হযরত মসীহ্‌ মওউদ (আ.) এর পুস্তকসমূহ পাঠের গুরুত্ব ও উপকারীতা

হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) শেষ যুগের ব্যাপারে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন সেগুলোর মধ্যে একটি এটিও ছিল যে, এমন যুগ আসবে যখন ধর্ম কেবল নাম মাত্র থাকবে আর কুরআন করীমের শুধু অক্ষর অবশিষ্ট থাকবে এবং আলেমরা এই ধরাপৃষ্ঠে নিকৃষ্ট জীব হবে। সুতরাং এরকম সময়েই আল্লাহতা’আলা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) কে প্রেরণ করেছেন যেন তার মাধ্যমে পুনরায় ধর্ম সঞ্জীবিত হয় এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নাম পৃথিবীতে পুনরায় উদ্ভাসিত হয় এবং কুরআন করীমের প্রকৃত বিষয় ও উত্তম শিক্ষা লোকদের নিকট পৌঁছায়। আর তেমনি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) খোদাতা’আলার সাহায্য সহযোগিতায় ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দুনিয়াবাসীকে জানিয়েছেন। তিনি (আ.) জ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞানের সমুদ্র প্রবর্তন করেছেন আর নিষ্প্রাণ পৃথিবীকে জীবিত করে তা দেখিয়েছেন। “সুলতানুল কলম” সেই আধ্যাত্মিক ধনভাণ্ডার যা পৃথিবীবাসীর সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন যার ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, যখন মসীহ্ আগমন করবেন তখন তিনি এতো সম্পদ পৃথিবীকে দিবেন যে সেটা গ্রহণ করার লোক থাকবে না। হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) এর সকল পুস্তক ও মালফুযাত সেই ধনভান্ডার ও সম্পদের সমারোহ। সেগুলোতেই সৌন্দর্যমন্ডিত সেই মনি মানিক্য মতি রয়েছে যা মানুষের ইহকাল ও পরকাল লাভের জন্য যথেষ্ট।

পুস্তক পাঠের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বঃ

হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) ২৭ ডিসেম্বর ১৯২০ জলসা সালানায় বলেন, তোমরা অবশ্যই অন্যান্য বিষয়ে লেখাপড়া করো কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান অবশ্যই অর্জন করো এবং নিজের ভিতরে ধর্মীয় বিষয়াবলী বুঝার ও গ্রহণ করার ক্ষমতা সৃষ্টি করো। সেটার জন্য প্রথম তো কুরআন শিখো আর দ্বিতীয়ত হযরত সাহেবের (আ.) পুস্তকসমূহ পাঠ করো। আর অবশ্যই স্মরণ রেখো হযরত সাহেবের পুস্তকসমূহ কুরআনের তফসীর” 

ফিরিশতাগণের অবতীর্ণ হওয়াঃ

হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন,

“যে পুস্তকসমূহ এমন একজন লিখেছেন যার ওপর ফিরিশতা অবতীর্ণ হত, তাই এমন পুস্তকটি পাঠ করলেও ফিরিশতা অবতীর্ণ হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি হযরত সাহেবের পুস্তকসমূহ পাঠ করবে তার ওপরও ফিরিশতা অবতীর্ণ হবে।” (মালায়েকাতুল্লাহ্‌)

প্রত্যেক আহ্‌মদীর আত্মাঃ

হযরত খলীফাতুল মসীহ্‌ সালেস (রাহে.) বলেন, “সুতরাং কুরআন করীমের সেই তফসির যা বর্তমান সময়ের প্রয়োজনীয়তাকে পূরণকারী তা হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-এর পুস্তকাদিতে পাওয়া যায়। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সেই জ্ঞানভান্ডার যা তার পুস্তকসমূহে পাওয়া যায় তা প্রতিটি আহমদীর জীবন ও আত্মা। যদি আপনারা সেই পুস্তকসমূহ বা সেই পুস্তক সমূহে বর্ণিত জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত থাকেন তাহলে আহমদীয়াত তো প্রসার লাভ করবে না । বরং তোমরা এরূপ এক নিষ্প্রাণ শরীর হয়ে যাবে যার মাঝে কোন জীবনীশক্তি থাকবে না।” (মাশায়েলে রাহ)

প্রত্যহ পাঠের উপদেশঃ

হযরত খলীফাতুল মসীহ সালেস (রাহে.) আহমদী ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এবং যুবকদের নসিহত করতে গিয়ে ১৩ মে ১৯৬৭ বাৎসরিক তালিমী ক্লাসের সমাপনী অধিবেশনে বলেন, “সেই প্রকৃত নসিহত যা আমি এখন ছেলে-মেয়েদের করতে চাই তা হচ্ছে এই যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এর পুস্তক সমূহ পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রত্যহ হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এর যে কোন পুস্তক বা মালফুযাতের যে কোন অংশ পড়ুন। মালফুযাত থেকে যদি আপনি আরম্ভ করেন তাহলে সবচেয়ে উত্তম কেননা তাতে যে বিষয়সমূহ বর্ণিত হয়েছে তা সাধারণভাবে বোধগম্য বিষয়।”

তিনি (রাহে.) আরো বলেন, “যেভাবে বানানো সদ্য সিমেন্টের নতুন দেয়ালে আপনি নখ দ্বারা চিহ্ন করতে পারেন অনুরূপভাবে আপনাদের বংশধরদের ওপর শয়তান রেখাপাত করার চেষ্টা করে। আর সেটার চিকিৎসা হচ্ছে যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এর পুস্তক বেশী থেকে বেশী পড়া। এই কাজ আপনি কোন আলাদা সময় না বের করেই করতে পারেন । শুধু নিয়্যত করা আবশ্যক । যদি আপনি পাঁচ পৃষ্ঠাও প্রতিদিন পড়েন তো একমাসে আপনি ১৫০ এবং বছরে ১৮০০ পৃষ্ঠা পড়ে ফেলবেন । যদি আপনারা এখান থেকে শপথ নিয়ে যান যে, আমরা প্রতিদিন হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পুস্তকের পাঁচ পৃষ্ঠা পড়ব। বরং আমি পাঁচের শপথকেও ছেড়ে দিচ্ছি যদি আপনারা প্রত্যহ তিন পৃষ্ঠা পড়ার অঙ্গীকার করেন। তাহলে আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি যে, খুব অল্পদিনেই আপনাদের মাঝে এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসবে। আর আল্লাহ্ তাআলার ফযলসমূহ আপনাদের ওপর অবতীর্ণ হবে । খোদাতা’আলার ফযল ও রহমতে আপনাদের এরূপ অংশ লাভ হবে যে, আপনারা পৃথিবীবাসীকে গোলক ধাঁধায় নিমজ্জিতকারী হবেন। এ ব্যাপারে সামান্য মনোযোগের প্রয়োজন । অত:পর আপনারা খোদা তাআলার দরবারে তার এরূপ বান্দা বলে পরিগণিত হবেন যা তার প্রিয় বান্দাগণ হয়ে থাকেন। আপনারা পৃথিবীর জন্য আদর্শ ও পথ প্রদর্শক হয়ে যাবেন এবং খোদা তাআলার কল্যাণসমূহ আপনারা লাভ করবেন। কিন্তু এই পথ প্রদর্শক ও আদর্শবান এবং খোদাতা’আলার কল্যাণসমূহের অর্জন হযরত মসীহ্‌ মওউদ (আ.)-এর বর্ণনাকৃত কুরআনের তফসিরের বাহিরে অর্জিত হতে পারবে না। এর ফলে আপনার লেখাপড়ায় অথবা আপনি কোন অন্য কাজ করছেন তো আপনার কাজে কখনোই কোন ব্যাঘাত পড়বে না। বরং এই পড়া ভালো প্রভাব ফেলবে । যদি আপনাদের কেউ ছাত্র হোন তাহলে এটি পড়ার কারণে তার ব্রেনে, মসৃণতার সৃষ্টি হবে। আর তার ভিতরে একটি জ্যোতির সৃষ্টি হবে। অত:পর সে অন্যান্য বিষয় যেমন ক্যামিষ্ট্রি, ইংরেজী ও অন্যান্য বিষয়গুলোকে খুব সহজেই বুঝতে পারবে এবং পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাবে। যদি সে কোন কাজ করে তাহলে তার কাছে তা সহজতর হবে।” (মাশায়েলে রাহ)

হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) ধর্মীয় শিক্ষাকে খুব সুন্দর ও বিস্তারিত ভাবে নিজের পুস্তকসমূহে বর্ণনা করেছেন এ ধনভান্ডারের প্রতি দৃষ্টি দেয়া উচিত। এর মাঝে কুরআন করীমের তফসীর নিহিত। আঁ হযরত (সা.) এর সৌন্দর্য্য ও অনুগ্রহের উল্লেখ এতে রয়েছে। এতে খোদা তাআলার গুণাবলীর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আর তিনি পৃথিবীবাসীকে সেই খোদা, সেই মহান, কারীম, রাহীম, রাজ্জাক এবং সমস্ত শক্তি ও প্রশস্ততা ও পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী খোদার চেহারা দেখিয়েছেন যাকে মানবজাতি ভুলে গিয়েছিল। এই পুস্তকসমূহে আরো উত্তম পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন আর সমস্ত বিশ্বাসের প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। সুতরাং এই আধ্যাত্মিক খাবারের মূল্যায়ন করা উচিৎ এবং তা থেকে কল্যাণ লাভ করা দরকার।

হযরত আক্বদাসের রচনা পদ্ধতিঃ

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.) ১০ জুলাই ১৯৩১ জামা’তের লেখকবৃন্দ সদস্যগণ ও প্রাবন্ধিকগণকে এই আহবান করেন যে, তারা যেন হযরত আকদাসের লেখনীর পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তিনি বলেনঃ

“হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.)-এর সত্তা থেকে পৃথিবীতে যে অঢেল কল্যাণ প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে একটি বড় কল্যাণ হচ্ছে তার লেখনীসমূহ। হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) এর রচনাসমূহও সম্পূর্ণ খোদা প্রদত্ত। আর সেগুলোর মাঝে আধ্যাত্মিকতা ও বাগ্মীতাপূর্ণ শব্দাবলী পাওয়া যায় । এগুলো এরূপ প্রবন্ধসমূহের সমারোহ যার ব্যাপারে সাধারণত পৃথিবীবাসী অবগত নয়। কেননা নবীদের বাক্য স্ববিরোধিতা, মিথ্যা ও লৌকিকতা থেকে মুক্ত হয়। এর ভিতর থেকে এমন এক ধারাবাহিকতা ও আকর্ষণ পরিলক্ষিত হয় যে, যে ব্যক্তি এটিকে পাঠ করে এমন মনে হয় যেন শব্দগুলো থেকে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ বের হয়ে তাদের শরীরের সাথে মিশে যাচ্ছে। এটি মারাত্মক অকৃতজ্ঞতা ও অমর্যাদা হবে যদি আমরা এই মহা মর্যাদাবান রচনাবলীসমূহকে পর্যালোচনা করে নিজেদের রচনাবলী অনুরূপ না বানাই” (আল ফযল, ১৬ জুলাই ১৯৩১)

হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আল খামেস (আই.) এর দিকনির্দেশনাঃ

“এটি আমি পূর্বেও বলেছি যে, বর্তমান যুগে হযরত আক্বদাস মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পুস্তকসমূহকে পাঠ করার প্রতিও দৃষ্টি নিবদ্ধ করা উচিত। আর তা থেকে কল্যাণও লাভ করা উচিত । এটিও কুরআন করীমের একটি ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ যা আমরা তার (আ.) পুস্তক থেকে পাই।

এদিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত আর এই পুস্তকসমূহ অবশ্যই পড়া উচিত। এই পুস্তকসমূহ থেকে আপনি দলিল প্রমাণ পেতে পারেন যা থেকে লোকদের আপত্তিসমূহের উত্তর প্রদান করতে পারেন। আর তার (আ.) সভা থেকে, তার সাহচার্য থেকে ফায়দা লাভের এটাই মাধ্যম। আমি প্রথমেও বলেছি যে, তার পুস্তকসমূহ পাঠের প্রতি বেশী থেকে বেশী দৃষ্টি দিন । এর ফলে বিরুদ্ধবাদীদের আপত্তির উত্তরও পাবো এবং কুরআন করীমের তত্ত্বজ্ঞানও আমরা লাভ করতে সক্ষম হবো” [তথ্য: মাসিক খালিদ (মাশায়ালে রাহ)

সুতরাং প্রতিটি আহ্‌মদী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার জন্য এটি আবশ্যকীয় যে, তারা যেনো হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.)-এর পুস্তকসমূহ পাঠ করে তা থেকে জ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে নিজেদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে আলো ও জ্যোতি পৌঁছায়। কেননা বর্তমান যুগে জ্ঞান লাভের আর কুরআন করীমকে বুঝার ও হযরত রাসূলে করীম (সা.) এর হাদীসসমূহের মর্মার্থ উপলব্ধি করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পুস্তকসমূহ। সেই সাথে আরো বলতে চাই বর্তমান যুগের অবক্ষয় থেকে নিজেকে ও পরিবার পরিজনকে মুক্ত রাখার সবচেয়ে উত্তম উপায় বা রাস্তা হচ্ছে নিজেদের ঘরে হযরত মসীহ্‌ মওউদ (আ.)-এর পুস্তকসমূহের চর্চা করা।

যদি আগামী প্রজন্মকে ভাল ও নেক রেখে যেতে চান তাহলে নিজেদের ঘরে ইমাম মাহ্‌দী (আ.)-এর পুস্তকের চর্চা প্রত্যহ আবশ্যকীয় করে নিন। মহান আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে এর গুরুত্ব বোঝার তৌফিক দান করুন, আমীন ।

সংকলন ও অনুবাদঃ
মওলানা জাফর আহমদ

[পাক্ষিক আহ্‌মদী; ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৯ ইং তারিখের সংখ্যা হতে সংগৃহীত]

Tags: