কোভিড ১৯ লকডাউন (১ম পর্ব)

ভূমিকা

এ বছর অন্যান্য সময়ের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। এই ডায়েরী লেখার সময় পুরো বিশ্ব কোভিড ১৯ দ্বারা আক্রান্ত।

অতীতে, আমার লেখা সকল ডায়েরীতে বিভিন্ন ব্যক্তিগত ঘটনা, কিছু জামাতী অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য অফিসিয়াল মিটিং সম্বন্ধে বর্ণনা করেছিলাম।

এখানে কোভিড ১৯ সংক্রান্ত হুজুরের নির্দেশাবলী সম্বন্ধে লেখা হয়নি। বরং হুজুরের সাথে ব্যক্তিগত যে মোলাকাতের সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম সে সময়ে বর্ণনা করেছি।

অনন্য এক ভাইরাস

জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাস ব্যাপী আমি নিয়মিতভাবে হুজুরকে করোনাভাইরাসের সংবাদ প্রেরণ করতাম। প্রথম থেকেই একটি বিষয় পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল যে এটি কোন সাধারণ ভাইরাস নয়। শুরু থেকেই এমনকি, আন্তর্জাতিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা দেবার পূর্বেই হুজুর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিষয়টিকে বিবেচনা করছিলেন।

অনেক আহমদীই জানেন যে হুজুর প্রাথমিক দিকেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য হোমিওপ্যাথি ঔষধ ব্যবস্হাপনা প্রদান করেছেন। সে সময় মহামারী মূলত চীন ও আশেপাশের দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল।

একটি ঘটনা আমার মনে আছে, তখন প্রায় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়। ইউকে তখনও মহামারীর কারণে কোন লকডাউন প্রদান করেনি। আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করি যে করোনাভাইরাসে জামাতের বিভিন্ন কার্যক্রম ব্যহত হবে কিনা।

হুজুর বলেন

“হ্যা। মনে হচ্ছে সেরকমই হবে। শান্তি সম্মেলন মার্চের শেষের দিকে হবার কথা। কিন্তু আমার মনে হয়না সেটি এখন সম্ভব হবে।”

হুজুর জানতে চান :

“শান্তি সম্মেলন সম্বন্ধে তোমার কি অভিমত?”

আমি বিনয়ের সাথে উত্তর দেই :

“হুজুর, আমারও মনে হয় যে এটি আয়োজন করা অত্যন্ত কঠিন হবে। কারণ সে সময় সমগ্র ইউকে এবং অন্যান্য দেশ থেকেও অতিথিরা আসবেন। সেমসয় জনসমাগমের প্রতি সরকারী বিধি নিষেধও আরোপ করা হতে পারে। ”

হুজুর বলেন :

“হ্যা। আমরা জানব না যে কোন অতিথি সম্প্রতি কোথায় সফর করেছেন, কাদের সাথে দেখা করেছেন। কাজেই এতে অনেক ঝুঁকি রয়েছে। ”

কাজেই এই আলোচনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে যখন হুজুরের নির্দেশনায় শান্তি সম্মেলন বাতিল করা হয় তখন আমি অবাক হইনি। যদিও তখন ইউকেতে জনসমাগম নিষিদ্ধ ছিল না।

প্রতিরোধমূলক ব্যবস্হা

মার্চ মাস থেকে ইউকে ও আশেপাশের পরিস্হিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। আমরা টিভিতে স্পেন ও ইতালীর দুর্বিষহ অবস্হার খবর পেতে থাকি। সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ইউকের মধ্যেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু ইউকের সরকার তখনো অন্যান্য দেশের মতো বিধি নিষেধ আরোপে দ্বিধা করতে থাকে।

অপরদিকে, আমাদের জামাত হুজুরের দিক নির্দেশনায়, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্হা নেয়া শুরু করে দেয়। হুজুর জুমআর খুৎবার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী আহমদীদের এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।

যেমন, সরকারী কোন নির্দেশের পূর্বেই হুজুর অসুস্হ ও বৃদ্ধ মানুষদের বাসায় অবস্হান করার নির্দেশ দেন।

জামাতী অফিসের ব্যাপারে হুজুর আমাদের ব্যক্তিগতভাবে দিক নির্দেশনা দেন। হুজুর বলেন যে কিভাবে সামান্য উপসর্গ দেখা দিলেই জামাতের কর্মকর্তাগণ যেন বাসায় নিজেদের পৃথক করে ফেলেন।

এর পাশাপাশি, অন্যান্য ছোটখাট ব্যবস্হাও গ্রহণ করতে হবে। যেমন, প্রতি নামাজের পর সাদা কাপড় পরিস্কার করা এবং পরিবর্তন করা। কার্পেটের উপর সেই কাপড় বিছিয়ে দেয়া যেন জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে না পারে।

ভয়াবহ অনুভূতি

অবশেষের, মার্চের শেষভাগে ইউকেতে বিভিন্ন বিধিনিষেধ শুরু হয়। ২৩ মার্চ, ২০২০ তারিখে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যের পূর্বেই অনুমান করা যাচ্ছিল যে এবার প্রধানমন্ত্রী দেশব্যাপী লকডাউন দিতে যাচ্ছেন।

আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে এতে আমি অত্যন্ত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারণ এর ফলে আমার নিয়মিত রুটিন, হুজুরের কাছে আমি যে রিপোর্ট প্রদান করি সেটি ব্যাহত হবে। এই পরম সৌভাগ্য আমি বিগত ১২ বছর যাবৎ লাভ করে আসছি।

২৩ মার্চ ২০২০ তারিখ, হুজুরের সাথে মোলাকাতের সময় আমি দ্বিধাজড়িতভাবে জিজ্ঞেস করি :

“হুজুর, যদি সরকার লকডাউনের ঘোষণা দেয়, তাহলে কি আমি ইসলামাবাদের এসে রিপোর্ট করা চালিয়ে যাব? ”

আমি হুজুরের জবাব নিয়ে অত্যন্ত ভীত ছিলাম। হুজুরের উত্তর আমার আশংকাকেই সত্য বলে প্রমাণ করে। একইসাথে হুজুরের উত্তর আইনের শাসনের প্রতি ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গীও তুলে ধরে।

হুজুর বলেন :

“হ্যা, যদি সরকার লকডাউনের মাধ্যমে সফরের প্রতি বিধি নিষেধ আরোপ করে, তাহলে বাসায় অবস্হান করবে। এখানে আসার প্রয়োজন নেই।”

হয়ত হুজুর আমার মনের ব্যথা অনুধাবণ করতে পারছিলেন। এরপর হুজুর বলেন :

“এছাড়া আমরা ফোনের মাধ্যমে আলোচনা চালিয়ে যেতে পারব।”

এতে আমার কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। যদিও আমি পুরোপুরি বিষয়টি বুঝতে পারিনি। আমি মনে করেছিলাম হয়ত টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে আমার রিপোর্ট হুজুরের কাছে প্রেরণ করতে হবে। অথবা প্রাইভেট সেক্রেটারী মুনীর জাভেদ সাহেবের মাধ্যমে হুজুর আমাকে মাঝে মধ্যে দিক নির্দেশনা প্রদান করবেন।

লকডাউন

আমি গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরে আসি। এরপর গভীর মনোযোগ সহকারে প্রধাণমন্ত্রীর বক্তব্যটি শুনতে থাকি। সাধারণত আমি যখন কোন রাজনীতিবিদের বক্তব্য শুনি তখন তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু বলেন কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখি। যেন হুজুরকে সেই তথ্য প্রদান করতে পারি। কিন্তু, এসময় আমি গভীরভাবে তার বক্তব্য শুনি এবং এতে হুজুরের কাছে মোলাকাতের প্রতি কোন বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে কিনা সেটি বোঝার চেষ্টা করি ।

আমি যেরকম আশা করেছিলাম সেটিই হল। প্রধাণমন্ত্রী লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু একইসাথে তিনি এটিও উল্লেখ করেছেন যে কারো পক্ষে যদি বাসায় বসে কাজ করা সম্ভব না হয় তাহলে সে বাইরে যেয়ে কাজ করতে পারবে।

এটি শোনার পর আমার ওকালতি বুদ্ধি জাগ্রত হয়ে উঠে। যেটি গত ১৩ বছর যাবৎ ঘুমিয়ে ছিল। আমি একটি ‘লুপহোল’ পেয়ে গিয়েছি। আমি নিজেকে বোঝাই যে আমার পক্ষে বাসায় অবস্হান করে হুজুরের কাছে রিপোর্ট করা সম্ভব নয়। কাজেই সফর করে হুজুরের সাথে দেখা করা কোনভাবেই আইনবিরুদ্ধ হবে না।

কিন্তু, হুজুর আমাকে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী আমি হুজুরের সাথে মোলাকাত করতে যেতে পারব না। এজন্য আমাকে হুজুরের অনুমতি নিতে হবে। আমি সেরকমই করি। এর উত্তরে হুজুর আমাকে বলেন :

“এ সময়ে, প্রতি সপ্তাহে একদিন ইসলামাবাদে আস। বাকি দিন বাসা থেকেই কাজ করযদি কোন কারণে তোমাকে প্রয়োজন হয়, তখন আমি তোমাকে ইসলামাবাদের ডেকে আনব।  ”

হুজুরের নির্দেশ পড়ার পর আমার মধ্যে মিশ্র অনুভূতি কাজ করে। কারণ একদিকে অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত আমি হুজুরের কাছে স্বাভাবিকভাবে রিপোর্ট করতে পারব না। অপরদিকে আমি কিছুটা স্বস্তিবোধ করছি, যে অত্যন্ত সপ্তাহে একদিনের জন্য হলেও হুজুরের সাথে দেখা করতে পারছি।

দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিবর্তন

হঠাৎ করেই আমার পুরো কার্যক্রম সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। গত ১৩ বছর ধরে হুজুরের সাথে মোলাকাত আমার সকল চিন্তা ও কাজ জুড়ে ছিল। আমার অফিস ও ব্যক্তিগত জীবন মোলাকাতের সময়ের উপর নির্ভর করত। হঠাৎ করেই আমি বাসা থেকে কাজ করছি। প্রতিদিন ইসলামাবাদে সফর করতে হচ্ছে না। দৈনন্দিন মোলাকাতের জন্য কোন নোট নিতে হচ্ছে না। বরং, অন্যান্য সকলের মতোও আমি বাসা থেকে কিভাবে সন্তানদের শিক্ষা প্রদান করা যায় সে নিয়ে চিন্তা করছি।

সামনের সময় গুলোতে, গুগোল অনেক প্রয়োজনীয় ও বিশ্বাসী বন্ধু বলে বিবেচিত হয়। আমার বড় ছেলের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এর মাধ্যমে হয়ে যায়। সত্য কথা বলতে লকডাউনের প্রথম ২-৩ দিন আমার ভালই লাগে। সে সময় সুন্দর আবহাওয়া ছিল। আমি রৌদ্রজ্জ্বল বিকেলে প্রতিদিন বিকেলে হেটে বেড়াতাম।

কিন্তু দ্রুতই আমি হুজুরের সাথে সাক্ষাতের জন্য অস্হির হয়ে পড়ছিলাম।

ভিন্ন পরিস্হিতি

সপ্তাহের কোন দিন আমি হুজুরের সাথে দেখা করতে চাই সেটি হুজুর আমকেই নির্ধারণ করতে বলেন। তাই আমি শুক্রবারকে বেছে নেই।

হুজুরের সাথে সোমবার শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাই ২৭ মার্চ, শুক্রবার হুজুরের সাথে দেখার করার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। সন্ধ্যার সময় আমার মোলাকাতের সময়। কিন্তু আমি এতটাই আনন্দিত ছিলাম যে সকালেই ইসলামাবাদের চলে যাই।

আমি কিছুটা দুঃখিত ছিলাম কারণ লকডাউনের কারণে হুজুর জুমআর খুৎবা প্রদান করতে পারছেন না। এর পরিবর্তে হুজুর তার অফিস থেকে সরাসরি বার্তা প্রদান করবেন।

আমি লক্ষ্য করি, যে গত ৩-৪ দিনের ব্যবধানেই ইসলামাবাদের আবহাওয়া পুরো পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই তাপমাত্রা পরিক্ষা করা হচ্ছিল। কিন্তু এবার আমাকে তিন স্হানে তাপমাত্রা পরিক্ষা করা হল এবং এরপর আমি প্রধান ভবনে প্রবেশের অনুমতি পেলাম।

ইসলামাবাদ অনেক নীরব বলে মনে হচ্ছিল। ইসলামাবাদে থাকে না এরকম কেউই সেখানে ছিল না। কেবল মাত্র কয়েকজন এমটিএর সদস্য ছিল। ইসলামাবাদের বেশিরভাগ সদস্যই তাদের বাসায় অবস্হান করছিল।

হুজুরের অফিসের কর্মীসহ সকলের মুখেই মাস্ক ছিল। আমার কাছে কোন মাস্ক ছিল না। এতে আমি অস্বস্তিবোধ করছিলাম। তাই আমি দ্রুতই একটি মাস্ক এর ব্যবস্হা করি।

আমি একটি অবাক করা বিষয় জানতে পারি। যে খোদ্দামুল আহমদীয়া কিছু করোনাভাইরাস টেস্ট কিট সংগ্রহ করেছে। কয়েকজন অফিস কর্মী ইতোমধ্যে পরিক্ষাও করিয়েছেন। আমিও নিজেকে পরিক্ষা করার আগ্রহ প্রকাশ করি। পরিক্ষার পর যখন ফলাফল নেগেটিভ আসে তখন আমি আস্বস্ত হই।

প্রায় সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে আমি হুজুরের সাথে দেখা করার সৌভাগ্য অর্জন করি, আলহামদুলিল্লাহ। আমি হুজুরের সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটাই এবং তার কাছে রিপোর্ট পেশ করি।

হুজুর বলেন :

“আমি যদিও বলেছিলাম যে সপ্তাহের যে কোন দিন তুমি আসতে পার। কিন্তু আমি চিন্তা করছিলাম যে শুক্রবারই সবচাইতে উত্তম হবে।”

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, হুজুরের সামনের চেয়ার কিছুটা দূরত্বে রাখা হয়েছিল। আমি বুঝতে পারলাম যে হুজুরের নির্দেশে ইসলামাবাদের সকলেই এখন থেকে মাস্ক পরিধান করছে। সাক্ষাতের সময় কয়েকবার আমার মাস্ক মুখ থেকে সরে যায়। হুজুর আমাকে সতর্ক করেন এবং মাস্ককে ঠিকমতো উপরে উঠানোর জন্য বলেন। মাস্ক সঠিকভাবে কিভাবে পড়তে হবে সেটিও হুজুর দেখিয়ে দেন।  

সাক্ষাতের পর, আমি আবর দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি। কারণ আবারও এক সপ্তাহের জন্য আমি হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাব না। আমি নিজেকে মনে করিয়ে দেই যে অসংখ্য আহমদী রয়েছেন যারা কখনো হুজুরের সাথে সাক্ষাত করতে পারেন নি। আমার নিজের সামান্য দুঃখের জন্য অপ্রয়োজনীয়ভাবে দুঃখিত না হয়ে, আল্লাহ্‌পাকের এই বরকতের নিয়মিতভাবে শোকরিয়া আদায় করা উচিৎ।

শূণ্য মসজিদে জুমআর খুৎবা

৩ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে আমি পরবর্তী মোলাকাতের জন্য ইসলামাবাদ সফর করি। গত সপ্তাহে লকডাউনের জন্য হুজুর জুমআর খুৎবা প্রেরণ করতে পারেন নি। কয়েকজন আহমদী উকিলের সাথে কথা বলার পর হুজুর জুমআর খুৎবা প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেন।

এমটিএর মাধ্যমে হুজুরের জু্মআর খুৎবা শুনে বিশ্বব্যাপী সকল আহমদীগণই অত্যন্ত আনন্দিত হন। সরকারী বিধি নিষেধের কারণে জুমআর খুৎবা প্রদানের সময় মসজিদে হুজুর ছাড়া একজন এমটিএ ক্যামেরাম্যান ও মুয়াজ্জিন ছিলেন।

হুজুরের সাথে সাক্ষাতের সময় আমি জানতে চাই যে এভাবে জুমআর খুৎবা প্রদানে হুজুর কেমন অনুভব করছেন? হুজুর হেসে বলেন :

“এটি একদমই কঠিন ছিল না! আমি মুয়াজ্জিন অথবা ক্যামেরাম্যান এর দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর আমার মনে হচ্ছিল আমি অন্যান্য খুৎবার মতোই খুৎবা প্রদান করছি। ”

আমি বলি যে কিছূ আহমদী উকিল মনে করেন যে গত সপ্তাহেও হুজুর এভাবে খুৎবা প্রদান করতে পারতেন। হুজুর বলেন :

“হ্যা, ২-১ জন উকিল বলেছেন যে ২৭ মার্চ তারিখেও আমি দুই এক জনের উপস্হিতিতে মসজিদে খুৎবা প্রদান করতে পারতাম। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নেই যে সেই নাজুক পরিস্হিতিতে জুমআর খুৎবা প্রদান করা সঠিক হবে না।  ”

আমি এ সুযোগে হুজুরকে আর একটি প্রশ্ন করি। আমি বলি যে একজন আমার কাছে জানতে চেয়েছেন যে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে হুজুরের ব্যক্তিগত উদ্যম হ্রাস পেয়েছে কিনা?

এরকম কোন প্রশ্ন করা হয়েছে শুনে হুজুর অত্যন্ত অবাক হন। হুজুর বলেন :

“আমাকে কি বিষণ্ন বা হতাশ বলে মনে হচ্ছে? আল্লাহ্‌পাকের পরিক্ষা ও মানুষের মৃত্যুর কারণে  কিছুটা দুঃখ তো থাকবেই। কিন্তু মহান আল্লাহ্‌পাকের উপর আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। তাই বিষণ্ণ বা হতাশাগ্রস্হ হবার কোন কারণ নেই। ”

হুজুরের অফিস থেকে বের হবার সময় আমি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের ইউরোপ সফরের ডায়েরী পেশ করি। হুজুর বলেন যে সময় করে তিনি এটি নিরীক্ষণ করে দিবেন।

একটি অপ্রত্যাশিত ফোনকল

পরদিন ৪ এপ্রিল,২০২০ তারিখে সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে আমি উঠোনে আমার সন্তানদের সাথে বসেছিলাম। তখন প্রাইভেট সেক্রেটারীর অফিস থেকে আমার কাছে ফোন আসে। ফোন করেছিলেন মোবাল্লেগ গালিব জাভেদ সাহেব, যিনি প্রাইভেট সেক্রেটারীর অফিসে কর্মরত আছেন। তিনি বলেন যে হুজুর আমার সাথে কথা বলতে চান।

এটি শুনে আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে যাই। হুজুর কেন আমার সাথে কথা বলতে চান সে বিযয়ে আমার কোন ধারণাই ছিল না। আমি অত্যন্ত ভীত হয়ে যাই। আমি সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাড়াই। আমার স্ত্রী সন্তানদের কোনরকম শব্দ না করার জন্য ইশারা করি। দৌড়িয়ে আমার রুমে চলে যাই।

এক মুহুর্ত পর ফোনে হুজুরের কন্ঠ ভেসে আসে। হুজুর বলেন :

“আসসালামু আলাইকুম, তুমি কেমন আছ?”

আমার কন্ঠ জড়িয়ে আসে। পূর্বেও আমি হুজুরের সাথে কয়েকবার ফোনে কথা বলেছি। প্রতিবারই আমার এইরকমই অবস্হা হয়েছিল। যখন আমি ব্যক্তিগতভাবে হুজুরের সাথে দেখা করি, তখন মানসিকভাবে কিছুটা প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এরপর হুজুরের সাথে দেখা করতে যাই। কিন্তু ফোনে যখনই আমি হুজুরের সাথে কথা বলি সেটি সবসময়ই একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা এবং আমি মানসিকভাবে কোনরকম প্রস্তুতি নেবার সুযোগ পাইনি।

হুজুর আমাকে বলেন যে তিনি আমার লেখা ডায়েরীটি পড়েছেন এবং কিছু স্হানে সংশোধন প্রয়োজন। হুজুর এত দ্রুত সম্পূর্ণ ডায়েরী পড়ে ফেলেছেন শুনে আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে যাই। কারণ ডায়েরীটি ১০০ পৃষ্ঠারও বেশি ।

হুজুর বলেন যে তিনি পেন্সিল দিয়ে ডায়েরীতে সংশোধন করেছেন এবং গালিব সাহেব সেগুলো স্ক্যান করে আমাকে মেইল করবেন। কিন্তু, হতে পারে যে কোন লেখা আমি নাও বুঝতে পারি। এজন্য হুজুর আমাকে বুঝিয়ে দেবার জন্য ফোন দিয়েছেন।

হুজুর আমাকে একটি কলম বা পেন্সিল নিতে বলেন। আমি দ্রুত একটা কিছু খুঁজে নেবার জন্য আশে পাশে দেখতে শুরু করি, যেন হুজুরের মূল্যবান সময় নষ্ট না হয়।

হুজুর আমার ব্যক্তিত্ব খুব ভাল ভাবেই জানতেন। হুজুর বলেন :

“তোমার প্রয়োজনীয় সময় নাও, তাড়াহুরো করার কিছু নেই!”

আমি উঠোনে যেয়ে একটি কলম ও পুরনো একটি খাম খুঁজে পাই। আমি সেগুলো আমার রুমে নিয়ে আসি এবং হুজুরকে জানাই যে আমি প্রস্তুত হয়েছি।

পরবর্তী ১০ মিনিটে হুজুর আমার ডায়েরীতে কয়েকটি ভুল সংশোধন করে দেন।

একটি স্হানে আমি মুসলেহ মাউদ(রঃ) এর ইংরেজী ভাষার দক্ষতা সম্বন্ধে কিছু লিখেছিলাম। হুজুর বলেন যে আমি ঘটনাটি সঠিকভাবে উল্লেখ করিনি। এরপর হুজুর আমাকে পুরো ঘটনাটি ব্যাখ্যা করেন।

প্রকৃত ঘটনাটি সংশোধন করায় আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ও আশ্বস্তবোধ করি। কারণ পূর্বে আমি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলাম। আমি বুঝতে পারি যে, কেউ চাইলে আমার পূর্বের লেখাটিকে ভিন্নভাবে উপস্হাপন করতে পারত। এতে মুসলেহ মাউদ(রঃ) এর পবিত্র চরিত্রের উপর আপত্তি স্হাপন করার সুযোগ থাকত।

আরো কিছু বিষয় সংশোধনের পর হুজুর জার্মানীর একটি ঘটনার প্রতি নির্দেশ করেন। সেখানে আহমদীগণ একটি ব্রীজের উপর দাড়িয়ে হুজুরের কাফেলার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছিল। হুজুর বলেন :

“তুমি লিখেছ, যে আমি তাদের দেখেছি কিনা, সে ব্যাপারে তোমার কোন ধারণা নেই। আমি আহমদীদের লক্ষ্য করেছি, তাই তোমার সেটি উল্লেখ করা উচিৎ। এতে তারা আনন্দিত হবে।  ”

ফোন শেষ হবার পূর্বে হুজুর বলেন :

“তুমি কি এসময় মালাকে রান্না ও ঘর পরিস্কারের কাজে সাহায্য করছ?”

আমি হুজুরকে জানাই যে রান্নায় খুব একটা সাহায্য করছি না; কিন্তু ঘর পরিস্কারের ব্যাপারে সাহায্য করছি। হুজুরের প্রশ্ন শুনে আমি বুঝতে পারি যে হুজুর চাচ্ছেন আমি যেন আমার স্ত্রীকে যতটা বেশিই সম্ভব সাহায্য করি। কারণ আমাদের দুইটি বাচ্চা ছাড়াও একজন সদ্যভূমিষ্ঠ বাচ্চা রয়েছে। তাই পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ আমি মাঝে মধ্যে রান্নাও করি।

হুজুর ‘আল্লাহ্‌ হাফিয’ বলে ফোন রাখার পর আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ বোধ করি। আমি আবেগতাড়িত হয়ে যাই। কারণ এভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে হুজুরের সাথে ফোনে কথা বলতে পারব তা আশা করিনি।

নামের মধ্যাংশ

কয়েকদিন পর মুনীর জাভেদ সাহেব আমাকে ফোন করেন। তিনি বলেন যে হুজুর আমার সাথে কথা বলতে চান। এটিও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল এবং আমি এজন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।

আমি কেমন আছি জানার পর হুজুর জিজ্ঞেস করেন যে ২ দিন পূর্বে হুজুর আমার যে ডায়েরী দেখে দিয়েছিলেন, সেটি আমি পাবলিশ করেছি কিনা?

আমি হুজুরকে বলি যে আমি সেটি পাবলিশ করেছি। এ সুযোগে আমি হুজুরকে পাঠকদের কিছু প্রতিক্রিয়া জানাই।

ডায়েরীতে আমি লিখেছি যে মার্চ মাসে আল্লাহ্‌পাক আমাদের একজন কন্যা সন্তান দান করেন। আমি হুজুরকে জানাই যে অনেক মানুষ আমাকে এ জন্য মোবারকবাদ প্রদান করেন। হুজুর এ কথা শুনে বলেন :

“তুমি তোমার মেয়ের নাম উল্লেখ করো নি – মানুষজন কি তার নাম জানতে চায় নি?”

হুজুরের কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম যে হুজুর অত্যন্ত গভীরভাবে ডায়েরীর প্রতিটি বিষয় পড়েন। এটি সত্যিই এক অকল্পনীয় ব্যাপার যেখানে সামান্য জিনিসও তার চোখ এড়িয়ে যায় না।

উত্তরে আমি বলি :

“হুজুর, ২-১ জন নাম জানতে চেয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই কেবল মোবারকবাদ জানিয়েছেন। ”

এ সুযোগে আমি হুজুরকে বলি :

“হুজুর, এ সময় আমাদের মেয়ের জারিয়ার কোন মিডেল নেম দেয়া হয়নি। আমরা কি কোন মিডেল নেম দিব এবং যদি দেই তাহলে সেটি কি হতে পারে? ”

এক মুহুর্ত নীরবতার পর হুজুর বলেন :

“তোমরা তাকে জারিয়া আবিদ নামে ডাকতে পার।”

স্বভাবিকভাবেই আমি এতে অত্যন্ত আনন্দিত হই। আমি চিন্তা করিনি যে আমার মেয়ের নামের মাঝে আমার নামও থাকবে। আমি যখন আমার স্ত্রী মালাকে এ কথা জানাই সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। কারণ হুজুর আমাদের মেয়ের নামের কেবল ফার্সট নেম নয় বরং মিডেল নেমও নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

আমি হুজুরকে ডায়েরী সম্বন্ধে বিভিন্ন মানুষের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছিলাম। একসময় আমি একজন ব্যাক্তির উক্তি ভুল বলে ফেলি। আমার বলা উচিৎ ছিল :

“তিনি লিখেছিলেন যে হুজুরের বক্তব্য তার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে..”

এর পরিবর্তে আমি হুজুরকে বলি :

“তিনি লিখেছিলেন যে আমার বক্তব্য তার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে..”

যদিও আমি দ্রুত আমার ভুল সংশোধন করে ফেলি, কিন্তু হুজুর ইতোমধ্যেই সেটি লক্ষ্য করে ফেলেন।

হুজুর হেসে বলেন :

“আমার মনে হয়, বাসায় থেকে তুমি মালাকে অনেক বক্তব্য প্রদান করছ। এজন্য তুমি মনে করেছো যে, সেই মহিলা তোমার বক্তব্যের কথাই বলছেন!”

আমি হুজুরের কথায় হেসে উঠি। কিন্তু একইসাথে আমি হুজুরের কথার গভীরতাও চিন্তা করি। বাসায় থাকার কারণে আমি হয়ত ঘরের ব্যাপারে বেশিই মতামত প্রদান করছিলাম।

একজন অনুগত সেবক

হুজুরের সাথে ফোন কল শেষ হবার পূর্বে আমি হুজুরকে তার নিরাপত্তা দলের একজন অনুগত সদস্য, নাসির সাইদ সাহেবের মৃত্যুর জন্য সমবেদনা জানাই।

তাকে কয়েকদিন পূর্বে হার্ট এট্যাকের পর হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি একদিন পূর্বে মৃত্যুবরণ করেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজেউন।

তার মৃত্যুর ঘটনা সকলের জন্যই কষ্টদায়ক। গত ইসলামাবাদ সফরের সময় হুজুরের বক্তব্য আমি তার মৃত্যুর ইশারা পেয়েছিলাম। গত শুক্রবার, নাসির সাহেবের মৃত্যুর মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। আমি হুজুরকে গুজবের বিষয়টি জানাই। হুজুর এতে মোটেও সন্তোষ প্রকাশ করেননি। কিন্তু, একইসাথে হুজুর এটিও বলেন যে হয়ত তিনি আর বেশি সময় আমাদের মাঝে থাকবেন না।

সে সময় হুজুর বলেন :

“তিনি বেঁচে থাকা অবস্হায় কেন মানুষ তার মৃত্যুর সংবাদ ছড়াচ্ছে? এটি পরিস্কার করা প্রয়োজন যে এ ধরণের গুজব একেবারেই মিথ্যা এবং অসম্মানজনক। হতে পারে যে তার এই পরিস্হিতিতে তিনি হয়ত বেশি দিন বাচঁবেন না। কিন্তু কারো মৃত্যুর পূর্বেই সেটি প্রচার করা অত্যন্ত অবিবেচক ও ভুল একটি কাজ। এটি আমাদের দুঃখকে অযথাই বাড়িয়ে তুলে। ”

আমার সমবেদনা জানানোর পর হুজুর ফোনে বলেন :

“হ্যা, বর্তমান কোভিড লকডাউন পরিস্হিতিতে বিষয়টি আরো কঠিন এবং দুঃখজনক। তার পরিবার মৃত্যুর পূর্বে তাকে হাসপাতালেও দেখতে যেতে পারে নি। এখন তাদের কাছে ব্যক্তিগতভাবে যেয়েও সমবেদনা জানানো যাচ্ছে না। এটি বড়ই দুঃখজনক ব্যাপার। কেবল ঘনিষ্ঠ পরিবারবর্গই কবর দেয়ার পূর্বে জানাজার নামাযে অংশগ্রহণ করতে পারবে। ইনশাল্লাহ্‌, যখন পরিস্হিতি স্বাভাবিক হবে তখন আমি তার গায়েবানা জানাজা নামায আদায় করব।  ”

কথার শেষদিকে হুজুর বলেন :

“প্রতিদিনই প্রস্তুত থাকবে, কারণ সময় হলেই আমি তোমাকে ফোনে কল দিব। মোলাকাতের সময় যেরকমভাবে প্রস্তুত থাকে, সেভাবেই প্রস্তুত থাকবে।”

এই কথা শুনে আমি বুঝতে পারি যে লকডাউনের পূর্বে ফোনের মাধ্যমে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সম্বন্ধে হুজুর কি বোঝাতে চেয়েছিলেন। এতে আমি সত্যিই অবাক হয়ে যাই, যে আমি প্রতিদিন ফোনের মাধ্যমে হুজুরের সাথে কথা বলতে পারব।

হুজুরের সাথে সামনাসামনি সাক্ষাৎ করার চাইতে উত্তম কিছু হতে পারে না। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ আমার দুঃখ অনেকটাই লাঘব হয়ে যায়। কারণ আল্লাহ্‌র অশেষ বরকতে আমি নিয়মিতভাবে ফোনের মাধ্যমে হুজুরের সাথে কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করি, আলহামদুলিল্লাহ্‌।

ফোন মোলাকাত

৭ এপ্রিল ২০২০, তারিখ সন্ধ্যার সময় আমি আরো একবার হুজুরের সাথে কথা বলার সৌভাগ্য লাভ করি। এবার আমি সাক্ষাতের জন্য প্রস্তত ছিলাম। হুজুরকে স্বাভাবিক মোলাকাতের মতোই প্রেস ব্রিফিং প্রদান করি।

ফোনে হুজুরের সাথে কথা বলা অনেক সৌভাগ্য ও বরকতের বিষয়। কিন্তু হুজুরকে সামনাসামনি দেখতে না পারার কারণে কিছুটা সমস্যা হয়। যেমন, হুজুরের অফিসে সাক্ষাতের সময় মাঝে মধ্যেই হুজুর কোন কিছু পড়েন বা তার ফাইল দেখেন। তখন আমি সাধারণতই নীরবতা পালন করতাম। কিন্তু ফোনে অনেক সময় আমি বুঝতে পারি না যে হুজুর কি তার ফাইল দেখছেন, নাকি আমার কোন কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

যাহোক, আমি হুজুরকে বলি যে ইউকেতে কোভিড ১৯ এর কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় ৮০০ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এতগুলো মানুষের মৃত্যুতে হুজুর গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং যারা কষ্ট করছেন তাদের জন্য দোয়া করেন।

আমি হুজুরকে একজন সিরিয়ান আহমদী বোন , রিম সারিকি সাহিবার কথা উল্লেখ করি। তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেন এবং সেসময় তিনি অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন। কারণ হুজুর, তার স্বামী(ইব্রাহীম ইখলাফ) ও তার সাথে ফোনে কথা বলেছেন।

হুজুর বলেন :

“আমি রিম কে বলেছি যে তার স্বামী ইব্রাহীমের অসুস্হতা নিয়ে সে প্রেস ডিপার্টমেন্টে যে আর্টিকেল লিখেছে, এজন্য আমি তার সাথে কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছি। ”

হুজুর প্রেস ও মিডিয়া অফিসে রিম সাহিবার লেখা একটি আর্টিকেল সম্বন্ধে এখানে উল্লেখ করেছেন। তার স্বামী করোনাভাইরাসে আক্রান্তের কারণে তাদের যে কঠিন পরিক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সে ব্যাপারে তিনি বড়ই আবেগপ্রবণ এক আর্টিকেল পাবলিশ করেছেন।

হুজুর আরও একবার নাসির সাইদ সাহেবের কথা উল্লেখ করেন। এবং দুঃখ প্রকাশ করেন যে কোভিড পরিস্হিতির কারণে তার পরিবারকে মানুষজন ব্যক্তিগতভাবে সমবেদনা জানতে পারছে না , জানাযার নামাযে সামিল হতে পারছে না।

আমি উল্লেখ করি যে সোশ্যাল মিডিয়াতে মানুষজন তাকে সম্মান জানাচ্ছে। আমি বলি :

“হুজুর, আমি নিশ্চিত যে নাসির সাহেব কখনোই সোশ্যাল মিডিয়াতে ছিলেন না। হয়ত এ ব্যাপারে তার কোন ধারণাই ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও গত কয়েকদিন আমি সোশ্যাল মিডিয়াতে আহমদীদের অনেক বার্তা দেখেছি।তিনি বিশ্বব্যাপী অনেক আহমদীদের হৃদয়কে জয় করেছেন।   ”

এরপর হুজুর দয়া পরবশ হয়ে আমার সন্তানদের কথা জানতে চান। আমি বলি যে কোভিড ১৯ লকডাউনের কারণে আমাদের সদ্যজাত কন্যাকে কোন স্বাস্হ্যকর্মী/নার্সকে দেখাতে পারিনি। তাই আমরা তার স্বাস্হ্য নিয়ে নিশ্চিত নই।

হুজুর বলেন :

“চিন্তার কোন কারন নেই। যতক্ষন সে ঠিকমতো খাচ্ছে, তার কোন সমস্যা হবে না। নিয়মিতভাবে তার তাপমাত্রা চেক করবে। আল্লাহ্‌পাক তাকে বরকত প্রদান করুন।”

হুজুরের দোয়া ও নির্দেশনা আমাদের হৃদয়কে প্রশান্তি প্রদান করে, যেটি একজন স্বাস্হ্যকর্মীর দেয়া ভরসার চাইতে লক্ষ গুণ বেশি।

আমি হুজুরকে বলি যে একজন আমাকে বলেছেন যে লকডাউনের একটি সামান্য উপকারিতা এটি হতে পারে যে এর ফলে হুজুর বিশ্রাম ও তার পরিবারের সাথে সময় কাটানোর কিছুটা সময় পাবেন।

এটি শুনে হুজুর কিছুটা হাসেন ও বলেন :

“আমি সকাল থেকেই অফিসে মেইল চেক করছি। আমি তো আমার দৈনন্দিন কার্যক্রমের কোন পার্থক্য দেখতে পারছি না! আমার পরিবারের জন্য নির্ধারিত সময়কেও অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। ”

প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া

সে সময় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের স্বাস্হ্যের অনেক অবনতি ঘটে। তাকে কিছুদিন ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা হয়। বিভিন্ন সংবাদে তার অবস্হাকে খুবই সংকটজনক বলে প্রচার করা হচ্ছিল। কিন্তু আমি আশাবাদী ছিলাম যে তিনি সুস্হ হয়ে যাবেন। কারণ যখন বরিস জনসনের অসুস্হতার খবর প্রথম প্রকাশিত হয়, সেসময় হুজুর তার সুস্বাস্হ্য ও দ্রুত রোগমুক্তির জন্য দোয়া করেন এবং তাকে ব্যক্তিগতভাবে একটি চিঠি প্রদান করেন।

হুজুর প্রিন্স চার্লসকে উদ্দেশ্য করেও চিঠি লিখেন, কারণ তিনিও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দুজনেই আল্লাহ্‌র রহমতে সুস্হ হয়ে উঠেন।

সহনশীলতার প্রয়োজনীয়তা

৮ এপ্রিল ২০২০ তারিখে প্রিয় হুজুর আমাকে ফোনকল করেন। আমি তাকে জানাই যে আমাদের বোন রিম সারিকি সাহিবার লেখা আর্টিকেলটি সম্বন্ধে অনেক ভাল প্রতিক্রিয়া পেয়েছি।

হুজুর বলেন :

“তুমি কি জান তার লেখার কোন অংশটি আমার সবচাইতে বেশি পছন্দ হয়েছে? সেটি হল একজন আহমদী মহিলার প্রতি রিম’এর প্রতিক্রিয়া। যখন ইব্রাহীমের পরিস্হিতি অত্যন্ত সংকটজনক ছিল তখন সেই মহিলা বলেন যে ‘দুশ্চিন্তা করো না।  যখন তুমি অথবা তোমার পরিবারের কোন অসুস্হ থাকেন, এর অর্থ হল আল্লাহ্‌পাক তোমাদের কোন পাপকে ক্ষমা করে দিচ্ছেন। ’ এর উত্তরে রিম বলে ‘আপনি যে হাদীসের উল্লেখ করছেন সেটি সম্বন্ধে আমি খুব ভাল করেই অবগত আছি। কিন্তু আমার এই গভীর সংকটময় এবং দুর্বল মুহুর্তে এটি আমাকে মনে করিয়ে দেবার আপনার কোন প্রয়োজন ছিল না। ’ ”

হুজুর বলেন :

“আমি অনেক আনন্দিত যে রিম এ প্রসঙ্গটি তার লেখায় প্রকাশ করেছে। কারণ কিছু আহমদী এমন আছেন যারা খুবই অসংবেদনশীল এবং তারা অযথা বেশী কথা বলতে পছন্দ করে। সেই হাদীসটি অসুস্হ মুমীনদের জন্য স্বস্তি স্বরূপ। যেন তারা এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে। যখন কেউ কোন পরিক্ষার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে তখন তাদের অতীতের ভুলের কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য এই হাদীস নয়! এ বিষয়টির প্রতি সদর লাজনার লক্ষ্য দেয়া উচিৎ। অসুস্হ মানুষকে সঠিকভাবে সান্তনা ও স্বস্তি প্রদান করা লাজনাদের শিখতে হবে ।  ”

পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্ব

আমি হুজুরকে জানাই যে ইউকে এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের চূড়ায় অবস্হান করছে। গত ২৪ ঘন্টায় ৯০০ জনের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংক্রমণের মাত্রা অন্যান্যদের চাইতে অনেক বেশি।

হুজুর বলেন :

“মুসলমান হিসেবে আমাদের ঘরে-বাইরে সকল স্হানে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যবিধির সর্বোচ্চ মানদন্ড বজায় রাখতে হবে। এটিই ইসলামের শিক্ষা। যদি মানুষ ইসলামিক ঐতিহ্য সঠিকভাবে পালন করে তাহলে সংক্রমনের ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।  ”

হুজুর বলেন :

“গতকাল, আমার নির্দেশে, ইসলামাবাদের ব্যক্তিগত ও অন্যান্য সকল এলাকা জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও, ব্যাকটেরিয়া দূর করার জন্য অফিস ও বাসাতে ধূপ ব্যবহার করা হচ্ছে। তোমার বাসাতেও এটি ব্যবহার করা উচিৎ। ”

মহামারীর সময়ে পবিত্র রমজান

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল তারিখে আমি ইসলামাবাদে হুজুরের কাছে রিপোর্টের জন্য উপস্হিত হই। হুজুরের অফিসে প্রবেশের সময় আমি মুখের মাস্ক নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়েছিলাম। আমার চশমা বারবার ঘোলা হয়ে যাচ্ছিল। মাস্কও পিছলে পড়ে যাচ্ছিল। হুজুর সেটি লক্ষ্য করেন এবং নাকের পাশে চাপ দিয়ে কিভাবে মাস্কটিকে সঠিকভাবে বসাতে হবে সেটি বুঝিয়ে দেন।

সামনেই পবিত্র রমজান মাস। একটি বিষয় পরিস্কার যে খুব দ্রুত মসজিদ খোলার কোন সম্ভাবনা নেই। এই আলোকে আমি হুজুরের কাছে জানতে চাই যে এ বছর মহামারীর কারণে রমজান মাস কিভাবে পালন করা হবে।

উত্তরে হুজুর বলেন :

“মহামারী থাকুক বা না থাকুক, পবিত্র রমজান মাসের বরকত সবসময়ই থাকবে। স্বাভাবিক পরিস্হিতিতে জামাতে নামায আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটিই হচ্ছে আল্লাহ্‌র আদেশ। মুসলিম উম্মতের মধ্যে একতা সৃষ্টি করার জন্যও আমরা মসজিদে জামাতে নামায আদায় করি । ”

হুজুর বলেন :

“কিন্তু, যদি কোন মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। তাহলে মসজিদের দাবি হল মুসল্লীগণ যেন মসজিদে নামায আদায় থেকে বিরত থাকেসে সময় আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, যে একাকী নামায আদায়ের মাঝেও অনেক বরকত নিহিত। তাই আহমদীদের এই সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। যেন তারা নিজেদের বাসায় আল্লাহ্‌র ইবাদতের মাধ্যমে তার নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়।  ”

হুজুর আরো বলেন :

“জামাতে নামায আদায়ের মাধ্যমে আমরা মুসলিম উম্মত হিসেবে একতাবদ্ধ হবার সুযোগ লাভ করি। কিন্তু একজন মানুষ যখন একাকী নামায আদায় করে তখনই সে নিজের হৃদয়কে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ্‌পাকের সামনে উপস্হাপন করতে পারে। তার নৈকট্য অর্জনে সক্ষম হয়। এ সময় বেশিরভাগ মানুষই তাদের স্বাভাবিক জাগতিক কাজকর্ম থেকে মুক্তি লাভ করেছে। তাই আরো বেশি করে তাহাজ্জুদ নামায আদায়, নিয়মিত দোয়া ও পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতে রত থাকা উচিৎ। ”

হুজুরের বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায় যে সকল পরিস্হিতিতেই আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। আমরা মসজিদে ইবাদত করতে না পারলেও, পবিত্র রমজান ও আমাদের জীবনের লক্ষ্য সবসময়ই নির্দিষ্ট।

জুমআর নামায আদায়

আমি হুজুরকে বলি যে গত দুই সপ্তাহ আমি বাসাতে জুমআর নামায আদায় করিয়েছি।

হুজুর হেসে বলেন :

“মাশাআল্লাহ্‌, ভাইরাসের কল্যাণ্যে এখন তুমিও জুমআর নামায আদায় করা শিখে নিয়েছো!”

হুজুর জিজ্ঞেস করেন যে আমি খুৎবা সানী মুখস্হ করেছি কিনা। আমি বলি যে প্রতি সপ্তাহে শোনার কারণে বেশির ভাগই আমার মুখস্হ আছে। কিন্তু তারপরও আমি কাগজ দেখে পড়ি।

হুজুর বলেন :

“মুখস্হ থাকলেও সামনে কাগজে লিখে রাখা ভাল। কারণ যে কোন সময় তুমি কোন অংশ ভুলে যেতে পার। তাহলে যখন তুমি তেলাওয়াত করবে তখন সেটি আরও উত্তম হবে।  ”

একটি ভুল ফয়সালা

১২ এপ্রিল ২০২০ তারিখ  সন্ধ্যার সময় আমি এমটিএ নিউজের ব্যাপারে সরাসরি হুজুরের কাছ থেকে একটি বার্তা পাই। এমটিএ দপ্তরের খবরের দায়িত্ব আমার উপরেই ন্যস্ত।

সেই ভিডিওটি (মৃত) নাসির সাইদ সাহেবের জীবনীর উপর বানানো হয়েছে। সেখানে নাসির সাহেবের জামাতী সেবা সম্বন্ধে হুজুরের জুমআর খুৎবা এবং নাসির সাহেবের ছেলে, খালিদ সাইদ সাহেবের একটি সাক্ষাৎকার দেয়া হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি মোবারক মসজিদের বাইরে রেকর্ড করা হয়েছে।

হুজুর তার বার্তায় বলেন যে কোভিড-১৯ পরিস্হিতির কারণে সামনা সামনি কারও সাক্ষাৎকার নেয়া এখন উচিৎ হয়নি। এর ফলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ নাসির সাহেব তার মৃত্যুর পূর্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন।

পরদিন, ১৩ এপ্রিল ২০২০, সোমবার আমার জন্য অনেক কষ্টকর দিন ছিল। প্রতিটি মুহুর্ত , প্রতিটি মিনিট অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছিল। সাক্ষাতকারের জন্য করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাকে স্বাভাবিকভাবেই হুজুর পছন্দ করেন নি।

এমটিএ ইন্টারন্যাশনাল এর এমডি হুজুরের প্রাইভেট সেক্রেটারী মুনীর জাভেদ সাহেবের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। যেখানে হুজুরের অসম্মতি এবং তদন্ত করার কথা লেখা ছিল। যে কিভাবে এমন পরিস্হিতিতে সরাসরি সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে।

এমডি সাহেব আবার কাছে জানতে চান যে কেন আমি এই সাক্ষাৎকারের অনুমতি দিয়েছিলাম। মুনীর জাভেদ সাহেবও আমার সাথে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে জানতে চান। এটি আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন সময় ছিল। আমি তাদের নিশ্চিত করি যে আমার অনুমতি নিয়েই সাক্ষাতকারটি নেয়া হয়েছিল। এমডি সাহেবের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জরুরী সার্কুলার জারি করা হয়।

আমি অত্যন্ত দুঃখিত বোধ করছিলাম। আমার নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য ক্যামেরাম্যান ও তার সাথে যারা কাজ করেছে সকলেই এখন ঝুঁকির সম্মুক্ষীণ। সৌভাগ্যবশত ক্যামেরাম্যান সবসময়ই দুই মিটার দূরত্ব বজায় রেখেছিল। তার সকল যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরকম ঝুঁকি নেবার কোন প্রয়োজন ছিল না।

কিন্তু আমার জন্য সবচাইতে কষ্টকর ছিলে যে আমার কারণে হুজুর মর্মাহত হয়েছেন। আমি তার আশানুযায়ী কাজ করতে পারিনি। পুরো দিন আমি হুজুরের কথা শোনার জন্য ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছিলাম। কারণ আমি জানি একমাত্র তার কথাই আমার দুঃখকে দূর করতে পারে।

আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে, বিকেলে আমি ৩৫ মিনিটের মতো হুজুরের সাথে ফোনে কথা বলি। আমি আশা করছিলাম যে শুরুতেই নিশ্চয়ই হুজুর এমটিএ নিউজের ঘটনাটি উল্লেখ করবেন।

কিন্তু, হুজুর আমার ও আমার পরিবারের খোজ খবর নেন। আমি নিজের মনের শান্তির জন্যই হুজুরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি।

ফোনে এক-দুই মিনিট কথা বলার পর আমি বলি :

“হুজুর এমটিএ নিউজের সাক্ষাতকারের ভুলের জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। ”

হুজুর বলেন :

“তোমার কি মনে হয়নি, যে এভাবে সাক্ষাতকার নেয়া অত্যন্ত দায়িত্বহীন এবং ভুল হচ্ছে? ”

আমি বলি :

“সে সময় আমি বলেছিলাম যেন সেখানে কেবলমাত্র ক্যামেরাম্যান থাকে। তিনি যেন খালিদ সাহেব থেকে সবসময় ২ মিটার দূরত্ব বজায় রাখেন। সকল যন্ত্রপাতিকে সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করার জন্যও আমি বলেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম যে এটিই যথেষ্ট হবে। হুজুরের বার্তা পাবার পরই আমি বুঝতে পেরেছি যে নাসির সাইদ সাহেব যেহেতু করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এ কারণে সকলেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।”

হুজুর বলেন:

“হ্যা, এটি একদমই ভুল হয়েছে। যদি তুমি বিবিসি ও অন্যান্য নিউজ চ্যানেল দেখে থাক, তাহলে লক্ষ্য করবে যে তারা স্কাইপ ও অন্যান্য ভাবে সাক্ষাৎকার গ্রহন করছে। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তোমার সকল সাক্ষাৎকার এভাবেই গ্রহন করবে। ”

এ ধরণের সময় একজন মানুষ হুজুরের প্রকৃত মর্যাদা ও দয়ার নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে। হুজুর আমার কাজে হতাশ হলেও , তিনি আমাকে অপমান করেননি। হুজুর কখনো উচুস্বরে কথা বলেন নি। তিনি এ ব্যাপারে কথা বলেই তার কথা শেষ করেননি। কারণ হুজুর জানতেন যে এখন কথা শেষ করলে আমি এ বিষয়টি নিয়েই ভাবতে থাকব।

এ বিষয় নিয়ে হতাশ হলেও হুজুর ভিডিওর বিভিন্ন অংশের প্রশংসা করেন। হুজুর জানতে চান যে মানুষজনের সেটি কেমন লেগেছে। হুজুরের এসব কথা শুনে আমার মনে হল যে আমার বুকের উপর থেকে এক ভারী বোঝা অপসারণ করা হয়েছে।

আমি হুজুরকে জানাই যে ভিডিও আপলোডের প্রথম ২৪ ঘন্টায় অনেক দর্শক এটি দেখেছে। আমরা পাকিস্তানের সাহিবজাদা মির্জা খুরশীদ আহমদ, সাহিবজাদা মির্যা গোলাম আহমদ সাহিব তাদের নিয়েও এ ধরণের ভিডিও বানিয়েছিলাম। কিন্তু নাসির সাহেবের ভিডিও থেকে তাদের ভিডিওর চাইতেও বেশি প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে।

হুজুর এতে মোটেও অবাক হননি। হুজুর বলেন :

“এটিই স্বাভাবিক। কারণ মিয়া খুরশীদ এবং মিয়া আহমদ পাকিস্তান ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে অনেক পরিচিত। কিন্তু নাসির সাহেব খিলাফতে ওয়াক্তের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। তাই ইন্দোনেশিয়াম সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড, জাপানের মতো বিভিন্ন দেশের আহমদীগণও তাকে চিনতেন। ”

হুজুরের সাথে কথা বলার পর আমার হৃদয়ের ভার অনেকটাই হালকা হয়ে যায়। আমার দুর্বলতা সত্ত্বেও হুজুর আমার প্রতি দয়া ও ভালবাসা প্রদর্শন করেন। কিন্তু আমার ভুলের কারণে হুজুর হতাশ হয়েছেন, এ ব্যাপারটি পরবর্তী ২৪ ঘন্টা আমার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। এর কারণে , আমি রাতের বেলা ও পরের দিনও দুশ্চিন্তাগ্রস্হ থাকি।

১৪ এপ্রিল ২০২০, তারিখ বিকেল ৬.১৫ মিনিটে পিএস অফিস থেকে আমার কাছে ফোন আসে। তিনি বলেন যে হুজুর আমার সাথে কথা বলতে চান। সাধারণত কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই প্রাইভেট সেক্রেটারী সাহেবে হুজুরের কাছে লাইন পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সেদিন কিছুটা সময় লাগছিল।

প্রতিটি মুহুর্ত পার হবার সাথে সাথে আমি আরো দুশ্চিন্তাগ্রস্হ হয়ে উঠছিলাম। যদিও আমি এখন নিয়মিতভাবেই হুজুরের সাথে ফোনে কথা বলি। কিন্তু তারপরও আমার দুশ্চিন্তা একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি।

প্রায় ১০ মিনিট পর প্রাইভেট সেক্রেটারী সাহেব হোল্ড থেকে ফোন উঠান এবং বলেন:

“আবিদ, আমি এখন তোমার লাইন হুজুরের কাছে প্রেরণ করছি।”

কল সংযোগ হবার পর হুজুর বলেন “আসসালামু আলাইকুম” এবং আমি কেমন আছি জানতে চান।

আমি বলি যে এমটিএ নিউজের ঘটনার জন্য আমি গত দিন থেকে এখনও কিছুটা দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছি।

হুজুর বলেন :

“যদি তুমি এ ধরণের ভুল কর, তাহলে সারাদিন দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকবে এটিই স্বাভাবিক! কিন্তু, মাঝে মাঝে এ ধরণের ভুল ভবিষ্যতের জন্য উপকারী বলে প্রমাণিত হয়। এর ফলে মানুষ আরো বিনীত হয় এবং আল্লাহ্‌র দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর ফলে তারা নিজেদের সংশোধন ও আচরণকে উন্নত করতে সক্ষম হয়। ”

ভুল তথ্য

এরপর আমি হুজুরকে জানাই যে গত ২৪ ঘন্টায় ইউকেতে কতজন মানুষ করোনাভাইরাসের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে।

হুজুর বলেন :

“ইউকে সরকারের এই তথ্য পুরোপুরি সঠিক নয়। এটি প্রকৃত মৃতের সংখ্যা নয়। কারণ এখানে কেবল তাদের সংখ্যাই রয়েছে যারা হাসপাতালে মারা গিয়েছেন। নিজস্ব বাসা ও কেয়ারহোমে যারা মারা গিয়েছেন তাদেরকে এর মাঝে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।”

পরবর্তীতে ইউকে সরকারও এটি স্বীকার করে। কয়েক সপ্তাহ পর তারা বাসা ও কেয়ারহোমে যারা মারা গিয়েছেন তাদের সংখ্যাও গণনা করে।

আমি হুজুরকে বলি যে ইউকে সরকার কখন লকডাউন শিথিল করবে এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী আগস্ট-সেপ্টেম্বর; আর একজন বলছে অক্টোবর/নভেম্বর। আমি এটি জানানোর পর অপেক্ষা করছিলাম। আমি আশা করছিলাম হুজুর হয়ত ইউকে এবং জার্মানী জলসা আয়োজনের সম্ভাবনার কোন কথা বলবেন। কিন্তু হুজুর নীরব থাকেন।

ধৈর্য্য, সহানুভূতি ও সহনশীলতা প্রয়োজনীয়তা

আমি হুজুরকে ফোর্বস ম্যাগাজিনে পাবলিশ হওয়া একটি সংবাদের ব্যাপারে জানাই। যেখানে জার্মানী, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড এবং কিছু স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের প্রধানমন্ত্রীর ব্যাপারে লেখা হয়েছে। আর্টিকেলে বলা হয়েছে যে এসকল দেশ অন্যান্য দেশের চাইতে করোনাভাইরাস পরিস্হিতি ভালভাবে মোকাবেল করেছে। কারণ তাদের দেশের প্রধাণ হলেন একজন নারী।

হুজুর বলেন :

“নারীদের ঘর চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ কারণে স্বভাবতই সীমাবদ্ধ বাজেটে কিভাবে সবকিছু পরিচালনা করতে হবে এ বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে। এ ছাড়াও ঘর পরিচানলনার কারণে তাদের মাঝে উচ্চ মানের ধৈর্য্য, সহানুভূতি ও সহনশীলতার বিকাশ ঘটেছে। এ ধরণের পরিস্হিতিতে যেখানে মানুষ অসুস্হ হয়ে মৃত্যুবরণ করছে, সেখানে নারীগণ ভাল নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কারণ স্বভাবতই তারা পুরুষদের চাইতে অধিক শান্ত এবং সহানুভূতিশীল। তাই তারা মনুষের দুঃখ কষ্ট গভীর ভাবে অনুভব করে সে অনুযায়ী ব্যবস্হা নিতে পারছেন।  ”

অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাব

আমি হুজুরকে একজন আহমদীর কথা বলি। যিনি আমাকে লিখেছেন যে আহমদীগণ করোনাভাইরাসের কারণে অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্হ সময় অতিবাহিত করছেন। এ জন্য তিনি একটি প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। হুজুর এমটিএ ইন্টারন্যাশনাল এর মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক আলমী দোয়ার আয়োজন করতে পারেন।

এ প্রস্তাবের উত্তরে হুজুর বলেন :

“এ ধরণের দোয়ার কি প্রয়োজন; যেখানে আমি প্রতি সপ্তাহে জুমআর নামায আদায় করাচ্ছি এবং সেটি এমটিএর মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রচার করা হচ্ছে। কিছু মানুষের মধ্যে ‘পীর’ মানসিকতা প্রবেশ করেছে। তারা মনে করে যতক্ষণ মানুষ দুই হাত উঠিয়ে দোয়া করবে না ততক্ষণ পর্যন্ত সেটি সঠিক দোয়া বলে বিবেচিত হবে না। প্রতি জুমআর খুৎবাতেই আমি মহামারী শেষ হবার জন্য দোয়া করছি, জামাতের সদস্যদের জন্য দোয়া করছি। যারা আমার খুৎবা দেখছে তারা যদি ‘আমীন’ বলে তাহলেই তো সেটি আলমী দোয়া হয়ে যায়।  ”

ইসলামাবাদের এক বছর

১৫ এপ্রিল ২০২০ তারিখে আমি হুজুরের সাথে ফোনে কথা বলার সৌভাগ্য লাভ করি। আমি হুজুরকে জানাই যে আজ হুজুরের ইসলামাবাদে যাবার এক বছর পূর্ণ হয়েছে।

আমি দেখেছি যে অধিকাংশ মানুষই তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তারিখ নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। কিন্তু আমি সবসময়ই লক্ষ্য করেছি যে, হুজুর এ ধরণের বিষয় নিয়ে কখনোই সময় নষ্ট করেন না।

এবারও সেরকমই হয় কারণ আমি যখন হুজুরকে বিষয়টি বলি তখন হুজুর বলেন ‘মাশাআল্লাহ্‌’। সাথে সাথেই হুজুর বলেন ‘আর কি বলবে?’ অর্থাৎ আমার উচিৎ এখন রিপোর্টের পরের অংশ পেশ করা।

ইসলামাবাদে মোলাকাত

১৭ এপ্রিল ২০২০ তারিখ আমি হুজুরের সাথে মোলাকাতের জন্য ইসলামাবাদ যাই।

হুজুর জানতে চান যে আমার কাছে পর্যাপ্ত মাস্ক রয়েছে কিনা। আমি বলি যে আমার কাছে কয়েকটি মাস্ক রয়েছে। হুজুর উঠে দাড়ান এবং তার অফিসের একটি বক্স থেকে আমাকে তিনটি মাস্ক প্রদান করেন।

হুজুর নিজে একটি মাস্ক পরিধান করেন। কয়েক মিনিট পর হুজুর হাসেন ও বলেন :

“এসব মাস্ক বেশি সময় ধরে পরে থাকা মোটেও সহজ বিষয় নয়!”

আমি বলি :

“হ্যা এটি অনেক কঠিন, আমার মাথা গরম হয়ে যায় এবং চশমাও ঘোলা হয়ে পড়ে।”

“হুজুর আমি কখনো কল্পনা করিনি যে এমন দিনও আসবে। যখন আমি আপনাকে মাস্ক পরিহিত অবস্হায় দেখব এবং আমি নিজেও আপনার সামনে মাস্ক পরে বসে থাকব। ”

হুজুর হাসেন ও বলেন :

“হ্যা”

দুশ্চিন্তাগ্রস্হ সময় এবং বাবার ভালবাসা

১৮ এপ্রিল ২০২০, তারিখ আমি কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্হ হয়ে পড়ি। কারণ আমার দুই ছেলে মাহিদ ও মোশাহিদ দুজনের মধ্যেই করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। একজনের খুশখুশ কাশি এবং অন্যজনের জ্বর ছিল। যেহেতু আমাদের ঘরে একজন সদ্যভূমিষ্ঠ বাচ্চা রয়েছে এজন্য আমরা আরো বেশি দুশ্চিন্তা করছিলাম।

হুজুরকে এ বিষয়ে জানাবো কিনা এ ব্যাপারে আমি দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগছিলাম। আমি একবার চিন্তা করছিলাম যে এটি সাধারণ সর্দি-কাশি জনিত ব্যাপার। বাচ্চারা দ্রুতই সুস্হ হয়ে পড়বে। অপরদিকে আমার মনের মাঝে এটিও কাজ করছিল যে এটি করোনাভাইরাস হলেও হতে পারে।

আমরা এনএইচএস ১১ সার্ভিসে কল করি। তারা অনেক উপকারী ছিল, কিন্তু আমাদের বাচ্চার উপসর্গের ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা তারা দিতে পারে নি। তারা আমাদের বলে যে এটি করোনাভাইরাস হলেও হতে পারে আবার সাধারণ সর্দি জ্বরও হতে পারে।

আমার হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য আমি হুজুরের কাছে বার্তা পাঠাই এবং দোয়ার জন্য আবেদন করি। আমি পূর্বেও অনেকবার হুজুরের ভালবাসা ও দয়া প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু সেদিন এবং পরবর্তী কয়েকদিন আমাদের জন্য হুজুর যে ভালবাসা প্রদর্রশন করেন সেটি সত্যিই অভাবনীয়।

আমার স্ত্রী মালা স্বভাবতই আমার চাইতেও বেশি দুশ্চিন্তা করছিল। সে চিন্তা করছিল যদি আমি বা আমার স্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যাই তাহলে কিভাবে আমাদের সন্তানদের দেখাশোনা করব। যদি আমাদের বাচ্চাদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, তাহলে আমরা তাদের সাথে থাকতে পারব না।

সে ১৩ বছর বয়সের একটি বালকের ঘটনা বার বার উল্লেখ করতে থাকে। সে করোনাভাইরাসের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে। মৃত্যুর সময় হাসপাতালে তার কাছে কেউ ছিল না এবং জানাজার সময়েও পরিবারের কেউ যেতে পারে নি।

যেহেতু আমাদের বাচ্চাদের উপসর্গ খুবই সামান্য ছিল, আমি আমার স্ত্রীকে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করি। যে চিন্তা কিছু নেই, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একজন মা হিসেবে সে অনেক ভয় পাচ্ছিল।

কিন্তু খলীফার অপার দয়া ও ভালবাসায় তার সকল ভয় দ্রুতই শেষ হয়ে যায়। তার সকল দুশ্চিন্তা দিন শেষে নির্ভরতায় পরিণত হয়।

হুজুরের কাছে বার্তা পাঠানোর পর হুজুর দোয়া সংবলিত একটি চিঠি আমাদের প্রেরণ করেন।

তিনি নির্দেশ দেন আমরা যেন বাচ্চাদেরকে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক হোমিওপ্যাথি সেবন করানো শুরু করি। এ জন্য ড. হাফিজ ভাট্টি সাহেব( ইন চার্জ কেন্দ্রীয় হোমিওপ্যাথি দপ্তর) এর সাথে আলোচনা করি এবং তারপর হুজুরকে জানাই।

আমি তৎক্ষনাৎ হাফিয সাহেবের সাথে কথা বলি। তাক ধন্যবাদ জানাই কারণ তিনি কেবল আমাদের নয় বরং সমগ্র বিশ্বের আহমদীদের জন্য চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন।

এতে হাফিজ সাহেব আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন :

“আমি কোন ধন্যবাদের যোগ্য নই। বরং সকল ভালবাসা ও ধন্যবাদ যুগ খলীফার প্রাপ্য। এটি তার অসীম দয়া যে তিনি আমাকে সেবা করার অনুমতি দিয়েছেন। দোয়া করবেন আমি যেন জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সেবা করে যেতে পারি। ”

এরপর হুজুর আরো একটি বার্তা প্রেরণ করেন। হুজুর লিখেন :

“এ সময় ( তখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সর্বোচ্চ ছিল) হাসপাতালে না যাওয়াই উত্তম। হোমিওপ্যাথির পাশাপাশি বাচ্চাদেরকে মধু সেবন করাও। বাসার সকলেই গরম পানিতে দারচিনি মিশিয়ে অল্প করে পান কর। যার জ্বর হয়েছে তাকে ৪-৫ ঘন্টা পরপর প্যারাসিটামল দাও। আর যার কাশি হয়েছে তাকে এক দিনে দুটি করে প্যারাসিটামল দাও। একটি পাতিলে পানি ফুটিয়ে সেখানে কিছুটা ভিকস দিয়ে দাও এবং ৩০ মিনিটের জন্য সেই বাষ্পকে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে দাও। এরকম দিনে দুই বার করে করবে। মহান আল্লাহ্‌পাক তাদের পূর্ণ সুস্হতা দান করুন। ”

কিছু সময় পর হুজুর আরো দিক নির্দেশনা প্রেরণ করেন :

“বাষ্পের ক্ষেত্রে, এটি নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা যাবে না। কারও কাছেও আনা যাবে না। পাতিলটি চুলোতেই রেখে দিবে এবং সেটি সাধারণভাবে পুরো ঘরে ছড়িয়ে যাবে। ”

পরবর্তী কয়েকদিন হুজুর নিয়মিতভাবে আমাদের খোজ খবর রাখতেন এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন দিক নির্দেশনাও প্রদান করতেন। হুজুর দয়া করে আমাকে ফোনও করতেন এবং দৈনন্দিত রিপোর্ট নেবার পূর্বে আমার সন্তানদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেন।

হুজুর আমাকে সেই সপ্তাহের শুক্রবার ইসলামাবাদে যেতে নিষেধ করেন। হুজুর বলেন যে সন্ধ্যার সময় তিনি আমাকে ফোন দিবেন।

আমি মহান আল্লাহ্‌র নামে কসম খেয়ে বলছি কোন বাবা-মাই তার সন্তানদের এতটা ভালবাসতে পারবেন না। যতটা হুজুর জামাতের সদস্যদের ভালবাসেন।

হুজুরের নিয়মিত নির্দেশনা ও দোয়ার ফলে আমার স্ত্রীর দুশ্চিন্তাও দূর হয়ে যায়। আমরা দুজনেই নিশ্চিত ছিলাম যে আমাদের বাচ্চাদের যাই হোক না কেন, তারা সম্পূর্ণ সুস্হ হয়ে যাবে। মহান আল্লাহ্‌পাকের অশেষ রহমতে তারা দুজনেই পুরোপুরি সুস্হ হয়ে উঠে।

সাবধানতা অবলম্বন

পরদিন সন্ধ্যার সময় আমি হুজুরের সাথে ফোনে কথা বলি। আমি হুজুরকে জানাই যে কয়েকটি দেশ হয়ত ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল করার পরিকল্পনা করছে। আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করি যে লকডাউন শিথিল করার এটিই উপযুক্ত সময় কিনা?

হুজুর বলেন :

“পশ্চিমা বিশ্বে জার্মানীই সবচাইতে সফলভাবে করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করতে পেরেছে। কারণ তারা মহামারী সংক্রমণের প্রাথমিক ভাগেই লকডাউন শুরু করেছিল। এবং অনেক শুরু থেকেই তারা টেস্টিং করে আসছে। যদি ইউকে এবং ফ্রান্সও একই পন্থা অনুসরণ করত তাহলে তাদের দেশেও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম হতো। এখন ইউকে তে লকডাউন শিথিল করা উচিৎ হবে না। জার্মানী কিছুটা শিথিল করতে চাইলেও করতে পারে; কিন্তু তাদেরও যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন, যদি তারা স্কুল শুরু করতে চায় তাহলে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে প্রতি ক্লাসে যেন সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থী থাকে। তাদের মধ্যে যেন নূন্যতম দূরত্ব বজায় রাখা হয়।  ”

আমি জার্মান পত্রিকা ‘বিল্ড’ এ প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের উল্লেখ করি। সেখানে চীনকে করোনাভাইরাসের জন্য দায়ী করা হয়েছে। তারা একটি প্রতীকী বিল পাবলিশ করেছে। যেখানে জার্মানীর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির জন্য ১৪৯ বিলিয়ন ইউরো দেবার জন্য চীনকে বলা হয়েছে।

হুজুর বলেন :

“এ ধরনের বিষয় অত্যন্ত অযৌক্তিক। এখন কি প্রতিটি দেশই তাদের ক্ষয়ক্ষতির বিল চীনকে পেশ করবে? এর ফলে একতা সৃষ্টি হবে না। বরং বিভিন্ন দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও বিভেদ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে কোন পক্ষই লাভবান হবে না। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের অবিবেচক নীতির মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্হানে বহুল ক্ষতিসাধন করেছে। তারা কি কখনো তার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে? ”

ভুল আবিস্কার

আমি হুজুরকে বলি যে বিশ্বের বিভিন্ন স্হান থেকে আহমদীগণ খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) স্মৃতিচারণে বিভিন্ন ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করছে। কারণ ১৯ এপ্রিল ২০০৩ তারিখে খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) মৃত্যুবরণ করেন। বিগত বছরসমূহেও আমি এ ধরণের পোস্ট দেখেছি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এ বছর এসব পোস্টের সংখ্যা অনেক বেশি।

হুজুর বলেন :

“কারো মৃত্যুর দিনকে স্মরণ করা কেবল অপ্রয়োজনীয়ই নয় বরং সম্পূর্ণ ভুল। ইসলামে ‘মৃত্যুবার্ষিকী’ বলে কিছু নেই। এ বছর বেশি মানুষ পোস্ট করছে কারণ এবার অনেক বেশি মানুষ ঘরে বসে রয়েছে। তাই তারা সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশি সময় দিচ্ছে। তারা হয়ত কারো পোস্ট দেখছে এবং চিন্তা করছে যে এখন তাদেরও কিছু পোস্ট করা উচিৎ। যদি আহমদীগণ প্রকৃত অর্থেই খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ)এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে চায়, তাহলে বছরে একদিন একটি বার্তা প্রেরণ না করে; প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এবং তার খলীফার নির্দেশসমূহ মেনে চলা উচিৎ।  ”

অবসর নেয়ার আদর্শ স্হান

আর একটি ফোন মোলাকাতের সময় আমি হুজুরকে জানাই যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইমিগ্রেশন এবং গ্রীন কার্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তিনি বলেছেন যে করোনাভাইরাসের জন্যই এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ মনে করছে যে তিনি এই সুযোগে ইমিগ্রেশন কমানোর জন্যই এই বুদ্ধি করেছেন।

এটি শুনে হুজুর আমার পরিবারের একজন সদস্যের কথা উল্লেখ করেন যিনি এই নীতির কারণে অসুবিধার সম্মুক্ষীন হতে পারেন। আমি বললাম যে আমার একজন পরিচিত ব্যক্তি আছেন। যিনি ইউএসএ থেকে পাকিস্তানে চলে আসার চিন্তা করছেন। কারণ তিনি মনে করেন অবসর করার জন্য পাকিস্তানই উত্তম হবে।

তাদের আবেগের কথা চিন্তা করে হুজুর বলেন :

“ যদি তুমি পাকিস্তানে বেড়ে উঠ, পরবর্তীতে অন্য কোন দেশে চলে গেলেও তোমার রক্তে সবসময়ই পাকিস্তান থাকবে। বেশিরভাগ পাকিস্তানীই মনে করে যে অবসরের জন্য অন্যান্য দেশের তুলনায় পাকিস্তান অনেক বেশি আরামদায়ক। পশ্চিমা বিশ্বে বয়স্কদের অনেক কাজ নিজেদেরই করতে হয়। যখন বৃদ্ধ হবার কারণে তারা আর কর্মক্ষম থাকেন না তখনও তাদের কাজ করা ছাড়া উপায় থাকে না। অপরদিকে, রাবওয়াতে বয়স্ক পাকিস্তানীগণ অনেক আরাম আয়েসে থাকতে পারেন। তারা অনেক সেবা পেয়ে থাকেন এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ও অনেক কম।  ”

আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করি যে তাহলে কি হুজুর বোঝাতে চাইছেন যে রাবওয়াতে অধিক প্রশান্তি পাওয়া যায়।

হুজুর বলেন :

“রাবওয়াতে সকলেই যে প্রশান্তিময় জীবন যাপন করছে সেটি বলা যাবে না। কারণ সেখানে নিয়মিত অত্যাচার করা হচ্ছে। কিন্তু জীবনযাত্রা সেখানে অনেক সহজ ও আরামদায়ক।  ”

হুজুর আরও বলেন :

“অপরদিকে, যারা পশ্চিমা বিশ্বে বেড়ে উঠেছে, তাদের জন্য পাকিস্তানে অবসরে যাওয়া মোটেও সহজ হবে না। এটি নির্ভর করে তোমার রক্তে কি আছে এবং কিভাবে তোমাকে গড়ে তোলা হয়েছে।”

এরপরের কথা আমি ঠিক মতো বুঝতে পারিনি । আমার মনে হল হুজুর জানতে চাচ্ছেন যে আমাকে রাবওয়া অথবা কাদিয়ানে পোস্টিং করে দিবেন কিনা? আমি হুজুরকে আবার প্রশ্ন করতে চাইনি। তাই আমি যা শুনেছি তার উপর নির্ভর করেই উত্তর প্রদান করি। আমি হুজুরকে বলি :

“হুজুর, যদি আপনি রাবওয়া অথবা কাদিয়ানে যান, তাহলে আমি আনন্দের সাথেই সেখানে যাব। যেখানেই আপনি থাকবেন সেখানে আমার প্রশান্তি এবং সেখানেই আমি আনন্দিত থাকব।”

হুজুর বলেন :

“আচ্ছা ঠিক আছে… আর কিছু?”

আমার উত্তর যথাযথ হয়েছিল কিনা সেটি আমি আজও জানি না। হয়ত আমি হুজুরকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এক উত্তর প্রদান করেছিলাম !

নেতৃত্বের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ

২৪ এপ্রিল ২০২০ তারিখে আমি হুজুরের সাথে ফোনে কথা বলি। আমি হুজুরকে জানাই যে গত সন্ধ্যায় ইউএস প্রেসিডেন্ট এক অদ্ভূত প্রেস ব্রিফিং করেছেন। সেখানে তিনি কোভিড-১৯ এর মোকাবেলা করার জন্য ব্লিচ ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। এটি খুবই ভয়ংকর ব্যপার যে বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী দেশের নেতা কিভাবে এমন কথা বলতে পারেন।

আমি হুজুরকে বলি যে কিছু ব্লিচ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এমন বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে যে ব্লিচকে কোন পরিস্হিতিতেই সেবন করা যাবে না।

রিপোর্ট শোনার পর হুজুর বলেন :

“ব্লিচ সম্বন্ধে এই বিবৃতি সত্যিই অবিশ্বাস্য এবং অজ্ঞতার চরম নিদর্শন। মাঝে মধ্যে আল্লাহ্‌পাক কোন দেশের অবিচার ও নিষ্ঠুরতাকে শাস্তি দেবার জন্য তাদেরকে এমন নেতৃত্ব প্রদান করেন, যিনি পুরো দেশ ও জাতির জন্য অপমানের কারণ হন।  ”

উর্দু ক্লাসের স্মরণীয় মুহুর্ত

দুই এক দিন পূর্বে আমি হুজুরকে এমটিএ আর্কাইভ থেকে একটি ভিডিও শেয়ার করি। সেটি ছিল ১৯৯৭ সালে খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) এর উর্দু ক্লাসের একটি ভিডিও। সেখানে খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) সবাইকে খলীফাতুল মসীহ আল খামেস(আইঃ) এর একটি ছবি দেখিয়ে ক্লাসের সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

আমার পরম সৌভাগ্য যে আমি তখন সেই উর্দু ক্লাসে উপস্হিত ছিলাম। খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) সে সময় আমার সাথে কথা বলেন। তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে তৎকালীন সাহিবযাদা মসরূর আহমদ, খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) এর সাথে সেই বছরের শুরুর দিকে হার্টেলপুল সফর করেছিলেন।

সেই সময়ের স্মৃতি আমার পরিস্কার মনে আছে। ১৯৯৭ সালে আমি একজন টিনএজার ছিলাম। আমার তখন মনে হয়েছিল যে সাহিবযাদা মসরূর আহমদের মাঝে বিশেষ কোন ব্যাপার রয়েছে। কারণ খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) তার কথা গভীর মমতা ও ভালবাসার সাথে উল্লেখ করছিলেন।

শৈশবে খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) এর সাথে আমি অনেক সময় কাটিয়েছি। এটি আমার পরম সৌভাগ্য যে তিনি আমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিনি যিনি পরবর্তীতে প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এর মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। যার সাথে আমি আমার জীবনের অনেক বছর কাজ করার সৌভাগ্য লাভ করব।

ফোনে কথা বলার সময় হুজুর সেই ভিডিওটির কথা উল্লেখ করেন। আমি অবাক হই যখন হুজুর ভিডিওটিকে সকলের সাথে শেয়ার করার জন্য নির্দেশ দেন। যেহেতু ভিডিওটিতে আমি উপস্হিত ছিলাম একারণে সেটি শেয়ার করতে আমি কিছুটা লজ্জ্বিতবোধ করছিলাম। আমার মনের কথা আঁচ করতে পেরে হুজুর আবারো আমাকে সেটি শেয়ার করতে বলেন যেন মানুষ এথেকে উপকৃত হতে পারে।

এর ফলে আমি প্রথমে সেটি পারিবারিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এবং পরবর্তীতে আমার অফিসের সদস্যদের সাথে শেয়ার করি। পরিশেষে, আমি টুইটারে ভিডিওটি শেয়ার করি যার মাধ্যমে সেটি পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

পরবর্তী ২-১ দিন সারা বিশ্বের আহমদীগণ ভিডিওটির প্রতিক্রিয়ায় আমাকে বার্তা প্রদান করে। অনেকেই লিখেন যে এর ফলে তাদের ঈমান আরো দৃঢ় হয়েছে। হুজুর(আইঃ) সম্বন্ধে খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) এর ভালবাসা দেখে তারা অত্যন্ত আনন্দিত ও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। তাদের মন্তব্য শুনে আমি বুঝতে পারলাম যে আহমদীগণ এথেকে উপকৃত হতে পারে বলে হুজুর কি বোঝাতে চেয়েছিলেন।

শোক সংবাদ

তখন ছিল ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিক। এটি বলা হচ্ছিল যে ইউকে কোভিড-১৯ মহামারীর সর্বোচ্চ চূড়া অতিক্রম করছে। মৃত্যুসংখ্যা তখনো অনেক বেশি ছিল।

সেসময় আর একটি দুঃখজনক খবর আসে। গোলাম মোস্তফা সাহেব যিনি পিএস অফিসে স্বেচ্ছাসেসবক হিসেবে কাজ করতেন, তিনি এসময় ইন্তেকাল করেন। ২৭ এপ্রিল হুজুরের সাথে ফোনে কথা বলার সময় আমি সমবেদনা প্রকাশ করি।

হুজুর বলেন :

“এখন, ইসলামাবাদ জামাতের দুইজন সদস্য, নাসির সাইদ এবং গোলাম মোস্তফা , করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। গোলাম মোস্তফা সাহেবের অনেক ভাল গুণাবলী ছিল। তিনি সবসময়ই মসজিদে অবস্হান করতেন এবং মসজিদকে ঘিরেই তার জীবন আবর্তিত হতো। মহান আল্লাহ্‌পাক তার স্ত্রী –সন্তানদের রক্ষা করুন এবং তাদেরকে সবসময় জামাতের সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকার তৌফিক দান করুন। ”

একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

ইব্রাহিম ইখলাফ সাহেবের কোভিড-১৯ এ আক্রন্তের অনুভূতি নিয়ে লেখা একটি আর্টিকেল সম্বন্ধে আমি নিয়মিত প্রতিক্রিয়া পাচ্ছিলাম। ইব্রাহিম সাহেব লিখেন যে করোনাভাইরাসের সংক্রমনের ঠিক পূর্বেই হুজুর ইসলামাবাদে চলে আসেন। এটি প্রকৃতপক্ষে এক ঐশি পরিকল্পনা।

আমি হুজুরের কাছে এ ব্যাপারে তার মতামত জানতে চাই। হুজুর বলেন :

“হ্যা, সে যা বলেছে, ঠিক বলেছে। কারণ মহামারীর সময়ে জামাতের কেন্দ্র যদি  ফযল মসজিদেই থাকত তাহলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হতো। আমার পক্ষে বাসস্হান অথবা অফিস ছেড়ে মসজিদে যাওয়া সম্ভব হতো না। এছাড়াও, বিভিন্ন অফিস সদস্য এবং পিএস অফিসের সদস্যগণ যারা ইসলামাবাদে রয়েছেন তারাও এখন কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন। কিন্তু যদি আমি ফযল মসজিদে থাকতাম তাহলে তারা কাজ করতে পারতেন না।  ”

সংশোধনের মাধ্যমে ভালবাসা

কিছুদিন পূর্বে আমি একটি আর্টিকেল লিখেছিলাম। সেখানে রাবওয়ার কমর সোলেমান সাহেবের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়েছে। যিনি বাব্বী নামেও পরিচিত।

আমি হুজুরকে বলি যে কমর সোলেমান সাহেব বলেন যে কাযা বোর্ড বিভিন্ন সময় মানুষকে বিচার অনুযায়ী জরিমানা প্রদান করতে নির্দেশ প্রদান করত। হুজুর মাঝে মধ্যে তার প্রজ্ঞা অনুযায়ী সে সকল ব্যক্তির জরিমানা নিজের ব্যক্তিগত অর্থ থেকে আদায় করে দিতেন।

হুজুর বলেন :

“আমি জুমআর খুৎবায় বলেছি যে যখন কোন আহমদীর বিরুদ্ধে আমার কোন ব্যবস্হা গ্রহণ করতে হয়, সেটি আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক ও দুঃখের বিষয়। কিন্তু জামাতের কল্যাণের জন্য আমাকে শাস্তি প্রদান করতেই হয়। কারণ এটি আমার দায়িত্ব। যেন সেই ব্যক্তি নিজেকে সংশোধন করে। আর বাব্বী সঠিক কথাই বলেছে। কয়েকবার আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজনের জরিমানা আদায় করে দিয়েছি। যেন বিবাদ দ্রুত মীমাংসা করা যায়। জামাতের ঐক্য যেন কোনভাবেই হুমকির সম্মুক্ষীণ না হয়। ”

ইউকে জলসা বাতিল

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আগস্ট মাসে ইউকে জলসার আয়োজন করা অসম্ভব মনে হতে থাকে। কিন্তু অফিসিয়ালভাবে ইউকে জলসা বাতিলের কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি।

এপ্রিলের শেষ দিকে আমি সাহস সঞ্চার করে হুজুরকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি :

“হুজুর, ইউকে জলসা আয়োজনা করার কোন সম্ভাবনা কি রয়েছে? ”

হুজুর বলেন :

“এটি ভুলে যাও – এ বছর ইউকে জলসা হবার কোন সম্ভাবনা নেই! প্রথমত, সরকার জনসমাগমের কোন অনুমতি দিবে না। আর যদি এ্ররকম নাও হয়, তাহলেও মহামারী পরিস্হিতিতে নিরাপদভাবে জলসা আয়োজন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়।  ”

হুজুর আরও বলেন :

“জলসার জন্য নির্ধারিত বাজেট জামাতের অন্যান্য প্রকল্পে কাজে লাগানো যাবে। এছাড়াও, এর ফলে আমরা মানবতার সেবায় কাজ করার আরো সুযোগ পাব। যেটি এখন অন্যান্য সময়ের তুলনায় আরো বেশি প্রয়োজন। ”

আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করি যে বছরের শেষ দিকে জলসা আয়োজনের কোন সম্ভাবনা রয়েছে কিনা?

হুজুর বলেন :

“এত আগেই সে ব্যাপারে কিছু বলা যাচ্ছে না, সময় হলে দেখা যাবে। ”

কিছুদিন পর আমীর সাহেব ইউকে সার্কুলারের মাধ্যমে জামাতের সদস্যদের জানিয়ে দেন যে হুজুরের নির্দেশে আগস্ট মাসের ইউকে জলসা অণুষ্ঠিত হচ্ছে না।

খিলাফতের প্রজ্ঞা

আমি হুজুরকে বলি যে ইউকে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রী একটি ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন যে যখন ইউকেতে স্কুল শুরু করা হবে, তখন ক্লাসের শিক্ষার্থী সংখ্যা সীমাবদ্ধ রাখা হবে এবং হঠাৎ করেই স্বাভাবিক নিয়মে সম্পূর্ণ স্কুল শুরু করা সম্ভব হবে না।

হুজুর বলেন :

“আমি কিছুদিন পূর্বে তোমাকে বলেছিলাম। যে যখন স্কুল শুরু করা হবে তখন অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে তা চালু হবে। এটিই একমাত্র নিরাপদ উপায়। ”

আমি বলি :

“হুজুর, সরকার হয়ত এই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য লাখ লাখ অর্থ খরচ করে গবেষণা করেছে। যদি তারা আপনার কাছে এসে দিক নির্দেশনা চাইত, তাহলে তারা অনেক অর্থ ও সময় সাশ্রয় করতে পারত।  ”

হুজুর আমার মন্তব্য শুনে হাসেন।

যদিও আমি হালকাভাবেই কথাটি বলেছিলাম, কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে মহান আল্লাহ্‌পাক যুগ-খলীফাকে কেবল ধর্মীয় নয় বরং জাগতিক বিভিন্ন বিষয়েও প্রজ্ঞা প্রদান করেন।

বিভিন্ন সময়ে কিছু বিনীত রাজনীতিবিদ ও নেতা হুজুরের উপদেশ ও দিক নির্দেশনা নিয়েছেন। কিন্তু, দুঃখজনক হল বেশিরভাগ মানুষই খিলাফতের সাথে যে মহান বরকত জড়িত সে ব্যাপারে বড়ই উদাসীন। আমরা কেবল এই দোয়াই করি যেন তাদের উত্তরাধিকারগণ প্রকৃত সত্যকে অনুধাবণ করতে পারেন।

ছাতা

সেদিন সকালে একজন খাদেম আমাকে ফোন করে তার দুঃখের কথা ব্যক্ত করে। বর্তমান পরিস্হিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য বৃষ্টির সময় হুজুরকে নিজের ছাতা নিজেই ধরতে হচ্ছে।

আমি ফোনে হুজুরকে বিষয়টি জানাই। হুজুর বলেন :

“যদি আমাকে ছাতা ধরতে হয় তাহলে অসুবিধা কোথায়?”

হুজুর আরো বলেন :

“ফযরের সময় বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই আহমদ ( মাহমুদ আহমদ সাহেব) ছাতা নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন। কিন্তু আমি তাকে ও অন্যান্য নিরাপত্তা সদস্যদের দূরে থাকতে বলি। এরপর, ওয়াকাস (সাহিবযাদা মির্যা ওয়াকাস আহমদ) এগিয়ে এসে ছাতা ধরার আহবান জানায়। কিন্তু আমি তাকে বলি যে আমি নিজেই ছাতা বহন করব।”

হুজুর বলেন:

“আমি তো এখন স্বাধীনতা লাভ করেছি, এবং এটি উপভোগ করছি।  ”

আমি হুজুরকে বলি :

“হুজুর, যদি আপনি আনন্দ অনুভব করেন তাহলে সবকিছু ভাল আছে।”

আমরা অনেক ছোটখাট সুবিধা ভোগ করি যা আমরা নিজেরাও জানি না। হুজুর এখন সেসব ব্যাপারই উপভোগ করছেন। যেমন নিজের ছাতা ধরা, সবসময় তার আশেপাশে মানুষের ভিড় না থাকা ইত্যাদি।

সাধারণ অবস্হায় হুজুর তার নিরাপত্তা কর্মীদের ছাতা ধরার ও অন্যান্য কাজের অনুমতি দেন। কিন্তু সাহায্যের জন্য বা এসব প্রটোকল হুজুর উপভোগ করেন এ কারণে এসব করেন না। তিনি এ সকল কাজের অনুমতি দেন যেন আমাদের মাঝে খিলাফতের সেবা করে বরকত লাভের যে ইচ্ছা রয়েছে সেটি পূরণ হয়।

আমরা কেবল হুজুরের অবস্হা অনুমান করতে পারি। তার সকল চলাফেরা সবসময় জনসমাগম দ্বারা আবৃত। কিন্তু মহান আল্লাহ্‌পাকের খাতিরে তিনি সকল বোঝা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন।

এর অর্থ এই নয় যে তিনি খিলাফতের পূর্বের সময়কে স্মরণ করেন না। যখন তার জীবনে স্বাধীনতা ছিল। একারণেই নিজের ছাতা বহন করতে পারায়, হুজুরের কথায় এক আনন্দের আভা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। 

প্রেস ও মিডিয়ার প্রতি দিক নির্দেশনা

মে ১, ২০২০ তারিখ শুক্রবার হুজুরের নির্দেশে আমি বাসাতেই অবস্হান করি। কারণ তখনো আমাদের বাচ্চাদের অসুস্হ হবার দুই সপ্তাহ সময় অতিবাহিত হয়নি।

হুজুর দয়াপরবশ হয়ে সন্ধ্যায় আমাকে ফোন করেন এবং অবস্হা জানতে চান।

কোন এক অজ্ঞাত কারণে হুজুরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি বলি :

“হুজুর, আমি আজ আপনার জুমার খুৎবা শুনেছি।”

হুজুর বলেন :

“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি প্রথমবারের মতো আমার জুমআর খুৎবা শুনছো!”

আমি হুজুরকে জানাই যে হল্যান্ডে কিছু নন-আহমদী মুসলমান একটি দাবী জানাচ্ছে। তাদের দাবী হল কিছু ডাচ শহরে শুক্রবারের আযান যেন লাউডস্পীকারে প্রচারের অনুমতি দেয়া হয়। কিছু সংবাদমাধ্যমে এ ব্যাপারে আমাদের জামাতের অভিমত জানতে চাচ্ছে।

হুজুর বলেন :

“হল্যান্ড কোন ইসলামিক দেশ নয়। তাই আমরা লাউডস্পীকারের মাধ্যমে আযান প্রচারের দাবি জানাতে পারি না। কর্তৃপক্ষের এই দাবি নাকচ করে দেয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু যদি তারা অনুমতি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি পরম দয়ার নিদর্শন হবে। এটি অত্যন্ত প্রশংসার দাবিদার হবে। ”

ব্রিফিং এর সময় আমি হুজুরকে একজন শিখ ডাক্তারের ঘটনা উল্লেখ করি। যিনি এনএইচএস এর হয়ে কাজ করছেন। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী তাকে কোভিড-১৯ থেকে নিরাপদ রাখার জন্য একটি বিশেষ পিপিই ফেসমাস্ক পরিধান করতে হবে। এজন্য তার দাড়ি কাটার প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু তিনি দাড়ি কাটার জন্য অস্বীকৃতি জানান। এর ফলে তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে।

এই ঘটনায় মানুষ মিশ্র অনুভুতি প্রকাশ করছে। অনেকেই বলছে যে তিনি বিদ্রোহী আচরণ করছেন। আবার অনেকেই বলছে যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কারো ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত দিতে পারে না।

আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করি যে এ পরিস্হিতিতে একজন মুসলমান ডাক্তার কি করতে পারেন। হুজুর বলেন যে এরকম পরিস্হিতিতে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতিকার খুঁজতে হবে। যেখানে ধর্মীয় অনুভূতি মানবসেবার পক্ষে কোন বাধা তৈরী করবে না।

হুজুর বলেন :

“দাড়ি বেশি বড় হবার কোন প্রয়োজন নেই। তাই ধর্মীয় বিশ্বাস অটুট রাখার জন্য একজন মুসলমান ডাক্তার দাড়ি ছোট করে নিতে পারেন। যেন ফেসমাস্ককে ঠিকভাবে মুখের সাথে পড়ানো যায়। ”

অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্হাপনের মাধ্যমে নেতৃত্ব প্রদান

সপ্তাহের শেষের দিকে আমি হুজুরের কাছ থেকে একটি ফোন কল পাই। সেখানে আমি বলি যে আমার বড় ছেলের ৭ বছর বয়স হয়েছে। তাকে কি এখন থেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করতে হবে কিনা এ ব্যাপারে আমি হুজুরের দিক নির্দেশনা চাই।

বিশেষত, আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে তাকে ফযরের সময় উঠানো উচিৎ হবে কিনা। অথবা এশার নামায পর্যন্ত তাকে জাগিয়ে রাখব কিনা। কারণ গ্রীষ্ম কালের এশা অনেক রাতে আদায় করা হয়।

হুজুরের উত্তর ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ ইসলামিক শিক্ষার প্রতিফলন।

হুজুর পরিস্কারভাবে বলেন যে ৭ বছর বয়সে কিছু নমনীয়তার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু নামাযের গুরুত্ব স্হাপনের সকল প্রচেষ্টা করতে হবে।

হুজুর বলেন :

“মাহিদকে বল, সে যেন প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ২-৩ ওয়াক্তের নামায আদায় করে। যদি সে পাঁচ ওয়াক্ত আদায় করতে পারে তাহলে আরো উত্তম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল তোমাকে ব্যক্তিগত উদাহরণের মাধ্যমে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্হাপন করতে হবে। যদি তুমি এখন বাসায় নামায আদায় করাও, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সে তোমার সাথে নামায আদায় করবে। এভাবে অতিরিক্ত কোন কষ্ট ছাড়াই, এটি তার অভ্যাসের অংশ হয়ে যাবে। ”

হুজুর আরো বলেন :

“তাকে নম্রভাবে ভালবাসার সাথে বোঝাও। তাকে একটি বিষয় পরিস্কার করে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, সে যখন ১০ বছর বয়সের হবে তখন পাঁচ ওয়াক্তের নামায আদায় করা তার দায়িত্ব। এছাড়াও এখন রমজান মাস চলছে। রমজানের স্পৃহা বোঝানোর জন্য তাকে একটি ছোট রোজা রাখতে দিতে পার। একরাতে সেহরীর সময় উঠিয়ে খাবার খাইয়ে দাও। এরপর সে দুপুরে খাবার খেয়ে তার রোযা শেষ করতে পারে। ”

এরপর আমি মাহিদকে ডেকে বলি যে হুজুর তার জন্য নামায ও রোযার ব্যাপারে বিশেষ দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সে এতে অত্যন্ত আনন্দিত হয়।

পরের সপ্তাহে সে হুজুরের নির্দেশ অনুযায়ী একটি ছোট রোযা রাখে। এটি নিশ্চিত যে এর ফলে সে রমজানের স্পৃহা আরো ভালভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হবে।

আল্লাহ্‌পাকের প্রতি মনোনিবেশ

আমি হুজুরকে বলি যে আমার মনে হচ্ছে এবারের ঈদের নামায বাসাতেই আদায় করতে হবে।

হুজুর বলেন যে তিনি ইউকের আমীর সাহেবকে এ ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি জামাতের সদস্যদের অবহিত করবেন যে এবারের ঈদের নামায বাসাতেই আদায় করতে হবে। কারণ রমজান মাসের শেষে সরকারের আরোপিত লকডাউন উঠে যাবে এরকম কোন নির্দেশ পাবার কোন সম্ভাবনা নেই।

আমি হুজুরকে বলি :

“হুজুর, বিশ্বের বর্তমান পরিস্হিতি অত্যন্ত অদ্ভুত লাগছে।”

হুজুর অত্যন্ত সুন্দরভাবে বলেন :

“তাহলে এখনে নিজেকে আল্লাহ্‌পাকের প্রতি মনোনিবেশ কর। এটিই একমাত্র সমাধান, এটিই একমাত্র রাস্তা।”

ভিক্টোরি ইন ইউরোপ (ভিই) ডে উদযাপন করার উত্তম উপায়

পরবর্তী কয়েক দিন হুজুর অফিসের ব্যাপারে আমাকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিতে থাকেন। ইউকে জামাত আমার কাছে একটি ব্যাপারে হুজুরের দিক নির্দেশনা জানতে চায়। সেটি হল , ভিক্টোরি ইন ইউরোপ (ভিই) ডের ৭৫ তম বার্ষিকী উদযাপন করার জন্য তারা কি মসজিদে পতাকা, ব্যানার ইত্যাদি মসজিদ প্রাঙ্গনে লাগানো যাবে কিনা।

হুজুর বলেন :

“বর্তমানে, অনেক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে এবং অনেকেই অসুস্হ হয়েছে। তাই এটি উদযাপন করার কোন সময় নয়। ইউকে জামাতকে নির্দেশনা দাও যে এজন্য তারা যে অর্থ বরাদ্দ রেখেছিল , সেটি যেন স্বাস্হ্য সেবার জন্য কাজ করছে এমন কোন চ্যারিটিকে প্রদান করে দেয়।”

মনোযোগ দিতে ব্যর্থ

আমি হুজুরকে জানাই যে ইউকেতে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা ইতালীর সংখ্যাকে অতিক্রম করেছে। এখন পুরো বিশ্বে এক্ষেত্রে আমেরিকার পরেই ইউকের অবস্হান।

হুজুর বলেন :

“ইতালীতে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সর্বোচ্চ ছিল, তখন ইতালিয়ান সরকার ইউকের মতো অন্যান্য দেশকে ইতালীর ভুল থেকে শিক্ষা নেবার অনুরোধ জানিয়েছিল। তাদেরকে সংক্রমন ছড়িয়ে পড়ার পূর্বেই লকডাউন দেবার আবেদন করেছিল। কিন্তু, ইউকে এ থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহন করেনি। সঠিক পদক্ষেপ নিতে অনেক দেরী করে ফেলেছে। এর ফলাফল এখন সকলের সামনেই পরিস্কার।  ”

বিশ্বনেতাদের সংশোধনের সঠিক সময়

একটি মোলাকাতের সময় হুজুর বলেন যে তিনি মনে করছেন আরও একবার বিশ্বনেতৃবিন্দের কাছে চিঠি লেখার সময় এসেছে। হুজুর আমাকে সামনের দিনগুলোতে ডিকটেশন নেবার জন্য তৈরী থাকতে বলেন।

হুজুর বলেন :

“বিশ্বনেতাদের সরাসরি সতর্ক করা আমার দায়িত্ব। তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে এখন মহানআল্লাহ্‌পাকের প্রতি মনোনিবেশ করার সময় এসে গিয়েছে। পূর্বেই আমি অনেকবার এই সংবাদ প্রেরণ করেছি। করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বে এক অভূতপূর্ব সংকট তৈরী করেছে। এ প্রেক্ষিতে আমার মনে হয় তাদেরকে আরও একবার সতর্ক করার সময় হয়েছে। তাদেরকে ব্যাখ্যা করতে হবে যে কেবলমাত্র মহান আল্লাহ্‌পাকের দয়া ও অনুগ্রহের ফলেই মানবজাতি আরও গভীর দূর্দশা ও ধ্বংস থেকে রক্ষা পেতে পারে। ”

দুঃখ ভারাক্রান্ত

হঠাৎ করেই, ১১ মে তারিখ থেকে হুজুরের কাছ থেকে আমি কোন ফোন পাচ্ছিলাম না। আমি নিজেকে স্বান্তনা দেই যে হুজুর নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছেন। শীঘ্রই , শুক্রবারে আমি ইসলামাবাদে হুজুরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, ইনশাল্লাহ্‌।

কিন্তু, অসংখ্য আহমদীর মতো আমি যখন ১৫ মে, ২০২০ তারিখ দুপুর ১টার সময় এমটিএ তে প্রাইভেট সেক্রেটারী মুনীর জাভেদ সাহেবকে দেখি, তখন আমি বুঝতে পারি যে নিশ্চয়ই কোন খারাপ কিছু ঘটেছে।

তার কথা শোনার সাথে সাথেই আমার হৃদয় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তিনি হুজুরের এক বার্তা পাঠ করে শোনান। সেখানে হুজুর বলেন যে কয়েকদিন পূর্বে হুজুর পড়ে গিয়ে গুরুতরভাবে আহত হন। এ কারণে জুমআর খুৎবা দিতে পারছেন না।

আমার মনের গভীর ব্যথা, দুঃখ ও অসহায়ত্ব ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ বিশ্বের সকল আহমদীরই সেই একই অনুভূতি হয়েছে। নিজেকে আমার অতি তুচ্ছ , নগন্য মনে হচ্ছিল। আমার প্রিয় খলীফা আঘাত পেয়েছেন আর আমি এ ব্যাপারে পুরোপুরি অজ্ঞ।

আমি হুজুরের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই। হুজুর আমাকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি আলহামদুলিল্লাহ্, দ্রুততার সাথে সুস্হ হয়ে উঠছেন।

কিছুদিন পর আমি হুজুরের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য লাভ করি।

আমার প্রিয় খলীফার সাথে সাক্ষাৎ

আমি সেই মুহুর্ত কখনো ভুলতে পারব না। যখন আমি হুজুরের আঘাত পাবার পর প্রথম হুজুরের অফিসে প্রবেশ করি। প্রবেশের পূর্বে আমি চিন্তা করছিলাম যে কিভাবে আমি হুজুরকে তার অবস্হার কথা জিজ্ঞেস করব, কোন কোন শব্দ আমি ব্যবহার করব।

কিন্তু আমি কোন কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই হুজুর বলেন :

“আবিদ তুমি কেমন আছ? মালা এবং বাচ্চারা কেমন আছে? ”

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যে এই পরিস্হিতিতে, যখন আমার হুজুরের সুস্হতার খোজ খবর নেয়া উচিৎ। তখনও হুজুর নিজেই আমার ও আমার পরিবারের খোঁজ নিচ্ছেন।

বসার পর আমি লক্ষ্য করলাম যে হুজুরের আঘাত প্রায় ভাল হয়ে গিয়েছে। হুজুর তার ডেস্কে বসে স্বাভাবিকভাবে কাজ করছেন দেখে আমি অনেকটাই আশ্বস্ত হলাম।

হুজুর কিভাবে আঘাত পেয়েছিলেন সেটি বর্ণনা করেন।

পুরো ঘটনা বর্ণনা করার আমার কোন অধিকার নেই। কিন্তু আমি এটুকু বলতে চাই যে বিপদের সময়ও হুজুরের সাহস সকল মানুষের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

হুজুর বাগানে যাচ্ছিলেন একটি সুইচ অফ করার জন্য। সেখানেই তিনি পড়ে যেয়ে গুরুতর আঘাত পান। তা সত্ত্বেও তিনি প্রথমে সুইচটি অফ করেন এবং তারপর ঘরে যেয়ে ডাক্তার সাব্বির ভাট্টি সাহেবকে ফোন করেন। যিনি, সৌভাগ্যবশত তখন ইসলামাবাদেই ছিলেন।

গুরুতর আঘাত ও ব্যথা সত্ত্বেও হুজুর ডাক্তার সাহেবকে আশ্বস্ত করেন। হুজুর তাকে কোনরকম দুশ্চিন্তা না করে কাজ করতে বলেন।

পরবর্তী কয়েক দিন সম্বন্ধে হুজুর বলেন :

“আলহামদুলিল্লাহ, আমার অবস্হা এখন অনেক ভাল। ব্যথাও একদম নেই বললেই চলে। প্রথম দিকে যখন ব্যথা ছিল, তখন আমি অফিসে না আসতে পারলেও ওয়াকাসকে (সাহিবযাদা মির্যা ওয়াকাস আহমদ) অফিসের ফাইল পত্র নিয়ে আসতে বলতাম। বাসায় বসে ফাইল ও চিঠিপত্র দেখতাম। ”

আমি বললাম :

“হুজুর, সেসময় আমিও আপনাকে দপ্তরী চিঠি প্রেরণ করতাম। পরের দিনই তার জবাব পেয়ে যেতাম। যখন আমি জানতে পারলাম যে আপনি আঘাত পেয়েছেন তখন আমি অনেক বিব্রতবোধ করছিলাম। কারণ আমি অপ্রয়োজনীয় চিঠির মাধ্যমে আপনার কাজের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু একইসাথে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম যে আপনি এত দ্রুত সেগুলো দেখে ফেলেছেন।”

হুজুর বলেন :

“যখন আমি আঘাতপ্রাপ্ত হই, তখন আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে পুরোপুরি সুস্হ হতে হয়ত কমপক্ষে ২ সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্‌পাকের অশেষ রহমত ও দয়ার কারণে আমি দ্রুত সুস্হতা লাভ করি। ”

হুজুর কাজ করার সময় বলেন যে হাটু ও কবজিতে এখনো কিছুটা ব্যথা রয়েছে।

এটি বলার পর আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে হুজুর কাছের একটি কাপবোর্ডে ঝুঁকে কিছু একটা নিচ্ছেন। যার ফলে তার হাটুর উপর স্বভাবতই অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। হুজুর যখন দাড়ালেন আমি দেখলাম যে তিনি কাপবোর্ড থেকে কিছু একটা বের করেছেন। তিনি সেটি আমাকে ঈদের উপহার হিসেবে প্রদান করেন। আমার চোখের অশ্রু সংবরণ করতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল।

সবসময়ই যুগখলীফা আমাদের প্রতি ভালবাসার কারণে তার নিজের সকল ব্যথাকে অগ্রাহ্য করে আসেন।

তিনি ইসলামের জন্য এবং বিশ্বের সকল আহমদীগণের জন্য সকল প্রকার ত্যাগ স্বীকার করেন।

মহান আল্লাহ্‌পাক সকল আহমদী মুসলমানদের এটি বোঝার তৌফিক দান করুন, যে আমরা মহা সৌভাগ্যের অধিকারী; কারণ আমাদের মাঝে খিলাফত রয়েছে। আমীন।