শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত উমর (রা.) জুমুআর খুতবা ২৯ অক্টোবর ২০২১

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ২৯ অক্টোবর, ২০২১ মোতাবেক ২৯ ইখা, ১৪০০ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা
তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
মহানবী (সা.) যাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করেছিলেন তাদের মাঝে হযরত উমর (রা.)ও একজন। হযরত আবু মূসা (রা.) বর্ণনা করেন, আমি মহানবী (সা.)-এর সাথে মদিনার কোন এক বাগানে ছিলাম এমন সময় এক ব্যক্তি এসে দরজা খুলতে বলে। তখন নবী করিম (সা.) বলেন, তার জন্য দরজা খুলে দাও এবং তাকে জান্নাতে সুসংবাদ দাও। আমি আগুন্তুকের জন্য দরজা খুলে দেখি, তিনি হযরত আবু বকর (রা.)। আমি তাকে সে বিষয়ের সুসংবাদ প্রদান করি যা মহানবী (সা.) বলেছিলেন। তিনি আল হামদুলিল্লাহ্ বলেন। এরপর অপর এক ব্যক্তি আসে এবং দরজা খুলতে বলে। মহানবী (সা.) বলেন, তার জন্য দরজা খুলে দাও এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও। আমি দরজা খুলে দেখি, হযরত উমর (রা.)। আমি তাকে সেকথাই বলি যা নবী করিম (সা.) বলেছেন। তিনি আল হামদুলিল্লাহ্ বলেন। এরপর আরেকজন আসে এবং দরজা খুলে দিতে বলে। মহানবী (সা.) বলেন, তার জন্য দরজা খুলে দাও এবং তাকেও জান্নাতের সুসংবাদ দাও যদিও সে এক বিপদের সম্মুখীন হবে। আমি দরজা খুলে দেখি তিনি হলেন, হযরত উসমান (রা.)। আমি তাকে সেকথা বলি যা মহানবী (সা.) বলেছিলেন। তিনিও আল হামদুলিল্লাহ্ বলেন আর এরপর বলেন, বিপদাপদ থেকে নিরাপত্তার জন্য কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করা যায়।
হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন আবু বকর জান্নাতি, উমর জান্নাতি এবং উসমান জান্নাতি, হযরত আলী জান্নাতি, হযরত তালহা জান্নাতী, হযরত যুবায়ের জান্নাতি, হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ জান্নাতি, হযরত সা’দ বিন আবি অক্কাস জান্নাতি, হযরত সাঈদ বিন যায়েদ জান্নাতি এবং আবু উবায়দা বিন র্জারাহ জান্নাতি একথা তিনি দশ ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমরা একবার নবী করিম (সা.)-এর পাশে ছিলাম, সেই সময় তিনি (সা.) বলেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম তখন আমি নিজেকে জান্নাতে দেখলাম। সেখানে আমি দেখি, এক মহিলা একটি প্রাসাদের পাশে ওযু করছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করি এই প্রাসাদ কার? লোকজন বলে, এটি উমর বিন খাত্তাব (রা.)-এর প্রাসাদ। আমি তার আত্মাভিমানের কথা চিন্তা করে সেখান থেকে চলে আসি। হযরত উমর (রা.)ও সেখানে বসা ছিলেন, তিনি (রা.) একথা শুনে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রসূল (সা.)! আমি কি আপনার প্রতিও আত্মাভিমান দেখাব, আপনি কেন চলে এলেন, সেখানে গিয়ে আশিষমন্ডিত করতেন!
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ইল্লিয়্যিনদের কোন ব্যক্তি যখন জান্নাতবাসীদের প্রতি উঁকি দিয়ে দেখবে তখন তার চেহারার কারণে জান্নাত আলোকজ্জ্বল হয়ে ওঠবে যেন তার চেহারা এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত উমর (রা.) উভয়ই তাদের অন্তর্ভুক্ত আর তারা দুজন কতইনা উত্তম মানুষ।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) কতৃক বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের কাছে জান্নাতিদের একজন আসছে, তখন হযরত আবু বকর (রা.) আসলেন। তিনি পুনরায় বলেন, তোমাদের কাছে এক জান্নাতবাসী আসছে, তখন হযরত উমর (রা.) আসেন। অনুরূপভাবে এক রওয়ায়েতে রয়েছে, হযরত আনাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ (সা.) হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (রা.) সম্পর্কে বলেছেন, আবু বকর ও উমর হলো নবী রসূলগণ ব্যতীত জান্নাতের পূর্বাপর সকল বয়োজ্যষ্ঠদের সর্দার।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন উমর বিন খাত্তাব জান্নাতবাসীদের প্রদীপ। হযরত উমর (রা.)-এর মর্যাদা সম্পর্কে আরেকটি রেওয়ায়েত রয়েছে যা মহানবী (স.) হতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আকওয়া বিন আমের বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, আমার পরে যদি কোন নবী হত তবে অবশ্যই উমর বিন খাত্তাব হত। অর্থাৎ এটি নবুয়্যতের অব্যবহতি পরের কথা বলা হয়েছে, নয়তো প্রতিশ্রæত মসীহ্ ও মাহদীকে মহানবী (সা.) নিজেই নবীউল্লাহ্ (আল্লাহ্র নবী) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
রসূলুল্লাহ্ (স.) হযরত উমরকে মুহাদ্দাস আখ্যায়িত করা সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন, নিশ্চয় পূর্ববর্তী বিভিন্ন উম্মতে মুহাদ্দাস হতো। আমার উম্মতের মধ্যে যদি কেউ (মুহাদ্দাস) থেকে থাকে তবে সে হচ্ছে উমর বিন খাত্তাব (রা.)।
হযরত আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ্ (স.) বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগুলোর মাঝে এমন লোক ছিল যারা মুহাদ্দাস ছিল। আমার উম্মতে অনুরূপ কেউ থাকলে সে হচ্ছে হযরত উমর। মুহাদ্দাস সেই ব্যক্তি যার প্রতি অজস্র ইলহাম এবং কাশ্ফ হয়ে থাকে।
অতঃপর বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী বনী ইসরাঈল জাতিতে এরূপ ব্যক্তি ছিল যাদের সাথে আল্লাহ্ বাক্যালাপ করতেন অথচ তারা নবী ছিল না। আমার উম্মতে এরূপ কেউ থেকে থাকলে সে হচ্ছে উমর।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, খোদা তা’লা সর্বদা রূপকের ব্যবহার করেন আর প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতার ভিত্তিতে একজনের নাম আরেকজনকে দিয়ে থাকেন। যে ইব্রাহীমের ন্যায় হৃদয় রাখে সে খোদা তা’লার দৃষ্টিতে ইব্রাহীম। আর যে উমর ফারুকের হৃদয় রাখে সে খোদা তা’লার দৃষ্টিতে উমর ফারুক। তোমরা কি এ হাদীস পড় না যে, যদি এ উম্মতেও মুহাদ্দেস থাকে যার সাথে আল্লাহ্ তা’লা বাক্যালাপ করেন তবে সে হচ্ছে উমর। এখন এ হাদীসের অর্থ কি এটি যে, হযরত উমরের মাধ্যমে মুহাদ্দাসিয়ত শেষ হয়ে গেছে, কক্ষনো না। বরং এ হাদীসের অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তির অধ্যাত্মিক অবস্থা উমরের আধ্যাত্মিক অবস্থার ন্যায় হয়ে গেছে সে প্রয়োজনের সময় মুহাদ্দাস হবে। এরপর তিনি (আ.) বলেন, এ অধমের প্রতিও একবার এ মর্মে ইলহাম হয়েছিল যে, “ফীকা মা’দাতুন ফারুকিয়্যা” পূর্ণ ইলহামটি হলো, আনতা মুহাদ্দাসুল্লাহ্ ফীকা মা’দাতুন ফারুকিয়্যা, অর্থাৎ তুমি আল্লাহ্র মুহাদ্দাস, তোমার মধ্যে ফারুকী বৈশিষ্ট্য বা উপকরণ রয়েছে।
যেমনটি আমি বিগত খুতবাগুলোর কোন এক খুতবায় বলেছি, হযরত উমর (রা.) কুরআনের সংরক্ষণ ও সংকলনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে এখানেও উল্লেখ করছি। হযরত আবু বকর (রা.)-এর যুগে ইয়ামামার যুদ্ধে কুরআনের ৭০ জন হাফেয শহীদ হন। এ সম্পর্কে হযরত যায়েদ বিন সাবেত আনসারী বর্ণনা করেন, যখন ইয়ামামাতে লোকদের শহীদ করা হয় তখন হযরত আবু বকর (রা.) আমাকে ডেকে পাঠান। সেই সময় তার কাছে হযরত উমর (রা.) ছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, উমর আমার কাছে এসে আমাকে বলেছেন ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক লোক শহীদ হয়েছে আর আপনি যদি কুরআনকে সংকলিত করে সংরক্ষণ না করেন আমার আশঙ্কা হয় অন্যান্য যুদ্ধেও ক্বারী এভাবে শহীদ হলে পবিত্র কুরআনের অনেকটা হারিয়ে যাবে। হযরত উমর বলেন, আমার পরামর্শ হলো, পবিত্র কুরআন এক জায়গায় সংকলন করুন। হযরত আবু বকর (রা.) উমর কে বলেন, আমি এমন কাজ কীভাবে করি যা মহানবী (সা.) করেন নি। উমর (রা.) বলেন, আল্লাহ্র কসম! আপনার এই কাজ শুভ হবে। পুনরায় হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, উমর আমাকে বার বার এটাই বলতে থাকে। অবশেষে আল্লাহ্ তা’লা এই বিষয়ে আমার বক্ষ উন্মোচন করে দেন। আর এখন আমিও এটাই যথার্থ বলে মনে করি যা উমর যথাযথ মনে করেছিলেন, অর্থাৎ কুরআনের সংকলন হওয়া উচিত। এরপর যায়েদ বিন সাবিত (রা.) কুরআনের সংকলণ করার কাজ শুরু করেন। এর বিস্তারিত বিবরণ আমি পূর্বেই দিয়েছি।
হযরত উমর (রা.) এর কুরআন করিম হিফয করার বিষয়ে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন,
আবু উবায়দা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর মুহাজের সাহাবীদের মাঝে নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের কুরআন হিফয করার বিষয় প্রমাণিত আর তারা হলেন- আবু বকর, উমর, উসমান, আলী, তালহা, সা’দ, ইবনে মাসউদ, হুযাইফা, সালেম, আবু হুরায়রা, আবদুল্লাহ্ বিন সায়েব, আবদুল্লাহ্ বিন উমর এবং আবদুল্লাহ্ বিন আব্বাস রাযি আল্লাহু আনহুম। এটাও বলা হয় যে, মহানবী (সা.)-এর প্রতি অবর্তীণ হওয়া ওহীর সাথে হযরত উমরের (রা.)-এর মতামতের সামঞ্জস্যতা রয়েছে। সিহাহ্ সিত্তার বর্ণনায় হযরত উমরের চিন্তাধারার সাথে ওহীর সামঞ্জস্যের কথা যেসব হাদীসে বর্ণিত হয়েছে সেখানে তিনটি বিষয়ে সামঞ্জস্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। সিহাহ্ সিত্তার রেওয়ায়েতের সংখ্যা সম্মিলিত ভাবে দাড়ায় ৭ (সাত)। সহীহ্ বুখারীতে হযরত উমর (রা.)-এর পক্ষ থেকে একটি রেওয়ায়েত বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, তিনটি বিষয়ে আমার মতামত আমার প্রভুর ইচ্ছার সাথে মিলে গেছে। আমি বলেছিলাম, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমরা মাকামে ইব্রাহীমকে নামাযের জায়গা বানিয়ে নিতে পারি। তিনি এটি বলেন আর এরপর وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى আয়াত অবতীর্ণ হয়। এছাড়া পর্দার বিষয় বলার পর পর্দার আদেশ অবতীর্ণ হয়। আমি বলি, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আপনি আপনার স্ত্রীদের পর্দা করার আদেশ দিন, কেননা তাদের সাথে ভালো মন্দ উভয় ধরণের মানুষ কথা বলে। এরপর পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হয়। অতঃপর মহানবী (সা.)-এর স্ত্রীগণ আত্মাভিমানের কারণে মহানবী (সা.) সম্পর্কে জোটবদ্ধ হয়। হযরত উমর (রা.) বলেন, তখন আমি তাদের বললাম, অর্থাৎ সেই স্ত্রীদেরকে যাদের মধ্যে তার কন্যাও ছিল, মহানবী (সা.) যদি তোমাদের তালাক দিয়ে দেন তাহলে আমি আশা করি, তার প্রভু তোমাদের থেকে উত্তম স্ত্রী মহানবী (সা.)-কে দিবেন। এ বিষয়ে এই আয়াত অবতীর্ণ হয় যে, عَسَىٰ رَبُّهُ إِنْ طَلَّقَكُنَّ أَنْ يُبْدِلَهُ أَزْوَاجًا خَيْرًا مِنْكُنَّ অর্থাৎ আর হতে পারে তিনি যদি তোমাদের তালাক দিয়ে দেন তাহলে তার খোদা তোমাদের পরিবর্তে তার (সা.) জন্য তোমাদের চেয়ে উত্তম স্ত্রী দিবেন।
সহীহ্ মুসলিমে এসেছে, হযরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত উমর (রা.) বলেন, তিন ক্ষেত্রে আমার প্রভুর সাথে আমার কথা মিলে গেছে। মাকামে ইব্রাহীম সম্পর্কে, পর্দা সম্পর্কে এবং বদরের যুদ্ধের যুদ্ধবন্ধীদের সম্পর্কে, কিন্তু বদরের যুদ্ধ সম্পর্কে এই রেওয়ায়েতটি সঠিক না। এ বিষয়ে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। হযরত মির্যা বশির আহমদ সাহেবও কতিপয় দলিলপ্রমাণ উদ্ধৃত করে লিখেছেন। পুরোনো আলেম এবং তফসীরকারীরাও লিখেছেন এবং এটি প্রমাণ করেছেন যে, বদরের যুদ্ধবন্ধীদের শাস্তি দেয়ার বর্ণনাটি সঠিক নয় আর এর বিস্তারিত বর্ণনা আমি পূর্বে একটি খুতবায় উপস্থাপন করেছি।
সহীহ্ মুসলিমে হযরত উমর (রা.)-এর মুনাফিকদের জানাযা না পড়ার বিষয়েও কুরআনী আয়াতের সাথে মিল পাওয়া যায়। হযরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, আব্দুল্লাহ্ বিন উবাই বিন সুলুল যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার পুত্র আব্দুল্লাহ্ বিন আব্দুল্লাহ্ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হয় এবং মহানবী (সা.)-এর নিকট নিবেদন করে, তিনি (সা.) যেন তার পিতাকে দাফন করার জন্য তাকে তাঁর (সা.) জামা দান করেন। সুতরাং তিনি (সা.) তাকে জামা দিয়ে দেন। এরপর সে মহানবী (সা.)-এর নিকট তার জানাযার নামায পড়ানোর আবেদন করে। তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) তার জানাযার নামায পড়ানোর জন্য যান। এতে হযরত উমর (রা.) দাঁড়িয়ে যান এবং রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাপড় টেনে ধরেন এবং নিবেদন করেন, হে আল্লাহর রসূল (সা.)! আপনি কি তার জানাযার নামায পড়াতে যাচ্ছেন অথচ আল্লাহ্ তা’লা আপনাকে তার জানাযার নামায পড়তে নিষেধ করেছেন। এতে রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাকে (এ বিষয়ে) পূর্ণ অধিকার দিয়েছেন এবং বলেছেন, استغفر لہم او لا تستغفر لہم অর্থাৎ তুমি তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর বা না কর। যদি তুমি তার জন্য ৭০ বারও ইস্তেগফার কর (কোন লাভ হবে না) তিনি (সা.) বলেন, আমি ৭০ বারের অধিকবার ইস্তেগফার করব। হযরত উমর (রা.) বলেন, সে মুনাফিক। কিন্তু (তারপরও) রসূলুল্লাহ্ (সা.) তার জানাযার নামায পড়ান। তখন মহাসম্মানিত ও প্রতাপান্বিত আল্লাহ্ আয়াত و لا تصل علی احد منھم مات ابدا অবতীর্ণ করেন, অর্থাৎ তুমি মুনাফিকদের মধ্য হতে কখনো তাদের কোন মৃত ব্যক্তির জানাযার নামায পড়বে না এবং কখনো তাদের কবরে দোয়ার জন্য দন্ডায়মান হবে না।
মদ নিষিদ্ধ হওয়া বিষয়ে হযরত উমর (রা.)-এর চিন্তাধারার কুরআনের ওহীর সাথে মিলের কথা সুনান তিরমিযীতে পাওয়া যায়। হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) দোয়া করেন, হে আল্লাহ্! মদ সর্ম্পকে আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক নির্দেশ অবতীর্ণ কর, তখন সূরা বাকারার আয়াত يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তুমি বল, এদুটির মধ্যে মহাপাপ নিহিত আছে এবং মানুষের জন্য সেগুলোর মধ্যে অল্প কিছু উপকারও আছে; কিন্তু এই উভয়ের পাপ (ও ক্ষতি) এগুলোর উপকার অপেক্ষা গুরুতর (সূরা বাকারা : ২২০)। যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন হযরত উমর (রা.)-কে এই আয়াত পড়ে শুনানো হয়। এই আয়াত শুনে হযরত উমর (রা.) পুনরায় বলেন, হে আল্লাহ্! আমাদের জন্য মদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা বর্ণনা কর, তখন সূরা নিসার আয়াত لَا تَقۡرَبُوا الصَّلٰوۃَ وَ اَنۡتُمۡ سُکَرٰی অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা চেতনাহীন বা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাযের ধারে কাছে যেয়ো না যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমরা যা বল তা অনুধাবন করার যোগ্য হয়ে ওঠ (সূরা নিসা : ৪৪)। হযরত উমর (রা.) পুনরায় আসেন এবং তাঁকে এই আয়াত পড়ে শুনানো হয়। তখন তিনি (রা.) পুনরায় বলেন, হে আল্লাহ্! আমাদের জন্য মদ সংক্রান্ত নির্দেশাবলী সুস্পপষ্টভাবে বর্ণনা কর, তখন সূরা মায়েদার আয়াত إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَن يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ ۖ فَهَلْ أَنتُم مُّنتَهُونَ অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ শয়তান মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে শুধু শত্রুত ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহ্র যিকর এবং নামায হতে বিরত রাখতে চায় অতএব তোমরা কি নিবৃত্ত হবে? (সূরা মায়েদা : ৯২)। হযরত উমর (রা.) পুনরায় আসেন এবং এই আয়াত তাঁকে পড়ে শুনানো হয় তখন তিনি (রা.) বলেন, আমরা নিশ্চয় এথেকে বিরত থাকব, আমরা বিরত থাকব।
আল্লাহর ওহীর সাথে হযরত উমর (রা.)-এর চিন্তাধারার সামঞ্জস্যতার সিহাহ্ সিত্তাতে উল্লেখিত এই কথাগুলো ছাড়াও জীবনীকারগণ আরো অনেক ঐকতানের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লামা সুয়ূতী প্রায় বিশটি মিলের কথা উল্লেখ করেছেন।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, হযরত উমর (রা.)-এর পদমর্যাদা সম্পর্কে কী জান, তিনি সাহাবীগণের মধ্যে কত মহান মর্যাদার অধিকারী? তার মর্যাদা এমন যে, কখনো কখনো তাঁর (রা.) মতামত অনুসারে কুরআন শরীফের আয়াত অবতীর্ণ হয়ে যেত। আর তাঁর সম্পর্কে এই হাদীস রয়েছে যে, শয়তান উমরের ছায়া দেখে পলায়ন করে। দ্বিতীয়ত এই হাদীসও রয়েছে যে, যদি আমার পরে কেউ নবী হতো তবে উমর হতো। তৃতীয় এই হাদীস রয়েছে যে, পূর্ববর্তী উম্মতসমূহে মুহাদ্দাস হতো, এই উম্মতে যদি কেউ মুহাদ্দাস থেকে থাকে তবে সে হলো হযরত উমর।
বিভিন্ন যুদ্ধে হযরত উমর (রা.)-এর পরামর্শ প্রদান এবং মহানবী (সা.)-এর তা গ্রহণ করা সম্পর্কে রেওয়ায়েত রয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা নাকি হযরত আবু সাঈদ (রা.) এ ব্যাপারে রেওয়ায়েতকারী আমেশের সন্দেহ ছিল যে, তাদের মধ্যে থেকে কে ছিলেন। যাহোক তিনি বলেন, তবুকের যুদ্ধের দিন মানুষের প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছিল। (তাই) তারা বলে, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আপনি অনুমতি দিলে আমারা আমাদের পানি বহনকারী উট জবাই করে খাব এবং (এর) চর্বি ব্যবহার করব। মহানবী (সা.) বলেন, ঠিক আছে (জবাই) করে নাও। তখন হযরত উমর (রা.) এসে নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আপনি যদি এমনটি করেন তাহলে বাহনের সঙ্কট দেখা দিবে। তবে আপনি লোকদেরকে তাদের কাছে গচ্ছিত পাথেয় নিয়ে আসতে বলুন। অর্থাৎ তাদের নিকট যেসব খাদ্যদ্রব্য রয়েছে সেগুলো নিয়ে আসুক আর এতে বরকতের নিমিত্তে দোয়া করুন। এটি অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ্ এতে বরকত দান করবেন। তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, হ্যা! এটি ঠিক। বর্ণনাকারী বলেন, মহানবী (সা.) একটি চামড়ার দস্তরখানা আনিয়ে বিছিয়ে দেন এরপর তাদের কাছে রয়ে যাওয়া পাথেয় নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। অর্থাৎ যে খাদ্যসামগ্রীই ছিল তা নিয়ে আসতে বলেন। বর্ণনাকারী বলেন, কেউ এক মুষ্ঠি ভুট্টা আনে, কেউ এক মুষ্ঠি খেজুর আর কেউবা আবার রুটির টুকরো ইত্যাদি নিয়ে আসে। এভাবে এই দস্তরখানায় কিছুটা (খাদ্যসামগ্রী) একত্র হয়ে যায়। বর্ণনাকারী বলেন, মহানবী (সা.) তাতে বরকতের জন্য দোয়া করেন। এরপর বলেন, এখন নিজ নিজ পাত্রে (খাবার) নিয়ে নাও আর তারা পাত্রে সেগুলো নিয়ে নেয় এবং সৈন্যদলের সব পাত্র ভরে নেয়া হয়। এরপর সবাই পরিতৃপ্ত হয়ে খায় আর কিছুটা বেঁচেও যায়। তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্ ভিন্ন কোন উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহ্র রসূল। যে ব্যক্তি সন্দেহমুক্ত হৃদয়ে এ দুটি সাক্ষ্যসহ খোদার সাথে সাক্ষাৎ করবে তাকে জান্নাত থেকে বিরত রাখা হবে না। এটি সহীহ্ মুসলিমের রেওয়ায়েত। সহীহ্ বুখারীতে এ রেওয়ায়েতটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ইয়াযিদ বিন আবি উবায়েদ হযরত সালমা বিন আকুয়া (রা.) হতে বর্ণনা করেন, এক অভিযানে লোকদের পাথেয়তে ঘাটতি দেখা দেয় আর তাদের কাছে কিছুই ছিল না। ফলে তারা মহানবী (সা.)-এর কাছে নিজেদের উট জবাই করার অনুমতি নিতে এলে তিনি (সা.) তাদেরকে অনুমতি দিয়ে দিলেন। এরপর হযরত উমর (রা.) তাদের সাথে সাক্ষাৎ করলে হযরত উমর (রা.)কে তারা (এ বিষয়ে) অবগত করল; তখন হযরত উমর (রা.) বললেন, তোমাদের উট শেষ হয়ে গেলে তোমাদের কীভাবে চলবে? একথা বলার পর হযরত উমর (রা.) নবী করীম (সা.)-এর নিকট গিয়ে বললেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! তাদের উট শেষ হয়ে গেলে তাদের চলবে কীভাবে? তখন মহাবনী (সা.) বললেন, লোকদের মাঝে ঘোষণা দাও! সবাই যেন তাদের গচ্ছিত পাথেয় নিয়ে আসে। এরপর মহানবী (সা.) সেই পাথেয় বা খাদ্যসামগ্রীতে বরকতের দোয়া করেন আর এরপর তাদের পাত্র আনিয়ে নেন। লোকেরা (তাদের পত্র) ভরে ভরে নেয়া আরম্ভ করে। এমনটি করা শেষ করলে রসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ভিন্ন কোন উপাস্য নেই এবং আমি তাঁর রসূল।
আযানের সূচনা সম্পর্কেও হযরত উমর (রা.) স্বপ্ন দেখেছিলেন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লার ওহী সাহাবীদের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। রসূলে করীম (সা.)-এর যুগে আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ (রা.) নামে এক সাহাবী ছিলেন। আল্লাহ্ তা’লা তাকে ওহীর মাধ্যমে আযান শিখিয়েছেন আর মহানবী (সা.) তার সেই ওহীর ওপর ভিত্তি করেই মুসলমানদের মাঝে আযানের প্রচলন করেছিলেন। পরবর্তীতে পবিত্র কুরআনের ওহীও এর সত্যায়ন করে। হযরত উমর (রা.) বলেন, আমাকেও আল্লাহ্ তা’লা এ আযানই শিখিয়েছিলেন। কিন্তু বিশ দিন পর্যন্ত আমি একথা ভেবে নীরব থাকি যে, মহানবী (সা.)-এর সমীপে আরেক ব্যক্তি এ বিষয়টি বর্ণনা করেছে। আরেকটি রেওয়ায়েতে একথাও রয়েছে যে, এক ফিরিশতা এসে আমাকে আযান শিখায় আর তখন আমি কিছুটা জাগ্রত ও আধোঘুমে ছিলাম।
সুনান তিরমিযীর রেওয়ায়েত আমি ইতোপূর্বেও বর্ণনা করেছি, কিন্তু এখানেও আবার বলে দিচ্ছি। পরের যেসব বাক্য রয়েছে তা থেকেই বুঝা যায় যে, মহানবী (সা.)-এর দৃষ্টিতে হযরত উমর (রা.)-এর স্বপ্নের কতটা গুরুত্ব ছিল। মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ (রা.) তাঁর পিতার পক্ষ থেকে বর্ণনা করেন, আমি সকালবেলা মহানবী (সা.)-এর কাছে আসি এবং তাঁকে স্বপ্ন শুনাই। তিনি (সা.) বলেন, অবশ্যই এটি সত্য স্বপ্ন। তুমি বেলালের সাথে যাও, নিশ্চয়ই তোমার চাইতে তার আওয়াজ উঁচু, শ্বাস দীর্ঘ আর তাকে তুমি (সেই বাক্যগুলোই) বলতে থাক যা তোমাকে বলা হয়েছে। তার উচিত হবে সেগুলোর ঘোষণা দেয়া। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন যায়েদ (রা.) বলেন, হযরত উমর (রা.) যখন নামাযের জন্য হযরত বেলাল (রা.)-এর আযান শুনেন তখন তিনি (রা.) তার চাদর হেঁচড়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে বলেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, নিশ্চয়ই আমি তেমনই দেখেছি যেমনটি সে আযানে বলেছে। বর্ণনাকারী বলেন, মহানবী (সা.) বলেন, সুতরাং সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্রই। অতএব এ কথাটি অধিক নির্ভরযোগ্য। অর্থাৎ এখন এ বিষয়টি আরো সত্যায়িত হয়ে গেল।
হযরত উমর (রা.) মহানবী (সা.)কে কেমন সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন (আর তার নিকট) মহানবী (সা.)-এর কী মর্যাদা ছিল এ সম্পর্কে হযরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি অর্থাৎ ইবনে উমর (রা.) একবার নবী করীম (সা.)-এর সাথে কোন সফরে ছিলেন। তিনি হযরত উমর (রা.)-এর একটি উটে আরোহিত ছিলেন যেটি ছিল কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত প্রকৃতির আর সেটি মহানবী (সা.)-এর বাহনকে (পিছনে রেখে) সামনে চলে যেত। সেসময় তাঁর পিতা হযরত উমর (রা.) তাঁকে বলতেন, ‘আব্দুল্লাহ্! মহানবী (সা.)-কে পিছনে রেখে কারো সামনে এগোনো উচিত নয়।’ মহানবী (সা.)-এর বাহনের সামনে তোমার বাহনের যাওয়াটা ঠিক না। তখন মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে বলেন, আমার কাছে এটি বিক্রি করে দাও। হযরত উমর (রা.) বলেন, এটি তো আপনারই। মহানবী (সা.) এটি কিনে নেন এবং বলেন, হে আব্দুল্লাহ্! এটি এখন তোমার। এটি দিয়ে তুমি যা খুশি কর। তিনি (সা.) এটি (কিনে) নিয়ে উপহার দিয়ে দেন।
হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, সূর্য হেলে যাওয়ার পর মহানবী (সা.) এসে যোহরের নামায পড়েন এবং মিম্বরে দাঁড়িয়ে প্রতিশ্রুত মুহূর্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই সময় বড় বড় ঘটনা ঘটবে। এরপর তিনি (সা.) বলেন, কেউ কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করতে পার। আমি যতক্ষণ পর্যন্ত এ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রয়েছি তোমরা আমার কাছে যাই জানতে চাইবে তা আমি তোমাদের জানিয়ে দেব। একথা শুনে লোকেরা অনেক কাঁদে। মহানবী (সা.) কয়েকবার বলেন, আমাকে প্রশ্ন কর। তখন হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন হুযাফা সাহ্মী (রা.) দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, আমার পিতা কে? জবাবে তিনি (সা.) বলেন, হুযাফা। এরপরও তিনি (সা.) বহুবার বলেন, আমাকে জিজ্ঞেস কর। তখন হযরত উমর (রা.) হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বলেন, রাযীনা বিল্লাহি রাব্বাও ওয়া বিল ইসলামে দ্বীনাও ওয়া বি-মুহাম্মাদিন নাবীয়্যান, অর্থাৎ আমরা এতে সন্তুষ্ট যে, আল্লাহ্ আমাদের প্রভু, ইসলাম আমাদের ধর্ম এবং মুহাম্মদ (সা.) আমাদের নবী। এতে মহানবী (সা.) নীরব হয়ে যান। এরপর তিনি (সা.) বলেন, এখনই আমার সামনে এই দেয়ালের প্রশস্ত দিকে জান্নাত ও জাহান্নাম উপস্থাপন করা হয়েছে; এমন কল্যাণ ও অনিষ্টের (দৃশ্য) আমি কখনোই দেখি নি।
বুখারী শরীফে এমনই আরেকটি রেওয়ায়েতের উল্লেখ পাওয়া যায়। (এটি) হযরত আবু মূসা (রা.)-এর পক্ষ থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি (রা.) বলেন, মহানবী (সা.)-কে কতিপয় এমন বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে তা তিনি পছন্দ করেন নি। অনেক বেশি প্রশ্ন করা হলে তিনি (সা.) অসন্তুষ্ট হন এবং লোকদের উদ্দ্যেশে বলেন, তোমরা আমাকে যা খুশি জিজ্ঞেস কর। তখন জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে, আমার পিতা কে? প্রত্যুত্তরে তিনি (সা.) বলেন, তোমার পিতা হুযাফা। অতঃপর আরেকজন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমার পিতা কে? জবাবে তিনি (সা.) বলেন, শায়বার মুক্ত ক্রীতদাস সালেম তোমার পিতা। হযরত উমর (রা.) যখন মহানবী (সা.)-এর পবিত্র চেহারার এই পরিবর্তন লক্ষ্য করেন তখন তিনি বলেন, হে রসূলুল্লাহ্ (সা.)! মহাসম্মানিত ও প্রতাপান্বিত আল্লাহ্র সমীপে আমরা নিজেদের ভুলত্রæটি হতে তওবা করছি। এরপর বুখারী শরীফেরই আরেকটি রেওয়ায়েত রয়েছে যাতে যুহ্রী বর্ণনা করেন, হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) আমাকে বলেছেন, রসূলুল্লাহ্ (সা.) বাইরে এলে হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন হুযাফা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমার পিতা কে? তিনি (সা.) বলেন, তোমার পিতা হুযাফা। এরপর তিনি (সা.) অনেকবার বলেন, আমাকে জিজ্ঞেস কর। তখন হযরত উমর (রা.) নতজানু হয়ে নিবেদন করেন, আমরা এতে সন্তুষ্ট যে, আল্লাহ্ আমাদের প্রভু, ইসলাম আমাদের ধর্ম এবং মুহাম্মদ (সা.) আমাদের নবী। এরপর তিনি (সা.) নীরব হয়ে যান।
হযরত আবু কাতাদা আনসারী (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ্ (সা.)-কে তাঁর রোযা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। বর্ণনাকারী বলেন, রসূলুল্লাহ্ (সা.) এতে অসন্তুষ্ট হন। তখন হযরত উমর (রা.) বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের প্রভু, ইসলাম আমাদের ধর্ম এবং মুহাম্মদ (সা.) আমাদের রসূল আর আমাদের বয়আত যে প্রকৃত বয়আত তাতেই আমরা সন্তুষ্ট ।
সহীহ্ বুখারীতে আরেকটি রেওয়ায়েত রয়েছে। (তাতে বর্ণিত হয়েছে যে,) হযরত উমর (রা.) একবার মহানবী (সা.)-এর নিকট আসেন, তখন তিনি (সা.) এক বালাখানায় অবস্থান করছিলেন। হযরত উমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমি তাঁর কাছে গিয়ে কী দেখলাম! তিনি একটি চাটাইয়ের ওপর শুয়ে আছেন আর তাঁর এবং চাটাইয়ের মাঝে কোন বিছানা নেই। তাই চাটাই তার পাশর্^দেশে দাগ ফেলে দিয়েছে। তিনি খেজুরের আশ ভরা একটি চামড়ার বালিশের ওপর হেলান দিয়ে বসে আছেন। আমি মহানবী (সা.)-এর ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখি, আল্লাহ্র কসম! তিনটি কাঁচা চামড়া ছাড়া সেখানে আর কিছুই দেখতে পাই নি। তখন আমি মহানবী (সা.)-কে বলি, দোয়া করুন যেন আল্লাহ্ আপনার উম্মতকে স্বাচ্ছন্দ্য দান করেন। কেননা পারস্যবাসী এবং রোমানদেরকে অনেক সম্পদ দেয়া হয়েছে আর তারা জাগতিক (স্বাচ্ছন্দ্য) লাভ করেছে, অথচ তারা আল্লাহ্র ইবাদত করে না। মহানবী (সা.) হেলান দিয়ে বসেছিলেন। (এ অবস্থাতেই) তিনি (সা.) বলেন, হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এখনো সন্দেহে নিপতিত? তারা এমন লোক যাদেরকে এই পার্থিব জীবনেই স্বল্পসময়ে তাদের পছন্দের জিনিস দেয়া হয়েছে। তখন আমি বলি, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমার ক্ষমার জন্য দোয়া করুন।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, একবার হযরত উমর (রা.) তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখলেন, ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। তিনি একটি চাটাইয়ের ওপর শুয়ে আছেন আর চাটাইয়ের দাগ তাঁর পিঠে লেগে আছে। এটি দেখে হযরত উমর (রা.)-এর কান্না পায়। তখন তিনি বলেন, হে উমর! তুমি কাঁদছো কেন? উত্তরে হযরত উমর (রা.) নিবেদন করেন, আপনার কষ্ট দেখে আমার কান্না পাচ্ছে। কায়সার ও কিসরা কাফের হওয়া সত্তে¡ও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন অতিবাহিত করছে, কিন্তু আপনি এমন কষ্টে দিনাতিপাত করছেন? তখন তিনি (সা.) বলেন, এ পৃথিবী আমার কী কাজের? আমার দৃষ্টান্ত তো সেই আরোহীর ন্যায় যে প্রচন্ড গরমের সময় একটি উটনীতে সফর করে আর দ্বিপ্রহরের তীব্রতা যখন তাকে ভীষণ কষ্ট দেয় তখন সেই আরোহিত অবস্থায়ই বিশ্রামের জন্য একটি গাছের ছায়ায় আরাম করে আর স্বল্পক্ষণ পর সে আবার সেই দাবদাহের মাঝে পথ চলা শুরু করে।
একটি ঘটনা রয়েছে যাতে মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে দোয়া করতে বলেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। হযরত উমর (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.)-এর সমীপে আমি ওমরা পালনের অনুমতি চাইলে তিনি (সা.) আমাকে অনুমতি দিয়ে বলেন, লা তানসানা ইয়া আখী মিন দুআইকা। হে আমার ভাই! আমাকে তোমার দোয়ায় ভুলে যেও না। হযরত উমর (রা.) বলেন, এটি এমন একটি বাক্য যার বিনিময়ে গোটা পৃথিবী পেলেও আমি এতটা খুশি হব না। আরেকটি রেওয়ায়েতে এর শব্দে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে আর তা হলো আশরিকনা ইয়া আখী ফী দুআইক। অর্থাৎ হে আমার ভাই! আমাকেও তোমার দোয়ায় অন্তর্ভুক্ত রেখো।
মহানবী (সা.)-এর সাথে হযরত উমর (রা.)-এর কত গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল তা এই ঘটনা থেকে বুঝা যায়। এ বিষয়টি পূর্বেও একটি খুতবায় বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা (রা.)-কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) যখন ইন্তেকাল করেন তখন হযরত উমর (রা.) এ সংবাদ শুনে দাঁড়িয়ে যান এবং বলেন, আল্লাহ্র কসম! রসূলুল্লাহ্ (সা.) ইন্তেকাল করেন নি। হযরত আয়েশা (রা.) বলতেন, হযরত উমর (রা.) প্রায়শই বলতেন, খোদার কসম! আমার হৃদয়ে এ ধারণাই স্থান পায় যে, আল্লাহ্ অবশ্যই তাঁকে পুনরুত্থিত করবেন, অর্থাৎ মহানবী (সা.)-কে অবশ্যই উত্থিত করবেন যাতে কিছু লোকের হাত-পা কেটে দিতে পারেন। যাহোক, এরপর হযরত আবু বকর (রা.) এসে সূরা আলে ইমরানের ১৪৫ নম্বর পাঠ করলে হযরত উমর (রা.)কে প্রকৃত বিষয়টি বুঝার আহ্বান জানান এবং এরপর বিষয়ের অবসান ঘটে। এ সম্পর্কে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন,
মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুতে সাহাবীদের ইজমাও এ বিষয়েই হয়েছে যে, সব নবী মৃত্যুবরণ করেছেন। এর কারণটি হলো, মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুতে হযরত উমর (রা.)-এর মনে এ ধারণা সৃষ্টি হয় যে, তিনি (সা.) এখনো জীবিত এবং পুনরায় আবির্ভূত হবেন। তাঁর এই বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় ছিল যে, তিনি সেই ব্যক্তির শিরোচ্ছেদের জন্যও প্রস্তুত ছিলেন যে এর বিরুদ্ধে কথা বলবে। কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এসে যখন সকল সাহাবীর সামনে ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রসূলুন ক্বাদ খালাত মিন ক্বাবলির্হি রুসুল আয়াত পড়লেন তখন হযরত উমর (রা.) বলেন, (এটি শুনে) আমার পা কেঁপে উঠে এবং শোকাভিভূত হয়ে আমি মাটিতে পড়ে যাই। অন্য সাহাবীরা বলেন, আমাদের কাছে মনে হলো এ আয়াতটি যেন আজই অবতীর্ণ হয়েছে। সেদিন আমরা এই আয়াতটি অলিগলি ও বাজারে পড়ে বেড়াই। অতএব কোন নবী যদি জীবিত থাকতেন তাহলে এই দলিল যুক্তিযুক্ত হতো না যে, সকল নবী মৃত্যুবরণ করেছেন, তিনি (সা.) কেন ইন্তেকাল করবেন না? হযরত উমর (রা.) বলতে পারতেন, আপনি কেন ধোঁকা দিচ্ছেন? হযরত ঈসা (আ.) তো এখনো আকাশে জীবিত বসে আছেন। তিনি জীবিত থাকলে আমাদের নবী (সা.) কেন জীবিত থাকতে পারবেন না? কিন্তু সকল সাহাবীর নীরবতা এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, সকল সাহাবীরই বিশ্বাস ছিল, হযরত ঈসা (আ.) মৃত্যুবরণ করেছেন। এ সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-ও লিখেছেন যা ইতোপূর্বে একটি খুতবায় আমি বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।
হযরত উমর (রা.) কীভাবে মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ করতেন সে সম্পর্কে হযরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলে করীম (সা.) হাজরে আসওয়াদ-এর দিকে মুখ করে দাঁড়ানোর পর তাতে ঠোঁট রেখে দেন এবং দীর্ঘক্ষণ কাঁদতে থাকেন। তিনি (সা.) ফিরে তাকিয়ে হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.)কেও কাঁদতে দেখেন। মহানবী (সা.) বলেন, হে উমর! এটি সেই জায়গা যেখানে অশ্রæ বিসর্জন দেয়া হয়। আবেস হযরত উমর (রা.)-এর বরাতে বর্ণনা করেন, তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছে এসে সেটিকে চুমু খেয়ে বলেন, আমি ভালোভাবে জানি, তুমি একটি পাথরমাত্র, অপকার বা উপকার কিছুই করতে পার না। আমি যদি নবী (সা.)-কে তোকে চুমু খেতে না দেখতাম তবে আদৌ তোকে চুমু খেতাম না। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, হযরত উমর (রা.) একবার তাওয়াফ করছিলেন। হাজরে আসওয়াদের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাতে তিনি তার লাঠি দিয়ে স্পর্শ করে বলেন, আমি জানি তুমি এক পাথরমাত্র, তোমাতে কোন শক্তিই নেই। কিন্তু আমি কেবল খোদার নির্দেশের অধীনেই তোমাকে চুম্বন করি। একত্ববাদের এই প্রেরণাই তাকে জগতে মহীয়ান করেছে। তিনি এক খোদার তৌহীদ তথা একত্ববাদের পূর্ণ প্রেমিক ছিলেন। তিনি এটি সহ্য করতে পারতেন না যে, তাঁর শক্তিমত্তায় অন্য কাউকে অংশীদার করা হবে, অর্থাৎ খোদা তা’লার শক্তিমত্তায়। নিঃসন্দেহে তিনি ‘হাজরে আসওয়াদ’-এর সম্মানও করতেন, কিন্তু তা খোদা তা’লার নির্দেশ মনে করে করতেন। এ কারণে নয় যে, ‘হাজরে আসওয়াদ’-এর কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল, খোদা তা’লা যদি আমাদের কোন তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ বস্তুকেও চুমু খাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন, তাহলে আমরা সেটিকে চুমু খাওয়ার জন্যও প্রস্তুত আছি, কেননা আমরা খোদা তা’লার বান্দা, কোন পাথর বা জায়গার বান্দা নই। অতএব তিনি সম্মানও করতেন আর তৌহীদকেও ভুলে যেতেন না। আর এটিই এক সত্যিকার মু’মিনের বৈশিষ্ট্য। এক প্রকৃত মু’মিন বায়তুল্লাহ্কে তেমনই পাথরের এক ঘর মনে করে যেভাবে পৃথিবীতে আরো হাজারো পাথর-নির্মিত ঘর রয়েছে। এক সত্যিকার মু’মিন ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে সেভাবেই পাথর মনে করে যেভাবে পৃথিবীতে আরও কোটি কোটি পাথর রয়েছে, কিন্তু সে বায়তুল্লাহ্র সম্মানও করে, সে ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে চুমুও খায়, কেননা সে জানে যে, আমার প্রভু আমাকে এসব জিনিসের সম্মান করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু যদিও সে এ স্থানের সম্মানে ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে চুমু খায়, তথাপি সে পূর্ণ আস্থার সাথে এই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত যে, আমি এক খোদার বান্দা, কোন পাথরের বান্দা নই। এটিই ছিল সেই বাস্তবতা যার প্রকাশ হযরত উমর (রা.) করেছেন। তিনি ‘হাজরে আসওয়াদ’-কে লাঠি দিয়ে আঘাত করে বলেন, তোমার কোন গুরুত্ব আছে বলে আমি মনে করি না। তুমি তেমনই এক পাথর যেভাবে আরো কোটি কোটি পাথর পৃথিবীতে দেখা যায়, কিন্তু আমার প্রভু নির্দেশ দিয়েছেন যেন তোমার সম্মান করা হয়, তাই আমি (তোমার) সম্মান করি। এ কথা বলে তিনি অগ্রসর হন আর সেই পাথরটিকে চুমু খান। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর বর্ণনা করেন যে, হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) মহানবী (সা.)-কে সেই সময় (একটি) প্রশ্ন করেন যখন কিনা তিনি তায়েফ থেকে ফিরে আসার পর জেরানায় অবস্থানরত ছিলেন, তিনি নিবেদন করেন যে, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমি অজ্ঞতার যুগে মসজিদুল হারাম-এ এক দিন এ’তেকাফ করার মানত করেছিলাম, (এ সম্পর্কে) আপনার নির্দেশ কী? তিনি (সা.) বলেন, যাও এবং এক দিনের এ’তেকাফ কর। বৈধ মানত যে যুগেই হোক না কেন তা পূর্ণ করা উচিত এই শিক্ষা মহানবী (সা.) প্রদান করেছেন। অতঃপর বর্ণনাকারী বলেন, একবার আল্লাহ্র রসূল (সা.) তাকে খুমুস বা গনিমতের এক মেয়ে প্রদান করেন। মহানবী (সা.) যখন মানুষের বন্দিদের মুক্ত করে দেন আর হযরত উমর এমর্মে তাদের আওয়াজ শুনতে পান যে আমাদেরকে মহানবী (সা.) মুক্ত করে দিয়েছেন, তখন হযরত উমর জিজ্ঞেস করেন যে, কী হয়েছে? তারা বলে, মহানবী (সা.) মানুষের বন্দিদের মুক্ত করে দিয়েছেন। তখন হযরত উমর নিজের পুত্র আবদুল্লাহকে বলেন, হে আব্দুল্লাহ্! তুমি সেই মেয়ের কাছে যাও যাকে মহানবী (সা.) দান করেছিলেন আর তাকে স্বাধীন করে দাও।
হযরত হুযায়ফা মহানবী (সা.)-এর বিশ্বস্ত সাহাবী বলে পরিগণিত ছিলেন। হযরত হুযায়ফা (রা.) তাবুকের যুদ্ধের সময়ের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) নিজ বাহন (তথা উটনী) থেকে অবতরণ করলে তাঁর ওপর ওহী অবতীর্ণ হয়। (তখন) তাঁর (সা.) বসে থাকা বাহন (তথা উটনী) দাঁড়িয়ে যায় এবং সেটি নিজ লাগাম টানতে থাকে। আমি সেটির লাগাম ধরে ফেলি এবং মহানবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেই। এরপর আমি সেই উটনীর কাছে বসে থাকি যতক্ষণ না মহানবী (সা.) দন্ডায়মান হন। এরপর আমি সেই উটনীকে তাঁর কাছে নিয়ে যাই। তিনি (সা.) জিজ্ঞেস করেন, কে? আমি উত্তরে বলি, হুযায়ফা। মহানবী (সা.) বলেন, আমি তোমাকে একটি গোপন কথা বলব, তুমি কিন্তু সেটি কাউকে বলবে না। আমাকে অমুক অমুক ব্যক্তির জানাযার নামায পড়তে নিষেধ করা হয়েছে আর (তখন) তিনি (সা.) মুনাফেকদের একটি দলের নাম উল্লেখ করেন। মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর হযরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে যখন কোন ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করত আর যার সম্পর্কে হযরত উমর মনে করতেন যে, সে মুনাফেক-দলের অন্তর্ভুক্ত, তখন তিনি হযরত হুযায়ফা (রা.)-এর হাত ধরে জানাযার নামায পড়ার জন্য সাথে নিয়ে যেতেন। হযরত হুযায়ফা (রা.) যদি সাথে যেতেন তাহলে হযরত উমর (রা.)ও সেই ব্যক্তির জানাযা পড়তেন। আর যদি হযরত হুযায়ফা নিজের হাত হযরত উমর (রা.)-এর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতেন তাহলে হযরত উমর (রা.)ও তার জানাযার নামায পড়তেন না।
হযরত উমর (রা.)-এর মহানবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী আক্ষরিক অর্থে পূর্ণ করা সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বর্ণনা করেন যে, হযরত উমর (রা.) যিনি সততা ও নিষ্ঠায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি এমন স্বাদ লাভ করেছেন যে, পরবর্তীতে দ্বিতীয় খলীফা হয়েছেন। মোটকথা এভাবে সকল সাহাবী পুরো সম্মান লাভ করেছেন। রোম ও পারস্য সম্রাটে ধনসম্পদ ও রাজকন্যারা তাদের হস্তগত হয়েছে। এ বিষয়ে লিখিত আছে যে, একজন সাহাবী পারস্য সম্রাটের দরবারে যান। সম্রাটের ভৃত্যরা সোনা-রুপার চেয়ার বিছিয়ে দেয় আর নিজেদের জাঁকজমক প্রদর্শন করে। তিনি বলেন, আমরা এই ধনসম্পদে লালায়িত নই। আমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে, পারস্য সস্রাটের হাতের বালাও আমাদের হস্তগত হবে। অতএব হযরত উমর (রা.) সেই বালাগুলো এক সাহাবীকে পরিধান করান, যেন সেই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বর্ণনা করেন যে, স্বর্ণ পরিধান করা পুরুষদের জন্য বৈধ নয়। কিন্তু হযরত উমর (রা.) পারস্য সম্রাটের হাতের বালা একজন সাহাবীকে পরিয়েছেন। যখন তিনি তা পরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তখন তাকে তিনি ভর্ৎসনা করে বলেন, মহানবী (সা.) বলেছিলেন যে, তোমার হাতে আমি পারস্য সম্রাটের হাতের বালা দেখতে পাচ্ছি। অনুরূপভাবে এক উপলক্ষ্যে পারস্য সম্রাটৈর মাথার মুকুট ও তার রেশমী পোশাক যখন গনিমতের মাল হিসেবে আসে, তখন হযরত উমর (রা.) এক ব্যক্তিকে সেই মুকুট ও পোশাক পরার আদেশ দেন। সে যখন তা পরে নেয় তখন তিনি কেঁদে ফেলেন এবং বলেন, কিছুদিন পূর্বেও পারস্য সম্রাট এই পোশাক পরে এবং এই মুকুট পরিধান করে ইরানে স্বৈরাচারমূলক শাসন করত আর আজ সে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। জগতের অবস্থা এমনই হয়ে থাকে। হযরত উমর (রা.)-এর এই কাজ বাহ্যিকতার পূজারীদের কাছে হয়ত সঠিক মনে হবে না, কেননা রেশম ও স্বর্ণ পরিধান করা পুরুষদের জন্য বৈধ নয়, কিন্তু একটি পুণ্য বিষয় বুঝানো আর উপদেশ দেয়ার জন্য হযরত উমর (রা.) এক ব্যক্তিকে কয়েক মিনিটের জন্য স্বর্ণ ও রেশম পরিধান করিয়েছিলেন। মোটকথা আল্লাহ্র তাকওয়া-ই হলো প্রকৃত মূল জিনিস। সব নির্দেশাবলী আল্লাহ্র তাকওয়া সৃষ্টির জন্য হয়ে থাকে। আল্লাহ্র তাকওয়া অর্জনের জন্য কোন জিনিস, যা বাহ্যত ইবাদত মনে হয়, যদি পরিত্যাগ করতে হয় তাহলে তা-ই পুণ্যের কারণ হবে।
হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) বলেন, আমাকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে যে, আমি এক ক‚পের পাশে দাঁড়িয়ে চরকায় বাঁধা বালতি দিয়ে পানি টেনে বের করছি। এরই মাঝে হযরত আবু বকর (রা.) আসেন আর তিনি এক বা দুই বালতি পানি এমনভাবে টেনে বের করেন যে, তাঁর টানাতে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছিল। আল্লাহ্ তাঁর দুর্বলতা ঢেকে রাখবেন এবং তাকে ক্ষমা করবেন। এরপর উমর বিন খাত্তাব (রা.) আসেন আর সেই বালতিটি এক বড় বালতিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তখন আমি এমন শক্তিশালী কাউকে দেখি নি, যে এমন আশ্চর্যজনক কাজ করেছে যেমনটি হযরত উমর (রা.) করেছেন। (তিনি) এত পানি বের করেন যে, মানুষ পরিতৃপ্ত হয়ে যায় আর স্ব স্ব স্থানে গিয়ে বসে পড়ে। হযরত ইবনে উমর বলেন, আমি মহানবী (সা.) এর কাছে শুনেছি যে, তিনি বলতেন, একদা ঘুমন্ত অবস্থায় আমার কাছে একটি দুধের পেয়ালা আনা হয় আর আমি এতটা পান করি যে, আমি এর সতেজতা বা তরলতা নিজ নখ দিয়ে নিঃসরিত হতে দেখি। অতঃপর আমি আমার অবশিষ্ট দুধটুকু হযরত উমর বিন খাত্তাবকে প্রদান করি। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আপনি এর কী ব্যাখ্যা করেছেন। মহানবী (সা.) বলেন, জ্ঞান। হযরত যয়নুল আবেদীন ওলীউল্লাহ্ শাহ সাহেব এ হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘ফাযলুল ইলম’ এর অর্থ এ স্থলে জ্ঞানের মাহাত্ম্য নয়, বরং জ্ঞানের অবশিষ্টাংশ। জ্ঞানের মাহাত্ম্য সম্পর্কে পৃথক অধ্যায় গঠন করা হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর স্বপ্ন এবং এর ব্যাখ্যা দ্বারা; অধিকন্তু সেসব ঘটনা দ্বারা, যেগুলোর মাধ্যমে এ স্বপ্নের সত্যায়ন হয়, এটা প্রমাণ করা উদ্দেশ্য যে, পার্থিব বিজয় এবং মাহাত্ম্য যা মুসলমানরা হযরত উমর (রা.)-এর মাধ্যমে অর্জন করেছে, সেটি নবুওয়্যতের জ্ঞানের অবশিষ্ট অংশ ছিল, যা হযরত উমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে লাভ করেছিলেন। কুরআন মজীদে মহানবী (সা.)-কে তাঁর উক্ত পূর্ণাঙ্গীন মর্যাদার কারণে ‘মাজমাঊল বাহরাইন’ অর্থাৎ ইহজাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণসংক্রান্ত জ্ঞানের সমাহার আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইমাম বুখারী রাজনীতিকে আল-ইলম এর মাঝে অন্তর্ভূক্ত করে এদিকে ইঙ্গিত করেছেন যে, মহানবী (সা.) পরিপূর্ণ সত্য এনেছেন যা মানুষের দুই জগতের কল্যাণকে পরিবেষ্টন করে আছে। যেভাবে মসীহ্ (আ.) তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, যখন সেই রূহুল হক (বা সত্যের রূহ) আসবেন তখন তিনি পরিপূর্ণ সত্য নিয়ে আসবেন। (যোহন, অধ্যায় ১৬, শ্লোক ১২)
হযরত উমর (রা.)-এর ঘটনাবলী অধ্যয়ন করলে এই অবশিষ্ট দুধের প্রকৃত সত্য জানা যায় যা তিনি মহানবী (সা.)-এর কল্যাণভান্ডার থেকে তিনি পান করেছেন। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, মহানবী (সা.)-এর সম্মুখে একবার হযরত উমর (রা.) স্বপ্নে দুধের পেয়ালা লাভের উল্লেখ করেন। তখন তিনি (সা.) বলেন, এর অর্থ হলো ‘জ্ঞান’।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছি, তিনি (সা.) বলতেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি দেখলাম লোকজনকে আমার সম্মুখে উপস্থিত করা হয়েছে আর তারা জামা পরিধান করে আছে। তাদের কয়েকজনের জামা বুক পর্যন্ত পৌঁছায় আর কয়েকজনের এর নীচ পর্যন্ত। আর উমর (রা.)-কেও আমার সামনে উপস্থিত করা হয়। তিনি জামা পরিধান করে ছিলেন, যা তিনি হেঁচড়ে চলছিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, আপনি এর কী অর্থ করেছেন? তিনি (সা.) বলেন, এর অর্থ ‘ধর্ম’।
মহানবী (সা.) একবার বিভিন্ন সাহাবীর বিশেষত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত উমর (রা.) সম্পর্কে বলেন, আমার উম্মতে আল্লাহ্র ধর্মের ব্যাপারে সবচেয়ে দৃঢ় হলেন উমর। হযরত মালেক বিন আগওয়াল থেকে বর্ণিত, হযরত উমর (রা.) বলেন, তোমার হিসাব গ্রহণের পূর্বেই আত্মপর্যালোচনা কর, কেননা এটি তুলনামূলকভাবে সহজ, অথবা বলেছেন, তোমাদের হিসাবের ক্ষেত্রে অধিক সহজ। আর তোমাকে ওজন করার পূর্বে নিজ প্রবৃত্তির ওজন কর এবং সর্বাগ্রে সবচেয়ে বড় জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর। یَوۡمَئِذٍ تُعۡرَضُوۡنَ لَا تَخۡفٰی مِنۡکُمۡ خَافِیَۃٌ (সূরা আল হাক্কা: ১৯) অর্থাৎ, সেদিন তোমাদেরকে (আল্লাহ্র সম্মুখে) উপস্থিত করা হবে এবং (কোন) গোপন বিষয় তোমাদের কাছে গোপন থাকবে না।
হযরত হাসান (রা.) যখন হযরত উমর (রা.)-এর উল্লেখ করতেন তখন বলতেন, আল্লাহ্র কসম! যদিও তিনি প্রথমে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না আর আল্লাহ্র রাস্তায় ব্যয়কারীদের মাঝে সর্বোত্তমও ছিলেন না, কিন্তু সংসার বিমুখতায় এবং আল্লাহ্ তা’লার আদেশের ব্যাপারে কঠোরতার ক্ষেত্রে তিনি মানুষের চেয়ে এগিয়েছিলেন। আর আল্লাহ্র বিষয়ে কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে ভয় করতেন না।
হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, আল্লাহ্র কসম! হযরত উমর বিন খাত্তাব যদিও ইসলাম গ্রহণে আমাদের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন না; কিন্তু তিনি কোন্ বিষয়ে আমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন তা আমি উদঘাটন করেছি তিনি আমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি পুণ্যবান এবং জগতবিমুখ ছিলেন।
হিশাম বিন উরওয়া তার মায়ের বরাতে বর্ণনা করেন, যখন হযরত উমর (রা.) সিরিয়ায় আসেন তখন তার জামা পিছন দিক থেকে ছেড়া ছিল। সেটি এক মোটা ও সুমবুলানী (ইরানী) জামা ছিল। সুমবুলানী হলো এমন দীর্ঘ জামা যা, মাটির সাথে লেগে থাকে আর কথিত আছে এ ধরনের জামা রোমানরাও পরিধান করত। যাহোক তিনি এই জামা আযরিয়াত বা এ্যয়লাবাসীদের নিকট প্রেরণ করেন। এটিও সিরিয়ার পথে একটি শহর, আর এই এ্যয়লা সিরিয়ার নিকটবর্তী ও লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি শহর। যাহোক বর্ননাকারী বলেন, সে সেই জামা ধৌত করে এবং এতে তালি লাগিয়ে দেয় এবং হযরত উমর (রা.)-এর জন্য একটি কুবতরি জামাও প্রস্তুত করায়। কুবতরি হলো তুলার তৈরী সাদা ও পাতলা কাপড়। অতঃপর সেই উভয় জামা নিয়ে সে হযরত উমর (রা.)-এর কাছে আসে এবং তার সামনে কুবতরি জামা উপস্থাপন করে। হযরত উমর সেই জামাটি নেন এবং সেটিকে ছুয়ে দেখেন আর বলেন, এটি বেশি মোলায়েম। আর সেটি সেই ব্যক্তির প্রতি ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, আমাকে আমার জামা দিয়ে দাও, কেননা সেটি সব জামার মাঝে সবচেয়ে বেশি ঘাম শোষণকারী। অর্থাৎ, সেই ছেঁড়া জামা, যেটিতে তুমি তালি লাগিয়েছ সেটিই উত্তম।
হযরত আনাস বিন মালেক বর্ণনা করেন, আমি হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.)-কে সেই সময় দেখেছি যখন তিনি আমীরুল মু’মিনীন ছিলেন। তখন তার জামায় কাঁধের মাঝামাঝি চামড়ার তিনটি তালি লাগানো ছিল। অপর এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি হযরত উমর (রা.)-এর জামায় কাঁধের মাঝামাঝি চামড়ার চারটি তালি দেখেছি।
যাহোক হযরত উমর সংক্রান্ত এই বর্ণনা এখনও চলছে, ইনশাআল্লাহ্ আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। এখন আমি একজন মরহুমের স্মৃতিচারণ করতে চাই এবং জুমুআর নামাযের পর তার জানাজাও পড়াব, ইনশাআল্লাহ্।
এই স্মৃতিচারণ ডাক্তার তাসীর মুজতবা সাহেবের, যিনি ফযলে উমর হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন। কিছুদিন পূর্বে সত্তর বছর বয়সে তিনি মৃত্যু বরণ করেন, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। তার বিভিন্ন রোগ ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই তিনি অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায় এবং তিনি মৃত্যু বরন করেন, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। ডাক্তার সাহেবের পরিবারে আহমদীয়াত আসে তার পিতার কাযিন হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাহাবী সৈয়দ ফখরুল ইসলাম সাহেবের মাধ্যমে। কিন্তু ডাক্তার তাসীর মুজতবা সাহেবের পিতা গোলাম মুজতবা সাহেব তার ছাত্রজীবনে ১৯৩৮ সনে বয়আত গ্রহণ করেন। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সালেস যখন নুসরত জাহাঁ স্কীমের অধীনে জীবন উৎসর্গ করার আহ্বান জানান তখন ডাক্তার তাসীর সাহেবের পিতা ডাক্তার গোলাম মুজতবা সাহেব করাচীতে সিভিল সার্জন হিসেবে কার্মরত ছিলেন। উক্ত তাহরীকে সাড়া দিতে তিনি সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন আর ওয়াকফ করে ১৯৭০ সালে আফ্রিকা চলে যান এবং ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সেখানে অর্থাৎ ঘানা, নাইজেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে সেবা প্রদান করেন। মেডিসিন বিষয়ে নিজের পড়শোনা শেষে ডাক্তার তাসীর মুজতবা সাহেবও প্রায় দুই বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। অতঃপর করাচী সিভিল হাসপাতালে কাজ করেন। এরপর করাচীর জিন্নাহ্ হাসপাতালে কিছুকাল কর্মরত থাকেন। ১৯৮২ সালে তিনি তিন বছরের জন্য জীবন ওয়াকফ করলে তাকে ঘানা প্রেরণ করা হয়। সেখানে টিচিমান নামে একটি হাসপাতালে তিনি কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে তিনি কোরে হাসপাপতালে সেবা করার তৌফিক লাভ করেন, যা মূলত তার পিতাই আরম্ভ করেছিলেন। তিনি তার পিতার সাথে তিন বছর কাজ করেন আর তার কাছ থেকেই সার্জারি শিখেছেন। তিনি খুবই দক্ষ সার্জন ছিলেন। ঘানায় ডাক্তার তাসীর সাহেব প্রায় ২৩ বছর কাজ করার তৌফিক লাভ করেছেন।
এরপর তিনি রাবওয়ার ফজলে উমর হাসপাতালে ১৭ বছর সেবাদানের সৌভাগ্য লাভ করেছেন এভাবে মোট ৪০ বছর তিনি সেবাদানের সৌভাগ্য পেয়েছেন। সৈয়দ দাউদ মুযাফফর শাহ সাহেব এবং সাহেবযাদী আমাতুল হাকীম সাহেবার কন্যা আমতুর রউফ সাহেবার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাহেবযাদী আমাতুল হাকীম সাহেবা হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.)-এর কণ্যা ছিলেন। ডাক্তার সাহেবের এক পুত্র এবং এক কন্যাসন্তান রয়েছে।
তাঁর সহধর্মিণী আমাতুর রঊফ সাহেবা বলেন, অসুস্থতার সময় আমি যখন তাঁকে দেখতে গিয়েছি তখন তিনি বলেন, হুযূরকে আমার পক্ষ থেকে সালাম দিবে (অর্থাৎ আমাকে সালাম দিয়েছে) আর তাঁর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন চিরবিদায়ের সালাম দিচ্ছেন। এরপর তিনি লেখেন, ঘানায় তিনি একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। অতি কষ্টে রাত পার করেন। খুবই ভয়াবহ অবস্থা ছিল। ফজরের সময় বললেন, কেউ সালাম দিয়েছে, দেখ তো কে? আমি বললাম, দরজা বন্ধ, কারও তো ভিতরে আসার সুযোগ নেই। এক ঘণ্টা পর তিনি পুনঃরায় বললেন, আমি সালাম দিতে শুনেছি, কেউ সালাম দিয়েছে আর এরপর থেকেই তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান। এটি ঘানার ঘটনা। তিনি বলেন, আমি তার জন্য দোয়া করি, আর আমাকে বলা হয়েছে যে, তিনি দীর্ঘায়ূ লাভ করবেন। তিনি অতি বিনয়ী, নিঃস্বার্থ ও নিরীহ মানুষ ছিলেন। কখনও কারও দোষ বলে বেড়ান নি, পরচর্চা ও কারো বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেন নি। অন্যকে এসব করতে দেখলে তিনি চুপ থাকতেন।
ডাক্তার সাহেবের ভাই লেখেন, আমরা দেখেছি, ছুটির পরও তিনি রোগী দেখতেন। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, অন্যান্য ডাক্তাররা যেহেতু রোগী কম দেখে তাই যেসব রোগী হাসপাতালে আসে তারা বিনা চিকিৎসায় ফেরত চলে যাবে-এই ভেবে আমি তাদেরকে দেখি এবং অন্যান্য ডাক্তারদের বোঝা নিজের ওপর চাপিয়ে নিই। খুবই ভদ্র এবং স্বল্পভাষী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। নিরাপত্তা কর্মী এবং হাসপাতালের কর্মীরা বলেন, সদা হাস্যবদনে কুশলাদী জিজ্ঞেস করে তবেই যেতেন। রোগীদের সাথে আর বিশেষত আহমদীদের সাথে তিনি অতি উত্তম ব্যবহার করতেন আর হাসপতালের সময়ের বাইরে কেউ ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছে গেলে প্রায়শ তিনি ফিস না নিয়েই তাদেরকে দেখতেন। রাবওয়ার জামেয়া আহমদীয়ার প্রিন্সিপাল মোবাশে^র সাহেব লেখেন, বিভিন্ন সময় তাঁর সাথে আমার বসার সুযোগ হয়েছে। তিনি খুবই স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন, খুব ন¤্রভাবে, উদার মনে আর ভালবাসার সাথে এবং বিনীতভাবে কথা বলতেন। এমন বিনয়, ন¤্রতা এবং সরলপনা আমি আর কারও মাঝে দেখি নি। তিনি বলেন, আমি হাসপালের লোকদের কাছেও শুনেছি বিশেষ করে দরিদ্রদের কাছে শুনেছি আর এমন এমন ঘটনা শুনেছি যে, ঈর্ষাও হত আবার সুখানুভূতিও হত যে, হাসপাতালে এমন ডাক্তারও আছেন! তিনি আরও বলেন, (পূর্বে যেভাবে উল্লেখ করেছি) ডাক্তার সাহেব রোগী দেখতেন বরং অনেক সময় হাসপাতালের কর্মদিবস শেষ হলে ডাক্তার সাহেব উঠে বাইরে চলে এসেছেন অথবা নিজের রুম থেকে বাইরে বের হওয়ার সময় কোন রোগী এসে যেত তখন তিনি সেই রোগীকে এমনভাবে নিজের রুমে নিয়ে যেতেন যেন তিনি তারই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি দরিদ্রদের প্রতি পরম দয়াদ্র ছিলেন।
জার্মানির হিউমিনিটি ফাষ্টের চেয়ারম্যান আতহার যুবায়ের সাহেব বলেন, আমি যখন ২০০৪ সালে আফ্রিকা সফরে যাই তখন আমার সাথে ডাক্তার সাহেব ঘানায় এবং অন্যান্য স্থানে আমার সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি বেনিনেও আমার সাথে গিয়েছিলেন। আতহার যুবায়ের সাহেব বলেন, ডাক্তার সাহেব কোন এক মহিলাকে বিচলিত দেখতে পেলেন। ডাক্তার সাহেব আমাকে বললেন, তাকে জিজ্ঞেস করুন- সমস্যা কী? সেই মহিলা বলেন, আমি খলিফাতুল মসীহ্র সাথে সাক্ষাত করতে এসেছি আর আমার কাছে যা-ই ছিল, আমি তা ব্যয় করে ফেলেছি, আমার কাছে ফিরে যাওয়ার পয়সা নেই। তখন ডাক্তার সাহেব বলেন: ঠিক আছে, তাকে ত্রিশ হাজার ফ্রাঙ্কসিফা (আফ্রিকার স্থানীয় মুদ্রা) দিয়ে দাও। তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন, সেই সময়, সেই যুগে তা প্রায় একজন সাধারণ মানুষের এক মাসের উপার্জনের সমপরিমান অর্থ ছিল যা ডাক্তার সাহেব তৎক্ষণাৎ প্রদান করেন।
হানিফ মাহমুদ সাহেব-ও লিখেছেন, তিনি নিতান্তই মধ্যমপন্থা অবলম্বনকারী ও বিনয়ী ছিলেন। তিনি ওয়যাকফে জিন্দেগীদের সাথে অনেক ভালোবাসা ও আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করতেন। একবার তার (মাহমুদ সাহেবের) স্ত্রী অসুস্থ হলে (ডাক্তার সাহেব) তার চিকিৎসা করেন বরং তিনি (অর্থাৎ মাহমুদ সাহেব) বলেন, আমরা তো কেবল পরামর্শের জন্য গিয়েছিলাম রোগী দেখাতে যাই নি। তিনি জিজ্ঞেস করেন যে টিকেট কোথায়, আমরা বললাম আমাদের টিকিট কাটা হয় নি, তিনি (অর্থাৎ ডাক্তার সাহেব) তৎক্ষণাৎ তার অধিনস্তকে ডেকে তার পকেট থেকে একশত টাকা বের করে তার বা মাহমুদ সাহেবের স্ত্রীর জন্য টিকিট কেটে আনতে দেন। আমাদের বারবার অনুরোধ করার পরও তিনি টাকা নেন নি। নিষ্পাপ চেহারায়, মানুষের বেশে মূর্তিমান একজন ফিরিশতা ছিলেন। স্বল্পভাষী নীরব প্রকৃতির মানুষ ছিলেন আর মসজিদে মুবারকে নামায পড়তে আসার সময়ও নীরবে এসে দীর্ঘ নামায আদায় করতেন।
মূত্ররোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মুজাফ্ফর চৌধুরী সাহেব যিনি এখানে ইউ.কে-তে থাকেন, তিনিও সেখানে ওয়াকফে আরযিতে গিয়ে থাকেন। শান্ত স্বভাবের, অত্যন্ত দয়ালু এবং সহানুভূতিশীল একজন মানুষ ছিলেন। নতুন নতুন জিনিস শেখার প্রতি (ডাক্তার সাহেবের) অনেক অগ্রহ ছিল যেন লোকদের সাহায্য করতে পারেন এবং তিনি বলেন, আমি যখন ওয়াকফে আরযিতে গিয়েছিলাম, তখন আমি তার দপ্তরে বসতাম আর তিনি নিজের চেয়ারে আমাকে বসাতেন এবং ‘আপনি নিজের চেয়ারে বসুন’- তাকে এ অনুরোধ করা সত্তে¡ও তিনি অন্য কোথাও গিয়ে বসে যেতেন।
রাবওয়ার আওয়াল তাহরীকে জাদীদ উকিলুল মাল লুকমান সাহেব বলেন, তিনি আনেক গুণের আধিকারী ছিলেন, আর্থিক কুরবানীর প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল। যখন থেকে পাকিস্তানে এসেছেন, তাহরীকে জাদীদের চাঁদা প্রতিবছর প্রথম দিকে এলানের অনতিপরেই নিজে অর্থ দপ্তরে এসে আদায় করতেন। অতপর তিনি লিখেন, পেশায় তিনি ডাক্তার হলেও সবর্দা মানবতার সেবা করাই তার অভিষ্ট লক্ষ্য বলে দৃষ্টিগোচর হত।
চিকিৎসার প্রয়োজনে, এলোপ্যাথ ব্যতীত অন্যকোন চিকিৎসা অগ্রহণযোগ্য এমন নয়, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাও প্রদান করতেন। আশোকোরে হাসপাতালের বর্তমান ইনচার্য ডাক্তার নঈম সাহেব বলেন, মিশনারী ডাক্তার হিসেবে হাসপাতালে ২১ বছর সেবা করেছেন। তিনি আরও বলেন, আজ তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে অত্র এলাকার, অত্র অঞ্চলের গ্রাম-গঞ্জ থেকে অনেক লোক আসে, ডাক্তার সাহেবের সাথে তাদের বেশ সুসম্পর্ক ছিল, বিশেষ করে তারা সমবেদনা প্রকাশ করছিলেন এবং বলছিলেন, ডাক্তার সাহেব অনেক ভাল মনের অধিকারী, স্বল্পভাষী, নিজের কাজের প্রতি মনোযোগী, দরিদ্রের প্রতি সদয়, খুবই অতিথিপরায়ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অনুরূপভাবে, তার জাগতিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি, জামা’তী বই-পুস্তক ও হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পুস্তাকাদি পাঠের প্রতিও গভীর আগ্রহ ছিল। অতঃপর ডাক্তার (নঈম) সাহেব লিখেন, ডাক্তার সাহেব আহমদীয়া হাসপাতাল আসোকোরেতে সার্জারীর ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অভুতপূর্ব সেবা প্রদান করেছেন যার ফলাফল আজও আমরা সেইসকল রোগীদের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি, যারা পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে এই হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ও রোগমুক্তির উদ্দেশ্যে আসে এবং নিজেদের আফ্রিকান সহজ ভাষায় ‘মুজতবা’ নামের উল্লেখ করেন। যদিও তার নাম ছিল তাসীর মুজতবা তথাপি ডাক্তার মুজতবা নামে সুপরিচিত ছিলেন। তার পিতাও এখানে কিছু দিন সেবাদান করেছেন। পরবর্তীতে সেই নামই প্রসিদ্ধি লাভ করে। তিনি হাসপাতাল প্রাঙ্গনে একটি সুন্দর মসজিদও নির্মাণ করিয়ে ছিলেন।
সর্বোপরি ডাক্তার সাহেব একজন নিঃস্বার্থ এবং সৃষ্টির সেবাকারী মানুষ ছিলেন আর তার পেশাকে তিনি সেই লক্ষ্যেই কাজে লাগিয়েছেন। তার মাঝে এবং তার পিতার মাঝে এই বৈশিষ্ট্য আমি স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেছি যে, অসুস্থদের চিকিৎসা করা ছাড়াও দরিদ্র রোগীদেরকে বিনামূল্যে বিভিন্ন ঔষধের সাথে পথ্যাদির জন্য অর্থও দিতেন বরং দুধ-ডিম এনে রাখতেন আর অসুস্থ রুগীদের দিয়ে বলতেন, তোমাদের দুর্বলতা দূর করার জন্য এগুলো খাওয়া আবশ্যক। ঔষধও বেশি করে দিতেন আর সাথে পথ্যও দিতেন আর বলে দিতেন যে, এগুলো খেলে তোমার স্বাস্থ্য ভাল থাকবে।
ডাক্তার গোলাম মুজতবা সাহেবও ঘানায় অনেক সেবা করেছেন কিন্তু ডাক্তার তাসির মুজতবা সাহেব এই কাজকে আরো গতিশীল করেছেন আর আমি নিজেও কতক সেইসব ঘানিয়ানদের সম্পর্কে অবগত যারা তার অনেক প্রশংসা করতেন। যাহোক, তিনি প্রকৃত ওয়াক্ফের প্রেরণায় সমৃদ্ধ হয়ে সেবা করেছেন আর বিশেষ করে ওয়াকেফে জিন্দেগীদের জন্যও যখনই তিনি সেখানে যেতেন, তাদেরকে বিশেষভাবে দেখতেন আর তাদের চিকিৎসা করতেন এবং নিজের ঘরে থাকার ব্যবস্থাও করতেন।
হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.) যখন সফরে গিয়েছিলেন তখন তিনিও ডাক্তার সাহেবের বাড়িতেই অবস্থান করেছিলেন আর আতিথেয়তা করা তার বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য ছিল।
হানিফ সাহেব লিখেন, তিনি একজন ফিরিশতাতুল্য মানুষ ছিলেন, নিঃসন্দেহে মুর্তিমান এক ফিরিশতা ছিলেন, আল্লাহ্ তা’লা তার প্রতি অগণিত রহমত বর্ষণ করুন, তার পদমর্যাদা উন্নীত করুন। আতিথেয়তার বিষয়ে এটিও উল্লেখ করে দিচ্ছি যে, পুরুষ তখনই আতিথেয়তা করতে পারে যখন ঘরের মহিলাও অতিথিপরায়ণ হয়। তার স্ত্রীও অনেক অতিথিপরায়ণ ও সেবা দানকারী। তার দীর্ঘায়ূ এবং সুস্বাস্থ্যের জন্যও দোয়া করবেন, আল্লাহ্ তা’লা যেন তার বয়স এবং স্বাস্থ্যে প্রভূত কল্যাণ দান করেন আর তার সন্তানদেরকেও তার পুণ্যসমূহ ধরে রাখার তৌফিক দিন আর তারা যেন তাদের মায়ের সেবাদানের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে।