জলসা সালানা ইউকে ২০১৭ – ৩য় পর্ব

জলসা সালানা ইউকে ২০১৭

ব্যক্তিগত ডায়েরী – ৩য় পর্ব

আবিদ খান (বাংলা অনুবাদ)

সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট সাহেবের ফোনকল

১ আগস্ট ২০১৭ তারিখেও হুজুর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে মিটিং করছিলেন। হুজুর সিয়েরা লিওনের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন গোত্রের প্রধান, রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন সিয়েরা লিওনের চীফ জাস্টিস ছিলেন এবং তিনি সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্টের (আরনেস্ট কোরোমা) বাণী পাঠ করে শোনান। সেখানে তিনি আহমদীয়া জামাতকে অভিনন্দন জানান এবং সিয়েরা লিওনে শিক্ষা ও মানবসেবামূলক কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এরপর সিয়েরা লিওন সরকারের একজন প্রতিনিধি বলেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে হুজুরের সাথে কথা বলতে চান।

হুজুর তাকে ফোন করার অনুমতি দেন এবং তিনি প্রেসিডেন্টকে ফোন কল করেন। ফোনে কথা বলার সময় হুজুর প্রেসিডেন্ট সাহেবকে তার বার্তার জন্য ধন্যবাদ জানান, সিয়েরা লিওনের খোঁজ খবর নেন এবং দেশের জন্য দোয়া করেন।

আমার মনে হল আফ্রিকান কিছু সরকার কিছুটা হলেও খলীফাতুল মসীহর মর্যাদা বুঝতে পারেন এবং তাদের দেশের উন্নতির জন্য হুজুরের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন। অতীতে হুজুর বলেছেন যে তিনি আশা করেন আফ্রিকা একসময় পুরো বিশ্বকে নেতৃত্ব দিবে। খলীফাতুল মসীহকে সম্মান দেবার বিষয়ে তারা ইতোমধ্যেই এগিয়ে আছে।

স্পষ্ট বক্তব্য

সিয়েরা লিওনের একজন মহিলা হুজুরকে বলেন “সিয়েরা লিওন থেকে যেসকল মহিলা এখানে এসেছেন আমি তাদের পক্ষ থেকে বলতে চাই যে আমরা জলসায় আগত ৩৭ হাজার মানুষের মধ্যে একজন হতে পেরে গর্বিত। আমাদের স্বপ্ন হল পরের বছর পুরো একটি প্লেন ভর্তি মানুষ নিয়ে জলসায় আসা। হুজুর আপনার বক্তব্য শুনে আমরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি, এর মাধ্যমে আমরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা শিখতে পেরেছি এবং এটি বলাই যথেষ্ট যে আপনার কথা আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছে।  ”

হুজুর উত্তরে তাকে বলেন “আপনি কেবল মহিলাদেরই নন বরং পুরুষদেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন। কারণ আমার মনে হয় না আপনি যেভাবে আপনার মনের অনুভূতি ব্যাখ্যা করেছেন কোন পুরুষ তার চেয়ে ভাল বলতে পারত।”

পরবর্তীতে হুজুর আমাকে সিয়েরা লিওনের প্রতিনিধিদের সাক্ষাতের ব্যাপারে কথা বলেন। হুজুর বলেন “আমি তোমাকে পূর্বেই বলেছিলাম যে আফ্রিকানরা অত্যন্ত সুন্দরভাবে কথা বলতে পারে এবং সিয়েরা লিওনের সেই মহিলার বক্তব্যই তার প্রমাণ। তিনি যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন তা অত্যন্ত উচ্চমানের!”

মাদাগাস্কার, লাইবেরিয়া ও ক্যামেরনের প্রতিনিধি

মাদাগাস্কার থেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ যিনি বিগত সরকারের আমলে মন্রী ছিলেন তিনি হুজুরকে বলেন “আমি দেখেছি আপনাদের জামাত অন্যান্য মুসলমানদের চাইতে আলাদা। আপনাদের জামাত ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ এবং আপনাদের মূল উদ্দেশ্য হল অন্যদের সাহায্য করা বিশেষ করে যারা সুবিধাবঞ্চিত ও কষ্টের মধ্যে আছে। আমি আপনাদের এসকল কর্মের জন্য ধন্যবাদ জানাই।  ”

হুজুর তাকে বলেন “আমাদেরকে ধন্যবাদ জানানোর আপনার কোন প্রয়োজন নেই। অন্যদের সাহায্য করা আমাদের লক্ষ্য ও কর্তব্য। ”

লাইবেরিয়ার একজন সংসদ সদস্য বলেন “লাইবেরিয়ার আহমদীদের আমি প্রায় এক দশক ধরে চিনি এবং আমি দেখেছি যে তারা অনেক শান্তিপ্রিয় ও অনুগত নাগরিক। গত কয়েকদিনে আমি দেখেছি কেবল লাইবেরিয়ার আহমদীই নয় বরং বিশ্বের সকল আহমদীই একই রকম। তারা সকলেই শান্তি ও সৌহার্দ্যের বাণী প্রচার করছে। ”

লাইবেরিয়া থেকে আগত আর একজন অতিথি বলেন “বিপদের সময়ই প্রকৃত বন্ধুকে চেনা যায়। যখন ইবোলা আমাদের দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে তখন একমাত্র আহমদী হাসপাতালই চিকিৎসা সেবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। অন্য সকল হাসপাতালই বন্ধ ছিল। এই উপকারের জন্য আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। ”

হুজুর তাকে বলেন “হ্যা, আমি আহমদী হাসপাতালকে বন্ধের নির্দেশ দিতে পারি না যখন মানুষের আমাদের প্রয়োজন। প্রয়োজনের সময় মানুষকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব।  ”

ক্যামেরনের একজন সাংবাদিক বলেন “আমি কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করিনি যে আমি এরকম একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশে আসতে যাচ্ছি। আপনি পুরো বিশ্বকে দেখিয়েছেন যে মুসলমানগণ শান্তিপ্রিয়, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও দয়ালু। আমাকে এই কথা বলার জন্য মাফ করবেন কিন্তু আমাকে বলতেই হচ্ছে যে আমি এতে অনেক বিস্মিত হয়েছি। আমি নিশ্চিত আমার দেশের অনেকেই এরকম শান্তিপ্রিয় মুসলমান দেখে অবাক হবে। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার কাজ হল ত্রুটি বের করে তার সমালোচনা করা। কিন্তু আমি এখানে সমালোচনা করার মতো কিছু পাচ্ছি না। ”

হুজুর হাসেন ও বলেন “হ্যা, আপনি ইসলামে কোন ত্রুটি পাবেন না। জলসাতে শান্তির যেই প্রদর্শনী দেখেছেন তা অন্য কোন দেশ বা জাতির মধ্যে খুঁজে পাবেন না।”

অগ্রগামী জামাত

হুজুর হন্ডুরাস থেকে আগত নতুন আহমদীদের সাথে কথা বলেন। সেখানে সম্প্রতি জামাত গঠিত হয়েছে। হন্ডুরাসের প্রথম বয়াতকারী আহমদী বলেন “আমি আপনাকে আমার মনের অনুভুতি এবং এই জলসায় ভালবাসাপূর্ণ আবহাওয়া ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না। আমি একই আবহাওয়া আমার দেশেও দেখতে চাই। আমি চাই যে তারাও ইসলাম গ্রহণ করুক।  ”

হন্ডুরাসের দ্বিতীয় আহমদী একজন মহিলা। তার স্বামী নেই এবং দুইটি সন্তান রয়েছে। তিনি রিসিপশনিস্ট হিসেবে কাজ করেন। এটি বোঝা যাচ্ছিল যে তিনি অনেক কষ্ট করে জীবনযাপন করছেন কিন্তু আহমদীয়াতের ফলে তিনি শান্তি পেয়েছেন। তিনি বলেন “আমি এখানে এসে সবকিছু ভুলে গিয়েছি এবং মানসিক শান্তি পেয়েছি। আমার মনে হয়েছে এটিই আমার প্রকৃত বাসা। ”

হুজুর হন্ডুরাস জামাতের উদ্দেশ্যে বলেন “আলহামদুলিল্লাহ, আপনারা ইসলামের শিক্ষাকে গ্রহণ করেছেন এবং দেখেছেন যে ইসলাম শান্তির একটি উৎস। আমাদের লক্ষ্য হল মানবজাতিকে ভালবাসা ও তাদের সাহায্য করা। তাই আমি আশা করব আপনারা এখন আপনাদের দেশে যেয়ে মানুষের কাছে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রচার করবেন।  ”

এরপর হুজুর প্রত্যেক নতুন আহমদীকে অত্যন্ত ভালবাসার সাথে প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর ইলহাম খচিত আংটি উপহার দেন। যেখানে লেখা ছিল “আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?”

আংটি দেবার পূর্বে হুজুর লক্ষ্য করেন যে যাকে আংটি দেয়া হচ্ছে তার হাতে সেটি ঠিকমতো বসছে কিনা।

গায়ানা প্রতিনিধি

গায়ানা প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন হিন্দু পুরোহিত ছিলেন যিনি পেশায় একজন সাইকোলোজিস্ট। তিনি হুজুরকে বলেন “আমি একজন হিন্দু। কিন্তু জলসায় অংশগ্রহণ করার পর আমার নিজেকে হৃদয়ে একজন আহমদী বলে মনে হচ্ছে।”

একজন মহিলা সাংবাদিক বলেন “গায়ানাতে আমি বিভিন্ন মুসলিম দলের সাথে কাজ করেছি এবং তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। কিন্তু আপনাদের মাঝে যে ভালবাসা দেখেছি তার সাথে অন্যদের কোন তুলনাই হয় না। আমি আশা করব যে একদিন অন্যান্য সকল মুসলমানগণ আহমদীয়াত গ্রহণ করবে।”

হুজুর হাসেন ও বলেন “আমাদের লক্ষ্য কেবল মুসলমানদের সংশোধন নয় বরং বিশ্বের সকল মানুষের হৃদয়কে জয় করা, ইনশাল্লাহ। ”

এরপর তিনি হুজুরকে স্বপ্নের গুরুত্ব সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেন। হুজুর তাকে বলেন “প্রত্যেক ব্যক্তি সে ধার্মিক হোক বা না হোক ঘুমানোর সময় স্বপ্ন দেখে। তাই বেশির ভাগ স্বপ্নই আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন নিদর্শন নয়। তারা আমাদের অবচেতন মনের ফলাফল। কিন্তু যদি আপনি কোন বিষয়ে দোয়া করেন এবং স্বপ্নে সেই বিষয়ের কোন দিক নির্দেশনা পান তাহলে সেটি আল্লাহর পক্ষ থেকে । ”

একটি হৃদয়গ্রাহী মুহুর্ত

এরপর হিন্দু পুরোহিত বলেন “আমি মুসলমানদের মতো করে দোয়া করতে চাই। কিন্তু এটি করার পূর্বে আমার ইচ্ছা হল আমি ওয়াদা করব যে আমি আহমদীয়া মুসলিম জামাতকে সাহায্য করব এবং আমি চাই যে এই জামাত আরো বৃদ্ধি পাক। বিশেষ করে বয়াতের ৯ম শর্তটি আমার খুবই ভাল লেগেছে যেখানে আহমদীদের বলা হয়েছে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব পালন করতে। এই শর্তটি আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে এবং আমি এটি কে মেনে চলার ওয়াদা করছি। ”

এরপর তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করেন। আমি তখন আমার মোবাইল দিয়ে সেটি রেকর্ড করি। তিনি অনেক সময় নিয়ে সূরা ফাতিহা মুখস্হ করেছেন এবং অত্যন্ত আবেগ দিয়ে সেটি তিলাওয়াত করছিলেন। তিলাওয়াতের পর হুজুর ‘আমীন’ বলেন এবং তাকে ধন্যবাদ জানান।

হুজুর বলেন “আমার দৃষ্টিতে আপনি একজন হিন্দু পুরোহিত হতে পারেন কিন্তু আপনি ইতোমধ্যেই কমপক্ষে অর্ধেক মুসলমান। আপনি অনেক সুন্দরভাবে পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরা তিলাওয়াত করেছেন। আমার উপদেশ হল আপনি সূরা ফাতিহার ‘আমাদের সরল-সুদৃঢ় পথে পরিচালিত কর’ এই আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করুন এবং দোয়া করার সময় এই আয়াতের উপর মনোযোগ দিন। ”

সাক্ষাতের কিছু সময় পর হুজুর আমাকে বলেন “মাশাল্লাহ, হিন্দু অতিথি অত্যন্ত সুন্দরভাবে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করেছে। মনে হচ্ছে তার ইসলাম সম্বন্ধে ভাল ধারণা আছে।”

আফ্রিকান সংবাদ মাধ্যমের সাথে সাক্ষাৎকার

হুজুর এরপর আফ্রিকা থেকে আগত কিছু সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ন্যাশনাল টেলিভিশনে ইউকে জলসার পুরোটাই বা অংশবিশেষ প্রচারিত হয়েছে। সাংবাদিকগণ হুজুরকে জানায় যে তাদের দেশে জলসা সম্প্রচারে মানুষ কিরকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

একজন আফ্রিকান সাংবাদিক বলেন “আমরা অনেক ফোনকল ও ইমেইল পেয়েছি। যেখানে সাধারণ মানুষ বলেছে যে তারা জলসা দেখে অবাক হয়েছে। ইসলাম সম্বন্ধে পূর্বে তাদের যেই ভীতি ও ভুল ধারণা ছিল তা সম্পূর্ণ দূর হয়েছে। ”

“আমাদের মানুষের জন্য এটি একটি স্বস্তির বিষয় যে ওহাবীজম ও সন্ত্রাসবাদ প্রকৃত ইসলাম নয় যেটি তারা পূর্বে মনে করত। দুঃখজনক হল আফ্রিকাতে ওহাবীজমের অনেক প্রভাব রয়েছে। তাই মানুষ ইসলামকে ভয় পায় এবং একে একটি সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে দেখে। কিন্তু এই জলসা দেখে অনেক মানুষের ভুল ধারণা দূর হয়েছে। আপনার বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত ইসলাম সম্বন্ধে জানতে পেরেছে।  ”

বিভিন্ন সাংবাদিকের বক্তব্য শুনে হুজুর নোট করে নেন যে সিয়েরা লিওনে সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছেছে। হুজুর বলেন “জলসার দিনে বোঝা যাচ্ছে যে সিয়েরা লিওনের টিভি এমটিএ হয়ে গিয়েছিল। কারণ তারা বিরতিহীন ভাবে এমটিএ সম্প্রচার করে আসছিল। তাই এই বছর সম্প্রচারের দিক দিয়ে তারা ঘানাকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। ”

আহমদী পরিবারের আবেগ

হুজুর প্রায় ৭৫ টি পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমি তাদের কারো কারো সাথে কথা বলি। অষ্ট্রেলিয়া থেকে আগত মোহাম্মদ ইউনুস (৩৬ বছর), তার স্ত্রী ও তাদের তিনজন ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তারা হুজুরের সাথে দেখা করে। ইউনুস সাহেব ২০০৭ সালে আহমদীয়াত গ্রহণ করেম এবং লন্ডনে চলে আসেন যেন হুজুরের কাছাকাছি থাকতে পারেন। ২০১২ সালে তিনি অষ্ট্রেলিয়া ফিরে যান, যেন তার দেশের মানুষের মাঝে আহমদীয়াতের বাণী পৌছাঁতে পারেন।

হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর তিনি বলেন “গত এক দশকে আহমদীয়াত আমাকে নতুন জীবন দান করেছে। আমার জীবনের এখন একটি শক্ত ভিত্তি এবং একটি বরকতময় রাস্তা রয়েছে যেই পথ দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে পারি। আমি এখন আত্মবিশ্বাসী, আমার মনে এখন শান্তি ও নিরাপত্তা রয়েছে যেটি পূর্বে কখনো ছিল না। জীবনের প্রতিটি বিষয়ে আমার ধর্মই আমার জন্য যথেষ্ট এবং খিলাফত আমার পথপ্রদর্শক।   ”

তিনি অষ্ট্রেলিয়া ফিরে যাবার কারণ সম্বন্ধে বলেন “প্রকৃত সত্য হল একজন স্হানীয় অধিবাসী হিসেবে আমার মনে হচ্ছে এটি আমার দায়িত্ব যে আমি যেন আমার দেশে প্রকৃত ইসলামের বাণী প্রচার করি। অবশ্যই আমি হুজুরের কাছাকাছি থেকে অত্যন্ত আনন্দিত। কিন্তু আমার দেশ ও আমার বাবা-মায়ের জন্য যে দায়িত্ববোধ রয়েছে যারা আমার প্রয়োজনের সময় আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন তার জন্য আমাকে ফিরে যেতে হবে। এখন আমার মনে হচ্ছে অষ্ট্রেলিয়াতে তবলীগ করে আমি হুজুরের আরো কাছে যেতে পারব।  ”

ইউনুস সাহেবের স্ত্রী ফাইযা সাহিবা একটি ঈমান উদ্দীপক ঘটনা বলেন। তিনি বলেন “আজকে আমরা আমাদের নবজাতক বাচ্চা ফারাহ কে নিয়ে এসেছিলাম। আমি যখন গর্ভবতী ছিলাম তখন হুজুরের কাছে দোয়ার জন্য চিঠি লিখতাম যেন আমার প্রসবে কোনরকম সমস্যা না হয়। কিন্তু প্রত্যাশিত তারিখে দুই সপ্তাহ পূর্বে আমার পানি ভেঙে যায় এবং আমি নিশ্চিত ছিলাম যে অতিদ্রুতই বাচ্চা প্রসব হয়ে যাবে কারণ আমি হুজুরের কাছে দোয়ার জন্য চিঠি লিখেছিলাম। কিন্তু ডাক্তার আমাকে পরিক্ষা করার পর বললেন যে প্রসব হতে এখনো অনেক দেরী আছে এবং তাদের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই এবং হুজুরকে চিঠি লিখে আমার স্বামীকে ফ্যাক্স করে দিতে বলি। ”

“চিঠি লেখার এক মিনিটের মধ্যেই আমার স্বাভাবিক প্রসববেদনা শুরু হয় এবং ডাক্তারদের ভুল প্রমাণিত করে দুই ঘন্টার মধ্যেই নিরাপদভাবেই বাচ্চা প্রসব হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত যে হুজুরের দোয়ার ফলেই এরকম হয়েছে। আমি একে একটি অলৌকিক ঘটনা হিসেবেই দেখি। আলহামদুলিল্লাহ।   ”

একজন বয়াতকারীর আহমদীয়াত গ্রহণের সফর

আমি লন্ডনের গ্রীসেনহল রোড দিয়ে হাটার সময় হঠাৎ করেই একজন আফ্রিকান-আমেরিকান আহমদীর সাথে দেখা হয়ে যায়। তার নাম হল আব্দুল সুবহান আযীম(৫৬ বছর) এব তিনি একজন বয়াতকারী আহমদী। যদিও আমাদের পূর্বে কখনো দেখা হয়নি কিন্তু আমরা দ্রুতই বন্ধু হয়ে যাই। তিনি আমাকে তার আহমদীয়াত গ্রহণের কাহিনী বলেন। তার কথা শুনে আমার মনে হল যে আমি কোন বিখ্যাত প্রবন্ধ শুনছি। কিন্তু তিনি আমাকে বলেন যে এটি সত্যিই তার নিজের জীবনের কাহিনী। আমি জানতে পারি যে তিনি একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। তিনি আমেরিকাতে একটি টিভি শো “The Black Perspective” হোস্ট করতেন।

তিনি বলেন “আমি খৃষ্টান হিসেবে জন্মগ্রহণ করি কিন্তু ২০০১ সালে Nation of Islam এ যোগদান করে ইসলাম গ্রহণ করি। সেখানে যোগদান করার কারণ হল আমি ম্যালকম এবং তার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। আমি ন্যাশন অফ ইসলামের মিনিস্টার অফ ইনফরমেশন হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলাম। আমার একটি কাজ ছিল বই কেনা। আমি পূ্র্বে কখনো আহমদীয়াতের নাম শুনিনি কিন্তু বই কিনতে যাবার সময় আমি কিছু আহমদী বই পাই এবং সেগুলো পড়তে শুরু করি। পরবর্তীতে আমি আহমদী বই বিক্রেতার সাথে কথা বলি এবং তাকে জানাই যে আমি হযরত মির্যা গোলাম আহমদ(আঃ) এর বই পড়েছি এবং আমার খুবই ভাল লেগেছে। আমার মনে হয়েছে যে প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এই পার্থিব জীবন নিয়ে চিন্তা করতেন না বরং তার একমাত্র চিন্তা ছিল আধ্যাত্মিকতা এবং আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া। আমি যতই তার বই পড়তে থাকি আমি বুঝতে পারি যে ম্যালকম নয় বরং মহানবী(সাঃ) ই আমার জীবনের আদর্শ হওয়া উচিৎ।   কিছু নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারণে ২০১৩ সালে আমি Nation of Islam ত্যাগ করি।  ”

“আমি আহমদী বই-পত্র পড়তে থাকি এবং জুমআর খুৎবা শুনার জন্য অণুপ্রাণিত হই। আমি ফিলাডেলফিয়ার আহমদী মসজিদে জুমআর খুৎবা শুনতে যাই এবং ২০১৬ সালে ইউএসএ জলসাতে অংশগ্রহণ করি। সেখানে আমি সকলের কাছ থেকে অসম্ভব রকম ভালবাসা পাই। আমি প্রতি শুক্রবারে মসজিদে যেতে থাকি এবং আমার টিভি শোতে প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর বাণী প্রচার করতে থাকি। যদিও আমি তখনো আহমদীয়াত গ্রহণ করিনি। আমি Nation of Islam এর নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কারণে বয়াত করতে দেরী করছিলাম। ”

“প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর কিশতিয়ে নূহ বইটি আমার অত্যন্ত ভাল লাগে। কারণ সেখানে তিনি লিখেছেন যে নিজের ধর্মকে জানতে হবে এবং তার উপর নিশ্চয়তা অর্জন করতে হবে। বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে যে তিনি প্রকৃতভাবেই আল্লাহকে চিনতে পেরেছেন এবং জানেন যে আল্লাহপাক কি চান। আমিও বয়াত গ্রহণের পূর্বে আহমদীয়াতের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম। সময়ের সাথে সাথে আহমদীয়াতের প্রতি আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হতে ধাকে এবং আল্লাহর রহমতে আমি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বয়াত গ্রহণ করি।  ”

হুজুর সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমি যখন হুজুরের কোন উত্তর শুনি আমি দেখতে পারি যে হুজুর অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং তিনি গভীরভাবে পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন করেছেন এবং বুঝেছেন। প্রকৃতপক্ষে যখন আমি হুজুরের কথা শুনি আমার মনে হয় হুজুর কোরআন পাঠ করছেন। আমি গতকাল হুজুরের সাথে দেখা করতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। আমি তাকে বলতে পেরেছি যে আমি তাকে ভালবাসি এবং এতে আমি অত্যন্ত গর্বিত।  ”

“একবার হুজুর আমার হৃদয়কে ভেঙে দিয়েছিলেন। এক খুৎবায় তিনি বলেছিলেন এমন কিছু স্হানে এমন গরীব অবস্হায়ও কিছু মহিলা আছেন যাদের নিজেদের বাচ্চার জন্য পানি আনতে দশ মাইল হাটতে হয়। হুজুর সেই খুৎবায় বলেন যে আপনি কি মনে করেন সেইসব মহিলাদের কোন অনুভূতি বা হৃদয় নেই? সেই মুহুর্তে আমি বুঝতে পারি যে খলীফা সমাজের সবচেয়ে অবেহেলিত মানুষের দুঃখকেও অনুভব করেন। সেই মুহুর্তে আমি অত্যন্ত প্রভাবিত হই। আমার মনে হচ্ছিল তখনই আমি একটি প্লেনে উঠে তাদের কাছে পানি নিয়ে যাই। ”

প্রথমবারের মতো ইউকে জলসায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি বলেন “জলসা অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে। কিন্তু সকালবেলা হাদীকাতুল মাহদীতে পানি অত্যন্ত ঠান্ডা ছিল তাই আমি প্রথমে দুঃখিত হয়েছিলাম। এরপর আমি কোরআনের একটি আয়াত পড়ি যে ‘আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নয়?’ তখন আমি বুঝতে পারলাম যে ঠান্ডা পানি ও অন্যান্য কষ্টের কোন অর্থ নেই কারণ আল্লাহ ও তার নবীই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাই আমি বলতে পারি যে আমার জলসা অভিজ্ঞতা অত্যন্ত আনন্দপূর্ণ, আমি এখানে মনের শান্তি লাভ করেছি এবং আমি গর্বিত যে শয়তানকে হারাতে পেরেছি। ”

তার সন্তানদের সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমার ছেলের বয়স ২৫ বছর এবং সে বলেছে যে সে আমার মতো মুসলমান হতে চায়। আমি যখন ন্যাশন অফ ইসলামের সদস্য ছিলাম তখন সে এরকম কোন কথা বলেনি। তাই বোঝা যায় যে আহমদী হবার পর আমার মধ্যে ভাল পরিবর্তন এসেছে।  ”

“ছোটবেলায় আমার পিতা-মাতা আমাকে জোর করে চার্চে নিয়ে যেত এবং আমি তা খুবই অপছন্দ করতাম। তাই আমি আমার ধর্মকে আমার বাচ্চাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাই না। কিন্তু আমার ব্যবহারই তাদের উপর ভাল প্রভাব ফেলছে এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করছে। আমি মনে করি এটি আহমদীয়াতের একটি বরকত।   ”

ইসলামের গুণাবলী

২ আগস্ট ২০১৭ তারিখে হুজুর আরো কিছু দেশের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে বেনিনের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন। তিনি হুজুরকে বলেন “আমি বেনিনের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসেছি। আমি আপনাকে জানাতে চাই যে আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বাণী আমাদের দেশের সকল প্রান্তে পৌঁছেছে। আমরা বিশ্বাস করি যে যদি বিশ্ববাসী আপনার বার্তাকে শুনে ও পালন করে তাহলে এই পৃথিবী জান্নাতে পরিণত হবে। ”

হুজুর তাকে বলেন “আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আশা করব যেন বেনিনে আপনারা আমাদের শান্তি ও সৌহার্দ্যের বাণী প্রচার করেন। আপনাদের দেশ হিসেবে একত্র হতে হবে এবং আফ্রিকাকে মহাদেশ হিসেবে একসাথে কাজ করতে হবে। তাহলে আপনারা সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করতে পারবেন এবং আপনাদের দেশ উন্নতি করবে। ”

বেনিনের সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুজুরকে ধন্যবাদ জানান ও বলেন “একজন মহিলা হিসেবে আমি আপনাকে বলতে চাই যে আপনি জলসাতে মহিলাদের উদ্দেশ্য যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে আমি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছি। কারণ সেখানে আপনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে মহিলাদের প্রকৃত মর্যাদা ব্যাখ্যা করেছেন। আমাদের দেশে মহিলাদের সাথে ভাল ব্যবহার করা হয় না। তাই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আফ্রিকার পুরুষ ও মহিলা যেন আপনার বক্তব্য শুনে। ”

তার কথা শুনে আমি চিন্তা করলাম যে কেবল আফ্রিকাতেই নয় বরং পুরো বিশ্বেই মহিলাদের সাথে খারাপ আচরণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিভিন্ন বিখ্যাত হলিউড ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদদের স্ক্যান্ডালের খবর আসছে। তারা অনেক বছর ধরেই বিনা বিচারে নারীদের হেনস্হা করে আসছিলেন। কিছুদিন পূর্বে আমি হুজুরকে এরকম একটি ঘটনার কথা বলি যেখানে ইউকের একজন মন্ত্রীকে স্ক্যান্ডালের কারণে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ ছিল যে তিনি একজন মহিলা সাংবাদিকের হাটুতে হাত রেখেছিলেন।

হুজুর আমাকে বলেন “তারা এটি মানুক বা নাই মানুক, কিন্তু এসকল হয়রানি পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে ইসলামিক শিক্ষার পিছনে কি গভীর প্রজ্ঞা রয়েছে। আমরা জানি না যে মন্ত্রী কোন উদ্দেশ্যে কাজটি করেছিলেন কিন্তু ইসলাম বলে যে পুরুষ ও মহিলাকে সম্মানজনক দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। পর্দার মাধ্যমে ইসলাম সকল প্রকার সন্দেহ দূর করে। ”

পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানদের তিরস্কার করা হয় যদি তারা সবার সাথে অবাধে হাত না মেলায় এবং মহিলাদেরকেও পর্দার কারণে সমালোচনা করা হয়। কিন্তু এসকল ইসলামিক মূল্যবোধের কারণেই তারা আরো সংকটজনক পরিস্হিতি থেকে রক্ষা পাচ্ছে।

আরো কিছু প্রতিনিধিদের দাথে সাক্ষাৎ

হুজুর এরপর মার্শাল আইল্যান্ড. কিরিবাতি, মাইক্রোনেশিয়া, আইভরি কোষ্ট, মরিশাস, মরক্কো, গুয়াতেমালা ও গিনি কোনাক্রি দেশের প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন। প্রতিশ্রুত মসীহ (আঃ) এর বাণী এখন সুদূর প্যাসিফিক আইল্যান্ড পর্যন্ত পৌছে গেছ। কিরিবাতির মত ছোট দেশেও যার জনসংখ্যা মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার সেখানেও আল্লাহর রহমতে ৪০০ জন আহমদীর জামাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানকার জামাতের মোবাল্লেগ জানান একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারীভাবে রেজিষ্টার হতে হলে সদস্য সংখ্যা মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে ১০% হতে হবে।

হুজুর বলেন “ঠিক আছে, আপনাদের তাজনীদ কমপক্ষে আরো ১০ হাজার বৃদ্ধি করুন তাহলেই আপনারা রেজিষ্টার করতে পারবেন। ”

মরক্কোর একজন প্রতিনিধি হুজুরকে দোয়ার জন্য অনুরোধ করেন যেন তিনি ইউরোপে তার জন্য ভাল পাত্রী পান। হুজুর বলেন “যদি ইউরোপে বিয়ে করা আপনার ইচ্ছা হয় তাহলে আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন। কিন্তু আমি কেবল ইউরোপ নয় বরং পুরো জামাত নিয়েই চিন্তিত। কারণ যদি মরক্কোর আহমদী ছেলেরা ইউরোপে বিয়ে করে তাহলে মরক্কোর আহমদী মেয়েদের কে বিয়ে করবে? তাদের কি একাকী ফেলে রাখা হবে? ”

গুয়াতেমালা থেকে আগত একজন নন-মুসলিম অতিথি তার জলসা অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে বলেন “আমার পুরোজীবনে আমি আহমদীদের মতো এমন মানুষ দেখিনি যারা অন্যদের প্রতি এতটা লক্ষ্য রাখে। আপনি শিখিয়েছেন যে আল্লাহর ভালবাসা অর্জনের জন্য তার সৃষ্টিকে ভালবাসতে হবে। মিডিয়াতে ইসলামকে যেভাবে প্রচার করা হয় এটি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ”

“ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন খৃষ্টান। কিন্তু খৃষ্টানদের কোন মতবাদই আমাকে আল্লাহর ভালবাসা অর্জন বা মানবজাতির প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করতে বলে না। বরং তারা কেবল বলে পয়সা অর্জন কর আর চার্চে দিয়ে দাও। এর ফলে আমি খৃষ্টান ধর্ম থেকে দূরে সরে যাই। এই জলসায় আমি এমন ধর্ম দেখেছি যা পুরো বিশ্বে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।   ”

গুয়েতামালার একজন বিচারক বলেন “এই জলসায় অংশগ্রহণ করে আমি নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান বলে মনে করছি। আমার মনে হয়েছে এই তিন দিনে আমি ইসলামিক শিক্ষার উপর ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি অর্জন করেছি। এখন আমি আমার দেশে ইসলামের শান্তিপূর্ণ শিক্ষা প্রচার করতে পারব। ”

হুজুর তাকে বলেন “আপনি একজন বিচারক। তাই মনে রাখবেন ইসলাম ন্যয়বিচার ও সৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার শিক্ষা দেয়। আপনার উচিৎ আপনার দেশের মানুষের মধ্যে এই স্পৃহা গড়ে তোলা যেন তারা সবসময় সত্যের পথে থাকে। এজন্য যদি তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেও সাক্ষ্য দিতে হয় তারা যেন তা দেয়। ”

একটি আফ্রিকান দেশ গিনি কোনাক্রি থেকে আগত একজন অতিথি বলেন “আমি হজ্জ্ব ও অন্যান্য ইসলামিক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। কিন্তু আমি বিনা দ্বিধায় বলতে পারি যে জলসা সালানার মতো আধ্যাত্মিক পরিবেশ আমি কোথাও দেখিনি। আমি দেখেছি যে ছোট ছোট বাচ্চারাও মুখে হাসি নিয়ে অন্যদের সাহায্য করছে। আমি আপনাকে কেবল আহমদীদের নেতা বলেই মনে করি না বরং ইসলামের নেতা বলে মনে করি। আমি নিশ্চিত যে আল্লাহর সাহায্য আপনার সাথে আছে। ”

হুজুর তাকে বলেন “প্রকৃত ইসলামের চেয়ে কোন কিছুই শান্তিপূর্ণ হতে পারে না। কিন্তু বেশিরভাগ মুসলমানই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ভুলে গিয়েছে। এর ফলে তারা বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় অশান্তির কারণ হচ্ছে। কিন্তু আমরা আহমদীরা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার অনুসরণ করি। এটি আমাদের আশা এবং আমরা দোয়া করি যেন বিশ্বের সকল মুসলমান শান্তির জন্য একসাথে কাজ করে।  ”

“এই বছর ব্রিটিশ পুলিশ জলসার নিরাপত্তার জন্য একজন নতুন ইন্সপেক্টরকে নিয়োগ দিয়েছেন। জলসার শেষ দিনে তিনি বলেন যে তিনি রিপোর্ট করবেন যে জলসাতে পুলিশের কোন প্রয়োজন নেই; কারণ জলসাতে সবকিছুই শান্তিপূর্ণ ও সকলেই বিনয়ী। এটিই প্রকৃত ইসলাম। ”

একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত

আমি জামাতের গেস্ট হাউজের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন একজন আহমদী মোবাশশের আরহমদ সাহেব(৫৪ বছর) আমার সাথে কথা বলতে আসেন। আমি তাকে গত কয়েক বছরে অনেক বার দেখেছি। কখনো তার হাতে ঝাড়ু ছিল আবার কখনো তিনি হয়ত মসজিদ প্রাঙ্গন পরিস্কার করছেন। কখনো তিনি নামাযের পূর্বে মসজিদে যায়নামাজ বিছাতেন এবং নামাযের পর সেগুলো গুছিয়ে রাখতেন। আমি যদিও তাকে অনেকবার দেখেছি কিন্তু তার সাথে আমার সেভাবে কথা হয়নি।

এবার তিনি আমাকে বলেন “আমি শুনেছি যে তুমি লিখে থাক এবং মানুষ তোমার লেখা পড়ে। আমি একজন নিরক্ষর মানুষ, আমি লিখতে ও পড়তে জানি না। হয়ত তুমি আমার জীবনের একটি ঘটনা লিখতে পারবে যেটি খিলাফতে আহমদীয়াতের সত্যতার প্রমাণ। ”

“২০০৬ সালে আমার একটি কন্যা সন্তান হয় এবং তার হাত স্হায়ীভাবে মুষ্টিবদ্ধ ছিল। আমরা এজন্য তাকে নিয়মিতভাবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। কিন্তু যখন তার বয়স ৯ মাস হয় ডাক্তার আমাদের এমন কথা বলে যেটি আমরা কখনো শুনতে চাইনি। ডাক্তার বলেন যে আমার মেয়ে কখনোই সুস্হ হবে না এবং সে কখনো কথা বলতে পারবে না; তার জীবনে আরো অনেক শারীরিক ও মানসিক সমস্যা থাকবে। ”

“আমরা কত সৌভাগ্যবান যে আমাদের খলীফা আমার মতো নিরক্ষর ও অধমের সাথেও দেখা করেন। তিনি তাদের সাথেও দেখা করেন যাদেরকে পুরো বিশ্বের মানুষ নিচু শ্রেণীর মানুষ বলে মনে করে। আমি হুজুরের সাথে দেখা করি ও সবকিছু বলি। হুজুর আমাকে এত সুন্দর কথা বলেন যেটি কেবল খিলাফতে ওয়াক্তই বলতে পারেন।

হুজুর বলেন ‘কোন চিন্তা করবেন না। ডাক্তাররা যাই বলুক না কেন তারা ভুল বলছে। তোমার মেয়ে একদম সুস্হ হয়ে যাবে’ ”

এসময় তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন ও তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন “যখন আমার মেয়ের বয়স ১৮ মাস হল তখন সে আমার সামনে বসে ছিল। আমি দেখলাম যে সে প্রথমবারের মতো তার নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলল। আমি আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি এটি একটি অলৌকিক ঘটনা এবং আমার খলীফার দোয়ার ফলাফল। আলহামদুলিল্লাহ আমার মেয়ের বয়স এখন ১১ বছর এবং ডাক্তারদের সকল কথা ভুল প্রমাণিত করে সে সুস্হ সবলভাবে বেড়ে উঠছে। আমি কসম খেয়ে বলছি এ পৃথিবীতে এমন কিছুই নেই যা খলীফাতুল মসীহর দোয়ার বরকতে লাভ করা যাবে না।  ”

এ কথা বলে মোবাশশের সাহেব তার পাশে থাকা ঝাড়ু তুলে নিলেন এবং মসজিদের প্রাঙ্গন পরিস্কার করতে লাগলেন। বর্তমানে আমি তাকে প্রায়ই দেখি এবং তখনই আমার তার কথাগুলো মনে পড়ে যায়।

আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলন

হুজুর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রায় ১৬ জন সাংবাদিকের সাথে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন।

মেক্সিকোর এক সাংবাদিক হুজুরকে প্রশ্ন করে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউএসএ-মেক্সিকো বর্ডারে দেয়াল তৈরীর কথা বলছেন সেটি কতটুক বাস্তবসম্মত।

হুজুর বলেন “এখানে কিছু চিন্তার বিষয় আছে যেমন মানবপাচার ও ড্রাগ চোরাচালান ইত্যাদি। কিন্তু একইসাথে এটিও মনে রাখতে হবে যে ইউএসএ ও মেক্সিকো প্রতিবেশী দেশ। তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বহু দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হবে। তাই এভাব দেয়াল তৈরী করে দেয়া সঠিক নয়। বরং সরকারদের এটি নিশ্চিত করা উচিৎ যে বর্ডার চেকিং যেন ভালমতো করা হয় এবং সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে যেন বন্ধ করা যায়। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে একে অপরের প্রতি সম্মান রেখে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যেতে হবে।  ”

রুয়ান্ডার এক সাংবাদিক হুজুরকে বলেন “আমি ইউকের জামেআ আহমদীয়া দেখেছি এবং সেখানে কিছু ছাত্রের সাথে কথা বলেছি যারা মোবাল্লেগ হবার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। মোবাল্লেগ হিসেবে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেবার ফলে কি তাদের প্রতিভাকে বাধাগ্রস্হ করা হচ্ছেনা?  ”

হুজুর বলেন “জামাত কাউকে জামেআতে ভর্তি হবার জন্য জোর করে না। ছাত্ররা তাদের নিজেদের ইচ্ছায় এখানে ভর্তি হয়েছে। বেশিরভাগ আহমদী তরুণ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে এবং বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। কেবল ১৩০ জন ছাত্র জামেআতে মোবাল্লেগ হবার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ”

“আপনি সাংবাদিকতা পেশা বেছে নিয়েছেন এবং আহমদীদের মধ্যেও সাংবাদিক রয়েছেন। কিন্তু একজন আহমদী তরুণ যদি নিজেকে ধর্মের জন্য উৎসর্গ করতে চায় এবং মোবাল্লেগ হতে চায় তাহলে সেটিও তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তাদেরকে কোন কিছুতেই বাধ্য করা হচ্ছে না। ”

বেনিনের একজন মহিলা সাংবাদিক বলেন যে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় মহিলাদের ভূমিকা কি?

হুজুর বলেন “আমি মহিলাদের দেশ গড়ার কারিগর বলে মনে করি। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি তারা করতে পারে তাদের সন্তানদের সঠিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে। এভাবে মহিলারা তাদের সন্তানদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেয়। ”

একজন প্রবীণ আহমদীর ভাবনা

রাবওয়ার মোবাশশের কাহলন সাহেব (৬৬ বছর) আহমদীদের মধ্যে একটি পরিচিত মুখ। তিনি মুফতি সিলসিলাহ তে অনেক বছর কাজ করেছেন। আমাকে স্বীকার করতে হবে যে আমি মুফতি সিলসিলাহর কাজ সম্বন্ধে এতটা জানতাম না। তাই জলসার এক সপ্তাহ পরে আমি তাকে তার কাজ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করি।

তিনি আমাকে বলেন “ধর্মের দুইটি শাখা রয়েছে। একটি হল ‘কালাম’ যার কাজ হল ধর্মের সত্যতা প্রমাণ করা। অন্য শাখা হল ‘ফিকাহ’ যার কাজ হল দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন বিষয়াবলীর ইসলামী নিয়মনীতি ব্যাখা করা। মুফতি হল একজন বিচারক যিনি ফিকাহ সম্বন্ধে ফতোয়া দিতে পারেন।”

“মানুষ ফতোয়া বলতে অন্য কিছু মনে করে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর অর্থ হল ‘উত্তর’ এবং মুফতি হল সেই ব্যক্তি যিনি বিভিন্ন দৈনন্দিন বিষয়ের ইসলামিক উত্তর প্রদান করেন। আমাদের জামাতে প্রকৃতপক্ষে একজনই মুফতি রয়েছেন যিনি হলেন আমাদের খলীফা। তাকে বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য ও গবেষণা করার জন্য হযরত মুসলেহ মাউদ(রাঃ) মুফতি সিলসিলাহ গঠন করেন। কিন্তু খলীফাতুল মসীহ মুফতির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য নন। আমরা কেবল তাকে আমাদের মতামত জানাতে পারি। তিনি যদি মনে করেন তাহলে সেটি গ্রহণ করবেন বা বর্জন করবেন।   ”

খিলাফতের পূর্বে হুজুর সম্বন্ধে তিনি বলেন “খিলাফতের পূর্বে হুজুর অনেক কম কথা বলতেন। আমি লক্ষ্য করেছি যে হুজুরের প্রধান লক্ষ্য ছিল দোয়া। প্রত্যেক বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে হুজুর আল্লাহর কাছে মাথা নত করে দোয়া করতেন। ”

“খিলাফতের পূর্বে আমি বুঝতেই পারিনি যে হুজুরের এতটা ধর্মীয় জ্ঞান রয়েছে। এটি তার বিনয়ের একটি উদাহরণ। তিনি কখনো তার জ্ঞানকে জাহির করতেন না। মাঝে মাঝে হুজুর আমাদের কোন বিষয়ের রেফারেন্স খুজে বের করতে বলতেন। আমরা চেষ্টা করতাম কিন্তু খুজে পেতাম না তখন হুজুরের আর একটি বার্তা আসত যেখানে লেখা থাকত যে রেফারেন্সটি কোন বই এর কত নাম্বার পাতায় লেখা আছে। এতে বোঝা যায় হুজুর কতটা গভীরভাবে এসব বই অধ্যয়ন করেছেন। ”

ইউকে জলসা সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমার মতে একজন আহমদীর প্রধান অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ ইউকে জলসাতে অংশগ্রহণ করা। কারণ খলীফাতুল মসীহ এখানে রয়েছেন। তার সাথে আল্লাহপাক সরাসরি কথা বলেন। তাই তার উপস্হিতি এই জলসাকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়।  ”

“সূরা আল নাহলে এ আল্লাহপাক বলেছেন যে তিনি মৌমাছিকে ওহীর মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছেন। তার মানে মৌমাছিও আল্লাহপাকের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। এর ফলশ্রুতিতে মৌমাছি মধু তৈরী করে যাকে সকল রোগের ঔষুধ বলে মনে করা হয়। মৌমাছির এই ক্ষমতা আল্লাহর ওহীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের খলীফা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে নেক মানুষ যাকে আল্লাহপাক সরাসরি দিক নির্দেশনা দেন। তাহলে আমরা কল্পনাও করতে পারবনা যে খলীফার সাথে কি পরিমাণ বরকত রয়েছে। ”

আমি শুনেছি যে মোবাশশের সাহেব মসীহ মাউদ(আঃ) এর বই এতবার পড়েছেন যে অনেক অংশ তিনি মুখস্হ করে ফেলেছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি যে এখনো কি তিনি এভাবে পড়ার সময় পান কিনা?

তিনি বলেন “আমি যখন জামেআতে পড়ি তখন থেকেই আমার অভ্যাস হল প্রতি নামাযের পর কোরআন তিলাওয়াত বা অন্য কোন ধর্মীয় বই পড়া। আমি নামাযের পর আমার বুকশেলফ থেকে বই নিয়ে প্রায় এক ঘন্টা বই পড়ি।  ”

মেক্সিকো প্রতিনিধি

২ আগস্ট ২০১৭ তারিখ হুজুর মেক্সিকো থেকে আগত কিছু বয়াতকারী আহমদীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাদের সকলকে উপহার প্রদান করেন, তাদের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে জানতে চান এবং তারা কোন অসুবিধার মধ্যে আছে কিনা সে ব্যাপারে খোজ খবর নেন।

সেখানে খুবই সুঠাম দেহের অধিকারী একজন আহমদীকে হুজুর বলেন “আপনি অনেক শক্তিশালী ও সুস্বাহ্যের অধিকারী কিন্তু আমাদের মোবাল্লেগগণ অত্যন্ত চিকন! তাই আমার মনে হয় মোবাল্লেগদের আর একটু বেশী খাবার খাওয়া উচিৎ। ”

প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন তরুণ খুবই হাসিখুশি ছিলেন । সে হুজুরের অফিসের চারপাশ দেখছিল এবং ছোট বাচ্চার মতো হাসিখুশি ছিল। হুজুরও তার এই হাসিখুশি মনোভাব পছন্দ করেন। পরবর্তীতে গ্রুপ ছবি তোলার সময় হুজুর জামাতের মোবাল্লেগ সাহেবকে বলেন “এটি খুবই ভাল যে আপনাদের হাসিখুশি রাখার জন্য আপনাদের মধ্যে একজন প্রফুল্লচিত্তের মানুষ রয়েছে।”

তু্র্কমেনিস্তানের একজন বয়াতকারী আহমদী

হুজুর তু্র্কমেনিস্তানের একজন বয়াতকারী আহমদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন যিনি তার দেশের একজন প্রসিদ্ধ লেখক এবং সাবেক সাংবাদিক। তিনি হুজুরকে বলেন “আমি এ জলসায় আহমদীয়াত গ্রহণ করেছি এবং আন্তর্জাতিক বয়াতে অংশগ্রহণ করেছি। জলসায় উপস্হিত সকল আহমদীই অত্যন্ত আন্তরিক এবং এটি আমার খুবই ভাল লেগেছে। এখানে হাজার হাজার অতিথি আছে কিন্তু তারপরও আমার সাথে এমন ব্যবহার করা হয়েছে যেন আমি কোন বিশেষ ব্যক্তিত্ব। এমন আতিথেয়তা পেয়ে আমি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। আমার মনে হয়েছে এরকম আতিথেয়তার স্পৃহা মহানবী(সাঃ) এর সাহাবীগণ প্রদর্শন করতেন। আমি নিশ্চিত যে আহমদীদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছে যারা অতিথিদের খাবার দেবার জন্য নিজের সন্তানদেরও অভুক্ত রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিবে যেমনটি মহানবী(সাঃ) এর সময় তার সাহাবীরা করেছিলেন।  ”

“হুজুর আপনি জলসার কিছুদিন পূর্বে জামেআ পরিদর্শনের জন্য এসেছিলেন। সেখানে আমি প্রথমবারের মতো আপনাকে দেখি এবং আমার পুরো শরীরে একপ্রকার বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় যেটি আমি পূর্বে কখনো অনুভব করিনি। আমার মনে হল যে আমার হয়ত জ্বর এসেছে কিন্তু পরক্ষণেই আমি বুঝতে পারি যে এটি হল খিলাফতের প্রতি আমার ভালবাসা। সেদিন থেকে যখনই আমি জলসাতে আপনাকে দেখেছি, আপনার পিছনে নামায আদায় করেছি এবং আপনি যখনই তিলাওয়াত করতেন তখন আপনার সুন্দর কন্ঠস্বর শুনে আমার হৃদয় বিগলিত হয়ে যেত। ”

“আমার পিতার মৃত্যুর সময়ও আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরেনি, তখন আমি আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি যখন আন্তর্জাতিক বয়াতে অংশগ্রহণ করি তখন আমি আমার চোখের অশ্রুকে নিয়ন্ত্রন করতে পারিনি। আমি কসম খেয়ে বলছি যে আমি সেইরকম অনুভূতি পূর্বে কখনো অনুভব করিনি। ”

হুজুর তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন “একজন প্রকৃত মুসলিম তখনই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে যখন সে দেখবে যে মহানবী (সাঃ) কে পুরো বিশ্ব কিভাবে দেখছে। যিনি সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ, যিনি সবচেয়ে পবিত্র মানুষ তাকে অনেকেই সবচেয়ে নিষ্ঠুর মানুষ বলে মনে করে। তাই আমাদের পুরো বিশ্বের সামনে মহানবী(সাঃ) এর প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরতে হবে। আমাদের আল্লাহপাকের কাছে মাথা নত করে চোখের পানি ফেলে দোয়া করতে হবে যেন বিশ্ববাসী ইসলাম ও মহানবী(সাঃ) এর প্রকৃত মর্যাদা বুঝতে পারে। যিনি সকল মানবজাতির জন্য দয়ার সাগর ছিলেন।  ”

দিকনির্দেশনা

হুজুর কাজাখাস্তানের কিছু প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎ করেন। সে সময় সেখানকার লাজনার সদর সাহিবা বলেন “হুজুর আমি যখন গর্ভবতী ছিলাম তখন আপনাকে চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ করেছিলাম যেন আমাদের বাচ্চাকে সন্তানকে ওয়াকফে নও তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উত্তরে আপনি আমাদের বাচ্চার জন্য সাফীর নাম দিয়েছিলেন। সে সময় আমরা জানতাম না যে আমাদের ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে। কিন্তু আপনি কেবল ছেলের নাম দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে আমাদের ছেলেই হয়েছিল। আপনি কিভাবে জানলেন? এটি আমার জন্য একটি অলৌকিক বিষয়। ”

হুজুর বলেন “আমি নিজেও জানি না। এটি আল্লাহর সিদ্ধান্ত। সাধারণত আমি দুইটি নাম পাঠিয়ে থাকি একটি ছেলের ও একটি মেয়ের। কিন্তু মাঝে মাঝে আমি কেবল একটি নাম পাঠাই কারণ আল্লাহপাক আমাকে সেভাবেই নির্দেশনা দেন। মাঝেমধ্যে আল্লাহপাক এরকম জিনিস দেখিয়ে থাকেন যেন আমাদের ঈমান দৃঢ় হয়। এখন আপনার দায়িত্ব আরো কঠোর পরিশ্রম করে আপনার দেশে ইসলামের প্রকৃত বাণী প্রচার করা। ”

নাইজেরিয়ার প্রতিনিধি

নাইজেরিয়ার প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রায় ১৫ জন আহমদী নারী-পুরুষ ও নাইজেরিয়ার আমীর সাহেব ছিলেন। একজন হুজুরকে জানায় যে সে নাইজেরিয়ার প্রথম আহমদী যিনি সেখানকার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

হুজুর বলেন “মাশাল্লাহ, আল্লাহপাক আপনাকে বরকত দান করুন। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনার উচিৎ নাইজেরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতি গুরুত্ব দেয়া। এজন্য বাইরের দেশে তেল পরিশোধনের জন্য না পাঠিয়ে আপনার দেশের পুরনো তেল পরিশোধনাগার গুলোর সংস্কার করুন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করুন এবং আপনার দেশের সম্পদ যেন দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয় সেটি নিশ্চিত করুন। এটিই হল আপনার প্রতি আমার কাজ। ”

নাইজেরিয়ার আমীর সাহেব বলেন “আমি নাইজেরিয়ার জামাতের সদস্যদের বলেছি যে হুজুর সরকারের আমন্ত্রণ ছাড়া নাইজেরিয়া সফরে আসবেন না। ”

হুজুর বলেন “এটি আপনার শর্ত হতে পারে কিন্তু আমার এরকম কোন শর্ত নেই। আমার সরকারী সফরে যাবার কোন ইচ্ছা নেই। আমার একমাত্র শর্ত হল জামাত যেন ধার্মিকতায় উন্নতি করে এবং দোয়া করে যেন নাইজেরিয়ার সরকার বোকো হারাম ও অন্যান্য সন্ত্রাসী দলকে নির্মূল করতে পারে। ”

দিনের পরবর্তী সময়ে হুজুর ৮০ টিরও বেশি আহমদী পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন যাদের মধ্যে ৪ সদস্যের লাজনাদের একটি দল ছিল যারা সিঙ্গাপুর থেকে জলসায় অংশগ্রহণ করতে এসেছে। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর তারা খুবই আনন্দিত ছিল। সকলেই আমাকে বলেন যে হুজুরকে সিঙ্গাপুর সফরের জন্য অনুরোধ করতে। আমি তাদের অনুরোধ হুজুরের কাছে পৌছে দেই।

হুজুর তখন আমাকে বলেন “আমার সিঙ্গাপুর অনেক পছন্দ হয়েছে এবং সেখানকার জামাতও অনেক আন্তরিক।”

 

 

 

আহমদীদের আবেগ

৩ আগস্ট ২০১৭ তারিখে হুজুর আরো কিছু আহমদী পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে পাকিস্তানের শিয়ালকোটের মির্যা উসমান বেগ (৩২ বছর) ছিলেন যিনি বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছেন। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর আমি তার সাথে কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন “হুজুর সকল বিষয়েই আমাদের জন্য আদর্শ। তাকে দেখে আমাদের ভিতরে আরো উন্নত ও ভাল মানুষ হবার একটি অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়। তার সাথে দেখা করে আমি বুঝতে পেরেছি যে আমি খলীফার যত কাছে থাকতে পারব আমার জন্য ততই মঙ্গলজনক হবে।  ”

আমি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত মোহাম্মদ রফি(৩১ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “আমি ২০১৫ সালে আহমদীয়াত গ্রহণ করি। পূর্বে আমি ওহাবী মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম। কলেজে থাকার সময় থেকেই আমি আহমদীদের চিনতাম। যদিও মানুষ তাদের সম্বন্ধে অনেক নেতিবাচক কথা বলত কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম যে তাদের নৈতিক চরিত্র অন্যান্য মুসলমানের চেয়ে অনেক উন্নত। কিন্তু আমি বয়াত করতে ভয় পাচ্ছিলাম কারণ এটি একটি জীবন পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্ত। তাই আমি অনেকদিন অপেক্ষা করেছি। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম যে বয়াত করার মধ্যেই বরকত নিহিত। বয়াতের দুই বছর পর আমার জীবন পুরো পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আমি মনে করি এখন আমি আল্লাহপাকের আরো নিকটবর্তী।  ”

 

আবেগপ্রবণ বক্তব্য

৪ আগস্ট ২০১৭ তারিখে হুজুর বায়তু্ল ফুতুহ মসজিদে জুমার খুৎবা প্রদান করেন। খুৎবায় হুজুর জলসার বরকত ও জলসায় আগত বিভিন্ন অতিথিদের মন্তব্য উল্লেখ করেন।

হুজুর বলেন “সংবাদ মাধ্যম আমাদের জলসার ভাল সম্প্রচার করেছে তাই ইসলামের প্রকৃত বার্তা অনেক মানুষের কাছে পৌছেছে। এজন্য আমাদের আল্লাহপাকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এগুলো সবই আল্লাহপাকের বরকতের ফলাফল। সে তুলনায় আমাদের প্রচেষ্টা অত্যন্ত সামান্য, কিন্তু তারপরও আমি তাদের কাজের জন্য প্রেস ও মিডিয়ার সকল সদস্যদের ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহ তাদের সকলকে পুরস্কৃত করুন। ”

জুমআর নামাযের পর হুজুর তার অফিসে এক নতুন দম্পতির সাথে তাদের পরিবার সহ সাক্ষাৎ করেন যারা সেদিনই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। হুজুর যেহেতু বিবাহে যেতে পারছেন না তাই তিনি সেখানেই তাদের জন্য দোয়া করেন।

জামাত কর্মকর্তা ও মোবাল্লেগদের সাথে মিটিং

বিকেলে হুজুর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রায় শতাধিক জামাত কর্মকর্তা ও মোবাল্লেগদের সাথে মিটিং করেন। হুজুর উপস্হিত সকলের কাছ থেকে তাদের কার্যকর্মের রিপোর্ট নেন এবং আগামী বছরের জন্য তাদের পরিকল্পনা জানতে চান। তারা হুজুরের কাছে বিভিন্ন বিষয়ের দিক নির্দেশনা চায় এবং দোয়ার জন্য আবেদন করে। হুজুর আফ্রিকান জামাতের কর্মকর্তাদের সাথে অনেক সময় নিয়ে কথা বলেন। সেখানে বর্তমানে অনেক বয়াত হচ্ছে। হুজুর প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করেন যে নতুন আহমদীদের তারা কিভাবে তরবিয়ত করছে। হুজুর বলেন “আপনাদের উচিৎ নতুন বয়াতকারী আহমদীকে তাহরীকের জাদীদ ও ওয়াকফে জাদীদে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করা। কারণ এটি তরবিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। আত্মত্যাগের স্পৃহাকে অবহেলা করবেন না। আমি দেখেছি যে নিতান্ত গরীব ব্যক্তিও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে যখন তার মনোযোগ সেদিক নিবদ্ধ করা হয়। দরিদ্রদের সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু একই সাথে তাদের মাঝে আত্মত্যাগের অভ্যাস সৃষ্টি করাও জরুরী। তাই যদি তারা এক পয়সাও দান করে তাহলেই চলবে। মূল কথা হল তাহরীকে জাদীদ ও ওয়াকফে জাদীদের অংশ হওয়া।  ”

“আমি আপনাদের কাছ থেকে কেবল সংখ্যা জানতে চাই না; যে আপনারা কয়জনের বয়াত নিয়েছেন এবং কত চাঁদা সংগ্রহ করেছেন। আমার মূল চিন্তা হল জামাতের সদস্যদের তরবিয়ত ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। আমাদের মোবাল্লেগদের উচিৎ নিয়মিতভাবে বিভিন্ন গ্রামে সফর করে আহমদীদের সাথে দেখা করা, তাদের দিকনির্দেশনা প্রদান করা ও তাদের সাহায্য করা। ”

 

“প্রত্যেক জামাতের উচিৎ জামাতে নামায আদায়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্হান নির্ধারণ করা। যদি কোন স্হান নির্মাণ করা সম্ভব না হয় তাহলে কারো বাসায় একত্র হয়ে জামাতে নামায আদায় করা উচিৎ। ”

হুজুর ২০১৬ সালে কঙ্গোর জামাতকে বলেছিলেন যে সেখানকার পিগমীদের সাহায্য করতে। কারণ তাদেরকে প্রায়ই নিচু চোখে দেখা হয়। সেখানকার মোবাল্লেগ সাহেব বলেন যে গত বছর ৭৫ জন পিগমী আহমদীয়াত গ্রহণ করেছেন যার মধ্যে একজন গোত্র প্রধানও রয়েছেন।

হুজুর তাকে বলেন “আমাদের উচিৎ পিগমীদের শিক্ষা প্রদানের জন্য একটি স্কুল নির্মাণ করা। ”

মিটিং এর পরবর্তী অংশে হুজুর তবলীগের উপর গুরুত্ব দেন। হুজুর বলেন “তবলীগ করার জন্য প্রজ্ঞা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্হানে বা একটি দেশে যেভাবে তবলীগ করা হয় অন্য দেশ বা স্হানে হয়তবা সেই পদ্ধতি কার্যকর হবে না। তাই প্রতিটি জামাতের উচিৎ নিজেদের স্হানীয় মানুষের চরিত্র অনুযায়ী তবলীগের পরিকল্পনা করা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রচারের জন্য ও মিথ্যা অপবাদের জবাব দেবার জন্য ব্যবহার করুন। ”

ইউএসএর একজন তরুণ মোবাল্লেগ বলেন “ইউএসএ জামাত সামাজিক মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সরাসরি সম্প্রচারের ফলে আফগানিস্তানের ১০ জন মানুষ বয়াত করেছে। ”

হুজুর তাকে বলেন “এটি ভাল কথা কিন্তু আপনি যেখানে কর্মরত আছেন সেখানকার অর্থাৎ আমেরিকার মানুষের প্রতি প্রথমে গুরুত্ব দেয়া উচিৎ ।”

অনুবাদের কাজে নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা জানান যে হুজুরের বই World Crisis : Pathway to Peace এখনো অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়নি।

হুজুর বলেন “প্রতিটি ভাষায় অনুবাদ করার কোন প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন অনুযায়ী পরবর্তীতে নির্ধারণ করা হবে যে এখন কোন ভাষায় অনুবাদ করা উচিৎ। একমাত্র একটি বই সকল ভাষায় অনুবাদ করা প্রয়োজন; সেটি হল ‘পবিত্র কোরআন’ ।”

মিটিং এর শেষ দিকে হুজুর ওয়াকফে নও সম্বন্ধে বলেন “ওয়াকফে নও ছেলেদের উচিৎ বেশি সংখ্যক যেন তাদের স্হানীয় জামেআতে মোবাল্লেগ হিসেবে ভর্তি হয়। জামাতের ভবিষ্যৎ ও প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর জামাতকে ছড়িয়ে দেবার জন্য আমাদের বিশ্বের সকল স্হানেই মোবাল্লেগ প্রয়োজন।  ”

 

বলিভিয়ার সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎকার

৫ আগস্ট ২০১৭ তারিখে বলিভিয়ার একজন সাংবাদিক হুজুরকে তার পরিবার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে।

হুজুর তাকে বলেন “আমি বিবাহিত এবং আল্লাহর রহমতে আমার দুইজন সন্তান ও পাঁচজন নাতী-নাতনী রয়েছে। তাদের সাথে সময় কাটাতে আমার খুবই আনন্দ লাগে। আমি যখন লন্ডনে থাকি তখন খাবার খাওয়ার সময় অথবা বিকেলে চা পানের সময় তাদের সাথে কয়েক মিনিট সময় কাটানোর সুযোগ পাই। কিন্তু জামাতের প্রতি আমার দায়িত্ব রয়েছে তাই এর চেয়ে বেশি সময় আমি দিতে পারি না। ”

ব্যক্তিগতভাবে আমি যদি একদিন আমার সন্তানদের না দেখি তাহলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু হুজুরের জন্য এই বিচ্ছেদ দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে গিয়েছে।

সাংবাদিক হুজুরের কাছে ইসলামের সাথে অন্যান্য ধর্মের সম্পর্ক জানতে চান?

হুজুর বলেন “আমার মনে হয় ইসলামের বিরোধিতার মূল হল যে ইসলাম দাবি করে এটি একটি সম্পূর্ণ ও সার্বজনীন ধর্ম। আমরা দাবি করি যে কেবল কোরআনই একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যাতে কোনপ্রকার বিচ্যুতি আসেনি। এই বক্তব্য অন্য ধর্মের অনুসারীদের চিন্তিত করে তুলে। কারণ তারা বুঝতে পারে যে ইসলামের পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।  ”

“বর্তমানে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে যারা ধার্মিক নয় এবং কেবল বস্তুবাদিতা নিয়েই ব্যস্ত। তারা ইসলামের প্রসারকে অন্য ধর্মের প্রসারের চেয়ে বেশি ভয় পায়। ইসলাম বলে যে ধর্মে কোন প্রকার বলপ্রয়োগ নেই। ইসলাম এটিও বলে যে সত্য ও মিথ্যা এখন পরিস্কার হয়ে গিয়েছে তাই আমরা আমাদের বাণী শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার করে যাব।  ”

প্যারাগুয়ে, কঙ্গো, ক্যাম্বোডিয়া ও ইতালীর প্রতিনিধি

কঙ্গোর প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন মন্ত্রী ছিলেন যিনি পূর্বে খৃষ্টান ছিলেন এবং বর্তমানে আহমদীয়াত গ্রহণ করেছেন। তিনি হুজুরকে বলেন “আমি এই জলসা কখনো ভুলতে পারব না কারণ আমি সবদিকেই ভালবাসা দেখতে পেয়েছি। যেভাবে সকলে তাদের দায়িত্ব পালন করছিল যাদের মধ্যে ছোট ছোট বাচ্চারাও ছিল; এতে আমি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছি। ”

“হুজুর, সবকিছু নিরাপদে শেষ হয়েছে দেখে আমি আশ্বস্ত হয়েছি। কারণ আপনি আপনার বক্তব্যে মাঝেমধ্যে শক্তিশালী দেশের গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন। তাই আমি চিন্তিত ছিলাম যে তারা আপনাকে বা এই জলসায় আক্রমন করতে পারে। ”

হুজুর তাকে বলেন “যদি আপনি সত্য কথা বলতে চান তাহলে সাহসের সাথে কোনরকম ভয় না পেয়ে বলতে হবে।”

মন্ত্রী সাহেব তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য হুজুরের কাছ থেকে উপদেশ চান। হুজুর তাকে বলেন “সবসময় নিজেকে দেশের সেবক বলে মনে করবেন। কারণ মহানবী(সাঃ) আমাদের শিখিয়েছেন যে দেশের নেতাদের এরকমই হওয়া উচিৎ। জনগণের দুঃখ-কষ্ট আপনাকে বুঝতে হবে, আপনার উচিৎ তাদেরকে ভালবাসা ও তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখা।  ”

মিটিং এর শেষে তিনি হুজুরকে কিছু অর্থ উপহার হিসেবে দিতে চান। হুজুর সাথেসাথেই তা ফিরিয়ে দেন ও বলেন “এই অর্থ আপনার দেশের মানুষের উপকারের জন্য ব্যয় করুন। আপনি কোন মানবসেবামূলক সংগঠনকেও দান করতে পারেন। ”

মিটিং এ ক্যাম্বোডিয়ার একজন অতিথি বলেন “আমি এই জলসায় অসাধারণ কিছু পাইনি। কিন্তু তারপরও আমাকে স্বীকার করতে হচ্ছে যে আমি কখনো এরকম শৃঙ্খলাপূর্ণ সমাবেশ দেখিনি। যেখানে এত মানুষকে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে এবং সকলেই ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছে।  ”

হুজুর হাসেন ও বলেন “একদিকে আপনি বলছেন যে জলসায় অসাধারণ কিছু দেখতে পাননি আবার আর একদিকে বলছেন যে এইরকম শৃঙ্খলা পূর্বে কখনো দেখেননি। ”

মিটিং এ হুজুর ইতালী থেকে আগত অতিথিদের সাথে কথা বলেন। সেখানে একজন ইতালিয়ান ছিল যিনি এই জলসায় বয়াত গ্রহণ করেছেন। হুজুর তাকে বলেন যে তার সূরা ফাতিহা শেখা উচিৎ এবং হুজুর সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করেন। এরপর হুজুর বলেন “মহানবী(সাঃ) বলেছেন সূরা ফাতিহা ছাড়া নামায অর্থহীন, তাই আপনার যত দ্রুত সম্ভব সূরা ফাতিহা শিখে ফেলা উচিৎ ।  ”

 

গাম্বিয়া, মিশর, উগান্ডা, জিম্বাবুয়ে, ঘানা ও আফ্রিকান প্রতিনিধি

গাম্বিয়ার আমীর সাহেব বলেন “হুজুর, আপনার দোয়ার বরকতে এই বছর আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, সন্তুষ্ট এবং মুখে হাসি নিয়ে এখানে এসেছি। ”

হুজুর বলেন “আল্লাহর অশেষ রহমতে গাম্বিয়াতে নতুন সরকার গঠন হয়েছে এবং আহমদীদের উপর অত্যাচারের সময় শেষ হয়েছে। আপনারা অনেক বছর ধরে কষ্ট করেছেন, অনেক আহমদীর উপর পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। এজন্য আপনাদের আল্লাহপাকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ এবং দোয়া করা উচিৎ যেন ভবিষ্যতেও পরিস্হিতি আহমদীদের অনুকূলে থাকে।   ”

মিশরের আকজন আহমদী খালিদ সাহেব বলেন “হুজুর, আমি আপনাকে বলতে চাই যে মিশর জামাত খলীফাতুল মসীহর প্রতি অনেক ভালবাসা রাখে। মহানবী(সাঃ) শিখিয়েছেন যে যদি হৃদয় পরিস্কার থাকে তাহলে শরীরও ভাল থাকবে। মানুষ বলে থাকে যে মিশর হল পৃথিবীর হৃদয় তাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ”

হুজুর অত্যন্ত ভালবাসার সাথে বলেন “আমার জন্য মিশরের হৃদয় হল সেখানকার আহমদীগণ। তাই আমি কমপক্ষে এটি চাই যে মিশরের জামাত যেন পবিত্র ও ধার্মিক হয়। আমি এমন রিপোর্ট শুনতে চাই না যে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ”

মিশরের আর একজন আহমদী ফেইথ বলেন “আমার মতে এই জলসা সালানা ইসলামের পক্ষে একটি আধ্যাত্মিক যুদ্ধ। আমাদের অস্ত্র হল আমাদের কলম, দোয়া এবং খলীফাতুল মসীহর প্রজ্ঞা। যার মাধ্যমে তিনি পুরো বিশ্বের মানুষের হৃদয়কে জয় করে চলেছেন। ”

মিশরের একজন আহমদী মহিলা জানতে চান যে মিশরের মহিলারা কিভাবে ইসলামের বাণী প্রচারে সহযোগিতা করতে পারে। হুজুর বলেন “সমাজ থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে ফেলবেন না। বরং মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখুন এবং তাদেরকে বলুন যে মহানবী(সাঃ) এর প্রতি আপনার কি গভীর ভালবাসা রয়েছে। তাদের সাথে সাক্ষাৎ করুন এবং মহানবী(সাঃ) এর পবিত্র চরিত্র নিয়ে আলোচনা করুন। কিন্তু সবসময় প্রজ্ঞার সাথে তবলীগ করবেন। তাই প্রথমে আপনার বন্ধু ও কাছের মানুষকেই তবলীগ করুন।  ”

 

ঘানার একজন আহমদী পুলিশকে হুজুর বলেন “আহমদী পুলিশের সততা ও ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্হাপন করা উচিৎ। কখনো কোনরকম দুর্নীতিতে জড়িত হবেন না। ”

এ্কজন আহমদী হুজুরকে বলেন “অনেক বছর পূর্বে আপনি আমার মেয়েকে একটি কলম উপহার দিয়েছিলেন এবং দোয়া করেছিলেন যেন সে পড়ালেখায় উন্নতি করে। হুজুর আপনার দোয়ার বরকতে সে পড়ালেখায় অনেক ভাল করেছে এবং বর্তমানে সে একজন ডাক্তার।  ”

ঘানার জামাতের রিশতানাতা সেক্রেটারী সাহেব হুজুরকে বলেন যে তার দুইটি স্ত্রী রয়েছে। হুজুর তাকে বলেন “আপনি কি কেবল নিজের জন্যই বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসেন নাকি অন্যদের জন্যও উপযুক্ত প্রস্তাব আনেন! ”

হুজুরের কথা শুনে রুমের সকলেই হেসে ফেলে।

মিটিং এর শেষে ঘানার একজন আহমদী বলেন যে এ বছর অনেক আহমদী জলসায় আসতে পারেনি কারণ তাদেরকে ভিসা দেয়া হয়নি। হুজুর বলেন “আমরা দোয়া করতে পারি যেন ভবিষ্যতে তাদেরকে ভিসা দেয়া হয়। যদি আমার হাতে ক্ষমতা থাকত তাহলে আমি ঘানার প্রত্যেক আহমদীকেই ভিসা দিতাম। ”

 

 

দোয়ার বরকত

জলসার পর রবিবার ৬ আগস্ট ২০১৭ তারিখে হুজুর ইউকে প্যান আফ্রিকান মুসলিম এসোসিয়েশন(PAAMA) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে যান। বিভিন্ন দেশের অবস্হিত আহমদী গণ যারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন তারাই এই সংগঠনের সদস্য। তাদের সংগঠক আহমদ কোনাড়ু (৪২ বছর) আমাকে বলেন “হুজুর অনুগ্রহ করে আমাদের সাথে অংশগ্রহণ করায় আমাদের সদস্যদের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাকে আল্লাহপাক খলীফা হিসেবে নির্বাচন করেছেন তাই তার উপস্হিতি আমাদের আরো ভাল মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করে। ”

“কিছু আহমদী রয়েছে যারা জামাত থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছে। কিন্তু যখন তারা হুজুরকে দেখে ও তার বক্তব্য শুনে তখন তাদের সকল চিন্তা ও ভুল ধারণা সাথেসাথেই দূর হয়ে যায়। বরং তখন তাদের নিজেদের ধর্মের জন্য গর্ববোধ হয়। তাই এই আয়োজন কেবল দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য নয় বরং এটি আমাদের ঈমানকে আরো দৃঢ় করে।  ”

“আমি নিজেই প্রমাণ পেয়েছি যে আল্লাহপাক সবসময় খলীফার সাথে থাকেন এবং তার দোয়া কবুল করেন। আমি ৮ বছর যাবৎ মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়ার রিজিওনাল কায়েদ হিসেবে কাজ করেছি। সেসময় আমি স্কটল্যান্ড এলাকায় জামাতের উন্নতির জন্য চেষ্টা করেছি। আমি চাইতাম খোদ্দামদের জন্য নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গড়ে তুলতে। তাই আমি চেষ্টা করতাম আমার সন্তানরা যেন প্রতিদিন ফযর ও এশার নামায জামাতে আদায় করে এবং জামাতের সকল কর্মকান্ডে অংশ নেয়। ”

“কিন্তু কায়েদ হিসেবে ৮ বছরের মেয়াদ শেষ হবার পর আমার দুঃখ হতে লাগল। কারণ এখন আমি আর ইজতেমাতে আমার খলীফার সাথে হাত মেলানোর সুযোগ পাব না। কারণ আমাদের স্কটল্যান্ড মজলিস এবার কোন পুরস্কারই জিততে পারেনি। তাই ২০১৫ সালে খোদ্দাম ইজতেমার তাহাজ্জুদের সময় আমি আল্লাহর কাছে কেঁদে দোয়া করি ও ক্ষমা প্রার্থনা করি, কারণ আমি আমার মজলিসের জন্য ভাল কাজ করতে পারিনি। আমি দোয়া করি যে আমার একটি কাজও যদি আল্লাহপাকের পছন্দ হয় তাহলে আমি যেন আমার প্রিয় খলীফার সাথে হাত মেলানোর সুযোগ পাই। যাকে আল্লাহপাক সবচাইতে বেশি ভালবাসেন। এই দোয়া আমি ও আল্লাহপাক ছাড়া আর কেউই জানত না। ”

“আমি ইজতেমার সময় বারবার এই দোয়াই করতে থাকি। কিন্তু ইজতেমা শেষ হয়ে গেল এবং আমি আমার হুজুরের সাথে হাত মেলানোর কোন সুযোগ পেলাম না। তাই আমি অত্যন্ত দুঃখিত ছিলাম। আমি স্কটল্যান্ডের খোদ্দামদের একত্রিত করা শুরু করলাম কারণ আমাদের এখন সেখানে ফিরে যেতে হবে। আমাদের সফর শুরু করার পূর্বে আমি বাথরুমে যাচ্ছিলাম তখনই ন্যাশনাল আমেলার একজন সদস্য আমাকে এসে বলল যে হুজুর ইজতেমার স্হান পরিদর্শন করছেন। আমি তখনই সেখানে যাই এবং এক কোনায় দাড়িয়ে থাকি। আমার ও হুজুরের মাঝে অনেক মানুষ দাড়িয়ে ছিল কিন্তু হুজুর কোনভাবে আমাকে দেখে ফেলেন এবং কাছে ডাকেন। আমি এত দূরে ছিলাম যে হুজুরের ডাকও শুনতে পাইনি। একজন বলল যে হুজুর আমাকে ডাকছেন। ”

“আমি হুজুরের কাছে গেলে হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে খোদ্দাম হিসেবে এটিই আমার শেষ বছর কিনা? তারপর হুজুর আমাকে কিছু হাসির কথা বলেন। হুজুর বলেন যে ঘানার অধিবাসীরা আনসারে প্রবেশ করতে অত্যন্ত ভয় পায়। তাই তারা ৫০ বছর বয়সের কাছাকাছি না যেয়ে কখনো স্বীকার করে না যে তারা আনসার হয়েছে। সকলেই হাসেন এবং হুজুর আমার সাথে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। এই মুহুর্তটির জন্যই আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করছিলাম। হুজুর আমার হাত ধরেই থাকেন এবং এভাবেই আমরা কয়েক মিনিট হেটে সামনে এগিয়ে যাই। ”

“সে সময়ের অনুভুতি কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। কেবল আমিই জানি যে আল্লাহর কাছে আমি কি দোয়া করেছিলাম। যখন মনে হল যে হুজুরের সাথে হাত মেলানোর আর কোন সুযোগই নেই তখনই আল্লাহপাক এমনভাবে আমার দোয়া কবুল করলেন যা আমি কখনো কল্পনাও করিনি। ”

 

একজন প্রবীণ দরবেশ

আমি জামাতের একজন প্রবীণ দরবেশ তৈয়ব আলী (৯১ বছর) সাহেবের সাথে কিছু সময় কাটাতে পেরে আনন্দিত। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় যে কয়জন ব্যক্তি কাদিয়ানে থেকে যাবার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন এখন তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনই বেঁচে রয়েছেন এবং তিনি তাদের মধ্যে একজন। আমি যখন গেস্ট হাউজে তার রুমে যাই তখন তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। আমি আমার নাম বলি এবং বলি যে তার বিশ্রাম নেয়া হলে আমি আবার আসব। তিনি হেসে আমাকে বলেন “আমি জামাতের জন্য সবসময় প্রস্তুত, তাই আমার বিশ্রাম নেবার কোন প্রয়োজন নেই। আমি কেবল তোমাকে একটি কথাই বলব তা হল একটু জোরে কথা বল কারণ আমি কানে কম শুনি। ”

লন্ডনে তার সফর সম্বন্ধে তিনি বলেন “তুমি কি বিশ্বাস করতে পার যে আমার বয়স ৯১ বছর আর আমি এই প্রথম লন্ডনে এসেছি? আমি এবারই প্রথম প্লেনে উঠেছি! আমার মনে গভীর ইচ্ছা ছিল যে একবারের জন্য হলেও ইউকে জলসাতে অংশগ্রহণ করব। তাই আমি হুজুরের কাছে অনুমতি চেয়ে চিঠি লিখি এবং হুজুর অনুগ্রহ করে তা কবুল করেন।  ”

আমি তাকে জিজ্ঞেস করি দেশভাগের সময় কাদিয়ানের পরিস্হতি কেমন ছিল। তিনি বলেন “দেশভাগের সময় ও পরবর্তী কয়েক বছর পরিস্হিতি অনেক বিপজ্জনক ও কষ্টসাধ্য ছিল। আশেপাশে কোন মুসলমন ছিল না। সকল হিন্দু, শিখ ও সরকার আমাদের বিপক্ষে ছিল। অনেকেই আমাদের কাদিয়ান থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলাম যে কোন অবস্হাতেই প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর ভূমি ছেড়ে যাব না। আমরা নিজেদের অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি কারণ হযরত মুসলেহ মাউদ(রাঃ) আমাদের দিক নির্দেশনা দিতেন ও আমাদের জন্য দোয়া করতেন।  ”

“অনেক সময় পর্যন্ত আমরা মাসিক ৫ রুপি হারে ভাতা পেয়ে এসেছি। আমি কিছু সাবান আর তেল কিনতাম এবং ৫ রুপি শেষ হয়ে যেত। সৌভাগ্যবশত জামাতের লঙ্গরখানা চালু ছিল যেখানে আমরা খাবার খেতে পারতাম। এই কষ্টকর সময় ১৮ মাস পর্যন্ত স্হায়ী হয়েছিল এরপর ধীরে ধীরে অবস্হার উন্নতি হতে থাকে। জামাতের কিছু অফিস তৈরী করা হয় এবং আমরা সেই অফিসে কাজ করতে থাকি। প্রকৃত সত্য হল মহান আল্লাহপাক আমাদের রক্ষা করেছেন, তা নাহলে পার্থিব দিক দিয়ে আমাদের কোন আশাই ছিল না। আমরা যেভাবে রক্ষা পেয়েছি সেটিই প্রমাণ করে যে প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর জামাত আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত সত্য জামাত। ”

আমি তাকে জিজ্ঞেস করি কাদিয়ানে থেকে যাবার সিদ্ধান্তের জন্য তিনি কখনো আফসোস করেছেন কিনা? আমার মনে হল তিনি আমার প্রশ্নে কষ্ট পেয়েছে। তিনি বলেন “তুমি আমাকে এরকম প্রশ্ন কিভাবে করতে পারো? দরবেশ হিসেবে আমার জীবন পালন করার অর্থ হল আমি বিশ্বের সবচেয়ে সৌভাগ্যশালী ব্যক্তি। কারণ আমি খলীফাতুল মসীহর নির্দেশ অনুযায়ী আমার জীবন পরিচালিত করেছি। আমি কখনো আমার মৃত্যুকে ভয় পাইনি এবং আমার পরিবারের জন্য দুশ্চিন্তা করিনি; কারণ আমি জানি যে আমি প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর সেবা করছি। ”

“আমি অনেক দীর্ঘ জীবন লাভ করেছি এবং একটি জিনিস আমি শিখেছি যে আমাদের কখনো খলীফাতুল মসীহর আগে যাবার চেষ্টা করা উচিৎ নয়। কখনো যুগ খলীফাকে না জানিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিবে না। যেদিন আমাদের জামাত এরকম করার চেষ্টা করবে সেদিনই জামাত ধ্বংস হয়ে যাবে।”

তিনি বলেন ২০০৫ সালে কাদিয়ান সফরের সময় হুজুর সকল দরবেশের ঘরে যান। তিনি বলেন “আমি অনেক সাধারণ এক বান্দা। কিন্তু তারপরও হুজুর ২০০৫ সালে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। হুজুরের আগমনের বরকত ইনশাল্লাহ আমার ভবিষ্যত প্রজন্মও লাভ করবে। হুজুর অনুগ্রহ করে কিছু মিষ্টি খান এবং আমাদের সাথে ছবি তুলেন। ”

আমি তাকে আমার ও পরিবারের জন্য দোয়ার অনুরোধ করি। তিনি বলেন “একটি কথা মনে রাখবে যে খিলাফতই আমাদের সবকিছু। যদি তুমি যুগ খলীফার নির্দেশনা অনুসরণ কর তাহলে তুমি ভাল থাকবে। কিন্তু যেদিন থেকে তুমি তা বন্ধ করবে সেদিন থেকে তোমার জীবনের সব বরকত তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হবে। ”

খিলাফতের প্রতি ভালবাসা

আমি হুজুরের অফিস থেকে বের হবার কয়েক মিনিট পর হুজুর তার অফিস থেকে বের হন এবং মাহমুদ হলের দিকে এগিয়ে যান। সেখানে হুজুর ভারত থেকে আগত অতিথি ও কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন ও ছবি তুলেন। তারা পরের দিনই ভারতের উদ্দেশ্য রওনা হবে। তারা যখন একজন একজন করে হুজুরের কাছে আসছিল তখন একজন তার সন্তানদের জন্য হুজুরকে কিছু উপহার দেবার জন্য অনুরোধ করে। হুজুর তাকে দুইটি কলম দেন। এরপর যিনি আসেন তিনি কেবল তার সন্তান নন বরং তার নাতী-নাতনীদের জন্যও উপহার চান। হুজুর জানতে চান যে তারা মোট কতজন এবং সেই কয়টি কলম উপহার দেন। এরপর সকলেই তাদের পরিবারের জন্য উপহার নেয়া শুরু করে। একজন বলেন যে তার ১৬ জন নাতী-নাতনী রয়েছে তাই হুজুর তাকে ১৬ টি কলম উপহার দেন।

সেখানে কাদিয়ানের দরবেশ তৈয়ব আলীও ছিলেন। যখন তিনি হুজুরের সাথে দেখা করতে আসলেন তখন তিনি তার স্ত্রীর জন্য একটি আংটি দেবার অনুরোধ করলেন।

হুজুর বলেন “ঠিক আছে, আ্মি আপনাকে আংটি দিব। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার স্ত্রী আংটি পেয়ে চিন্তা করবে যে বিবাহের ৮০ বছর পর কেন আপনার তাকে আংটি দেবার ইচ্ছে হল!”

সকলেই হুজুরের কথা শুনে হেসে ফেলি।

অবিস্মরণীয় কয়েক সপ্তাহ

জলসা সালানা শেষ হবার পর এক সপ্তাহ পার হয়েছে। ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন স্হান থেকে আগত আহমদীদের সংখ্যা কমতে লাগল। হুজুর তার স্বাভাবিক কার্যকর্মে ফিরে গেলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক কার্যকর্ম ও হুজুরের স্বাভাবিক কার্যকর্মের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। হুজুরের স্বাভাবিক কার্যকর্মের মধ্যে রয়েছে অফিসের কর্মকর্তাদের সাথে মিটিং, আহমদী পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ, ২০০ টিরও বেশি দেশ থেকে যেসব অফিসিয়াল রিপোর্ট আসে সেগুলো দেখা এবং দিক নির্দেশনা প্রদান করা; হুজুর প্রতিদিন নিজে প্রায় ৭০০ আহমদীর সম্পূর্ণ চিঠি পড়েন এবং প্রায় হাজারের মতো চিঠির সারাংশ পড়েন। হুজুর ব্যক্তিগতভাবে প্রায় ৫০০-১০০০ আহমদীর চিঠিতে প্রতিদিন স্বাক্ষর করেন।

প্রায় প্রতি সপ্তাহেই বিভিন্ন দেশ থেকে হুজুরের সাথে দেখা করার জন্য কর্মকর্তা আসেন এবং হুজুর অনেক সময় নিয়ে তাদের কথা বলেন ও তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন। হুজুর সময় পেলেই ওয়াকফে নও ও জামেআ আহমদীয়ার ক্লাস নেন।

আগামী সপ্তাহেই হুজুরকে BBC র একটি ডকুমেন্টারী ‘The Caliphate in the Countryside’ এর জন্য আতাহার আহমদ সাহেবকে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। এটি বিবিসির একটি ধর্মীয় সিরিজ ‘Heart and Soul’ এর একটি পর্ব হিসেবে প্রচারিত হবে।

সেই সপ্তাহেই হুজুর আমাকে তার অফিসে ডাকেন এবং প্রায় ৯০ মিনিট ধরে তার একটি বক্তব্যের জন্য নির্দেশনা দেন। যেটি হুজুর আগামী জলসা সালানা জার্মানীতে বলবেন। হুজুর কিছুদিনের মধ্যেই সেজন্য জার্মানীর উদ্দেশ্যে রওনা হবেন।

আমি হুজুরের যে সকল কর্মকান্ড বর্ণনা করলাম সেগুলো কেবল হুজুরের কাজের একটি অংশ। একজন আমাকে চিঠিতে লিখেছে যে আমি যতই হুজুরের কর্মকান্ড ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করি না কেন একটি জিনিস আমি কখনোই তুলে ধরতে পারব না। সেটি হল হুজুরের ইবাদত। সেই ব্যক্তি একদম সঠিক কথা লিখেছেন। আমরা হুজুরকে দিনের বেলায় দেখে থাকি, কিন্তু হুজুরের রাত আল্লাহর জন্য নিবেদিত। সেই সময় যখন আমাদের অধিকাংশই ঘুমিয়ে থাকি আমাদের খলীফা জেগে থাকেন এবং আল্লাহর কাছে সিজদায় রত হয়ে চোখের পানি ফেলে আমাদের ও মানবজাতির জন্য দোয়া করেন।

আমার মনে আছে একবার হুজুরের একজন নিরাপত্তা কর্মী আমাকে বলেছিল যে তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ করার সময় হল রাতের শিফট। কারণ এসময় সে দেখতে পায় যে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু হুজুরের ফ্লাটের লাইট সকালের অনেক আগেই জ্বলে উঠে। সে জানে যে যুগ খলীফা জেগে আছেন এবং জামাতের সদস্যদের জন্য দোয়া করছেন।

 

উপসংহার

আল্লাহর অশেষ রহমতে জলসা সালানা ইউকে ২০১৭ একটি বরকতময় জলসা বলে প্রমাণিত হয়েছে। যারা জলসায় অংশগ্রহণ করেছে তারা সকলেই জলসার বরকতময় পরিবেশ প্রত্যক্ষ করেছে। হুজুর অনেক আহমদীর সাথে দেখা করেছেন, তাদের কষ্টের কথা শুনেছেন, তাদের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তাদের ধর্মের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন।

হুজুর বিভিন্ন অতিথি ও সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরেছেন।

এ সপ্তাহেই আমি হুজুরের কাছ থেকে সুসংবাদ পাই যে আমি হুজুরের সাথে জার্মানী সফরের সৌভাগ্য লাভ করেছি। আমি আর একটি বরকতময় সফরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।

মহান আল্লাহপাক আমাদের হুজুরকে দীর্ঘ ও সুস্হ জীবন দান করুন, আমীন।