22 May হুজুরের (আইঃ) হল্যান্ড ও জার্মানী সফর অক্টোবর ২০১৫ ব্যক্তিগত ডায়েরী পার্ট-২ (শেষ পর্ব)
[হুযুর (আইঃ) এর হল্যান্ড এবং জার্মানী সফরঃ আবিদ খান সাহেবের ব্যক্তিগত ডায়েরী। ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন নুরে কাওসার রিফাত সাহেব। দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ করা হল]
একটি স্মরণীয় সকাল
শনিবার ১০ অক্টোবর, ২০১৫ হুজুরের হল্যান্ড সফরের ষষ্ঠ দিন।
হুজুর আগের দিন সন্ধ্যায় অনুগ্রহ করে আমাকে বলেন যে আমি যেন হল্যান্ডের বিখ্যাত প্যানোরমা ছবিটি দেখতে যাই। তাই আমি নাদিম আমিনী সাহেবের সাথে সেদিন হেগ শহরে ভ্রমণের পরিকল্পনা করি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল আমরা ফযরের নামায পড়ে বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু এই ভ্রমণের ব্যাপারে আমার কিছুটা আলসেমী ছিল। কারণ সেদিন হজুর নানপেস্টে সাইক্লিং করতে বের হবেন। আর আমি যদি শহর ঘুরতে যাই তাহলে আমি হুজুরের সাথে সাইক্লিং এর সুযোগ হারাবো।
সেদিন ফযরের নামাযের পর আহমদ ভাই বলেন যে হুজুর বলেছেন আমাদের শহর ভ্রমণ পিছিয়ে দিতে এবং সাইক্লিং এর জন্য তৈরী হতে। হুজুরের সাথে সাইক্লিং করার বিশেষ সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। হুজুর আমাদের কথা মনে করে সংবাদ পাঠিয়েছেন এজন্যও আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম।
আমি অনেক বছর ধরে সাইকেল চালাই না। তাই আমি এ ব্যাপারে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। ১৯৭৭ সালে আমি উর্দু ক্লাসের সাথে নানপেস্ট সফর করেছিলাম। তখন সাইকেল চালানোর সময় আমি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে যাই এবং সাইকেলের গতি অনেক বাড়িয়ে দেই। এরপর আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাইকেল থেকে পড়ে যাই। আমার মাথা মাটিতে যেয়ে লাগে এবং আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার মাথার ক্ষত পরিস্কার করে ব্যান্ডেজ করে দেয়া হয়। তাই আমি এবার ঠিক করি যে সাইকেলের গতি স্বাভাবিক রেখে হুজুরের সাথে সাইক্লিং করা উপভোগ করব।
আমি দ্রুত তৈরী হয়ে আমার সাইকেলের কাছে পৌছলাম। এই সাইকেলটি আমি কয়েকদিন ধরে হল্যান্ডে ব্যবহার করছি। বেশীর ভাগ কাফেলা সদস্য ও হল্যান্ড জামাতের কিছু সদস্যও সেখানে উপস্হিত ছিল। তারা তাদের সাইকেলের সিট পরিস্কার করে হুজুরের জন্য অপেক্ষা করছিল।
হুজুরের নিরাপত্তা দলের সদস্য মাহমুদ খান সাহেব একজন দক্ষ সাইক্লিস্ট। তাই তিনি সাইক্লিং এর জন্য সঠিক পোশাক ও জিনিস নিয়ে এসেছেন। অন্যান্য সদস্যগণ জিনস, ট্র্যাকশুট অথবা কামিজ পড়ে এসেছেন। প্রায় ৭:৪৫ মিনিটে হুজুর তাঁর বাসস্থান থেকে বের হয়ে আমরা যেখানে অপেক্ষা করছিলাম সেখানে আসেন। হুজুর একটি আফগানী টুপি, খয়েরী সালোয়ার কামিজ, কালো রংএর রেইনপ্রুফ জ্যাকেট ও খয়েরী জুতো পড়ে ছিলেন। আল্লাহর রহমতে হুজুরকে বুদ্ধিমান ও সুন্দর লাগছিল।
হুজুরের নিরাপত্তা দল তার জন্য একটি সাইকেল ঠিক করে রেখেছিল। হুজুর তার সাইকেলে উঠেন এবং কোন বিলম্ব না করেই সাইকেল চালিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠে পড়েন। অনেক দূরে সামনে দুজন খোদ্দাম সাইকেল চালাচ্ছিল। কিন্তু এছাড়া হুজুরই সবার সামনে ছিলেন। হুজুরের কয়েক মিটার পিছনে তাঁর নিরাপত্তা দল এবং তার পেছনে আমরা সবাই ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমরা সাইকেল রেসে আছি এবং হুজুর আমাদের নেতৃত্বে আছেন।
হুজুর একটি ভাল গতিতে কোন বিরতি না নিয়ে সাইকেল চালাতে থাকেন। প্রথমে আমরা হল্যান্ডের গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে নানপেস্ট লেক পার হই। অনভিজ্ঞতার জন্য আমার সাইকেল কিছটা কাঁপছিল। কিন্তু হুজুর একদম স্বাভাবিকভাবে নিশ্চিন্ত মনে সাইকেল লাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে হুজুর এক হাতে সাইকেল চালাচ্ছিলেন এবং উপরে উঠার সময় গিয়ার পরিবর্তন করছিলেন।
লেক পার হবার পর সামনের খোদ্দাম দুজন বাম দিকে গেল। কিন্তু হুজুর সেখানে যেয়ে ডানদিকে মোড় নিলেন। খোদ্দাম দুজনকে আমাদের কাছে আসতে আরো ১০ মিনিট সময় লেগেছিল।
প্রায় ৩০ মিনিট পর হুজুর এক মিনিটের জন্য থামেন। আমি শুনলাম হুজুর জিজ্ঞেস করছেন “আবিদ কোথায়?” আমি আমার সাইকেল থেকে নেমে হুজুরের কাছে গেলাম। হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করেন আমার কেমন লাগছে, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি কিনা। আমি বললাম যে কিছুদিন আগে আমি যে সাইক্লিং করেছিলাম তার চেয়ে এটি একটু কঠিন এবং গতিও একটু বেশী। কিন্তু আমি এটি অনেক উপভোগ করছি।
এরপর হুজুর আবার সাইক্লিং শুরু করেন। আমরা হুজুরের পিছনে তাকে অনুসরণ করি। সাইক্লিং এর বাকি সময় আমি হুজুরের নিরাপত্তা দলের সাথে ও সরাসরি হুজুরের পিছনে সাইক্লিং করি। হুজুর কিভাবে সাইক্লিং করেন আমি সেটি লক্ষ্য করতে থাকি।
সকালের সতেজ হাওয়া যখন আমার মুখে লাগছিল তখন আমি ভাবলাম এভাবে ফযরের পর হুজুরের সাথে সাইক্লিং করার চেয়ে বেশি উপভোগ্য জিনিস আর কি হতে পারে। এটি আমাদের সকলের জন্য অনেক সম্মানের বিষয়। এটি আমাদের সকলের জীবনের জন্য স্মরণীয় মুহুর্ত।
সেদিন হুজুর ৬.৪ মাইল সাইক্লিং করেন। আলহামদুলিল্লাহ, হল্যান্ড সফরের বাকি দিনগুলোতে আমদের সৌভাগ্য হয়েছিল প্রতিদিন ফযরের পর হুজুরের সাথে সাইক্লিং করার।
হুজুরের সামান্য বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য
হুজুর তার বাসস্থানে যাবার পূর্বে আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমরা কখন হেগ শহর ঘুরতে বের হব। আমি বললাম যে হুজুর যদি অনুমতি দেন তাহলে আমরা গোসল করেই বের হব। হুজুর অনুগ্রহ করে অনুমতি দেন এবং নাদিম সাহেবকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন “তুমি কি আবিদকে শুধুই রুটি অথবা কেক খাওয়াবে নাকি?” নাদিম বলেন “না হুজুর, আমরা খুব ভাল নাশতা করব।” যেকোন জিনিসের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি হুজুর যে লক্ষ্য রাখেন সেটি আসলেই অসাধারণ। কিন্তু নাদিমের আত্মবিশ্বাস সত্ত্বেও হুজুরের কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়। আমরা যখন একটি সার্ভিস স্টেশনে যাই সেখানে খাবারের মেনু খুব বেশি ছিল না। তাই আমি একটি টোস্ট ও নাদিম একটি কেক খায়।
প্যানোরমা ছবি দর্শন
তৈরী হয়ে আমরা ৯.৩০ মিনিটে হেগের উদ্দেশে বের হই। হুজুর উপদেশ দিয়েছিলেন আমরা যেন প্যানোরমা মেসডাগ দেখতে যাই। এটি একটি ১২০ মিটার লম্বা প্যানোরমিক ছবি। বিখ্যাত ডাচ পেইন্টার হেনরিক মেসডাগ উনিবংশ শতাব্দীতে এটি আঁকেন।
ছবিটি বিখ্যাত স্ক্যাভেনিয়ান সামুদ্রিক তীরবর্তী অঞ্চলের একটি দৃশ্য। এটি কোন সাধারণ ছবি নয়। এতে দৃষ্টিবিভ্রমের প্রভাব রয়েছে। ছবিটির সামনে বালু রাখা আছে এবং ছবির উপর ও নিচের অংশ দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখা হয়েছে। তাই ছবিটিকে দেখলে একটি বাস্তব দৃশ্য বলে মনে হয়। ছবিটি আসলেই প্রশংসার দাবিদার। হুজুরের দয়ার কারণেই আমার এই বিখ্যাত ছবিটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।
ছবি দেখা শেষে আমি ও নাদিম শহরে কয়েকটি দোকানে যাই। আমি লন্ডনে নিয়ে যাবার জন্য কিছু কফি কিনি। এরপর আমরা একটি স্হানীয় কফিশপে যাই ও দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। আমি স্যালমন সালাদ ও নাদিম চিকেন সিজার সালাদ নেই। সালাদের স্বাদ ভালই ছিল। কিন্তু শরীরের জন্য একটি বেশিই ভাল ছিল।
আমরা চেয়েছিলাম ফিরে এসে জোহর ও আসরের নামাযের আদায় করব। কিন্তু যানজটের জন্য আমাদের দেরী হয়ে যায়। হুজুরের কাছে ফিরে আসতে পেরে আমি আনন্দিত। আমরা ফিরে যেয়ে হুজুরকে বলি যে দুপুরে আমরা সালাদ খেয়েছি। হুজুর বলেন “তোমাদের উচিৎ ছিল সমুদ্রতীরে চলে যাওয়া এবং সমুদ্র দর্শন করতে করতে মাছ ও চিপস খাওয়া।” হুজুরের কথা শোনার পর আমার আফসোস হতে লাগল যে আমরা কেন এরকম করলাম না। কিন্তু তারপরও সময়টি ভালই কেটেছিল।
স্থানীয় আহমদীদের আবেগ
সেদিন বিকেলে হুজুর কিছু স্থানীয় আহমদীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমি সেরকম কিছু সৌভাগ্যবান আহমদীদের সাথে কথা বলি।
আমি দুজন ভাই এর সাথে কথা বলি। বড় ভাই এর বয়স ২২ বছর ও ছোট ভাই এর ১৭ বছর। তারা ২০০৯ সালে পাকিস্তান থেকে পরিবারসহ হল্যান্ডে আসে।
ছোট ভাইটি বলে “হুজুরের হল্যান্ড সফরের পূর্বে আমি পাচঁ ওয়াক্ত নামায আদায়ের ব্যাপারে দুর্বল ছিলাম। কিন্তু হুজুর আসার পরে আমি তার পেছনে সকল নামায আদায় করেছি। এতে আমি কোনরকম আলস্য বা ক্লান্তি বোধ করিনি বরং আমার মনে হয়েছে আমি সারাদিন ও রাত হুজুরের পিছনে দাড়িয়ে নামায আদায় করতে পারব। ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতে আমি সবসময় নামায আদায় করব। আমি দোয়া করি যেন একদিন আমি হজুরের নিরাপত্তা কর্মী হতে পারি।”
বড় ভাই বলেন “হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর আমি অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। আমার মনে হয় আমার নিজেকে আরো উন্নত করা প্রয়োজন। পূর্বে আমি নামায আদায়ের ব্যাপারে দুর্বল ছিলাম। কিন্তু হুজুরের পিছনে নামায আদায়ের পর আমি নিয়মিত নামায আদায়ের গুরুত্ব সম্বন্ধে বুঝতে পারি। হজুরকে দেখার পর আমি বুঝতে পারি যে আমরা কত সৌভাগ্যবান। হুজুরের কারণেই আমরা একতাবদ্ধ হতে পেরেছি। যদি খিলাফত না থাকত তাহলে আমাদের জামাত বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ত।”
আমি ২৮ বছরের এক খাদেম মোহাম্মদ আতাউল আলী সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “আমার ছেলের বয়স পাচঁ বছর। তার হার্ট এর সমস্যা রয়েছে। আমি আল্লাহর কছম খেয়ে বলছি যে একমাত্র হুজুরের দোবার ফলেই সে আজ জীবিত রয়েছে। যখন সে আরো ছোট ছিল তখন ডাক্তার বলেছিল যে তার অবস্হা আশংকাজনক এবং সে বেচেঁ থাকবে কিনা এ ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না। আমরা দেখালাম যে একইরকম সমস্যায় অন্যান্য বাচ্চারা মারা যাচ্ছিল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমাদের ছেলে সম্পূর্ণ সুস্হ হয়ে উঠে।”
মোলাকাতের সময় হুজুর তার ছেলেকে দেখে বলেন এটিই সেই ছেলে কিনা যার হার্টে সমস্যা ছিল। আতাউল সাহেব বলেন “এটি কিভাবে সম্ভব, যে হাজার হাজার মানুষ যারা হুজুরের সাথে মোলাকাত করতে আসে তাদের মধ্যে থেকে হুজুর আমার সন্তানকে মনে রাখেন। সত্যিই খিলাফত এমন একটি ব্যাবস্থা যা একটি ঢাল স্বরূপ। এটি আমাদের সকলকে রক্ষা করে। যদি আমরা খিলাফতের সাথে সংযুক্ত থাকি তাহলেই আমরা বেঁচে থাকতে পারব।”
আমি একজন আফ্রিকান বোনের সাথে কথা বলি। তার নাম যয়নাব। তিনি সিয়েরালিওনের অধিবাসী এবং গত ১০ বছর ধরে হল্যান্ডে বসবাস করছেন। তিনি একজন নন আহমদী মুসলমান। তিনি এক আহমদী বোনের কাছ থেকে আহমদীয়াত সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি হুজুরের সাথে মোলাকাত সম্বন্ধে বলেন “আমি এখনো আহমদীবাত গ্রহণ করিনি। কিন্তু হজুরের সাথে সাক্ষাতের পর আমি বলতে পারি যে আমি আহমদীয়াত গ্রহণের জন্য প্রায় তৈরী। আহমদীয়াত যে সত্য এ ব্যাপারে আমার হৃদয় এখন পরিতৃপ্ত। হুজুরের সাথে সাক্ষাত আমার জন্য একটি অনন্য ও অভূতপূর্ণ অভিজ্ঞতা। তাকে দেখার পর আমি এক প্রকার আধ্যাত্মিকতা অনুভব করি যেটি আমি আগে কখনো অনুভব করিনি। আমি হুজুরকে দোবা করতে বলি যেন আমি ও আমার সন্তানগণ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি। ” “যদিও আমি আহমদীয়াত গ্রহণ করিনি কিন্তু আমি এটি বলতে পারি যে আহমদী জামাত একটি সত্য বন্ধুর মতো যারা সবসময় সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে যাতা আমরা আল্লাহর আরো কাছে যেতে পারি।”
হুজুরের সাথে কিছু মুহুর্ত
বিকেলে মাগরিব ও এশার নামাযের পর আমি আমার রুমে যেয়ে স্ত্রী ও সন্তানের খবর নেবার জন্য বাসায় ফোন করি। কয়েক মিনিট পর আমি হুজুরের রুমের দরজা খোলার এবং হুজুরের নিচে নেমে আসার পায়ের শব্দ শুনতে পাই। হুজুর আমার রুমে এসে বসলেন এবং সেদিনের প্যানোরমা ভ্রমণের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। হুজুর বলেন “আমি ১৯৮৮ সালে এটি প্রথম দেখেছিলাম। খলীফা হবার পর আরো দুবার দেখেছি। দেখার জন্য নির্ধারিত স্হানে যখন প্রবেশ করা হয় তখন ছবিটিকে বাস্তব বলে মনে হয়।”
হুজুর বলেন তাকে সেখানে একবার বিশেষ ব্যবস্থায় ছবিটির নিচের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল যে এটিকে শত শত আলাদা ক্যানভাসে আকাঁ ছবি একসাথে যুক্ত করে বানানো হয়েছিল। সেসময় হুজুরের সফর সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছিল। কিছু সাংবাদিক হুজুরের সাক্ষাতকার নিয়েছিল ও সেটি সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করেছিল। এ সম্বন্ধে হুজুর বলেন “এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এবার সংবাদ মাধ্যমে প্রচারণার ব্যাপারে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু স্হানীয় জামাতের উচিৎ এ ব্যাপারে অনুপ্রাণিত হবে এটির উপর ভিত্তি করে তাদের কর্মকান্ড আরও বৃদ্ধি করা।”
তীব্র শীতে সাইক্লিং
পরদিন সকালে ফযরের পর হুজুর আবার নানাপেস্ট গ্রাম্য রাস্তায় সাইক্লিং করতে বেরিয়ে পড়েন। পূর্বের দিন যারা সাইক্লিং করেছিলেন তাদের কাউকে আমার ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। তাই হুজুর তার বাসস্থান থেকে বের হবার পূর্বে জার্মানী থেকে আসা ডাক্তার আতাহার যুবায়ের সাহেব সবাইকে কিছু ওয়ার্ম আপ ব্যায়াম করান।
কিন্তু সেদিন আবহাওয়া আগের দিনের চেয়েও ঠান্ডা ছিল। তাই সাইক্লিং এর সময় আমাদের যাদের হাতে গ্লাভস ছিল না তাদের মনে হচ্ছিল যে হাতের আঙ্গুল যেন খুলে পড়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছিল আমার হাত কখনো এরকম ঠান্ডা হয়নি। কিন্তু আমার নিজের চেয়েও বেশি চিন্তা হচ্ছিল হুজুরের জন্য। মনে হচ্ছিল হুজুরেরও অনেক ঠান্ডা লাগছে।
হুজুর এক হাতে সাইক্লিং করছিলেন আর অন্য হাত গরম করার জন্য জ্যাকেটের পকেটে রাখছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর হুজুর হাত পরিবর্তন করছিলেন। এক সময় হুজুর এক মিনিটের জন্য সাইক্লিং থামিয়ে দুই হাত ঘষে গরম করার চেষ্টা করেন।
মসজিদে পৌছে হুজুর বশির সাহেবকে ডেকে তার গাড়ি থেকে হুজুরের গ্লাভস আনতে বলেন। পরের কয়েকদিন হুজুর গ্লাভস পরে সাইক্লিং করেন।
ওমায়ির সাহেবের সাইক্লিং প্রতিভা
সাইক্লিং এর দ্বিতীয় দিন ওমায়ির আলিম সাহেব আমাদের সাথে যোগ দেন। তার স্বাস্হ্যজনিত কিছু সমস্যা ছিল। তাই আমি চিন্তিত হয়ে তাকে বলি যে সাইক্লিং করলে আর কোন অসুবিধা হবে কিনা। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন ও বলেন “তুমি শুধু আমার দিকে কাল লক্ষ্য রেখ। আমি তোমাদের সকলকে পেছনে ফেলে দিব।”
সাইক্লিং এর সময় তার কথাই সত্য হয়েছিল। মাঝেমাঝেই তিনি আমাদের থেকে এগিয়ে যেতেন। মনেই হতো না যে এতে তার কোন কষ্ট হচ্ছে। দেখে মনে হতো কোন কার্টুন ছবি। হঠাৎ করেই একজন সবার থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমি তার এ রহস্য ফাঁস করে দিতে চাই না। কিন্তু আমি মনে করি এটা বলা ভুল হবে না যে তাকে একটি অদৃশ্য হাত সাহায্য করেছিল(ব্যাটারিচালিত মোটর)।
ফ্রান্সের নও মোবাঈন আহমদীদের সাথে সাক্ষাৎ
১১ অক্টোবর রবিবার, ২২ জন নও মোবাঈন হুজুরের সাথে সাক্ষাতের জন্য ফ্রান্স থেকে নানপেস্টের বায়তুন নূর মসজিদে আসেন। এটি বড়ই আবেগঘন সময় ছিল। সেখানে তারা নিজেদের অনুভূতি হুজুরকে জানায়। ইসলাম সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন করে এবং বিভিন্ন সমস্যার জন্য হুজুরের কাছে দোয়ার জন্য আবেদন করে।
নও মোবাঈনদের মধ্যে ফ্রান্সের অধিবাসী ছাড়াও অন্যান্য দেশ থেকে আগত আহমদীও ছিল যেমন আলজেরিয়া, মালি, মরিশাস ও মরক্কো।
একজন আলজেরিয়ান নওমোবাঈন হুজুরের কাছে জানতে চান কিভাবে ফ্রান্সে আহমদীয়াতের প্রসার ঘটবে।
হুজুর বলেন “জামাতের লিফলেট বিতরণ অব্যাহর রাখতে হবে। সেখানে পবিত্র কোরআনের আয়াত, মহানবী(সাঃ) এর হাদীস, প্রতিশ্রুত মসীহ (আঃ) ও তার খলীফার উক্তি থাকবে। জামাতের সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে ফ্রান্সে মানুষের কাছে প্রকৃত ইসলামকে তুলে ধরতে হবে”।
“পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণ মানুষের ইসলামভীতি রয়েছে। এর কারণ হল তথাকথিক মসুলমান নামধারী জঙ্গী সংগঠনসমূহ। তাই আহমদী মুসলমানদের দ্বায়িত্ব হল নৈতকতার সর্বোচ্চ উদাহরণ প্রদর্শন করে এই ভীতি দূর করা। প্রত্যেক আহমদীকেই তার কর্তব্য পালন করতে হবে। সাধারণভাবে বলা যায় সকলেরই দশ জন করে বন্ধু রয়েছে। সে তার এই দশ জন বন্ধুর কাছে প্রকৃত ইসলামের বার্তা পৌছে দিবে। যদি পুরো জামাত এই কাজ করে তাহলে খুব সহজেই হাজার হাজার মানুষের কাছে ইসলামের বাণী পৌছে যাবে।”
“কিন্তু সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হবে যদি না তার জন্য আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে দোয়া না করা হয়। আমাদের কর্তব্য হল ইসলামের বাণী পৌছে দেয়া এবং বাকি ব্যাপার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়া। আমাদের কখনোই হতাশ হওয়া উচিৎ নয় কারণ একদিন পৃথিবীর মানুষ সত্যের দিকে আসবেই। একটি দেশের জীবনচক্রে এক প্রজন্ম খুব একটি উল্লেখযোগ্য সময় নয়। তাই আমাদের ধৈর্য ধরা উচিৎ।”
একজন নও মোবাঈন বলেন যে আহমদীয়াত গ্রহনের ফলে তার পরিবার ও বন্ধুগণ তার বিরুদ্বে চলে গেছে। হুজুর তাকে আশ্বস্ত করেন ও তাকে মনে করিয়ে দেন কোন বিরোধিতায় যেন তার ঈমান দুর্বল না হয়। হুজুর বলেন “মহানবী (সাঃ) ও তার সাহাবীরা কি তাদের ঈমানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন নি। তারা একের পর পর ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। তাদের উপর সকল প্রকার অত্যাচার করা হয়েছে। তাই নিজের ঈমানের জন্য একজন আহমদী মুসলমানকেও সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ”
“আহমদী হবার জন্য তোমার পরিবার ও আত্মীয় স্বজন তোমার বিরোধিতা ও অত্যাচার করবে। কিন্তু তারপরও তুমি তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে ও তাদের সুবিধা অসুবিধার দিকে লক্ষ্য রাখবে। কারণ এটিই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা।”
একজন আহমদী নও মোবাঈন বলেন “কিছুদিন পূর্বে আমি একটি স্বপ্ন দেখি। সেখানে একটি জোরালো কন্ঠ আমাকে বলে যে আমি খলীফাতুল মসীহর সাথে সাক্ষাত করব। আমি খুব অবাক হয়ে যাই যখন পরের দিনই ফ্রেঞ্চ জামাত থেকে আমাকে ফোন দেয়া হয়। তারা আমাকে প্রস্তুত হতে বলে কারণ আমরা হল্যান্ডে হুজুরের সাথে সাক্ষাত করতে যাব।”
হুজুর তার স্ত্রী সম্বন্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন যে তার স্ত্রী আহমদী নন। হুজুর বলেন “কোনভাবেই তোমার স্ত্রীকে আহমদীয়াত গ্রহণের জন্য চাপ প্রয়োগ করবে না। বরং তার সাথে সবসময় ভালবাসার সাথে ব্যবহার করবে। তোমার সদাচরণ দেখে ইনশাল্লাহ একদিন সে আহমদীয়াত গ্রহণ করবে।”
একজন নও মোবাঈন এসেছিলেন যিনি মূলত কমোরস আইল্যান্ডের অধিবাসী। কিন্তু তিনি বর্তমানে ফ্রান্সে বসবাস করছেন। তিনি হজ্জ্ব ও নন আহমদী ইমামের পেছনে নামায আদায়ের ব্যাপারে জানতে চান। হুজুর বলেন “যদি কোন আহমদী হজ্জ্বে যায় এবং পরিস্হিতির স্বীকার হয়ে বা চাপের মুখে তাকে নন আহমদী ইমামের পেছনে নামায আদায়ে বাধ্য করা হয়, তবে সে তখন তার পেছনে নামায আদায় করে নিবে। কিন্তু তার এটা মনে রাখতে হবে যে সেই ইমাম প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) কে মানেনি। তাই যখন সে সুযোগ পাবে তখন ব্যাক্তগতভাবে সেই নামায আবার আদায় করে নিবে। যদি সম্ভব হয় তাহলে আহমদীরা নিজেরা জামাত করে নামায আদায় করবে।”
এ ব্যাপারে হুজুর মুসলেহ মাউদ(রাঃ) এর একটি ঘটনা উল্লেখ করেন। হুজুর বলেন “মুসলেহ মাউদ(রাঃ) খলীফাতুল মসীহ আউয়াল(রাঃ) এর সময়ে হজ্জ্বে গিয়েছিলেন। মুসলেহ মাউদ(রাঃ) সেখানে নন আহমদী ইমামের পিছনে নামায আদায় করতে চাননি। কিন্তু তাকে বলা হল যে খলীফাতুল মসীহ আউয়াল(রাঃ) বলেছেন হজ্জ্বের সময় নন আহমদী ইমামের পেছনে নামায আদায় করা যেতে পারে। তাই তিনি সেই ইমামের পেছনে নামায পড়েন। কিন্তু তিনি নামাযে সন্তুষ্টি পান না। তাই আবার ব্যাক্তিগতভাবে নামায আদায় করেন। মুসলেহ মাউদ(রাঃ) যখন কাদিয়ানে ফিরে যান তখন খলীফাতুল মসীহ আউয়াল(রাঃ) বলেন যে তুমি ঠিক কাজই করেছো। আমার প্রকৃত নির্দেশ ঠিক এরকমই ছিল। যে যদি হজ্জ্ব নন আহমদী ইমামের পিছনে নামায আদায় করতে হয় তাহলে পরবর্তীতে ব্যক্তগতভাবে সেটি আবার আদায় করবে।”
একজন আফ্রিকান মহিলা সাম্প্রতিক আহমদীয়াত গ্রহণ করেছেন। তার দুটি সন্তান রয়েছে। তার কাহিনী শুনে আমি অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। তিনি বলেন “আহমদীয়াত গ্রহণের ফলে আমার স্বামী আমাকে ত্যাগ করেছে এবং ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। আমাকে অনেক ত্যাগ কষ্ট করতে হচ্ছে। কিন্তু আমি আহমদীয়াতের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত আছি এবং এজন্য সবরকম অত্যাচার ও বিরোধিতা সহ্য করার জন্য প্রস্তুত।”
তার কথা শুনে হুজুর অত্যন্ত ভালবাসার সাথে তাকে বলেন “আল্লাহ আপনাকে অনেক বরকতময় ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন দান করুন। আল্লাহ আপনাকে সর্বোৎকৃষ্ট ভবিষ্যত দান করুন এবং আপনার পারিবারিক জীবন সুখী হোক। আল্লাহ আপনাকে দৃঢ় বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।” সবার সাথে সাক্ষাত শেষে হুজুর জোহর ও আসরের নামায আদায় করান। এরপর ফ্রেঞ্চ থেকে আসা আহমদীগণ হুজুরের হাতে বয়াত গ্রহণ করেন।
স্থানীয় আহমদীদের আবেগ
সেদিন হুজুর ডাচ জামাতের সদস্যদের সাথেও সাক্ষাত করেন। তাদের একজন ছিলেন ওয়াদু বাজোয়া(৪২ বছর) সাহেব। তিনি মাষ্টার আব্দুল কুদ্দুস(২০১২ সালে পাকিস্তানে শহীদ হয়েছেন) সাহেবের বড় ভাই। আমি কুদ্দুস সাহেবের স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে ২০১৫ সালের প্রথম দিকে সাক্ষাত করেছিলাম। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর ওয়াদুদ বাজোয়া সাহেব বলেন “এটি আল্লাহর অশেষ রহমত যে আমাদের পূর্বপুরুষগণ আহমদীয়াত গ্রহণ করেছিলেন। না হলে আমাদের কোন অস্তিত্বই থাকত না। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের সময় তার সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতার প্রভাবে পৃথিবীর আর কোন বিষয়ই মনে থাকে না। ”
মাষ্টার কুদ্দুস সাহেব সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমার ভাই কুদ্দু্স তার ওয়াদা পূরণ করেছে। আমি নিশ্চিত যদি সে পুনরায় এই পৃথিবীতে আসে তাহলে আবার হাসিমুখে তার জীবন উৎসর্গ করবে।”
তিনি বলেন যে তার বাবা মোবারক আহমদ বাজোয়া সাহেবও সেখানে আছেন। তাই আমি তার সাথে দেখা করতে যাই। তিনি খুবই বয়স্ক ও বুর্বল মনে হচ্ছিল। কথা বলার সময় তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি বলেন “আমাদের পরিবার বড়ই ভাগ্যবান। কারণ আমার ছেলে কুদ্দুস তার ধর্মের জন্য শাহাদাত বরণ করেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন যোগ্যতাই নেই। কিন্তু আল্লাহতাআলা আমাকে একজন শহীদের বাবা হবার পরম সম্মান দান করেছেন। আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে দোয়া করি যেন তিনি আমার ছেলের কোরবানী কবুল করেন।”
হুজুরের ভালবাসা সম্বন্ধে তিনি বলেন “কিছু বছর পূর্বে আমার মেয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং সে খুব অসুস্থ হয়ে যায়। সে হুজুরের একজন নিরাপত্তা কর্মীর(ইজাজ উর রহমান) স্ত্রী ছিল। তার অসুস্হতার সময় আমার মেয়ে ও আমাদের পরিবারের প্রতি হুজুর অসামান্য ভালবাসা প্রদর্শন করেন। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার মেয়ে ইন্তেকাল করে। এরপর আমাদের প্রতি হুজুরের ভালবাসা আরো বৃদ্ধি পায়। হুজুর আমাদের জন্য দোয়া করেন ও আমাদের ধৈর্য ধরার উপদেশ দেন। আমাদের উপর খিলাফতের ছায়া ও ভালবাসা সত্যিই একটি অনন্য।”
তার কথা শূনে আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। তার ছেলে শহীদ হয়েছে এবং তার মেয়ে ক্যান্সারে মারা গেছ। কিন্তু তারপরও তার কোন রাগ বা দুঃখ নেই। বরং তিনি বারবার এই কথাই বলতে থাকেন যে তার পরিবার অনেক ভাগ্যাবান। এরকম ধৈর্য, বিশ্বাস ও অবিচলতা একমাত্র আল্লাহর প্রকৃত জামাতেই থাকা সম্ভব।
আমি আর একজন ডাচ আহমদী আব্দুল হক কম্পিয়ার (৪০ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি ২০০০ সালে আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। তিনি বলেন “আহমদীয়াত আমার জীবনকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। এটি আমার হদয়কে প্রশান্তি দান করেছে। আমার মনে ধর্ম সম্বন্ধে যে সকল প্রশ্ন ছিল আমি সবগুলোর সন্তোষজনক জবাব পেয়েছি। খিলাফতের সৌন্দর্যও সকল আহমদী আমার হৃদয়কে জয় করে নিয়েছে। আমার মনে হয়েছে আমি সারা জীবন এই জিনিসের খোজেই ছিলাম। এখন আমার জীবনের একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। আমি পূর্বের চেয়ে আরো ভাল মানুষে পরিণত হয়েছি।”
“আমি অনেক ভাগ্যবান কারণ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি হুজুরের সাথে সাক্ষাত করতে পেরেছি। হুজুরের দয়া ও প্রজ্ঞা অসাধারণ। অনেক সময় হুজুর একটি নির্দেশ দেন যার গুরুত্ব আমরা তখন বুঝতে পারিনা। কিন্তু কিছু সময় পরে সেই নির্দেশের প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়। হুজুর শুধু আমার খলীফাই নন তিনি আমার বন্ধুও। যেকোন সমস্যা আমি হুজুরকে জানাই এবং হুজুর চিন্তা করে আমাকে সমস্যার সমাধান দেন। আমার কোন সমস্যাই আমার কাছে ছোট বলে মনে হয় না, তাই আমি যেকোন সমস্যাই হুজুরকে জানাতে পারি।”
আমি ওয়াকার রানজাহ(২৯ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি আলমীর শহরে সমাজসেবক হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন “আমরা সকলেই দুর্বল। তাই মাঝেমাঝেই আমরা ভুল কাজ করি। অন্যান্য আহমদীদের সব কাজও আমাদের সবার পছন্দ হয় না। কিন্তু হুজুরকে দেখলে আমরা এসব ছোটখাট জিনিস ভুলে সবাই এক হয়ে যাই। আমরা যুঝতে পারি ইসলামের শিক্ষা পরিপূর্ণ ও সুন্দর। ফলে আমরা ইসলামের দিকে আরো গভীরভাবে আকৃষ্ট হই।”
আমি ড: যুবায়ের আকমল(ডেন্টিস্ট) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি হল্যান্ড ন্যাশনাল আমেলায় অনেকদিন ধরে কাজ করছেন। তিনি বলেন “হুজুর আমাদের সেকল দুর্বলতাও দেখেন যেগুলোকে আমরা লক্ষ্য করি না অথবা গুরুত্ব দেই না। অতীতে হুজুর আমাদের কিছু আমেলা মিটিং এ উপস্হিত ছিলেন। তিনি প্রত্যেক বিভাগের দিকেই লক্ষ্য দিতেন। তিনি আমাদের বলেন অন্যদের উপর নির্ভর না করে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে। হুজুর কেবল আধ্যাত্মিক নেতা নন বরং প্রশাসনিক নেতা হিসেবেও অসাধারণ।”
একজন নতুন বন্ধু
হল্যান্ড সফরে আমি সাফির সিদ্দীকের(২৬ বছর) সাথে অনেক সময় কাটাই। সে জামেআ আহমদীয়া ইউকে থেকে পাশা করা মোবাল্লেগদের প্রথম ব্যাচ। জামেআতে হুজুরের ভালবাসা ও দিক নির্দেশনা সম্বন্ধে সে বলে “সাত বছর জামেআ থাকা অবস্হায় হুজুর আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দিক নির্দেশনা দিতেন। প্রকৃত কথা হল আমাদের কোন মোবাল্লেগের যদি কোন একটি যোগ্যতাও থাকে তাহলে তার কারণ হল হুজুরের দোয়া ও ভালবাসা। আমি নিশ্চিত যে আমার ব্যাচের সকল মোবাল্লেগগণই এ ব্যাপারে একমত হবেন। ”
“জামেআতে হুজুর ছাত্রদের খাবারের মেনু ঠিক করে দিতেন। তিনি মাঝে মাঝে আমার বিছানা ও আলমারীর অবস্হা দেখার জন্য আমার রুমেও আসতেন।”
হল্যান্ডে পোস্টিং দেবার পর সে হুজুরের সাথে দেখা করতে যায়। হুজুর তাকে বলেন “তোমার দু্টি প্রধান উদ্দেশ্য রয়েছে। একটি হল তোমাকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে হবে এবং তাঁর সাথে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরী করতে হবে। এর দ্বিতীয় কর্তব্য হল জামাতের সদস্য ও আল্লাহর মধ্যে সম্পর্ক স্হাপন করা। ”
হল্যান্ড সফরে হুজুরের মিডিয়াতে সাক্ষাতকারের ব্যবস্হার জন্য সাফিরকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। এ ব্যাপারে সে বলে “প্রত্যেক সাংবাদিক সাক্ষাতকারে পর বলেছে যে তারা হুজুরকে দেখে অভিভূত। আমি একজন সাংবাদিকের ব্যাপারে কিছুটা চিন্তিত ছিলাম যে সে কোন বিরূপ মন্তব্য করে ফেলে কিনা। কারণ আমি জানতাম সে ইসলামবিরোধী ছিল। কিন্তু সেই হুজুরের বার্তা শুনে বেশী প্রভাবিত হয়েছে। এর ফলে আল্লাহ ও খলীফাতুল মসীহ প্রতি আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়েছে। ”
“আমার হল্যান্ডে পোস্টিং হবার পর হুজুরের এটাই প্রথম হল্যান্ড সফর। তাই এখানকার স্হানীয় আহমদীগণ আমার সাথে মজা করে বলত যে তুমি এখানে আসার আগে হুজুর নিয়মিত হল্যান্ড আসতেন। কিন্তু তুমি আসার পর তা বন্ধ হয়ে গেছে। এটি সম্পূর্ণ তোমার দোষেই হয়েছে। কিছুদিন পর আমিও চিন্তা করতে থাকি যে হয়ত তাদের কথাই ঠিক। তাই হুজুর এখানে আসার পর আমি অত্যন্ত আনন্দিত। তাদের এই মতবাদ এখন আর চলবে না।”
একটি বিশেষ কলা
১১ অক্টোবর রাতের নামায ও খাবার শেষে আমরা যেখানে থাকি সেখানে হুজুর আসেন। আমি যে ডাইনিং টেবিলে কাজ করছিলাম হুজুর সেখানেই বসেন। হুজুর লক্ষ্য করেন আমি যেখানে কাজ করছিলাম সে টেবিলের একপাশে একটি ফলের ঝুড়ি রয়েছে। সেখানে কলা, আঙুর ও নাশপাতি রয়েছে। হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমরা এগুলো কেন খাইনি। আমি বললাম আমরা যেহেতু হুজুরের বাসস্হানে রয়েছি তাই তার অনুমতি না নিয়ে তো আমরা এসব ফল খেতে পারি না।
হুজুর বলেন এতদিনে তো আঙুরগুলো অবশ্যই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম যে দেখে তো ভাল আছে বলেই মনে হচ্ছে। হুজুর আমার কথায় আশ্বস্ত হলেন না। তিনি বলেন যে আঙুর খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। হুজুরের কথাই পরে সত্য প্রমাণিত হয়। হুজুর চলে যাবার পর আমি দেখি যে আঙুরের নিচে সাদা ছত্রাক জমেছে।
এরপর হুজুর কলার দিকে মনোনিবেশ করেন। হুজুর বলেন যে দেখে তো মনে হচ্ছে বেশি পেকে গিয়েছে। হুজুর আমাকে একটি কলা দিতে বলেন। কলাটির উপরে বাদামী দাগ হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হল যে এটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু হুজুর বলেন “আমি এরকম কলাই পছন্দ করি এবং এটি দেখে নষ্ট মনে হলেও আসলে ভেতরে ভালই রয়েছে। বাসাতেও আমি কলা খাবার পূর্বে কিছুদিন পাকার জন্য রেখে দেই।”
কলাটীর বাইরের অবস্থাদেখে আমি হুজুরের কথায় কিছুটা সন্দিহান ছিলাম। কিন্তু হুজুর যখন কলাটি ছিললেন তখন দেখা গেল যে আসলে সেটি ভালই রয়েছে। হুজুর তার হাত দিয়ে কলাটি দুভাগ করলেন এবং একভাগ আমাকে খেতে দিলেন। আমি এক কামড় দেবার পর হুজুর সেটি আবার আমার হাত থেকে নিলেন। হুজুর আমার অংশে একটি কাল অংশ দেখেছেন তাই সেটি সরিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি হুজুরের হাত পরিস্কার করার জন্য টিস্যু নিয়ে আসি। এপর হুজুর অর্ধেক ও আমি বাকি অর্ধেক কলা খাই। আমি জীবনে যত কলা খেয়েছি তার মধ্যে এটি সবচেয়ে স্মরণীয় ও সবচেয়ে মজাদার কলা ছিল, কারণ আমি এটি হুজুরের সাথে ভাগ করে খেয়েছি।
হুজুর এরপর টেবিলে জাপানিজ বিস্কুট দেখেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমরা এটি খেয়েছি কিনা। আমি বলি যে এটিও একই কারণে খাওয়া হয়নি। হুজুর প্যাকেট খুলে নিজে কয়েকটি নিয়ে আমাকে বাকিগুলো দিয়ে দেন। আমি সেটি লন্ডনে আমার স্ত্রী ও ছেলের জন্য নিয়ে যাই। সেই কয়েক মুহুর্ত আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহুর্ত।
হুজুরের সাথে কিছু স্মরণীয় মুহুর্ত
হুজুর আমাকে সারাদিন কার সাথে দেখা করেছি তা জানতে চান। আমি হুজুরকে জামাতের তরুণ মোবাল্লেগ সাহেব সাফির সিদ্দীকের কথা বলি। তাকে স্থানীয় জামাতের লোকজন এই কথা বলে জ্বালাতন করত যে তিনি এখানে আসার পর হুজুর আর হল্যান্ডে আসেন না। হুজুর হাসতে হাসতে বলেন “এখন তো তাদের আনন্দিত হওয়া উচিৎ। কারণ পূর্বে আমি কখনো ৪-৫ দিনের বেশি হল্যান্ডে থাকিনি। কিন্তু ইনশাল্লাহ এবার আমি ১০ দিন থাকব।”
“এত দিনে নিশ্চয় তোমার ডায়েরী লেখার মতো অনেক কিছু পেয়েছো। কিন্তু সবগুলো একভাগে প্রকাশ না করে দুটি ভাগ করবে যাতে মানুষের পড়তে সুবিধা হয়। ”
হুজুর আমাকে সাইক্লিং সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেন। আমি বলি যে সাইক্লিং করে অনেক আনন্দ পেয়েছি কিন্তু আবহাওয়া অনেক ঠান্ডা ছিল। হুজুর বলেন “আবহাওয়া কেবল ঠান্ডা নয়, একবারে হাড়কাপানো শীত ছিল। তাই আমি এক হাতে সাইক্লিং করছিলাম ও অন্য হাত পকেটে রেখে তা গরম করতে চাচ্ছিলাম। কালকের সাইক্লিং এর জন্য আমি গ্লাভস বের করে নিয়েছি।”
হুজুরের অনুপম দয়া ও ভালবাসা
পরদিন সকালে ফযরের নামাযের পর আমি আমার রুমে এসে সাইক্লিং এর জন্য প্রস্তুত হই। সে সময় আহমদ ভাই আমাকে ডেকে একজোড়া মোটা উলের গ্লাভস দেন। হুজুর সেগুলো আমাকে দেবার জন্য তাকে দিয়েছেন। আমার জন্য হুজুরের দয়া ও ভালবাসা দেখে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও অবাক হয়ে যাই। আমার কাছে কোন হাত গ্লাভস ছিল না। তাই আমি ভাবছিলাম পায়ের মোজা দিয়ে কাজ চালিয়ে নিব।
কুদ্দুস সাহেব আমাকে বলেন যে নামাযের পর হুজুর নিজের রুমে না যেয়ে গাড়ির মধ্যে থেকে আমার জন্য হাতের গ্লাভস বের করে আহমদ ভাইকে দেন। এটা শোনার পর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। আমি শুধু বলতে পারি আলহামদুলিল্লাহ ও মাশাআল্লাহ। হুজুরের প্রতি ভালবাসায় আমার হৃদয় পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু আমি কিছুটা লজ্জ্বিত ছিলাম কারণ আমার জন্য হুজুরের কিছু মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে।
আগের দিন আমি কিছুটা দুঃখিত ছিলাম কারণ আমি কোন গ্লাভস নিয়ে আসিনি। কিন্তু আজ আমি এজন্যই অনেক আনন্দিত।
হ্রদের পাশে কিছু সময়
গত দুই দিনের মতই হুজুর ৭.৪৫ মিনিটে তার বাসা থেকে বেরিয়ে সাইক্লিং শুরু করে দেন। আমরা গত দিনের রাস্তা ধরেই এগিয়ে যাই। কিন্তু ফেরার সময় হুজুর নানপেস্ট হ্রদের পাশে কিছু সময়ের জন্য থামেন।
হুজুর আমাকে ডেকে জানতে চান যে গ্লাভস পড়ার ফলে কোন লাভ হয়েছে কিনা। আমি বলি যে গ্লাভস খুবই ভাল কাজ দিয়েছে। সাইক্লিং এর পুরো সময়ই আমার হাত গরম ছিল। আমি হুজুরকে তার গ্লাভস সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করি। হুজুর বলেন “আমার গ্লাভস খুবই ভাল কাজ করেছে। সাইক্লিং এর শেষ পর্যায়ে আমার হাত একটু বেশীই গরম হয়ে গিয়েছিল।”
হুজুর আব্দুল্লাহ সাপরাহ সাহেবের দিকে তাকান ও তাকে লেকের চারপাশে দৌড়াতে বলেন। সাপরাহ সাহেব সাথেসাথেই দৌড় শুরু করে দেন। এটি খিলাফতের প্রতি আনুগত্যের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত যেটি আমার মনে দাগ কেটেছে। কারণ সাপরাহ সাহেবের বয়স প্রায় ৫০ বছর। কিন্তু হুজুরের নির্দেশ শোনামাত্রই তিনি যত জোরে পারেন দৌড়াতে শুরু করেন। এতে তিনি কোনরকম সংকোচ বা তিনি আঘাত পেতে পারেন এরকম কোন চিন্তা করেননি। তিনি দৌড়ানোর জন্য উপযুক্ত জুতা ও কাপড় কোনটাই পড়েননি। কিন্তু এগুলো নিয়ে তার কোন চিন্তাই ছিলনা। দৌড় থেকে ফিরে এসে তিনি হুজুরকে বলেন “আমাকে দৌড়াতে বলার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এখন আমি অনেক সতেজ অনুভব করছি।”
হুজুর হাসতে হাসতে বলেন “এজন্যই আমি আপনাকে দৌড়াতে বলেছিলাম।”
লন্ডনে বসবাসরত মোহাম্মদ ডগার সাহেব আমার বন্ধু। তিনি একজন ওয়াকফে জিন্দেগী এবং বর্তমানে এমটিএ তে কাজ করছেন। তিনি পারিবারিক সফরে হল্যান্ডে এসেছেন। সেদিন তিনিও আমাদের সাথে সাইক্লিং করতে এসেছেন। হুজুর তাকে দেখার পর তাকে ও আরো কয়েকজন এমটিএর সদস্যদের লেকের পাশে দৌড়াতে বলেন। তারা দৌড় শুরু করার পর হুজুর বলেন যে যখন তারা ক্লান্ত হয়ে যাবে তখন যেন ফিরে আসে। কিন্তু কিছুটা দূরে চলে যাবার কারণে তারা হুজুরের এই নির্দেশ শুনতে পায়নি। তাই তারা সম্পূর্ণ লেক ঘুরে আসে। সেটি অনেক বড় দূরত্ব ছিল।
মুজাম্মিল অনেক সুঠাম এবং সে জামাতের ইজতেমা ও অন্যান্য খেলাধুলায় বিজয়ী হয়ে থাকে। তার কাছেও সম্পূর্ণ লেক ঘুরে আসা অনেক কষ্টকর ছিল। এপর হুজুর দয়া করে উপস্হিত সকলের সাথে ছবি তোলার অনুমতি দেন। প্রথম ছবিতে ছিলেন হুজুরের নিজস্ব কাফেলা যারা লন্ডন থেকে তার সাথে এসেছেন। পরবর্তী ছবিতে হল্যান্ড জামাতের সদস্যগণ। এরপর কয়েকজন খোদ্দাম যারা নিরাপত্তা ডিউটি দেবার জন্য জার্মানী থেকে এসেছেন। এমটিএ র সদস্যগণ তাদের দৌড় থেকে আসার পর হুজুর তাদের সাথেও একটি ছবি তুলেন। সবশেষে ওমর আলিম সাহেব যিনি সকলের ছবি তুলে দিচ্ছিলেন, তিনিও হুজুরের সাথে ছবি তোলার সুযোগ পান। তখন সেখানে উপস্হিত সকল সদস্যই হুজুরের সাথে ছবি তুলার সৌভাগ্য লাভ করেন।
আমরা যখন মসজিদে ফিরলাম, আমি লক্ষ্য করলাম যে সকল ব্যক্তিদের মুখেই হাসি লেগে রয়েছে। তাদের অনেক আনন্দিত মনে হচ্ছিল। একমাত্র খিলাফতের প্রতি ভালবাসাই এরকম আনন্দ ও সন্তুষ্টির কারণ হতে পারে।
ইউনিএক বেকারীতে সকালের নাশতা
আমি আমার রুমে যেয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল করার কথা চিন্তা করছিলাম। তখন আহমদা ভাই আমার কাছে এসে বলেন যে সাইকেল নিয়ে বের হবার জন্য কারণ কিছু কাফেলা সদস্য ও স্হানীয় খাদেম কাছেই একটি ক্যাফেতে যাচ্ছে। আমি খুবই ক্লান্ত ছিলাম, তাই আমার যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আহমদ ভাই পুরো সফরে আমার সাথে অনেক দয়ালু ব্যবহার করেছেন। তাই আমি আমার এই রুমমেটের অনুরোধ ফেলতে পারলাম না এবং তাদের সাথে যেতে রাজী হলাম।
কয়েক মিনিট সাইক্লিং করে আমরা একটি সুন্দর ক্যাফেতে আসলাম যেটির নাম ছিল ইউনিএক বেকারী। সেখানে আমরা গরম কফি, বিস্কিট ও রুটি খেয়ে এক ঘন্টা সময় কাটাই। খাজা কুদ্দুস সাহেব জানতেন যে আমার মিষ্টি খাবারের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। তাই তিনি আমাকে এক টুকরো কেক খেতে বলেন যেটি তিনি অর্ডার করেছেন। এত সকালে আমি কেক খেতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমি তার অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। কেকটি অনেক সুস্বাদু ছিল।
ক্যাফের অন্যান্য সকল সদস্য ছিল স্হানীয় ডাচ। তাই ক্যাফেতে ১৫ জনের মতো এশিয়ান লোক দেখে ক্যাফের মালিক কিছুটা অবাক হন। তিনি একটি ক্যামেরা এনে আমাদের ছবি তুলেন। তিনি বলেন যে এই ছবি তিনি সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করবেন। তিনি আমাদেরকে বিনামূ্ল্যের বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
কেনাকাটা
হুজুর ও তার স্ত্রী নিজেদের জন্য খুব কমই সময় পান। যেসব জিনিস আমরা খুব সাধারণ ভাবে নেই যেমন কেনাকাটা করা, একসাথে খেতে যাওয়া ইত্যাদি তাদের জন্য খুবই বিরল ঘটনা। তাই ১২ অক্টোবর সোমবার আমি অত্যন্ত আনন্দিত হই যখন আহমদ ভাই আমাকে জানান যে সকল কাফেলার গাড়ীকে প্রস্তুত হবার জন্য কারণ হুজুর ও তার স্ত্রী কাছের একটি শহর (যোলে) র একটি শপিং সেন্টার ভ্রমণ করবেন।
দুপুর ১২.৪০ মিনিটে আমরা রওনা হই এবং ১ টার দিকে সেখানে পৌছাই। হুজুর ও তার স্ত্রী ভিএন্ডডি নামে একটি বহুতল শপিং কমপ্লেক্সে যান। সেখানে প্রায় দুই ঘন্টা ধরে তারা বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখেন। অন্যান্য সাধারণ ভ্রমণার্থীদের মতোই হুজুর বিভিন্ন কাপড় ও জিনিস দেখতে থাকেন। মাঝেমাঝে হুজুর তার চশমা পড়ে বিভিন্ন পণ্যের লেভেল ট্যাগও পড়েন। একটি রান্নার সামগ্রীর দোকানে হুজুর কিছু একটি জিনিস কেনার জন্য সেখানে কর্মরত একজনকে কিছু জিজ্ঞেস করেন। আলহামদুলিল্লাহ, সবশেষে মনে হল হুজুর ও তার স্ত্রী তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনতে পেরেছেন।
এটি একটি বিরল অভিজ্ঞতা ছিল। এদিন হুজুর ও তার স্ত্রী অন্যান্য সাধারণ স্বামী-স্ত্রীর মতো বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখতে পেরেছেন। আমি হুজুরের স্ত্রীর জন্যও অনেক আনন্দিত হই। হুজুর খলীফা হবার পর তাকেও জামাতের জন্য প্রতিনিয়ত অনেক আত্মত্যাগ করতে হচ্ছে।
কেনাকাটার জন্য কিছু বিশেষ উপদেশ
আমি ও অন্যান্য কাফেলা সদস্যরাও বিভিন্ন দোকানে ঘোরাফেরা করছি। আমি একটি বড় রেইনকোট খুজছিলাম। একটি দোকানে আমি যেরকম খুজছিলাম সেরকম একটি রেইনকোট দেখতে পাই। আমি কয়েকজন কাফেলা সদস্য ও আহমদভাইকে রেইনকোটটি দেখাই। তারা সকলেই বলে যে এটিকে ভালই মনে হচ্ছে। সসময় হুজুরও আমার কাছ দিয়েই হেটে যাচ্ছিলেন। তাই আমি চিন্তা করি যে হুজুরের মতামতটাও নিয়ে নেই।
হুজুর কয়েক মুহুর্ত ভালভাবে রেইনকোটটি দেখেন ও বলেন “রেইনকোটটি ভালই, কিন্তু এটি একটু আটসাট ও ছোট মনে হচ্ছে।”
আমি হুজুরকে তার উপদেশের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমি রেইনকোটটি আর না নিয়ে সেটি দোকানে রেখে দেই। আমি সেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই তা হলো; ছেলেদের আটসাট কোট পরা উচিৎ নয়। আমি লক্ষ্য করলাম যে হুজুরও সবসময় ঢিলেঢালা ওভারকোট পড়ে থাকেন। আলআমদুলিল্লাহ, হুজুরের উপদেশ আমার জন্য অনেক বরকতময় বলে প্রমাণিত হল। কারণ লন্ডনে যেয়ে আমি তার চেয়ে আরো ভাল একটি রেইনকোট পাই।
হজুরের বায়তুন নূর কমপ্লেক্স পরিদর্শন
১২ অক্টোবর বিকেলে হুজুর বায়তুন নূর নানপেস্ট কমপ্লেক্স পরিদর্শন করেন। হুজুর রান্নাঘর ও সেখানকার স্বেচ্ছাসেবক, লাজনা হলরুম ও লাজনা রান্নাঘর পরিদর্শন করেন। এপর হজুর প্রত্যেক অতিথিদের রুম পরিদর্শন করেন, যেখানে বেশিরভাগ কাফেলা সদস্য রয়েছেন।
হুজুর মুনীর জাভেদ সাহেব ও মাজীদ সাহেবের রুমে যেয়ে জানতে চান যে অতিথিদের রুমের যে মান থাকা উচিৎ তা বজায় রাখা হচ্ছে কিনা। তারা বলেন যে সবকিছু ঠিক আছে। হুজুর বলেন “এসব ব্যাপার অনেক গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করা উচিৎ। যেন যেসব স্হানে দুর্বলতা রয়েছে ভবিষ্যতে সেসব কাটিয়ে উঠা যায়। ”
হুজুর ওমায়ীর আলীম সাহেবের রুমও ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। বেডরুম, টয়লেট ও ছোট রান্নাঘরও পর্যবেক্ষণ করেন। হুজুর বিল্ডিং এর উপরের তলার অবস্হা জানতে চান যেখানে পূর্বে বায়তুন নূর মসজিদ ছিল। স্হানীয় জামাত বলে যে সেখানকার অবস্হা বর্তমানে সর্বোত্তম নয়। হুজুর বলেন যে “সেখানকার মানও দ্রুত উন্নত করা প্রয়োজন। পরিস্কারের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের উচিৎ অতিথিদের রুম কেবল যখন অতিথি আসবেন তখন নয় বরং বছরের সবসময়ই পরিচ্ছন্ন রাখা। আমি আশা করি আমার পরবর্তী হল্যন্ড সফরের সময় এমটিএ দলকে নানপেস্ট কমপ্লেক্সেই থাকার ব্যবস্থা করা হবে।”
কিছু মূল্যবান মুহুর্ত
রাতের নামায ও খাবার শেষে আমি ৯.৪৫ মিনিটে আমার রুমে আসি। কিছুক্ষণ পর হুজুর বেসমেন্টে আমাদের রুমে আসেন। তাই হুজুরের সান্নিধ্যে আমার কিছু বরকতময় সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়। হুজুর আমাকে সকালের শপিং কমপ্লেক্সের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেন। আমি বলি যে ঢিলেঢালা কোট পরার ব্যাপারে হুজুরের উপদেশের জন্য আমি অনেক কৃতজ্ঞ। আমি এটা মনে করে আনন্দিত যে আমি সেই কোটের জন্য কোন টাকা নষ্ট করিনি।
হুজুর বলেন “নানপেস্টের স্হানীয় মার্কেট অনেক সুন্দর। খিলাফতের পূর্বেও আমি নানপেস্টের শপিং কমপ্লেক্স আসতে পছন্দ করতাম। সেখানে ব্লকার নামে একটি দোকান রয়েছে। যেখানে কম দামে ভাল জিনিস পাওয়া যায়। তুমি সেখানে একবার ঘুরে আসতে পার।”
গতরাতে আমি হুজুরের সাথে একটি কলা ভাগাভাগি করা খাবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। হুজুর আজকেও ফলের ঝুড়ির দিকে তাকান। সেখানে এখনো একটি কলা দেখতে পান। সেটি গতদিনের থেকেও পাকা ও আরো বেশী কালো দাগে পূর্ণ ছিল। তবুও হুজুর আমাকে কলাটি আনতে বলেন। হুজুর এক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলেন “ইনশাল্লাহ কলাটি ভালই থাকবে।”
হুজুরের কথামতোই হুজুর যখন কলাটি ছিললেন দেখা গেল যে কলাটি ভালই রয়েছে এবং মোটেও বেশী পেঁকে যায়নি। গতদিনের মতোই হুজুর কলাটি দুভাগ করে একভাগ নিজে নিলেন ও আর এক ভাগ আমাকে দিলেন।
সেদিন হুজুরের সফরসূচিতে কোন মোলাকাত ছিল না। কিন্তু তারপরও হুজুর সকাল ও সন্ধ্যায় অফিসে গিয়েছেন। হুজুরকে আমি এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি। হুজুর বলেন “আজকে কোন মোলাকাত ছিল না। কিন্তু সকল জামাতী প্রতিবেদন ও মানুষের চিঠি দেখার জন্য আমার অফিসে যাওয়া প্রয়োজন ছিল।”
হুজুর তার রুমে যাবার জন্য উঠে দাড়ালে আমি হুজুরকে গ্লাভস দেবার জন্য ধন্যবাদ জানালাম। হুজুর বলেন “ইনশাল্লাহ সেগুলো পুরো শীতেই তোমার হাতকে গরম রাখবে।”
লেকের পাশে বাঁশি শোনা
পরদিন ১৩ অক্টোবর ফযরের পর হুজুর তার কাফেলাসহ সাইক্লিং করতে বের হন। গতদিনের মত এদিনও হুজুর লেকের পাশে থামেন। হুজুরকে রান্নার একজন স্বেচ্ছাসবকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সে বলে যে সে বাশিঁ বাজাতে পারে। সে হুজুরের কাছে শোনানোর জন্য অনুমতি চায়। হুজুরের অনুমতি নিয়ে সে পাচঁ মিনিট বাঁশি বাজায়। সে বাঁশিতে একটি বিষাদময় সুর বাজায়। তার বাঁশি বাজানো শেষ হলে কুদ্দুস সাহেব হুজুরকে বলেন যে আহমদ ভাইও বাঁশি বাজাতে পারেন। আহমদ ভাই বলেন যে আমি তিনি কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তিনি আসলে পারেন না। যাহোক এরপর তিনি কয়েকটি নোট বাজান।
স্থানীয় আহমদীদের আবেগ
সেদিন আমি কয়েকজন আহমদীদের সাথে কথা বলি। তাদের একজন হল মোহাম্মদ আফযাল মালহি(৪৫ বছর)। তিনি লঙ্গরখানায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৮৮ সাল থেকে হল্যান্ডে আছেন। খিলাফতের প্রতি আবেগ ও অনুভূতি সম্বন্ধে তিনি বলেন “হুজুরকে একজন যতই দেখবে, ততই হুজুরকে আরো বেশী করে ভালবাসবে। হুজুর এখানে আসার পর আমাদের মনে হচ্ছে আমরা এক নতুন আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করেছি। আমি চাই না যে এই সফর কখনো শেষ হোক। কিন্তু আগামীকালই হুজুর চলে যাচ্ছেন। আমি হুজুরের থেকে দূরে চলে যাব এটি চিন্তা করেই আমার শরীর খারাপ লাগছে।”
“আমরা একটি শহরে থাকি যেটি এখান থেকে ১২০ কিমি দূরে। আমি এখানে চলে আসার চিন্তা করেছি। কিন্তু আমার সন্তানগণ শহরে থাকতেই পছন্দ করে। কিন্তু এ সপ্তাহে তারা নিজেরাই আমার কাছে এসে বলে যে আমাদের উচিৎ নানপেস্টে চলে আসা, যেন হুজুর যখনই এখানে আসবেন তখন যেন আমরা হুজুরের সাথে বেশী সময় কাটাতে পারি।”
আমি মির্যা ফারহান শোকার (৩৫ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি নিরাপত্তা দলের একজন কর্মী। কথা বলার সময় তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। সে বলে “হল্যান্ডে আসার পূর্বে আমি ৩ বছর থাইল্যান্ডে আটকে ছিলাম। সেখানে আমি আমার এসাইলাম কেসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেটি অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। কিন্তু হুজুরকে দেখে আমি অতীতের সকল কষ্ট ভুলে গেছি। আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহপাক আমার ও আমার পরিবারের উপর অশেষ বরকত নাযেল করেছেন। আমি কসম খেয়ে বলছি যে আমার পরিবার, সন্তান ও আমার জীবন সবসময় খিলাফতের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত। আমরা খিলাফতকে আমাদের জীবনের থেকেও বেশী ভালবাসি। ”
আমি সাজিদ মাজিদ(২৯ বছর) নামে একজন খোদ্দামের সাথে কথা বলি। সে দুই বছর পূর্বে পাকিস্তান থেকে হল্যান্ডে এসেছে। সে বলে “এই সফরে আমি নিরাপত্তা দলের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য লাভ করেছি। তাই আমি আমার নাতি-নাতনী দের বলতে পারব যে আমি খিলাফতে ওয়াক্তের সেবা করেছি। এই সময়ে আমরা দুনিয়ার বিষয় থেকে আমাদের ঈমানকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমি বলতে পারি যে এর ফলে যে তৃপ্তি ও আনন্দ পাওয়া যায় তা অন্য কোনভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়। আমার কেবল একটিই চাওয়া যদি হুজুর এখানে সবসময়ের জন্য থাকতে পারতেন।”
ব্লকার সফর
গতদিন হুজুর আমাকে বলেছিলেন ব্লকার শপে যাবার জন্য। তাই জোহর ও আসরের নামায পড়ে আমি ও আহমদ ভাই সাইকেল নিয়ে নানপেস্ট টাউন সেন্টারে যাই। সেখানে আমরা ব্লকার শপে যাই। আমরা দেখলাম যে সেটি কোন বিশাল ও জাকজমকপূর্ণ দোকান নয়। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস অনেক কম দামে পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডেও উইলকো নামে এরকম একটি দোকান রয়েছে।
আমি চিন্তা করলাম যে বিশ্বের বিভিন্ন নেতাগণ বিভিন্ন অভিজাত দোকানে কেনাকাটা করেন। সেখানে আমাদের হুজুর অত্যন্ত সাদামাটা ও সহজ সরল জীবন যাপন করেন। হুজুর যে এই দোকান পছন্দ করেন এটি তার সহজ সরল জীবন যাপনের আর একটি দৃষ্টান্ত। হুজুরের ব্লকার সফরের উপদেশ অনেক উপকারী বলে প্রমাণিত হল। আমি আমার ছেলে মাহিদ ও স্ত্রী মালার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে উপহার কিনতে পারি। আমি মাহিদের জন্য একটি কী-বোর্ড(গান বাজানোর যন্ত্র) কিনে দেই। সেটি তার খুব পছন্দ হয় কিন্তু আমাদের কানের উপর এজন্য অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। আমার স্ত্রীর জন্য কিছু পানীয় গ্লাস নেই, যেটি তার খুব পছন্দ হয়।
স্থানীয় মোবাল্লেগের বাসায় হুজুরের সফর
বিকেলে হুজুর সেখানকার মোবাল্লেগ সাহেব সাফীর সিদ্দীক এর বাসায় যান। সেখানে হুজুর প্রায় ৩৫ মিনিট ছিলেন। সফরের পর আমি তার সাথে কথা বলি। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে হুজুর তার বাসায় এতক্ষণ ছিলেন। সে বলে যে এই সময়কে কেবল একভাবেই বর্ণনা করা যায় “দুনিয়াতেই বেহেশত”।
তিনি বলেন “হুজুর আফ্রিকাতে তার সময়ের কথা বলছিলেন। সেখানে হুজুরের বেতন অন্যান্য আহমদী ডাক্তার ও মোবাল্লেগদের থেকে কম ছিল। কিন্তু তারপরও তাদের অর্থই আগে শেষ হয়ে যেত এবং হুজুর বিভিন্ন ভাবে তাদের সাহায্য করতেন। মাঝেমধ্যে হুজুরের স্ত্রীকেও অনেক কম সময়ের মধ্যে ৪০-৫০ জন লোকের খাবার রান্না করতে হতো। তাই হুজুর আমার স্ত্রীকেও অতিথিপরায়ণ হতে উপদেশ দেন। ওয়াকফে নও মেয়েদের এটি কর্তব্য যে তারা অন্যদের সুবিধার জন্য ব্যক্তিগত আরাম আয়েস পরিত্যাগ করবে। ”
আমীর সাহেবের সাথে কয়েক মিনিট
সেদিন বিকেলে আমি হল্যান্ড জামাতে আমীর হেবাতুন নূর সাহেবের(৭৩ বছর) সাথে কথা বলি। তাকে অনেক সরল ও দয়ালু মানুষ বলে মনে হল। তিনি ১৯৬৮ সালে আহমদীয়াত গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৫ সাল থেকে হল্যান্ড জামাতের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন “পঞ্চম খলীফার যুগ জামাতের জন্য অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে জামাত উন্নতি করছে। আমি দেখেছি খিলাফতের প্রতি আহমদীদের আনুগত্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সফরের সময় একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী আমাদের মসজিদে এসে বলেন যে আহমদী মুসলমান ও খলীফার মধ্যে ভালবাসার এমন সম্পর্ক আমি কখনো দেখিনি।”
হুজুরের সাথে তার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি বলেন “হুজুরের একটি অসাধারণ গুণ রয়েছে। তিনি যাদের সাথে সাক্ষাত করেন তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করেন। আমি অবাক হয়ে যাই যে অনেক বছর পরও তিনি আমার জীবন ও অনেক আহমদীদের জীবন সম্বন্ধে এত কিছু জানেন। ভালবাসার মাধ্যমে হুজুর সবাইকে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি অনেক ক্ষমাশীল। আমি অনেক ভুল করে থাকি। কিন্তু হুজুরের ভালবাসাই আমাকে আশা ও সাহস যোগায় যাতে আমি ভুল কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারি।”
শেষবারের মতো সাইক্লিং
আজ ১৪ অক্টোবর হুজুর ও তার কাফেলা হল্যান্ড থেকে জার্মানীর উদ্দ্যেশে রওনা হবে। অনেকেই ভেবেছিল যে আজ যেহেতু আমরা লম্বা সফরে যাব তাই আজ হয়তবা হুজুর সাইক্লিং করবেন না। কিন্তু গত কয়েকদিনের মতোই হুজুর ফযরের পর সাইক্লিং এর জন্য বের হন। মুনীর জাভেদ সাহেব হুজুরের ব্যক্তিগত সহকারী সেদিন ও তার আগের দিন সাইক্লিং করেন নি। আমি তাকে একদিন এর কারণ জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন “প্রত্যেকেরই তার সীমা সম্বন্ধে জানা উচিৎ। আমি সফরে এসেছি হজুরের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে তাকে সাহায্য করার জন্য। যদি আমি আহত হই তাহলে আমি আমার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারব না।”
আমি তার চিন্তাধারা শুনে প্রভাবিত হই। কোন আহমদীই হুজুরের সাথে সাইক্লিং করার সুযোগ হারাতে চাইবে না। কিন্তু তিনি খলীফাতুল মসীহর প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য স্বেচ্ছায় সাইক্লিং করার সুযোগ ছেড়ে দিলেন।
সাইক্লিং এর সময় আমি কাফেলার মাঝখানে ছিলাম। আমার ঠিক সামনেই ছিলেন হল্যান্ড জামাতে প্রবীণ সদস্য তাহের মাহমুদ সাহেব। এক স্হানে রাস্তা চিকন হয়ে যায়। সেখানে রাস্তার মাঝখানে একটি পোল রাখা ছিল। তাহের সাহেব সেটিকে লক্ষ্য করেননি। তাই তিনি সরাসরি সেটিতে যেয়ে আঘাত করেন ও পড়ে যান। আমি তাকে পড়তে দেখে দ্রুত ব্রেক করি ও সাইকেল থেকে নেমে পড়ি। আলহামদুলিল্লাহ তাহের সাহেব পায়ে হালকা ব্যথা পেলেও বড় কোন আঘাত পাননি।
হুজুরের সাথে পদভ্রমণ
শেষ দিনে আমরা কিছুটা কম পথ সাইক্লিং করি। কিন্তু ফেরার সময় লেকের পাশে বিরতি নেই। এসময় হুজুর লেকের পাশে নিজেই হাটা শুরু করেন এবং সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করেন। এক মিনিট পর হুজুর আমাকে তার কাছে ডাকেন ও আমরা একসাথে হাটতে থাকি।
হুজুর গত দিনের আহমদী খাদেম এর বাঁশি বাজানোর কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে একবার এক ব্যক্তি মহানবী(সাঃ) এর সামনে বাদ্যযন্ত্র বাজায় এবং তিনি এর অনুমতি দেন। হুজুর আমাকে পাকিস্তানের একটি মজার ঘটনা বলেন। “খলীফাতুল মসীহ রাবে(রহঃ) তাকে সিন্ধু প্রদেশের একটি কৃষিজমি দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। একবার আমি সিন্ধুতে একজন নন আহমদীর দেখা পাই যে বাঁশি বাজাতো। আমাকে দেখে সে বলল
“পূর্বে তাহের মিঞা(খলীফাতুল মসীহ রাবে রহঃ) তার কৃষিজমি দেখাশোনার জন্য এখানে আসতেন। তখন আমি তাকে বাঁশি বাজিয়ে শোনাতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তোমাদের জামাত তাকে এখন পীর(খলীফা) বানিয়ে ফেলেছো এবং তার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছো।” ”
আমি হুজুরের কাহিনী শুনে অনেক হাসলাম। হুজুরও পুরনো স্মৃতি স্মরণ করে আনন্দ পেলেন। হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমি দৌড়াতে পারি কিনা। আমি বললাম যে পূর্বে আমি অনেক দৌড়াতাম কিন্তু গত দু বছরে কোন দৌড়াদৌড়ি করিনি। আমি ভাবলাম হয়ত হুজুর আমাকে দৌড়াতে বলবেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে হুজুর আমাকে দৌড়াতে বলেননি এবং আমি সাধারণ গতিতে হুজুরের পাশে হাটতে থাকি। হুজুর বলেন “তুমি অনেক তরুণ এবং হালকা পাতলা গড়নের। তাই ব্যায়াম ও সাইক্লিং করাতে তোমার কোন অসুবিধা হবার কথা নয়। আমি সাইক্লিং এর পর মাঝে মাঝে আমার পায়ের পেশীতে টান অনুভব করি।”
হুজুরের কথা শূনে আমি দুঃখ পাই। হুজুর সাধারণত কখনো নিজের অসুবিধার কথা প্রকাশ করেন না। আমরা কাফেলার অন্যান্য সদস্যদের কাছে ফিরে আসি। আমি হুজরকে বলি যে তাহের সাহেব সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। হুজুর তাকে কাছে ডাকেন ও তার অবস্হা জিজ্ঞেস করেন। হুজুর তাকে দ্রুত হোমিওপ্যাথি ঔষুধ আর্নিকা নেবার পরামর্শ দেন।
আলহামদুলিল্লাহ, নানপেস্টের গ্রাম্য পরিবেশে প্রিয় হুজুরের সাথে সময় কাটানো সত্যিই অসাধারণ।
সকালের নাশতার সময় একটি বিস্ময়কর মুহুর্ত
এরপর আমি নাশতার জন্য কাফেলাদের নির্ধারিত ডাইনিং রুমে যাই। সেখানে কেবল হল্যান্ড জামাতের জেনারেল সেক্রেটারী মোজাফফর সাহেব ছিলেন। এই সফরে তার সাথে কয়েকবার দেখা হয়েছে কিন্তু খুব একটা কথা বলা হয়নি। আমি শুনেছে যে তার পিতাকে (চৌধুরী হামিদ সাহেব) ১৯৮৪ সালে পাকিস্তানে শহীদ করা হয়। তিনি আমাকে আমার কাজ ও দায়িত্ব সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেন। আমি বলি যে জামাতকে সাহায্য করার আমি যে সুযোগ পেয়েছি তা আমার পিতা-মাতার দোয়ার ফলাফল।
এটি শোনার পর তিনি কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন “খলীফাতুল মসীহ রাবে(রহঃ) আপনার পিতা-মাতার তবলীগের কথা বলেছেন। আমি তাদেরকে আমার আদর্শ মনে করি যদিও তাদের সাথে আমার কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। তাদের সম্বন্ধে খলীফাতুল মসীহ রাবে(রহঃ) যে সকল কথা বলেছেন আমার প্রায় সবই মনে আছে। তারা আমাকে আমার পিতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমার পিতারও তবলীগের প্রতি আকর্ষণ ছিল।”
তিনি বলেন যে তিনি নিয়মিত আমার পিতা-মাতার জন্য দোয়া করেন। ডাইনিং রুম থেকে বের হবার সময় আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাই। হল্যান্ডের একজন মানুষ এমন দুইজনকে তার আদর্শ মনে করে ও তাদের জন্য দোয়া করে যাদের সে কখনো দেখেনি, কেবল খলীফাতুল মসীহর কাছে তাদের কথা শুনেছে। এটিও খিলাফতের বরকতে একটি অনুমপ নিদর্শন।
হল্যান্ড থেকে বিদায়
হুজুরকে বিদায় জানানোর জন্য অনেক স্থানীয় আহমদী উপস্থিত ছিলেন। তারা হুজুরের বাসার সামনে লাইন দিয়ে দাড়িয়ে ছিল। তাদের অনেকের চোখেই পানি ছিল। অনেকে নযম গাচ্ছিল (খলীফা কে হাম হ্যায়, খলীফা হামারা….)। কিছুক্ষণ পর হুজুর বেরিয়ে আসেন এবা তার গাড়ীর লাগেজ প্যাকিং পরিদর্শন করেন। হুজুর তার গাড়ীর প্যাকিং দেখে সন্তুষ্ট হলেন না। তাই পরবর্তী ১০ মিনিটে বৃষ্টির মাঝে দাড়িয়ে হুজুর গাড়ীর লাগেজ কিভাবে পুনরায় প্যাক করা হবে সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে থাকলেন। একসময় হুজুর নিজের হাতেই লাগেজ ঠিকঠাক করলেন। হুজুর সন্তুষ্ট হবার পর গাড়ির বনেট বন্ধ করার অনুমতি দিলেন। নীরব দোয়ার পর কাফেলা সকাল ১১.৫৫ মিনিটে নানপেস্ট থেকে জার্মানীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। স্হানীয় আহমদীগণ তাদের আধ্যাত্মিক নেতাকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানায়।
জার্মানীতে আগমন ও নর্ডন এ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
দুপুর ১.০৫ মিনিটে আমরা জার্মানীর ভিতরে প্রবেশ করি। এতক্ষণ হল্যান্ড জামাত হুজুরকে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন জার্মান জামাত বাকি সফরে হুজুরকে এসকর্ট করে নিয়া যাবার সম্মান লাভ করবে।
জার্মানীতে প্রবেশ করেই আমরা বর্ডারের কাছের একটি শহর নর্ডনে থামি। সেখানে হুজুর সাদিক মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন করবেন। আলহামদুলিল্লাহ সেই অনুষ্ঠানটি অনেক বরকতময় বলে প্রমাণিত হয়েছিল। সেখানে প্রায় ১০০ জন অতিথি ও বিভিন্ন সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ উপস্হিত ছিলেন। প্রথমে জার্মানীর আমীর সাহেব সংক্ষিপ্ত স্বাগত বক্তব্য দেন। এরপর নর্ডনের মেয়র সাহেব ও সেখানকার সহকারী জেলা কমিশনার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তারা সিরিয়া থেকে আগত শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় জার্মানীকে সাহায্য করার জন্য জামাতকে ধন্যবাদ জানান। বিশেষ করে জামাত যে অনুবাদের জন্য সাহায্য প্রদান করেছে সেজন্য তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
হুজুরের বক্তব্য
অতিথিদের বক্তব্যের সময় হুজুর তাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্টের নোট নিচ্ছিলেন। হুজুর উর্দুতে বক্তব্য দেন। হুজুরের বক্তব্যে অতিথিদের সেসব বিষয়ের উল্লেখ ছিল। হুজুর বলেন “মসজিদ হল শান্তির প্রতীক। এটি কেবল মুসলমানদের নয় বরং সকলের জন্যই শান্তি স্হাপনের কেন্দ্রবিন্দু।”
“আমরা আহমদীরা মনে করি আমাদের আশেপাশে যারা রয়েছে তাদের ভালবাসা ও সাহায্য করা আমাদের কর্তব্য। মসজিদ আমাদের জন্য শান্তি ও আশ্রয়ের স্হান। আমরা অন্যান্যদের মাঝেও ভালবাসা, সৌহার্দ্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”
“মুসলমান হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি যে আল্লাহ সমগ্র মানুষের প্রতিপালক। তাই সকলকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব বলে মনে করি। আহমদী মুসলমান যে কোন উপায়ে মানবজাতিকে সাহায্য করার জন্য সবসময় প্রস্তুত।”
হুজুরের নম্রতার একটি উদাহরণ
জ্যামের কারণে হুজুর নির্ধারিত সময়ের কিছু পরে নর্ডনে পৌছান। এজন্য হুজুর অতিথিদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং হুজুরের জন্য অপেক্ষা করার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানান। হুজুর বলেন যে তারা আমার জন্য অপেক্ষা করেছে এটিই প্রমাণ করে যে তারা অনেক দয়াবান, সহনশীল ও উদার মনের মানুষ।
হুজুরের এ বক্তব্য অনেক অতিথির মনের গভীর প্রভাব ফেলে। তারা হুজুরের নম্র ব্যবহারের প্রশংসা করে। এটিও হুজুরের বিনয় ও নম্র স্বভাবের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। অন্যান্য বিশ্বনেতা ও হুজুরের মাঝে যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে সেটি সকলের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়।
হুজুরের বক্তব্যের প্রভাব
হুজুর এরপর মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্হাপন করেন। এরমধ্যে আমি কয়েকজন অতিথির সাথে কথা বলি। তারা বলে যে হুজুরের বক্তব্য ইসলাম ও মসজিদ নিয়ে তাদের মনে যে ভয় ছিল তা দূর করেছে।
একজন জার্মান মহিলা এডা বলেন “সত্যি কথা বলতে আজকের পূর্বে আমি ইসলাম সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানতাম না। কিন্তু আপনার খলীফা খুব সুন্দরভাবে ইসলামের শিক্ষা প্রচার করেছেন। আমার তাকে অনেক ভাল মানুষ বলে মনে হয়েছে। মানবজাতির প্রতি তার প্রকৃত সহানুভূতি রয়েছে। তিনি আমাদের বলেছেন প্রতিবেশীদের সাহায্য করতে ও শান্তি প্রতিস্ঠিত করতে। এসকল বার্তা আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।”
আর একজন অতিথি মিস্টার জি. ভিয়েরস বলেন “আমি একজন খৃষ্টান ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারী। আজ আমি আর একটি সুন্দর ধর্ম ইসলাম সম্বন্ধে জানতে পারলাম। খলীফা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে ভালবাসা, স্বাধীনতা ও শান্তি হল ইসলামের ভিত্তি।”
মিস আনিকা মোলম্যান বলেন “আমি মোটেও কোন ধর্মীয় মানুষ নই। আজকের পূর্বে আমি এটা জানতাম না যে এই বিশ্বে একজন খলীফা রয়েছেন। কিন্তু যখন আমি খলীফাকে দেখলাম ও তার কথা শুনলাম আমার মনে হল যে তিনি বিশ্বের মানুষের জন্য একজন আদর্শ হতে পারেন। ইসলাম নিয়ে যদি কারো মনে কোন ভীতি বা সংশয় থেকে থাকে, তার বক্তব্য শোনার পর তা সম্পূর্ণ দূর হয়ে যাবে।”
পল শোল্যান্ড বলেন “আমি পূর্বে চার্চে যেতাম। কিন্তু সেখানে আমি অস্বস্তিবোধ করতাম। আমার মনে হত খৃষ্টান প্রিস্ট আমাদের দিকে অবহেলার চোখে দেখত এবং আমাদেরকে পাপী বলে মনে করত। কিন্তু আজকে খলীফা নিজেকে আমাদের চেয়ে বড় মনে করেননি ও আমাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখেননি। তিনি অনেক বিনয়ী। তিনি সকলকে সম্মানের চোখে দেখেছেন। তিনিই একজন প্রকৃত নেতা।”
একজন স্হানীয় কাউন্সিলর মিসেস জুটা বলেন “খলীফার কথা শুনে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। তার কন্ঠ অনেক পবিত্র। তাকে দেখে আমার এমন এক প্রকার অনুভূতি হয় যেটি আমি আগে কখনো অনুভব করিনি।”
আমি একজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “আমি আপানাদের খলীফার সাক্ষাৎকার নিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তার বক্তব্য শোনার পর তার আর কোন প্রয়োজন নেই। ইসলাম নিয়ে যেসকল ভীতি ছিল তিনি তার বক্তব্যে সেসকল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।”
রিভারসাইড হোটেলে বিরতি
ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠান শেষে আমরা কাছে রিভারসাইড হোটেলে গেলাম। সেখানে প্রায় এক ঘন্টার মত ছিলাম। হুজুর ও তার স্ত্রী একটি রুমে গেলেন এবং আমরা হোটেলের ক্যাফেতে গেলাম। বিভিন্ন অতিথিদের সাথে দেখা করার জন্য আমি পূর্বে লাঞ্চ করতে পারিনি। তাই আমি এসময় কাপাচিনো কফি ও চকোলেট মাফিন দিয়ে লাঞ্চ করে নেই। স্বল্প বিরতির পর হুজুর আসেন ও হোটেলের একটি রুমে জোহর ও আসর নামায আদায় করেন। নামযের পূর্বে হুজুর কিবলার দিক সম্বন্ধে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নেন।
বিপদ থেকে অল্পের জন্য রক্ষা
বিকেল ৪.৩০ মিনিটে আমরা ফ্র্যঙ্কফোর্টে বায়তুস সুবাহর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। হোটেল থেকে বের হবার সময় আমাদের গাড়ীর ড্রাইভার আসির আমিনী সাহেব হুমায়ুন সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন যে রাস্তা দিয়ে কোন গাড়ী আসছে নাকি। তিনি অনেক আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন যে “না”। তাই নাসির গাড়ি বের করে ডান দিকে ঘুরে যায়। কিন্তু সেমসয় সে দেখে যে অনেক বড় ও শক্তিশালী একটি ট্র্যাক্টর আমাদের খুব কাছ দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সেটির সাথে ধাক্কা লাগলে আমরা নিশ্চিতভাবেই মাটির সাথে মিশে যেতাম। আমরা হুমায়ুন সাহেবের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু তিনি শান্তভাবে হাসতে হাসতে বললেন “তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে যে, কোন গাড়ী আসছে নাকি। এটি একটি ট্র্যাক্টর, গাড়ী নয়।”
আমরা তার কথা শুনে হেসে ফেললাম। আমাদের কিছু হয়নি চিন্তা করে আমরা আস্বস্ত হলাম। আমার মনে হয় হুমায়ুন সাহেব নিজেও ট্র্যাক্টরটি দেখতে পাননি।
ফ্র্যাঙ্কফোর্টে আগমন
কাফেলা গাড়ীতে তেল নেবার জন্য একটি পেট্রোল স্টেশনে থামল। হুজুর ও তার স্ত্রী সেখানকার দোকানে কিছু সময়ের জন্য গেলেন। আমি দেখলাম তারা বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি ও চকোলেট দেখছে। শেষে তারা কাফেলার জন্য দুই ব্যাগ চকোলেট কিনলেন।
সফরের বাকি রাস্তায় অনেক যানজট ছিল। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ হুজুর রাত ৮.৩৫ মিনিটে বায়তুস সুবাহ মসজিদে পৌছান। সেখানে অনেক আহমদী হুজুরকে স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
কিছুক্ষণ পর হুজুর মাগরিব ও এশার নামায আদায় করেন। তারপর তিনি নিজ বাসায় যান। কাফেলা সদস্যগণ ডিনারের জন্য ডাইনিং হলে যাই। এরপর আমরা আমাদের রুমে চলে যাই। আমি পূর্বে জার্মানী সফরে যে রুমে ছিলাম এবারও আমাকে সেই রুমই দেয়া হয়। পূর্বের মতোই এবারও আমার রুমমেট হলেন মোবারক জাফর সাহেব।
হুজুরের অনাড়ম্বর জীবন যাপনের একটি দৃষ্টান্ত
পরদিন ১৫ অক্টোবর ২০১৫, জোহর ও আসর নামায আদায়ের পর হুজুর নিজের রুমে যাচ্ছিলেন। তখন হুজুরের ব্যক্তিগত সহকারী সাহেব তাকে একটি চিঠি দেন। সাথেসাথেই হুজুর সেখানে মসজিদের বাইরে একটি ডেস্কের উপর চিঠিটি রাখেন। হুজুর ভালভাবে চিঠিটি পড়েন এবং সেখানেই হাত দিয়ে কিছু নির্দেশনা লিখে দেন। তারপর তিনি চিঠিটি মুনীর জাভেদ সাহেবকে দিয়ে নিজের রুমে যান। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে কাজ করার জন্য যুগ খলীফার কোন বিশাল আয়োজনের প্রয়োজন নেই। যে কোন সময় যে কোন কাজ করার দরকার হলেই হুজুর সেটি করে ফেলেন।
মাজিদ সাহেবের কাগজ সম্বন্ধীয় জ্ঞান
আমি অফিসে কাজ করছিলাম। একই রুমে মাজিদ সাহেব ও মোবারক সাহেবও কাজ করছিলেন। মাজিদ সাহেব একজন স্হানীয় আহমদীকে ডাকেন ও তাকে একটি লেখার প্যাড দিতে বলেন। তিনি কিরকম প্যাড চান তার বিস্তারিত বর্ণনা সেই আহমদীকে দেন। প্যাডের কাগজ কেমন হবে, মার্জিন কেমন হবে ইত্যাদি। এরপর তিনি বলেন যে সবচেয়ে ভাল প্যাড হল “পাক্কা প্যাড।” তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন “আবিদ তোমার কাছেও পাক্কা প্যাড রয়েছে।”
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম যে আমার কাছে কি প্যাড রয়েছে তা আমি নিজেই জানি না। তিনি বলেন যে তিনি গতদিন আমার প্যাডের দিকে লক্ষ্য করেছেন এবং তিনি জানেন যে সেটি হল পাক্কা প্যাড। আমি তারপর আমার প্যাডের দিকে নজর দেই এবং আসলেই সেট পাক্কা প্যাড ছিল।
আমাকে স্বীকার করতেই হবে আমি মাজিদ সাহেবের কাগজের উপর জ্ঞান দেখে আভিভূত।
স্থানীয় আহমদীদের আবেগ
১৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় হুজুর কিছু স্হানীয় আহমদীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমি তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলি। আমি জাফর খান(৪৯ বছর) ও তার স্ত্রী ফারিহা খান এর সাথে কথা বলি। তারা তাদের দুই সন্তান নিয়ে হুজুরের সাথে দেখা করেন। আমি লক্ষ্য করলাম তাদের ছেলে তাবিশ খান(১৬ বছর) এর চোখ লাল হয়ে আছে। মনে হল সে কাঁদছিল। সে বলল “আমি হুজুরের কাছে তার সাথে কোলাকুলি করার অনুমতি চাইলাম এবং হুজুর আমাকে অনুমতি দিলেন। আমি অনেক ভাগ্যবান কারণ আমি হুজুরের সাথে কোলাকুলি করতে পেরেছি, তার এত কাছে আসতে পেরেছি। আমি হুজুরের এত কাছে আসার মুহুর্ত কখনো ভুলতে পারব না।”
ফারিহা সাহিবা বলেন “আমি অনেকদিন ধরেই অসুস্হ। মোলাকাতের সময় হুজুরের তা মনে ছিল। তিনি আমার অবস্হা জানতে চান ও আমাকে কিছু ঔষুধ নেবার পরামর্শ দেন। যুগ খলীফার ভালবাসা পিতামাতার ভালবাসার চেয়েও গভীর। হুজুর আমাকে আস্বস্ত করেন ও বলেন যে আমি ঠিক হয়ে যাব। আমার মনে হচ্ছে হুজুরের সাথে মোলাকাতের বরকতে আমি এখনই সুস্হ হয়ে গেছি।”
আমি মির্জা আব্দুল করিম(৪৫ বছর) ও তার স্ত্রী সাদাফ করিম এর সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “আমি যখন হুজুরের হাত স্পর্শ করি আমার মনে হল আমার জীবনের সকল সমস্যা ও কষ্ট দূর হয়ে গিয়েছে। হুজুরের উপস্হিতিতে আমার মনে হল আমি এক অভয়ারণ্যে রয়েছি। ”
তার স্ত্রী বলেন “হুজুরের প্রত্যেকটি কথাই আমাদের জন্য দোয়া স্বরূপ। আমি যখনই আমার কোন সমস্যার জন্য হুজুরকে দোয়ার আবেদন জানাই সাথেসাথেই সেটি দূর হয়ে যায়। মাঝেমাঝে মনে হয়ে এটি একটি অলৌকিক ঘটনা। এটি প্রমাণ করে যে আল্লাহপাক যুগ খলীফার দোয়াকে সবার উপরে স্হান দিয়ে থাকেন। ”
আমি একজন মহিলা কুরাতুল আইন সাদিক সাহিবার সাথে কথা বলি। তিনি তার স্বামী সহ হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি বলেন “আমি যখন হুজুরের সাথে দেখা করছিলাম তখন আমি ভাবলাম আমাদের খলীফা কত পবিত্র। আমার যখন তার সাথে সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য হয়েছে তখন আমারও উচিৎ তার মতো হবার চেষ্টা করা। আমি চেষ্টা করব আরো ভাল মানুষ হবার জন্য। ”
একটি ঈমান বর্ধক কথোপকথন
আমি একজন জার্মান আহমদী নাসির নজোয়েরা(৩৫ বছর) ও তার স্ত্রী সেমিরা নজোয়েরা সাহিবার সাথে কথা বলি। তারা বয়াত গ্রহণ করে আহমদী হয়েছেন। কিছু সময় পরে তারা জামাত থেকে দূরে চলে যান। কিন্তু গত বছর তারা আবার জামাতে যোগ দেন। তারা কেন আবার আহমদীয়াতে ফিরে আসে সেই ঘটনা বড়ই চমকপ্রদ। নাসির সাহেব বলেন “আমরা আবার আহমদীয়াতে ফিরে আসি কারণ আল্লাহপাক নিজে থেকেই আমাদের এই পথে নিয়ে আসেন। আল্লাহপাক স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের জানান যে আহমদীয়া জামাত কোন মানুষের তৈরী জামাত নয় বরং এটি আল্লাহর জামাত। কোন আহমদী আমাদের জামাতের দিকে ফেরত আনেনি। স্বয়ং আল্লাহপাক আমাদের হৃদয়কে সত্যের দিকে নিয়ে এসেছে। তখন থেকে আমাদের উপর আল্লাহর বরকত নাযিল হচ্ছে এবং আমাদের সকল সমস্যা দূর হয়ে গিয়েছে। ”
“আজ আমি ১০-১১ বছর পর হুজুরের সাথে দেখা করি। আমি অনেক নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু হুজুর আমাদের সাথে অনেক দয়া ও ভালবাসার আচরণ করেন। তাকে দেখে আমাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায়। হুজুর বলেন যে যদি আমরা অন্য আহমদীর মাঝে কোন দুর্বলতা দেখতে পাই এটি যেন আমাদের ঈমানকে দুর্বল না করে। আমাদের উচিৎ ইসলাম আমাদের কি শিক্ষা দিচ্ছে সেটা পালন করা।”
তার স্ত্রী সেমিরা সাহিবা তারা অনুভূতি সম্বন্ধে বলেন “পুনরায় আহমদী হবার পর আমি অনেক ভাল অনুভব করছি। আহমদীয়াত ছেড়ে যাওয়া প্রথমেই অনেক কষ্টকর ছিল। আমার সবসময় মনে হত যে আমার জীবনে কি যেন নেই। এখন আমার জীবনের সেই শূন্যতা আর নেই। ”
ড্রাইভিং টেস্ট নিয়ে হুজুরের উপদেশ
এমাই একজন আহমদী মহিলা ফওজিয়া শহীদের সাথে কথা বলি। তিনি তার স্বামীকে নিয়ে হুজুরের সাথে দেখা করতে এসেছেন। তিনি বলেন “ব্যক্তিগত জীবন ও পার্থিব বিষয়ে এমি একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ। কিন্তু হুজুরের সামনে আমি কথাই বলতে পারছিলাম না এবং পুরোটা সময়ই আমি কাঁপছিলাম। হুজুরের মাঝে আমি একধরণের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য্য অনুভব করি যা আমি আগে কোথাও দেখিনি। আমি হুজুরকে আমার ড্রাইভিং টেস্ট পাশ করার জন্য দোয়ার জন্য অনুরোধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম যে এটা করা ঠিক হবে কিনা।”
আমি বললাম যে আমার স্ত্রী মালা ইউকে তে দুইবার ড্রাইভিং টেস্টে ফেল করেছে। এ ব্যাপারে হুজুরকে বলা হলে হুজুর বলেন “পরের বার টেস্টের সময় মনে মনে সূরা ফাতিহা পড়তে থাকবে এবং শান্ত থাকবে। বাকিটা আল্লাহর উপর ছেড়ে দিবে।”
পরের টেস্টে আমার স্ত্রী হুজুরের উপদেশ অনুসরণ করে এবং কোন সমস্যা ছাড়াই টেস্ট পাশ করে। এই কথা শুনে তিনি বলেন যে পরের টেস্টে তিনিও এই উপদেশ অনুসরণ করবেন।
ছেলেকে বাবার তালিম
আমি একজন পরিবারকে দেখালাম হুজুরের সাথে মোলাকত করে বের হতে। তাদের একটি ৪-৫ বছরের ছেলেও ছিল। সের একটি চকোলেট খাচ্ছিল যেটি হুজুর তাকে দিয়েছে। আমি শুনতে পেলেম যে তারা বাবা তাকে বলছে “এই চকোলেটটি হুজুরের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ উপহার। এতে অনেক বরকত রয়েছে। তাই তুমি পুরোটাই এক একা খেয়ে ফেলো না। তোমার উচিৎ এটি তোমার বন্ধু ও পরিবারের সবার সাথে ভাগাভাগি করে খাওয়া। যাতে তারাও এর বরকত পেয়ে থাকে।”
সেটি সেই বাচ্চাটির জন্য খুবই ভাল তালিমের ব্যাপার ছিল। তারা বাবা তাকে হুজুরের উপহার ভাগাভাগি করে খাবার জন্য উপদেশ দিচ্ছিলেন। কিন্তু আমজি বাচ্চাটির জন্য কিছুটা মন খারাপ করলাম। কারণ আমি দেখলাম যে সে মন খারাপ করে বাকি চকলেটটি তার পকেটে রেখে দিল।
আহমদীদের আবেগ
আমি একজন আহমদী মোহাম্মদ শরীফ(৩৮ বছর) ও তার স্ত্রী রাজিয়া শরীফের সাথে কথা বলি। তারা এক বছর পূর্বে জার্মানীতে আসে এবং এটিই হুজুরের সাথে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। বিশেষভাবে রাজিয়া সাহিবাকে বেশি আবেগপ্রবণ ছিলেন। আমার সাথে কথা বলার সময় অনবরত চোখের পানি মুছছিলেন। তিনি বলেন “প্রায় প্রত্যেক মাসেই আমি হুজুরকে স্বপ্নে দেখতাম। আজ সকল স্বপ্ন সত্য হয়েছে। আমার জীবন সারাজীবনের জন্য পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এখন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে কারণ হুজুর আমাদের জন্য দোয়া করেছেন।”
একজন তরুণ আহমদী আমীর উল আযিন(৩০ বছর) বলেন “পাকিস্তানে আমার ভিসা প্রত্যাখ্যান করে দেয়া হয়। এরপর আমিদোয়া করি ও আল্লাহ, এমার একমাত্র ইচ্ছা আমার খলীফার সাথে দেখা করা। এর দুইদিন পরই আমার ভিসা হয়ে যায়। আজকে আমি প্রথমবারের মত আমার খলীফার সাথে দেখা করি। আমি এখনো কাঁপছি। আমার মনে হচ্ছে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। আজ একটি অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ।”
হুজুরের দয়ার একটি দৃষ্টান্ত
সেদিন সন্ধ্যায় মাগরিব ও এশার নামাযের পর হুজুর মসজিদ থেকে বের হচ্ছিলেন। তখন একজন বয়স্ক ব্যক্তি জোরে হুজুরকে ডাকে এবং বলে যে তিনি হুজুরের সাথে দেখা করতে চান। তার আচরণ খুবই অসম্মানজনক ছিল। তার কথা শুনে হুজুর পিছেনে ফিরে তাকান এবং তার দিকে এক মুহুর্ত দেখেন। এপর হুজুর মসজিদে থেকে বেরিয়ে যান। আমরা সকলেই তার আচরণে অনেক দুঃখ পেয়েছিলাম। কিন্তু হুজুর একদম শান্ত ছিলেন এবং কোনরকম রাগ প্রদর্শন করেননি। লিফটের কাছে যেয়ে হুজুর স্হানীয় জামাতের কাছ থেকে লোকটি সম্বন্ধে জানতে চান। এরপর হুজুর ব্যাক্তিগত সহকারী মুনীর জাভেদ সাহেবকে বলেন “তাকে আমার অফিসে দেখা করার জন্য একটি সময় নির্ধারিত করে দিন।”
হুজুরের কথা শুনে আমি কেঁপে উঠলাম এবং চিন্তা করলাম আমাদর খলীফা কতটা দয়ালু ও সহানুভূতিশীল। তার প্রতি কোনরকম রাগ নয় বরং হুজুরের একমাত্র চিন্তা ছিল কিভাবে তার সমস্যা সমাধান করা যায়। পরদিন আমি শুনলাম যে হুজুর মুনীর জাভেদ সাহেবের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়েছেন যে মোলাকাতের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে কিনা।
মুনীর সাহেব প্রায় দুইদিন পর আমাকে বলেন যে হুজুর তার অফিসে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং হুজুর তাকে অনেক সময় দিয়েছেন। এই ঘটনা মনে হলে আমি দোয়া করি যেন কেউ কখনো হুজুরের সাথে এরকম অসম্মানজনক ব্যবহার না করে। কিন্তু এ ব্যাপার থেকে বোঝা যায় যে হুজুর জামাতের সকলের প্রতিই কতটা সহানুভূতিশীল ও সকলের জন্যই হুজুরের ভালবাসা রয়েছে।
ফ্র্যাঙ্কফোর্টে জুমুআর খুৎবা
১৬ অক্টৌবর, ২০১৫ হুজুর বায়তুল আফিয়াত থেকে জুমুআর খুৎবা দেন। এটি বায়তুস সুবহার অপর পাশেই অবস্হিত। গত বছর জার্মানীতে এসে হুজুর এটির উদ্বোধন করেছিলেন।
গত কয়েক বছরে হুজুর ফ্র্যাঙ্কফোর্টে থাকাকালীন একটি স্পোর্টস সেন্টারে খুৎবা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন সেটি সিরিয়ান শরণার্থীদের আশ্রয়স্হল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ এখন জামাত বায়তুল আফিয়াত মসজিদ ব্যবহার করতে পারছে। অনেক লোক সেখানে নামায পড়তে পেরেছে। লাজনাগণ ও বাকিরা বায়তুস সোবাহতে নামায আদায় করেছেন। সেদিন প্রায় ৪৯০০ লোক জুমুআর নামায আদায় করেন।
জুমুআর খুৎবায় হুজুর বলেন কিভাবে জামাত উন্নতি করছে। “প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) বলেছেন যে একটি সময় অবশ্যই আসবে যখন আহমদী মুসলিম জামাতকে পুরো বিশ্ব চিনবে। পুরো বিশ্বে এটি ছড়িয়ে যাওয়া একটি ঐশি নিদর্শন বলে প্রমাণিত হবে। আজ ভারতের সেই ছোট গ্রাম থেকে উঠা এক ব্যাক্তির বাণী সারা বিশ্বে প্রচারিত হচ্ছে। ”
“প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর অনুসারীদের উপর এমন কঠোরভাবে অত্যাচার ও ও বিরোধিতা করা হয়েছে, যে এটি যদি কোন মানুষের তৈরী জামাত হতো তাহলে এতদিনে এটি ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু ইনশাল্লাহ আহমদীয়া মুসলিম জামাত কখনো ধ্বংস হবে না, বরং আল্লাহর সাহায্যে এটি প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে থাকবে।”
হুজুরের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা
সেদিন বিকেলে আমি একজন আহমদী ওয়াকার আহমদ(৩০ বছর) ও তার স্ত্রী হেবাতুস সামী সাহিবার সাথে কথা বলি। হেবাতুস সাহিবা প্রথমবারের মতো হুজুরের সাথে দেখা করেন। তিনি বলেন “একটি জিনিস আমি লক্ষ্য করি যে হুজুরের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। আমাদেরকে দেখেই হুজুর আমাদের পড়াশোনার অবস্হা বুঝে ফেলেছেন। হুজুর আমাদের প্রতি অনেক ভালবাসা রাখেন ও আমাদের জন্য চিন্তা করেন। আমি একটি ব্যাপারে হুজুরকে দোয়ার জন্য অনুরোধ করি। হুজুর সাথে সাথেই আমাদের চিন্তা করতে মানা করেন এবং বলেন যে তিনি ঔষুধ পাঠিয়ে দিবেন এবং আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
হেবাতুস সাহিবার কথা একদম সঠিক। অনেক ছোটখাট জিনিসও হুজুরের চোখ এড়িয়ে যায় না। উদাহরণস্বরূপ: অনেকবারই হুজুর আমাকে বলেছেন যে জুমুআর খুৎবার সময় আমি ঠিক কোথায় বসেছিলাম। অনেক সময় আমি অনেক দূরে বসেছিলাম কিন্তু হুজুর তা ঠিকই লক্ষ্য করেছেন। অন্যান্য লোকেরও একইরকম অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি হুজুরের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার আর একটি দৃষ্টান্ত পাই। তখন আমরা মাগরিব ও এশার নামাযের জন্য দাড়াচ্ছিলাম। আমি প্রথম কাতারেই ছিলাম কিন্তু হুজুরের থেকে কয়েক মিটার দূরত্বে। হুজুর সকল কাতার তৈরী হবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখন হঠাৎ করেই আমি হুজুরের কন্ঠ শুনতে পাই। তিনি আমাকে ডাকেন ও বলেন “তোমার কি ঠান্ডা লেগেছে?”
আমি বললাম যে হ্যাঁ আমার একটু ঠান্ডা লেগেছে। আমার মনে হয় আমি যখন টিস্যু দিয়ে নাক মুছছিলাম তা হুজুর দেখে ফেলেছেন। হুজুর বলেন “আ্যকোনাইট ১০০০ নিয়ে নাও।” তারপর হুজুর নামায আদায় করান।
অসুস্হতা বোধ করা
প্রকৃতপক্ষে আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই আমার কিছুটা খারাপ লাগছিল। আমার গলা ও মাথা ব্যথা করছিল এবং নাক দিয়ে পানি পড়ছিল। আমি প্যারাসিটামল ও ভিটামিন সি ট্যাবলেট নিয়েছিলাম।
পরদিন ১৭ অক্টোবর আমার শরীর আরো খারাপ হয়। গতদিন আমি সবার থেকে আমার অসুস্হতার ব্যাপারটি লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম কিন্তু এখন আর সেটি পারলাম না।
ফযরের সময় মোবারক সাহেব দেখলেন যে আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তাই তিনি বললেন যে আমি যেন রুমেই ফযরের নামায আদায় করে নেই। কিন্তু আমি মসজিদেই নামায আদায় করে রুমে এসে আরাম করি।
সারাদিন বিভিন্ন কাফেলা সদস্য ও স্হানীয় আহমদীগণ আমার অবস্হার খোঁজ খবর নেন। সত্যি বলতে তাদের সকলের আমার প্রতি এত মনোযোগে আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করি।
জামেআ আহমদীয়া জার্মানীর প্রথম সমাবর্তন
সেদিন হুজুর জামেআ আহমদীয়া জার্মানীর প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য জামেআতে যান। আমার শরীর খারাপ থাকলেও আমিও জামেআতে যেতে চাচ্ছিলাম কারণ আমি পূর্বে সেখানে যাইনি। হুজুর খিলাফতের শতবার্ষিকী বছর ২০০৮ সালে জামেআ আহমদীয়া জার্মানীর উদ্বোধন করেন। সেটি বায়তুস সুবাহ থেকে ৪৫ মিনিটের দুরত্বে রাইডস্ট্যাট শহরে তৈরী করা হয়।
সেখানে যেয়ে আমার মনে হল যে ২০১২ জার্মানী সফরে হুজুর আমাকে বলেছিলেন “জামেআ আহমদীয়া জার্মানী শুরু করা অনেক বরকতময়। ইনশাল্লাহ এই দিনটি আহমদীয়া জার্মানীর ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন বলে স্মরণ করা হবে।”
১৭ অক্টোবর সকাল ১১.৫০ মিনিটে হুজুর জামেআ তে পৌছান। জামেআর প্রিন্সিপাল শামসাদ কমর সাহেব হুজুরকে জামেআ আহমদীয়ার বিভিন্ন অংশ দেখান। আলহামদুলিল্লাহ জামেআ আহমদীয়া জার্মানীর কমপ্লেক্স একটি প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার জন্য খুবই সহায়ক।
১২ টার সময় সমাবর্তন অনুষ্ঠান শুরু হয়। হুজুর ১৬ জন তরুন মোবাল্লেগকে শাহেদ সার্টিফিকেট প্রদান করেন। এরপর তিনি তাদের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যতের জন্য কিছু উপদেশমূলক বক্তব্য দেন। তিনি বলেন “একজন মোবাল্লেগ অন্যদের উপর তখনই ভাল প্রভাব ফেলতে পারবে যদি তাদের নিজেদের নৈতিক ও ধর্মীয় মান সর্বোচ্চ পর্যায়ের হয়। পূর্বে মানুষ তোমাদের অনেক ভুল ভ্রান্তি উপেক্ষা করে গেছে কারণ তখন তোমরা তরুণ শিক্ষার্থী ছিলে। কিন্তু এখন সকলেই তোমাদের দিকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখবে। তাই তোমাদের দায়িত্ব হল সর্বোচ্চ নৈতিক মান প্রদর্শন করা। তোমাদের কথা ও কাজের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকা উচিৎ নয়। তোমরা অন্যদের যেরকম উপদেশ দিবে নিজেরাও যেন সেভাবে চল সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। তোমরা যা প্রচার করবে সেভাবেই যদি জীবন যাপন কর তাহলেই তোমরা অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম হবে।”
“তোমরা জামেআ আহমদীয়া জার্মানী থেকে পাশ করা প্রথম ক্লাস। তাই তোমাদের কর্তব্য তোমাদের পরে যারা আসবে নিজেদেরকে তাদের জন্য আদর্শ হিসেবে তৈরী করা। তারা যেন তোমাদের দেখানো পথে চলতে অনুপ্রাণিত হয়।”
“কখনোই মনে করবে না যে তোমরা সবকিছু শিখে ফেলেছো। সারা জীবন জ্ঞান আহরণ করবে। ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়াও সমসাময়িক ঘটনা ও সমস্যা সম্বন্ধে জানতে হবে। ”
“মোবাল্লেগ হিসেবে তোমরা যুগ খলীফার প্রতিনিধি। তাই তোমাদের কর্তব্য হল সারা বিশ্বে যুগ খলীফার বাণী পৌছে দেয়া। তোমরা এটি তখনই সফলভাবে করতে পারবে, যখন তোমরা নিজেরা তার কথা শুনবে ও তার কথামতো জীবনযাপন করবে। কেবলমাত্র তখনই তোমরা যুগ খলীফার সত্যিকারের প্রতিনিধি হিসেবে গন্য হবে।”
অনুষ্ঠানের পর সেখানে সবাই দুপুরের খাবার খায়। বিশেষভাবে আমার কিমা কারলি মজা লেগেছিল।
হুজুরের জামেআ আহমদীয়া জার্মানী পরিদর্শন
অনুষ্ঠানের পর হুজুর জামেআর বাকি অংশ পরিদর্শন করেন যেটি পূ্র্বে দেখা হয়নি। হুজুর একজন ছাত্রের বেডরুম পরিদর্শন করেন। তিনি তার বিছানা, আলমারী ও বাথরুম চেক করে দেখেন।
হুজুর আমাকে ডেকে জানতে চান যে আমার কাছে জামেআ কেমন মনে হচ্ছে। আমি বললাম যে আমি যেমন ভেবেছিলাম এটি তার চেয়ে অনেক বড় ও উন্নতমানের। হুজুর বলেন “এটিকে আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী বানানো হয়েছে। কিন্তু এখানে একটি জিনিসের অভাব রয়েছে। সেটি হল ৩০ একর সবুজ গাছপালা যেটি ইউকে জামেআ তে রয়েছে।”
হুজুরের কথা একদম সঠিক। জামেআ আহমদীয়া ইউকে অনেক মনোরোম ও সুন্দর পরিবেশে বানানো হয়েছে।
জামেআ আহমদীয়া বিনিময় কার্যক্রম
২০১৪ সালে হুজুর নির্দেশ দেন যে জামেআ আহমদীয়া ইউকে ও জার্মানীর মধ্যে বার্ষিক বিনিময় কার্যক্রম শুরু হবে। এক জামেআ থেকে অন্য জামেআত কিছু ছাত্র দুই সপ্তাহের জন্য পড়াশোনার জন্য যাবে। এটি শিক্ষক ও ছাত্র উভয়কেই আরো উন্নত হতে সাহায্য করবে।
তার নির্দেশ অনুযায়ী ইউকে জামেআর ষষ্ঠ বছরের সকল ছাত্র সমাবর্তন অনুষ্ঠানের জন্য কিছুদিন পূর্বে জার্মানীতে পৌছে। তারা পরবর্তী এক সপ্তাহ এখানে ক্লাস করবে। জার্মানী থেকে ছাত্রগণ কিছুদিন পরে ইউকেতে যাবে।
তাই জামেআ ইউকের অনেক ছাত্রই হুজুরের সাথে দেখা করার সুযোগ পায়। হুজুর ভালবাসার সাথে জার্মানীতে তাদের কেমন লাগছে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন।
মোবারক মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপন
১৮ অক্টোবর ২০১৫, হুজুর মোবারক মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্হাপনের জন্য ফ্র্যাঙ্কফোর্ট থেকে ফ্লোরস্ট্যাট শহরে যান। ফ্লোরস্ট্যাট একটি ছোট শহর এবং তার জনসংখ্যা ১০ হাজারের কম। মসজিদে মোবারক শহরের কেন্দ্রে তৈরী হবে। এটি স্হানীয় বড় রাস্তা ও বাজারের পাশেই।
সকাল ১১.৪৫ মিনিটে ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠান শুরু হয় যেখানে প্রায় ১৫০ জন অতিথি ছিলেন। জার্মানীর আমীর সাহেব উদ্বোধনী বক্তৃতা দেন। অতিথিদের মধ্যে সংসদ সদস্য ও স্হানীয় মেয়র শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। দুজনেই ফ্লোরস্ট্যাট শহরে হুজুরকে স্বাগত জানান। এরপর হুজুর তার বক্তব্য দেন। হুজুর বলেন “আহমদীয়া মুসলিম জামাতের ইতিহাস ও কর্মকান্ড মানবজাতির প্রতি আমাদের দয়া, ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রমাণ করে। তাই এই মসজিদ যখন তৈরী হবে তখন এটি মানবজাতির জন্য শান্তি ও সৌহার্দ্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করবে। ”
মসজিদ তৈরীতে স্হানীয় লোকেরা যে সাহায্য করেছেনে এজন্য হুজুর তাদের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন “আমরা সকল ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে সাহায্য করি। এটি আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ।”
বক্তব্যের পর হুজুর মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্হাপন করেন।
হুজুরের বক্তব্যের প্রভাব
ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানের পর আমি কয়েকজন অতিথির সাথে কথা বলি। একজন তরুণ জেনস বলেন “আমি খুব ধর্মীয় ব্যক্তি নই। কিন্তু আপনার খলীফা আমার দেখা অন্যান্য ধর্মীয় ব্যক্তি থেকে আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছে। তার কথা আমার হৃদয় ছুয়ে গিয়েছে। তিনি বড়ই দয়ালু ও কোমল হৃদয়ের মানুষ। আমি যে সকল ধর্মীয় ব্যক্তিদের দেখা পেয়েছি তাদের অনেকেই কঠোর হৃদয়ের। আমি একই সাথে আনন্দিত ও অবাক হয়েছি।”
আমি গ্যাবি নামে একজন মহিলার সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “আমি একজন নাস্তিক এবং আমি সকল ধর্মেরই বিরোধী। কিন্তু তারপরও আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে আপনার খলীফার খু্বই সহানুভূতিশীল মানুষ এবং ইসলামও একটি সহনশীল ধর্ম। তার বার্তা খুবই সহজ “সকলের সাথেই ভাল ব্যবহার কর” । বর্তমান বিশ্বে এখন এই বার্তারই প্রয়োজন ছিল। ”
একজন জার্মান ব্যক্তি লারস ফলসেট আমাকে বলেন “খলীফাকে দেখে ও তার কথা শুনে আমার চোখে পানি এসে যায়। আমার তার কথা শোনারও কোন প্রয়োজন ছিল না। তাকে দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে তিনি একজন প্রকৃত সত্যবাদী মানুষ। আজকের দিনটি সত্যিই অসাধারণ।”
একজন সাংবাদিক স্টেফান বলেন “সবার উপর খলীফার বিশেষ প্রভাব পড়েছে। তাকে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। আমি তার প্রত্যেকটি কথাই নোট করেছি। আমি তাকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখব যার মূল বিষয় হবে খলীফার বার্তা যে তিনি সকলকে শান্তির জন্য একত্রে কাজ করতে বলেছেন।”
আমি উইলকানিং নামে এক ব্যক্তির সাথে কথা বলি। তিনি অনেক আবেগপ্রবণ ছিলেন। তিনি বলেন যে তিনি হুজুরের সাথে দেখা করতে চান। পরে যখন হুজুর সকল অতিথিদের সাথে দেখা করেন তখন আমি তাকে বললাম যে এখন আপনিও হুজুরের সাথে সাক্ষাত করতে পারেন। তিনি বলেন “আমি সত্যিই তার সাথে দেখা করতে চাই। কিন্তু যখন সেই মুহুর্ত এসে গেল তখন আমি এমন একজন বড় মাপের মানুষের সাথে দেখা করতে লজ্জ্বিতবোধ করছি। আমি বহুদিন ধরেই আপনাদের খলীফার মতো একজনের সন্ধান করছিলাম। আমি এমন একজনকে খুজছিলাম যিনি প্রকৃতপক্ষে একজন শান্তির দূত। আজকে আমি যাকে খুজছিলাম তাকে পেয়ে গেছি। সত্যি বলতে আমি যখন এই অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম তখন আমি ভাবিনি যে আজ আমি এরকম পবিত্র ও সম্মানিত একজনের দেখা পাব। ”
স্হানীয় আহমদীদের অনুভূতি
সেদিন সন্ধ্যায় আমি একজন আহমদী নাসির আহমদ(৪১ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি জার্মান নিরাপত্তা দলের সদস্য। সফরের পূর্বে হুজুর নির্দেশ দিয়েছিলেন যে পাঁচ জন জার্মান খোদ্দাম নিরাপত্তা দায়িত্ব পালনের জন্য হল্যান্ড আসবেন। তিনি তাদের মধ্যে একজন। হল্যান্ডে তার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি বলেন “জার্মান নিরাপত্তা দলের একজন সদস্য হিসেবে হল্যান্ড যেতে পেরে আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি। সেখানে সবচেয়ে স্মরণীয় মুহুর্ত ছিল হুজুরের সাথে সাইক্লিং করতে পারা। তিনি বর্তমান বিশ্বে আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা। লাখ লাখ আহমদীর মধ্যে আমি একজন যার হুজুরের সাথে সাইক্লিং করার সৌভাগ্য হয়েছে। একদিন আমাদের হুজুরের সাথে লেকের পাশে ছবি তোলারও সুযোগ হয়েছে।”
আমি একজন তরুণ মোবাল্লেগ ইফতেখার আহমদ (২৮ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি গতদিন জামেআ থেকে শাহেদ সার্টিফিকেট নেন। তিনি অনেক লম্বা বিশাল দেহের অধিকারী। তার পাশে আমাকে খুজেই পাওয়া যাচ্ছিলনা। তিনি একটি অতিরিক্ত বড় মাপের আচকান কোট পড়েছিলেন। মোলাকাতের সময় হুজুর তার কোটের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন এবং উপদেশ দেন যে আচকান কোটা পাওয়ার সবচেয়ে ভাল স্হান হল রাবওয়া। হুজুরের সম্বন্ধে তিনি বলেন “হুজুরের ব্যাপারে একটি বিষয় আমাকে সবসময়ই অবাক করে। হুজুর কত বিশাল এক দায়িত্ব পালন করছেন। সমগ্র পৃথিবীর দায়ভার তার কাধের উপর। কিন্তু তারপরও হুজুর সবসময় শান্ত থাকেন। তিনি কখনো ভয় পান না। এটি প্রমাণ করে যে মহান আল্লাহপাকের উপর তার অগাধ বিশ্বাস রয়েছে।”
আমি একজন আহমদী মোহাম্মদ আনোয়ার বাট(৬৮ বছর) ও তার স্ত্রীর সাথে কথা বলি। তারা কিছুদিন হল পাকিস্তান থেকে জার্মানী এসেছে। তাদের সাথে কথা বলার সময় আমি নিজেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। কারণ তারা তাদের সারাজীবন খলীফাতুল মসীহর সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেছেন। সেদিন হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর তারা আনন্দে কেঁদে ফেলে।
তিনি বলেন “আমি সারা জীবন এই মুহুর্তটির জন্য অপেক্ষা করেছি। আমি আমার খলীফার সাথে একই বাতাসে শ্বাস নিয়েছি, তার পিছনে নামায আদায় করেছি, এটি আসলেই অবিশ্বাস্য। আমি আজ সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত; আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই।”
মার্ক এনথনি ম্যাককেই(২২ বছর) একজন নতুন বয়াতকারী আহমদী। তিনি তার স্ত্রী সহ হুজুরের সাথে দেখা করেন। আহমদীয়াতে আগমনের সফর সম্বন্ধে তিনি বলেন “পূর্বে আমি খৃষ্টান ছিলাম। কিন্তু আমি যেসব প্রশ্নের উত্তর খুজছিলাম খৃষ্টান ধর্ম আমাকে তা দিতে পারেনি। কিন্তু যখন আমি আহমদীয়াতের সন্ধান পেলাম এবং ইসলাম সম্বন্ধে জানতে পারলাম তখন আমি প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করলাম। আমি দেখলাম যে আহমদী মুসলিম জামাত কোন রাজনৈতিক দল নয় বরং এটি এমন এক দল যা আল্লাহর আরো কাছে যাবার পথ দেখায়। পূর্বে আমার জীবনের কোন অর্থ ছিল না। কিন্তু এখন আমার প্রতিটি মিনিট ও সেকেন্ডের একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। ”
হুজুরের সাথে তার সাক্ষাত সম্বন্ধে তিনি বলেন “প্রত্যেক দিনই আমি খিলাফতের গুরুত্ব সম্বন্ধে পূর্বের চেয়ে গভীরভাবে বুঝতে সক্ষম হই। খলীফাতুল মসীহ ব্যতীত আমাদের ইসলাম ধর্ম মৃত। আজকে হুজুরকে দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে তিনি কত পবিত্র এক সত্তা।”
সেদিন সন্ধ্যায় পাচঁজন তরুণ জার্মান ও তার্কীশ মহিলা হজুরের সাথে সাক্ষাত করেন। তাদের কেউ নতুন বয়াতকারী আহমদী ও কেউ আহমদীয়াত সম্বন্ধে জানতে এসেছেন। এসরা নামে একজন মহিলা ২ মাস পূর্বে বয়াত করেছেন। তিনি তুরস্কের অধিবাসী হলেও বর্তমানে জার্মানীর ফ্র্যাঙ্কফোর্টে বসবাস করছেন। তিনি বলেন “হুজুরের সাথে সাক্ষাতের সময় আমার মনে হল আমি এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে আছি। তিনি অনেক দয়ালু ও সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল। আমি তার সাথে মনে খুলে কথা বলতে পেরেছি। তার সাথে সাক্ষাতের পর আমার ঈমান আরো দৃঢ় হয়েছে।”
আর একজন জার্মান মহিলা যিনি আহমদীয়াত গ্রহণ করেন নি বলেন “খলীফার সাথে সাক্ষাতের পর আমি অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। তিনি আমাদের সকল প্রশ্নের জবাব দেন এবং কিছু কৌতুকও বলেন। তাই আমরা তারে সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে পেরেছি। এতে কোন সন্দেহ নেই যে তার সাথে কথা বলার পর আমি ইসলাম গ্রহণের অনেক কাছে চলে এসেছি।”
আর একজন জার্মান মহিলা জেনী বলেন “হুজুরের চারপাশে যে পরিবেশ পুরোপুরি অন্যরকম। আমি তখন একপ্রকার আলো অনুভব করি যেটি আগে কখনো অনুভব করিনি। তার পাশে থাকলে অন্য কোন দিকে তাকানোই যায়না। তার আধ্যাত্মিকতা সবাইকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। আমি আহমদী নই। কিন্তু আজকের পরে আমার মনে হচ্ছে আমি আল্লাহ ও ইসলামের আরো কাছে চলে এসেছি।”
এরপর তাদের দলে একজন বলেন “আমরা দুঃখিত, আর কথা বলা সময় নেই। কারণ আমাদের এখন আপা জান এর সাথে দেখা করতে যেতে হবে।”
তারা খুব ভালবাসার সাথে আপাজান বলে হুজুরের স্ত্রীকে সম্বোধন করে। মনে হচ্ছিল যে তারা অনেক দিনের পুরনো আহমদী। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখনো ইসলাম গ্রহণ করে নি।
ফ্র্যাঙ্কফোর্টে বিবাহ অনুষ্ঠান
১৮ অক্টোবর হুজুর কয়েকজন আহমদীর বিবাহের ঘোষণা দেন। এর পূর্বে হুজুর ছোট বক্তব্য দেন। এতে তিনি বলেন “স্বামী-স্ত্রীর উচিৎ একে অপরের প্রতি যে দায়িত্ব রয়েছে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। তাদের সন্তান যেন তাদেরকে নিজেদের জন্য আদর্শ মনে করে সেজন্য তাদের নৈতিকতার সর্বোচ্চ মান প্রদর্শন করা উচিৎ। ”
হুজুর এরপর কয়েকজনের বিবাহের ঘোষণা দেন। একজন আহমদী তার বোনের উকিল হিসেবে তার পক্ষে সম্মতি দিবে। হুজুর যখন তার বোনের বিবাহের ঘোষণা দিতে যাবেন তখন তার বোনের নাম বলার পূর্বেই সে উঠে দাড়ায় ও বলে “মনযুর হ্যায়” (আমি রাজী)।
হুজুর তার দিকে তাকিয়ে বলেন “তোমাকে আর একটু ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে। যখন তোমার কাছ থেকে সম্মতি চাওয়া হবে তখন সম্মতি দিবে।”
সবাই এতে হেসে উঠে এবং হুজুর বিবাহের ঘোষণা দেন। সঠিক সময়ে সেই আহমদী আবার সম্মতি প্রদান করেন।
এমটিএ পরিদর্শন
জার্মান এমটিএ র একজন সদস্য আমার কাছে এসে বলেন যে তারা আমার একটি সক্ষাৎকার নিতে চান। আমার শরীর তখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। তাই আমি কোন সাক্ষাৎকার দিতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু তারপরও আমি রাজী হলাম কারণ আমি তাদের হতাশ করতে চাইনি।
নামাযের পরে আমি এমটিএ স্টুডিওতে গেলাম। সেখানে ১৫ মিনিটের মতো সাক্ষাৎকার রেকর্ড করা হল। সেখানে আমাকে হুজুরের বিভিন্ন কর্মকান্ড ও সফর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়।
সাক্ষাৎকারের পর জার্মান এমটিএ স্টুডিওর ইনচার্জ মোজাফফর আহমদ সাহেব আমাকে তার অফিসে নিয়ে যান। সেখানে এমটিএর বাকি সদস্যরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি তাদের সবাইকে দেখে একটু বিস্মিত হয়ে যাই। তারা হুজুরের সাথে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা জানতে চান। আমি আমার সাধ্যমত তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করি। অনেকেই আছেন যারা প্রশ্ন শোনার সাথেসাথেই উপযুক্ত জবাব তৈরী করে ফেলতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার সেই দক্ষতা ছিল না। তাদের সাথে কথা শেষ করার পর আমার মনে হল যে তাদের প্রশ্নের আরো ভাল উত্তর আমার কাছে ছিল। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই, অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
তাদের সাথে আমি যেসব কথা বলেছিলাম তাদের একটি হল: “হুজুরের গত বছরের জার্মানী সফরের সময় আমি আমার ডায়েরীতে লিখেছিলাম যে হুজুর ও তার স্ত্রী গাড়ীতে সফরের সময় পপকর্ণ খাচ্ছিলেন। আমরা আহমদীরা হুজুরকে যতটা সম্ভব অনুসরণ করার চেষ্টা করি। তাই ডায়েরী প্রকাশের পরদিনই আমার কাছে বিভিন্ন দেশ থেকে আহমদীদের মেইল আসে। তাদের একটিই প্রশ্ন ছিল “পপকর্ণ গুলো কি মিষ্টি ছিল না লবণাক্ত?” আমি হুজুরের কাছে ব্যাপারটি খুলে বলে তার কাছে জানতে চাইলাম যে হুজুরের কোনটি পছন্দ। হুজুর বললেন “আমার লবণাক্ত পপকর্ণই বেশী পছন্দ, কিন্তু মাঝেমধ্যে আমি মিষ্টি পপকর্ণ্ও খেয়ে থাকি।”
জার্মান এমটিএ তে সাক্ষাৎকাতরের জন্য প্রস্তুত না থাকলেও সেখানে আমার ভালই লেগেছে।
একটি আবেগময় পর্যবেক্ষণ
১৯ অক্টোবর হুজুর ও তার কাফেলা লন্ডনের পথে রওনা হবেন। তাই সকালেই আমি আমার লাগেজ গুছিয়ে ফেলি ও গাড়ীর কাছে নিয়ে যাই। বাইরে যেয়ে দেখি যে কিছু খোদ্দাম কাপড় দিয়ে হুজুরের গাড়ী পরিস্কার করছে। হঠাৎ করেই আমি দেখি একজন ৬০ বছরের বৃদ্ধ তাদের কাছে যেয়ে বলেন “দয়া করে আমাকেও হুজুরের গাড়ী পরিস্কার করার একটু সুযোগ দাও।”
একজন খাদেম তাকে কাপড় দিলেন এবং তিনি হুজুরের গাড়ীর হেডলাইত পরিস্কার করে দিলেন। তিনি অনেক যত্ন ও সম্মানের সাথে লাইট পরিস্কার করে কাপড়টি খাদেমকে ফেরত দেন। এরপর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং শার্টের হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছতে থাকেন।
আমি তাকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম যে হুজুরের গাড়ী পরিস্কার করাকে তিনি অশেষ বরকত ও সম্মানের বিষয় বলে মনে করেন। এটি অনেক আবেগময় দৃশ্য ছিল। এটি আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে খিলাফতের বরকত কোন সাধারণ বিষয় নয়।
ফ্র্যাঙ্কফোর্ট থেকে বিদায়
সকাল ১০.৩০ মিনিটে হুজুর বায়তুস সুবাহ মসজিদ থেকে যাত্রা শুরু করেন। শত শত স্হানীয় আহমদী হুজুরকে বিদায় জানান।
সার্ভিস স্টেশনে নামায আদায়
দুপুর ৩ টায় আমাদের কাফেলা খাবার ও নামায আদায়ের জন্য বেলজিয়ামের পউযো সার্ভিস স্টেশনে যাত্রা বিরতি নেয়। অন্য কোন উপায় না থাকায় আমরা সার্ভিস স্টেশনের রেস্তোরাতেই নামায আদায় করি। সেটি একটি দেখার মতো দৃশ্য ছিল। হুজুর আমাদের নামাযের ইমামতি করছেন এবং রেস্তোরার অন্যান্যরা খাবার খাচ্ছে। ঘটনাটি আমাকে ২০১২ সালে আমেরিকার আপেলবিজ রেস্তোরায় হুজুরের নামায পড়ানোর স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়।
দুপুরের খাবার পরিবেশন
নামাযের পরে আমরা দুপুরের খাবারের জন্য বসি। হুজুর ও তার স্ত্রী এক পাশে একটি টেবিলে বসেন ও আমরা অন্য একটি টেবিলে বসি। আমি ও আহমদ ভাই পুনরায় হুজুর ও তার স্ত্রীকে খাবার পরিবেশনের সম্মানীয় দায়িত্ব পাই। হুজুর বিভিন্ন খাবারের মধ্যে হালকা করে ভাজা কড মাছ, পাশতা ও স্যালমন রোল নেন। আহমদ ভাই আমাকে খোঁজ নিতে বলেন যে কি কি মিষ্টান্ন রয়েছে। আমি একটি ছোট টেবিলে কিছু মিষ্টান্ন প্যাকেট করা অবস্হায় দেখি। সেখান থেকে আমি কিছু চীজকেক, চকোলেট ও একবাটি ফল নেই। কিন্তু তারপর আমি লক্ষ্য করি যে সেটি আসলে বাসায় খাবার নিয়ে যাবার স্হান। আর একটি টেবিলে বিভিন্ন মিষ্টান্ন প্লেটে সাজানো রয়েছে। আমি সেখান থেকেও কিছু নেই এবং সবগুলোই হুজুরের সামনে পেশ করি।
হুজুর জিজ্ঞেস করে যে এগুলো কোন প্রকারের কেক। একমাত্র মিষ্টান্নর ব্যাপারেই আমার অগাধ জ্ঞান রয়েছে। তাই আমি হুজুরকে বলতে সক্ষম হই যে কোন কেক এ কি রয়েছে।
হুজুর একটি চীজকেক ও কিছু ফল নিলেন। হুজুর যে কেকগুলো নেননি আমি সেগুলো নিরাপত্তা দলের একজনকে দিলাম। আমি নিশ্চিত যে কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই তারা সেগুলো শেষ করে ফেলেছিল। হুজুর খাওয়া শেষ করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমি কি খেয়েছি। আমি বললাম যে আমিও ভাজা মাছ নিয়েছিলাম। হুজুর ও তার স্ত্রীকে খাবার পরিবেশন করা আমার জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু হুজুর এ ব্যাপারেও অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। বিকেলে তিনি আমাকে বলেন “আমাদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করার জন্য ধন্যবাদ।”
আমি বললাম “হুজুরকে যে কোন উপায়ে সাহায্য করতে পারা আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়।”
রেস্তোয়ায় কিছু জার্মান আহমদীও এসেছিলেন। তারা শেষবারের মতো হুজুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেন। হুজুর উপস্হিত সকলের সাথেই দেখা করেন।
লন্ডনে ফিরে আসা
আমাদের কাফেলা বিনা বিরতিতে ক্যালসিসে পৌছায়। সেখানে আমরা রাস্তার পাশে কিছু শরণার্থীদের হাটতে দেখি। মনে হল তারা চ্যানেল পার হয়ে ইউকেতে যাবার চেষ্টা করছে। কয়েকজন লোককে দেখেই আমরা বলতে পারি যে তারা কিরকম অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের যা কিছু আছে, তা আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকতের জন্যই রয়েছে তাদেরকে দেখে আমাদের সেটি স্মরণ করা উচিৎ।
সন্ধ্যা ৬ টায় আমরা ইউকেতে প্রবেশ করি। ৭.৩০ মিনিটে হুজুর তার বাসায় পৌছান। সেখানে বহু আহমদী হুজুরের জন্য অপেক্ষা করছিল।
আমার পরিবারও আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে আমার ছেলে মাহিদের মুখেও বিরাট হাসি দেখতে পেলাম।
উপসংহার
অন্যান্যবারের মত হুজুরের এবারের সফরটিও একটি ঐতিহাসিক ও বরকতময় সফর ছিল। এটি কখনো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। হুজুর অত্যন্ত সুন্দরভাবে তার বাগ্মীতা দ্বারা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে হল্যান্ড সংসদে তুলে ধরেছেন; তিনটি মসজিদের ভিত্রি প্রস্তর স্হাপন করেছেন; অনেকগুলো সংবাদ মাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এবং জামেআ আহমদীয়া জার্মানীর সমাবর্তন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন।
হুজুর এত কিছুর মধ্যে সাইক্লিংও করেছেন।
আল্লাহতাআলা হুজুরকে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন দান করুন। আমীন।
শেষ