হুজুরের জার্মানী সফর আগস্ট ২০১৭ (১ম পর্ব)

হুজুরের জার্মানী সফর আগস্ট ২০১৭ (১ম পর্ব)

ব্যক্তিগত ডায়েরী- আবিদ খান

 

ভূমিকা

১৯ আগস্ট ২০১৭ তারিখে হুজুর তার কাফেলা নিয়ে ১০ দিনের সফরের জন্য জার্মানীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সকাল ১০.১০ মিনিটে হুজুর তার বাসস্হান থেকে বের হন এবং নীরব প্রার্থনার পর আমরা মসজিদ ফযল থেকে যাত্রা শুরু করি। এসময় আহমদ ভাই হুজুরের গাড়ীর সামনের সিটে বসার সৌভাগ্য লাভ করেন। গত কয়েক বছর ধরে আহমদ ভাই অসুস্হ। গত বছরও তার একটি অপারেশন হয়েছে এবং এর ফলে তার গলার স্বাভাবিক কন্ঠস্বর পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। আল্লাহর রহমতে তিনি কথা বলতে পারেন কিন্তু পূর্বের মতো জোরে বলতে পারেন না। আহমদ ভাই অবশ্য সকল সমস্যা ধৈর্য্যের সাথে মোকাবেলা করছেন।

আমাদের কাফেলা যখন ইউরোটানেলে প্রবেশ করবে তখন আমি আহমদ ভাই এর একটি টেক্সট মেসেজ পাই। তিনি লিখেছেন “আমি ব্যক্তিগতভাবে চিন্তা করেছিলাম যে আমার অসুস্হতার জন্য হুজুর কখনো আমাকে আর দীর্ঘ সফরের জন্য তার গাড়ীতে ডিউটি করতে অনুমতি দিবেন না। কিন্তু আমি সুস্হ হবার সাথে সাথেই হুজুর আমাকে ডেকে পাঠান। এটি কেবল আল্লাহর রহমত এবং হুজুরের ভালবাসা যে তিনি আমাকে এই সুযোগ দিয়েছেন। ”

প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর প্রয়োজনীয়তা

আমাদের কাফেলা দুপুরে ইউরোটানেল পৌছায়। ট্রেনে উঠার পূর্বে হুজুর কয়েক মিনিটের জন্য সার্ভিস স্টেশনে যান এবং আমাকে তার কাছে ডাকেন। হুজুর আমাকে হোয়াটসঅ্যাপের একটি ভিডিওর কথা জিজ্ঞেস করেন যেখানে একজন মহিলা সমুদ্রতীরে নামায পড়ছিল কিন্তু তার পোশাক মার্জিত ছিল না। সেই ভিডিওতে একজন নন আহমদী মৌলবী মন্তব্য করে যে তার সেই সময় নামায পড়া ঠিক হয়নি কারণ তখন সূর্য একদম মাথার উপর ছিল।

হুজুর বলেন “এটি হল প্রমাণ যে এখন কেন মুসলমানদের দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য ইমাম মাহদী(আঃ) এর প্রয়োজন। এ সময় তথাকথিত মৌলবীগণ সামান্য বিষয় নিয়ে তুলকালাম বাধিয়ে দেয় কিন্তু প্রকৃত বিষয় নিয়ে কোন আলোচনাই করে না। যেমন এখানে তাদের এতে কোন আপত্তি নেই যে মহিলাটি প্রায় নগ্ন অবস্হায় নামায পড়ছে বরং তাদের চিন্তা হল সূর্যের অবস্হান নিয়ে!  ”

 

নাদিম সাহেবের উত্তম পরিকল্পনা

ইউরোটানেলে অনেক গাড়ীর ভীড় ছিল। তাই আমাদের জানানো হল যে আমাদেরকে দুপুর ১.২০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। দেরী হচ্ছে দেখে নাদিম আমিনী যিনি আমাদের গাড়ী চালাচ্ছিলেন বারগার কিং থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসে। হুজুরকে দেবার পর হুজুর একটি ফিশ-বার্গার, কিছু ফ্রাই ও আইসড টি নেন। কয়েক মিনিট পর হুজুর চিকেন বার্গার ফেরত দিয়ে আর একটি ফিশ বার্গার নেন। নাদিম অত্যন্ত আনন্দিত ছিল। কারণ খাবার কেনার পরিকল্পনা তারই ছিল।

সে আমাদের বলে “হুজুর এতই বিনয়ী যে তিনি কখনোই তার জন্য কিছু চাইবেন না। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত ছিলেন। এটি আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানের বিষয় যে হুজুর আমার সামান্য উপহার গ্রহণ করেছেন। ”

ব্রুজেস এ যাত্রা বিরতি

বিকেল ৪.১০ মিনিটে আমাদের কাফেলা নামায ও দুপুরের খাবারের জন্য ব্রুজেস এর একটি হোটেলে যাত্রা বিরতি নেয়। আমাদের কাফেলার প্রথম তিনটি গাড়ী ১.২০ মিনিটের মধ্যে ইউরোটানেল অতিক্রম করে। কিন্তু যানজটের জন্য চতুর্থ গাড়িটি প্রায় এক ঘন্টা দেরী হয়। সেই গাড়ীতে জামেআর শিক্ষার্থীগণ ছিল। আমরা ফ্রান্সে আসার পর হুজুর কয়েকবার সেই গাড়ীর খোঁজখবর নেন এবং গাড়ীর চালককে বার্তা পাঠান সে যেন দ্রুত গাড়ী না চালায়। আমরা হোটেলে থাকা অবস্হায় তারা সেখানে এসে পৌছায়। হুজুর তাদের জিজ্ঞেস করেন যে তারা খেয়েছে কিনা। তারা যখন বলে যে তারা খেয়ে নিয়েছে তখনই হুজুর ফ্রাঙ্কফোর্ট যাত্রার জন্য গাড়ীতে উঠেন।

কয়েক মিনিট পূর্বেই হুজুর যাত্রা শুরুর জন্য রুম থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু তখন হুজুর জানতে পারেন যে এখনো অনেকের খাওয়া হয়নি। তাই হুজুর তাদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আবার রুমে চলে যান। এতে বোঝা যায় হুজুর তার সফরসঙ্গীদের প্রতি কতটা খেয়াল রাখেন ও ভালবাসেন। হুজুর সবসময় লক্ষ্য রাখেন যেন তাদের মৌলিক প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রাখা হয়।

যাত্রা শুরুর সময় হুজুর দেখেন জার্মানীর আমীর সাহেব মাহমুদ ভাই এর সাথে কথা বলছেন। হুজুর তাকে বলেন “আমীর সাহেব, আপনি কি আবার মাহমুদ খানকে আপনার সাথে সাইক্লিং এ যাবার জন্য উৎসাহিত করছেন?”

তারা দুজনেই হুজুরের কথা শুনে হাসলেন। কিন্তু আমার মনে হয় তারা কিছুটা লজ্জ্বাও পেয়েছেন। কারণ পূর্বের সফরে আমীর সাহেব মাহমুদ ভাইকে নিয়ে সাইক্লিং করতে বের হয়েছিলেন এবং তখন একটি দুর্ঘটনার কারণে মাহমুদ ভাইকে এক মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে!

শান্তির যুবরাজ

প্রায় দুই ঘন্টা যাত্রার পর আমরা একটি সার্ভিস স্টেশনে বিরতি নেই। সেখানে হুজুর জার্মানীর আমীর সাহেবের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন। তখন জার্মানীর কিছু মানুষ হুজুরকে দেখে জামাতের সদস্যদের কাছে হুজুরের পরিচয় জানতে চান। একজন জার্মান বলেন “তিনি কি কোন যুবরাজ? তাকে দেখতে যুবরাজের মতোই লাগছে!”

স্হানীয় আহমদীগণ তাদেরকে হুজুরের পরিচয় জানান এবং খলীফাতুল মসীহ হিসেবে তিনি যে বিশ্বে শান্তির বাণী প্রচার করছেন সেটি ব্যাখ্যা করেন।

এরপর আমরা আবার আমাদের যাত্রা শুরু করি। প্রায় রাত দশটার সময় আমার মনে হল যে আমরা প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কিন্তু একটি গাড়ী দুর্ঘটনার জন্য আমাদেরকে অন্য পথ দিয়ে যেতে হয় যেটি খুবই দীর্ঘ ছিল। আহমদ ভাই ওয়াকিটকি তে খবর নিচ্ছিলেন যে হুজুর জানতে চাচ্ছেন দুর্ঘটনায় কোন আহমদী গাড়ী ছিল কিনা? আমি চিন্তা করলাম যে হুজুর সবসময় আহমদীদের জন্য চিন্তা করছেন। কয়েক মিনিট পর হুজুরকে জানানো হয় যে কোন আহমদী দুর্ঘটনার সাথে জড়িত ছিল না।

 

বায়তুস সুবুহ তে আগমন

আল্লাহর অশেষ রহমতে হুজুর ও তার কাফেলা রাত ১০.২৫ মিনিটে বায়তুস সুবুহতে পৌছায়। সেখানে শত শত আহমদী নারী, পুরুষ ও বাচ্চাগণ হুজুরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাড়িয়ে ছিল। এরপর হুজুর মাগরিব ও এশার নামায আদায় করান।

আহমদীদের আবেগ

পরদিন সকাল থেকেই আহমদীদের সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে হুজুরের জামাতী কর্মকান্ড শুরু হয়ে যায়। যারা হুজুরের সাথে দেখা করেছেন আমি তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলি। আমি রাজ্জাক আহমদ (৫২ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে জার্মানী এসেছেন। তিনি তার পাকিস্তানের জীবন সম্বন্ধে বলেন “পাকিস্তানে আমি এবং আমার পরিবারকে অত্যন্ত কঠিন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমার দুইজন চাচাতো ভাই এবং এক ভাতিজাকে শহীদ করা হয়েছে। পাকিস্তানের বাইরের আহমদীগণ এটি কল্পনাও করতে পারবে না যে প্রতিদিন আমাদের কিরকম সমস্যার সম্মুক্ষীণ হতে হয়। আপনি কল্পনা করতে পারবেন না যে খলীফার পিছনে নামায আদায় করার কি অনু্ভূতি। ”

“আমি আজ আমার চোখে পানিকে নিয়ন্ত্রন করতে পারিনি। কারণ আমি আমার জীবনে প্রথমবারের মতো খলীফার সাথে দেখা করছি। এটি আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। আমি মনে করি আমার পরিবার পাকিস্তানে যে অত্যাচারের সম্মুক্ষীণ হয়েছে এটি তারই পুরস্কার।  ”

আমি এক তরুণ আহমদী পরিবার জুনায়েদ বুখারী(২৮ বছর) ও তার স্ত্রী আনাম মাসুদ সাহিবার সাথে কথা বলি। তারা মূলত পাকিস্তানের অধিবাসী। জুনায়েদ ও তার মা ২০০৪ সালে আহমদীয়াত গ্রহণ করে কিন্তু পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নন-আহমদীই থাকে। তিনি বলেন “আমি ১৫ বছর বয়সে আহমদীয়াত গ্রহণ করি। আমি কিছু আহমদী ছেলের সাথে ক্রিকেট খেলতাম এবং তারা আমাকে তাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে বলে। এটি আমার উপর গভীর প্রভাব ফেলে। আমি যে সুন্নী ইসলাম পালন করতাম ও আহমদীয়াতের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। হয়ত সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল আহমদীগণ যা প্রচার করত সেটাই পালন করত। ”

“আহমদীয়াত গ্রহণের পর আমাদের আত্মীয়-স্বজন আমাদের উপর অত্যন্ত রাগান্বিত হয়। তারা আমার ও আমার মায়ের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে। কিছু সময় পর তারা আবার আমাদের সাথে যোগাযোগ করে কিন্তু আমাদের সম্পর্ক আগের মতো আন্তরিক হয়নি। কিন্তু সেটি কোন সমস্যা নয় কারণ আমি প্রকৃত ইসলাম পেয়ে গিয়েছি। যেটি আমাকে জীবনের দিক নির্দেশনা দিয়েছে এবং প্রকৃত ইসলাম কি সেটি বুঝিয়েছে। ”

তার স্ত্রী হুজুরের সাথে প্রথমবার সাক্ষাতের অনুভূতি সম্বন্ধে বলেন “যখন আমি হুজুরের রুমে যাই এবং প্রথমবারের মতো হুজুরের চেহারা দেখি, তখন আমি কোন কথাই বলতে পারিনি। যাই হোক আমি কেবল হুজুরের দোয়া চাই এবং এখন আমার কাছে সেটি রয়েছে। আমার পাকিস্তান থেকে চলে আসার কোন ইচ্ছাই ছিল না। কিন্তু বিদেশে চলে আসার আমার একমাত্র আকর্ষণ ছিল যে একদিন আমি হুজুরের সাথে দেখা করতে পারব। আলহামদুলিল্লাহ, আজকেই সেই দিন। ”

 

আমি নাভেদ আহমদ (৩০ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “আমি যখন হুজুরের সাথে দেখা করি তখন আমার মনে হল আমি এক নতুন জীবন লাভ করেছি। এটি সামান্য এক মিনিটের সাক্ষাৎ ছিল কিন্তু এর বরকত সারাজীবন থাকবে। আমাদের খলীফার ভালবাসার কোন তুলনা নেই। আমি যখন পাকিস্তানে ছিলাম তখন আমাদের গ্রামে আহমদীদের উপর অনেক অত্যাচার করা হতো। আমি তখন দোয়ার জন্য হুজুরকে চিঠি লিখতাম। অনেক ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও হুজুর আমার চিঠির উত্তর দিতেন এবং নিজ হাতে তাতে সই করতেন। হুজুর আমাদের বেশি করে ইসতেগফার করতে বলতেন। এটি হুজুরের দোয়ারই ফলাফল যে আজ আমি জার্মানীতে শান্তিতে বসবাস করতে পারছি।  ”

আসিফ আহমদ(৪০ বছর) ও তার স্ত্রী মোবাশশের নাসের সাহিবা প্রথমবারের মতো হুজুরের সাথে দেখা করেন। তারা আমাকে বলেন যে পাকিস্তানে তাদের উপর অনেক অত্যাচার করা হয়েছে এবং তাদের এক আত্মীয়কে কয়েক বছর পূর্বে শহীদ করা হয়েছে। তাদের আত্মীয়ের কবর নন-আহমদীগণ নিয়মিতভাবে নষ্ট করে থাকে। কিন্তু এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাদের ঈমান সামান্যও দুর্বল হয়নি বরং তা আরো দৃঢ় হয়েছে।

মোবাশশের সাহিবা বলেন “পাকিস্তানের সকল প্রতিকূলতার বিনিময়ে আল্লাহপাক আজ আমাকে সবচেয়ে সুন্দর পুরস্কার দিয়েছেন। আমি আজ হুজুরের সুন্দর চেহারা, হাসি ও নূর দেখেছি। এটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ”

“যারা আমাদের উপর অত্যাচার করে আমি তাদের বলতে চাই যে তারা আমাদের হত্যা করতে পারে, কবর নষ্ট করতে পারে, আমাদের বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করতে পারে; কিন্তু তারা কখনোই খলীফার সাথে আমাদের বন্ধনকে শেষ করতে পারবে না। আমাদের বেচেঁ থাকার জন্য এই একটি জিনিসই যথেষ্ট। ”

রাশিয়ার বালুকণা

সকালে আমি জামিল আহমদ(৩০ বছর) নামে একজন তরুণ মোবাল্লেগের সাথে কথা বলি। তিনি ২০০৯ সালে জামেআ আহমদীয়া রাবওয়া থেকে পাশ করেন এবং বর্তমানে রাশিয়ার উফা শহরে কাজ করছেন। এটি মস্কোর ১৩০০ কিমি পূর্বে অবস্হিত।

তিনি বলেন “কয়েক বছর পূর্বে আহমদী হবার কারণে আমার বাবা ও ভাই এর উপর আক্রমণ করা হয়েছিল। কিন্তু আমার পরিবার এজন্য কোথাও কোন অভিযোগ করেনি। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আবার প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করে। আমার বাবা সেটি সহ্য করতে পারেনি; তাই তিনি তাদের কঠোরভাবে আজেবাজে কথা বলতে নিষেধ করেন। যদিও তারাই আমাদের উপর অত্যাচার করছিল কিন্তু তারাই পুলিশের কাছে যেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে। তাই পুলিশ আমার বাবাকে থানায় নিয়ে যায় এবং কয়েক সপ্তাহ আটকে রাখে। কিন্তু পাকিস্তানে আহমদীদের জন্য এটি কোন নতুন বিষয় নয় বরং এটি খুবই সাধারণ ব্যাপার। ”

আমি রাশিয়াতে তার অবস্হা কেমন তা জানতে চাই যেখানে তিনি ৪ বছর ধরে কাজ করছেন। তিনি বলেন “যখন আমি প্রথম রাশিয়াতে যাই আমার জন্য পরিস্হিতি অনেক কঠিন ছিল। কারণ আমি তাদের ভাষা জানতাম না। সবকিছুই আমার জন্য নতুন ছিল। দৈনন্দিন চলাফেরা করাও এজন্য অসুবিধাজনক  ছিল। কিন্তু আমি সবসময় ইতিবাচক ছিলাম এবং কখনো এরকম চিন্তা করিনি যে আমি এভাবে কাজ করতে পারব না। কারণ আমি জানতাম আমার কাছে হুজুরের দোয়া রয়েছে। আমি নিজেকে এজন্য ভাগ্যবানও মনে করি কারণ আমি এমন একটি দেশে কাজ করছি যার সম্বন্ধে মসীহ মাউদ(আঃ) ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে বালুকণার মতো মানুষ আহমদীয়াতে প্রবেশ করবে। তাই যখন এখানে প্রচন্ড শীতও পড়ে আমি দুঃখিত হই না বরং আমি গর্ববোধ করি যে আমি পৃথিবীর এই অংশে জামাতের সেবা করতে পারছি। ”

“আমার ছেলে রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছে। আর রাশিয়ার আইন অনুযায়ী তার ভিসার জন্য আমাদের পাকিস্তানে যেয়ে আবেদন করতে হবে। আমি জানি যে এজন্য অনেক সময় লেগে যাবে। তাই আমি দোয়ার জন্য হুজুরকে চিঠি লিখি। আশ্চর্যজনকভাবে রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ আমার ছেলের জন্য সরাসরি ভিসা দিয়ে দেয়। এটি আমাদের জামাতের জন্য প্রথম ঘটনা যেখানে একজন আহমদী বাচ্চাকে রাশিয়ে নিজে থেকেই ভিসা দিয়েছে।  ”

 

ঈমানের দৃষ্টান্ত

আমি তারিক মাহমুদ(৪০ বছর) ও তার স্ত্রী রাজিয়া সাহিবার সাথে কথা বলি। তারিক সাহেব বলেন তিনি পাকিস্তানের শিয়ালকোটে ছিলেন। সেখানে আহমদীয়াতের কারণে ২০০৭ সালে তার উপর অমানুষিক অত্যাচার করা হয়। কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি না দিয়ে উল্টো তাকেই জেলে পাঠানো হয়। এটিই হল পাকিস্তানের আইনের অবস্হা যেখানে অত্যাচারীদের সাহায্য করা হয়। পুরো ঘটনা বর্ণনা করার পূর্বে তিনি আমাকে তার মুখ ও মাথার কিছু ক্ষতচিহ্ন দেখান। ঘটনাটি বলার সময় তিনি তার চোখের পানি আটকাতে পারেননি। তিনি বলেন “১০ বছর আগের ঘটনা। সন্ধ্যার সময় আমি মসজিদ থেকে বাসায় ফিরছিলাম। তখন হঠাৎ করেই একজন হকি স্টীক দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি এবং এক ঘন্টা সেখানেই পড়ে থাকি। কিন্তু পাকিস্তানের আইন নির্যাতিতদের পক্ষে নয়। তাই আমার বিরুদ্ধেই মামলা করা হল যে আমি নন-আহমদীদের উপর আক্রমণ করেছি। ”

“মামলার ফলে আমাকে দুই মাস জেলে থাকতে হয়। এরপর আমি জামিন পাই। আমি সেই দুই মাস কখনো ভুলতে পারব না। পরিস্হিতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও অমানুষিক ছিল। আমার চারপাশে অনেক বিপজ্জনক মানুষ ছিল এবং তাদের সাথেই আমার থাকতে হয়েছে। ”

“কিন্তু এর ফলে আমার ঈমান সামান্যও দুর্বল হয়নি। আমি সামান্য সুবিধা পাবার আশায় কখনো আমার ধর্মকে লুকাইনি। বরং আমি যখন জামিন পাই তখন একই রাস্তা দিয়ে মসজিদ যাওয়া আশা করি।  ”

“সেই সময়টি আমার ও আমার পরিবারের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময় ছিল। কিন্তু আমরা সবচেয়ে ভাল পুরস্কার পেয়েছি। আমরা খলীফার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছি এবং এটিই আমাদের জন্য সবকিছু। হুজুরের হাসি ও ভালবাসা আমাদের সকল দুঃখ-কষ্টকে দূর করে দিয়েছে। ”

তার কথা শেষ হবার পর তার স্ত্রী রাজিয়া সাহিবা নিজের চোখ মুছেন ও বলেন “আমাদের বাবা-মা এখনো পাকিস্তানে। তাই আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি যে আপনি যদি সুযোগ পান তাহলে হুজুরের কাছে দোয়ার আবেদন জানাবেন যেন আল্লাহপাক তাদের রক্ষা করেন। আমরা চাই তারা যেন আমাদের সাথে এসে থাকেন। কিন্তু তারা অনেক বৃদ্ধ ও দুর্বল হয়ে গেছেন তাই এত দীর্ঘ সফর করতে চাচ্ছেন না। ”

একটি আকস্মিক সফর

আমি জামেআ কানাডা থেকে আগত একজন ছাত্র আরসালানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি। আমি তাকে আগে থেকেই চিনতাম, কারণ হুজুরের ২০১৬ সালের কানাডা সফরের সময় তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। সে আমাকে বলে যে কিভাবে সে ও জামেআতে তার একজন বন্ধু হুজুরের সাথে এই সফরে আসার সুযোগ পেয়েছে।

আমি তাকে এই কাফেলায় দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম। কারণ কয়েকদিন পূর্বেই সে আমাকে বলেছিল যে সে জার্মানী জলসায় কয়েকজন বন্ধুর সাথে নিজের খরচে আসবে।

আরসালান আমাকে পুরো ঘটনা বর্ণনা করে। সে বলে “কয়েক সপ্তাহ পূর্বে আমি হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করি এবং হুজুরের কাছে অনুমতি চাই যে আমি কি তার সাথে জার্মানী সফরে আসতে পারি। হুজুর বলেন যে কাফেলার সদস্য সংখ্যা কম, তাই আমাকে আমার ব্যবস্হা নিজেই করতে হবে। তাই আমি আমার জামেআ বন্ধুদের সাথে সফর করার পরিকল্পনা করি। কিন্তু আমরা যার গাড়ী নিতে চাইছিলাম সে কেবল জার্মানী জলসার আগের দিন আসতে পারবে। কিন্তু আমরা চাইছিলাম হুজুরের কাছে যত বেশি দিন সম্ভব অবস্হান করা।   ”

“তাই আমি ও আমার জামেআর বন্ধু ফারুক অনলাইনে প্লেন, ট্রেন, বাস ও অন্যান্য যাতায়াতের উপায় খুঁজতে থাকি। কিন্তু প্রতিটিই আমাদের বাজেটের বাইরে ছিল। অবশেষে আমরা এক ব্যক্তির সন্ধান পাই যিনি কিছু অর্থের বিনিময়ে আমাদের জার্মানী নিয়ে যেতে সম্মত হন। আমরা যখন তাকে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলাম তখন হুজুরের একজন কর্মকর্তা আমাদের বলেন যে কিছু করার পূর্বে হুজুরের অনুমতি নিয়ে নিতে।  ”

“আমরা হুজুরের ব্যক্তিগত সেক্রেটারী সাহেবকে আমাদের পরিকল্পনা বলি। কয়েক মিনিট পর তিনি হুজুরের রুম থেকে বের হয়ে এসে বলেন যে হুজুর আমাদের এভাবে সফর করার অনুমতি দেন নি। কারণ এতে কোন নিশ্চয়তা থাকে না যে আমরা কার সাথে সফর করছি। সেই ব্যক্তি কোন অপরাধী বা চোরাচালানকারীও হতে পারে। কিন্তু হুজুর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে জামাতের ব্যবস্হাপনা আমাদের জার্মানী সফরে সাহায্য করবে। এই সংবাদ শুনে আমরা এত আনন্দিত ছিলাম যেটি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমরা এটি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।  ”

“পরবর্তীতে সেদিনই সন্ধ্যায়, হুজুরের সফরের আগের দিন আমাদের পরিকল্পনা আবারো পরিবর্তন হয়ে যায়। হুজুরের ব্যক্তিগত সেক্রেটারী সাহেব আমাদের জানান যে হুজুর এখন নির্দেশ দিয়েছেন যে আমি ও আমার বন্ধু ফারুককে যেন কাফেলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না যে এই খবর শুনে আমরা কতটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছিলাম। সফরের মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বে হুজুর আমাদের তার কাফেলায় অন্তর্ভুক্ত করেন এবং আমাদের জন্য আর একটি গাড়ী কাফেলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। হুজুরের সাথে এখানে আসতে পারা, তার পিছনে নামায আদায় করতে পারা সত্যিই অকল্পনীয়। ”

আহমদীদের আবেগ

পরবর্তী দিন আমি আরো কিছু আহমদীদের সাথে কথা বলি যারা হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। আমি মুজাফফর আহমদ(৩১ বছর) ও তার স্ত্রী ফারাহ তাবাসসুম সাহিবার সাথে কথা বলি। তারা মূলত পাকিস্তানের অধিবাসী এবং বিগত ৪ বছর ধরে জার্মানীতে আছেন।

তিনি বলেন “পাকিস্তানে বাস করা আমাদের জন্য একটি কঠিন পরিক্ষা। প্রতিদিনই আমাদের জামাতের উপর অত্যাচার করা হয়। স্কুল ও কলেজ সব জায়গায়ই আমাকে সমস্যার সম্মুক্ষীণ হতে হয়েছে। মানুষ আমাকে এবং প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) কে গালি গালাজ করত। অনেকে আমার ও আমার আহমদী বন্ধুর সাথে একত্রে খেতে চাইত না। কিছু মানুষ আমাদের উপর আক্রমণও করত এবং এর ফলে আমাদের এলাকায় কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। কিন্তু জার্মানীতে আমরা আমাদের ধর্ম পালনে স্বাধীন। এখানে আমার স্ত্রীও মসজিদে আসতে পারে কিন্তু পাকিস্তানে নিরাপত্তার জন্য মহিলারা মসজিদে যেতে পারত না। ”
তার স্ত্রী প্রথমবারের মতো হুজুরের সাথে সাক্ষাতের ফলে কিছুটা আবেগপ্রবণ ছিলেন। তিনি বলেন “হুজুরের অফিসে আমি কোন কথাই বলতে পারিনি। আমার কেবল মনে হচ্ছিল আমি একজন ফেরেশতার সামনে বসে আছি। আমি এখনো চোখের পানি আটকাতে পারছি না। আমি অনেক ভাগ্যবান। এই দিন আমার পরিবারের জন্য অত্যন্ত বরকতময়। আমাদের বাচ্চা একজন ওয়াকফে নও। তাই আমি হুজুরের দোয়া চাই যেন সে ওয়াকফে নও এর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে। আমি হুজুরকে বলতে চাচ্ছিলাম তিনি যেন দোয়া করেন যেন আমাদের সন্তান একজন মোবাল্লেগ হয়। কিন্তু আমি হুজুরের সামনে কথাই বলতে পারিনি। তাই আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি হুজুরকে এই দোয়ার জন্য বলবেন।  ”

আমি মোহাম্মদ আশরাফ (৫১ বছর) ও তার স্ত্রী আমাতুল ওয়াদুদ সাহিবা ও তাদের সন্তানদের সাথে কথা বলি। তিনি ৬ বছর ধরে জার্মানীতে আছেন। তিনি বলেন “১৯৮৯ সালে বিরোধীরা আমাদের ও আশেপাশের কয়েকটি আহমদী বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। সৌভাগ্যবশত জামাতের সাহায্যে আমরা আমাদের বাড়ী পুনঃনির্মাণ করি। এসব কারণে আমি জার্মানীতে এসে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ; কারণ এখানে আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। আমি এখানে তবলীগ করতে পার, লিফলেট বিতরণ করতে পারি এবং তবলীগ স্টলে কাজ করতে পারি। সেই দিন এখন অতীত যখন আমি কাউকে সালামও জানাতে পারতাম না; আলহামদুলিল্লাহ।   ”

তার স্ত্রী প্রথমবারের মতো হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে বলেন “হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করা আমার জীবনের সবচেয়ে মূলবান মুহুর্ত। আমি এই অভিজ্ঞতা পূর্বে কখনো অনুভব করিনি। আমি হুজুরকে অসংখ্যবার এমটিএ তে দেখেছি। কিন্তু হুজুরকে সামনাসামনি দেখা সম্পূর্ণ নতুন একটি অভিজ্ঞতা।  ”

“আমি একটি জিনিস বুঝতে পেরেছি সেটি হল, এখানে আহমদীরা যেসব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে সেটির জন্য তাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। যখন তারা মসজিদে যায় তাদের বুঝতে হবে যে এটি তাদের জন্য অত্যন্ত সম্মানের বিষয়। তারা এখানে অন্যদের বলতে পারে যে তারা আহমদী মুসলমান। তারা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে তারা বিনা বাধায় মানুষের কাছে তাদের ধর্ম সম্বন্ধে বলতে পারে। পাকিস্তানে এ সকল মৌলিক জিনিস থেকেই আহমদীরা বঞ্চিত রয়েছে।  ”

মোহাম্মদ আবু বকর সাহেব(৩১ বছর) তার পরিবার নিয়ে হুজুরের সাথে দেখা করেন। তিনি বলেন “আমি পাকিস্তানে মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়ার কায়েদ হিসেবে কাজ করেছিলাম। অনেক অত্যাচার ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও পাকিস্তান জামাত অনেক ঐক্যবদ্ধ ছিল। আমার মতে এখনো পাকিস্তান জামাত ইউরোপের অনেক জামাতের চেয়ে শক্তিশালী। পাকিস্তানে খোদ্দামুল আহমদীয়া আমাদের যে তরবিয়ত প্রদান করে সেটি অনেক কার্যকরী। তারা আমাদের বিভিন্ন বিষয় সমন্বয় করতে ও অন্যদের সেবা করার শিক্ষা প্রদান করে। ”

“হুজুরের সাথে দেখা করার অভিজ্ঞতা আমি কখনো ভুলতে পারব না। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র মানুষের সামনে বসতে পেরে নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান বলে মনে করছি। হুজুর হলেন চুম্বকের মতো যার দিকে আমরা আকৃষ্ট হই। আমি নিশ্চিত খিলাফতের বরকতের ফলে আমাদের উপর অত্যাচার একসময় শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের ঈমান আজীবন দৃঢ়ভাবে বেঁচে থাকবে।  ”

আমি তিনজন ভাইবোন মোহাম্মদ নওয়াজ(৩১ বছর) এবং তার দুই বোন সুমেরা ও সাইমার সাথে কথা বলি। তারা আমাকে জানায় যে তাদের মা আহমদী কিন্তু বাবা আহমদী নন। তাই তাদের বাসায় অনেক সসমস্যার সম্মুক্ষীণ হতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও তাদের ঈমান সামান্যতম দুর্বল হয়নি।

নওয়াজ সাহেব বলেন “আজকে আমি আমার অতীতের সকল কষ্ট ভুলে গিয়েছি। কারণ আজ আমি বিশ্বের সবচেয়ে দয়ালু, সুন্দর ও ভালবাসাপূর্ণ মানুষের সাথে দেখা করেছি। কয়েক মিনিটেই হুজুর যে দিক নির্দেশনা দেন সেটি আমাদের সারা জীবন কাজে লাগবে।  ”

সুমেরা সাহিবা বলেন “পাকিস্তানে আমি সবার সামনে কলেমাও পড়তে পারতাম না। সেখানে এমন পরিস্হিতি যে আমাদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং আমরা কোর্টে গিয়েছি। কিন্তু কোর্ট আমাদের প্রতি কোন সহানুভূতি প্রদর্শন করেনি কারণ আমরা আহমদী। কিন্তু যখনই কোন প্রতিবন্ধকতা এসেছে সেটি প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর সত্যতা সম্বন্ধে আমাদের ঈমানকে আরো দৃঢ় করেছে। ”

সালিমা সাহিবা বলেন “আমি হুজুরের কাছে দোয়ার জন্য আবেদন করি যেন আমাদের বাবা আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন ভাল হৃদয়ের মানুষ। কিন্তু তিনি তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমাদের বিরোধিতা করেন। তাই আমার বাবা ও আমাদের পরিবারের শান্তির জন্য আমি হুজুরের কাছে দোয়ার আবেদন করি যেন একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে।  ”

২১ আগস্ট সকালে হুজুর আরো কিছু পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমি একজন আহমদী আমীর জলিল(৪৭ বছর) ও তার ছেলে ইউসুফ জলীল(১৭ বছর) এর সাথে কথা বলি। তিনি ১৯৯০ সালে পাকিস্তান থেকে জার্মানীতে আসেন। তিনি বলেন “আমি যখন তরুণ ছিলাম তখন পাকিস্তানে আহমদীদের অবস্হা অনেক কষ্টদায়ক ছিল। সেটি ছিল জেনারেল জিয়ার আমল। তাই আমাদের এলাকায় আহমদীদের বিরুদ্ধে অনেক কর্মকান্ড পরিচালিত হতো। কয়েকবারই নন-আহমদীগণ আমাকে মেরেছে এবং মাঝেমধ্যেই আমাদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করার জন্য তারা আমাদের বাসার সামনেই তাবু খাটিয়ে থাকত। ”

“কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে যে এত অত্যাচারের কারণে আমাদের ঈমান কখনো দুর্বল হয়েছে কিনা; আমি তাকে বলব আহমদীয়াতের উপর আমাদের যে বিশ্বাস সেটি কখনো দুর্বল হবে না, ইনশাল্লাহ। আমরা যেকোন ধরণের অত্যাচার সহ্য করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি কারণ আমাদের খিলাফত রয়েছে। তারা আমাদের হত্যা করতে পারে, আমাদের সন্তানদের ও ভালবাসার মানুষদের হত্যা করতে পারে; কিন্তু আমাদের সাথে খলীফার ভালবাসা ও দোয়া রয়েছে। আমি এইমাত্র হুজুরের সাথে দেখা করে আসলাম। তিনি আমার দেখা সবচেয়ে পবিত্র মানুষ। আমি খলীফা ও জামাতের জন্য সবরকম ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত রয়েছি।  ”

তার ছেলে ইউসুফ বলেন “আমি জার্মানীতেই বড় হয়েছি। তাই আমাকে বাবার মতো সেরকম অত্যাচারের সম্মুক্ষীণ হতে হয়নি। কিন্তু আমি শপথ করে বলছি যদি আমার উপরও তাদের মতো অত্যাচার করা হয় তাহলেও আমি সবকিছুর জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আমি আহমদীয়াতের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে সামান্যও দেরী করব না। আমি আজকে হুজুরকে দেখেছি এবং আমি জানি তিনি যা বলেন তাই সঠিক। আমার জীবন তখনই বরকতময় হতে পারি যদি আমি খলীফার কথা শুনি ও তা মেনে চলি। ”

এরপর আমি সাবির আহমদ (৪০ বছর) ও তার স্ত্রী ফারাহ সাবির সাহিবার সাথে কথা বলি। তিনি আমাকে তার জন্মের পূর্বের এক ঘটনার কথা বলেন যার ফলে তার পরিবারের আহমদীয়াতের প্রতি ঈমান আরো দৃঢ় হয়েছে। তিনি বলেন “আমার বাবা তখন তরুণ ছিলেন এবং তখনো বিবাহ করেননি। তার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই জামাত থেকে দূরে সরে যায়। আমার বাবা শিক্ষিত ছিলেন না তাই জামাতের বিরুদ্ধে যেসব অপপ্রচার করা হতো, তার ফলে তার ঈমানও হারিয়ে যাবার আশংকা ছিল।  ”

“কিন্তু কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বেই তিনি গুরুতর অসুস্হ হয়ে পড়েন। ডাক্তার বলেন যে এতে তার জীবনও যেতে পারে। আমার বাবা আল্লাহর কাছে দোয়া করেন ‘যদি প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) সত্য হয় তাহলে আমাকে সুস্হতা দান কর যেন আমি সামনের কাদিয়ান জলসাতে যেতে পারি’। ”

“কয়েক দিন পর আমার বাবা স্বপ্ন দেখেন যেখানে দুইজন ডাক্তার তাকে সুস্হ করে তুলেন। আলহামদুলিল্লাহ এরপর তার শরীর সুস্হ হয়ে যায় এবং তিনি কাদিয়ান জলসায় যান। জলসায় তিনি সেই দুইজন লোককে দেখেন যারা স্বপ্নে তাকে সুস্হ করে তুলেছিল। এটি একটি অলৌকিক ঘটনা। তিনি সাথেসাথেই বুঝতে পারলেন যে তার পরিবারের সকল সদস্যরা তাকে ভুল বোঝাচ্ছে। এর মাধ্যমে আল্লাহপাক তার ঈমানকে রক্ষা করেন।  ”

“আমি আমার বাবার কাছে কৃতজ্ঞ কারণ তিনি অসুস্হ অবস্হায় আল্লাহর কাছে সেই দোয়া করেছিলেন। সেই কারণেই আজ আমি একজন গর্বিত আহমদী হিসেবে এখানে দাড়িয়ে আছি। আমার নিজের যদিও কোন যোগ্যতাই নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও বাবার দোয়ার ফলেই আজ আমি যুগখলীফার সাথে দেখা করতে পেরেছি।”

তার স্ত্রী বলেন “হুজুরের সাথে দেখা করার অনুভূতি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আমি যখন পাকিস্তানে থাকতাম তখন মানুষের কথা শুনতাম যারা হুজুরের সাথে দেখা করে এসেছেন। আমি মনে করতাম যে তারা কতই না ভাগ্যবান। আমি কখনো ভাবিনি যে আমিও সেই সৌভাগ্য অর্জন করতে পারব। কিন্তু আজ আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি, আমার স্বামী ও সন্তান বিশ্বের সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তির মধ্যে কয়েকজন।  ”

আমি পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ থেকে আগত একজন বয়স্ক আহমদী আল্-রাকা (৬৯ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “পাকিস্তানে আমাদের পরিবারের উপর অনেক অত্যাচার করার হয়েছে। আমাদের বাসা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং আমি ও অন্যান্য কয়েকজন আহমদীদেকে হত্যা করার চেষ্টাও করা হয়েছে। আমাদের পরিবারকে বয়কট করা হয়েছিল। তাই আমরা দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারতাম না যেমন বাজারে যেয়ে কেনাকাটা করা। স্হানীয় মোল্লাদের প্রভাবে আমার মেয়েকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়। আমার বাচ্চাদের রিকশা থেকে নামিয়ে মারা হত কারণ তারা আহমদী।  ”

আমি তাকে জিজ্ঞেস করি এসব অত্যাচার কি কখনো অসহ্য বলে মনে হতো? তিনি বলেন আসতাগফিরুল্লাহ, কখনো নয়! আমাদের ঈমান কখনো এক বিন্দু পরিমাণও দুর্বল হয়নি। তারা আমাকে হাজারবার হত্যা করতে পারে কিন্তু প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর উপর আমার যে বিশ্বাস রয়েছে সেটি কখনো দুর্বল হবে না। কারণ এই বিশ্বাসই আমার সারা জীবনের সম্পদ। আবিদ সাহেব মনে রাখবেন তারা আমাদের হত্যা করতে পারে কিন্তু তারা কখনো আমাদের ঈমানকে কেড়ে নিতে পারবে না। এজন্য আমাদের বিরুদ্ধবাদীরা আমাদের উপর যতই অত্যাচার করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তাদের কোন ক্ষমতাই নেই।  ”

 

বায়তুস সুবুহতে দলীয় মোলাকাত

হুজুর বায়তুস সুবুহ মসজিদে প্রায় ৩০০ জন আহমদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। আহমদীগণ লাইন ধরে দাড়িয়ে ছিলেন এবং তারা একজন একজন করে এসে হুজুরের সাথে দেখা করেন। তারা হুজুরের সাথে হাত মেলায়, দোয়া চায় এবং হুজুরের সাথে ছবি তুলে। অনেক আহমদীই হুজুরের সাথে প্রথমবার দেখা করে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন। একজন খুবই বয়স্ক ব্যক্তি হুজুরের সাথে দেখা করেন। মনে হচ্ছিল একন ছোট বাচ্চা তার বাবার সাথে দেখা করতে এসেছে। হুজুর তাকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কোন স্হান থেকে এসেছেন। কিন্তু তিনি কোন কথাই বলতে পারছিলেন না। তিনি কাঁপছিলেন এবং তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছিল। হুজুর তার গালে হাত দেন ও তার জন্য দোয়া করেন।

একজন আহমদী হুজুরের কাছে এসে বলেন ‘হুজুর আমার জন্য দোয়া করবেন। একটি বিষয়ে আমার বিরুদ্ধে পুলিশ তদন্ত করছে।’

হুজুর তাকে জিজ্ঞেস করেন “আপনি কি ভুল কোন কাজ করেছেন?”

সেই ব্যক্তি লজ্জ্বার সাথে মাথা নাড়ায়।

হুজুর বলেন “তাহলে প্রতিদিন বেশি বেশি করে ইসতেগফারের রত থাকুন । ”

এভাবে প্রত্যেকেই হুজুরের সাথে দেখা করেন। কেউ কেউ হুজুরের সাথে দেখা করে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন, অনেকের মুখে হাসি দেখা যায়। তাদের আবেগ যেরকমই হোক না কেন তারা সকলেই খিলাফতের প্রতি ভালবাসায় একতাবদ্ধ।

আধ্যাত্মিক সেবক

এ বছর জার্মানীর জলসায় আমেরিকার মোবাল্লেগ ইনচার্জ আযহার হানিফ সাহেব বক্তব্য রাখবেন। আমি তার বক্তব্য শোনার জন্য আগ্রহী ছিলাম কারণ তিনি খুব ভাল বক্তা। আমরা জার্মানীতে একই বিল্ডিং এ থাকছিলাম। দুপুরের খাবার সময় আমি তার পাশেই বসলাম। আমি তার কাছে আফ্রিকান-আমেরিকান মোবাল্লেগ হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলাম।

তিনি বিনয়ের সাথে আমাকে বলেন “আবিদ সাহেব, আমি আপনার ডায়েরী পড়তে অত্যন্ত পছন্দ করি। কারণ সেখানে আমার প্রিয় খলীফার অনেক কথা লেখা থাকে। কিন্তু আমি সেখানে আমার নিজের বিষয়ে কিছু পড়তে চাই না। কারন আমি কেবল মসীহ মাউদ(আঃ) এর একজন সামান্য সেবক। আমার খলীফা আমাকে যেখানে যেতে বলেন আমি সেখানেই যাই, তিনি যা করতে বলেন আমি তাই করি। আমি তার নির্দেশ মেনে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করি। এটিই হল আমার জীবনকাহিনী।  ”

আযহার সাহেব একজন আফ্রিকান-আমেরিকান আহমদী। তাই তিনি সেই সম্প্রদায়ের অন্তর্গত যাদের উপর শত শত বছর ধরে অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছে। এখনো বলা যায় না যে তাদেরকে সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার দেয়া হচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়তই সংবাদপত্রে দেখতে পাই যে কালো হবার জন্য তাদের কিরকম বৈষম্যের স্বীকার হতে হচ্ছে।

কিন্তু আমি একজন মানুষের সামনে বসে আছি যিনি নিজেকে মসীহ মাউদ(আঃ) এর দাস হবার দাবী করেন এবং এই দাসত্বের জন্য গর্ববোধ করেন। অবশ্য এই দাসত্ব সম্পূর্ণ নতুন এক প্রকার দাসত্ব এবং এই বন্ধন এক নতুন প্রকারের বন্ধন। এটি কোন শিকল বা হাতকড়ার দাসত্ব নয়। বরং এটি হল স্বাধীনতা ও মুক্তির দাসত্ব। এটি এক আধ্যাত্মিক দাসত্ব যেটি মানুষকে সম্মান ও স্বাধীনতা দেয়।

বায়তুস সামাদ মসজিদ উদ্বোধন

২১ আগস্ট হুজুর বায়তুস সামাদ মসজিদ উদ্বোধনের জন্য জার্মানীর গিসেন শহরের উদ্দেশ্য রওনা হন। আমাদের কাফেলা বিকেল ৫.৪৫ মিনিটে সেখানে পৌছায়। সেখানে হুজুর ফলক উন্মোচনের পর নীরব প্রার্থনা করেন। তারপর মসজিদে জোহর ও আসরের নামায আদায় করান। নামাযের পর হুজুর স্হানীয় জামাতের সদস্যদের সাথে দেখা করেন এবং বাচ্চাদের মাঝে চকলেট বিতরণ করেন।

প্রেস কনফারেন্স

বিকেল ৬.২৫ মিনিটে আমরা শহরের কেন্দ্রে যাই যেখানে ২৬৫ জন অতিথি উপস্হিত ছিলেন। সেখানে যাবার পর জার্মানীর আমীর সাহেব হুজুরকে বলেন যে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজ করা হয়েছে।

হুজুর বলেন “আমাকে যে সূচী দেয়া হয়েছে সেখানে তো অনুষ্ঠানের পর সংবাদ সম্মেলন হবার কথা। ”

হুজুর এরপর মেইন হলরুমে যান যেখানে কয়েকজন সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলেন। সাংবাদিকগণ হুজুরকে আহমদীয়া মুসলিম জামাতের উদ্দেশ্য, বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ বৃদ্ধি, ইসলামে নারী-পুরুষের পার্থক্য বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করেন। একজন সাংবাদিক বলেন যে ইউরোপে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হুজুর বলেন যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের স্বাভাবিক ফলাফল হল ক্রোধ ও ভয়। হুজুর বলেন যে ইসলাম সকল প্রকার সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে এবং আহমদী মুসলমানগণ প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার প্রচার করে।

সাংবাদিক হুজুরকে প্রশ্ন করেন “বেশিরভাগ মুসলমানই আহমদীদের সাথে একমত নয় এবং তারা তো আপনাদের মুসলমান হিসেবেই স্বীকার করে না। ”

হুজুর তাকে বলেন যে এটি প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর সত্যতাই প্রমাণ করে। তিনি বলেন “মহানবী(সাঃ) ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে একসময় বেশিরভাগ মুসলমানই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ভুলে যাবে। তখন আল্লাহপাক ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা পুনরুদ্ধার করার জন্য একজনকে পাঠাবেন। অনেক মুসলমানই এখনো আহমদীয়াত গ্রহণ করেনি। কিন্তু প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ আহমদীয়া জামাতে প্রবেশ করছে। ১২৮ বছর পূর্বে একজন মাত্র মানুষ এই জামাতের সূচনা করেছিলেন। যিনি ভারতের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে থাকতেন। আজ পুরো বিশ্বে তার লাখ লাখ অনুসারী রয়েছে। একটি ধর্মের পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে সময় প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় খৃষ্টান ধর্ম পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে প্রায় ৩০০ বছর লেগেছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) বলেছেন যে আমাদের জামাত ছড়িয়ে পড়তে ৩০০ বছর লাগবে না।  ”

একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে আহমদী মহিলারা পৃথক হলে বসে আছেন কেন? এটি কি ইন্টিগ্রেশনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে না। হুজুর বলেন “সকল ধরণের পর্দা বা শালীনতা ছেড়ে দেয়ার নাম ইন্টিগ্রেশন নয়! একসাথে ক্লাবে যাওয়া বা মদপান করাও ইন্টিগ্রেশন নয়! আমার মতে ইন্টিগ্রেশন হল দেশকে ভালবাসা, আইন মেনে চলা এবং নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী দেশের জন্য কাজ করা। সকল অভিবাসীকে তারা যে দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে সে দেশের প্রতি অনুগত ও সৎ থাকতে হবে। ”

“নারী-পুরুষের পৃথক স্হানে বসা একটি ধর্মীয় বিষয়। কিন্তু এর ফলে আহমদী মহিলাদের কোনভাবেই সুবিধাবঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে না। আমাদের জামাতে অনেক মহিলা ডাক্তার, নার্স, বিজ্ঞানী, স্থাপত্যবিদ এবং অন্যান্য পেশার মহিলা রয়েছেন। তারা তাদের কর্মজীবনে দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। কিন্তু যখন নামাযের সময় আসবে তখন তারা তাদের ধর্মীয় শিক্ষা অনুযায়ী পৃথক স্হানে বসতেই স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করবেন।    ”

 

একটি সুন্দর অভিব্যক্তি

প্রেস কনফারেন্সের পর হুজুর বাইরে আসেন যেখানে স্হানীয় মেয়র মিসেস ডিটলিন্ড গ্রেব হুজুরকে গাছে পানি দেবার জন্য অনুরোধ করেন যেটি শহরের পক্ষ থেকে তিনি মসজিদে উপহার দিয়েছেন। মেয়র বলেন যে এভাবে তিনি মসজিদটিকে তাদের এলাকায় অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। হুজুর যখন গাছটিতে পানি দিতে যাচ্ছিলেন তখন তিনি পিছনেই দাড়িয়ে ছিলেন। হয়ত তিনি ভেবেছিলেন যেহেতু তিনি একজন মহিলা তাই হুজুর তার সাথে একত্রে গাছে পানি দিতে চাইবেন না।

হুজুর মেয়রকে বলেন “আমাদের উচিৎ দুইজন একসাথে পানি দেবার পাত্রটিকে ধরি ও গাছে পানি দেই। ”

মেয়র হুজুরের প্রস্তাব শুনে অবাক ও আনন্দিত হন। তিনি আবারো হুজুরের কাছে নিশ্চিত হয়ে নেন যে আসলে তিনি কি বলতে চেয়েছেন। হুজুর আবারও তাকে সামনে এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেন এবং তারা একসাথে গাছে পানি দেন। হুজুর হাসেন ও বলেন “এটিই হল প্রকৃত ইন্টিগ্রেশন।”

মেয়র মনে করতে পারেন যে ইসলাম মহিলাদেরকে পুরুষের থেকে কম সম্মান দেয়। কিন্তু হুজুর এই ঘটনার মাধ্যমে মেয়র সাহেবের মন থেকে এই সন্দেহ দূর করে দেন। হুজুর ইসলামিক শিক্ষার কারণে মহিলাদের সাথে হাত মেলাতে পারবেন না। কিন্তু হুজুর একই সাথে এটিও পরিস্কারভাবে ব্যক্ত করেন যে ইসলামে নারী-পুরুষের মাঝে যে পর্দা রয়েছে সেটি শান্তি স্হাপন ও সমাজের উন্নতির জন্য কোন প্রতিবন্ধকতা নয়।

গিসেন শহরে অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান

বায়তুস সামাদ মসজিদ উদ্বোধন উপলক্ষ্যে গিসেন শহরে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোরআন তেলাওয়াত ও জার্মানীর আমীর সাহেবের উদ্বোধনী বক্তব্যের পর কয়েকজন অতিথি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন যাদের মধ্যে স্হানীয় মেয়রও ছিলেন। সকল অতিথি মসজিদ স্হাপনের জন্য অভিবাদন জানান এবং জামাতের শান্তি ও সৌহার্দ্যের বাণী প্রচারের প্রশংসা করেন। স্হানীয় মেয়র কিছুদিন পূর্বে বার্সিলোনায় সন্ত্রাসী হামলা সম্বন্ধে বলেন “আহমদী মুসলমানগণ শান্তিপ্রিয় এবং যদি মানুষ আপনাদের আদর্শ অনুসরণ করে তাহলে আমরা কখনো বার্সিলোনার মতো সন্ত্রাসী হামলা দেখতাম না। শান্তির জন্য একত্রে কাজ করার প্রতীক হিসেবে আমি ও হযরত মির্যা মাশরুর আহমেদ মসজিদের চারাগাছে পানি দিয়েছি।  ”

হুজুরের বক্তব্য

অতিথিদের বক্তব্যের পর হুজুর তার বক্তব্য দেন যেখানে তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতা, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহানুভুতি এবং ইসলামিক বিভিন্ন শিক্ষা নিয়ে কথা বলেন। হুজুর বলেন “এই মসজিদের নাম হল বায়তুস সামাদ। সামাদ আল্লাহপাকের একটি গুণবাচক নাম যার অর্থ হল আল্লাহ হল সেই সত্ত্বা যিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং চিরস্হায়ী, সবকিছুই আল্লাহর উপর নির্ভরশীল। তাই আল্লাহপাক একমাত্র তাকেই ইবাদত করতে মানুষকে আদেশ দিয়েছেন এবং তার কাছেই আশ্রয় চাইতে বলেছেন। ”

হুজুর ব্যাখা করেন যে ইসলাম সকল নবীকেই সম্মান করার শিক্ষা দেয় এবং এর ফলে অন্যান্য ধর্মের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা বজায় থাকে। হুজুর বলেন “যখন আমরা মূসা অথবা ঈসা নবীর কথা বলি তখন তার নামের সাথে আলাইহিস সালাম বলি। কারণ আমরা আল্লাহ প্রেরিত সকল নবীকেই সম্মান করি। আমরা বিশ্বাস করি তারা ন্যায়পরায়ণ বান্দা ছিলেন যাকে আল্লাহপাক শান্তি স্হাপনের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তাই আমরা সকল নবী ও তাদের শিক্ষাকে সম্মান করি। এটি হল বিশ্বে প্রকৃত শান্তি স্হাপনের মূলভিত্তি।  ”

হুজুর বলেন “ধর্মীয় মতভেদের পার্থক্যকে সম্মান করা উচিৎ এবং একে দূরত্ব ও ঘৃণা সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা উচিৎ নয়। মানুষের বিনা কারণে ধর্মীয় পার্থ্যক্য নিয়ে অভিযোগ করা উচিৎ নয়, এর ফলে দূরত্ব সৃষ্টি হবে এবং মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। ”

“আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করতে চাই যেখানে সকলের প্রতি দয়া ও সহানুভূতি থাকবে। আমরা শত্রুতা, বিশৃঙ্খলা ও সংঘর্ষপূর্ণ পৃথিবীতে থাকতে চাই না। এটিই হল আমাদের লক্ষ্য এবং এজন্যই আমরা সারা বিশ্বে মসজিদ নির্মাণ করছি। ”

হুজুরের বক্তব্যের প্রভাব

হুজুরের বক্তব্যের পর আমি কিছু অতিথির সাথে কথা বলি। তাদের সাথে কথা বলে এটি পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল যে তারা হুজুরের বক্তব্যে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছে এবং ইসলাম সম্বন্ধে তাদের যে ভীতি ও ভুল ধারণা ছিল তা দূর হয়েছে।

আমি ডেভিড নামে একজন খৃষ্টানের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “আপনার খলীফার কথা শোনার পর আমার মনোভাব পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। পূর্বে আমি আপনার মতো কোন মুসলমানের সাথে বসতে ভয় পেতাম। কিন্তু এখন আমি আনন্দিত যে আপনি আমার পাশে বসেছেন এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে আপনি আমার কোন ক্ষতি করবেন না। একজন প্রকৃত মুসলমান সবসময়ই শান্তিপ্রিয় হয়ে থাকেন। খলীফার বক্তব্য শোনার পর তার প্রতি আমার সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি আমাদের শান্তি, ভালবাসা, সাম্যের কথা বলেছেন এবং তিনি দেখিয়েছেন যে ‘ভালবাসা সবার ত’রে, ঘৃণা নয়কো কারো পরে’ এই বাণী অর্থহীন নয় বরং সত্য।   ”

একজন জার্মান মহিলা মিসেস ওটে বলেন “আমি একদিনে এতকিছু জানতে পেরে আশ্চর্য হয়েছি! এটি পরিস্কার যে সন্ত্রাসবাদ ও হিংস্রতার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তিনি অনেক পরিস্কারভাবে এবং যুক্তিসহকারে তা ব্যাখ্যা করেছেন। সত্য কথা হল সকল দেশেই এবং সকল ধর্মেই কিছু খারাপ মানুষ আছে; কিন্তু এজন্য আমরা পুরো দেশ বা ধর্মকে দোষারোপ করি না। তাই যদি কোন মুসলমান কোন খারাপ কাজ করে থাকে এজন্য ইসলামকে দোষ দেয়া ঠিক নয়।  ”

ফ্র্যাঙ্ক মিচার নামে একজন অতিথি বলেন “আমার ভাল লেগেছে যে আপানাদের খলীফা নিজেই ইসলামে মুসলমানদের অধিকার এবং নারী-পুরুষের পার্থক্যের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি ইসলামের এই বিষয়টিকে লুকানোর চেষ্টা করেননি। অনেকেই বলে থাকেন যে ইসলাম নারীদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে কিন্তু খলীফা প্রমাণ করেছেন যে এটি সঠিক নয়। তিনি ইন্টিগ্রেশনের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন সেটিও আমার ভাল লেগেছে, তিনি বলেছেন যে ইন্টিগ্রেশনের প্রকৃত অর্থ হল দেশের উন্নতির জন্য কাজ করা।   ”

জনাব শাহীন নামে একজন অতিথি বলেন “আজকের বিশ্বে আপনাদের খলীফাকে খুবই প্রয়োজন। কারণ পুরো বিশ্ব ইসলামকে ঘৃণার চোখে দেখে। আপনার খলীফা যেই ইসলামের কথা বলেছেন তারা যদি সেই ইসলামের কথা জানত তাহলে তারা ইসলামকে ঘৃণা বা ভয় পেত না। তারা বুঝতে পারত যে ইসলাম নিজের দেশের প্রতি অনুগত হবার শিক্ষা দেয় এবং মসজিদ কোন সন্ত্রাসীদের স্হান নয়।    ”

অতিথি মি: কুরী বলেন “আমি আপনার খলীফাকে দেখে ও তার কথা শুনে খুবই আভিভূত ও লজ্জ্বিত হয়েছি কারণ আমি পূর্বে কখনো আহমদীয়া মুসলিম জামাতের কথা শুনিনি। আপনাদের খলীফা অনেক ভালবাসাপূর্ণ ও যৌক্তিক মানুষ। মিডিয়াতে ইসলামকে ভুলভাবে প্রচার করা হয়; তিনি দেখিয়েছেন যে প্রকৃত ইসলাম সমাজকে একত্র করে শান্তি স্হাপন করতে পারে।   ”

একজন আবেগপ্রবণ মহিলা

আমি যখন বিভিন্ন অতিথির সাথে কথা বলছিলাম তখন জামাতের মোবাল্লেগ সাহেব আমাকে বলেন যে আপনাকে একজন জার্মান মহিলা অতিথির সাথে দেখা করতে হবে কারণ যখন কোরআন তেলাওয়াত করা হচ্ছিল তখন তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তার চোখে পানি এসে যায় এবং তিনি তার আবেগকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য হলের বাইরে চলে যান। তার কথা শুনে আমি সেই মহিলার কাছে যাই ও আমার পরিচয় দেই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি যে অনুষ্ঠানে তার কোন জিনিসটি সবচেয়ে ভাল লেগেছে। তিনি আমাকে হুজুরের বক্তব্যের অনেক বিষয় তার ভাল লেগেছে বলেন। কিন্তু কোরআন তেলাওয়াতের কোন কথাই তিনি বললেন না। আমি তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করি যে আর কোন বিশেষ বিষয় তার ভাল লেগেছে কিনা। কিন্তু তিনি আবারো হুজুরের বক্তব্যের কথাই উল্লেখ করেন। আমি এরপর তাকে নির্দিষ্ট করে তেলাওয়াতের কথা জিজ্ঞেস করি। কিন্তু তার উত্তর শুনে আমার মনে হলো না যে তিনি তেলাওয়াত শুনে অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। পরিশেষে আমি তাকে সরাসরি বলি যে একজন আমাকে বলেছেন যে আপনি তেলাওয়াতের সময় এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন যে হল রুমের বাইরে চলে যান।

আমার কথা শুনে তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন ও বলেন “আমার রুমের বাইরে যেতে হয়েছিল কারণ হঠাৎ করেই আমার কাশি উঠছিল এবং আমি কারো সমস্যা সৃষ্টি করতে চাইনি। সেই ব্যক্তি আপনাকে ঠিকই বলেছিল যে আমার চোখে পানি চলে এসেছিল; কিন্তু সেটি ছিল আমার কাশির জন্য, আবেগের জন্য নয়! ”

যদিও আমি আমার বক্তব্যের জন্য লজ্জিত ছিলাম কিন্তু তার কথা শুনে আমিও হেসে ফেলি। আমি আমার ভুলের জন্য তার কাছে ক্ষমা চাই! সৌভাগ্যবশত তিনি আমার কথায় কিছু মনে করেননি। পরবর্তীতে সেই মোবাল্লেগ আমার সাথে মহিলার কি কথা হল জানার জন্য আসেন। প্রকৃত ঘটনা শুনে তিনিও বিব্রত হন।

খলীফাতুল মসীহর সাথে কাজ করা

গিসেন শহর থেকে ফেরার সময় হুজুরের একজন নিরাপত্তা কর্মী আব্দুল কুদুস সাহেব ২০০১ সালের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। এক দশকেরও বেশী সময় ধরে তিনি লন্ডনে হুজুরের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দলের একজন সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জার্মানীর ফ্র্যাঙ্কফোর্টে বড় হয়েছেন এবং তখন জার্মানীর খোদ্দাম হিসেবে সেখানেও নিরাপত্তা কর্মীর কাজ করেছেন। তখন হুজুর জার্মানীতে সফরে আসলেই কুদুস সাহেব পুরো সময় মসজিদে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেন।

২০০১ সালে হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) জার্মানী সফরে আসেন এবং তিনি হুজুরের পুরো সফরের সময় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। হুজুরের লন্ডন ফিরে যাবার পর দিন তিনি তার নিজের স্বাভাবিক কাজে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু রাস্তায় তিনি গাড়ী দুর্ঘটনার স্বীকার হন। আল্লাহর রহমতে একজন ডাক্তার তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তিনি গাড়ীর ধ্বংসাবশেষ দেখে আমার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। ডাক্তার বলেন যে অ্যাম্বুলেন্স ডাকলে কুদুস সাহেবকে বাচানো যাবে না, তাকে আকাশে তুলে হাসপাতালে নিতে হবে। পরবর্তী দুই দিন তার উপর অনেক জটিল অস্ত্রপ্রচার করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ ২-৩ দিন পর তার জ্ঞান ফিরে আসে।

তিনি বলেন “হাসপাতালে আমার যখন প্রথম জ্ঞান আসে, আমি দুর্ঘটনার কথা মনে করি এবং আমি চিন্তা করি ‘আমি বেঁচে আছি’। এরপর আমার বউ, বাচ্চা ও পরিবারের কথা মনে না এসে আমার মনে হলো যে আমি আর কখনো হুজুরের নিরপত্তার দায়িত্ব পালন করতে পারব না। এই দুঃখ যেকোন শারীরিক কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।   ”

“আমার ভাই আমাকে বলে যে হুজুরের কাছে দোয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে। লন্ডনের নিরাপত্তা দল জানায় যে হুজুর পরের দিন ফযরের পর আমার অবস্হা সম্বন্ধে জানতে চেয়েছেন। আমি এটি শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হই যে আমার খলীফা আমাকে মনে রেখেছেন। হুজুরের দোয়ার ফলে আমি দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে থাকি।  ”

“আল্লাহর অশেষ রহমতে খলীফাতুল মসীহ আল খামেস (আইঃ) প্রথম সফর হিসেবে জার্মানীতে আসেন এবং তখন আমি নিরাপত্তার দায়িত্বের জন্য শারীরিকভাবে সুস্হ ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ ২০০৫ সাল থেকে আমি হুজুরের নিরাপত্তা দলে কাজ করছি এবং আমি খলীফাতুল মসীহর জন্য কাজ করতে পারাকে সবচেয়ে সম্মানের বলে মনে করি। ”

অপরাধবোধ

২২ আগস্ট ২০১৭ তারিখে হুজুর কিছু আহমদী পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমি তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে কথা বলি। ওয়াসিম আহমদ খান সাহেব (৩৯ বছর) বলেন “আমি পাকিস্তানের লাহোরে নিরাপত্তার কাজ করতাম। কিন্তু লাহোরের ২৮ মে আহমদী মসজিদ আক্রমনের এক মাস পূর্বে আমি জার্মানীতে আসি। আমি খবর পাই যে সেই আক্রমনে আমার কিছু বন্ধুও শহীদ হয়েছে।  ”

“সেদিনের পর থেকে আমি এক ধরণের অপরাধবোধে ভুগছি। কারণ জার্মানীতে চলে আসার জন্য আমি বেঁচে গেছি কিন্তু আমার বন্ধুরা শাহাদাৎ বরণ করেছে। কিন্তু আজ হুজুরকে দেখার পর আমি প্রশান্তি লাভ করেছি। আমি বুঝতে পেরেছি যে আমার কর্তব্য হল প্রতিনিয়ত জামাতের সেবা করে যাওয়া। ”

আমি তাকে বলি যে ২০১৬ সালে জামেআ আহমদীয়ার এক ছাত্র রাজা সেলিম হাইকিং করতে যেয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। তখন তার সাথের বন্ধুরাও আপনার মতো নিজেদেরকে দোষী বলে মনে করত। কিন্তু হুজুর তাদের বুঝিয়েছেন যে সত্যিকারের বন্ধুর অধিকার তখনই আদায় করা হবে যখন তারা তার বন্ধুর অসমাপ্ত কাজ শেষ করবে।

এ কথা শুনে ওয়াসিম সাহেব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন ও তার চোখে অশ্রু এসে যায়। তিনি বলেন “আমি ওয়াদা করছি, আমার যেসব বন্ধু লাহোরে শাহাদাত বরণ করেছে তাদের জন্য আমি আমার সাধ্যমত কাজ করব। আমি খলীফা ও জামাতকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ দিয়ে সাহায্য করব। ”

 

আহমদীদের আবেগ

আমি মানসূর আহমদ (৩২ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি রাবওয়া থেকে জার্মানীতে চলে এসেছেন। তিনি বলেন “পাকিস্তানে আহমদীদের বিরোধিতা এতটাই বেশি যে মাঝে মাঝে মনে হয় নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। এরপর আমি দুবাই চলে যাই কিন্তু সেখানেও চুপচাপ থাকতে হয়। সেখানেও জুমআর নামায পড়া একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা। তাই জার্মানী আসার পূর্বে আমি ধর্মীয় স্বাধীনতা কি তাই বুঝতাম না। ”

“আল্লাহর রহমতে এখন সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা সত্যিই অসাধারণ। আমি আশা করছিলাম আমাদের সাক্ষাতের সময় যেন কখনো শেষ না হয়। আমি এখানে প্রথমবারের মতো নামাযে হুজুরের তেলাওয়াত শুনি। আমি তখন আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছিলাম না। আমার মনে হল আমি সম্পূর্ণ এক নতুন জগতে আছি।  ”

এরপর আমি রানা ফযলে ওমর (৩১ বছর) ও তার স্ত্রী হাফিযা সাহিবার সাথে কথা বলি। ফযল সাহেব বলেন “আমার বড় দাদা যিনি প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর সাহাবী ছিলেন তার কবরের ফলক বিরোধীরা নষ্ট করে ফেলেছে এবং তারা হুমকি দিচ্ছে যে তার মৃতদেহকেও কবর থেকে উঠিয়ে ফেলা হবে। ”

“আমরা প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে দোয়া করছি যে তিনি যেন আমাদের সকল বিরোধিতা থেকে রক্ষা করেন। কয়েক সপ্তাহ পর আমরা খবর পাই যে ব্যক্তি আমার বড় দাদার কবর নষ্ট করার হুমকি দিয়েছিল সে একটি সন্ত্রাসী দলে যোগ দেবার জন্য সীমান্ত পেরিয়ে আফগানিস্তানে যায়। সেখানে রকেটের আঘাতে তার মৃত্যু হয়। তার পরিণাম দেখে তার দলের সদস্যরা ভীত হয় এবং হুমকি দেয়া বন্ধ করে।  ”

হুজুরের সাথে দেখা করা সম্বন্ধে তার স্ত্রী বলেন “আমি এত নার্ভাস ছিলাম যে হুজুরকে রাবওয়াতে আমার নিজের এলাকার নামই বলতে পারছিলাম না। কিন্তু হুজুর নিজেই আমাকে মনে করিয়ে দেন। আমার স্বামী বলে থাকেন যে হুজুরকে দেখে কখনো মানুষ নিজের নামই ভুলে যায়।   ”

পাঞ্জাবী নযম

আমি মোহাম্মদ ইয়াকুব (৭৭ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি কয়েক সপ্তাহ পূর্বে লন্ডনে হুজুরের সাথে দেখা করেন। তিনি বলেন “আমি ২৪ জুলাই তারিখে হুজুরের সাথে দেখা করি। হুজুর জানতে চান আমি কোথায় উঠেছি এবং আমি তাকে বলি যে আমি বায়তুল ফুতুহ মসজিদে উঠেছি। হুজুর অনেক দয়ালু এবং তিনি আমার স্বাচ্ছ্যন্দের জন্য চিন্তা করছিলেন। কিন্তু আমি হুজুরকে বলি যে আমার একমাত্র লক্ষ্য হল হুজুরের কাছাকাছি থাকা এবং আমার কোন প্রকার আরাম আয়েশের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারপরও হুজুর বলেন যে আমি যেন ফযল মসজিদে উঠি, তাহলে আমার জন্য সুবিধা হবে। আমি আলহামদুলিল্লাহ বলি, কারণ এর ফলে আমি সারা দিন-রাত আমার খলীফার কাছাকাছি থাকার সুযোগ পাব।  ”

তিনি আরও বলেন “আমি কানাডাতে লঙ্গর খানায় কাজ করি ও জামেআর ছাত্রদের জন্য খাবার রান্না করি। আলহামদুলিল্লাহ এজন্য আমি জামাতের কাছ থেকে কোন অর্থ নেই না। আমি তাদের জন্য কাজ করতে পেরে গর্বিত কারণ আমি বিশ্বাস করি এসব ছাত্ররাই একদিন খলীফার দূত হয়ে সারা বিশ্বে ইসলামের সঠিক বাণী প্রচার করবে। কেউ যদি আমার পরিচয় জানতে চায় আমি তাকে বলব যে আমি খিলাফতের একজন সামান্য কাদেম।  ”

এরপর তিনি হঠাৎ করেই একটি পাঞ্জাবী নযম গাইতে শুরু করেন। যেখানে প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) ও খিলাফতে আহমদীয়ার কথা বলা আছে। নযম শেষ করার পর তিনি বলেন যে তিনি নিয়মিত পাঞ্জাবী নযম গান এবং হুজুরের সামনেও গেয়েছেন।

উপহার

২৩ আগস্ট ২০১৭ তারিখে আমি বায়তুস সুবুহ মসজিদের প্রাঙ্গনে হাটছিলাম। তখন আমি গাম্বিয়ার তিনজন আফ্রিকান আহমদীর দেখা পাই। তারা হলেন ওমর শাহ(৪৭ বছর)- গাম্বিয়ার মোবাল্লেগ, আল হাজ জাগনে (৬৫ বছর) এবং ইয়ানকুবা সিনায়োকো (৪৩ বছর)।

আমি যখন তাদের সাথে কথা বলতে চাইলাম ওমর সাহেব বললেন “এটি উত্তম হবে যদি আমরা কথা শুরু করার আগে দোয়া করে নেই।”

এরপর তিনি সূরা ফাতিহা ও দরূদ পড়েন এবং তারপর আফ্রিকাতে তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন।

আমি আফ্রিকান আহমদীদের ঈমানের দৃঢ়তা দেখে অবাক হয়েছি। তারা যেকোন সাধারণ আলাপচারিতার পূর্বেও আল্লাহ ও তার রাসূল(সাঃ) কে স্মরণ করে।

আমি শুনেছি যে গাম্বিয়ার নতুন সরকার নির্বাচিত হবার পর আহমদীদের উপর অত্যাচার অনেক কমেছে। ওমর সাহেব বলেন “গাম্বিয়ার অবস্হা পরিবর্তন হচ্ছে। যদিও রাজনীতিবিদ দের পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না কিন্তু লক্ষণ এখন ভাল বলেই মনে হচ্ছে। যেমন আমাদের সরকারের মন্ত্রী ইউকে জলসাতে এসেছেন, যেটি খুবই ভাল লক্ষণ। একমাত্র হুজুরের দোয়ার ফলেই আমাদের অবস্হা উন্নতি হয়েছে এবং হবে ইনশাল্লাহ্। ”

“গাম্বিয়াতে আহমদীদের ঈমান অনেক দৃঢ়। সেখানে হাজার হাজার আহমদী রয়েছে যারা কখনো তাদের খলীফার সাথে দেখা করেনি। কিন্তু তারপরও খিলাফতের সাথে তাদের ভালবাসা ও বন্ধন অত্যন্ত গভীর। আমি এখানে আসার পূর্বে তাদেরকে বলি যে আমি হুজুরের সাথে দেখা করব। তারা এটা শুনে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। আমি দোয়া করি গাম্বিয়া জামাত যেন হুজুরকে সেখানে আমন্ত্রন জানাতে পারে। যদি সেটি সম্ভব হয় তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে একটি অবিশ্বাস্য ও ঐতিহাসিক ঘটনা হবে।  ”

 

ইয়ানকুবা সাহেব তার দেশের অবস্হা সম্বন্ধে বলেন “সবাই আশঙ্কা করছিলাম যে নির্বাচনের পর গাম্বিয়াতে রক্তের নদী বয়ে যাবে, কিন্তু দেখা যায় এক ফোটা রক্তপাতও হয়নি। গাম্বিয়ার একজন নাগরিকও ভাবেনি যে এরকম শান্তিপূর্ণভাবে নতুন সরকার গঠন হবে। এই অলৌকিক ঘটনা সম্ভব হয়েছে খলীফাতুল মসীহর দোয়ার ফলে। নির্বাচনের পূর্বেও হুজুর আমাদের ধৈর্য্য ধারণ করতে বলেছেন এবং বলেছেন যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। হুজুরের কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ”

হুজুরের সাথে দেখা করার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি বলেন “হ্যা, আমি হুজুরের সাথে দেখা করেছি। পুরো সময় আমার মনে হচ্ছিল যে আমার শরীরের প্রতিটি অংশই কাঁপছে। আমি হুজুরের উপস্হিতিতে সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম।  ”

আল হাজী জাগনে সাহেব বলেন “আমি গাম্বিয়ার প্রথম দিকের কয়েকজন আহমদীর মধ্যে একজন। এজন্য আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি। তরুণ বয়সে আমার পরিবারের জমি বিরোধীরা দখল করে নেয় এবং আমাদের অনেক দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। কিন্তু অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের ঈমান সামান্যও দুর্বল হয়নি। আজ আমাদের সন্তানরা তার সুফল ভোগ করছে। মহান আল্লাহপাক তাদের সফলতা দান করেছেন এবং আমার সন্তানরাই আমাকে এখানে আসার খরচ দিয়েছে যেন আমি আমার প্রিয় খলীফার সাথে দেখা করতে পারি। ”

“আমি পূর্বে প্রেসিডেন্টে ও অন্যান্য নেতাদের সাথেও দেখা করেছি। কিন্তু হুজুরের সাথে দেখা করার অভিজ্ঞতা পুরোপুরি আলাদা। হুজুরের মধ্য থেকে যে নূর বের হয় সেটি অত্যন্ত পবিত্র। ”

“সাক্ষাতের পর আমরা হুজুরের অফিস থেকে বের হই। এরপর একজন আমাদের কাছে এসে আমাদেরকে একটি করে খাম দেন। আমাদের বলা হয় যে হুজুর আমাদের জন্য উপহার দিয়েছেন। আমরা হুজুরের কাছ থেকে উপহার পেয়ে আভিভূত হয়ে যাই। আমাদেরই উচিৎ হুজুরকে উপহার দেয়া কিন্তু হুজুর আমাদের এত ভালবাসেন যে তিনিই আমাদের উপহার দিচ্ছেন। হুজুরের কাছ থেকে আমরা যে দয়া ও ভালবাসা পেয়েছি তার জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা আমাদের নেই। ”
আজীবন সেবা করে যাওয়া

আমি সাদিক আহমদ মুনাওয়ার (৭৩ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি ১৯৬৯ সালে জামেআ আহমদীয়া রাবওয়া থেকে পাশ করে মরিশাসে ১৩ বছর মোবাল্লেগ হিসেবে কাজ করেন। এরপর তাকে কঙ্গোতে পাঠানো হয় যেখানে তিনি ১৯৮৪ সালে প্রথম জামাত প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি মাদাগাস্কারে জামাতের প্রচারের জন্য যান এবং এরপর কিছুদিন পাকিস্তানে কাজ করেন। তিনি ২০১২ সাল থেকে জামাতের মোবাল্লেগ ইনচার্জ হিসেবে ফ্রেঞ্চ গায়ানাতে কর্মরত আছেন।

তিনি তার ওয়াকফে জিন্দেগীর জীবন সম্বন্ধে বলেন “আমি পাকিস্তানের খুবই সাধারণ পরিবারের একজন সন্তান। আমার বাবা শিক্ষিত ছিলেন না। কিন্তু আমি অনেক ভাগ্যবান কারণ তিনি আমাকে খলীফাতুল মসীহ সানী(রঃ) এর কাছে পেশ করে ওয়াকফে জিন্দেগী হিসেবে আমাকে গ্রহণ করার অনুরোধ করেন। এর অর্থ হল আমি সবচেয়ে নিচু স্তর থেকে একেবারে সিংহাসনে উঠে গেলাম; কারণ আমি সারাজীবন খিলাফতের সেবা করতে পেরেছি।  ”

“আমি ১৫-১৬ বছর বয়সে জামেআতে ভর্তি হই। তখন আমি সঠিকভাবে কোরআন তেলাওয়াতও করতে পারতাম না। কিন্তু ৯-১০ বছর পর আমি সফলভাবে জামেআ থেকে পাশ করি। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে আমাকে প্রথম পোস্টিং দেয়া হয় এবং আমার বাবা গর্বের সাথে আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসেন। আমার শিক্ষক হযরত মির্যা দাউদ সাহিব(রঃ) আমার বাবাকে বলেন ‘তোমার সারা জীবনের কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার আজ তুমি পেয়ে গিয়েছ।’ আমি তার কথা কখনোই ভুলতে পারব না।  ”

আমি তার কাছে নতুন স্হানে নতুন জামাত প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতা জানতে চাই। তিনি বলেন “যখন আপনাকে এক স্হান ছেড়ে অন্য দেশে যেতে বলা হয়, সেটি অনেক বড় একটি দায়িত্ব। কিন্তু আপনাকে নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে হবে, সেখানকার ভাষা এবং দেশের নিয়ম কানুন জানতে হবে। কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপেই খলীফাতুল মসীহর দোয়া আমাদেরকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবে। আমি দেখেছি কিভাবে হুজুরের দোয়া আমাকে সবসময় সাহায্য করেছে।  ”

“সময়ের সাথে সাথে আমি খিলাফতের গুরুত্ব ও মর্যাদা আরো গভীরভাবে বুঝতে পারি। আমি দেখেছি খলীফা সকল আহমদীর সাথেও আছেন। খিলাফতের দোয়ার কল্যাণে আমি অনেক অলৌকিক ঘটনা দেখেছি। এর ফলে আমার ও আমার সাথীদের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন কঙ্গোর একজন আফ্রিকান পুরুষ আহমদীয়াত গ্রহণ করে। সে তার বউকে তালাক দেয়ার কথা চিন্তা করছিল; কারণ ৪ বছর বিবাহ হলেও তাদের এখনো সন্তান হয়নি। আমি তাকে তালাক দিতে না করি এবং বলি যে এখন সে আহমদী; তাই খলীফাতুল মসীহর দোয়া তার সাথে আছে এবং সে ইনশাল্লাহ সন্তানের বাবা হতে পারবে। আমি তাকে বলি যে তার খৃষ্টান বউকে বলতে যদি তাদের সন্তান হয় সে যেন ইসলাম গ্রহণ করে। ”

“আমি খলীফাতুল মসীহর কাছে চিঠি লিখি এবং তাকে বলি যে আমি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে সেই আফ্রিকানকে বলেছি যে খলীফার দোয়ার কল্যাণে তার সন্তান হবে। আলহামদুলিল্লাহ হুজুর তার জন্য দোয়া করেন এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন এবং আল্লাহপাক তাদের একটি ছেলে সন্তান দান করেন। পরবর্তীতে তাদের আরো দুইটি ছেলে ও একজন মেয়ে হয়। তার বউ আহমদীয়াত গ্রহণ করে এবং সেই ব্যক্তি এখন জামাতের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন।  ”

মোবাল্লেগদের আত্মত্যাগ সম্বন্ধে তিনি বলেন “কঙ্গোতে জীবনযাপন অত্যন্ত কঠিন। এটি বলাও অতিরঞ্জন হবে না যে মাঝে  মাঝে আমার জীবন সংশয়ও হয়েছিল। আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখন আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। তাই তিনি সেখানে যেতে পারেন নি। তাই আমি যখন প্রথম আমার সন্তানকে দেখি তখন তার বয়স সাড়ে তিন বছর। তখন যোগাযোগ ব্যবস্হা এখনকার মতো উন্নত ছিল না। তাই আমি যখন তাকে এয়ারপোর্টে প্রথমবারের মতো দেখি সে আমার কাছে আসতেই চাচ্ছিল না। কারণ তার কাছে আমি একজন অপরিচিত ব্যক্তি। ”

“আমি ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু হুজুর আমার আবেদন গ্রহণ করেন নি। হুজুর বলেন মোবাল্লেগদের জন্য অবসর গ্রহণের চেয়ে কাজ করে যাওয়াই উত্তম। হুজুরের কথা শুনে আমি আর অবসরের কথা চিন্তা করিনি এবং মোবাল্লেগ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। ”

“আমি আমার জীবনের বেশির ভাগ অংশই ওয়াকফে জিন্দেগী হিসেবে কাটিয়েছি। একটি জিনিস যদি আমি শিখে থাকি তা হল খলীফাতুল মসীহ হলেন আমাদের জামাতের ছাদ। যতদিন আমরা এই ছাদের নিচে থাকব আমাদের সকল সমস্যা ও দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যাবে। ”

 

বিনয়ের আদর্শ

আমি জার্মানী জলসায় আগত আর একজন অতিথি আনোয়ার আহমেদ (৬১ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি একজন মোবাল্লেগ যিনি বর্তমানে রাবওয়াতে কাজ করছেন।

হুজুরের সাথে দেখা করার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমরা যেসকল পুরস্কার অতীতে পেয়েছি তার তুলনায় হুজুরের সাথে দেখা করার লক্ষ গুণ উত্তম। ”

খিলাফতের পূর্বে হুজুর সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমার মনে আছে একবার পাকিস্তানে জাতীয় শূরার সময় আমার দায়িত্ব ছিল অতিথিদের আপ্যায়ন করা। জামাতের কর্মকর্তাগণ সকলেই গাড়ীতে করে আসছিলেন তাই আমি আশা করছিলাম যে হুজুরও হয়ত গাড়ী করেই আসবেন। কারণ তিনি তখন নাযির এ আলা ছিলেন। কিন্তু আমি দেখলাম যে হুজুর হেটে হেটে সেখানে আসলেন। হুজুরকে এভাবে বিনয়ের সাথে আসতে দেখে আমার মনে হল যে তিনি হলেন আধ্যাত্মিক জগতের রাজা। আমি বাড়ীতে যেয়ে পরিবারের সবাইকে এই ঘটনা বলি। এটি আমার মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। ”

“খিলাফতের পূর্বেও আমি লক্ষ্য করেছি যে হুজুর কখনো কঠোরতা বা বকাঝকা করতেন না। তিনি ভালবাসা ও নম্রতা দিয়ে আমাদের সঠিক পথে দিক নির্দেশনা দিতেন। যদি কারো প্রকৃতই সাহায্যের প্রয়োজন হতো তখন তিনি তাদের সবাইকে সাধ্যমত সাহায্য করতেন। এদিক দিয়ে হুজুর তার বাবা হযরত মির্যা মানসূর আহমেদ সাহেবের মতোই হয়েছেন। ”

“আমি যখন প্রথম রাবওয়াতে কাজে যাই তখন হুজুরের বাবা নাযের এ আলা ছিলেন। আমি তার কাছে একটি কোয়ার্টারের জন্য লিখিত আবেদন নিয়ে যাই। তিনি বলেন যে বাসার সংখ্যার চেয়ে আবেদনকারীর সংখ্যা অনেক বেশী। কিন্তু এটি বলার সাথে সাথেই তিনি আমার আবেদনপত্রে সম্মতি স্বাক্ষর দিয়ে দেন। ”

“একই ধরণের সাহায্যের মনোভাব আমি হুজুরের মধ্যেও দেখতে পাই। হুজুর সবসময় ভালবাসা ও দয়ালু ব্যবহার করেন; কিন্তু একইসাথে জামাতের সীমাবদ্ধতার কথাও আমাদের বুঝিয়ে দেন। তাই আমি বলতে পারি যে খিলাফতের পূর্বেও হুজুর একজন আদর্শ নেতা ও পথপ্রদর্শক ছিলেন। ”

আহমদীদের আবেগ

আমি মোবারক আহমদ (৪২ বছর) সাহেব, তার স্ত্রী ও মেয়ের সাথে কথা বলি। তারা পাকিস্তানের অধিবাসী। মোবারক সাহেব বলেন তিনি পাকিস্তানে অত্যাচারের স্বীকার হয়েছিলেন। তিনি বলেন “একবার পাকিস্তানে আমাকে আগুনে জ্বালিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তারা ব্যর্থ হয়। আর একবার তারা আমার অফিসে হামলা করে এবং আমাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে আঘাত করে। ”

“বিরোধীরা ভাবতে পারে যে এভাবে আমাদের উপর অত্যাচার করার ফলে আমরা জামাতকে ছেড়ে দিব। কিন্তু প্রত্যেকবার আক্রমনের পর আমাদের ঈমান আরো দৃঢ় হয়। বর্তমানে আমি ও আমার পরিবার নিরাপদে জার্মানীতে রয়েছি এবং সফলভাবে ব্যবসা করছি। এসব কিছুই জামাতের সাথে থাকার বরকত। আজকে আল্লাহপাক আমাদের সবচেয়ে বড় পুরস্কার দিয়েছেন। আমরা আজ আমাদের প্রিয় হুজুরের সাথে কিছু সময় কাটানোর সৌভাগ্য লাভ করেছি। ”

মোবারক সাহেবের মেয়ে আলিশবা (১৩ বছর) বলেন “আমি যখন হুজুরের অফিসে ছিলাম আমার মনে হল যে আমি এমটিএ তে আছি। কারণ সাধারণত আমি হুজুরকে এমটিএ তেই দেখে থাকি। আমি অনেক ভাগ্যবান কারণ আমি হুজুরের সাথে দেখা করতে পেরেছি। ”

আমি মীর লাইক মাহমুদ তাহির (৫১ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি পাকিস্তানের অধিবাসী হলেও গত ৩০ বছর ধরে জার্মানীতে আছেন। তিনি বলেন “আমি ২০০৩ সালে প্রথমবার হুজুরের সাথে দেখা করি। তখন আমি হুজুরের সামনে কোন কথাই বলতে পারিনি। আজও আমি যখন হুজুরের সাথে দেখা করতে যাই তখনও কোন কথা বলতে পারিনি। কারণ আমি যখন হুজুরকে দেখি তখন আমার নিজের দুর্বলতা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। যদিও আমি কোন কথা বলতে পারিনি কিন্তু আমি নিশ্চিত যে হুজুরের দোয়ার বরকত সারা জীবন আমার সাথে থাকবে।  ”

“আমি গত ৩০ বছর ধরে জার্মানীতে আছি। গত ১২ বছর ধরে জামাত অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আমাদের জামাত সম্বন্ধে সারা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন হয়েছে। সংবাদ মাধ্যম ও হুজুরের বিভিন্ন সফরের ফলে মানুষ আহমদীয়া মুসলিম জামাত সম্বন্ধে জানতে পেরেছে। এখানে জার্মানীতে আমাদের জামাত সম্বন্ধে মানুষ ইতিবাচক চিন্তা করে। আমি মনে করে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম প্রচারে আমরা একটি নতুন যুগের আগমন দেখতে পাচ্ছি। আমরা সকলেই এটি অনুভব করছি। যেকোন ধর্মের মানুষ যখন আমাদের খলীফার বক্তব্য শুনে তখন তারা বিমোহিত হয়ে যায়।  ”

একজন আবেগপ্রবণ খোদ্দাম

আমি পাকিস্তানের শিয়ালকোটের একজন খোদ্দাম মোহাম্মদ ইদরিস(২৯ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তার সাথে কথা বলার সময় তার চোখ দিয়ে সবসময় পানি ঝড়ছিল। আমরা প্রায় ১০ মিনিট কথা বলি এবং এর মাঝে আমি পাঁচ বার তাকে বলি যে আমাদের এখন থামা উচিৎ। কারণ আমি তাকে আর কষ্ট দিতে চাচ্ছিলাম না।

তিনি একজন বাচ্চা ছেলের মতো কাদঁতে কাদঁতে বলেন “আমি কখনো কল্পনা করিনি যে আমার মতো একজন পাপী বান্দা পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র মানুষের সাথে দেখা করতে পারে। আমি গত বছর জার্মানীতে এসেছিলাম এবং হুজুরের সাথে দেখা করার আবেদন করেছিলাম। কিন্তু আমার আবেদন গৃহীত হয়নি। এরপর আমি স্বপ্ন দেখি যেখানে হুজুর আমাকে বলেন যে আমাকে আরো পবিত্র হতে হবে। আমি বুঝতে পারি যে আমি হুজুরের সাথে দেখা করার জন্য এখনো তৈরী হয়নি। পরবর্তী দুই মাস প্রতি দিন-রাত আমি আল্লাহর কাছে মাথা নত করে ক্ষমা প্রার্থনা করি।  ”

“আজকে হুজুরের সাথে দেখা করার সময় আমি হুজুরকে আমার স্বপ্নের কথা বলি। হুজুর আমার গায়ে হাত দিয়ে বলেন আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন ও বরকত দিন।”

“আবিদ সাহেব আমি আপনার সামনে আমার আবেগকে নিয়ন্ত্রন করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমি তাদের মধ্যে একজন যাদেরকে আল্লাহপাক যুগখলীফার সাথে দেখা করার সৌভাগ্য দান করেছেন। আল্লাহপাকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। এ সময় পৃথিবীতে খলীফাতুল মসীহ ব্যতীত আর কেউ গুরুত্বপূর্ণ নয়।  ”

“আমার মা কাদিয়ানের একজন দরবেশের মেয়ে। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন যে আমি যেন নিয়মিত হুজুরকে চিঠি লিখি। তাই আমি ছোটবেলা থেকেই সপ্তাহে কমপক্ষে একটি করে হুজুরকে চিঠি দেই। হুজুর আমার জন্য যে দোয়া করতেন সেগুলোই আমাকে রক্ষা করেছে।   ”

তার অশ্রু কোন কষ্টের অশ্রু ছিলনা। সেগুলো ছিল হুজুরের সাথে দেখা করতে পারা আনন্দের অশ্রু। খিলাফতে আহমদীয়ার প্রতি তার যে অগাধ ভালবাসা সেটিই তার অশ্রুতে প্রকাশ পাচ্ছিল। এটিই খিলাফতের সত্যতার প্রমাণ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে আল্লাহপাক যাকে পাঠিয়েছেন একমাত্র তিনিই মানুষের হৃদয়ে এরকম আবেগ সৃষ্টি করতে পারেন।

বরকতময় দিনসমূহ

আজ ২৪ আগস্ট ২০১৭, জলসা সালানার আগের দিন। সকালে আমি আমার লাগেজ গুছিয়ে নেই। কারণ সেদিন আমরা কার্লশুরের পথে রওনা হব যেখানে জলসা অনুষ্ঠিত হবে। আল্লাহর অশেষ রহমতে হুজুরের সফরের প্রথম অংশ শেষ হয়েছে। এ সপ্তাহে হুজুর মসজিদ উদ্বোধন করেছেন, সাংবাদিক ও আহমদীদের সাথে দেখা করেছেন। এটি একটি বরকতময় সপ্তাহ ছিল। আমার বিশ্বাস আগামী দিনগুলোও এরকম বরকতপূর্ণ হবে। আগামী কয়েকদিনে হুজুর জার্মানীর জলসায় বক্তব্য প্রদান করবেন ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন।