হুজুরের জার্মানী সফর ২০১৭ (১ম পর্ব)

ভুমিকা

৮ এপ্রিল ২০১৭, হুজুর ও তার কাফেলা ১৬ দিনের জার্মানী সফরের জন্য জন্য রওনা দেন। এ সময় হুজুর দুইটি স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ ডেনমার্ক ও সু্‌ইডেন সফর করবেন। সেখানে হুজুর দুইটি নতুন মসজিদ উদ্বোধন করবেন, দুইটি মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর স্হাপন করবেন এবং জামাতের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন মিটিং করবেন। কাফেলা সদস্যের মোট সংখ্যা ছিল ২৩ জন।

সফরের পূর্বাভাস

সফরের এক সপ্তাহ পূর্বে আমি হুজুরের অফিসে ছিলাম। কথা শেষ করে আমি যখন যাবার জন্য উঠে দাড়ালাম তখন হুজুর আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন ও বলেন

“ তুমি কি আমার সাথে জার্মানী যেতে চাও? ”

আমি এক মুহুর্ত দেরী না করে বলি

“অবশ্যই হুজুর।”

হুজুর বলেন “তাহলে সফরের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নাও। আমরা শনিবার রওনা দিব। পরিবারকে নিয়ে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে ফেল, যাতে তুমি চলে যাবার পর তাদের কোন অসুবিধা না হয়। ”

আমি হুজুরের অফিস থেকে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে বের হলাম।

 

হুজুরের দয়ার একটি উদাহরণ

সেদিন আমার ছেলে মাহিদের নার্সারী স্কুল ছুটি দিয়েছিল। আমি যেহেতু পরের সপ্তাহে চলে যাচ্ছি তাই আমি পরিবারের সাথে কিছু সময় কাটানোর জন্য হুজুরের কাছে দুই দিনের ছুটি চেয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম বিকেলে আমি হুজুরকে আমার রিপোর্ট দেবার জন্য আসব। হুজুর বলেন

“তোমাকে ছুটির অনুমতি দেয়া হল। দুই দিন বিকেলে রিপোর্ট দেবার জন্যও তোমার আসতে হবে না। পুরো দিন তুমি পরিবারকে সময় দাও। ”

আমাদের জন্য হুজুরের ভালবাসা অপরিসীম। আমার স্ত্রী ও সন্তান দুই দিন আমার সাথে ঘুরতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত ছিল।

দুই দিন ছুটি শেষে হুজুরের কাছে আসার পর হুজুর জানতে চান যে আমি কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমি বলি যে প্রথম দিন আমরা সিটি অফ লন্ডন, ন্যাচারাল হিসটোরি মিউজিয়াম ও দ্বিতীয় দিন শিশুদের থিম পার্ক, লিগোল্যান্ডে গিয়েছিলাম।

হুজুর বলেন যে খিলাফতের পূর্বে তিনি লন্ডনের কিছু ট্যুরিস্ট স্পটে ঘুরেছেন। কিন্তু লন্ডনের চোখ নামক একটি জায়গা আছে যেখানে বিশাল নাগরদোলা থেকে পুরো লন্ডন শহর দেখা যায়। হুজুর আমাকে বলেন ভবিষ্যতে পরিবারকে নিয়ে সেখানে যেতে।

আমি হুজুরকে বলি যে জার্মানী সফরের জন্য আমি ৭০ পাউন্ডে একটি স্যুটকেস কিনেছি।

হুজুর হাসেন ও বলেন “আমিও সম্প্রতি ১৮০ পাউন্ডে তিনটি স্যুটকেস কিনেছি।”

 

 

চিরায়ত রীতি নয়

এবার জার্মানী সফরের হুজুর কানাডার কয়েকজন জামেআ ছাত্রদেরও নিয়ে যাচ্ছেন। আমি তাদের কয়েক জনের সাথে কথা বলি। তারা অত্যন্ত আনন্দিত ও উত্তেজিত ছিল। হুজুর বলেন “এটি কোন চিরায়ত রীতি নয় যে আমি সকল সফরেই কিছু ছাত্রদের নিয়ে যাব। আমি তাদেরকে এবার সফরে নিচ্ছি কারণ আমার কানাডা সফরের সময় তারা প্রশিক্ষণের জন্য আফ্রিকাতে ছিল। তাই এবার তারা এই সফরের অভিজ্ঞতাও নিতে পারবে। ”

 

হুজুরের বক্তব্যে মোবাল্লেগদের প্রতি তার ভালবাসাই প্রকাশ পায়। হুজুর জানেন তরুণ মোবাল্লেগগণ অত্যন্ত দুঃখিত ছিল কারণ যখন হুজুর তাদের দেশে সফর করেন তখন তারা সেখানে থাকতে পারেনি। হুজুরের কানাডা সফরের সময় তারা হুজুরের নির্দেশে আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে জামাতের কাজ করছিল। তাই তাদের আনুগত্য ও ধৈর্য্যের পুরস্কার স্বরূপ হুজুর তাদেরকে এই সফরে যাবার অনুমতি দিয়েছেন।

 

মসজিদ ফযল থেকে যাত্রা শুরু

৮ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে আমি সকাল ৯.৫০ মিনিটে মসজিদ ফযলের উদ্দেশ্যে রওনা হই। গাড়ীতে উঠার পূর্বে হুজুর দোয়া করান এবং এরপর আমরা সফর শুরু করি।

দুপুর ১ টার দিকে আমরা ইউরোটানেলে প্রবেশ করি এবং ৩৫ মিনিটে চ্যানেল টানেল পার হয়ে ক্যালসিসে পৌঁছাই।

 

আমীর সাহেবের জন্য মিষ্টি

ক্যালসিসে আমরা একটি সার্ভিস স্টেশনে থামি। সেখানে জার্মানীর আমীর সাহেব ও জামাতের কয়েকজন সদস্য হুজুরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্হিত ছিলেন। হুজুর লক্ষ্য করেন যে আমীর সাহেবের গলার স্বর ভেঙ্গে গিয়েছে। আমীর সাহেব বলেন যে তার একপ্রকার ভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে এজন্য তিনি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছেন না। হুজুর তার গাড়ী থেকে একটি মিষ্টি নিয়ে আমীর সাহেবকে খেতে দেন। দিনের পরবর্তী সময়ে তার অবস্হার কিছুটা উন্নতি হয়। আমি নিশ্চিত হুজুর আমীর সাহেবের জন্য দোয়া করেছিলেন যার ফলে পরেরদিনই আমীর সাহেবের গলা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমি একজন স্হানীয় ডাক্তারের সাথে কথা বলেছিলাম, তিনি বলেছিলেন যে সাধারণত এধরণের ইনফেকশন ভাল হতে ৩-৪ দিন সময় লাগে।

 

কানাডার মোবাল্লেগদের জন্য বার্তা

হুজুর সার্ভিস স্টেশনে একটি দোকানে যান এবং আমাকে তার কাছে ডাকেন। তিনি জানতে চান যে সফর কেমন চলছে। আমি বলি যে আমার গাড়ীতে সিরজীল নামে কানাডার একজন তরুণ মোবাল্লেগ বসেছিলেন। তিনি এই সফরে আসতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন।

হুজুর বলেন “তাকে এবং অন্যান্য মোবাল্লেগদের বলবে যে বেশি আনন্দিত হবার কোন প্রয়োজন নেই। বরং তাদের উচিৎ বেশি বেশি করে দোয়া ও আল্লাহর ইবাদতে রত থাকা। ”

হুজুরের মন্তব্য অত্যন্ত সুন্দর ছিল। তিনি জানেন তরুণ মোবাল্লেগরা স্বাভাবিকভাবেই অনেক আনন্দিত থাকবে। কিন্তু তাদের এ সফরে আনার উদ্দেশ্য হল যেন তাদের আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। যখন হুজুর কোন সফরে যান, তখন হুজুরের প্রধাণ লক্ষ্য থাকে সেখান আহমদীদের আধ্যাত্মিকতা যেন বৃদ্ধি পায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই হুজুর তার সফরসঙ্গীদের জন্যও একই জিনিস চাইবেন।

 

দুপুরের খাবারের বিরতি

ক্যালসিসে স্বল্প বিরতির পর আমরা ফ্র্যাঙ্কফোর্টের উদ্দেশ্য রওনা দেই। দুপুর ৩ টার সময় আমরা বেলজিয়ামের একটি হোটেলে খাবারের জন্য থামি। হুজুর ও তার স্ত্রী হোটেলের একটি রুমে খাবার খান ও কাফেলার অন্যান্য সদস্যরা ডাইনিং হলে খাই।

খাবারের পূর্বে হোটলের একটি রুমে হুজুর জোহর ও আসর নামায আদায় করান। এরপর হুজুর কানাডার জামেয়া সদস্যদের সাথে কথা বলেন। তিনি জানতে চান যে পূর্বে কেউ জার্মানী এসেছিল কিনা। ফরহাদ গাফফার তার হাত উঠায়। কিন্তু হুজুর তাকে হাত নামিয়ে নিতে বলেন। কারণ সে জার্মানীতেই জন্ম ও বড় হয়েছে এবং পরবর্তীতে কানাডা গিয়েছে।

নামায শেষে হুজুর আমাকে ডেকে বলেন “জার্মান জামাত এবার দুপুরের খাবারের জন্য ভাল স্হান পছ্ন্দ করেছে। কিন্তু তুমি কানাডার ছাত্রদের বলবে যে সাধারণত আমরা সার্ভিস স্টেশনে খাবার খেয়ে থাকি। ”

হুজুর তরবিয়তের কোন সুযোগই নষ্ট করেন না। যারা প্রথমবারের জন্য হুজুরের সাথে সফর করছে হুজুর চাননি তারা খুব বেশি প্রত্যাশা করুক। বরং তিনি তিনি আশা করেন ওয়াকফে জিন্দেগীরা সাধারণ জীবন যাপনে খুশি থাকবে।

 

দুপুরের খাবার পরিবেশন

আলহামদুলিল্লাহ, আমি হুজুর ও তার স্ত্রীকে খাবার পরিবেশনের সুযোগ পেয়েছিলাম। যদিও খাবার পরিবেশনের জন্য আমি কেবল তাদের রুমে ট্রলি নিয়ে গেছি ও নিয়ে এসেছি। স্হানীয় জামাত আমাকে দুই বাটি আইসক্রীম ও এক বাটি ফল হুজুরের রুমে দিয়ে আসতে বলে। আমি হুজুরের রুমে যেয়ে দরজায় নক করি। হুজুর দরজা খুললে আমি জানাই যে হুজুরের জন্য ডেজার্ট নিয়ে এসেছি। হুজুর বলেন যে তারা ডেজার্ট খাবেননা।

কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে কাফেলার মধ্যে খাবার কখনোই নষ্ট হয় না।

বিকেল ৪.৩০ মিনিটে হুজুর ও তার স্ত্রী তাদের রুম থেকে বের হয়ে আসেন। হুজুর জানতে চান আমি কি খেয়েছি। আমি বলি যে আমি মাছ ও স্টেক খেয়েছি। হুজুর বলেন

“আমি শুনলাম যে স্টেক ভালভাবে রান্না হয়নি। তুমি যেখানেই স্টেক খাও সেটিই খারাপ হয়। যেমন তুমি কানাডা সফরে ৪০ ডলার দিয়ে স্টেক নিয়েছিলে যেটি তুমি খেতেই পারো নি। ”

হুজুরের স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর। তিনি মনে রেখেছে গত শীতে ক্যালগেরিতে আমি ৪০ ডলারের স্টেকটি খেতেই পারিনি। তবে জার্মানীর স্টেকটি এত খারাপ ছিলনা।

 

বায়তুস সুবুহ তে আগমন

রাত ৮.৪০ মিনিটে আমরা জার্মানীর বায়তুস সুবুহ মসজিদে পৌছলাম। সেখানে শত শত আহমদী হুজুরকে স্বাগত জানানোর জন্য উপস্হিত ছিল। তারা নারায়ে তাকবীর, নজম ও পতাকা নাড়িয়ে হুজুরকে স্বাগত জানায়। মাগরিব ও এশার নামায আদায় করার পর আমরা রাতের খাবারের জন্য ডাইনিং হলে যাই।

আহমদীদের আবেগ

৯ এপ্রিল ২০১৭ সকালে হুজুর কিছু আহমদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। বেশির ভাগ আহমদীই প্রথমবার অথবা অনেক বছর পর হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করছিল। আমি রহমত উল্লাহ নামে একজন তরুণ মোবাল্লেগের সাথে কথা বলি। তিনি পাকিস্তানে বড় হয়েছেন এবং কয়েক মাস পূর্বে জামেআ আহমদীয়ার শিক্ষক হিসেবে জার্মানীতে এসেছেন। তিনি বলেন

“পূর্বে আমি মানুষের কাছে ও বই পড়ে খিলাফতের নূর সম্বন্ধে শুনেছি। আজ আমি প্রতক্ষ্যভাবে সেই নূর দেখতে পেলাম। আমি বুঝলাম খিলাফতের প্রকৃত সৌন্দর্য বই পড়ে বা কারো কাছে শুনে বোঝা সম্ভব নয়। খলীফার সাথে কাটানো কিছু সময় আমার সারা জীবনের স্মরণীয় মুহুর্ত।”

 

আমি যাকা উল্লাহ(২৯ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি তার স্ত্রী সহ প্রথমবারের মতো হুজুরের সাথে দেখা করতে এসেছেন। তিনি বলেন “আমার বাবা-মা খলীফার সাথে দেখা করার সুযোগ পাননি। কিন্তু তাদের দোয়ার ফলে আমি ও আমার স্ত্রী আজ খলীফার সাথে দেখা করার বরকত লাভ করেছি। হুজুরের সাথে দেখা করা একটি জীবন পরিবর্তনকারী অভিজ্ঞতা। হুজুরকে কিছু সময়ের জন্য দেখে আমার মনে জামাতের সেবা করার ও জামাতের কাছাকাছি থাকার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে। ”

 

আমি মোহাম্মদ সেজাদ(৩৫ বছর, বয়াতকারী আহমদী) ও তার স্ত্রী সাদিয়া মুনীর সাহিবার সাথে কথা বলি। সেজাদ সাহেব বলেন “আমি হুজুরকে জানাই যে আমি ২০০৯ সালে আহমদীয়াত গ্রহণ করি। হুজুর বলেন যে মাঝেমাঝে নতুন আহমদীর মধ্যে কিছু দুর্বলতা দেখা যায়, হুজুর দোয়া করবেন যেন আমার ঈমান আরো দৃঢ় হয়। ইনশাল্লাহ হুজুরের দোয়ার বরকতে আমার ঈমান আরো বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ”

তার স্ত্রী সাদিয়া মুনীর সাহিবা (জন্মগত আহমদী) বলেন

“আজ আমাদের জন্য একটি অলৌকিক দিন। আমাদের দুই মাস বয়সের একজন বাচ্চা রয়েছে যে দুই মাস অপিরণত অবস্হায় ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তার আজ অথবা আগামীকাল ভূমিষ্ঠ হবার কথা ছিল। আমি আমাদের বাচ্চাকে হুজুরের কাছে নেবার জন্য মরিয়া ছিলাম। যেন আমরা হুজুরের দোয়া ও বরকত পেতে পারি। আল্লাহর রহমতে তাকে দুই দিন আগে ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে ছাড়া হয়। কিন্তু তারপরও এই যাত্রা তার জন্য অনেক কষ্টদায়ক ছিল। সে সারা পথই কাদঁছিল ও অস্হির ছিল। ”

“আমরা যখন ওয়েটি১ রুমে হুজুরের সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখনও সে অনেক কাদঁছিল। আমি অনেক চিন্তিত ছিলাম। তাই হুজুরের রুমে যেয়ে আমি হুজুরকে আমাদের বাচ্চার মুখে কিছু মধু দেবার জন্য অনুরোধ করি। হুজুর অনুগ্রহ করে আমার অণুরোধ রাখেন। তারপর থেকেই সে শান্ত হয়ে যায় এবং এরপর একবারও কাঁদেনি। আপনি নিজেও দেখতে পাচ্ছেন যে তাকে এখন সুস্হ ও সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। এটি খিলাফতের সাথে থাকার বরকত এবং নিঃসন্দেহে এটি সারাজীবন থাকবে। ”

 

একজন দর্জির ছেলের সেবা

আমি সকালে মাজিদ সাহেবের টেবিলে কিছু সুঁই-সুতা দেখতে পাই। আমি অবাক হয়ে ভাবি যে মাজিদ সাহেব কেন হঠাৎ করে সুঁই-সুতার বিষয়ে আগ্রহী হলেন। সেদিন বিকেলে আমি এর উত্তর পেলাম। তখন হুজুর মাজিদ সাহেবকে ডেকে পাঠান। সাধারণ হুজুর ডাকলে তিনি টুপি ও খাতা নিয়ে যান। কিন্তু এবার তিনি টুপির সাথে সুঁই-সুতা নিয়ে যান। ১০ মিনিট পর তিনি রুমে আসেন এবং বলেন “হুজুর সকালে তাকে বলেছিলেন যে তার আচকানের পকেটের ভিতরের সেলাই ছিড়ে গিয়েছিল। হুজুর মাজিদ সাহেবকে সেটি সেলাই করে দিতে বলেছিলেন। ”

আমি মাজিদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করি যে তিনি সেলাই এর ব্যাপারে কোন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কিনা।

তিনি বলেন “আমার বাবা পাকিস্তানে একজন দর্জি ছিলেন। যদিও আমার এ বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ নেই কিন্তু আমি বাবার কাছ থেকে সেলাই এর মৌলিক জিনিস শিখে নিয়েছি।”

আমার মনে হল এটি হুজুরের সাধাসিধে জীবন যাপনের একটি দৃষ্টান্ত। হুজুর চাইলেই নতুন কোট আনতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে তার স্টাফ মেম্বারের একজনকে দিয়ে দ্রুত কাজ করিয়ে নেন।

 

হুজুরের সাথে কিছু সময়

৯ এপ্রিল সন্ধ্যার সময় হুজুর আমাকে তার কাছে ডেকে পাঠান। আমার হাতঘড়ি দেখে হুজুর জানতে চান আমি স্হানীয় জার্মান সময়ের সাথে ঘড়ির সময় মিলিয়ে নিয়েছি কিনা। আমি বললাম “ঘড়ির সময় কিভাবে পরিবর্তন করতে হয় সেটি বের করতে আমার কিছুটা সময় লেগেছে। আমি যতবারই চেষ্টা করি শুধু তারিখ পরিবর্তন হয়, তারিখ একই থাকে। পরে আমি বের করলাম যে পাশের বাটনটিকে আরো একটি বের করে সেটি ঘুরাতে হবে।”

হুজুর বলেন “হ্যা। তারিখ পরিবর্তনের জন্য পাশের বাটনটিকে একবার টানতে হবে এবং সময় পরিবর্তনের জন্য দুবার।”

আমি হুজুরকে বলি যে মিশরে একটি সন্ত্রাসী দল কোপটিক খৃষ্টানের উপর আক্রমণ চালায়, এতে ১২ জনের মতো লোক মারা যায়। হুজুর বলেন “আমি খবরটি শুনেছি। আরবী ও উর্দুতে আমরা কপটিক কে কাবটি বলে উচ্চারণ করি। মহানবী(সাঃ) এর একজন স্ত্রী পূর্বে কপটিক ছিলেন যিনি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাই তিনি একজন উম্মুল মুমেনীন( মুমেনগণের মাতা)। তিনি মারিয়া কাবটি নামে পরিচিত। এখন সন্ত্রাসী দল ইসলামের নামে কপটিকদের হত্যা করছে। যেখানে ১৪০০ বছর পূর্বে মহানবী(সাঃ) শান্তির মাধ্যমে তাদের হৃদয়কে জয় করেছেন। ”

 

ওয়াল্ডশাট টিয়েনজেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা

১০ এপ্রিল,২০১৭ সোমবার হুজুর ও তার কাফেলা তিন দিন ও দুই রাতের ওয়াল্ডশাট সফরের জন্য রওনা দেন। নীরব প্রার্থনার পর আমাদের কাফেলা ১০.৪৫ মিনিটে ফ্র্যাঙ্কফোর্ট থেকে ওয়াল্ডশাট টিয়েনজেনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এটি সুইডেনের বর্ডারের কাছেই দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানীর একটি ছোট শহর যার জনসংখ্যা মাত্র ২৩০০০। এখানে জার্মানীতে আহমদীয়া জামাতের ৫০ তম মসজিদ উদ্বোধন হবে। হুজুর বিশ্বের আকর্ষণীয় স্হানে না যেয়ে দূরবর্তী ছোট একটি শহরে যাচ্ছেন। এতে বোঝা যায় হুজুর এসবের চেয়ে জামাতের কাজে সময় প্রদান করাকেই বেশী প্রাধান্য দেন।

 

সার্ভিস স্টেশনে যাত্রা বিরতি

দু্‌ই ঘন্টা পর আমরা একটি সার্ভিস স্টেশনে যাত্রা বিরতি নেই। সেখানে হুজুর একটি টেবিলে বসেন ও দয়া করে আমাকে কয়েক মিনিটের জন্য তার সাথে বসার সুযোগ দেন। কাছেই কফি বানাচ্ছিল তাই সেখানে সুগন্ধ ভেসে আসছিল। হুজুর বলেন “কফির সুগন্ধ অত্যন্ত লোভনীয়, তারা কফির সুগন্ধের মাধ্যমেই ভাল প্রচারণা করে নিচ্ছে। ”

আমি হুজুরকে বলি যে তার জন্য কফি নিয়ে আসব কিনা। কিন্তু হুজুর মানা করেন। হুজুর জানেন যে আমার কফি খুব পছন্দ। তাই হজুর আমাকে কফি নিতে বলেন। কিন্তু হুজুর কফি নিচ্ছেননা দেখে আমিও নিলাম না।

স্হানীয় জামাত আর একটু দূরের সার্ভিস স্টেশনে যাত্রা বিরতি নিবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু হুজুর একটু আগেই বিরতি নিতে চেয়েছেন তাই আমরা এখানে থেমেছি। এখানে এসে হুজুর বলেন “এটি খুব ভাল সার্ভিস স্টেশন এবং অনেক সুযোগ সুবিধাই এতে রয়েছে। আমি জানি না কেন স্হানীয় জামাত আরো দূরের সার্ভিস স্টেশন বেছে নিল। এটি সবদিক দিয়েই ঠিক আছে।”

আমি হুজুরকে বলি যে একজন তরুণ জামেআ শিক্ষার্থী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে হুজুর এই সফরের কোন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করবেন কিনা। আমি তাকে বলি যে হুজুর সফরের সময় গাড়ির জানালা দিয়েই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে থাকেন। হুজুর বলেন “হ্যা। আজ সকালে অনেক যানজট ছিল তাই গাড়ী অনেক ধীরে চলছিল। তখন আমি জানালা দিয়ে বাইরের সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করি। এটিই আমার জন্য যথেষ্ট।”

হুজুর কখনো নিজের জন্য চিন্তা করেন না। তার একমাত্র ইচ্ছা হল ইসলামের বিরুদ্ধে মানুষের যে ভুল ধারণা রয়েছে তার সংশোধন করা। হুজুর যখন কোন বক্তৃতা দেন তখণ তার কাঁধে বিরাট দ্বায়িত্ব থাকে। কারণ তিনি জানেন তার প্রতিটি কথা পুরো বিশ্ব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

সম্প্রতি হুজুর আমাকে বলেছেন যে গত বছরের ইউকে জলসাতে এক সাংবাদিক হুজুরের প্রশংসা করেছে কারণ হুজুর জলসাতে অনেকগুলো বক্তৃতা দিয়েছে। এর উত্তরে হুজুর বলেন “বক্তৃতা দেয়া কোন কঠিন ব্যাপার নয়। সকল রাজনীতিবিদ নিয়মিতভাবেই বক্তৃতা দিয়ে থাকে। কঠিন ব্যাপার হল আমি যা বলছি সেটি যেন প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও সঠিক হয়। ”

যখন সবাই জনপ্রিয়তা ও শ্রোতার প্রশংসা পাবার জন্য বক্তৃতা দেয়, সেখানে আমাদের খলীফা সবসময় লক্ষ্য রাখেন যে তিনি যা বলছেন তা যেন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুযায়ী হয়।

দুপুর ৩ টার সময় আমরা ওয়াল্ডশাট টিয়েনজেনে পৌছলাম। সেখানে আমরা একটি স্হানীয় হোটেলে উঠি।

 

হুজুরের সাধারণ জীবনযাপন

তিন দিনের সফরে আমি হুজুর ও তার স্ত্রীকে খাবার পরিবেশন করি। সত্যি কথা বলতে পরিবেশন করি বললে একটু বেশি বলা হয়ে যাবে। আমি কেবল খাবর তাদের রুমে দিয়ে আসি ও খাবার পর নিয়ে আসি। কিন্তু হুজুরের এটুকু সেবা করতে পেরেও আমি নিজেকে ধন্য বলে মনে করি। কিন্তু এর মাঝেও আমি হুজুরের সাধারণ জীবন যাপনের একটি দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। হুজুর কখনো কোন বিশেষ খাবার চাননি বা মেনুতে কি আছে তাও জানতে চাননি। বরং হুজুরকে যা দেয়া হতো তিনি বিনা অভিযোগে তাই খেয়ে নিতেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমি যখন কোন রেষ্টুরেন্টে যাই তখন আমি আমার পছন্দের খাবার বেছে নেই। কিন্তু হুজুর কখনো জানতে চাননি যে আর কি খাবার রয়েছে। হুজুরকে যে খাবার দেয়া হয়েছে তা নিয়ে তিনি কখনো অভিযোগ করেননি। যদিও আমি লক্ষ্য করেছি এই কয়দিনে হুজুর অনেক অল্প খাবার খেয়েছেন।

কয়েকদিন পর আমরা যখন ফ্র্যাঙ্কফোর্টে যাই, তখন আমি হুজুরের কাছে জানতে চাই যে খাবার হুজুরের পছন্দমতো ছিল কিনা। হুজুর বলেন একদিন খাবার তাদের ভাল লেগেছিল, আরেকদিন মোটামোটি ছিল এবং অন্যদিন তারা খুব একটা খেতে পারেননি।

আমি হুজুরের কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখ পেলাম। যে হুজুর মাঝেমাঝে ঠিকভাবে খেতেও পারেন নি। কিন্তু হুজুর এ নিয়ে কোন বিরক্তিভাব প্রকাশ করেননি। তিনি হাসিমুখেই আমাকে এসব বলছিলেন।

ওয়াল্ডশাটে হুজুরের একজন নিরাপত্তা কর্মী খাজা কুদ্দুস সাহেব আমাদের যবার কয়েকদিন আগেই সেখানে পৌছে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেন হুজুরের জন্য যে রুম ঠিক করা হয়েছে সেটি খুব ছোট। বিশেষভাবে রুমে যে খাবার টেবিল রয়েছে সেটি অনেক ছোট, তাই হুজুর ও তার স্ত্রী সেখানে ভালভাবে খেতে পারবেন না। আমি যখন হুজুরকে খাবার পরিবেশন করতে যাই তখন দেখি যে তাদের খাবার টেবিলটি সত্যিই অনেক ছোট।

খাজা কুদ্দুস সাহেব এজন্য হুজুরের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেন। হুজুর বলেন “আমাদের জন্য এটিই যথেষ্ট।”

 

জার্মানীর ৫০ তম মসজিদ উদ্ধোধন

দুপুরের খাবারের পর হুজুর ওয়াল্ডশাটে জামাতের নতুন নির্মিত মসজিদ আফিয়াত উদ্ধোধন করতে যান। সেখানে হুজুর জোহর ও আসর নামায আদায় করান। এটি জার্মানীতে জামাতের ৫০ তম মসজিদ। খলীফাতুল মসীহ রাবে(রহঃ) জার্মান জামাতের জন্য ১০০ টি মসজিদ নির্মাণের যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছিলেন  আল্লাহর রহমতে জার্মান জামাত তার অর্ধেক সফলভাবে সম্পন্ন করেছে।

 

SWR এর সাথে সাক্ষাৎকার

জার্মানীর SWR টিভি চ্যানেলের একজন সাংবাদিক মসজিদ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্হিত ছিলেন। তিনি নামাযের পর হুজুরকে একটি সাক্ষাৎকারের জন্য অনুরোধ জানান। অন্যান্য দেশে সাক্ষাৎকারের সময় পূর্ব থেকেই নির্ধারিত থাকে। কিন্তু জার্মানীতে মসজিদ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্হানীয় জামাত সেখানেই হুজুরকে সাক্ষাৎকারের অনুরোধ জানায়। তাই তখন স্টেজের পেছনেই কোনভাবে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্হা করা হয় যেটি কোন আদর্শ ব্যবস্হা নয়। এখানেই একই অবস্হা ছিল। আমীর সাহেব হুজুরকে সেখানেই সাক্ষাৎকারের অনুরোধ জানান। তাই সাক্ষাৎকারের জন্য কোন নীরব স্হানের পরিবর্তে মসজিদের এক পাশেই সেটি রেকর্ড করা হয়। যেখানে হুজুরের আশেপাশে অনেক মানুষ ছিল।

কিন্তু পরিস্হিত যাই হোক না কেন হুজুর কখনোই ইসলামের সঠিক শিক্ষা প্রচারের সুযোগ নষ্ট করেন না। সাংবাদিক হুজুরের কাছে জানতে চান কেন আমাদের জামাত এত ছোট শহরে মসজিদ বানাচ্ছে। হুজুর বলেন “সহজ কারণ হল আমাদের স্হানীয় সদস্যদের জন্য একটি স্হান প্রয়োজন যেখানে তারা একত্র হয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে পারবে। যেরকম ইহুদীদের সেনোগগ ও খৃষ্টানদের চার্চ, সেরকম আমাদের মসজিদও আল্লাহর ইবাদত ও মানাবসেবার কাজে ব্যবহৃত হবে।”

“আমরা শান্তির, ভালবাসা ও সৌহার্দ্যের বার্তা প্রচার করি। এগুলোই হল প্রকৃত ইসলামী শিক্ষা। আমরা কেবল মৌখিক দাবিই করিনা বরং আমাদের কাজের মাধ্যমে আমরা এগুলো পালন করি।  ”

 

মসজিদ আফিয়াত উদ্বোধন

সন্ধ্যায় হুজুর মসজিদ আফিয়াত উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ১১০ জন সম্মানিত অতিথি উপস্হিত ছিলেন। আমীর সাহেবের উদ্বোধনী বক্তব্যের পর স্হানীয় ব্যক্তিবর্গ ও ধর্মীয় নেতা শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন স্হানীয় খৃষ্টান ধর্মযাজক। অতিথিদের অনুরোধ করা হয়েছিল যেন তারা সংক্ষিপ্ত ২-৩ মিনিটের বক্তব্য দেন। কিন্তু তিনি প্রায় ১০ মিনিটের মতো বক্তব্য দেন। তার কথা শুনে আমার মনে হল এ সুযোগে তিনি আমাদের খৃষ্টান ধর্ম প্রচার করে নিলেন।

তার বক্তব্যের কিছু বিষয় ভাল ছিল। যেমন তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলেন। তিনি বলেন যে ইসলাম কোন সন্ত্রাসী ধর্ম নয়। সন্ত্রাসীরা সকল ধর্মকেই তাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছে।

তার বক্তব্য শেষে হুজুর তার বক্তব্য দেন। হুজুর বলেন “আমি খৃষ্টান ধর্মযাজকের প্রতি কৃতজ্ঞ কারণ তিনি আমার কাজ সহজ করে দিয়েছেন। আমি যেসব বিষয় বলতে চেয়েছিলাম তার অনেক কিছুই তিনি বলে ফেলেছেন যেমন ধর্মীয় স্বাধীনতা। এজন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই।”

খৃষ্টান ধর্মযাজক বেশি সময় নিয়েছেন বলে হুজুর কোনরকম বিরক্ত হননি। বরং হুজুর তাকে ধন্যবাদ জানান। হুজুর তার বক্তব্যে ইসলামের শিক্ষা, মসজিদের উদ্দেশ্য ও মানব সেবায় জামাতের কর্মকান্ড সম্বন্ধে কথা বলেন। হুজুর বলেন

“আমরা বিশ্বাস করি সকল দেশ ও জাতির জন্যই নবী প্রেরণ করা হয়েছে এবং আমরা সকলকেই আল্লাহ প্রেরিত সত্য নবী বলে স্বীকার করি। তাহলে এটি কিভাবে সম্ভব যে আল্লাহ বিভিন্ন দেশ ও জাতির মধ্যে বিভেদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ চাবেন।”

“ইসলামের শিক্ষা হল একজন প্রকৃত মুসলমানকে সকল ধর্মের ইবাদতগাহকে (চার্চ, সিনেগোন ইত্যাদি) রক্ষা করতে হবে। এটি সকল মুসলমানের জন্য আবশ্য কর্তব্য যেন সে সকল ধর্মের মানুষের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে এবং তাদের সাথে ভালবাসা ও দয়ার সহিত আচরণ করে। ”

 

“পূ্র্বে এখানে একটি মার্কেট ছিল যেখানে মানুষ পার্থিব জিনিস কিনতে আসত। এখন এটিকে আমরা মসজিদে রূপান্তর করেছি। এখন মানুষ এখানে আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জিনিস আহরণ করবে। আমরা এই মসজিদকে মানব সেবার একটি কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করব। পূর্বে এখানে জিনিস কিনতে অর্থ ব্যয় করতে হতো কিন্তু এখন এখানে দয়া ও ভালবাসা উপহার পেতে কিছু ব্যয় করতে হবে না।”

 

হুজুরের বক্তব্যের প্রভাব

হুজুরের বক্তব্যের পর আমি কিছু অতিথির সাথে কথা বলি। একজন অতিথি হর সাহেব বলেন “খলীফা বলেছেন যে আমাদের অমিলের চেয়ে অনেক বেশি মিল রয়েছে। তার কথা শুনে আমি আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছি। আমার ভাল লেগেছে যে তিনি খৃষ্টান ধর্মযাজককে তার বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় তিনি অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ যিনি আন্তধর্মীয় আলোচনাকে উৎসাহিত করেন যেখানে একজন ইমাম একজন খৃষ্টান ধর্মযাজকের প্রশংসা করছেন। ”

 

ড: এলিসা নামে একজন অতিথি বলেন “আমি খলীফার মুক্ত চিন্তাধারা দেখে অনেক প্রভাবিত হয়েছি। অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাহসিকতার সাথে তিনি সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তিনি যে এই ছোট শহরে এসেছেন এতেই প্রমাণিত হয় যে তিনি শান্তির জন্য বড় ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছেন এবং বোঝা যায় তিনি যদি একজনের হৃদয়কেও জয় করতে পারেন তাহলে তিনি সেটাই করবেন। ”

অতিথি মিসেস লফলার বলেন “সংবাদ মাধ্যমে আমি যে ইসলামের কথা শুনি আর আজকে আমি যে ইসলাম দেখলাম এই দুইটির মাঝে কোন মিলই নেই। আজকের ইসলাম ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও স্বাধীণ। আমার ভাল লেগেছে যে খলীফা মসজিদকে আধ্যাত্মিক মার্কেট বলেছেন যেখানে মানুষ আধ্যাত্মিকতা অর্জন করতে পারে।”

একজন মহিলা ক্রিস্টিনা বলেন “আমি আজ এখানে কোনরকম প্রত্যাশা নিয়ে আসিনি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে খলীফা এই পৃথিবীর মানুষ নন। তার প্রজ্ঞা সম্পন্ন বক্তব্য আমাদের জন্য একটি উপহার। আমি আশা করি এই উপহার যেন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি পরিস্কার করে বলছেন যে সন্ত্রাসীদের ইসলামের সাথে কোন সম্পর্ক নেই যেটি মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। আমি মনে করি আপনাদের খলীফাকে সকল মিডিয়াতে দেখানো উচিৎ। ”

 

জামাতে নামায আদায়ের গুরুত্ব

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে মাগরিব ও এশার নামাযের সময় হয়ে গেল। বেশির ভাগ স্হানীয় আহমদীই সেখানে উপস্হিত ছিল তাই তাদের মসজিদে যেতে কিছুটা সময় লাগবে। তাই হুজুর বললেন তিনি কিছুটা দেরী করে নামায আদায় করাবেন যেন বেশি সংখ্যক লোক উপস্হিত হতে পারে। জার্মানীর মোবাল্লেগ ইনচার্জ সাহেব বলেন “হুজুর, মসজিদে কিছু লোক থাকবে যারা সঠিক সময়ে আসেব। তাহলে তাদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে।”

হুজুর বলেন “যারা জামাতে নামায আদায় করতে চায় তারা নামায শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত দোয়া ও আল্লাহর যিকিরে রত থাকবে।”

দুঃসংবাদ

কয়েক মাস যাবৎ আমি শুনছি যে সাহিবযাদা মির্যা খুরশীদ আহমদ( নাযির এ আলা পাকিস্তান) সাহেবের স্ত্রী আমাতুল ওয়াহিদ সাহিবা অনেক অসুস্হ। তিনি হুজুরের ফুপু। হুজুরের সফরের পূর্বে তার শরীর আরো খারাপ করে। ওয়াল্ডশাটে অনুষ্ঠানের সময় হুজুরের প্রাইভেট সেক্রেটারী মুনীর জাভেদ সাহেব রাবওয়া থেকে একটি ফোন পান যেখানে তিনি জানতে পারেন যে আমাতুল ওয়াহিদ সাহিবা ইন্তেকাল করেছেন, ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন।

মুনীর সাহেব হুজুরকে দুঃসংবাদ দেন। হুজুর বলেন “ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন।”

এরপর হুজুর আগত অতিথিদের সাথে ইসলাম নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যান এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন। এটি হুজুরের ধৈর্যের একটি উদাহরণ এবং হুজুর ইসলামকে সবসময় অন্যান্য সকল বিষয়ের উপর প্রাধান্য দেন। তার ফুপুর মৃত্যুতে অনেক দুঃখ পেলেও হুজুর এক মুহুর্তের জন্যও তার কর্তব্য অবহেলা করেননি।

 

নামাযের পর হুজুর প্রায় রাত দশটার দিকে তার রুমে ফিরেন। হুজুরের রুম চারতলার করিডোরের একদম শেষ প্রান্তে। তার অপর পাশেই আমার রুম। মাঝের করিডোরটি অনেক সরু। তাই আমার ও হুজুরের রুমের মাঝে ২-৩ ফিট দুরত্ব। হুজুর যখন লিফট দিয়ে উপরে উঠেন তখন আমি প্রায় একই সময়ে সিড়ি দিয়ে উপরে পৌছাই। হুজুর আমাকে দেখে অনুষ্ঠান সম্বন্ধে জানতে চান। কিন্তু চারতলা সিড়ি বেয়ে উঠে আমার স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। তাই হুজুরের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার বেশ কষ্ট করতে হয়। আমি মনে করি আমার নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিৎ যেন অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে না পড়ি।

 

বিশেষ অতিথি

হুজুরের রুমের এত কাছে থাকা সত্যিই সৌভাগ্যের বিষয়। কিন্তু আমি সবসময় সতর্ক থাকি যেন আমার কোন কর্মকান্ডে হুজুর ও তার স্ত্রীর যেন কোন অসুবিধা না হয়। তাই রুমে এসে টিভি বা বাসায় ফোন না করে আমি ল্যাপটপে আমার কাজ করে থাকি।

কয়েক মিনিট কাজ করার পর আমার রুমে কেউ নক করে। আমি যখন দরজার কাছে যাই তখন শুনতে পারি যে হুজুর আমার নাম ধরে ডাকছেন। আমি লক্ষ্য করলাম এতে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছে।

আমি হুজুরকে আমার রুমে আমন্ত্রণ জানাই এবং হুজুর সোফাতে এসে বসেন। এর মধ্যে আমি মাথায় টুপি দিতে ভুলে যাই।

সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে হুজুর বলেন “সাক্ষাৎকারের সময় অনেক অল্প ছিল। যখন সময় কম থাকে তখন ইসলামের মূলনীতি প্রচার করাই সর্বোত্তম। তাই আমি ইসলামের শান্তি, সহিষ্ণুতা ও সকলের জন্য ভালবাসার শিক্ষার উপর আলোকপাত করেছি। ”

হোটেল পৌঁছে আজ আমি হুজুরের স্ত্রীকে হুজুরের ফুপুর ইন্তেকালরে জন্য সমবেদনা জানাই। কিন্তু এরপর আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে বুঝতে পারি যে তিনি ইন্তেকালের খবর পাননি। আমি ধরে নিয়েছিলাম যে তিনি নিশ্চয়ই কারো কাছে যেনে থাকবেন। এ ব্যাপারে হুজুর বলেন “আমি আমার স্ত্রীকে ইচ্ছে করেই তখন ব্যাপারটি জানাইনি। আমি রুমে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কারণ আমার স্ত্রী ফুপুর সাথে রাবওয়াতে লাজনাদের অনেক কাজ করেছে। তাই আমি চিন্তা করেছিলাম তাকে পরে ইন্তেকালের খবরটি জানাবো। ”

হুজুর যখন কথাগুলো বলছিলেন আমি তখন অত্যন্ত তীব্র অপরাধবোধে ভুগছিলাম। আমি হুজুরের কাছে আমার ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। কিন্তু হুজুরের আমার প্রতি কোন রাগ ছিল না। তিনি তার ফুপুর মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকার্ত ছিলেন।

হুজুর যাবার সময় বললেন “ভোর ৫.৩০ মিনিটে ফযরের নামায।”

আমি হুজুরকে বললাম “যাজাকাল্লাহ, আমি ভেবেছিলাম ৫.৪৫ মিনিটে ফযরের নামায। ”

হুজুর বলেন “না। নামায ৫.৩০ মিনিটে। সবাইকে জানিয়ে দাও।”

 

একটি আবেগঘন মিটিং

১১ এপ্রিল সকালে আমাদের কাফেলা বায়তুল নাসির মসজিদ উদ্বোধনের জন্য অগসবার্গ শহরে রওনা দিবে। হুজুর যখন গাড়ীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন তখন জার্মানীর আমীর সাহেব হুজুরকে বলেন যে একজন জার্মান মহিলা হুজুরের সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন। তাই হুজুর তার সাথে কথা বলার জন্য তার দিকে এগিয়ে যান। মহিলাকে খুবই আবেগপ্রবণ বলে মনে হচ্ছিল।

জার্মান মহিলার নাম হল সোফিয়া। তিনি কাছেই আক স্হানে মেডিকেল সেবা নিচ্ছিলেন। তখন তিনি আমাদের কাফেলার গাড়িগুলোকে হোটেলের সামনে পার্কিংরত অবস্হায় দেখেন। তাই তিনি কর্তব্যরত একজন খাদেমের কাছে জানতে চান যে এখানে এত গাড়ী কেন। খাদেম তাকে জামাত সম্বন্ধে বলে ও একটি লিফলেট দেয় যেখানে হুজুরের ছবি ছিল। সেই খাদেম আরও বলে যে আহমদীরা বিশ্বাস করে যে খলীফাকে আল্লাহ নির্বাচন করেন। এটি শুনে তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তিনি জানতে চান যে খলীফার সাথে দেখা করে তার দোয়া নেয়া সম্ভব হবে কিনা।

হুজুর যখন তার সাথে দেখা করতে যান তিনি হুজুরকে বলেন “আপনার সাথে দেখা করে আমার মনে হচ্ছে আমি পুরো পৃথিবী পেয়ে গেছি। এটি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান মুহুর্ত।”

হুজুর তাকে বলেন “ধন্যবাদ। আল্লাহ আপনাকে রহমত দান করুন। ”

সেটি খুবই আবেগঘন দৃশ্য ছিল। যেখানে পাশ্চাত্যের অনেকেই মুসলমানদের সন্ত্রাসী হিসেবে দেখে সেখানে একজন মহিলা যার পূর্বে জামাত সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিলনা, তিনি হুজুরকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।

পরবর্তীতে সেই খাদেম আমাকে জানায় যে তিনি হুজুরের সামনে হাটু দিয়ে বসে তাকে সম্মান জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে বোঝানো হয় যে মুসলমানরা বিশ্বাস করে কেবল আল্লাহর সামনেই মাথা নত করা যায়।

 

কানাডার মোবাল্লেগ

অগসবার্গ শহরের যাত্রাপথে আমরা কয়েক মিনিটের জন্য একটি সার্ভিস স্টেশনে বিরতি নেই। সেখানে হুজুর কাফেলার সাথে সফররত কানাডার তরুণ মোবাল্লেগদের ডাকেন। হুজুর জানতে পেরেছিলেন যে তাদের কেউ কেউ অসুস্হ। হুজুর জিজ্ঞেস করেন “তোমাদের মধ্যে কাদের মাথা ব্যথা রয়েছে।”

উত্তরে দুইজন তাদের হাত উঠায়। হুজুর বলেন “কারো মাথা ব্যথা বা সামান্য অসুস্হ হলে প্যারাসিটামল নিবে এবং তোমাদের দ্বায়িত্ব পালন করে যাবে।”

হুজুরের কথায় বোঝা যায় যে হুজুর চান তার প্রতিনিধিরা যেন শক্ত সামর্থ্য ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়।

সাজিদ ইকবাল তাদের মধ্যে একজন মোবাল্লেগ যে হুজুরের কথায় হাত তুলেছিল। সে আমাকে বলে “সার্ভিস স্টেশনে হুজুর বলেন কারো মাথা ব্যথা বা সামান্য অসুস্হ হলে প্যারাসিটামল নিবে এবং তোমাদের দ্বায়িত্ব পালন করে যাবে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী মুহুর্ত। কারণ হুজুরের অত্যন্ত ব্যস্ত সফরসূচীর মধ্যেও তিনি আমাদের কথা মনে রেখেছেন। ”

সার্ভিস স্টেশনে হুজুর লক্ষ্য করেন একজন মোবাল্লেগ পকেটে হাত দিয়ে দাড়িয়েছে। হুজুর বলেন “তোমার উচিৎ পকেট থেকে হাত বের করে নেয়া। আমি তোমাকে এটি মনে করিয়ে দিচ্ছি কারণ এটিও তোমার প্রশিক্ষণের একটি অংশ। ”

সে আমাকে পরবর্তীতে বলে যে সকল বিষয়ের প্রতি হুজুরের মনোযোগ দেখে সে আশ্চর্য। হুজুর জামাতের প্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণের কোন সুযোগই নষ্ট করেন না।

সিরজীল আহমেদ নামে আর একজন মোবাল্লেগ বলেন “হুজুরের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্তই অসাধারণ। সফরের সময় হুজুরের আমাদের প্রতি অনেক লক্ষ্য রাখেন। আমার জন্য একটি বিশেষ ঘটনা হল সার্ভিস স্টেশনে আমাদের সাথে হুজুরের কথা বলা। এটি বিশ্বাস করাই কঠিন যে যুগ খলীফা আমাদের সাথে সার্ভিস স্টেশনে কথা বলছেন। হুজুর আমাদের সাথে মজার কথা বলেছেন ও আমাদের প্রতি অনেক ভালবাসা প্রদর্শন করেছেন। ”

 

একটি অনন্য ডিসপ্লে বোর্ড

আমাদের কাফেলা বিকেল ৪.২০ মিনিটে অগসবার্গের নাসির মসজিদে পৌছায়। জামাতের স্হানীয় সদস্যরা এই  মসজিদের জন্য অনেক আনন্দিত ছিল। কারণ এই মসজিদের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার একটি হল মসজিদের গম্বুজ ও অন্যান্য অংশ রাতের বেলা বিভিন্ন রং প্রদর্শন করে। মসজিদের সামনে একটি এলইডি ডিসপ্লে বোর্ড রয়েছে যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সময় দেখানো হয়।

 

নাসির মসজিদ উদ্বোধন

হুজুর ফলক উন্মোচন ও নীরব প্রার্থনার মাধ্যমে মসজিদ উদ্বোধন করেন। এরপর হুজুর জোহর ও আসরের নামায আদায় করান। স্হানীয় মেয়র ও অন্যান্য কয়েকজন অতিথি তখন পাশেই দাড়িয়ে ছিলেন। এটি দেখে হুজুর জামাতের স্হানীয় প্রেসিডেন্টকে বলেন “আপনার উচিৎ ছিল মসজিদের পেছনে কিছু চেয়ারের ব্যবস্হা করা তাহলে অতিথিরা দাড়িয়ে না থেকে বসে থাকতে পারতেন।”

এরপর দ্রুত অতিথিদের জন্য কিছু চেয়ারের ব্যবস্হা করা হয়।

নাসির মসজিদ উদ্বোধন অনুষ্ঠান

পরবর্তীতে মসজিদের কাছেই একটি পার্কে মসজিদ উদ্বোধন অনুষ্ঠান করা হয়। সেখানে প্রায় ১৩০ জন অতিথি উপস্হিত ছিলেন যাদের মধ্যে মেয়র সাহেব ও কয়েকজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। জার্মানীর আমীর সাহেবের বক্তব্যের পর কিছু অতিথি শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। এরপর হুজুর তার বক্তব্য প্রদান করেন।

হুজুর তার বক্তব্যে মানবতার সেবায় জামাতের কর্মকান্ডের কথা তুলে ধরেন। যেমন জামাতের “ওয়াটার ফর লাইফ” প্রকল্পে হিউম্যানিটি ফার্স্ট ও IAAAE বিশ্বের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করে আসছে।

হুজুর বলেন “স্হানীয় মানুষরা যখন প্রথমবারের মতো বিশুদ্ধ পানি দেখে তখন তাদের চোখে মুখে যে আনন্দ দেখা যায় তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ছোট ছোট বাচ্চাদের মুখের হাসি দেখে মনে হয় যে তারা লক্ষ লক্ষ টাকার লটারী জিতে নিয়েছে। এ সকল সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সাহায্য এবং সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজের জন্যই আমরা মসজিদ নির্মাণ করি।  ”

অনুষ্ঠানের পূর্বে হুজুর মসজিদ প্রাঙ্গনে একটি গাছের চারা রোপণ করেন। এ ব্যাপারে হুজুর বলেন “আমরা গাছ রোপণ করি যেন পৃথিবী ও পরিবেশ সুন্দর থাকে এবং ফল দেয়। সেরকম আমরা আধ্যাত্মিক গাছও রোপন করি যেন আমরা ভালবাসা ও মানবতার ফল লাভ করতে পারি। তাই আমরা সবসময় আমাদের প্রতিবেশী ও আশেপাশের মানুষের সাথে ভালবাসা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করি এবং তাদের প্রাপ্য অধিকার দেবার জন্য সবসময় চেষ্টা করি। ”

“দ্বন্দ্ব ও বিভেদ সৃষ্টি না করে আমরা একে অপরের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করার চেষ্টা করি। আমাদের লক্ষ্য হল ভালবাসার সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে সকল মানবজাতিকে একত্র করা। ”

হুজুর জিহাদ সম্বন্ধে বলেন “মানুষের একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে তারা মনে করে মুসলমানরা সন্ত্রাসী হয়ে যায় কারণ পবিত্র কোরআনে সন্ত্রাসবাদ শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর সাথে সত্যের দূরতম সম্পর্ক নেই। কোরআন সবময় মানুষকে শান্তি, ভালবাসা ও নমনীয়তা শিক্ষা দেয়। শাব্দিকভাবে জিহাদের অর্থ হল সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। এটিই হল প্রকৃত জিহাদ এবং এটিই আহমদীয়া মুসলিম জামাত সারা বিশ্বে করে আসছে। ”

“সন্ত্রাসী দল দায়েশের নৃশংস কর্মকান্ড কেবল পশ্চিমা বিশ্বেই নয় বরং মুসলমান দেশসমূহেও রয়েছে। তারা কোন কারণ ছাড়াই হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের নেতাকে কোনভাবেই খলীফা বলা যাবে না। কারণ সকল বিষয়েই তারা ইসলামের শান্তিপূর্ণ শিক্ষাকে লঙ্ঘন করছে। ”

 

সাক্ষাৎকার

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর হুজুর কয়েকটি মিডিয়াকে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। একজন হুজুরকে জিজ্ঞেস করে শান্তি কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। উত্তরে হুজুর বলেন “পবিত্র কোরআন পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছে যে ধর্মে কোন জোর জবরদস্তি নেই। কোরআন আরো বলে তোমার জন্য তোমার ধর্ম আর আমার জন্য আমার ধর্ম। এটি হল সমাজে শান্তি স্হাপনের মূল ভিত্তি। এছাড়াও আলোচনা, সকলকে সম্মান করা ও তাদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে। অনেক সময় একটি পরিবারে দুই ভাইয়ের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে থাকে। কিন্তু এটি তাদের একে অপরের প্রতি ভালবাসাকে কমিয়ে দেয় না। তাই সমাজের মধ্যেই আমাদের একটি পরিবারের মতো থাকতে হবে। একে অপরের মতামতকে সম্মান করতে হবে। মানুষের মধ্যে যে বিভিন্নতা রয়েছে এটিকে আমাদের ঘৃণার কারণ হতে দেয়া যাবে না। ”

হুজুরের বক্তব্যের প্রভাব

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর আমি কিছু অতিথির সাথে কথা বলি। আনালিসা মেয়ের নামে একজন বলেন “আজকের অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত আবেগময় ছিল। আমার মনে হল আপনাদের খলীফা ক্যথলিকদের পোপের সমমর্যাদার একজন। সম্পূর্ণ বক্তব্যে হুজুর শান্তি স্হাপনের ব্যাপারেই কথা বলেছেন। তিনি জিহাদের ব্যাপারেও অত্যন্ত গভীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন জিহাদ মানে সন্ত্রাসবাদ বা যুদ্ধ নয় বরং এর প্রকৃত অর্থ হল নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সংগ্রাম করা।”

সাইমন ক্লাউস নামে একজন অতিথি বলেন “আমি এখানে আসার ব্যাপারে কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমি মনে করেছিলাম এটি কোন সন্ত্রাসীদের মিটিং এবং এখানে সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। কিন্তু আমার বন্ধুরা ইউটিউবে আহমদীয়া মুসলমানদের ভিডিও দেখেছে এবং তারা আমাকে আশ্বস্ত করে যে এটি একটি শান্তিপূর্ণ অনুষ্ঠান হবে। তাই আমি এখানে আসার সিদ্ধান্ত নেই। আমি এখন আনন্দিত কারণ আমি বুঝতে পেরেছি আমার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। ইসলাম সম্বন্ধে আমার পূর্বের ধারণা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। এখন আমি জানি যে ইসলামকে ভয় পাবার কিছু নেই। আহমদীয়া মুসলমানগণ কারো জীবন নিচ্ছে না বরং মানবতামূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে তারা মানুষকে জীবন দান করছে। আপানাদের খলীফা অত্যন্ত বিনয়ী ও আন্তরিক মানুষ। ”

 

ড: ই. ফ্রানয বলেন “আমি সবমসয় মনে করতাম যে ইসলাম প্রচারের একমাত্র মাধ্যম হল সন্ত্রাসবাদ। কিন্তু আজ আমি এমন এক ইসলাম দেখেছি যেটি ভালবাসার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়কে জয় করছে। আমি আপনার খলীফাকে ধন্যবাদ জানাই কারণ তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আমি জানতে পেরেছি যে খলীফা ৮ বছর আফ্রিকাতে মানবসেবামূলক কাজ করেছেন। এতে বোঝা যায় তিনি মানবতার জন্য অনেক বড় আত্মত্যাগ করেছেন।  ”

 

মিসেস জেবের বলেন “আজ আমি জানতে পেরেছে যে ১% মুসলমান সন্ত্রাসী হলেও ৯৯% মুসলমান ভাল ও শান্তিপূর্ণ। সত্য কথা হল সকল ধর্মেই ১% লোক থাকে যারা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাকে বিকৃত করে। তাই যারা বলে ইসলাম খারাপ এবং অন্য ধর্ম ভাল তারা অবিবেচকের মতো কথা বলে। আমি আশা করব আপানদের খলীফা জার্মানীর সকল স্হানেই যাবেন। কারণ জার্মানীতে ইসলামভীতি বেড়েই চলেছে। আমি মনে করি আপনাদের খলীফা আমাদের হৃদয় থেকে এই ভীতি দূর করতে পারবেন।”

কিন্তু মিসেস জেবের এটিও বলেন যে তিনি এটি জানতে পেরে বিস্মিত হয়েছেন যে মুসলমান মহিলারা অন্য হল রুমে বসেছে। পরবর্তী দশ মিনিট আমি তাকে আমাদের পর্দার ব্যাপারে বুঝিয়ে বলি। তাকে আমি মহিলাদের অংশে যেতেও অণুরোধ করি যেন তিনি মহিলাদের মতামতও জানতে পারেন। কিন্তু তিনি একটি কথাই বারবার বলতে থাকেন যে মুক্ত সমাজে মহিলা ও পুরুষকে অবশ্যই একসাথে বসতে হবে। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে মুক্ত সমাজে যদি পুরুষ ও মহিলা আলাদা বসতে চায় তাহলে সেটি করারও তাদের সুযোগ থাকতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে তার মতামত একই থাকে।

তিনি এই বিষয়ে অনেক দৃঢ় অবস্হান নিয়েছেন কারণ এ ব্যাপারে তার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি আমাকে বলেন “কয়েক বছর পূর্বে আমার মেয়ে একজন নন আহমদী মুসলমান মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করে। একদিন আমি যখন আমার মেয়েকে নিয়ে আসতে যাই তখন আমি শুনতে মুসলমান মেয়ের একজন পুরুষ আত্মীয় তাকে বলছে যে সে যেন আমার মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব না রাখে কারণ আমরা ভাল নই।”

মিউনিখে রাত কাটানো

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর আমরা মিউনিখের আল মাহদী মসজিদের গেলাম। সেখানে হুজুর মাগরিব ও এশার নামায আদায় করান। তখন প্রায় রাত ১০ টা বেজে গিয়েছিল এবং সারাদিন অনেক কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও নামাযের পর হুজুর লাজনা ও নাসেরাত সদস্যদের সাথে দেখা করতে যান। সেখানে থেকে রাতে থাকার জন্য আমরা পাশের একটি হোটেলে যাই।

আহমদীদের আবেগ

 

১২ এপ্রিল হুজুর আল মাহদী মসজিদে কিছু আহমদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমি তাদের কারো কারো সাথে কথা বলি। আমজাদ আলী (৩১ বছর) সাহেব বলেন “১৫ বছর জার্মানী থাকার পর আগামীকার আমি জন্মভূমি পাকিস্তানে যাচ্ছি। সেখানে আমি আমার পরিবারকে বলব যে একদিন পূর্বেই আমি আমার খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করেছি। আমি নিজের চোখে খলীফার নূরানী চেহারা দেখতে পেয়েছি। আমাদের খলীফা আমাদের দুর্বলতাকে ক্ষমা করে দেন এবং ভালবাসার সাথে আমাদের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। ”

সামার আহমদ (২৬ বছর) বলেন “খলীফার সাথে দেখা করা আমার ও আমার পরিবারের জন্য অত্যন্ত বরকতের বিষয়। কিন্তু আমরা আল্লাহর প্রকৃত বরকত তখনই পাব যখন আমরা পরিপূর্ণভাবে খলীফার আনুগত্য করব। খলীফার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করে আমি এখন আর ভালভাবে তার আনুগত্য করার চেষ্টা করব।”

ওমর লতিফ (৩১ বছর) বলেন “অগসবার্গের মসজিদ তৈরী করতে আমাদের আট বছর সময় লেগেছে। এই আট বছরকে আট শতাব্দী বলে মনে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে আমরা মনে করতাম আসলেই কি আমরা মসজিদ তৈরী করতে পারব। কিন্তু গতকাল খলীফাতুল মসীহ এই মসজিদ উদ্বোধন করেন। এই শহরে খলীফার আগমন আমাদের জন্য অত্যন্ত বরকতের বিষয়। খলীফার আগমনে আমাদের সকল সমস্যা ও কষ্ট এক মুহুর্তে মুছে গিয়েছে। একমাত্র খিলাফতই পারে সকল কষ্টকে আনন্দে পরিণত করতে। কেউ আমাকে পুরো বিশ্বের সকল সম্পদ উপহার দিতে পারে। কিন্তু আজ আমার আধ্যাত্মিক পিতার সাথে দেখা করে আমি যে আনন্দ লাভ করেছি তার সামনে জগতের সকল উপহার ম্লান হয়ে যাবে। ”

 

ইরফান তারিক (৩০ বছর) সাহেব বলেন “আমি এখানেই বেড়ে উঠি এবং ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট হিসেবে একটি কোম্পানীতে কর্মরত আছি। কেউ যখন বাইরের কোন কাজ করে তখন এটি অনেক সময় ভুলে যায় যে ধর্মের প্রতিও আমাদের কিছু কর্তব্য রয়েছে। তাই আমরা অনেক সৌভাগ্যবান যে হুজুর প্রতি বছর জার্মানীতে আসেন। আমরা যখন হুজুরকে দেখি তখন আমরা নিজেদের আধ্যাত্মিক অবস্হা নিয়ে চিন্তা করি। আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের জাগতিক কর্মকান্ডের কোন মূল্য নেই। ধর্মই আমাদের প্রধাণ লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। আজকের মোলাকাতে আমি হুজুরের কাছে জীবনের জন্য কিছু সাধারণ দিকনির্দেশনা চাই। হুজুর আমাকে বলেন যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা হল জীবনের সফল হবার মূল ভিত্তি। ”

“হুজুর জার্মানীতে আমাদের জামাতকে যেভাবে তুলে ধরেছেন তা সত্যিই অতুলনীয়। পূর্বে আমাদের অনুষ্ঠানে মিডিয়াকে আনতে অনেক অনুরোধ করতে হত। কিন্তু এখন হুজুরের বরকত ও দিক নির্দেশনার ফলে না ডাকলেও মিডিয়া আমাদের অনুষ্ঠানে এসে পড়ে। ”

 

কিছু বরকতময় মুহুর্ত

মোলাকাত শেষে হুজুর কয়েক মিনিটের জন্য আমাকে তার অফিসে ডাকেন। সেখানে আমি গতদিনের অনুষ্ঠানের অতিথি মিসেস জেবের সাহিবার কথোপকথন বলি। যে তিনি পুরুষ ও মহিলার আলাদা বসার ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেননি। হুজুর বলেন “এ অবস্হায় তোমার কোনরকম বিতর্ক বা আগ্রাসী মনোভাব দেখাবে না। বরং এ ধরণের অবস্হা ধৈর্য ও প্রজ্ঞার সাথে আলোচনা করতে হবে। যদি তোমার বোঝানোর পরও তিনি তোমার সাথে একমত না হন তাহলে তুমি কেবল এই কথাই বলবে “এই বিষয়ে আমাদের মতের ভিন্নতা রয়েছে এবং এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে বেশির ভাগ বিষয়ে আমরা একমত।” মনে রাখবে এসব বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা হল যেসকল বিষয়ে ঐকমত রয়েছে সেগুলোর সাহায্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। ”

হুজুর লন্ডনের সবাই কেমন আছে জানতে চান। আমি বলি যে কিছু বন্ধু আমাকে হুজুরের কাছে দোয়ার জন্য বলেছে কারণ তারা কেউ কেউ অসুস্হ। হুজুর বলেন “আল্লাহ সকলকেই সুস্বাস্হ্য দান করুন।”

হুজুর আমাকে বর্তমান বিশ্ব পরিস্হিতি সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেন। আমি হুজুরকে বলি যে ইউএসএ ও ইউকে G7 এর সদস্য দেশগুলোকে রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। কারণ রাশিয়া সিরিয়ান সরকারকে সাহায্য করছে। কিন্তু জার্মানী, ফ্রান্স ও ইটালী তা নাকচ করে দিয়েছে।

হুজুর বলেন “কয়েক সপ্তাহ পূর্বে জার্মানীর চ্যান্সেলর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে দেখা করেছিলেন। এটি শোনা যায় যে তখন ট্রাম্প তার সাথে গুরুত্ব সহকারে কথা বলেন নি। এখন জার্মানী ইউএসএর পলিসির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে দেশ হিসেবে জার্মানীর শক্তিমত্তা বোঝা যায়।”

 

দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন

মিউনিখে ৩ দিন থাকার পর নামায ও দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা ফ্র্যাঙ্কফোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। হুজুরের নিরাপত্তা দলের সদস্য মাহমুদ খান সাহেব গাড়ীতে আমাকে বলেন “দুই দিন আগে আমি তরুণ মোবাল্লেগদের সাথে কথা বলছিলাম। আমি তাদের বললাম যে যখন আমি প্রথমবার হুজুরের নিরাপত্তা দলের সদস্য হিসেবে বিদেশ সফর করি তখন খুবই উত্তেজিত ছিলাম। আমরা ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও বিভিন্ন দেশে সফর করতাম। আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করছি এটি চিন্তা করে আমি অনেক উত্তেজিত ছিলাম। কিন্তু যতই সময় যেতে লাগল সেই উত্তেজনা কমে যেতে লাগল এবং সেখানে চিন্তা ও ভয় আসা শুরু করল। ”

“প্রত্যেক সফর শেষে আমি খলীফাতুল মসীহর প্রতি বিশ্বের সকল আহমদীর যে  ভালবাসার বন্ধন ও তার মর্যাদা যে কত বড় সেটি সম্বন্ধে আরো গভীরভাবে বুঝতে পারি। আমি বুঝতে পারি যে পৃথিবীতে খলীফাতুল মসীহই আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। তাই আমি যদি আমার সকল শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে তার সেবা না করি তাহলে আমাকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ”

 

যাত্রাবিরতি

যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরই আমার টয়লেটে যাবার প্রয়োজন হল। কিন্তু আমার মনে হল না যে খুব দ্রুতই কোন যাত্রাবিরতি নেয়া হবে। গাড়ী চলতেই থাকল এবং আমি প্রার্থনা করতে থাকলাম যেন দ্রুত বিরতি নেয়া হয়। আমি অনেক আনন্দিত হলাম যখন আমাদের কাফেলা একটি সার্ভিস স্টেশনে বিরতির জন্য থামল। হুজুর গাড়ী থেকে নেমেই আমাকে তার কাছে ডাকলেন। আমি হুজুরের কাছে গেলে তিনি হেসে বলেন “আবিদ তোমাকে টয়লেটে যেতে হবে, তাই না?”

আমি হেসে বললাম যে জী হুজুর। হুজুর তখন কোন দেরী না করে আমাকে টয়লেটে যেতে বললেন। হুজুরের এই নির্দেশ পালন করার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম। আমি যখন গাড়ীতে ফিরে আসলাম তখন জানতে পারলাম যে অনেকেরই বিরতির প্রয়োজন ছিল। এমনকি কারো কারো অবস্হা আমার চেয়ে খারাপ ছিল।

বায়তুস সুবুহ তে আগমন

রাত ৮.৩০ মিনিটে আমারা বায়তুস সুবু্হ তে পৌঁছাই। যদিও হুজুর কেবল দুই দিনের জন্য গিয়েছিলেন কিন্তু হুজুর ফিরে আসাতে স্হানীয় আহমদীদের আনন্দ দেখে মনে হচ্ছিল তারা হুজুরকে অনেক বছর দেখেননি।

একটি অনন্য মোলাকাত

১৩ এপ্রিল ২০১৭ হুজুর কিছু আহমদী পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সাধারণত সকল মোলাকাত হুজুরের অফিসেই হয়ে থাকে। কিন্তু মোহাম্মদ আফজালের ছেলে রাওয়াল আফজাল (২৬ বছর) পক্ষাগাতগ্রস্হ। তাই তাকে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করত হয়। যখন তার পরিবারের হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করার সময় হল তখন তার হুইল চেয়ার হুজুরের অফিসে ঢোকানোর সময় দেখা গেল চেয়ারের ফ্রেম দরজার থেকে বড়। তাই হুজুর তাকে হুইলচেয়ারে বাইরেই বসতে বলেন এবং অন্যান্য সদস্যরা ভিতরে যায়। তারপর হুজুর তার অফিস থেকে বেরিয়ে রাওয়াল যেখানে অপেক্ষা করছিল সেখানে আসেন। তাই সে অফিসের বাইরেই হুজুরের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পায়। তার পুরো পরিবার অফিসের বাইরেই হুজুরের সাথে ছবি তোলে।

মোহাম্মদ আফজাল সাহেব আমাকে বলেন “আমরা কত ভাগ্যবান যে আমাদের খলীফার আমাদের প্রতি বিশেষ করে আমার ছেলের প্রতি এতটা ভালবাসা ও অনুগ্রহ দেখিয়েছেন। তিনি অনেক ব্যস্ত তারপরও তিনি আমার ছেলের সাথে দেখা করার জন্য বাইরে এসেছেন। এর চাইতে বড় বরকত আর কি হতে পারে!”

রাওয়াল বলেন “আমি পকিস্তানের শাহিওয়ালের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। সেখানে আমার অবস্হার যথাযথ কোন চিকিৎসা ছিল না। আমরা এখনো জানি না যে আমার অসুস্হতা জন্মগত নাকি তা জন্মের পরে হয়েছে। আমি কখনো হাটতে পারিনি এবং আমি আমার হাত অল্প নাড়াতে পারি। কিন্তু আল্লাহর রহমতে অসুস্হতা আমার ও খলীফার মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে বাধা দিতে পারেনি। আমি হুজুরকে নিয়মিত চিঠি দেই। আমি আমার মুখে একটি পেন্সিল রাখি এবং তা দিয়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডে চিঠি টাইপ করি। আপনি দেখে অবাক হবেন যে আমি কত দ্রুত টাইপ করতে পারি। আমি শিখেছি যে আল্লাহ মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা দান করেন।”

“হুজুরের অফিসে আসাও অনেক কঠিন ছিল কারণ আমার ইলেকট্রিক হুইলচেয়ার অনেক ভারী ও প্রশস্ত। মসজিদ ও করিডোরের মাঝ দিয়ে আসার সময় আমার অনেক কষ্ট ও দুশ্চিন্তা হয়েছে। ওয়েটিং রুমে এসে আমি অনেক আশাহত হই। কারণ আমি হুজুরের রুমে যেতে পারছিলাম না এবং হুজুরের সাথে দেখা করার আমার স্বপ্ন পূরণ হবে না। আমার পরিবার যখন হুজুরের অফিসে গেল তখন আমি বাইরে থেকে হুজুরের কথা শুনতে পারছিলাম। আমি নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছিলাম যে আমি হুজুরের যত কাছে এসেছি এর চেয়ে বেশি আমার ভাগ্যে নেই। কিন্তু যখন আমার পরিবারের সাথে মোলাকাত শেষ হল তখন আমি দেখলাম হুজুর আমার দিকে আসেছেন। আমি তখনকার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমি চিন্তা করছিলাম যে সত্যই কি আমার খলীফা শুধু আমার সাথে দেখা করার জন্যই অফিস থেকে বের হয়ে এসেছেন। এটি কিভাবে সম্ভব যে আমার মতো একজন তুচ্ছ ও দুর্বল মানুষের জন্য প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর খলীফা বের হয়ে আসবেন। নিঃসন্দেহে হুজুর সবচেয়ে দয়ালু ও ভালবাসাপূর্ণ এবং প্রত্যেক আহমদীর জন্যই হুজুরের ভালবাসা রয়েছে।  ”

“যখন মানুষ আমাকে দেখে তখন তারা মনে করে যে আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আমার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা। কিন্তু আমি মনে করি এটি সঠিক নয়। আসলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় সেটিই আমার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা। যেমন গত কয়েক মাস ধরে আমি কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না এবং ঘুমেও সমস্যা হচ্ছিল। এতে আমি অনেক হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু হুজুরের সাথে দেখা করে আমি নিজের মধ্যে এক প্রকার শক্তি অনুভব করছি। আমি নিশ্চিত হুজুরের দোয়ার বরকতে আমি আমার মানসিক সমস্যা কাটিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে জীবন যাপন করতে পারব। ”

 

হুজুরের সাথে কিছু মুহুর্ত

সন্ধ্যার সময় হুজুর আমাকে তার অফিসে ডাকেন। আমি হুজুরকে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত একটি দুঃখজনক ঘটনার কথা হুজুরকে জানাই। পাকিস্তানে একজন ইউনিভার্সিটির ছাত্রকে তার ভার্সিটিতেই হত্যা করা হয়েছে। কারণ তার বিরুদ্ধে গুজব শোনা যাচ্ছিল যে সে একজন আহমদী অথবা সে অনলাইনে আহমদীয়াতের প্রচার করত। তাই সে ব্লাসফেমী করেছে। হুজুর ঘটনাটি শুনে অত্যন্ত দুঃখ পান এবং দোয়া করেন “আল্লাহ তাদের দয়া করুন।”

হুজুর আমাকে বলেন যে তিনি আমার এক আমেরিকান বন্ধুর কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন যে তার ছেলে স্কুলে খারাপ কথা বলে। তিনি হুজুরের কাছে জানতে চেয়েছেন এজন্য তিনি তার ছেলেকে শাস্তি দিতে পারেন কিনা। হুজুর আমাকে বলেন “তোমার বন্ধুকে বলবে যে তার ছেলেকে শাস্তি দেবার কোন প্রয়োজন নেই। যদি সে এরকম ব্যবহার করে থাকে তাহলে বাবা হিসেবে দায়ভার তার উপরই বর্তায়। এতে বোঝা যায় সে তার সন্তানের সাথে সময় কাটায় না। তাকে বলো তার ছেলেকে নিয়ে লন্ডন এসে আমার সাথে দেখা করতে। ”

আমি আমার বন্ধুকে হুজুরের বার্তা পৌঁছে দেই। কয়েক সপ্তাহ পর সে লন্ডন এসে হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করে। সে আমাকে বলে হুজুর আমার ছেলের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন। তিনি আমার ছেলের সকল প্রশ্নের উত্তর দেন এবং প্রায় ১০ মিনিট কথা বলেন। আমরা হুজুরের দয়া গ্রহণ করে অত্যন্ত আনন্দিত।

 

রাউনহেইমে হুজুরের জুমআর খুৎবা

১৪ এপ্রিল ২০১৭ হুজুর জার্মানীর রাউনহেইমে জুমআর খুৎবা প্রদান করেন। গত কয়েকদিন ধরেন এমটিএর ডিরেকটর মুনীর ওদেহ সাহেব জুমআর স্হান নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। কারণ স্হানটি ফ্র্যাঙ্কফোর্ট এয়ারপোর্টের খুব কাছেই। প্লেন টেক অফের শব্দে জুমআর ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু স্হানীয় জামাত বলে যে এছাড়া আর কোন উপায় নেই। বায়তুস সুবুহ খুবই ছোট স্হান এবং স্হানীয় প্রশাসন ফ্র্যাঙ্কফোর্টের আনসার ও লাজনাদের মেইন হল ব্যবহার করার অনুমতি দেয়নি।

জুমআর প্রথম দিকে কয়েকটি প্লেন টেক অফ করে। এজন্য সাময়িকভাবে কিছুটা অসুবিধা হলেও বেশির ভাগ সময়ে আর কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু হুজুর জার্মান জামাতের দুর্বলতার কঠোর সমালোচনা করেন। হুজুর বলেন “আনসার ও লাজনাদের মেইন হল দুই বছর পূর্বে কেনা হয়েছে। কিন্তু জামাত এখনো স্হানীয় প্রশাসনের সাথে সেগুলো ব্যবহার করার জন্য কোন সমঝোতায় আসতে পারেনি। এর কারণ হল সকল কাজ শেষ মুহুর্তের জন্য ফেলে রাখা। পাকিস্তান ও আলজেরিয়ার মতো দেশে জামাতের কাজ করতে অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুক্ষীণ হতে হয়। কিন্তু জার্মানীতে জামাতের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। তাই এ সকল সমস্যা কেবল অলসতার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। ”

হুজুর খুৎবার পরবর্তী অংশে পাকিস্তান ও ভারতে তিনজন আহমদী যারা ইন্তেকাল করেছেন তাদের সম্বন্ধে কথা বলেন; তারা হলেন প্রফেসর আশফাক আহমেদ শহীদ, এইচ. নাসির উদ-দীন এবং সাহিবজাদি আমাতুল ওয়াহিদ বেগম।

 

একটি অনুপযুক্ত ভিডিও

সকালে হুজুর আমাকে মুনীর ওদেহ সাহেবের সাথে কথা বলে জামাতের একটি ভিডিওর ব্যাপারে খবর নিতে বলেন। সেখানে অগসবার্গ মসজিদ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে এবং ব্যাকগ্রাউন্ড শব্দ হিসেবে মানুষের গুনগুন শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাধারণত জামাতের ভিডিওতে ব্যাকগ্রাউন্ড শব্দ হিসেবে নযম বা আযান থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে কেবল গুনগুন শব্দ ছিল। জুমআর পরে মুনীর ওদেহ সাহেব হুজুরকে জানান যে এটি এমটিএ জার্মানী তৈরী করেছে। হুজুর বলেন

“ভিডিও ক্লিপটি পুরোপুরি অর্থহীন। এমটিএ জার্মানী কি এর চেয়ে ভাল কিছু তৈরী করতে পারেনি। এটি এই মুহুর্তে মুছে ফেলুন এবং এরকম যেসব ভিডিও রয়েছে তার একটি রিপোর্ট আমার কাছে পাঠান। ”

রিপোর্টের পর হুজুর নির্দেশ দেন যে এমটিএ জার্মানীর সকল ভিডিও সম্প্রচার করার পূর্বে সেটি যেন এমটিএ ইন্টারন্যাশনাল পরীক্ষা করে নেয়।

জুমআর নামাযে অংশ নিতে না পারা

আমাদের কাফেলা যখন রাউনহেম থেকে বের হচ্ছিল তখন আমি লক্ষ্য করলাম যে রাস্তার পাশে অনেক আহমদী পরিবার গাড়ীর ভেতরে অপেক্ষা করছে। এটি একটি আশ্চর্যে বিষয়। কারণ জুমআর পরে আমাদের কাফেলাই সর্বপ্রথম মসজিদ থেকে বের হয়েছে। তাই এতগুলো আহমদী জুমআর পর আমাদের পূ্র্বেই এখানে এসে থাকবে, এটি সম্ভব নয়। আমি জানতে পারলাম যে জুমআতে অংশগ্রহণকারী আহমদীর সংখ্যা অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তাই জামাত পরবর্তীতে আগত আহমদীদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। জানা যায় যে প্রায় ২-৩ হাজার আহমদী হুজুরের পিছনে জুমআর নামায আদায় করতে পারেনি। এর মধ্যে কিছু অন্য মসজিদে যেয়ে নামায আদায় করতে পেরেছে কিন্তু কিছু লোক একদমই জুমআর নামাযে অংশ নিতে পারেনি। এদের মধ্যে অনেকে বহুদূর থেকে এসেছেন।

আহমদীদের আবেগ

সন্ধ্যায় হুজুর আহমদী পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমি তাদের মধ্যে মাজহার আরাফাত (৩৫ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিন বলেন “আমি ২০০৫ সালে হুজুরের সাথে দেখা করেছিলাম। গত ১২ টি বছর আমি আধ্যাত্মিকভাবে ক্ষুধার্ত ছিলাম। প্রতি বছর হুজুর যখন জার্মানীতে আসেন আমি হুজুরের সাথে সাক্ষাতের জন্য আবেদন করি। কিন্তু আমাকে জানানো হয় যে আমার সময় এখনো আসেনি। আমি ভাবতে থাকি যে আমি কি হুজুরের সাথে দেখা করতে পারব। আমি ভাবি যে আমি হয়ত আধ্যাত্মিকভাবে হুজুরের সাথে দেখা করার মর্যাদা অর্জন করতে পারিনি। আজও আমি জানি যে হুজুরের সাথে সাক্ষাতের কোন যোগ্যতাই আমার নেই। আমি দুর্বলদের মধ্যেও দুর্বলতম। কিন্তু আল্লাহপাক আমার প্রতি অনেক দয়া প্রদর্শন করেছেন। হুজুরের সাথে দেখা করে আমার মনে হয়েছে আমি আল্লাহর কিছুটা হলেও কাছে পৌঁছেছি। আমি জানি যে আল্লাহ আমাকে ভালবাসেন কারণ তার ভালবাসা ছাড়া আমি এই বরকত লাভ করতে পারতাম না। ”

আমি রিজওয়ানা পারভেজ নামে একজন নতুন বয়াতকারী আহমদী মহিলা ও তার ছেলে সাদ এর সাথে কথা বলি। তার পাকিস্তানে একবার বিয়ে হয়েছিল; এরপর তার ডিভোর্স হয়ে যায়। তিনি এখন তার দ্বিতীয় স্বামী যিনি একজন আহমদী তার সাথে জার্মানীতে থাকছেন। তিনি বলেন “আমি যখন জার্মানীতে চলে আসছিলাম তখন আমার প্রথম স্বামী বলেন যে আমাদের ছেলেকে আমি জার্মানী নিতে পারব না। তিনি পাকিস্তান কোর্টে এজন্য একটি রিসট্রেইনিং অর্ডারের জন্য কেস ফাইল করেন। ”

“সেই কেস চলাকালীন সময়ে আমি দেখেছি যে আল্লাহপাক কিভাবে আহমদীদের সাহায্য ও রক্ষা করেন। আমি তখন আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করেছি এবং হুজুরের কাছেও দোয়ার জন্য চিঠি লিখেছি। একদিন হঠাৎ করে আমার প্রথম স্বামী বিচারকের সামনে উঠে দাড়িয়ে বলে যে আমি যদি আমার ছেলেকে নিয়ে জার্মানী যেতে চাই, এতে তার কোন আপত্তি নেই। এটি তার পূর্বের আচরেণের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা ছিল। এটি একটি অলৌকিক ঘটনা যে কিভাবে আল্লাহপাক তার খলীফার দোয়া কবুল করেন। এর ফলে আহমদীয়াতের প্রতি আমার বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়।”

“এখন আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে আমি সত্য ধর্ম গ্রহণ করেছি এবং প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর সকল দাবিই সত্য। আমি পাকিস্তানের মৌলভীদের বক্তৃতা শুনেছি। তাদের কথা আমার কাছে পুরোপুরি যুক্তিহীন ও অর্থহীন বলে মনে হতো। অপরদিকে খলীফার প্রতিটি কথাই অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন।”

“আমরা জার্মানীতে আসার পরও আমি জামাতের সাথে এতটা যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু একদিন আমার ছেলে সাদ এসে আমাকে বলল যে সে বয়াত করতে চায়। তার বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর কিন্তু সে বয়াত করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। যদিও তার মা হিসেবে আমারই তাকে অনুপ্রাণিত করা উচিৎ ছিল। কিন্তু তাকে দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি এবং আমার ঈমান দৃঢ় হয়েছে। ”

“পূর্বে আমি কখনো নামায আদায় করতাম না। কিন্তু এখন আল্লাহর রহমতে আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করি। আমি প্রতিদিন কোরআন পড়ি এবং তার অর্থ ও প্রকৃত জ্ঞান বোঝার চেষ্টা করি। আমার দেবর আমাকে জামাতের বই পড়ে শোনায় যার ফলে আমার বিভিন্ন বিষয় বোঝা সহজ হয়েছে। আমার এখন ইচ্ছে হল একজন প্রকৃত আহমদী হিসেবে জীবন অতিবাহিত করা। আমি দোয়া করি আমার আত্মীয়রা যারা আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে তারা যেন আহমদীয়াত গ্রহণ করে। তারা আমাকে ঘৃণা করে কিন্তু আমি তাদের ভালবাসি এবং আমি চাই তারা যেন খিলাফতের ছায়াতলে প্রবেশ করে।”

আমি তার ছেলে সাদ দূরানীর (১৬ বছর) সাথে কথা বলি। সে বলে “অধিকাংশ মানুষই কোন পার্থিব পুরস্কার পেলে খুশি হয়। কিন্তু আহমদীদের কোন পার্থিব পুরস্কারের প্রয়োজন নেই। কারণ আল্লাহ আমাদের সবচেয়ে বড় পুরস্কার দিয়ে দিয়েছেন সেটি হল খিলাফত। আমি পাকিস্তানে সেখানকার মোল্লাদের কথা শুনেছি। তারা যেভাবে ইসলাম প্রচার করে সেটি অত্যন্ত ঘৃণ্য। কিন্তু আমি যখনই খলীফার খুৎবা শুনি তখনই আমার খলীফার প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধি পায়। তার কথা শুনেই আহমদীয়াতের সত্যতা পরিস্কার হয়ে যায়। তাই আমি আমার মা কে বলি যে আমি যে কোন পরিস্হিতিতেই প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর জামাতে প্রবেশ করতে চাই।”

আমি আহমদী মোবাল্লেগ বাশারত আহমদ শাহীদ সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে এসেছেন এবং তাকে পূর্ব ইউরোপে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। পূর্বে তিনি কিরগিজিস্তানে পোস্টিংরত ছিলেন। কিন্তু সেখানকার মোখালেফাতের ফলে তাকে সেই দেশ ছাড়তে হয়। সে সময় সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমাকে যখন কিরগিজিস্তান ছাড়তে হয় তখন আমি কেন্দ্রে একটি রিপোর্ট পাঠাই। এর উত্তর হুজুর অত্যন্ত সুন্দর একটি চিঠি প্রেরণ করেন। কোন হতাশা বা বিরক্তি প্রকাশ না করে হুজুর লেখেন যে যখনই একটি দরজা বন্ধ হবে আল্লাহতা’লা হাজার দরজা খুলে দিবেন এবং কখনো প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর জামাতকে হতাশ হতে দিবেন না। ”

“হুজুরের কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা কিরগিজ ভাষায় একটি ওয়েবসাইট খুলি যেটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। তাই আমরা শারীরিকভাব উপস্হিত থাকতে না পারলেও আমাদের তবলীগ থেমে নেই বরং তা আরো বেড়ে গিয়েছে। ওয়েবসাইটে স্হানীয় মানুষ অনেক প্রশ্ন করে। আমরা সেগুলোর উত্তর দেই এবং সেখানে হুজুরের খুৎবা ও জামাতের অন্যান্য কর্মকান্ড পোস্ট করি। ”

কিছু মূল্যবান মুহুর্ত

১৫ এপ্রিল সকালে কিছু পরিবারের সাথে সাক্ষাতের পর হুজুর আমাকে তার অফিসে ডাকেন। আমাকে মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়া জার্মানী ও জামাতের উকিল সমিতির পক্ষ থেকে খলীফার সাথে আমার কিছু অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বক্তব্য প্রদানের অনুরোধ করা হয়েছে। আমি পূর্বেও এরকম কিছু বক্তব্য দিয়েছি কিন্তু এবার আমাকে তারা উর্দুতে কথা বলতে অনুরোধ করেছে। এজন্য আমি কিছুটা চিন্তিত ছিলাম কারণ আমার উর্দু একটু দুর্বল। আমি হুজুরকে আমার উদ্বেগের কথা জানাই। আমি ভেবেছিলাম হুজুর আমাকে ইংরেজীতে কথা বলার অনুমতি দিবেন। কারণ পূর্বে একবার হুজুর অনুমতি দিয়েছিলেন কারণ সেখানে বেশিরভাগই ইংরেজী বুঝতে পারত।

কিন্তু এবার হুজুর বলেন “হ্যা। তোমাকে উর্দুতেই বলতে হবে। কারণ মাত্র ১০% জার্মান খোদ্দাম ইংরেজী বুঝতে পারে। তুমি উর্দু বলার সময় মাঝে মাঝেই পুং ও স্ত্রী লিঙ্গ গোলমাল করে ফেল। আমি সবসময়ই তোমার ভুল ধরিয়ে দেই। এক্ষেত্রে তোমার উচিৎ সদর খোদ্দামকে অণুরোধ করা যেন তুমি কোন বড় রকমের ভুল করলে সে যেন তোমাকে সাহায্য করে।”

আমি হুজুরকে বলি যে আমি শুনেছি হুজুরের রুমের পানি খুব ঠান্ডা। হুজুর হাসেন ও বলেন “হ্যা। ফ্র্যাঙ্কফোর্টে আসার পর থেকেই আমি ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করছি। আজকে আমি তাদের এটি ঠিক করতে বলেছি।”

আমি বলি “হুজুর আমি গত দুই দিন ধরে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করছি। আমি ভেবেছিলাম আমার অবস্হা সবচেয়ে খারাপ। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আপনি আরও খারাপ অবস্হায় ছিলেন। ”

হুজুর উত্তরে হাসেন ও বলেন “মেজর সাহেবের পানি ঠিক আছে। আমার মনে হয় স্হানীয় জামাত মনে করেছে যদি মেজর সাহেব সন্তুষ্ট থাকেন তাহলেই সব ঠিক আছে।”

হুজুরের কথা শুনে আমি হেসে ফেলি।

এসময় আমি হুজুরকে বর্তমানে আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে সে সম্বন্ধে বলি। হুজুর বলেন “তোমার উচিৎ বাসায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাবার ও জিনিসপত্র মজুদ করে রাখা। আল্লাহ না করুন যদি নিউক্লিয়ার যুদ্ধ বেধেই যায় তাহলে তার বিধ্বংসী প্রভাব অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে।”

 

জেনারেল সেক্রেটারীর অফিস পরিদর্শন

হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর নামায শুরু হতে ১৫ মিনিট সময় ছিল। তাই হুজুর তার অফিস থেকে বের হয়ে জার্মানীর জেনারেল সেক্রেটারীর অফিসে যান। সেখানে জার্মানীর আমীর সাহেব, জেনারেল সেক্রেটারী ইলিয়াস মাজিকা সাহেব ও আরো কয়েকজন উপস্হিত ছিলেন। সেখানে হুজুর ১০-১৫ মিনিট বসেন এবং তাদেরকে গত জুমআর নামাযে অব্যবস্হাপনার জন্য কঠোরভাবে সমালোচনা করেন। কারণ সেদিন অনেক আহমদী নামায আদায় করতে পারেনি। হুজুর সেখানের স্হানের পরিমাণ জানতে চান এবং নিজেই ক্যালকুলেশন করে বের করেন যে সেখানে প্রায় ৬০০০ এর মতো মানুষ নামায আদায় করতে পারে। কিন্তু রিপোর্ট অনুযায়ী সেখানে ১১-১২ হাজার মানুষ নামায আদায় করতে গিয়েছিল।

হুজুর বলেন “সেসময় ইস্টারের বন্ধ চলছিল। তাই স্বাভাবিক ভাবেই জুমআর জন্য আগত আহমদীর সংখ্যা বেশী হবে। আপনাদের এজন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিৎ ছিল। হাজার হাজার গাড়ীকে ফিরিয়ে  দেয়া হয়েছে, তার মানে হাজার হাজার আহমদী জুমআর নামায আদায় করতে পারেনি।”

“এখানে বায়তুস সুবুহতে আমার খুৎবা দেখানোর মতো ভাল ব্যবস্হা নেই। আমি শুনেছি যারা এখানে জুমআর নামায আদায় করতে আসে তাদের অনেককেই ফোনে খুৎবা শুনতে হয়। কোন পরিকল্পপনা করার পূ্র্বে সকল বিষয় চিন্তা করে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হয়। আমাদের জামাতে সকলকে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। যদি সকল বিভাগের মধ্যে সমন্বয় না থাকে তাহলে সেই কাজ ব্যর্থ হবে। আমি যা বলছি তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করুন। ইনশাল্লাহ জার্মানীতে আহমদীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না করলে স্হান স্বল্পতার সমস্যা কখনোই কমবে না।”

হুজুর জানতে চান যে এই ঘটনার জন্য জামাত সকল সদস্যের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে কিনা। জেনারেল সেক্রেটারী সাহেব জানান যে একটি ড্রাফট এখনো বানানো হচ্ছে। হুজুর বলেন “এর জন্য তো এত সময় লাগার কথা নয়। আপনি সাথে সাথেই সকলকে একটি মেসেজ দিয়ে আপনাদের দুর্বলতা ও তাদের কষ্টের জন্য ক্ষমা চাইতে পারতেন।”

হুজুরের সাথে সাক্ষাত

দুপুরের খাবারের পর হুজুর তার বাসা থেকে বের হয়ে বায়তুস সুবুহ মসজিদের পাশে একটি খেলার হলরুমে যান। সেখানে প্রায় সকল বয়সের ৮০০ আহমদী উপস্হিত ছিল। তারা কখনো খলীফার সাথে দেখা করেনি। হুজুর হল রুমে যেয়ে স্টেজের সিটে বসেন। অনেকেই হুজুরকে প্রশ্ন করেন ও তার দোয়া চান।

একজন আহমদী বলেন “হুজুর আমি খলীফাতুল মসীহ হিসেবে আপনাকে আমার মালিক মোহাম্মদ (সাঃ) এর সালাম পৌঁছাতে চাই। যেটি তিনি ইমাম মাহদী(আঃ) কে দিয়েছেন।”

আর একজন আহমদী বলেন “আমি ও আমার মা কয়েক বছর পূর্বে পাকিস্তানে আহমদীয়াত গ্রহণ করেছি। আমাদের বাকি পরিবার এজন্য আমাদের উপর অত্যাচার করে। প্রথমদিকে তাদের অত্যাচার সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু আমার মায়ের মৃত্যুর পর সেটি অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। তাই আমি জার্মানীতে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই।”

হুজুর বলেন “সবসময় মনে রাখবে যে তোমার এখানে আসার প্রধাণ উদ্দেশ্য তোমার ধর্ম। তাই সর্বদা ইসলাম আহমদীয়াতের শিক্ষা মেনে চলার চেষ্টা করবে। যদি তুমি এখানে এসে তোমার শিক্ষাকে ভুলে যাও তাহলে এত কষ্ট করে এখানে এসে কোন লাভ নেই। লক্ষ্য রাখবে যেন তুমি সর্বদা ধর্মকে সকল জাগতীয় বিষয়ের উপর প্রাধান্য দাও। ”

প্রায় ২০ মিনিট পর হুজুর উঠে দাড়ান। আমি ভাবলাম যে হুজুর এবার চলে যাবেন। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখি যে হুজুর সামনে এগিয়ে সকল আহমদীকে তার সাথে হাত মেলানোর জন্য আমন্ত্রন জানান। পরবর্তী ১ ঘন্টা সকল আহমদী একজন একজন করে হুজুরের কাছে আসেন। তারা তাদের পরিচয় দেন, তাদের সমস্যা বলেন, দোয়ার জন্য আবেদন করেন ও হুজুরের সাথে ছবি তোলেন। হুজুর ধৈর্য্যের সাথে সকলের সমস্যা শুনে তাদের জন্য দোয়া করেন ও ছবি তুলেন। প্রথমদিকে আমি হুজুরের পাশেই দাড়িয়েছিলাম। এরপর আমি হাত পা নাড়ানোর জন্য একটু দূরে যাই। কয়েক মিনিট পর এসে দেখি হুজুরের সামনে বিশাল লাইন। আশে পাশের মানুষকেও ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। যেমন স্হানীয় যে খাদেমকে ছবি তোলার দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সে ক্লান্ত হয়ে আরেকজনকে ছবি তুলতে দেয় যেন কয়েক মিনিটের বিরতি নিতে পারে।

কিন্তু হুজুরকে দেখে এক মুহুর্তের জন্যও ক্লান্ত মনে হয়নি। হুজুর সকলের সাথেই হাসিমুখে ও ভালবাসার সাথে দেখা করেছেন। কেউ কেউ হুজুরের সামনে হাসিখুশী চেহারা নিয়ে আসত, কেউ তাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে না পেরে কেঁদে ফেলত।

একজন হুজুরকে বলে যে তিনি পাকিস্তান থেকে হেঁটে জার্মানীতে এসেছেন। এতে ৬ মাস সময় লেগেছে এবং অনেক বাধা বিপত্তির সম্মুক্ষীণ হতে হয়েছে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি সহি সালামতে জার্মানী এসে পৌঁছেছেন। তিনি বলেন আরো ২৬ জন আহমদী এভাবে হেটে জার্মানী আসার চেষ্টা করছে। তিনি হুজুরকে তাদের জন্য দোয়া করতে বলেন।

একজন আহমদী খোদ্দামকে হুজুর জিজ্ঞেস করেন “তোমার নাম্বার কত?”

হুজুর বোঝাতে চাইছিলেন যে ভাইবোনের মধ্যে তিনি কত নাম্বার। কিন্তু খোদ্দাম হুজুরের কথা বুঝতে ভুল করেছে। সে বলে “হুজুর আপনি কি আমার মোবাইল নাম্বার জানতে চাচ্ছেন। ”

হুজুর তার কথা শুনে হেঁসে ফেলেন।

যত সময় যেতে লাগল আমার মনে হল মানুযের সংখ্যা আরো বাড়তে লাগল। মনে হল রুম খালি তো হচ্ছেই না বরং ভীড় আরো বাড়ছে। অবশেষে ৩৫-৪০ মিনিট পর আমার মনে হল হলরুম একটু খালি হয়েছে। এক ঘন্টা পর হুজুর শেষ আহমদীর সাথে সাক্ষাৎ করে আর একটি হলরুমে গেলেন যেখানে তিনি লাজনাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারপর হুজুর তার অফিসে যেয়ে পারিবারিক মোলাকাতের জন্য সময় দেন। এরপর মাগরিব ও এশার নামাযের পূর্বে কয়েক ডজন আহমদী বাচ্চার আমীন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

 

একটি বরকতময় সপ্তাহ

আল্লাহতা’লার অশেষ বরকতে হুজুরের জার্মানী সফরের প্রথম সপ্তাহ শেষ হল। হুজুরের সাথে যারা ছিল তারা সকলেই খিলাফতের অশেষ বরকত দেখতে পেরেছে। তারা দেখেছে যে খলীফা অত্যন্ত চমৎকার ভাবে জামাতের ভিতরে ও বাইরে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা প্রচার করেছেন। যদিও আমি আমার পরের উর্দু বক্তব্য দেবার জন্য আগ্রহী ছিলাম না কিন্তু আমি সফরের পরবর্তী অংশের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।