং আমি ইন্টারনেটে এটি দেখে অবাক হই। এটি কোন আহমদী ইন্টারনেটে পাবলিশ করেছে। হুজুর এজন্য খুশি হননি কিন্তু তিনি কোন মন্তব্যও করেননি।
কিন্তু দুইদিন পর হুজুরকে জানানো হয় যে জামাতের টুইটার একাউন্ট থেকে ছবিটি পাবলিশ করা হয়েছে। হুজুর আমাকে বলেন যে টুইটার এর এডমিন কে বলে ছবিটি সরিয়ে ফেলতে। তারা আমাকে বলে যে তারা ছবিটি পাবলিশ করেছে কারণ সেটি পূর্ব থেকেই কোন আহমদী ইন্টারনেটে পাবলিশ করেছিল। আমি তাকে বোঝাই যে কোন আহমদী আর জামাতের একাউন্ট থেকে পাবলিশ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি ব্যাপার। হুজুর পুরো ঘটনা শোনার পর বলেন “জামাতের কর্মকর্তাদের কি কোন বিচার বিবেচনা নেই? কেউ কোন কিছু পাবলিশ করলে জামাতও সেই একই পোস্ট পাবলিশ করবে এরকম তো ঠিক নয়।”
হুজুরের মন্তব্য অত্যন্ত সঠিক। জামাতের সামাজিক মাধ্যমের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন আহমদীগণ তাদেরকে নিজেদের আদর্শ মনে করে এবং তাদের অনুসরণ করে। সবারই নিজেদের ছবি পাবলিশ করার ব্যাপারে স্বাধীনতা থাকে। এটি খুবই দুঃখজনক যে আহমদীরাই আমাদের প্রিয় খলীফার ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সম্মান দিচ্ছি না। হুজুর জামাতের জন্য তার জীবনের প্রতিটি মুহুর্তই ব্যয় করেন। তাই আহমদীদেরও উচিৎ হুজুরের ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি লক্ষ্য রাখা।
জলসায় আগত প্রতিনিধিদের অভিজ্ঞতা
প্রতি বছর হুজুর বিভিন্ন দেশ থেকে কিছু জামাতী সদস্যদের ইউকে জলসায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। মাঝেমাঝে মানুষ প্রশ্ন করে থাকে যে এভাবে নিমন্ত্রণ করে জামাতের খরচ বাড়ানোর কি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে খলীফাতুল মসীহর নির্দেশেই এই নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়। তাই এতে যে বরকত রয়েছে তা আর্থিক খরচের চেয়ে অনেক বেশি। আগত সদস্যরা জলসার বরকত লাভ করে এবং হুজুরের সাথে দেখা করে তার কাছ থেকে দিক নির্দেশনা গ্রহণ করে। মিটিং এর মাধ্যমে তারা অন্যান্য সদস্যদের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা লাভ করেন। প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) বলেন “জলসার অনেক গুলো উপকারিতার মধ্যে একটি হল জামাতের সদস্যরা একত্রিত হয়। এতে জামাতের সদস্যদের মধ্যে পরিচিতি বৃদ্ধি পায় এবং জামাত আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। ”
আমি এমন অনেক মানুষের সাথে কথা বলেছি। যারা যুগ যুগ ধরে জামাতের কাজ করে আসছেন। তাদের কখনো খলীফার সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি। তাদের নিজ খরচে জলসায় আসার আর্থিক সামর্থ্য নেই। খলীফার সাথে জলসায় এসে দেখা করার সুযোগ হয়তো তাদের জীবনে আর হবে না। এই স্মৃতিকেই তারা তাদের হৃদয়ে লালন করবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে গর্ব করে এই ঘটনা বর্ণনা করবে।
জলসার সময় আমি কিছু প্রতিনিধিদের সাথে তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলি। তাদের মধ্যে একজন হলেন তাহির আহমদ শামস(৩৭ বছর) সাহেব। তিনি মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়া পাকিস্তানের আমেলা সদস্য এবং জামেআ আহমদীয়া রাবওয়ার ভাইস প্রিন্সিপাল। হুজুরের সাথে প্রথমবারের মতো সাক্ষাত করার পর তিনি বলেন “এমটিএর মাধ্যমে হুজুরকে দেখা আর সামনাসামনি তার সাথে দেখা করার মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমার মনে হল পূর্বে আমি মৃত ছিলাম এবং এখন জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছি। হুজুরের সামনে বসে থাকার অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি চিন্তা করছিলাম যে আমি কত ভাগ্যবান। কিন্তু হাজার হাজার আহমদী রাবওয়াতে রয়েছে যারা তাদের খলীফাকে দেখতে পারছে না। ”
আমি একজন ওয়াকফে জিন্দেগী নাদীম আহমদ মোবাশশের (৩৩ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি ওয়াকফে জাদীদ রাবওয়া ও হিউম্যানিটি ফার্স্ট পাকিস্তানে কাজ করছেন। তিনিও হুজুরের সাথে প্রথমবারের মত দেখা করেছেন। তিনি বলেন “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে এটি কি হল! আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। হুজুরের চেহারা থেকে নূর বের হচ্ছিল। মাত্র দুই দিন আগে আমি রাবওয়াতে ছিলাম আর এখন আমি লন্ডনে হুজুরের সাথে দেখা করছি। যার সাথে দেখা করার জন্য আমি সারাজীবন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। ”
“গতকাল আমার জীবনের একটি বিশেষ দিন। এদিন আমি যুগ খলীফার পিছনে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করেছি। আমি অনেক ভাগ্যবান। এই সফরে আমার একমাত্র ইচ্ছা হলো হুজুরের পিছনে নামায আদায় করা। আমি নামাযের ওয়াক্তের এক ঘন্টা আগেই মসজিদে এসে পড়ি যেন সামনের সারিতে হুজুরের কাছে বসার সুযোগ পাই। আমি আশা করি হুজুর আমাকে দেখবেন এবং আমিও কাছে থেকে হুজুরকে দেখতে পাব। ”
আমি কাদিয়ান থেকে আগত বদর ম্যাগাজিনের সম্পাদক শেখ মুজাহিদ আহমদ শাস্ত্রী(৩৯ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “কাদিয়ানে আমরা সবাই অধীর আগ্রহে হুজুরের বরকতময় আগমনের জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যেন হুজুর আবার কাদিয়ানে সফর করতে আসেন। সবকিছুই প্রস্তুত, সবাই অপেক্ষা করছে আর আমরা দোয়া করছি আমাদের যেন আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে না হয়। ”
তার কথা শুনে আমার হুজুরের ২০১৫ সালের কাদিয়ান সফরের কথা মনে হল। সেই অভিজ্ঞতা আমি কখনো ভুলতে পারব না। সেসময় আমি ছাত্র ছিলাম। আমি জলসায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে এক সপ্তাহের জন্য কাদিয়ান গিয়েছিলাম। হুজুর যেখানেই যেতেন শত শত আহমদী লাইন ধরে রাস্তার পাশে হুজুরের জন্য অপেক্ষা করত। হুজুর তাদের দিকে তাকিয়ে হাসতেন ও হাত নাড়াতেন। সেই অভিজ্ঞতা সত্যিই অতুলনীয়।
জলসা পরিদর্শন
ঐতিহ্য অনুসারে ২৩ জুলাই ২০১৭ তারিখ হুজুর জলসাগাহ পরিদর্শন করেন। হুজুর পর্যায়ক্রমে বায়তুল ফুতুহ মসজিদ, জামেআ আহমদীয়া ও হাদীকাতুল মাহদী পরিদর্শন করেন। বায়তুল ফুতুহ মসজিদে হুজুর লঙ্গরখানা, বইয়ের দোকান ও বিভিন্ন দপ্তর পরিদর্শন করেন। এরপর হুজুর জামেআ আহমদীয়াতে যান। তখনই মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। দ্বায়িত্বরত কর্মীগণ আমাদের ছাতা প্রদান করেন। কিন্তু বৃষ্টির বেগ এত বেশি ছিল যে ছাতা থাকা আর না থাকা একই কথা। কিন্তু এতে হুজুর তার পরিদর্শন বন্ধ করেননি। হুজুর জামেআ বিল্ডিং এ প্রবেশ করার পর সেখানে উপস্হিত আরব আহমদীগণ নারার মাধ্যমে হুজুরকে অভ্যর্থনা জানান। সেখান থেকে বের হবার সময় তরুণ মোবাল্লেগগণ লাইন ধরে দাড়ায় ও হুজুরের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে। হুজুর তাদের বলেন “তোমাদের উচিৎ কেবল হাত না নাড়িয়ে মুখ দিয়ে সালাম বলা ।”
এটি আমার জন্যও একটি শিক্ষনীয় বিষয় ছিল। কারণ আমার এরকম অভ্যাস রয়েছে যখন হুজুর আমার পাশ দিয়ে হেটে যান আমিও হাত নাড়ি এবং খুবই নিচু স্বরে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলি।
হাদীকাতুল মাহদী পরিদর্শন
হাদীকাতুল মাহদীতে যাবার ময় আমি আহমদ ভাই এর সাথে একই গাড়ীতে বসেছিলাম। তিনি আমাকে বলেন যে খারাপ আবহাওয়ার জন্য গাড়ীতে বসেই হাদীকাতুল মাহদী পরিদর্শন করা হতে পারে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা সেখানে পৌঁছার পূর্বেই বৃষ্টি থেমে যায়। মাটি যেহেতু কর্দমাক্ত হয়ে গিয়েছিল তাই হুজুরের জন্য গাড়ীও তৈরী করা ছিল। কিন্তু হুজুর বলেন যে তিনি প্রতিবারের মতো এবারও পায়ে হেটেই পরিদর্শন করবেন। হুজুর জলসার বিভিন্ন দপ্তর পরিদর্শন করেন যেমন লঙ্গরখানা, রুটি প্ল্যান্ট, নিরাপত্তার ব্যবস্হা ইত্যাদি। পরিদর্শনের সময় হুজুর লঙ্গর খানাতে আলু গোশত, ডাল ও জর্দা খান। হুজুর জলসার স্টোর পরিদর্শন করেন ও সেখানে উপস্হিত কর্মীদের উদ্দেশ্য হাত নাড়েন। এক পর্যায়ে হুজুর হুইলচেয়ারে বসা একজন পঙ্গু বালককে দেখেন। তার নাম হল তালমীজ। সেও জলসার কর্মীদের একজন সদস্য। হুজুর তার কাছে থামেন ও ভালবাসার সাথে তার গালে হাত দেন। সেটি অত্যন্ত সুন্দর একটি দৃশ্য ছিল। একদিকে আমরা একজন পঙ্গু বালককে দেখি, খিলাফতের প্রতি ভালবাসার জন্য সে এই অবস্হাতেও জলসার কাজ করছে। অন্যদিকে আমরা সমাজের দুর্বল মানুষের প্রতি যুগ খলীফার ভালবাসা দেখতে পাই।
পরিদর্শনের সময় হুজুর দেখতে পান যে ফার্স্ট এইড দপ্তর ও রিশতানাতা দপ্তর পাশাপাশি স্হাপন করা হয়েছে। হুজুর হাসেন ও বলেন “আমার মনে হয় জলসা কর্তৃপক্ষ অনেক চিন্তাভাবনা করে এই দুইটি দপ্তরকে পাশাপাশি রেখেছে। যদি রিশতানাতা দপ্তর কোন ভুল প্রস্তাব নিয়ে আসে তাহলে কেউ অচেতন হয়ে যেতে পারে। তাই সাহায্যের জন্য পাশেই ফার্স্ট এইড রাখা হয়েছে। ”
প্রেস ও মিডিয়া প্রদর্শনী পরিদর্শন
হুজুর জলসার বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখছিলেন। আমি দেখলাম যে হুজুর আমাদের প্রেস ও মিডিয়া প্রদর্শনীর দিকে আসছেন। আমাদের প্রদর্শনী অন্যান্যদের তুলনায় অনেক ছোট। হুজুর যে আমাদের প্রদর্শনীতে আসছেন এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বরকতময় ও পুরস্কারস্বরূপ।
জলসা পরিদর্শনের পর হুজুরের বক্তব্য
জলসাগাহ পরিদর্শনের পর হুজুর স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখেন। হুজুর বলেন যে অনেক বছরের অভিজ্ঞতার ফলে জলসা সালানা ইউকের কর্মীগণ এখন দক্ষ হয়ে উঠেছে। এখন ছোট বাচ্চারাও দ্বায়িত্বের সাথে তাদের কর্তব্য পালন করে। একইসাথে হুজুর এটি বলেন যে কর্মীদের নৈতিকতার সর্বোত্তম মানদন্ড প্রদর্শন করতে হবে এবং কখনো কাউকে অসম্মান করা যাবে না। যদি তারা কোন কারণে হতাশ বা ধৈর্য্যের শেষ সীমায়ও পৌছে যায় তারপরও তাদের মুখে হাসি থাকতে হবে।
হুজুর বলেন যে “আমাকে খুব কম লোকই জলসার কর্মীদের প্রশংসা করে চিঠি লেখে। যদিও বেশিরভাগ মানুষেরই ভাল অভিজ্ঞতা থাকে। কিন্তু কেবল তারাই চিঠি লিখে যারা কোন সমস্যায় পড়েছে এবং সবচেয়ে বেশী যে সম্বন্ধে অভিযোগ আসে তা হল খাবার পরিবেশন নিয়ে। তাই খাবার পরিবেশনের সময় প্রত্যেককে তাদের পছন্দ অনুযায়ী খাবার দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। একজন যতবারই খাবার নিতে আসুক না কেন তাকে ভালবাসা ও দয়ার সাথে খাবার পরিবেশন করতে হবে। ”
বক্তব্যের পর হুজুর কর্মীদের সাথে রাতের খাবার খান। এরপর মাগরিব ও এশার নামায আদায়ের জন্য মসজিদ ফযলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
হুজুরের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ
২৪ জুলাই ২০১৭ তারিখ বিকেলে আমি রিপোর্ট দেবার জন্য হুজুরের অফিসে যাই। আমি দেখলাম হুজুর তার রুমে একটি কাগজে কিছু লেখায় ব্যস্ত আছেন। আমি বুঝতে পারলাম যে হুজুর জলসার জন্য তার বক্তব্য লিখছেন। তাই আমি হুজুরকে বিরক্ত না করে মাথা নিচু করে চুপ করে থাকলাম।
দশ মিনিট পর হুজুর কলম রেখে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন “আমার মনে যেসব চিন্তাভাবনা আসছিল সেগুলো দ্রুত লিখে ফেলাই উত্তম। ”
হুজুর আমাকে জলসা পরিদর্শনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। আমি বলি যে আমরা ভাগ্যবান ছিলাম কারণ আমরা যখন হাদীকাতুল মাহদীতে পৌছলাম তখন বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। হুজুর বলেন “বৃষ্টি থাকলেও কোন সমস্যা ছিল না। বৃষ্টির মধ্যেও আমি পরিদর্শন চালিয়ে যেতাম। কেন সামান্য বৃষ্টির জন্য আমাদের কাজ থেমে থাকবে?”
হুজুরের কথা শুনে আমি ভাবলাম যে কিছু কিছু মানুষ সামান্য অজুহাতে তাদের কর্তব্যে অবহেলা করে। কিন্তু যুগ খলীফা তার কাজের মাঝে কোন বাধাকেই পরোয়া করেন না।
একজন পুরোনো বন্ধুর সাথে সাক্ষাত
হুজুরের অফিস থেকে বের হয়ে আমি সিরাজ আহমদ (৫০ বছর) সাহেবের দেখা পাই। তিনি কাদিয়ান থেকে জলসায় অংশগ্রহণ করতে এসেছেন। তিনি গত ১১ বছর ধরে কাদিয়ানে নাযির তালিমের কাজ করছেন। বর্তমানে অতিরিক্ত দ্বায়িত্ব হিসেবে কাদিয়ানের নাযির-এ-আলা হিসেবেও কর্মরত আছেন। হুজুর ২০০৭ সালে আমাকে ও আমার স্ত্রীকে তিন মাসের জন্য কাদিয়ানে প্রেরণ করেন। তখন আমার সিরাজ সাহেবের সাথে বন্ধুত্ব হয়। তখন তিনি এক বছর হল জীবন ওয়াকফ করেছেন এবং আমি সম্প্রতি ওয়াকফ করেছিলাম। তাই আমাদের মধ্যে এই একটি মিল শুরু থেকেই ছিল। আমাদের আর একটি মিল হল যে কাদিয়ানে হয়ত তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি ইংরেজীতে কথা বলাই বেশি পছন্দ করতেন। তাই আমি সপ্তাহে কয়েকবার তার অফিসে যেয়ে তার সাথে কথা বলতাম।
তার সাথে অনেক দিন পর দেখা হয়ে আমার অনেক আনন্দ হচ্ছিল। দুই দিন আগে হুজুরের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে তিনি বলেন “আলহামদুলিল্লাহ দুই দিন পূর্বে আমার হুজুরের সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার মনে হল আমি পৃথিবীতেই জান্নাত লাভ করেছি। হুজুর হচ্ছেন পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। তাই কোন বিষয়ের সাথেই হুজুরের সাথে দেখা করার তুলনা করা যায় না। ”
“হুজুরের সাথে দেখা করার আগে আমি অনেক চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু হুজুরের রুমে যেয়ে তার দয়ালু চেহারা দেখে সব চিন্তা ম্যাজিকের মতো দূর হয়ে যায়। হুজুরের এত মহান মর্যাদা সত্ত্বেও তিনি আমাদের সাথে এমনভাবে কথা বলেন যেন আমরা তার বন্ধু। নিঃসন্দেহে হুজুরের চেয়ে ভাল বন্ধু আর কেউ হতে পারে না কারণ হুজুর আমাদের সকল সমস্যা ও চিন্তা দূর করে দেন। ”
হুজুরের সাথে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি বলেন “হুজুর আমাদেরকে কাজ করতে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেন, যেভাবে আর কেউ করতে পারে না। এজন্য আমরা আরো কাজ করতে এবং আরো উন্নত মান অর্জন করতে সচেষ্ট হই। ”
“২০০৬ সালে হুজুর আমাকে নাযির তালিম হিসেবে কাজ করার সুযোগ প্রদান করেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়ে দুই পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখেন। যদিও হুজুর হাজার মাইল দূরে বসে এই চিঠি লিখেছিলেন কিন্তু সেটি এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে এর ফলে আমরা নতুন পদে কাজ করা অনেক সহজ হয়ে যায়। আমার এরকম হয়নি যে কারো ফেলে যাওয়া পুরনো ফাইল-পত্র পড়াশোনা করে আমাকে কি করতে হবে তা বের করতে হয়েছে। বরং আমার মনে হয়েছে হুজুর আমাকে হাতে ধরে প্রতিটি কাজেই দিক নির্দেশনা প্রদান করছেন। ”
২০০৭ সালে হুজুর সিরাজ সাহেবকে ইউকে জলসায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। সে সময় তিনি হুজুরের সাথে প্রথম দাপ্তরিক মোলাকাতের সুযোগ পান। সেই মিটিং এর অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমি ভেবেছিলাম সেই মিটিং কেবল কয়েক মিনিটের হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটি ২৮ মিনিট স্হায়ী হয়েছিল। সেমসয় হুজুর এক এক করে আমার মনে যে সকল প্রশ্ন ছিল তার সবগুলোর উত্তর দিয়ে দেন। আমি সেদিন হুজুরের কাছে প্রায় ৩০ টি প্রশ্ন করেছিলাম এবং হুজুর সবগুলো বিষয়ই আমাকে পরিস্কার করে বুঝিয়ে দেন। দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তখন থেকেই কাজ করে চলেছি। ”
“মোলাকাতের পর আমি হুজুর সকল দিক নির্দেশনা এক এক করে কাগজে লিখে লিখিত অনুমোদনের জন্য হুজুরের কাছে পাঠিয়ে দেই। আমি পরের দিন কাদিয়ান চলে যাচ্ছিলাম। তাই হুজুরের ব্যক্তিগত সেক্রেটারী সাহেবকে আমি বললাম যে আমি হুজুরকে যেসব নোট দিয়েছি সেগুলো যেন তিনি আমাকে ফ্যাক্স করে দেন। আমি ভেবেছিলাম হয়ত হুজুরের কয়েকদিনে লেগে যাবে সবগুলো নোট দেখতে। কারণ সেটি জলসার সময় ছিল এবং হুজুর বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আপনি অনুমান করতে পারেন যে আমি কতটা অবাক হয়েছিলাম যখন সেক্রেটারী সাহেব আমাকে নোটগুলো ফেরত দিয়ে বললেন যে হুজুর ইতোমধ্যেই সেগুলো দেখে দিয়েছেন। আমি মাত্র গ্তকাল রাতেই হুজুরকে নোটগুলো দিয়েছিলাম এবং সেগুলো অত্যন্ত ব্যাপক ছিল। কিন্তু হুজুর কোনভাবে সব নোটই দেখে দিয়েছেন! ”
ভারতের প্রতি একটি উপহার
সিরাজ সাহেব বলেন যে হুজুরের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী ভারতীয় জামাত হাজার হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা প্রদান করছে। এই বিশাল প্রকল্প সম্বন্ধে তিনি বলেন “হুজুর বলেন যে তিনি যখন ২০০৫ সালে কাদিয়ান এসেছিলেন তখন সেখানে অনেক দারিদ্রতা দেখেছেন। হুজুর দেখেছেন যে দারিদ্রের জন্য তারা সন্তানদের শিক্ষা প্রদান করতে পারছে না। তাই হুজুর আমাদের নির্দেশ দেন যে এসকল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্হা করতে। এটি ভারতের প্রতি যুগ খলীফার একটি অত্যন্ত সুন্দর উপহার। এর মাধ্যমে অনেকেই উপকৃত হচ্ছে এবং এর মধ্যেই কেউ কেউ ডাক্তার, প্রকৌশলী ও অন্যান্য পেশায় কর্মরত আছে। শিক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে হুজুর ভারতে একটি চিরস্হায়ী বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। তিনি একটি বিষয় পরিস্কার করে দিয়েছেন যে দারিদ্রতা কোন শিশুর শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রতিবন্ধকতা হবে না। ”
খলীফাতুল মসীহর দিক নির্দেশনা
আমি সিরাজ সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম যে হুজুর কিভাবে কাদিয়ান জামাতকে এই বিরাট প্রকল্পের জন্য দিক নির্দেশনা প্রদান করছেন। তিনি বলেন “হুজুর আমাদের থেকে হাজার মাইল দূরে থাকেন। কিন্তু আমরা ছোট বড় প্রতিটি বিষয়ে হুজুরের দিক নির্দেশনা চাই। মাঝে মাঝে মনে হয় যে হুজুর কাদিয়ানেই অফিস করছেন। সত্য কথা হল আমরা নিজেরা চিন্তা করা বন্ধ করে দিয়েছি এবং প্রতিটি নির্দেশের জন্যই যুগ খলীফার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করি। কারণ আমরা জানি খলীফার প্রতিটি সিদ্ধান্তে অসীম বরকত রয়েছে। খলীফা হলেন আমাদের মাথা ও হৃদয়। আমাদের একমাত্র কাজ হল তার হাত ও পা হিসেবে তার নির্দেশ পালন করা। হুজুর আমাদের কখনো জিজ্ঞেস করেননি যে কেন আমরা তাকে এত প্রশ্ন করি। হুজুর কখনো উত্তর দিতে দেরী করেন না। আমরা যদি আজ কোন প্রশ্ন পাঠাই তাহলে পরের দিনের মধ্যেই হুজুরের দিক নির্দেশনা চলে আসে। ”
“আমি প্রায়ই হুজুরের কাছে ১৬-১৭ টি রিপোর্ট পাঠাই। যদি কোন দেরী হয় তাহলে সেটি আমাদের কারণেই হয়। পৃথিবীতে আমাদের মতো আরো ২০০ টি জামাত রয়েছে। সবাইকে হুজুর এভাবেই দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। এটি একটি অচিন্তনীয় ব্যাপার। ”
“আমার মতে হুজুরের কাজ করার ক্ষমতা আল্লাহর অস্তিত্বের একটি প্রমাণ। কারণ একমাত্র আল্লাহর সাহায্যের ফলেই একজন মানুষ এভাবে নিরন্তরভাবে কাজ করতে পারে। হুজুর এভাবেই প্রতিদিন ১৮-১৯ ঘন্টা করে ১৪ বছর ধরে কাজ করে আসছেন। আমার মনে হচ্ছে প্রতি বছর হুজুরের কাজের পরিধি আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ”
“যখন আমরা হুজুরকে রিপোর্ট পাঠাই তখন পরবর্তী দিন হুজুরের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষায় থাকি। যখন আমরা নির্দেশনা পাই তখন অত্যন্ত আনন্দিত হই। আমাদের মনে হয় আমরা হুজুরের সাথে প্রতিদিন সাক্ষাত করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ভারত জামাতে একটি বিপ্লব চলছে। কারণ প্রতিটি বিষয়ে আমরা খলীফাতুল মসীহর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি। ”
আহমদীদের আবেগ
আমি চৌধুরী মুনীর আহমদ (৮৭ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি রাবওয়ার নুসরাত জাহান কলেজের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি জলসার প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমবারের মতো ইউকে জলসায় আসার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তিনি বলেন “রাবওয়ার একজন শিক্ষক হিসেবে আমার ভাতা খুবই অল্প। তাই আমি কখনো ইউকে আসার খরচ বহন করতে পারতাম না। তাই এটি আমার জন্য খলীফাতুল মসীহর অশেষ অনুগ্রহ যে আমি এই সুযোগ পেয়েছি।”
আমি অবাক হয়েছি যে তিনি এত বয়স সত্ত্বেও অবসর গ্রহণ করেননি। তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন “যখন আমার মা ইন্তেকাল করেন তখন হুজুর রাবওয়ার নাযির এ আলা ছিলেন। তখন তিনি আমাকে স্বান্তনা দেবার জন্য আমার ঘরে আসেন। তখন আমার বয়স ৭২ বছর। আমি তাকে বলি যে হয়ত এখন আমার অবসর নেবার সময় এসে গেছে। হুজুর আমাকে বলেন যে যেহেতু আমি ওয়াকফে জিন্দেগী তাই যতদিন জামাতের আমাকে প্রয়োজন ততদিন কাজ চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। এটি ১৫-১৬ বছর আগের কথা। এরপর আমি আর কখনো অবসরের কথা বলিনি। আমি জামাতের সেবা চালিয়ে যাবার জন্য নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি। এমনকি আজও মোলাকাতের সময় হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমি এখনো শিক্ষকতা করার জন্য সুস্হ আছি কিনা। ”
তার সাথে কথোপকথনের শেষে তিনি আমাকে বলেন “আবিদ সাহেব, আমি দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে তৌফিক দান করুন যেন আপনি আমার বয়সেও জামাতের খেদমত করতে পারেন। ”
তার এই দোয়ার জন্য আমি তার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।
আমি খালিদ আহমদ (৫২ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি পাকিস্তানে জামাতের ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি বলেন “হুজুরের খিলাফতের পূর্বে আমি কয়েকবার হুজুরের গাড়ীর ড্রাইভার হিসেবে কাজ করার সৌভাগ্য লাভ করেছি। আজ আমি আমার অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারছি না। আমি যখন হুজুরের অফিসে যাই তখন হুজুর সাথেসাথেই আমাকে চিনে ফেলেন। আমার মনে হল আমি সেই বরকতময় অতীতে চলে গেছি যখন আমি হুজুরের গাড়ী চালানোর সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। হুজুর যেরকম ভালবাসা ও দয়ার সাথে আমাদের সাথে আচরণ করতেন সেটি আমি কখনো ভুলতে পারব না। তিনি কখনো নিজেকে আমাদের চেয়ে বড় মনে করতেন না। তিনি প্রায়ই আমাদের সাথে খাবার খেতেন এবং নিজ হাতে আমাদের প্লেটে খাবার তুলে দিতেন।”
আমি সিন্ধ প্রদেশের একটি গ্রামে মোবাল্লেগ হিসেবে কর্মরত আফতাব আহমেদ পাটেল (৬৫ বছর) সাহবের সাথে কথা বলি। তিনি হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আহমদীয়াত গ্রহণ করেন এবং তিনিও বাবার পথ অনুসরণ করেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ হিন্দুই আছেন। তিনি বলেন “আজ আমার জীবনের সবচেয়ে বরকতময় মুহুর্ত। কারণ আজ আমি আমার খলীফার বরকতময় হাত স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি খলীফার খুৎবা নিয়মিত শুনি এবং তার নির্দেশ আনুযায়ী জীবন যাপনের চেষ্টা করি।”
আহমদীয়াত গ্রহণের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এখনো হিন্দু ধর্মের অনুসারী। অনেক বছর ধরেই তারা আমাকে বয়কট করে চলেছে। কিন্তু কোনকিছু্ই আমার ঈমানকে দুর্বল করতে পারেনি। বরং আমি যে সঠিক পথে আছি এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে। ”
“আমি পাকিস্তানের একটি সুবিধাবঞ্চিত স্হানে কাজ করি। যেখানে পানির কোন সুব্যবস্হা নেই। কিন্তু এসব কোন সমস্যা নয়, কারণ আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হল প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর শিক্ষাকে অনুসরণ করা। তাই আমরা গ্রামের সকল ধর্মের মানুষের প্রতি ভালবাসা পূর্ণ আচরণ করি। আহমদীয়াত আমাকে কি দিয়েছে সেটি আমি অন্যান্যদের বলি যা হলো মনের শান্তি ও সঠিক পথের দিক নির্দেশনা। ”
হুজুরের আশ্বাস
আমি কানাডার অটোয়াতে কর্মরত তরুণ মোবাল্লেগ ইমতিয়াজ আহমদ সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন যে সম্প্রতি তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে দুইটি ফোনকল এসেছে। যে হুমকি দিয়েছে সে বলেছে যে তার ভাইকে আফগানিস্তানে হত্যা করা হয়েছে তাই এখন সে প্রতিশোধ নিবে। আমি ইমতিয়াজ সাহেব ও তার স্ত্রীর চেহারা দেখে বুঝতে পারছিলাম যে এ নিয়ে তারা কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছে। তারা ফোনকল রেকর্ড করে পুলিশকে দিয়েছেন এবং পুলিশ ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে দেখছে। কিন্তু তাদের হৃদয় সত্যিকারভাবে আশ্বস্ত হয়েছে যখন তারা হুজুরের সাথে দেখা করেছেন।
ইমতিয়াজ সাহেব বলেন “আমি হুজুরকে আমাদের দেয়া হুমকি সম্বন্ধে বলি। হুজুর মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনে ও দোয়া করেন যেন আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেন। এরপর হুজুর পরিস্হতি সহজ করার জন্য আমাকে বলেন যে আমাকে অন্য একটি শহরে পোস্টিং করে দেয়া হয়েছে তাই চিন্তার আর কোন কারণ নেই। এরপর হুজুর হাসেন এবং আমি ও আমার স্ত্রীও হুজুরের কৌতুকে হেসে ফেলি। হুজুরের সাথে কথা বলে আমরা আশ্বস্ত হই।”
মিডিয়া সম্বন্ধে হুজুরের দিক নির্দেশনা
জুলাই এর ২৫ তারিখ চলে আসল। কিন্তু আমি জলসা সম্বন্ধে মিডিয়া থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাচ্ছিলাম না। আল্লাহর রহমতে এবছর আমাদের মিডিয়া দল পূর্বের বছরের চেয়ে বড়। আমরা গত মাস থেকেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলাম। আমরা অনেক কষ্ট করেছি কিন্তু প্রত্যাশিত ফলাফল না পাওয়ায় আমরা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তাই হুজুরকে আমি বিষয়টি জানাই ও দোয়ার জন্য আবেদন করি।
হুজুর বলেন “কোন চিন্তা করবে না। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৩০ জন সাংবাদিক আসছে। তাই স্হানীয় সাংবাদিক জলসার প্রচারণা না করলেও তারাই করবে।”
হুজুরের এই কথা শুনেই আমার সব দুশ্চিন্তা ও হতাশা দূর হয়ে গেল। কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যম আমাকে বলেছে যে জলসা প্রতি বছরই হয়। তারা গত জলসায়ই এসেছিল। তাই তারা জানাতে চায় যে এবার তারা কেন আসবে। এবার কি নতুন কিছু আছে?
হুজুর বলেন “তুমি সাংবাদিকদের বলবে যে যদি তারা জানতে চায় যে ইসলাম কি সত্যিই কোন সন্ত্রাসীধর্ম, তাহলে তাদের জলসায় আসা উচিৎ। যদি তারা প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করতে চায় তাহলে এটি তাদের কর্তব্য। ”
হুজুর হেসে আরো বলেন “তাদের আরো বলতে পারো যে এবার জলসাতে কিছু নতুন জিনিস থাকবে। কিন্তু সেটি কি তা জানার জন্য তাদের জলসাতে আসতে হবে। তোমার সবকিছু বর্ণনা করে বলা উচিৎ হবে না। বরং তাদের মনে কিছু চিন্তার খোরাক রেখে দাও। এতে তারা কৌতুহলী হবে।”
হুজুরের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের দল সেভাবেই সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে এবং আমরা বেশ কিছু ইতিবাচক সাড়া পাই। কিছু সাংবাদিক বলে যে তারা জলসাতে আসবে এবং আরো কয়েকজন বলে যে তারা আসতে পারবে না কিন্তু তারা জলসার প্রতিবেদন পাবলিশ করবে। বেশিরভাগ সাংবাদিকই তাদের কথা রেখেছিলেন।
সবসময় নোট নেয়া
আমি লক্ষ্য করেছি যেসব বিষয়ে হুজুর তাৎক্ষনিক কোন মন্তব্য করেন না সে বিষয়টি হুজুর নোটবুকে লিখে রাখেন। যেমন এক সপ্তাহ পূর্বে আমি হুজুরকে সুইডেনের একটি সংবাদ জানাই। সেখানে একজন মহিলা লিখেছেন যে এখন এমন মিউজিক অনুষ্ঠান/কনসার্ট আয়োজন করা প্রয়োজন যেখানে কেবল মেয়েরাই থাকবে। কারণ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যে পুরুষরা মেয়েদের উপর বিভিন্ন রকম অত্যাচার করছে। সেসময় হুজুর কোন মন্তব্য করেননি কিন্তু ঘটনাটি তিনি লিখে রাখেন।
এক সপ্তাহ পর হুজুর সেই সংবাদটির সত্যতা নিশ্চিত করেন। হুজুর বলেন “আমি ইউকে জলসাতে লাজনাদের বক্তব্যতে ঘটনাটি বলব। তাই এটির সত্যতা যাচাই করা প্রয়োজন।”
“আজকে আমার পরিকল্পনা ছিল লাজনাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য তৈরী করে ফেলা। দুপুরের খাবারের পর আমি কয়েক মিনিটের জন্য ঘুমিয়ে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি পরিকল্পনার চেয়ে বেশি ঘুমিয়ে ফেলি। এর ফলে আমার বক্তব্য এখনো তৈরী হয়নি।”
আমি হুজুরকে বলি “হুজুর এটি ভাল হয়েছে কারণ জলসার সময় আপনি আর বিশ্রাম নেবার সুযোগ পাবেন না। তখন আপনি আরো ব্যস্ত হয়ে পড়বেন এবং ঘুমানোর জন্য আরো কম সময় পাবেন।”
হুজুর হাসেন ও বলেন “আল্লাহতা’লা আমাকে কয়েক মিনিটের ঘুমেই পুরোপুরি সতেজ করে দেন। তাই আমার বিশ্রাম নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। ”
একটি অসাধারণ ছুটি
হুজুর আমার কাছে জানতে চান জলসার উদ্দেশ্যে এসে যারা মসজিদ ফযলে উঠেছেন আমি তাদের কারো সাথে কথা বলেছি কিনা। আমি বলি যে তাদের সাথে দেখা করার সময় হয়ে উঠে নি। হুজুর গম্ভীর স্বরে আমাকে বলেন “যদি তুমি সুযোগ পাও তাহলে তাদের জিজ্ঞেস করো যে তারা কি জলসায় অংশগ্রহণ করতে এসেছে নাকি কেবল ঘোরাফেরা ও রাতভর গল্প-গুজব করতেই এসেছে।”
হুজুরের কথা শুনে আমার মনে হল হুজুর এ ব্যাপারে কোন রিপোর্ট পেয়েছেন বা নিজে কিছু দেখেছেন। যারা জলসার উদ্দেশ্যে আসে জলসাকেই তাদের প্রধান অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ। নিজেদের অ্যাধ্যাত্মিকতার মানকে আরো উন্নত করে আল্লাহর কাছে যাবার চেষ্টা করা উচিৎ। এসময়কে একটি পারিবারিক ছুটি মনে করা ঠিক নয়।
আহমদীদের আবেগ
আমি কানাডা জামাতের মোবাল্লেগ ইনচার্জ খলীল মোবাশশের (৭২ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “আমি আফ্রিকাতে ২৪ বছর কাজ করেছি। খিলাফত ও জামাতের প্রতি আফ্রিকান আহমদীদের ভালবাসা সত্যিই অসাধারণ। আমি তখন সিয়েরা লিওনের আমীর হিসেবে কাজ করছিলাম। তখন একজন বয়স্ক আহমদী আমার কাছে এসে তার মাথায় হাত রাখতে বলেন। তিনি বলেন যে আমি সম্প্রতি লন্ডন যেয়ে যুগ খলীফার হাত স্পর্শ করেছি। তাই তিনি সেই একই হাত তার মাথায় রাখতে চান। তিনি বলেন যে তার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে এবং সে হয়ত কখনো খলীফার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাবে না। তাই তিনি আমাকে অনুরোধ করেন আমি যেন তার এই ইচ্ছাটি পূরণ করি। ”
আমি পাকিস্তানের একজন মোবাল্লেগ শাহাব আহমেদ (২৭ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তাকে সম্প্রতি তানজানিয়াতে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। হুজুরের সাথে প্রথমবারের সাক্ষাতের পর তিনি বলেন “কিছুদিন আগে আমি চিঠিতে হুজুরকে লিখেছিলাম যে আমি সোয়াহিলি ভাষা শেখার চেষ্টা করছি। আজকে হুজুরের সাথে দেখা করার সময় হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করেন ‘তোমার সোয়াহিলি ভাষা শেখা কেমন হচ্ছে?’ হুজুরের স্মরণশক্তি দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। হুজুর হাজার হাজার চিঠি পান কিন্তু তারপরও তিনি আমার কথা মনে রেখেছেন। ”
“আফ্রিকায় কাজ করা নিয়ে আমি কিছুটা দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম যে আমি যুগ খলীফার নির্দেশমতো সেখানে যাচ্ছি। তাই আমার সাথে তার দোয়া রয়েছে। এর ফলে আমি সেখানে যেয়ে কাজ করার সাহস পাই। ইতোমধ্যেই আল্লাহর সাহায্য আসা শুরু হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তানের চেয়ে ইউকে থেকে তানজানিয়ার ভিসা পাওয়া আমার জন্য অনেক সহজ হয়েছে। ”
কথা বলতে বলতে একসময় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন “আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে খলীফা আমার নাম জানেন। কিছুক্ষন আগেই আমি তার রুমে ছিলাম এবং তিনি অত্যন্ত ভালবাসার সাথে আমার কাধে হাত রেখেছেন। আমি জামাতের জন্য সকল প্রকার ত্যাগস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। আমার খলীফা আমাকে যে ভালবাসা দেখিয়েছেন তার জন্য আমি যে কোন আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত। ”
একজন আবেগপ্রবণ খোদ্দাম
আমি কানাডার জামেআ থেকে আগত একজন ছাত্রের সাথে কথা বলি। তার সাথে আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সে আমাকে বলে যে জামেআতে তার কিছু সমস্যা হচ্ছে। সে বিষয়গুলো নিয়ে সাক্ষাতের সময় হুজুরের সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পরে ঠিক করে যে এভাবে অভিযোগ করা ঠিক হবে না। সাক্ষাতের পূর্বে সে বসে বসে চিন্তা করছিল যে তার সমস্যাগুলো হুজুর কখনোই আর জানতে পারবেন না। হুজুরের রুমে যাবার পর চুপ থাকার সিদ্ধান্তের জন্য তার আফসোস হতে লাগল।
কিন্তু সে হুজুরের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় যখন হুজুর তাকে বলেন “আমি জানি তোমাকে জামেআতে কিছু সমস্যার সম্মুক্ষীণ হতে হচ্ছে কিন্তু কোন চিন্তা করবে না। কারণ আমি তোমাদের মত তরুণ মোবাল্লেগদের জন্য দোয়া করি। ”
সে আমাকে বলে যে তার সব সমস্যাগুলোই হুজুর তাকে বলে। তার মনে হল হুজুর আগে থেকেই সব কিছু জানতেন। সে বলে “আল্লাহপাক সকল মানুষের উর্ধ্বে এবং আল্লাহপাকই খলীফাকে তার বান্দার সমস্যা সম্বন্ধে জানান। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর এই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে। আমার কাছে আর একটি জিনিস প্রমাণিত হল যে খলীফা কয়েক মিনিটের মধ্যেই একজন মানুষের সকল দুঃখ কষ্ট দূর করে দিতে পারেন। ”
জলসা সালানাতে জুমআর খুৎবা
আল্লাহর অশেষ রহমতে ২৮ জুলাই ২০১৭ তারিখ হাদীকাতুল মাহদীতে জুমআর খুৎবার মাধ্যমে ৫১ তম ইউকে জলসা শুরু হয়। খুৎবায় হুজুর জলসায় অংশগ্রহণকারীদের দ্বায়িত্ব সম্বন্ধে বলেন। হুজুর মনে করিয়ে দেন যে জলসায় অংশগ্রহণকারীদের অসদাচরণের জন্য মসীহ মাউদ(আঃ) এক বছর জলসা করেন নি। প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) বলেছিলেন যে জলসায় অংশগ্রহণকারীরা আধ্যাত্মিক নেয়ামত লাভের চেয়ে পার্থিব বিষয়াদি ও আরাম-আয়েশের দিকেই বেশি ঝুঁকে ছিল।
হুজুর বলেন “হাদীকাতুল মাহদীতে জলসার জন্য থাকার একটি সাময়িক ব্যবস্হা করা হয়েছে। তাই এখানে কখনোই স্হায়ী বিল্ডিং এর মতো স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যাবে না। তাই স্বেচ্ছাসেবকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কিছুটা দুর্বলতা থাকবেই। আমি আশা করব অতিথিরা এসব নিয়ে কোন অভিযোগ করবেন না। তাদের মনে রাখা উচিৎ স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের চাকর নয়। বরং তারা হলেন বিনয়ী মানুষ যারা প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর অতিথিদের সাহায্য করার জন্য নিজেদের পেশ করেছেন। তাই আমি দোয়া করব যে অতিথিগণ অনুগ্রহ ও দয়ালু আচরণ করবেন। ”
হুজুর আতিথেয়তার গুরুত্ব সম্বন্ধেও বলেন। তিনি বলেন যে মহানবী (সাঃ) এর রীতি হল আগত অতিথি নেতাদের সম্মান প্রদর্শন করা ও তাদের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখা। এমন অনেক অতিথিও আসে যারা ইসলাম সম্বন্ধে জানতে চায়। তাই আমাদের কর্তব্য হল প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর রীতি অনুযায়ী তাদের সাথে আচরণ করা।
সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাত
আমি জলসার উদ্দেশ্যে আগত কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলি। আল্লাহর অশেষ রহমতে জলসার পরিবেশ সাংবাদিকদের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। হুজুরের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী আমার দলের লাজনা সদস্যগণ মহিলা সাংবাদিকদের লাজনাদের অংশে নিয়ে যায় এবং সেখানে লাজনাদের সাথে অনেক আলোচনা হয়। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে সাংবাদিকগণ দেখতে পায় যে আমাদের লাজনাগণ তাদের কাজকর্মে পুরোপুরি স্বাধীণ। তারা দেখতে পায় যে সেখানে অনেক শিক্ষিত মহিলা রয়েছেন যাদের উপর জোর করে হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়নি। বরং এটি তারা গর্বের সাথে পরিধান করে।
সাংবাদিকগণ বিভিন্ন প্রদর্শনী ঘুরে ফেখেন যেমন রিভিও অফ রিলিজিয়ন, রুটি বানানোর প্লান্ট ইত্যাদি। গত বছরের মতো এবারও সাংবাদিকগণ প্লান্ট থেকে গরম রুটি নিয়ে খান এবং খুব উপভোগ করেন। আমাদের প্রেস ও মিডিয়া প্রদর্শনীতে টিভিতে হুজুরের বিভিন্ন বক্তব্যের অংশবিশেষ দেখানো হচ্ছিল। একজন মহিলা সাংবাদিক মনোযোগ দিয়ে সেটি দেখেন এবং আহমদীদের সাথে আমাদের শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করেন। তিনি আমাদের বলেন “জলসার পরিবেশ তার হৃদয় ও মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। আমি আহমদীয়াত গ্রহণের চিন্তা ভাবনা করছি এবং ‘বয়াতের শর্তসমূহ’ বইটি নিয়ে যাচ্ছি। ”
আর একজন মহিলা সাংবাদিক যিনি সম্প্রতি তার সাংবাদিকতা শুরু করেছেন তিনি বলেন “একজন মহিলা ও অতিথি হিসেবে আমি মনে করি আমাকে অনেক বেশি সম্মান ও আতিথেয়তা দেখানো হয়েছে। আমার মনে হল আমার উপস্হিতি যেন এখানে খু্বই প্রয়োজনীয়, যদিও আমি বড় কোন সাংবাদিক নই। কিন্তু তারপরও আমাকে এখানে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে দেখা হয়েছে। ”
আমি যখন প্রথম প্রেস ও মিডিয়া অফিসে কাজ করা শুরু করি তখন আমি মনে করতাম যে কেবল প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিকদের সাথেই আমাদের যোগাযোগ করা উচিৎ। কিন্তু হুজুরের কথা আমার এই চিন্তাধারাই পরিবর্তন করে দেয়। হুজুর বলেন “একজন সাংবাদিকের ২৫ লাখ পাঠক রয়েছে নাকি ২৫ হাজার সেটি আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমাদের সকলের সাথেই যোগাযোগ করতে হবে। যদি আমাদের বার্তা কেবল কয়েক হাজার মানুষের কাছেও পৌছায় তাহলেও সেটি আমাদের জন্য আনন্দের বিষয়। তাই ছোট সাংবাদমাধ্যমকে অবহেলা করবে না। যদি একজন সাংবাদিকের কোন পাঠকও না থাকে তাহলে অন্ততপক্ষে আমরা তার কাছেই ইসলামের প্রকৃত বাণী পৌছে দিব। ”
হুজুরের এই উপদেশ আমার চিন্তাধারায় গভীর প্রভাব ফেলে এবং আমি হুজুরের এই নির্দেশে গভীর প্রজ্ঞা দেখতে পেয়েছি। এমন হতে পারে যে এসকল সাংবাদিক পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা লাভ করবে। তখন তারা আগে থেকেই আমাদের জামাত সম্বন্ধে জানবে। নতুন সাংবাদিকরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের প্রতি আগ্রহ দেখায়। যেমন আমাদের জলসায় আগত সাংবাদিক বলেছেন যে তাকে জলসায় যে সম্মান দেয়া হয়েছে তিনি এর সাথে অভ্যস্ত নন। তাই এর ফলে তাদের মনে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। তারা আমাদের সাথে বেশি সময় কাটায় এবং জামাতের বিভিন্ন শিক্ষা সম্বন্ধে জানতে চায়। অপরদিকে জনপ্রিয় সাংবাদিকগণ তাদের কাজ শেষ করেই চলে যান।
জলসা সালানার প্রথম অধিবেশন
বিকেল ৪.২৫ মিনিটে হুজুর আহমদীয়াতের পতাকা উত্তোলনের পর জলসার প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। জলসায় আগত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন ইউকের শিক্ষা মন্ত্রী জাস্টিন গ্রিনিং এবং সংসদ সদস্য গোল্ডস্মিথ। স্টেজে উঠার পূর্বে হুজুর তাদের সাথে দেখা করেন। হুজুর তার বক্তব্যে সংস্কারের কথা বলেন এবং এ সম্বন্ধে প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর কিছু শিক্ষার উল্লেখ করেন। হুজুর বলেন “আল্লাহর প্রতি ভালবাসা হবে নিঃস্বার্থ। তাই মানুষ আল্লাহর প্রতি ভালবাসার কারণেই তার শিক্ষাকে মেনে চলবে। এর বিনিময়ে সে কোন পুরস্কার আশা করবে না। ”
হুজুর সন্ত্রাসীদের কথা তুলে ধরেন যারা এই শিক্ষার বিপরীত আচরণ করছে এবং ইসলামের নামে ঘৃণ্য কর্মকান্ড করে চলেছে। হুজুর বলেন “তারা যাই দাবী করুক না, সন্ত্রাসীদের মনে আল্লাহর প্রতি কোন ভালবাসা নেই এবং তারা ইসলামের শিক্ষার উপরও আমল করছে না। কারণ ইসলাম আমাদের সকল মানবজাতির প্রতি ভালবাসার শিক্ষা দেয়। ”
বক্তব্যের শেষ দিকে হুজুর দোয়া করেন “আল্লাহপাক যেন জামাতের প্রত্যেক সদস্যকে ইসলামের প্রকৃত দূত এবং আল্লাহ ও মানবজাতির সেবা করার তৌফিক দান করেন। ”
প্রথম অধিবেশনের পর হুজুর রান্নার স্হান ও রুটি প্লান্টে যেয়ে খাবার পরিদর্শন করেন। হুজুর বিভিন্ন পাত্র থেকে খাবার পরীক্ষা করে দেখেন। আমার মনে হল খাবারের মান দেখে হুজুর সন্তুষ্ট হয়েছেন।
জলসার প্রভাব
সন্ধ্যার সময় আমি প্রেস ও মিডিয়া অফিসে আরো কিছু অতিথির সাথে কথা বলি। একজন মহিলা সাংবাদিক বলেন “ছেলেরা মেয়েদের জন্য রান্না করছে এতে আমি খুব অবাক হয়েছি। প্রথমে এসে আমি কিছুটা চিন্তায় ছিলাম কারণ এখানে ছেলে ও মেয়েদের স্হান পৃথক করা হয়েছে। কিন্তু জলসাগাহ পরিদর্শনের পর আমি বুঝতে পেরেছি যে এর ফলে মহিলারা স্বাধীনভাবে থাকতে পারছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তারা নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারছে। ”
আর একজন মহিলা সাংবাদিক বলেন “এই জলসায় সকলেই অনেক কাজ করছে এবং সাহায্য করছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে এরা সকলেই স্বেচ্ছাসেবক। আমি কখনো কোন স্বেচ্ছাসেবককে জোরে কথা বলতে বা রাগান্বিত হতে দেখিনি। আমি যদি কল্পনা করি যে একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী কেমন হবে তাহলে মনে হয় সেটি আপনাদের জলসার মতোই হবে। ”
স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ করার উদ্দীপনা
হাদীকাতুল মাহদীতে জলসার প্রথম দিনের আবহাওয়া ভাল ছিল না। সন্ধ্যার পর হালকা বৃষ্টি ভারী বর্ষণে রূপ নেয় এবং কয়েক ঘন্টা ধরে এরকম বৃষ্টি হয়। আমার হাতে নোট নেবার জন্য নোটবুক থাকে তাই হাতে ছাতা নেয়া সম্ভব নয়। এর ফলে সেদিন আরো অনেকের মতো আমিও ভিজে গিয়েছিলাম। কিন্তু এরকম বৈরী পরিবেশও জলসার আনন্দ ম্লান করতে পারেনা। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য অনেকেরই ছাতা যথেষ্ট কাপড় ছিল না; কিন্তু তারপরও তারা তাদের দ্বায়িত্ব পালনে অবহেলা প্রদর্শন করেনি।
জলসার সময় কাজাকাস্তান থেকে একজন খোদ্দাম নিরাপত্তার দ্বায়িত্বে গেটের কাছে নিয়োজিত ছিল। যখনই আমি তার পাশ দিয়ে যেতাম সে মুখে বিরাট এক হাসি দিয়ে আমাকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলত। তাকে দেখে মনেই হয়নি যে সে অনেক সমস্যার মধ্যে তার কাজ করছে।
এরপর যারা টয়লেট পরিস্কারের কাজে নিয়োজিত রয়েছে তাদেরও অনেক কষ্ট হয়েছে। এই কাজটি এমনিতেই কঠিক। কিন্তু এটি আরো কঠিন হয়ে যায় যখন সকলেই কর্দমাক্ত জুতো নিয়ে টয়লেটে প্রবেশ করে।
কিন্তু কোন কর্মীই তাদের কাজ নিয়ে কোন অভিযোগ করেনি। তারা এই ভেবে গর্বিত ছিল যে তারা প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর অতিথিদের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ, স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ করার উদ্দীপনা জলসার পুরো তিন দিনই একইরকম ছিল।
লাজনাদের উদ্দেশ্য হুজুরের বক্তব্য
জলসার দ্বিতীয় দিন হুজুর লাজনাদের উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখেন। অত্যন্ত সুন্দরভাবে হুজুর ইসলামে নারীর উচ্চ মর্যাদা ও বাচ্চাদের নৈতিক শিক্ষা প্রদানের জন্য আল্লাহরতা’লার পুরস্কারের কথা ব্যাখ্যা করেন। হুজুর বলেন “পুরুষের প্রতি ইসলামের নির্দেশ হল বাড়িতে মহিলাদের কাজে সাহায্য করা। কিন্তু ইসলাম নারীদের উপর এমন কোন বাধ্যবাধকতা রাখেনি যে পুরুষদের পরিবার পরিচালনার ব্যায়ভার বহনে তাদের সাহায্য করতে হবে। ”
হুজুর জার্মানীতে একজন মহিলা যে শুধু নারীদের জন্য মসজিদ তৈরী করছেন সে সম্বন্ধে বলেন “ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা না বোঝা এবং হীনমন্যতার জন্য তিনি এরকম প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এর ফলে ইসলাম শক্তিশালী হবে না বরং আরো দুর্বল হয়ে যাবে। ”
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্যাপারে হুজুর বলেন “আমরা দুই নৌকায় আমাদের পা দিতে পারি না। তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই ডুবে যাব। তাই কোনরকম ভয়ে ভীত না হয়ে এবং হীনমন্যতায় না ভুগে আমাদের ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে। ”
দিকনির্দেশনা
লাজনাদের বক্তব্য দেবার পর হুজুর জোহর ও আসরের নামায আদায় করান। এরপর তিনি এমটিএর ব্যবস্হাপক সাহেবকে ডেকে বলেন যে পাকিস্তানের কোন কোন স্হানে কিছু সময়ের জন্য সম্প্রচার বন্ধ ছিল। হুজুরের কথা শোনার পর তিনি পাকিস্তান এমটিএর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। হুজুর তাকে বলেন যে পাকিস্তান এমটিএর ইনচার্জ সাইদ তাহির শাহ সাহেব ইউকে জলসাতেই আছেন। তাই সরাসরি তার সাথেই কথা বলা যেতে পারে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে হুজুর এই ঘটনার ফলে অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
জলসার সময় জলসা অফিসার ও ইউকের আমীর সাহেব প্রতিটি অধিবেশনের পর হুজুরের কাছে রিপোর্ট পেশ করতে ও দিক নির্দেশনা চাইতেন। যেমন দ্বিতীয় দিন হুজুরকে জানানো হয় যে পানির চাপ খুব কমে গিয়েছে। হুজুর বিভিন্ন সমাধান দেন ও বলেন যে যদি কোন সমাধানই কাজ না করে তাহলে কর্তৃপক্ষকে যেন বলা হয় পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে। হুজুর বলেন যে অতিথিদের আরামের জন্য সামান্য কিছু অর্থ ব্যয় করা কোন সমস্যা নয়।
সেদিন আমি আমীর সাহেবের সাথে খারাপ আবহাওয়া নিয়ে কথা বলি। আমীর সাহেব বলেন “হুজুর আমাদের বলেছেন যে কোন আবহাওয়া বা যে কোন পরিস্হিতিতেই জলসা সম্পন্ন হবে। তাই এসব সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে কিভাবে সবকিছু সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায় এবং অতিথিদের অসুবিধা কমানো যায় সে ব্যাপারে চিন্তা করুন। ”
একটি বিভ্রান্তির অবসান
জলসা সালানার বিকেলের অধিবেশনে হুজুর জামাতের উপর আল্লাহর অশেষ বরকত ও গত বছরের জামাতের কর্মকান্ডের সারমর্ম তুলে ধরেন। হুজুর বলেন আল্লাহর রহমতে গত বছর প্রায় ৬ লাখ মানুষ বয়াত করে আহমদীয়াত গ্রহণ করে। এর মধ্যে বেশির ভাগই আফ্রিকার। ২১০ টি দেশে জামাতের কেন্দ্র স্হাপন হয়েছে।
গত বছর কয়েকজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছে যে এতগুলো দেশে কিভাবে জামাতের কেন্দ্র স্হাপন হতে পারে, জাতিসংঘে তো এত দেশই নেই। আমি এই কথাটি হুজুরকে জলসার পরে বলি।
হুজুর হেসে বলেন “পৃথিবীতে এমন অনেক আইল্যান্ড আছে যারা নিজেদেরকে স্বাধীন দেশ বলে মনে করে; কিন্তু জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী তারা স্বাধীন দেশ নয়। আমরা কোন রাজনৈতিক দল নই। তাই এরকম সকল দেশকেই স্বাধীন দেশ বলে স্বীকার করি। ”
হুজুর এরপর তার মোবাইল দিয়ে গুগল সার্চ করেন ‘বিশ্বে কতটি দেশ রয়েছে?’। আমি হুজুরের পিছনে দাড়িয়ে দেখলাম যে জাতিসংঘের তালিকা ছাড়াও অনেক দেশ রয়েছে যারা নিজেদেরকে স্বাধীন দেশ বলে মনে করে। হুজুর আমাকে বলেন “এখন তুমি মানুষকে সঠিকভাবে ব্যাপারটি বোঝাতে পারবে। পরের জলসার আগে আমাকে মনে করিয়ে দিবে তাহলে আমি আমার রিপোর্টে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করব। ”
এই জলসার কয়েকদিন পূর্বে আমি বিবিসির খেলার খবর পড়ছিলাম। সেখানে একটি খবর ছিল যে একটি বক্সিং খেলা ২২০ টি দেশে সম্প্রচার করা হয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে বিবিসির মতো বিশ্বাসযোগ্য সংবাদমাধ্যমও সেসব দেশকে স্বীকৃতি দেয় যাদের জাতিসংঘ দেশ বলে স্বীকৃতি দেয় না।
প্রতিনিধিদের সাথে মিটিং
হুজুরের বক্তব্যের পর সন্ধ্যার সময় তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন গ্রীস, সুইজারল্যান্ড, উরুগুয়ে, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ড এবং সিয়েরা লিওন থেকে আগত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, নন আহমদী অতিথি এবং নতুন বয়াতকারী আহমদী।
একজন গ্রীক সাংবাদিক হুজুরকে প্রশ্ন করেন যে পৃথিবীতে শান্তির বাণী প্রচার করা কঠিন কিনা? হুজুর বলেন “আমাদের কাজ হল ইসলামের বাণী প্রচার করা এবং ইসলামের একটি মূল অংশ হল শান্তি। বর্তমানে বিশ্বে অনেক সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা চলছে। কিন্তু এর ফলে আমরা আমাদের কাজ কখনো বন্ধ করব না। ”
সুইজারল্যান্ড থেকে আগত একজন অতিথি প্রশ্ন করেন যে কেন হুজুরকে ‘His Holliness’ বলে সম্বোধন করা হয়। হুজুর বলেন “আমি কাউকে বলিনি আমাকে এভাবে সম্বোধন করতে। এটি জামাতের সদস্যদের সিদ্ধান্ত। তারা তাদের আধ্যাত্মিক নেতার প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের জন্য এরকম বলে। কিন্তু কেউ যদি আমাকে মির্যা মাশরুর আহমেদ বলে সম্বোধন করে তাহলে আমার কোন অসুবিধা নেই। আপনি অবশ্যই আমাকে আমার নাম ‘মাশরুর’ বলে সম্বোধন করতে পারেন। ”
স্পেন থেকে আগত প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েকজন সংসদ সদস্য ছিলেন। তাদের একজন বলেন যে তারা খৃষ্টান ধর্মের অনুসারী। হুজুর বলেন “আপনারা কোন ধর্মের অনুসারী এটি কোন ব্যাপার নয়। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে মানবজাতি হিসেবে আমরা সবাই এক। তাই কারো বিশ্বাস যাই হোক না কেন আমাদের উচিৎ সবাইকে ভালবাসা ও সম্মান করা। ”
হুজুর আরো বলেন “সম্প্রতি বৃষ্টির কারণে অতিথিদের অনেক কষ্ট হয়েছে। এজন্য আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ”
একজন মহিলা সংসদ সদস্য বলেন “আমার হুজুরের বক্তব্য অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। আমি ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। জলসার পূর্বে আমি আহমদীয়াতের ব্যাপারে তেমন কিছু জানতাম না কিন্তু এখন আমার ইসলাম সম্বন্ধে একটি পরিস্কার ধারণা হয়েছে। মিডিয়াতে ইসলামকে যেভাবে প্রচার করা হয় সেটি সম্পূর্ণ আলাদা।”
আর্জেন্টিনার একজন প্রতিনিধি হুজুরকে প্রশ্ন করেন “ইসলামের নামে যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চলছে এতে জামাতের প্রতিক্রিয়া কি?”
হুজুর বলেন “আমরা সবসময় এ ধরণের কর্মকান্ডের প্রতি তীব্র নিন্দা জানাই এবং আমরা পরিস্কারভাবে বলে দেই যে এগুলো ইসলামী শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেয়ে ইসলামী শিক্ষার আলোকে বক্তব্য দিয়েছি যে কিভাবে বিশ্বে শান্তি স্হাপন করা যায়। আমি বিশ্ব নেতাদের চিঠি লিখেছি এবং তাদের ভয়াবহ যুদ্ধের ঝুঁকি সম্বন্ধে সতর্ক করেছি । ”
“এই জলসাই একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ যে কিভাবে আমরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার উপর আমল করছি। এখানে শত শত মানুষ তিন দিন ধরে অবস্হান করছে। বৃষ্টির কারণে ও অন্যান্য সমস্যার কারণে মানুষের অনেক কষ্ট হয়েছে। কিন্তু আপনি অংশগ্রহণকারীদের মুখে কেবল হাসিই দেখতে পাবেন। এখানে কোন বিশৃঙ্খলা নেই এবং কোনরকম অঘটন ছাড়াই সবকিছু সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এটি হল ইসলামের সঠিক শিক্ষার ফলাফল।”
এরপর রাতের খাবারের পর হুজুর মাগরিব ও এশার নামায আদায় করান। এর মাধ্যমে জলসার দ্বিতীয় দিনের কার্যক্রম শেষ হল।