জুমুআর খুতবার সারমর্ম

শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত আবু বকর (রা.)’র স্মৃতিচারণ জুমুআর খুতবা ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

بسم اللہ الرحمن الرحیم

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ মোতাবেক ০৪ তবলীগ, ১৪০১ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা

তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
বর্তমানে আবু বকর (রা.)’র স্মৃতিচারণ করা হচ্ছে। কতিপয় যুদ্ধাভিযানের বিষয়েও উল্লেখ করা হয়েছিল। একটি যুদ্ধাভিযানের নাম ছিল ‘গাযওয়ায়ে বনু কুরায়যা’ (তথা বনু কুরায়যার অভিযান)। ওয়াকদী বনু কুরায়যার অভিযানে অংশগ্রহণকৃত সদস্যদের নাম উল্লেখ করেছেন। তদনুযায়ী বনু তায়েম গোত্র থেকে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এবং হযরত তালহা বিন উবায়দিল্লাহ্ (রা.) বনু কুরায়যার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন। হযরত আব্দুর রহমান বিন গানাম (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) যখন বনু কুরায়যার দিকে রওয়ানা হন তখন হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত উমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর সমীপে নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! মানুষ যদি আপনাকে জাগতিক চাকচিক্যময় পোশাকে দেখে তাহলে তাদের হৃদয়ে ইসলাম গ্রহণ করার আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পাবে। তাই আপনি ‘গুল্লা’ অর্থাৎ সেই সুন্দর পোশাকটি পরিধান করুন যেটি হযরত সা’দ বিন উবাদা (রা.) আপনাকে উপঢৌকনস্বরূপ উপস্থাপন করেছিলেন। মহানবী (সা.) সেটি পরিধান করেন যেন মুশরিকরা তাঁকে (সা.) সুন্দর পোশাকে দেখে। তিনি (সা.) বলেন, আমি অবশ্যই তা পরিধান করব এবং আল্লাহ্র শপথ, তোমরা উভয়ে যদি আমার জন্য কোন বিষয়ে একমত হও সেক্ষেত্রে আমি তোমাদের পরামর্শের পরিপন্থি কিছু করি না আর আমার প্রভু আমার জন্য তোমাদের উদাহরণ তেমনই বর্ণনা করেছেন যেরূপ ফিরিশতাদের মাঝে জিবরাইল এবং মিকাইলের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। আর ইবনে খাত্তাবের যতটুকু সম্পর্ক, তার উপমা ফিরিশতাদের মাঝে জিবরাইলের ন্যায়। আল্লাহ্ তা’লা প্রত্যেক উম্মতকে জিবরাইলের মাধ্যমে ধ্বংস করেছেন এবং তার উপমা নবীদের মাঝে নূহ্ (আ.)-এর ন্যায়, যখন তিনি বলেছিলেন, رب لا تذر علی الارض من الکافرین دیارا অর্থাৎ, হে আমার প্রভু! তুমি পৃথিবীতে কোন কাফিরের অস্তিত্ব রেখ না। আর ইবনে আবি কোহাফার অর্থাৎ হযরত আবু বকরের উপমা ফিরিশতাদের মাঝে মিকাইলের ন্যায়, যখন সে পৃথিবীতে বসবাসকারীদের জন্য ক্ষমা যাচনা করে এবং নবীদের মাঝে তার উপমা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ন্যায়, যখন তিনি বলেছিলেন,
فَمَن تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي ۖ وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (সূরা ইব্রাহীম: ৩৭)
অর্থাৎ যে আমার আনুগত্য করল সে সুনিশ্চিতভাবে আমার দলভুক্ত আর যে আমার অবাধ্যতা করল, সেক্ষেত্রে (হে আল্লাহ্!) তুমি অতীব ক্ষমাশীল এবং বার বার দয়াকারী। তিনি (সা.) বলেন, তোমরা উভয়ে আমার জন্য কোন একটি বিষয়ে একমত হলে আমি উক্ত পরামর্শের বিপরীত কিছু করব না, কিন্তু পরামর্শের ক্ষেত্রে তোমাদের অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন যেমনটি কিনা জিবরাইল, মিকাইল এবং নূহ ও ইবরাহীমের উদাহরণ।
মহানবী (সা.)-এর বনু কুরায়যা অবরোধ বিষয়ক একটি রেওয়ায়েত রয়েছে। আয়েশা বিনতে সা’দ নিজ পিতার বরাতে বর্ণনা করেন, তিনি (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে সা’দ, সম্মুখে অগ্রসর হও এবং তাদের ওপর তির নিক্ষেপ কর। আমি এতটা অগ্রসর হই যেন তারা আমার তিরের নাগালে এসে যায়। আমার কাছে পঞ্চাশের অধিক তির ছিল যা আমি কয়েক মুহূর্তের ভিতর নিক্ষেপ করি, আমাদের তির যেন পঙ্গপালের ন্যায় ছিল। ফলে তারা দুর্গের অভ্যন্তরে ঢুকে যায় এবং তাদের কেউ আর বাইরে উঁকি দিয়ে দেখছিল না। আমার তির ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হয়। তাই আমি কিছু তির নিক্ষেপ করি, কিছু সংরক্ষিত রাখি। হযরত কা’ব বিন আমর ম’যানী একজন দক্ষ তিরন্দাজ ছিলেন। তিনি বলেন,
সেদিন আমি আমার তূণে যতগুলো তির ছিল তা সবই নিক্ষেপ করছিলাম, এভাবে যখন রাতের কিছু অংশ পেরিয়ে যায় তখন আমরা তাদের ওপর তির নিক্ষেপ বন্ধ করি। তিনি বলেন, আমাদের তিরন্দাজি করা হয়ে গিয়েছিল; মহানবী (সা.) ঘোড়ায় আরোহিত ছিলেন এবং অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ছিলেন এবং তাঁর (সা.) চারপাশে অশ^ারোহীরা ছিল। এরপর তাঁর (সা.) নির্দেশে আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানস্থলে ফিরে আসি এবং সেখানে রাত্রিযাপন করি। আমাদের খাবার হিসেবে ছিল হযরত সা’দ বিন উবাদা প্রেরিত খেজুর, আর সেই খেজুর যথেষ্ট পরিমাণ ছিল। আমরা সেই খেজুর খেয়ে রাত অতিবাহিত করি। মহানবী (সা.), হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমর (রা.)-কেও খেজুর খেতে দেখা যায়। মহানবী (সা.) তখন বলছিলেন, খেজুর কতই না উত্তম খাবার!
হযরত সা’দ বিন মু’আয (রা.) যখন বনু কুরায়যার বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন, তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) তার প্রশংসা করেন এবং বলেন, তুমি আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত প্রদান করেছ। তখন হযরত সা’দ দোয়া করেন যে, হে আল্লাহ্! তুমি যদি কুরাইশদের সাথে মহানবী (সা.)-এর আরও কোন যুদ্ধ নির্ধারিত রেখে থাক, তবে তুমি সেটির জন্য আমাকে জীবিত রাখ। আর যদি তুমি মহানবী (সা.) ও কুরাইশদের মাঝে যুদ্ধের সমাপ্তি করে দিয়ে থাক, তবে আমাকে মৃত্যু দান কর। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বর্ণনা করেন, তার ক্ষত খুলে যায় অথচ তিনি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন এবং সেই ক্ষতের সামান্য চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট ছিল। তিনি (রা.) নিজ তাঁবুতে ফিরে আসেন যা রসূলুল্লাহ্ (সা.) তার জন্য টানানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। হযরত আয়েশা বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.), হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমর (রা.) তার কাছে যান। হযরত আয়েশা বলেন, সেই সত্তার নামে শপথ করে বলছি যার হাতে মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণ, আমি হযরত উমর (রা.)-এর কান্নার শব্দ হযরত আবু বকর (রা.)-এর কান্নার শব্দ থেকে আলাদাভাবে চিনতে পারছিলাম আর তখন আমি আমার নিজের কক্ষে ছিলাম। [অর্থাৎ হযরত সা’দ (রা.) যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন, তখন তারা দু’জন কাঁদছিলেন।] আমি আমার কক্ষে ছিলাম, আর তাদের বাস্তব অবস্থা তেমনই ছিল, যেমনটি আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন অর্থাৎ, رُحَمَآءُ بَيۡنَہُمۡ‌ বা তারা পরস্পরের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও আন্তরিকতা রাখে।
হুদায়বিয়ার সন্ধি সম্পর্কে লিখিত আছে, যেমনটি পূর্বের খুতবাসমূহেও উল্লেখ করা হয়েছে, মহানবী (সা.) একটি স্বপ্ন দেখেন যে, তিনি (সা.) সাহাবীদেরকে সাথে নিয়ে বায়তুল্লাহ্ প্রদক্ষিণ করছেন। এই স্বপ্নের ভিত্তিতে মহানবী (সা.) চৌদ্দশ’ সাহাবীর একটি দলসহ ৬ষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসের প্রথমদিকে এক সোমবার সকালে উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে যাত্রা করেন। মহানবী (সা.) যখন জানতে পারেন যে, মক্কার কাফিররা তাঁকে (সা.) মক্কায় প্রবেশে বাধা দিতে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে, তখন তিনি (সা.) সাহাবীদের কাছে পরামর্শ চান। হযরত আবু বকর পরামর্শ দিতে গিয়ে নিবেদন করেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমরা তো কেবল উমরা পালনের জন্য এসেছি, আমরা কারো সাথে যুদ্ধ করতে আসি নি। আমার অভিমত হলো, আমরা আমাদের গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকি; যদি কেউ আমাদেরকে বায়তুল্লাহ্ শরীফে যেতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, তবে আমরা তার সাথে যুদ্ধ করব।’
হুদায়বিয়া সন্ধির সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে যখন দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য প্রতিনিধি দল আসতে আরম্ভ করে, তখন উরওয়া আসে এবং মহানবী (সা.)-এর সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করে। উরওয়া বলে, ‘মুহাম্মদ! [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম]। বল দেখি, যদি তুমি নিজ জাতিকে একদম নিশ্চিহ্ন করে দাও, তাহলে (বল,) তুমি আরবদের মধ্যে কারো ব্যাপারে শুনেছ কি যে তোমার পূর্বে আপনজনদেরকেই ধ্বংস করেছে? আর ব্যাপার যদি ভিন্ন হয়, অর্থাৎ কুরাইশরা যদি বিজয় লাভ করে তবে আল্লাহ্’র কসম! তোমার সঙ্গীসাথি যারা এদিক-সেদিক হতে একত্রিত হয়েছে, আমি তাদের চেহারা দেখছি; তারা পলায়ন করবে এবং তোমাকে পরিত্যাগ করবে। একথা শোনার পর হযরত আবু বকর (রা.) উরওয়া বিন মাসঊদ-কে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় বলেন, যাও, যাও, গিয়ে তামাদের প্রতিমা লাত-কে চুমু দিতে থাক [অর্থাৎ তার পূজা কর]। একথা শুনে উরওয়া জিজ্ঞেস করে, এই ব্যক্তি কে? লোকজন বলে, আবু বকর। উরওয়া বলে, দেখ, সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ। যদি আমার প্রতি তোমার একটি অনুগ্রহ না থাকতো, যার প্রতিদান আমি এখনও তোমাকে দেই নি, তবে আমি তোমাকে এর জবাব দিতাম। হযরত আবু বকর (রা.)-এর অনুগ্রহ যা ছিল তাহলো, একটি বিষয়ে উরওয়া’র ওপর যখন রক্তপণ ধার্য হয় তখন হযরত আবু বকর (রা.) দশটি গর্ভবতী উটনী দিয়ে তাকে সাহায্য করেছিলেন। যাহোক একথা বলে উরওয়া মহানবী (সা.)-এর সাথে কথা বলা আরম্ভ করে।
হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় মহানবী (সা.)-এর সাথে কুরাইশদের চুক্তি হচ্ছিল। হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) বলতেন, আমি মহানবী (সা.)-এর নিকট যাই এবং বলি, আপনি কি সত্যি সত্যি আল্লাহ্’র নবী নন? তিনি (সা.) বলেন, কেন নয়? আমি বলি, আমরা কি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নই এবং আমাদের শত্রুরা মিথ্যার ওপর [প্রতিষ্ঠিত নয়]? তিনি (সা.) বলেন, কেন নয়? আমি নিবেদন করি, তাহলে আমরা আমাদের ধর্মের জন্য অসম্মানজনক শর্ত কেন মানব? তিনি (সা.) বলেন, আমি আল্লাহ্’র রসূল এবং আমি তাঁর অবাধ্যতা করব না। তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। [অর্থাৎ আমি যদি শর্ত মেনে নিয়ে থাকি তবে এটি আল্লাহ্ তা’লার নির্দেশের অবাধ্যতা নয়।] তিনি (সা.) বলেন, তিনি [তথা আল্লাহ্) আমায় সাহায্য করবেন। আমি বলি অর্থাৎ হযরত উমর বলেন, আপনি কি আমাদেরকে বলতেন না যে, আমরা অতি শীঘ্রই বায়তুল্লাহ্ তথা আল্লাহ্’র ঘরে যাব এবং তার তাওয়াফ করব। তিনি (সা.) বলেন, নিঃসন্দেহে আমি বলেছিলাম। আর আমি কি তোমায় এটি বলেছিলাম যে, আমরা এ বছরই বায়তুল্লাহ্ পৌঁছে যাব? হযরত উমর (রা.) বলতেন, আমি বলি, না। মহানবী (সা.) বলেন, আমি তো একথা বলি নি যে, আমরা এ বছরই বায়তুল্লাহ্ যাব। মহানবী (সা.) বলেন, তাহলে বায়তুল্লাহ্ অবশ্যই পৌঁছবে এবং তাওয়াফও করবে। হযরত উমর (রা.) বলতেন, একথা শুনে আমি হযরত আবু বকর (রা.)-এর নিকট আসি এবং আমি জিজ্ঞেস করি, হে আবু বকর (রা.)! মহানবী (সা.) কি সত্যিকার অর্থে আল্লাহ্’র নবী নন? তিনি (রা.) বলেন, কেন নয়! আমি জিজ্ঞেস করি, আমরা কি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নই এবং আমাদের শত্রুরা মিথ্যার ওপর? তিনি (রা.) বলেন, কেন নয়! আমি বলি, (তাহলে) আমরা আমাদের ধর্মের জন্য অবমাননাকর শর্ত কেন মানব? তখন হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, হে খোদার বান্দা! নিঃসন্দেহে মহানবী (সা.) আল্লাহ্’র রসূল এবং রসূল কখনো নিজ প্রভুর অবাধ্যতা করে না আর আল্লাহ্ অবশ্যই তাঁকে সাহায্য করবেন। প্রায় সেই শব্দই হযরত আবু বকর (রা.) পুনরাবৃত্তি করেছেন যা মহানবী (সা.) বলেছিলেন। এরপর হযরত আবু বকর (রা.) হযরত উমর (রা.)-কে বলেন, মহানবী (সা.) কর্তৃক কৃত সন্ধি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাক। আল্লাহ্’র শপথ, তিনি (সা.) অবশ্যই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। হযরত উমর (রা.) বলেন, আমি বলি, তিনি (সা.) কি আমাদেরকে বলতেন না যে, আমরা অবশ্যই বায়তুল্লাহ্ যাব এবং তাওয়াফ করব? হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, নিঃসেন্দহে। (তিনি আরো বলেন,) মহানবী (সা.) কি এটি বলেছিলেন যে, তুমি এবছরই সেখানে যাবে? হযরত উমর (রা.) বলেন, তখন আমি বলি, না (এমনটি বলেন নি)। তখন হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, তাহলে নিশ্চয় তুমি সেখানে যাবে এবং অবশ্যই তা তাওয়াফ করবে। যুহরী বলেন অর্থাৎ এই ঘটনা বর্ণনাকারী বলেন, হযরত উমর (রা.) বলতেন, আমি এই ভুলের কারণে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ বেশ কয়েকটি পুণ্যকর্ম করেছি। এটি বুখারী শরীফ থেকে নেয়া হয়েছে। এই হুদায়বিয়ার সন্ধির বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) লিখেন, উরওয়া মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে তাঁর সাথে আলোচনা আরম্ভ করে। মহানবী (সা.) তার সামনেও সেই একই বক্তব্য উপস্থাপন করেন যা ইতিপূর্বে তিনি বুদায়েল বিন ওয়ারাকার সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। উরওয়া নীতিগতভাবে মহানবী (সা.)-এর সাথে সহমত ছিল। কিন্তু কুরাইশদের দূতের দায়িত্ব পালন এবং তাদের পক্ষে বেশি বেশি শর্ত মানানোর উদ্দেশ্যে বলে উঠে, হে মুহাম্মদ (সা.)! আপনি যদি এই যুদ্ধে আপনার জাতিকে ধূলিসাৎ করেন তাহলে কি আপনি আরবদের মাঝে এমন কোন ব্যক্তির নাম শুনেছেন, যে আপনার পূর্বে এমন অত্যাচার করেছে? কিন্তু পরিস্থিতি যদি উল্টো হয়, অর্থাৎ কুরাইশরা যদি বিজয়ী হয় তাহলে খোদার কসম, আপনার আশেপাশে আমি এমন চেহারা দেখছি যারা পলায়ন করতে সময় নিবে না আর এসব লোক আপনার সঙ্গ পরিত্যাগ করবে। হযরত আবু বকর (রা.) তখন মহানবী (সা.)-এর পাশেই বসেছিলেন। উরওয়ার এমন কথা শুনে তিনি (রা.) রাগে ফেটে পড়েন এবং বলে উঠেন, যাও যাও, আর গিয়ে লাতকে চুম্বন করতে থাক। আমরা কি আল্লাহ্র রসূল (সা.)-কে পরিত্যাগ করব? ‘লাত’ প্রতিমাটি ছিল বনু সাকীফ গোত্রের একটি বিখ্যাত প্রতিমা। হযরত আবু বকর (রা.)-এর বলার উদ্দেশ্য ছিল, তোমরা হলে প্রতিমাপূজারি আর আমরা হলাম খোদাভক্ত। এমনটি হওয়াও কি সম্ভব যে, প্রতিমার জন্য তোমরা ধৈর্য ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করবে অথচ আমরা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনা সত্ত্বেও রসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে পরিত্যাগ করে পলায়ন করব? একথা শুনে, উরওয়া অগ্নিশর্মা হয়ে জিজ্ঞেস করে, কে এই ব্যক্তি যে এভাবে আমার কথার ওপর কথা বলছে? তখন লোকেরা বলে, ইনি আবু বকর। হযরত আবু বকর (রা.)-এর নাম শুনতেই উরওয়ার চোখ দুটি লজ্জাবনত হয়ে যায় আর সে বলে, হে আবু বকর! আমার প্রতি যদি তোমার বড় একটি অনুগ্রহ না থাকত [এখানেও সেকথার উল্লেখ করে, অর্থাৎ হযরত আবু বকর (রা.) একবার ঋণ পরিশোধ করে উরওয়ার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন।] তাহলে খোদার কসম! এখনই আমি তোমাকে বলতাম, এমন কথার উত্তর কীভাবে দিতে হয় যা তুমি বলেছ।
বুখারী শরীফের একটি রেওয়ায়েতে উল্লেখ রয়েছে যে, হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় মহানবী (সা.)-এর সাথে কুরাইশদের চুক্তি সম্পাদিত হচ্ছিল এবং শর্তগুলো নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় হযরত আবু জন্দল যে সোহেল বিন আমরের ছেলে ছিল শিকল জড়ানো অবস্থায় টলতে টলতে আসেন। সোহেল বিন আমর মক্কার প্রতিনিধি হয়ে এসেছিল। সে তাকে ফেরত পাঠানোর দাবি করে। ফলে মহানবী (সা.) তাকে কুরাইশদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন। এ ঘটনার কিছু বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) আর তাতে সেই ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে যেটি হযরত উমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর সাথে বাদানুবাদ করার সময় ঘটিয়েছিলেন। অর্থাৎ (তিনি বলেন,) আপনি যদি আল্লাহ্ তা’লার সত্যিকার নবী হয়ে থাকেন তাহলে আমরা ঝুঁকবো কেন? যাহোক এর বিবরণ হলো- অর্থাৎ আবু জন্দলকে কষ্ট দেয়া হচ্ছিল দেখে হযরত উমর (রা.) এসব কথা বলেন।
মুসলমানরা আবু জন্দলকে কষ্ট দেয়ার এসব ঘটনা দেখছিলেন এবং ধর্মীয় আত্মাভিমানের কারণে তাদের চোখ রক্তিম হয়ে যায় কিন্তু মহানবী (সা.)-এর সামনে তারা ভয়ে চুপ ছিলেন। অবশেষে হযরত উমর (রা.) আর সহ্য করতে পারেন নি। তিনি মহানবী (সা.)-এর নিকট আসেন এবং কম্পমান কণ্ঠে বলেন, আপনি কি খোদার সত্য রসূল নন? উত্তরে মহানবী (সা.) বলেন, হ্যাঁ! অবশ্যই। তখন উমর (রা.) বলেন, আমরা কি সত্যের ওপর নই আর আমাদের শত্রুরা কি মিথ্যার পূজারী নয়? জবাবে মহানবী (সা.) বলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ! অবশ্যই এমন। তখন হযরত উমর (রা.) বলেন, তাহলে কেন আমরা আমাদের সত্য ধর্মের বিষয়ে এই লাঞ্ছনা সহ্য করব? হযরত উমর (রা.)’র অবস্থা দেখে মহানবী (সা.) সংক্ষিপ্ত ভাষায় বলেন, দেখ উমর! আমি আল্লাহ্র রসূল এবং আমি আল্লাহ্র অভিপ্রায় সম্পর্কে অবগত, তাই আমি এর বিরুদ্ধে যেতে পারি না আর তিনিই আমার সাহায্যকারী। কিন্তু হযরত উমর (রা.)’র প্রকৃতিগত উত্তেজনা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি বলতে থাকেন, আপনি কি আমাদেরকে এটি বলেন নি যে, আমরা বায়তুল্লাহ্ প্রদক্ষিণ করব? তিনি (সা.) বলেন, হ্যা! আমি অবশ্যই বলেছিলাম, কিন্তু আমি কি কখনো একথা বলেছিলাম যে, এই তওয়াফ এ বছরই হবে? উমর (রা.) বলেন, না, এমনটি তো বলেন নি। তিনি (সা.) বলেন, তাহলে অপেক্ষা কর। ইনশাআল্লাহ্ তোমরা অবশ্যই মক্কায় প্রবেশ করবে এবং কাবা শরীফের তওয়াফ করবে। কিন্তু এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে হযরত উমর (রা.) আশ্বস্ত নি। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর যেহেতু বিশেষ প্রভাব ছিল তাই হযরত উমর (রা.) সেখান থেকে সরে গিয়ে হযরত আবু বকর (রা.)’র কাছে আসেন এবং তাঁর সাথেও এ ধরণের উত্তেজনাপূর্ণ কথা বলেন। হযরত আবু বকর (রা.)ও একই ধরণের জবাব দেন, আর পাশাপাশি উপদেশ স্বরূপ বলেন, দেখ উমর! নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কর। রসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর হাতে যে হাত রেখেছ সে বাঁধন দুর্বল হতে দিও না। কেননা খোদার কসম! যে ব্যক্তির হাতে আমরা হাত রেখেছি নিশ্চয়ই তিনি সত্য। হযরত উমর (রা.) বলেন, তখন তো আমি উত্তেজনার বশে এসব কথা বলেছি, কিন্তু পরবর্তীতে আমার গভীর অনুতাপ হয় এবং তওবাস্বরূপ আমি এই দুর্বলতার কলঙ্ক মোছার জন্য অনেক নফল ইবাদত করেছি। অর্থাৎ সদকা দিয়েছি, রোযা রেখেছি, নফল নামায পড়েছি এবং দাস মুক্ত করেছি যেন আমার এই গ্লানি দূর হয়ে যায়।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির ঘটনাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, মহানবী (সা.) যখন বায়তুল্লাহ্ প্রদক্ষিণের জন্য যান তখন মক্কার কাফিররা সংবাদ পেয়ে তাদের এক নেতাকে তাঁর কাছে পাঠায় একথা বলার জন্য যে, তিনি যেন এ বছর বায়তুল্লাহ্ তওয়াফের জন্য না আসেন। সেই নেতা তাঁর (সা.) কাছে পৌঁছে আর আলোচনা আরম্ভ করে। কথা বলার সময় সে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে, এ বছর আপনি কাবা শরীফ তওয়াফ না করে পরবর্তী কোন বছর পর্যন্ত স্থগিত করে দিন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, এশিয়ার লোকদের মধ্যে রীতি হলো, তারা যখন কাউকে কোন কথা মানাতে চায় তখন মিনতি স্বরূপ অন্যজনের দাড়িতে হাত স্পর্শ করে অথবা নিজের দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে, দেখ! আমি বয়স্ক মানুষ এবং জাতির নেতা, আমার কথা মেনে নাও। সুতরাং সেই নেতাও মিনতি স্বরূপ মহানবী (সা.)-এর পবিত্র শ্মশ্রু স্পর্শ করে। এই (দৃশ্য) দেখে এক সাহাবী সামনে এগিয়ে এসে নিজ তরবারির হাতল মেরে সেই নেতাকে বলেন, তোমার অপবিত্র হাত দূরে সরাও। তখন সেই নেতা তরবারির হাতল দ্বারা আঘাতকারী ব্যক্তিকে বলে, তুমি কি সেই ব্যক্তি যার প্রতি আমি অমুক সময় অনুগ্রহ করেছিলাম। একথা শুনে সেই সাহাবী নীরব হয়ে পেছনে সরে যান। সেই নেতা পুনরায় মিনতি স্বরূপ মহানবী (সা.)-এর দাড়িতে হাত লাগায়। সাহাবীরা বলেন, এই নেতার এভাবে হাত লাগানো দেখে আমাদের খুব রাগ হচ্ছিল, কিন্তু সেই সময় এমন কোন ব্যক্তি আমাদের চোখে পড়ছিল না যার প্রতি সেই নেতার কোন অনুগ্রহ নেই। তখন আমরা চাচ্ছিলাম যে, যদি আমাদের মধ্যে এমন কেউ থাকত যার প্রতি এই নেতার কোন অনুগ্রহ নেই। এমন সময় আমাদের মধ্যে থেকে এক ব্যক্তি সামনে অগ্রসর হন যিনি আপাদমস্তক শিরস্ত্রাণ ও বর্মাবৃত ছিলেন আর চরম উত্তেজিত কণ্ঠে সেই নেতাকে সম্বোধন করে বলেন, (দাড়ি থেকে) তোমার অপবিত্র হাত সরিয়ে নাও। তিনি ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.), যিনি একথা বলেছিলেন। সেই নেতা তাকে চিনতে পেরে বলে, হ্যা! আমি তোমাকে কিছুই বলতে পারব না, কেননা তোমার প্রতি আমার কোন অনুগ্রহ নেই।
সীরাত খাতামান্ নবীঈন থেকে নেয়া উদ্ধৃতিতে লেখা আছে যে, ৬ষ্ঠ হিজরী সনের যিলক্বদ মাসে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় যখন সন্ধিচুক্তি লেখা হয়েছিল তখন এই সন্ধিচুক্তির মোট দু’টি অনুলিপি প্রস্তুত করা হয় এবং সাক্ষী হিসেবে দুই পক্ষের বেশ কয়েকজন সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ তাতে স্বাক্ষর করেন। মুসলমানদের পক্ষে স্বাক্ষর প্রদানকারীরা হলেন, হযরত আবু বকর (রা.) হযরত উমর, হযরত উসমান, হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ, হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস এবং হযরত উবায়দাহ্ বিন র্জারাহর (রা.)। হযরত আবু বকর (রা.) বলতেন, ইসলামের ইতিহাসে হুদায়বিয়ার সন্ধির চেয়ে বড় আর কোন বিজয় নেই।
বনু ফাযারাভিমুখে হযরত আবু বকর (রা.)’র অভিযান: এ প্রসঙ্গে লেখা আছে যে, এই অভিযানটি ৬ষ্ঠ হিজরীতে সংঘটিত হয়। বনু ফাযারা গোত্র নজদ ও কুরা উপত্যকায় বসবাস করত। তাবাকুতুল কুবরা এবং সীরাতে ইবনে হিশামে লেখা আছে, এই অভিযানটি হযরত যায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে পাঠানো হয়েছিল কিন্তু সহীহ্ মুসলিম ও সুনান আবু দাউদের হাদীস হতে জানা যায় যে, মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)-কে উক্ত অভিযানের আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। যেমন সহীহ্ মুসলিমের রেওয়ায়েতে আছে যে, আয়াস বিন সারমা বর্ণনা করেন, আমার কাছে আমার পিতা বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমরা ফাযারা গোত্রের সাথে যুদ্ধ করেছি আর সে সময় আমাদের আমীর ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.)। মহানবী (সা.) তাঁকে আমাদের আমীর নিযুক্ত করেছিলেন।
হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.)ও এই যুদ্ধাভিযানের উল্লেখ করতে গিয়ে একথা উল্লেখ করেছেন যে,
মহানবী (সা.) তাঁর একদল সাহাবী হযরত আবু বকর (রা.)’র নেতৃত্বে বনু ফাযারা অভিমুখে প্রেরণ করেন। এই গোত্রটি সেসময় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এই সেনাদলে সালামা বিন আকওয়াও যোগদান করেন, যিনি প্রসিদ্ধ তীরন্দাজ ছিলেন এবং দৌড়ে বিশেষ দক্ষতা রাখতেন। সালামা বিন আকওয়া বর্ণনা করেন, আমরা প্রায় ফজরের নামাযের কাছাকাছি সময়ে সেই গোত্রের আবাসস্থলের নিকটে গিয়ে পৌঁছি এবং আমরা যখন নামায সম্পন্ন করি তখন হযরত আবু বকর (রা.) আমাদেরকে আক্রমণ করার নির্দেশনা প্রদান করেন। আমরা ফাযারা গোত্রের সাথে যুদ্ধ করতে করতে তাদের ঝর্না পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছি এবং এ যুদ্ধে মুশরিকদের অনেকেই নিহত হয় আর এরপর তারা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে যায় আর আমরা অনেককে বন্দিও বানিয়ে নিই। সালামা বর্ণনা করেন, পলায়নকারীদের মাঝে একটি দল ছিল নারী ও শিশুদের যারা দ্রুততার সাথে নিকটবর্তী একটি পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাদের ও পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গায় তীর নিক্ষেপ করতে আরম্ভ করি। ফলে, পলায়নকারী এই দল ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় আর আমরা তাদেরকে বন্দি বানিয়ে নিই। এদের মাঝে একজন বয়স্কা মহিলাও ছিল যে নিজের ওপর একটি লাল রঙের চামড়ার চাদর পরে রেখেছিল আর তার সাথে তার এক সুদর্শনা কন্যাও ছিল। আমি তাদের সবাইকে ঘিরে হযরত আবু বকর (রা.)’র কাছে নিয়ে আসি। তিনি (রা.) সেই কন্যাকে আমার তত্ত্বাবধানে দিয়ে দেন। আমরা যখন মদীনায় ফিরে আসি তখন মহানবী (সা.) আমার কাছ থেকে এই মেয়েটিকে নিয়ে নেন এবং তাকে মক্কায় পাঠিয়ে তার বিনিময়ে কতিপয় সেসব মুসলিম বন্দিকে ছাড়িয়ে আনেন যারা মক্কাবাসীদের কাছে বন্দি ছিল অর্থাৎ, মক্কাবাসীরা বন্দি করে রেখেছিল। তিনি (সা.) এই মেয়ের বিনিময়ে তাদেরকে ছাড়িয়ে নেন।
খায়বারের যুদ্ধ সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে যে, মহানবী (সা.) সপ্তম হিজরী সনের মহররম মাসে খায়বার অভিমুখে যাত্রা করেন। খায়বার পবিত্র মদীনা নগরী থেকে ১৮৪ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত একটি খেজুরবাগান সমৃদ্ধ অঞ্চল। এখানে অনেক আগ্নেয় শিলা রয়েছে। এখানে ইহুদীদের অনেকগুলো দুর্গও ছিল যেগুলোর মাঝে কতিপয়ের ধংসাবশেষ আজও অবশিষ্ট আছে। এসব দুর্গ মুসলমানরা খায়বারের যুদ্ধে জয় করেছিল। এ অঞ্চলটি খুবই ঊর্বর এবং ইহুদীদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল। মহানবী (সা.) মদীনায় নিজের অবর্তমানে সিবাহ্ বিন উরফাতা গিফারী (রা.)-কে আমীর নিযুক্ত করে যান। খায়বারের দুর্গগুলো দশ দিনের অধিক সময় ধরে অবরুদ্ধ থাকে। হযরত বুরায়দা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর মাইগ্রেনের ব্যাথা হতো, ফলে তিনি এক দুই দিন বাইরে বেরুতেন না। যাহোক, তিনি (সা.) যখন খায়বারে পৌঁছেন তখন তাঁর মাইগ্রেনের ব্যাথা আরম্ভ হয়। আর এরফলে তিনি (সা.) জনসমক্ষে আসেন নি। অর্থাৎ, তাঁর (তীব্র) মাথাব্যাথা হতো, যাকে মাইগ্রেন বলা হয়।
মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)-কে কাতীবা নামক দুর্গ অভিমুখে প্রেরণ করেন। তিনি (রা.) মহানবী (সা.)-এর পতাকা হাতে নেন এবং শত্রুদের মোকাবিলায় বুক চিতিয়ে দ-ায়মান হন এবং প্রচ- যুদ্ধ করেন। এরপর তিনি ফিরে আসেন, প্রাণপন চেষ্টা করা সত্ত্বেও জয় লাভ হয়নি। অতঃপর মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে প্রেরণ করেন। তিনিও তাঁর (সা.) পতাকা হাতে নেন এবং কঠিন যুদ্ধ করেন। এটি পূর্বাপেক্ষাও ভয়াবহ যুদ্ধ ছিল। এরপর তিনিও ফেরত আসেন কিন্তু বিজয় লাভ হয় নি। ইতিহাস ও সীরাতের অধিকাংশ পুস্তকে এটিই পাওয়া যায় যে, একে একে হযরত আবু বকর এবং হযরত উমর (রা.)-কে সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়েছিল কিন্তু তাঁদের হাতে দুর্গ বিজয় সম্ভব হয় নি। অবশ্য ‘সৈয়্যদনা সিদ্দীকে আকবর’ নামক একটি পুস্তক আছে যা লাহোর থেকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছিল; আমাদের গবেষকরা এতে দেখে আমাকে জানিয়েছেন যে, এ পুস্তকের লেখক লিখেছেন, হযরত আবু বকর (রা.)’র হাতে সেই দুর্গ বিজয় হয়েছিল কিন্তু তিনি সেখানে কোন রেফারেন্স দেন নি। যাহোক, লেখক লিখেন, একটি দুর্গ বিজয়ের জন্য হযরত আবু বকর (রা.) সেনাপতি হিসেবে গিয়েছিলেন যা তাঁর হাতে বিজয় হয়েছিল এবং অন্য একটি দুর্গের জন্য হযরত উমর (রা.)-কে পাঠানো হয় আর তিনিও সফল হন। তৃতীয় দুর্গ জয়ের দায়িত্ব হযরত মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.)’র ওপর ন্যস্ত হয় কিন্তু তিনি তাতে সফল হতে পারেন নি। এতে মহানবী (সা.) বলেন, সকালে আমি এমন একজনকে পতাকসহ সেনাপতি করে পাঠাবো যে খোদা ও তাঁর রসূল (সা.)-কে অনেক বেশি ভালোবাসে আর তাঁর হাতেই দুর্গ বিজয় হবে। অবশেষে হযরত আলী (রা.)-কে পতাকা দেয়া হয় এবং কামূস দুর্গ জয় হয়।
খায়বারের যুদ্ধ সম্পর্কে ওয়াকদী’র একটি রেওয়ায়েত রয়েছে, তা পড়ে দিচ্ছি কেননা লোকেরা তার ইতিহাসগ্রন্থও পড়ে থাকে কিন্তু এটি শতভাগ সঠিক হওয়া আবশ্যক নয়। যাহোক, তিনি লিখেন, খায়বারের যুদ্ধের সময় মহানবী (সা.)-এর এক সাহাবী হযরত হুব্বাব বিন মুনযির (রা.) তাঁর নিকট নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! ইহুদীরা খেজুর গাছকে নিজেদের যুবক সন্তানসন্ততির চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তাই আপনি তাদের খেজুর গাছ কেটে দিন। এরপর মহানবী (সা.) খেজুর গাছ কাটার নির্দেশ দেন এবং মুসলমানেরা দ্রুত খেজুর গাছ কাটতে আরম্ভ করে দেয়। একথাটি এভাবে শতভাগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না কিন্তু এর পরের অংশ আবার সঠিক বলে মনে হয়। তিনি বলেন, এটি দেখে হযরত আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-এর নিকট আসেন এবং নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! নিশ্চয়ই মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ্ আপনাকে খায়বার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং তিনি আপনাকে দেওয়া স্বীয় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন। আপনি খেজুর গাছ কাটবেন না। এরপর মহানবী (সা.)-এর ঘোষক তাঁর নির্দেশে ঘোষণা করে আর খেজুর গাছ কাটতে বারণ করে।
আল্লাহ্ তা’লা যখন মহানবী (সা.)-কে খায়বারে বিজয় দান করেন তখন তিনি (সা.) খায়বারের একটি বিশেষ উপত্যকা কাতীবা-কে নিজ আত্মীয়স্বজন, নিজ বংশের মহিলাদের এবং মুসলমান পুরুষ ও মহিলার মাঝে বিতরণ করেন। এসময় মহানবী (সা.) অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ছাড়াও হযরত আবু বকর (রা.)-কেও একশ’ ওয়াসাক শস্য ও খেজুর প্রদান করেন। এক ওয়াসাক সমান ষাট সা’ এবং এক সা’ সমান আড়াই কেজি হয়ে থাকে। এই হিসেবে প্রায় ৩৭৫ মণ শস্য হয় যা হযরত আবু বকর (রা.)’র ভাগে এসেছিল।
হযরত আবু বকর (রা.)’র নজদ্ অভিমুখে অভিযান। এ সম্পর্কে লেখা আছে, নজদ্ একটি আধো-মরু অঞ্চল কিন্তু সবুজ শ্যামল ও উর্বর ভূখ-, যেখানে অনেক উপত্যকা ও পাহাড় রয়েছে। এর দক্ষিণে ইয়েমেন এবং উত্তরে সিরিয়া মরুভূমি- ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত। এর পশ্চিমে হেজায মরুভূমি অবস্থিত। এই এলাকা সমতল ভূমি থেকে বারোশ’ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত আর এই উচ্চতার কারণেই একে নজদ্ বলা হয়ে থাকে। নজদে বনু কিলাব মুসলমানদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হলে তাদেরকে দমন করার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)-কে সেখানে প্রেরণ করেন। এই সারিয়া বা অভিযান শাবান মাসের ৭ম হিজরীতে সংঘটিত হয়। হযরত সালামা বিন আকওয়া (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)-কে আমাদের আমীর নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধির পর আবু সুফিয়ান যখন মক্কা আসে; এ সম্পর্কে উল্লিখিত আছে যে, কুরাইশের মিত্র বনু বকর যখন হুদায়বিয়া সন্ধি বিরোধী কাজ করে মুসলমানদের মিত্র গোত্র বনু খুযাআ’র ওপর আক্রমণ করে; আর কুরাইশরা অস্ত্র ও বাহন দিয়ে বনু বকরকে সাহায্য করে এবং হুদায়বিয়া সন্ধির তোয়াক্কা না করে চরম অহঙ্কার ও দম্ভভরে ঘোষণা করে যে, আমরা কোন সন্ধি মানি না; তখন আবু সুফিয়ান মদীনায় আসে এবং হুদায়বিয়ার সন্ধির নবায়ন করতে চায়। সে মহানবী (সা.)-এর নিকট যায়। কিন্তু তিনি (সা.) তার কোন কথার উত্তর দেন নি। অতঃপর সে আবু বকর (রা.)’র নিকট যায় এবং তাঁকে মহানবী (সা.)-এর সাথে কথা বলার অনুরোধ করে। কিন্তু তিনি (রা.) উত্তরে বলেন, আমি এমনটি করব না। অতঃপর যেমনটি হযরত উমর (রা.)’র স্মৃতিচারণে বর্ণনা করা হয়েছে, সে হযরত উমর (রা.)’র নিকট যায়। তিনিও অস্বীকার করেন। যাহোক, সে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়।
মক্কা বিজয়াভিযান। এই অভিযানকে ‘গাযওয়াতুল ফাতাহ্ আল্ আ’যম’ও বলা হয়। মক্কা বিজয় ৮ম হিজরীতে সংঘটিত হয়। তাবারীর ইতিহাসে বর্ণিত আছে, আল্লাহ্র রসূল (সা.) যখন লোকদেরকে সফরের প্রস্তুতির জন্য নির্দেশ প্রদান করেন তখন তিনি (সা.) নিজ পরিবারবর্গকে বলেন, আমার সাজসরঞ্জামও প্রস্তুত কর। হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর কন্যা হযরত আয়েশা (রা.)’র ঘরে যান। তখন হযরত আয়েশা (রা.) মহানবী (সা.)-এর জিনিসপত্র প্রস্তুত করছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আমার কন্যা! হুযুর (সা.) কি তোমাকে তাঁর সাজসরঞ্জাম প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছেন? তিনি উত্তরে বলেন, জ¦ী। হযরত আবু বকর (রা.) জিজ্ঞেস করেন, তোমার ধারণা কী, হুযুর (সা.) কোথায় যাওয়ার সংকল্প করেছেন? হযরত আয়েশা (রা.) উত্তরে বলেন, আমি কিছুই জানি না। অতঃপর মহানবী (সা.) লোকদেরকে বলে দেন যে, তিনি মক্কা অভিমুখে যাচ্ছেন। তিনি তাদেরকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন এবং দোয়া করেন, হে আল্লাহ! তুমি কুরাইশের গুপ্তচর ও গোয়েন্দাদের বাধাগ্রস্ত করে রাখ যতক্ষণ না আমরা তাদের অঞ্চলে তাদের অপ্রস্তুত অবস্থায় পৌঁছে যাই। এরপর লোকেরা প্রস্তুতি গ্রহণ করা আরম্ভ করে দেয়।
এই ঘটনার আরো ব্যাখ্যা করে সিরাতে হালবিয়ায় লিপিবদ্ধ আছে যে, হযরত আবু বকর (রা.) যখন হযরত আয়েশা (রা)-কে জিজ্ঞেস করছিলেন, সে সময়ই মহানবী (সা.) সেখানে আগমণ করেন। হযরত আবু বকর (রা.) জানতে চান, হে আল্লাহর রসূল (সা.)! আপনি কি সফরের সংকল্প করেছেন? তিনি (সা.) বলেন, হ্যাঁ। হযরত আবু বকর (রা.) নিবেদন করেন, তাহলে কি আমিও প্রস্তুতি গ্রহণ করবো? তিনি (সা.) বলেন, হ্যাঁ। হযরত আবু বকর (রা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! কোথায় যাওয়ার পরিকল্পনা রাখেন? তিনি (সা.) বলেন, কুরাইশের মোকাবিলা করার; কিন্তু সাথে এটিও বলেন, হে আবু বকর! এ বিষয়টি এখন গোপনই রাখবে। মোটকথা, মহানবী (সা.) লোকদেরকে প্রস্তুতির নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু কোথায় যাবেন এ সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করেননি। হযরত আবু বকর (রা.) নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল! কুরাইশ ও আমাদের মধ্যে কি এখনও সন্ধির মেয়াদ অবশিষ্ট নেই? তিনি (সা.) বলেন, আছে; তবে তারা বিশ^াসঘাতকতা করেছে এবং চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তবে আমি তোমাকে যা কিছু বলেছি তা গোপনই রাখবে।
একটি রেওয়ায়েতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর (সা.) কাছে নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আপনি কী কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা রাখেন? তিনি (সা.) বলেন, হ্যাঁ। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, আপনি হয়ত বনু আসফার তথা রোমানদের দিকে যাওয়ার অভিপ্রায় রাখেন। তিনি (সা.) বলেন, না। হযরত আবু বকর বলেন, তাহলে কি নাজাদ-এর দিকে যাত্রা করার ইচ্ছা? তিনি (সা.) বলেন, না। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, তাহলে আপনি হয়ত কুরাইশদের বিরুদ্ধে অভিযানের ইচ্ছা রাখেন। তিনি (সা.) বলেন, হ্যাঁ। হযরত আবু বকর (রা.) নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আপনার এবং তাদের মাঝে তো এখনও চুক্তির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া বাকি আছে। তিনি (সা.) বলেন, তুমি কি জান না যে, তারা বনু কা’ব অর্থাৎ বনু খুযাআ গোত্রের সাথে কী করেছে? এরপর মহানবী (সা.) গ্রামাঞ্চল এবং আশেপাশের মুসলমানদের কাছে বার্তা প্রেরণ করেন আর তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’লা এবং কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন রমজান মাসে মদিনায় এসে উপস্থিত হয়। অতএব মহানবী (সা.)-এর ঘোষণা অনুযায়ী আরব গোত্রগুলো মদিনায় আসতে আরম্ভ করে। যেসব গোত্র মদিনায় পৌঁছে তাদের মাঝে ছিল বনু আসলাম, বনু গিফার, বনু মুযায়না, বনু আশজাআ আর বনু জুহায়না। তখন মহানবী (সা.) এই দোয়া করেন যে, হে আল্লাহ্! কুরাইশদের গোয়েন্দা ও গুপ্তচরদের বিরত রাখ যতক্ষণ না আমরা তাদের কাছে তাদেরই এলাকায় আকস্মিকভাবে গিয়ে উপস্থিত হই। মহানবী (সা.) সকল রাস্তায় নজরদারি করার জন্য দল নিযুক্ত করেন যেন প্রত্যেক আনাগোনাকারী সম্পর্কে জানা থাকে। তিনি (সা.) তাদেরকে বলেন, অচেনা কোন ব্যক্তিকে তোমাদের সম্মুখ দিয়ে যেতে দেখলে তাকে বাধা দিবে যেন কুরাইশরা মুসলমানদের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে না পারে।
এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে গিয়ে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বর্ণনা করেন যে,
মহানবী (সা.) তাঁর এক স্ত্রীকে বলেন, আমার যাত্রার জন্য সাজসরঞ্জাম গোছানো আরম্ভ কর। তিনি সফরের জিনিসপত্র গোছানো আরম্ভ করেন। আর হযরত আয়েশাকে বলেন, আমার জন্য ছাতু বা শস্য ইত্যাদি ভেজে প্রস্তুত কর। তৎকালে এরূপ খাবারেরই প্রচলন ছিল। অতএব তিনি মাটি ইত্যাদি বেছে শস্যদানা প্রস্তুত করা আরম্ভ করেন। হযরত আবু বকর ঘরে তার মেয়ের কাছে আসেন। প্রস্তুতি দেখে তিনি জিজ্ঞেস করেন, হে আয়েশা! এটি কী হচ্ছে? মহানবী (সা.) কী কোন সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন? তিনি বলেন, সফরের প্রস্তুতি বলেই মনে হচ্ছে। তিনি (সা.) সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এতে হযরত আবু বকর বলেন, কোন যুদ্ধের পরিকল্পনা আছে কি? তিনি বলেন, আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না। মহানবী (সা.) বলেছেন, আমার সফরের জন্য সাজসরঞ্জাম প্রস্তুত কর আর আমরা তা-ই করছি। দুই-তিন দিন পর তিনি (সা.) হযরত আবু বকর এবং হযরত উমরকে ডাকেন এবং বলেন, দেখ! তোমরা জান যে, খুযাআ গোত্রের লোকেরা এসেছিল আর তারা জানিয়েছে যে, এই ঘটনা ঘটেছে। অপর দিকে খোদা তা’লা পূর্বেই আমাকে এই ঘটনার সংবাদ প্রদান করেছেন যে, তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আর অধিকন্তু তাদের (অর্থাৎ খুযাআর) সাথে আমাদের চুক্তি রয়েছে। এখন আমাদের ভয় পাওয়া আর মক্কার লোকদের বীরত্ব আর শক্তি দেখে তাদের মোকাবিলার জন্য না দাঁড়ানো ঈমানের পরিপন্থি বিষয়। অতএব আমরা সেখানে যাব, তোমাদের মতামত কী? হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আপনি তো তাদের সাথে চুক্তি করেছেন। এছাড়া তারা আপনারই স্বজাতি। তার কথার অর্থ ছিল এই যে, আপনি কি আপনার স্বজাতির সাথে যুদ্ধ করবেন? মহানবী (সা.) বলেন, আমরা স্বজাতির ওপর আক্রমণ করব না, চুক্তিভঙ্গকারীদের ওপর আক্রমণ করব। এরপর হযরত উমরকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, বিসমিল্লাহ্, আমি তো প্রতিদিন দোয়া করতাম যেন এই দিন আসে আর আমরা মহানবী (সা.)-এর সুরক্ষায় কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করি। মহানবী (সা.) বলেন, আবু বকর খুবই ন¤্র প্রকৃতির মানুষ কিন্তু সত্য কথা উমরের মুখ থেকে অধিক নিঃসৃত হয়। মহানবী (সা.) বলেন, প্রস্তুতি গ্রহণ কর। এরপর তিনি (সা.) চতুষ্পার্শ্বের গোত্রগুলোতে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তি, যে আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন রমজানের প্রাথমিক দিনগুলোতে মদিনায় সমবেত হয়। কাজেই, সৈন্যরা সমবেত হতে আরম্ভ করে আর কয়েক হাজার মানুষের সমন্বয়ে সৈন্যদল প্রস্তুত হয়ে যায় এবং তিনি (সা.) যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাত্রার প্রাক্কালে মহানবী (সা.) বলেন, হে আমার খোদা! আমি তোমার সমীপে দোয়া করছি, তুমি মক্কাবাসীদের কানকে বধির করে দাও আর তাদের গুপ্তচরদের অন্ধ করে দাও। যাতে তারা আমাদের দেখতে না পায় আর আমাদের কোন কথা যেন তাদের কানে না পৌঁছে। অতএব তিনি (সা.) বের হন। মদিনায় শত শত মুনাফিক থাকা সত্ত্বেও দশহাজার সৈন্যের মদিনা থেকে যাত্রা করার সংবাদ মক্কায় না পৌঁছা, এটি আল্লাহ্ তা’লারই কাজ ছিল।
তাবাকাত ইবনে সা’দ-এ লেখা আছে যে, মুসলমানদের কাফেলা বা দলটি এশার সময় মাররুয্ যাহরানে পৌঁছে। মাররুয্ যাহরান মক্কা থেকে মদিনার পথে ২৫ কি: মি: দূরত্বে অবস্থিত। অর্থাৎ, মক্কা থেকে ২৫ কি: মি: দূরে ছিল। তিনি (সা.) তাঁর সাহাবীদের নির্দেশ দেন আর তারা দশহাজার স্থানে আলো প্রজ্জ্বলিত করে। কুরাইশরা তাঁর যাত্রার সংবাদ পায় নি। তারা দুঃখ-ভারাক্রান্ত ছিল, কারণ তাদের ভয় ছিল যে, তিনি (সা.) তাদের সাথে যুদ্ধ করবেন। তারা সংবাদ পায়নি ঠিকই কিন্তু তাদের অর্থাৎ, কুরাইশদের ধারণা ছিল যে, এবার যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এ কারণে তাদের চিন্তা ছিল। মনে হচ্ছে এখানে ভুল লেখা হয়েছে, যাত্রার সংবাদ এখানে পৌঁছার পর পৌঁছে থাকবে। কাফেলা যখন এখানে অবস্থান নেয় এবং দশ হাজার স্থানে আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হয়, তখন কুরাইশরা আবু সুফিয়ানকে পরিস্থিতি অবগত হওয়ার জন্য প্রেরণ করে। তারা বলে, মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে তোমার সাক্ষাৎ হলে তুমি তাঁর কাছ থেকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা চেয়ে নিও। আবু সুফিয়ান বিন হারব, হাকীম বিন হিযাম এবং বুদায়েল বিন ওয়ারাকা রওয়ানা হয়ে যায়। (মুসলমান) সৈন্যদল দেখে তারা চরম উৎকণ্ঠিত হয়। মহানবী (সা.) সেই রাতে হযরত উমর (রা.)-কে নিরাপত্তা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। আবু সুফিয়ানের কণ্ঠ শুনে হযরত আব্বাস (রা.) তাকে ডেকে বলেন, (হে) আবু হানযালা! (এটি আবু সুফিয়ানের ডাক নাম)! সে বলে, উপস্থিত। আবু সুফিয়ান হযরত আব্বাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করে, তোমার পেছনে কী দেখছি? তিনি বলেন, আল্লাহ্র রসূল (সা.) দশ হাজার সৈন্যসহ এসেছেন। হযরত আব্বাস (রা.) তাকে আশ্রয় দেন এবং (তার) দু’জন সঙ্গীসহ তাকে মহানবী (সা.)-এর সকাশে উপস্থিত করেন, আর তারা তিনজনই ইসলাম গ্রহণ করে।
এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে, বাকি ইনশাআল্লাহ্ আগামীতে বর্ণিত হবে।
(সূত্র: কেন্দ্রীয় বাংলাডেস্কের তত্ত্বাবধানে অনূদিত)