জুমুআর খুতবার সারমর্ম

শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত উমর (রা.)-এর স্মৃতিচারণ জুমুআর খুতবা ২৬ নভেম্বর ২০২১

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ২৬ নভেম্বর, ২০২১ মোতাবেক ২৬ নবুয়্যত, ১৪০০ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:

হযরত উমর (রা.)-এর দরবারে জ্ঞানী লোকদের, বিশেষ করে যারা পবিত্র কুরআনের জ্ঞান রাখতেন তাদের অনেক বড় পদমর্যাদা ছিল, হোক না তারা অল্পবয়স্ক যুবক বা বালক কিংবা প্রবীণ। বুখারী শরীফে একটি হাদীস রয়েছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, উয়াইনাহ্ বিন হিস্ন বিন হুযায়ফাহ্ মদীনায় এসে তার ভাতিজা হুর বিন কায়েসের বাড়িতে উঠেন। হুর বিন কায়েস সেসব লোকের একজন ছিলেন যাদেরকে হযরত উমর (রা.) নিজের কাছে বসাতেন এছাড়া ক্বারীরাও অর্থাৎ কুরআনের আলেম বা জ্ঞানী ব্যক্তিরাও হযরত উমর (রা.)-এর কাছে বসতেন এবং তাঁকে পরামর্শ দিতেন তারা প্রবীণ হোন বা নবীন। উয়াইনাহ্ তার ভাতিজাকে বলেন, হে আমার ভাতিজা! এই আমীরের দৃষ্টিতে তুমি মর্যাদার অধিকারী, তাই তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য আমার হয়ে তুমি অনুমতি প্রার্থনা কর। হুর বিন কায়েস বলেন, আমি আপনার জন্য তাঁর কাছে যাওয়ার অনুমতি নিয়ে নিব। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলতেন, এরপর হুর উয়াইনাহ্র জন্য অনুমতি চাইলে হযরত উমর (রা.) তাকে অনুমতি প্রদান করেন। উয়াইনাহ্ তাঁর [অর্থাৎ উমর (রা.)-এর] কাছে এসে বলে, হে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহর কসম এটি কেমন কথা যে আপনি আমাদেরকে পর্যাপ্ত ধনসম্পদও দেন না আর আমাদের ও আমাদের সম্পদের মাঝে ন্যায়সঙ্গত আচরণও করেন না। একথা শুনে হযরত উমর (রা.) অসন্তুষ্ট হন, এমনকি তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় হুর হযরত উমর (রা.)-এর সমীপে নিবেদন করেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! আল্লাহ্ তা’লা তাঁর নবী (সা.)-কে বলেছেন, خُذِ الْعَفْوَ وَأْمُرْ بِالْعُرْفِ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ (সূরা আল্ আ’রাফ: ২০০) অর্থাৎ হে নবী! সর্বদা মার্জনার রীতি অবলম্বন কর এবং ন্যায়সঙ্গত কাজের আদেশ দাও আর অজ্ঞদের উপেক্ষা কর। আর এই উয়াইনাহ্ অজ্ঞদেরই একজন। আল্লাহ্র কসম! হুর যখন তাঁর সামনে এই আয়াত পাঠ করেন তখন হযরত উমর (রা.) সেখানেই থেমে যান আর কোন কিছু বলেন নি। হযরত উমর (রা.) আল্লাহ্র কিতাব, (অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের নির্দেশ) শুনলে থেমে যেতেন।
হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.) একটি ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেন, হযরত উমর (রা.)-এর দরবারে একজন ধনী ব্যক্তি আসে এবং সেখানে একজন দশ বছরের বালককে বসে থাকতে দেখে সে (তা) খুবই অপছন্দ করে, অর্থাৎ (তার মতে) এমন মহান দরবারে ছোকড়াদের কী কাজ? ঘটনাক্রমে সেই ধনী ব্যক্তির কোন কাজে হযরত উমর (রা.) অসন্তুষ্ট হয়ে জল্লাদকে ডাকেন, তখন সেই বালকই চিৎকার করে, وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَأَعْرِضْ عَنِ الْجَاهِلِينَ পাঠ করে এবং বলে, হাযা মিনাল জাহেলীন। (একথা শুনে) হযরত উমর (রা.)-এর চেহারা পান্ডুবর্ণ হয়ে যায় আর তিনি নীরব হয়ে যান। তখন তার ভাই, অর্থাৎ যে ব্যক্তি কিছু মন্তব্য করেছিল তার ভাই বলে, দেখেলে তো! আজ এই বালকই তোমার প্রাণরক্ষা করেছে যাকে তুমি তুচ্ছ জ্ঞান করছিলে।
হযরত উমর (রা.) শিশুদের তরবীয়ত বা শিক্ষদীক্ষার কীভাবে ব্যবস্থা নিতেন- সে সম্পর্কে একটি রেওয়ায়েত রয়েছে। ইউসুফ বিন ইয়াকূব বলেন, ইবনে শিহাব আমাকে, আমার ভাইকে এবং আমার চাচার পুত্রকে যখন আমরা অল্পবয়স্ক বালক ছিলাম, বলেছিলেন, বালক হওয়ার কারণে তোমরা নিজেদেরকে তুচ্ছ মনে করো না। কেননা হযরত উমর (রা.) যখন কোন সমস্যার সম্মুখীন হতেন তখন তিনি বালকদের ডাকতেন এবং তাদের কাছ থেকেও পরামর্শ গ্রহণ করতেন, কেননা তিনি তাদের মেধা ও মননকে প্রখর করতে চাইতেন।
হযরত ওমরের আত্মাভিমান সংক্রান্ত একটি ঘটনা রয়েছে। ওহুদের যুদ্ধে যখন যুদ্ধের দৃশ্যপট পাল্টে যায় আর মুসলমানদের চরম ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় তখন আবু সুফিয়ান তিনবার উচ্চঃস্বরে বলে, তোমাদের মাঝে কি মুহাম্মদ রয়েছে? নবী (সা.) সাহাবীদেরকে এর উত্তর দিতে বারণ করেন। এরপর সে তিনবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে, লোকদের মাঝে কি আবু কোহাফার পুত্র রয়েছে? এরপর সে তিনবার জিজ্ঞেস করে, এসব লোকের মাঝে কি খাত্তাবের পুত্র রয়েছে? এরপর সে তার সঙ্গীসাথির নিকট ফিরে গিয়ে বলে, এরা সবাই মারা গিয়েছে। একথা শুনে হযরত উমর (রা.) নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে বলেন, হে আল্লাহ্র শত্রু! আল্লাহ্র কসম! তুই মিথ্যা বলেছিস। তুই যাদের নাম নিয়েছিস তারা সবাই জীবিত আছে। এছাড়া যেসব বিষয় তোর কাছে কষ্টের কারণ সেগুলোর মধ্যে থেকেও তোর জন্য এখনো অনেক কিছু বাকি রয়েছে। তখন আবু সুফিয়ান বলে, এ যুদ্ধ বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ আর যুদ্ধ তো (কুপ থেকে পানি উঠানোর) বালতির মত কখনো একদিকে যায় আর কখনও অন্যদিকে অর্থাৎ একবার এ পক্ষের বিজয় হয় আবার অন্যবার অন্য পক্ষের।
বায়তুল মালের ধনসম্পদের সুরক্ষা ও তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে তিনি কতটা সতর্ক ছিলেনÑ এ সম্পর্কে রেওয়ায়েত রেয়েছে। যায়েদ বিন আসলাম বলেন, হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) দুধ পান করার পর এটি তাঁর পছন্দ হয় অর্থাৎ কেউ তাঁকে গ্যাসে দুধ দিলে তিনি তা পান করেন আর পছন্দ করেন। তখন যে তাঁকে দুধ পান করিয়েছিল তিনি (রা.) তাকে জিজ্ঞেস করেন, এ দুধ কোথা থেকে এসেছে? সে তাঁকে বলে, সে এক ঝর্ণায় গিয়েছিল যার নামও সে উচ্চারণ করে; সেখানে মানুষ যাকাতের উটগুলোকে পানি পান করাচ্ছিল, সেখানে তারা আমার জন্য দুধ দোহন করে যা আমি আমার পানির পাত্রে ঢেলে নিই। (একথা শুনে) হযরত উমর (রা.) গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি করে ফেলে দেন (আর বলেন,) এটি যাকাতের সম্পদ তাই এ দুধ আমি পান করব না।
বারা বিন মারুরের পুত্র বর্ণনা করেন, একদিন হযরত উমর (রা.) বাড়ি থেকে বের হন আর হাঁটতে হাঁটতে এসে তিনি মিম্বরে চড়েন করেন। তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন, তাঁর এই রোগ নিরাময়ের জন্য মধু সেবনের প্রস্তাব করা হয়, বায়তুল মালে মধুর পাত্র ছিল। হযরত উমর (রা.) বলেন, আপনারা আমাকে অনুমতি দিলে আমি মধু নিব, অন্যথায় এটি আমার জন্য হারাম তথা অবৈধ। তখন লোকেরা তাকে এটি নেয়ার অনুমতি দেয়।
বায়তুল মালের সম্পত্তির সুরক্ষার প্রতি কতটা যত্মবান র্ছিলেন এ সম্পর্কে এ ঘটনাটি পূর্বেও বর্ণনা করেছি, তথাপি সংক্ষিপ্তাকারে আবার তুলে ধরছি। একদিন দুপুরে প্রচন্ড গরমের মধ্যে পিছনে থাকা দুটি উটকে তিনি নিজেই হাকিয়ে চারণ ভূমিতে নিয়ে যাচ্ছিলেন যেন এদিক সেদিক কোথাও হারিয়ে না যায়। কাকতালিয়ভাবে হযরত উসমান (রা.) দেখেন এবং বলেন, একাজ আমরা করছি আপনি ছায়ায় চলে আসুন। তখন হযরত উমর (রা.) বলেন, তোমরা আরাম করে ছায়ায় বসে থাক, এটি আমার কাজ আর আমিই করব।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এ ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ্ তা’লা স্বীয় প্রতিশ্রুতি অনুসারে মুসলমানদের ধনসম্পদ, সম্মান ও প্রতিপত্তি দিয়েছেন কিন্তু তথাপি তারা ইসলাম সম্পর্কে উদাসীন হয়ে যায় নি। তিনি বলেছেন, তোমাদেরও যদি এসব কিছু অর্জিত হয়ে গিয়ে থাকে তোমরা তোমাদের ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন হবে না। ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে উদাসীন হবে না বা নিজেদের দায়িত্বাবলী সম্পর্কে উদাসীন হবে না। মুসলেহে মওউদ (রা.) বলেন, হযরত উসমান (রা.) বর্ণনা করেন, একবার আমি আমার কাচারি ঘরে বসেছিলাম আর এত প্রচন্ড দাবদাহ ছিল যে, দরজা খোলারও সাহস হচ্ছিল না। এমন সময় আমার দাস বলল, দেখুন! প্রচন্ড রোদের মধ্যে এক ব্যক্তি বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু সময় অতিবাহিত হতেই সেই ব্যক্তি আমার কাচারি ঘরের নিকট পৌঁছায় আর আমি দেখি, তিনি হযরত উমর (রা.)। তাঁকে দেখেই আমি কিছুটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি আর বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করি, এত গরমের মধ্যে আপনি কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন? উত্তরে হযরত উমর (রা.) বলেন, বায়তুল মালের একটি উট হারিয়ে গিয়েছিল, যেটির সন্ধানে আমি বাহিরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) লিখেন, আল্লাহ্ তা’লা বলেছেন আলাল আরায়েকে ইয়ানযুরূন। অর্থাৎ তারা সিংহাসনে সমাসীন থাকবে কিন্তু সর্বদা তাদের কাজ হবে নিগরানী বা তত্ত্বাবধান করা। জাগিতিক বিত্তবৈভব ও আরাম আয়েশ তাদেরকে অলস বানাবে না। সেসব সিংহাসনে তারা ঘুমিয়ে থাকবে না বরং সজাগ ও সতর্ক থাকেব। মানুষের অধিকার প্রদানে সযত্ন থাকবে এবং নিজেদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বাবলী সুচারুরূপে পালন করে যাবে।
সাম্য প্রতিষ্ঠার বিষয়ে রেওয়ায়েত রয়েছে। সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব বর্ণনা করেন, একজন ইহুদি ও মুসলমান বিবদমান অবস্থায় হযরত উমর (রা.)-এর নিকট আসে। হযরত উমর (রা.)-এর দৃষ্টিতে ইহুদি ব্যক্তি ন্যায়ের ওপর ছিল বলে মনে হয়, তাই তিনি সে অনুসারে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। এরপর সেই ইহুদি বলে, আল্লাহর কসম! আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করেছন।
হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, মিশরের এক ব্যক্তি হযরত উমর (রা.)-এর নিকট এসে বলে, হে আমীরুল মু’মেনীন! আমি আপনার নিকট অত্যাচার থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। তিনি (রা.) বলেন, তুমি উত্তম আশ্রয়স্থল অন্বেষণ করেছ। সেই ব্যক্তি বলে, আমি আমর বিন আস (রা.)-এর পুত্রের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি এবং তার চেয়ে এগিয়ে যাই। এজন্য সে আমাকে চাবুক মারা আরম্ভ করে আর বলে, আমি সম্মানীত ব্যক্তির পুত্র, আমার সামনে যাওয়ার সাহস তুমি কোথায় পেলে? একথা শুনে হযরত উমর (রা.) হযরত আমর বিন আস (রা.)কে পত্র লিখেন এবং তাকে তার ছেলেসহ উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। হযরত আমর বিন আস (রা.) উপস্থিত হলে হযরত উমর (রা.) বলেন, মিশরীয় ব্যক্তিটি কোথায়? চাবুক তুলে নাও আর মার। সেই ব্যক্তি তাকে মারতে থাকে, অর্থাৎ আমর বিন আস (রা.)-এর পুত্রকে আর হযরত উমর (রা.) বলছিলেন, সম্মানী ব্যক্তির পুত্রকে মার। অর্থাৎ সেই মিশরীয় ব্যক্তিকে বলছিলেন। হযরত আনাস (রা.) বলেন, সে তাকে প্রহার করছিল আর আমরা তার প্রহার করা পছন্দ করছিলাম। সে তাকে লাগাতার চাবুক মারতে থাকে, এক পর্যায়ে আমরা চাচ্ছিলাম যে সে এখন তাকে ছেড়ে দিক। এরপর হযরত উমর (রা.) সেই মিসরীয় ব্যক্তিকে বলেন, এখন আমর বিন আসের মাথায় মার। তখন সেই মিসরীয় ব্যক্তি বলে, হে আমীরুল মু’মেনীন তাঁর ছেলে আমাকে প্রহার করেছিল আর আমি প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছি। এরপর হযরত উমর (রা.) হযরত আমর বিন আস (রা.)-কে বলেন, লোকদেরকে তুমি কবে থেকে দাস বানিয়ে রেখেছ? অথচ তাদের মায়েরা তাদেরকে স্বাধীন হিসাবে জন্ম দিয়েছেন। তখন হযরত আমর বিন আস (রা.) নিবেদন করেন, হে আমীরুল মু’মেনীন এই ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না আর এই মিশরীয় ব্যক্তিও আমার নিকট আসে নি।
একবার হযরত উমর (রা.)-এর নিকট কিছু সম্পদ এলে তিনি তা মানুষের মাঝে বণ্টন করতে আরম্ভ করেন। এমতাবস্থায় লোকেরা ভিড় করলে হযরত সা’দ বিন ওয়াক্কাস (রা.) লোকদেরকে বাধা দিতে দিতে অগ্রসর হন এবং হযরত উমর (রা.)-এর নিকটে পৌঁছে যান। তিনি (রা.) তাঁকে চাবুক দিয়ে আঘাত করে বলেন, পৃথিবীতেই তুমি আল্লাহর বাদশাহকে ভয় পাও নি আর ভিড় ঠেলে সামনে চলে এসেছ। তাই আমি ভাবলাম যে তোমাকেও বলে দেই যে, আল্লাহর বাদশাহও তোমাকে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না।
হযরত উমর (রা.)-এর মনোবল কত দৃঢ় ছিল এ সম্পর্কে রেওয়ায়েত রয়েছে। একবার হযরত উমর (রা.) খুতবা দেয়ার সময় বলেন, হে লোক সকল! তোমাদের কেউ আমার মাঝে কোন বক্রতা লক্ষ্য করলে সে যেন তা সোজা করে দেয়। একথা শুনে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলে, আপনার মাঝে কোন বক্রতা দখলে সেটিকে আমরা আমাদের তরবারি দিয়ে সোজা করে দিব। তখন হযরত উমর (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ! কেননা তিনি এই উম্মতের মাঝে এমন লোককেও জন্ম দিয়েছেন যে উমরের বক্রতাকে তরবারি দিয়ে সোজা করবে। হযরত উমর (রা.) খুতবার মধ্যে বলেন, আমাকে তোমরা কল্যাণের আদেশ দিয়ে, মন্দ থেকে বিরত রেখে এবং উপদেশ দেয়ার মাধ্যমে সাহায্য কর।
এরপর আরেক স্থানে হযরত উমর (রা.) বলেন, সেই ব্যক্তি আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় যে আমাকে আমার দোষত্রæটি সম্পর্কে অবগত করবে।
এছাড়া হযরত উমর (রা.)-এর একটি উক্তি বর্ণনা করা হয় আর সেটি হলো, আমি কোন ভুল করলে আমার ভয়ে কেউ আমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবে না এটি নিয়েই আমি শংকিত।
একদিন তাঁর নিকট একব্যক্তি এসে জনসমক্ষে বলে, হে উমর! আল্লাহকে ভয় কর। তার একথা শুনে কিছু লোক খুব রাগান্বিত হয়ে যায় এবং তাকে চুপ করাতে চায়। এ অবস্থায় হযরত উমর (রা.) তাকে বলেন, তোমার পরিণাম শুভ হবে না! যদি তুমি (আমার) ত্রুটি না ধরে দাও। পক্ষান্তরে আমাদেরও পরিণতি শুভ হবে না যদি আমরা তা না শুনি। অর্থাৎ তাকে বলেন, কেবল কথার কথা বলো না বরং নির্দিষ্ট করে বল, কী বলতে চাও।
একদিন হযরত উমর (রা.) মানুষের মাঝে ভাষণ দেয়ার জন্য দÐায়মান হন। তিনি কেবল এতটুকু বলেছিলেন যে, হে লোকসকল! তোমরা শোন ও আনুগত্য কর। তখনই জনৈক ব্যক্তি কথার মধ্যে বলে বসে, হে উমর আমরা শুনবও না এবং আনুগত্যও করব না। হযরত উমর (রা.) তাকে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর বান্দা! কেন? সে বলে, এর কারণ হলোÑ বায়তুল মালের যে কাপড় বিতরণ করা হয়েছে তা দিয়ে লোকেরা কেবল কামিসই বানাতে পেরেছে পুরো পোশাক বানাতে পারে নি। আপনিও নিশ্চয় ততটুকুই কাপড় পেয়ে থাকবেন তাহলে আপনার পুরো কাপড় কীভাবে হয়ে গেল? তখন হযরত উমর (রা.) বলেন, তুমি তোমার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাক। এরপর এদিকে নিজ পুত্র আব্দুল্লাহকে ডাকেন। আব্দুল্লাহ (রা.) তখন বলেন, তিনি তার অংশের কাপড় তার পিতাকে দিয়ে দিয়েছেন যেন পিতার পুরো কাপড় তৈরী হয়ে যায়। একথা শুনে সবাই আশ^স্ত হয়ে যায় এবং সেই ব্যক্তি বলে, হে আমীরুল মু’মেনীন এখন আমরা শুনব এবং আনুগত্যও করব।
কতিপয় এমন অভদ্র ব্যক্তিও ছিল কিন্তু মহানবী (সা.)-এর হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাহাবীদের মুখ থেকে আপনারা কখনোই এ ধরণের কথা শুনবেন না। এরা সেসব লোক যারা পরবর্তীতে মুসলমান হয়েছে বা এরা একেবারেই অশিষ্ট অশিক্ষিত মূর্খ ছিল। যারা জ্যেষ্ঠ সাহাবী ছিলেন তাদের মাঝে এ ধরণের বিষয়াদি দেখা যেতো না, তাদের মাঝে ছিল পূর্ণ আনুগত্যের বৈশিষ্ট্য।
ধর্মীয় বিষয়াদিতে ইসলাম স্বাধীনতা প্রদান করে এ বিষয়ে হযরত উমর (রা.)-এর রীতি কী ছিল? আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের পর সেখানকার শাসক হযরত আমর বিন আস (রা.)-কে বার্তা পাঠায় যে, হে আরব জাতিগোষ্ঠী! আমি আপনাদের চেয়ে অধিকতর ঘৃণ্য জাতি তথা পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যকে জিযিয়া প্রদান করতাম। আপনি যদি সম্মত থাকেন তাহলে আমি আপনাদেরকে জিযিয়া প্রদান করতে প্রস্তুত আছি তবে শর্ত হলো আমার অঞ্চলের যুদ্ধন্দীদেরকে ছেড়ে দিতে হবে। হযরত আমর বিন আস (রা.) খলীফার কাছে পুরো বৃত্তান্ত লিখে পাঠান। হযরত উমর (রা.)-এর পক্ষ থেকে উত্তর আসে, তুমি আলেকজান্দ্রিয়ার শাসকের কাছে এ প্রস্তাব রাখ যে, সে যেন জিযিয়া প্রদান করে কিন্তু যেসব যুদ্ধবন্ধী তোমাদের, অর্থাৎ মুসলমানদের কাছে রয়েছে তাদেরকে এ সিদ্ধান্তে স্বাধীনতা দেয়া হবে যে, তারা চাইলে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে আর চাইলে স্বজাতির ধর্মে অটল থাকতে পারে। যারা মুসলমান হয়ে যাবে তারা মুসলমান হিসাবে গণ্য হবে এবং তাদের অধিকার ও দায়-দায়িত্ব মুসলমানদের মতই হবে কিন্তু যারা স্বজাতির ধর্মে অটল থাকবে তাদের ওপর তাদের অন্যান্য স্বধর্মীয়দের অনুরূপই জিযিয়া বা কর ধার্য হবে। অতঃপর হযরত আমর বিন আস (রা.) সকল বন্ধীকে একত্র করেন এবং তাদেরকে যুগ খলীফার নির্দেশনা পড়ে শোনান হয় তখন অনেক যুদ্ধবন্দী মুসলমান হয়ে যায়।
ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি (রা.) কতটুকু সতর্ক ছিলেন এ সংক্রান্ত একটি ঘটনা রয়েছে। একবার এক খ্রিষ্টান বৃদ্ধ মহিলা তার কোন প্রয়োজনে হযরত উমর (রা.)-এর কাছে আসে তখন তিনি (রা.) তাকে বলেন, মুসলমান হয়ে যাও তাহলে নিরাপদ থাকবে। আল্লাহ্ মুহাম্মদ (সা.)-কে সত্যসহকারে প্রেরণ করেছিলেন। সেই মহিলা উত্তরে বলে, আমি বৃদ্ধ মানুষ আর মৃত্যু আমার দাড়প্রান্তে। তিনি (রা.) তার অভাব মোচন করেন কিন্তু পাশাপাশি শঙ্কিত হন যে, কোথাও আবার তার এহেন কাজ এই মহিলার অভাবের অন্যায় সুযোগ নিয়ে তাকে মুসলমান হতে বাধ্য করার যেন নামান্তর না হয়ে যায়। এজন্য তিনি তার এহেন কাজের জন্য আল্লাহ্ তা’লার কাছে তওবা করেন এবং বলেন, হে আল্লাহ! আমি তাকে সোজা পথ দেখিয়েছিলাম আমি তাকে বাধ্য করি নি। অতএব এক্ষেত্রে তিনি খুবই সতর্ক ছিলেন।
আরেকটি ঘটনা রয়েছে হযরত উমর (রা.)-এর একজন খ্রিষ্টান ক্রীতদাস ছিল তার নাম ছিল ইশক। সে বর্ণনা করছে যে, আমি হযরত উমর (রা.)-এর ক্রীতদাস ছিলাম। তিনি (রা.) আমাকে বলেন, তুমি মুসলমান হয়ে যাও যেন মুসলমানদের কোন কোন বিষয়ে তোমার সাহায্য নিতে পারি, কেননা আমাদের জন্য সমীচীন নয় যে, একান্ত মুসলমানদের বিষয়ে এমন লোকদের দিয়ে কাজ করাই যারা অমুসলিম। কিন্তু আমি অস্বীকার করি। এতে তিনি (রা.) বলেন, লা ইকরাহা ফিদ্দীন, অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে জোর-জবরদস্তি নেই। যখন তার মৃত্যু নিকটবর্তী হয় তখন তিনি আমাকে মুক্ত করে দেন এবং বলেন, তুমি যেখানে ইচ্ছা চলে যাও।
পশুর প্রতি তাঁর দয়া-মায়ার একটি ঘটনা রয়েছে। আহ্নাফ বিন কায়েস বর্ণনা করেন, আমরা উমর বিন খাত্তাব (রা.)-এর কাছে এক প্রতিনিধিদলরূপে মহাবিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে আসি। তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কোথায় অবস্থান করছেন। আমি বলি, ওমুক স্থানে। এরপর তিনি আমার সাথে যাত্রা করেন আর আমাদের বাহন উটের আস্তাবল, অর্থাৎ সেগুলো বাঁধার স্থানে পৌঁছেন এবং প্রতিটি উটকে মনোযোগের সাথে দেখার পর বলেন, তোমরা কি তোমাদের বাহন সম্পর্কে আল্লাহ্কে ভয় কর না। তোমরা কি জান না যে, এসব প্রাণিরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তাদেরকে উন্মুক্ত ছেড়ে দাও না কেন যেন ঘাস প্রভৃতি খেতে পারে?
হযরত উমর (রা.) এমন একটি উট দেখেন যেটির অসহায়ত্ব ও রুগ্নতার চিহ্ন অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। সালেম বিন আব্দুল্লাহ্ বর্ণনা করেন, হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) স্বীয় হাত উটের পিঠের একটি ক্ষত স্থানের পাশে রাখেন এবং নিজেকে সম্বোধন করে বলেন, আমার ভয় হয় যে, আল্লাহ্র কাছে তোর সম্পর্কে না আবার জিজ্ঞাসিত হই।
আসলাম থেকে বর্ণিত আরেকটি রেওয়ায়েত রয়েছে, একবার হযরত উমর (রা.) বলেন, আমার তাজা মাছ খাওয়ার খুব ইচ্ছা হল। ইয়ারফা নামী হযরত উমরের একজন ক্রীতদাস বাহনে চড়ে অগ্রে-পশ্চাতে চার মাইল পর্যন্ত সন্ধান করে একটি ভালো মাছ ক্রয় করে আনে। এরপর সে বাহনের প্রতি মনোনিবেশ করে এবং সেটিকে গোসল করায়। ইত্যবসরে হযরত উমর (রা.) এসে পড়েন এবং বলেন, চলো। এরপরই তিনি বাহনকে দেখে বলেন, তুমি এই ঘাম ধুতে ভুলে গেছ যা তার কানের নীচে রয়েছে। তুমি উমরের ইচ্ছা পূর্ণ করার জন্য একটি পশুকে কষ্টে ফেলেছ! আল্লাহ্র কসম! উমর তোমার এই মাছ চেখেও দেখবে না।
একবার গ্রীষ্মকালে দুপুরবেলা হযরত উমর (রা.)-এর কাছে ইরাক থেকে এক প্রতিনিধি দল আসে। তাদের মধ্যে আহ্নাফ বিন কায়েসও ছিলেন। হযরত উমর (রা.) মাথায় পাগড়ী বেঁধে যাকাতের একটি উটকে আলকাতরা প্রভৃতি লাগাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, হে আহ্নাফ! কাপড় খুলে আস এবং এই উটের যতেœ আমীরুল মুমিনীনকে সাহায্য কর। এটি যাকাতের উট। এতে এতীম, বিধবা এবং মিসকীনদের অধিকার আছে।
এক ইহুদীর সাথে হযরত উমর (রা.)-এর কথোপকথন সম্পর্কিত একটি রেওয়ায়েত রয়েছে। তারেক হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ইহুদীদের জনৈক ব্যক্তি তাকে বলে, হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনাদের গ্রন্থে একটি আয়াত রয়েছে যা আপনারা পাঠ করে থাকেন। এটি যদি আমাদের প্রতি, অর্থাৎ ইহুদী জাতির প্রতি অবতীর্ণ হত তবে আমরা সে দিনটিতে ঈদ উদ্যাপন করতাম। হযরত উমর বলেন, সেটি কোনটি? সে বলে, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করেছি এবং তোমাদেরকে আমার সকল নেয়ামত দান করেছি এবং আমি তোমাদের জন্য ইসলামকে ধর্মরূপে মনোনীত করেছি। হযরত উমর (রা.) উত্তরে বলেন, আমার ঐদিনটির কথা স্মরণ আছে এবং ঐ স্থানটির কথাও যেখানে মহানবী (স.)-এর প্রতি এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। তখন তিনি (স.) জুমুআর দিনে আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এ সম্পর্কে বলেন, হযরত উমর (রা.)কে এক ইহুদী বলে, কুরআন মজীদে একটি আয়াত আছে, সেটি যদি আমাদের কিতাবে অবতীর্ণ হতো তবে আমরা সেদিন ঈদ উদ্যাপন করতাম। হযরত উমর (রা.) বলেন, সেটি কোন আয়াত? সে উত্তর দেয় الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ তখন হযরত উমর (রা.) বলেন, সে দিনটিতো আমাদের জন্য দুই ঈদের দিন। অর্থাৎ জুমুআর দিন এবং আরাফার দিন, অর্থাৎ এই দিনে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল।
কতিপয় বুযূর্গ ব্যক্তি হযরত উমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণনা করেন। যেমন আশ’আস হতে বর্ণিত যে, আমি ইমাম শা’বীকে বলতে শুনেছি, মানুষকে কোন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতে দেখলে সে বিষয়ে হযরত উমর (রা.)-এর কর্মপন্থা দেখবে, কেননা হযরত উমর (রা.) পরামর্শ ব্যতীত কোন কাজ করতেন না। ইমাম শা’বী বর্ণনা করেন, আমি হযরত কাবিসাহ্ বিন জাবেরকে একথা বলতে শুনেছি যে, আমি হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.)-এর সাথে ছিলাম। আমি তাঁর চেয়ে কিতাবুল্লাহকে অধিক পাঠকারী, আল্লাহ্র ধর্মের অধিক ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন এবং তাঁর চেয়ে উত্তম এর পঠন-পাঠনকারী কাউকে দেখি নি। হযরত হাসান বসরী বলেন, তোমরা যদি তোমাদের বৈঠককে সুরভিত করতে চাও তাহলে অধিকহারে হযরত উমর (রা.)-এর স্মৃতিচারণ কর। মুজাহিদ হতে বর্ণিত যে, আমরা পরস্পর বলাবলি করতাম, নিঃসন্দেহে হযরত উমর (রা.)-এর যুগে শয়তান শিকলাবদ্ধ অবস্থায় ছিল, কিন্তু তিনি (রা.) শহীদ হলে শয়তান পৃথিবীতে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠে। হযরত উমর (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, (তাঁর মাঝে) কবিসূলভ রুচীবোধ প্রবল ছিল। তিনি নিজে কবিতা বলতেন না, কিন্তু কবিতা শুনতেন, পছন্দ করতেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, আমি হযরত উমর (রা.)-এর সাথে একটি সফরে বের হই। এক রাতে পথ অতিক্রম করতে গিয়ে আমি তাঁর নিকটে যাই। তখন তিনি তাঁর পালানের সামনের অংশে চাবুক দিয়ে আঘাত করে নিন্মোক্ত পঙ্ক্তি পাঠ করেন,
کذبتم و بیت اللہ یقتل احمد و لما نطاعن دونہ و نناضل
و نسلمہ حتی نصرع حولہ و نذھل عن ابنائنا و الحلائل
অর্থাৎ তোমরা মিথ্যা বলছো। আল্লাহ্র ঘর খানা কা’বার শপথ! হযরত আহমদ (সা.) শহীদ হতে পারেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাঁর সুরক্ষায় বর্শা ও তরবারির ঝংকার প্রদর্শন না করি। আমরা তাঁকে ত্যাগ করব না যতক্ষণ আমরা তাঁর পাশে যুদ্ধ করতে করতে নিহত না হই এবং স্বীয় সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের ভুলে না যাব।
و ما حملت ناقتہ فوق رحلھا ابرو اوفی ذمۃ من محمد
অর্থাৎ কোন উটনী নিজের পিঠে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চেয়ে অধিক পুণ্যবান ও অঙ্গিকার রক্ষাকারী মানুষকে বসায় নি।
এক ঐতিহাসিক ডা. আলী মুহাম্মদ সালাবী ‘সৈয়দনা হযরত উমর বিন খাত্তাব উনকি শাখসিয়্যাত অওর কারনামে’ নামক গ্রন্থে কাব্যরস ও কবিত লেখার প্রতি আকর্ষণ সম্পর্কে লেখেন, খোলাফায়ে রাশেদীনদের মধ্যে কবিতার মাধ্যমে হযরত উমর (রা.)-ই সবচেয়ে বেশি দৃষ্টান্ত প্রদানকারী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কতক ব্যক্তি একথাও লিখেছে যে, তাঁর নিকট এমন বিষয় খুব কমই উত্থাপিত হয়েছে যা সম্পর্কে তিনি কোন পঙ্ক্তি শুনান নি। বর্ণনা করা হয় যে, একবার তিনি (রা.) নতুন কাপড় পরিধান করে বাইরে বেরিয়ে আসেন। লোকজন তাঁকে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে দেখতে থাকে। এতে তিনি (রা.) তাদেরকে উপমা দিতে গিয়ে এই পঙ্ক্তি শুনান যে,
لم تغن عن ہرمز یوم خزائنہ و الخلد قد حاولت عاد فما خلدوا
این الملوک التی کانت لعزتھا من کل اوب الیھا راکب یفد
অর্থাৎ মৃত্যুর সময় হুরমুযের সম্পদ তার কোন কাজে আসে নি এবং আদ জাতি চিরকাল স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু স্থায়ী হতে পারে নি। কোথায় সেই বাদশাহ্’রা যাদের ঝরনা ও ঘাটসমূহে চতুর্দিক থেকে আগত কাফেলা পরিতৃপ্ত হত।
আলী মুহাম্মদ সালাবী লিখেন যে, হযরত উমর সেসব কবিতাই পছন্দ করতেন যেগুলোতে ইসলামী জীবনের ঔজ্জ্বল্য প্রতিভাত হয়, যেগুলো ইসলামী বিশেষত্বের প্রতিফলন ঘটায় আর যেগুলোর অর্থ ইসলামী শিক্ষার বিরোধী এবং ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থি নয়। তিনি মুসলমানদেরকে উৎকৃষ্ট মানের কবিতা মুখস্থ করতে উৎসাহিত করতেন এবং বলতেন, কবিতা শিখ, এগুলোতে সেসব গুণাবলী থাকে যার সন্ধান করা হয়, অধিকন্তু প্রজ্ঞাবানদের প্রজ্ঞা-ও থাকে আর উন্নত চরিত্রের দিকে তা দিক-নির্দেশনা দেয়। কবিতার কল্যাণ সম্পর্কে তার চিন্তাধারা কেবল এতটুকুই ছিল না, বরং এটিকে হৃদয়ের চাবি এবং মানবদেহে কল্যাণের প্রেরণা সঞ্চারের কারণ মনে করতেন। তিনি কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণকে এভাবে বর্ণনা করেন যে, মানুষের সর্বোত্তম কৌশল কবিতার কয়েকটি ছত্রের সৃষ্টি, যেগুলোকে সে নিজ প্রয়োজনের সময় উপস্থাপন করে, সেগুলোর মাধ্যমে দয়ালু এবং উদার ব্যক্তির হৃদয়কে সে কোমল করে তুলে এবং নীচ ব্যক্তির হৃদয়কে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে।
অজ্ঞতার যুগের পুরোনো কবিদের কবিতাও তিনি গভীর আগ্রহের সাথে মুখস্থ করতেন, কেননা এর সাথে ঐশী কিতাব বুঝা এবং বুঝানোর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের কাব্যগ্রন্থ মুখস্থ করে নাও আর অজ্ঞ থেক না। শ্রোতারা তাকে জিজ্ঞেস করে যে, আমাদের কাব্যগ্রন্থ কোনটি? তখন হযরত উমর বলেন, অজ্ঞতার যুগের কবিতাসমূহ। সেগুলোতে তোমাদের কিতাব অর্থাৎ পবিত্র কুরআনের তফসীর রয়েছে এবং তোমাদের ঐশী গ্রন্থের অর্থ রয়েছে। তাঁর এই উক্তি তাঁর শিষ্য এবং কুরআনের ভাষ্যকার আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস-এর এই উক্তির সাথেও সামঞ্জস্য রাখে যাতে তিনি বলেছেন যে, তুমি যখন কুরআন পড় আর যদি তা না বুঝতে পার তাহলে এর অর্থ আরবের কবিতাসমূহের মাঝে সন্ধান কর, কেননা কবিতা রচনার ফলাফল হলো আরবদের কাব্যগ্রন্থ।
উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ জীবনীকার আল্লামা শিবলী নোমানী তার পুস্তক আল ফারুক-এ কবিতা বা কাব্যের প্রতি তার রুচিবোধের উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেন যে, কবিতা বলা বা কাব্যের প্রতি মোটের ওপর যদিও হযরত উমরের খ্যাতি স্বল্প আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তিনি কবিতা খুব কমই রচনা করতেন, কিন্তু কবিতার রুচি তার মাঝে এমন উন্নত মানের ছিল যে, তার জীবনের ইতিহাসে এই ঘটনা আমরা কোনভাবে বাদ দিতে পারি না। আরবের এক প্রসিদ্ধ ও পরিচিত কবির কাব্যের বিরাট অংশ তার মুখস্থ ছিল আর সব কবির কাব্য সম্পর্কে তার বিশেষ বিশেষ অভিমত ছিল। সাহিত্যিকরা সাধারণত এই কথা স্বীকার করে যে, তার যুগে হযরত উমরের চেয়ে বড় কোন কবিতা পাঠক ছিল না। জাহেয তার বই ‘আল বায়ান ওয়াত তাবঈন’-এ লিখেছেন যে, হযরত উমর বিন খাত্তাব স্বীয় যুগে কবিতার গভীরতা সবচেয়ে বেশি বুঝতেন। হযরত উমরের সাহিত্যের প্রতি রুচি এত গভীর ছিল যে, উন্নত কবিতা শুনলে তিনি তা বার বার আগ্রহের সাথে পড়তেন। যদিও খিলাফতের দায়িত্বের কারণে তিনি এসব কাজে জড়িত হতে পারতেন না বা জড়ানোর সুযোগ পেতেন না, তা সত্তে¡ও যেহেতু প্রকৃতিগত রুচি ছিল তাই শত-সহ পঙক্তি তার মুখস্থ ছিল। সাহিত্য বিশারদরা বলেন যে, তার এত বেশি কবিতা মুখস্থ ছিল যে, যখনই কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত করতেন অবশ্যই কোন পঙক্তি বা কবিতা পাঠ করতেন। তিনি শুধু সেসব কবিতা বা পঙক্তি পছন্দ করতেন যেগুলোতে আত্মসম্মানবোধ, স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মসম্ভ্রমবোধ, শিক্ষামূলক বিষয়াদি থাকত। এরই ভিত্তিতে সেনাকর্মকর্তা এবং বিভিন্ন জেলার কর্মকর্তাদের তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, মানুষকে কবিতা মুখস্থ করার নির্দেশ দেয়া হোক। যেমন আবু মূসা আশআরী (রা.)-কে তিনি এই নির্দেশ লিখে পাঠান যে, মানুষকে কবিতা বা কাব্য মুখস্থ করার নির্দেশ দাও, কেননা তা উন্নত নৈতিক বিষয়াদি এবং সঠিক মতামত আর ইনসাফ তথা ন্যায়বিচারের পথে পরিচালিত করে থাকে। সব জেলায় তিনি যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার বাক্যাবলী ছিল এই যে, নিজ সন্তানদের সাঁতার কাটা এবং ঘোড়ায় আরোহন করা শিখাও। আর প্রবাদবাক্য এবং উন্নতি মানের পঙক্তি মুখস্থ করাও, অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি কর। এখানে এ কথাও স্মরণ রাখার যোগ্য যে, হযরত উমর কবিতা ও কাব্যের বহু ত্রুটি দূর করেছেন। সে সময় পুরো আরবে যে রীতি প্রচলিত ছিল তা হলো, কবিরা ভদ্র মহিলাদের নাম প্রকাশ্যে কবিতায় উল্লেখ করত আর তাদের প্রতি নিজ ভালোবাসা প্রকাশ করত। হযরত উমর এই প্রথাকে দূরীভূত করেন, আর এর কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করেন। একইভাবে ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা লেখাকে তিনি অপরাধ আখ্যায়িত করেন আর প্রসিদ্ধ ব্যাঙ্গকবি হুতায়াকে এই অপরাধে তিনি কারাগারে প্রেরণ করেন। আল্লামা শিবলী নোমানী আরও লিখেন যে, সেই যুগের সবচেয়ে বড় কবি ছিল মুতাম্মেম বিন নুয়ায়রা, যার ভাইকে হযরত আবু বকর সিদ্দীকের যুগে হযরত খালেদ ভুলবশত হত্যা করেছিলেন। এই ঘটনা তাকে এতটা দুঃখভারাক্রান্ত করে যে, সে সবসময় কাঁদতো এবং শোকগাথা লিখতো। হযরত উমরের কাছে আসলে তিনি তাকে শোকগাঁথা শোনানোর নির্দেশ দেন। সে কিছু পঙক্তি পাঠ করে মাত্র। হযরত উমর তাকে বলেন, আমি যদি এমন শোকগাঁথা লিখতে পারতাম তাহলে আমি আমার ভাই যায়েদের উদ্দেশ্যে তা শোনাতাম বা লিখতাম। সে বলে, হে আমীরুল মু’মিনীন! যদি আমার ভাই আপনার ভাইয়ের মতো মারা যেতো, অর্থাৎ শহীদ হিসেবে মৃত্যু বরণ করত তাহলে আমি তার জন্য আদৌ শোক করতাম না। হযরত উমর সবসময় বলতেন যে, আর কেউ মুতাম্মেমের মতো আমাকে সমবেদনা জানায় নি।
হযরত উমরের শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন,
ভবিষ্যদ্বাণী সংক্রান্ত কোন কোন ঘটনা সম্পর্কে মনে করা হয় যে, তা একবারই পূর্ণ হবে, সেগুলো যদি ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয় বা অন্য কারো মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যেমনটি কিনা আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, ‘রোমান এবং পারস্য স¤্রাটের ধনভাÐারের চাবিকাঠি তাঁর হাতে রাখা হয়েছে’। এটি জানা কথা যে, এই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই মহানবী (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। আর তিনি (সা.) রোমান এবং পারস্য স¤্রাটের ধনভাÐারও দেখেন নি আর চাবিও দেখেন নি। কিন্তু যেহেতু অবধারিত ছিল যে, সেসব চাবি হযরত উমর (রা.) লাভ করবেন তাই হযরত উমরের অস্তিত্ব প্রতিচ্ছায়ারূপে যেন মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এরই সত্তা ছিল, এই কারণে ওহীর জগতে হযরত উমরের হাতকে আল্লাহ্র রসূল (সা.)-এর হাত আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এরপর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন,
এই বিশ্বাস রাখা আবশ্যক যে, সিদ্দীকে আকবর (রা.), হযরত উমর ফারুক (রা.), হযরত যুন্নুরাঈন (রা.) আর হযরত আলী মুর্তজা (রা.) সকলেই সত্যিকার অর্থে ধর্মের ক্ষেত্রে আমীন বা বিশসস্ত ছিলেন। আবু বকর (রা.), ইসলামের দ্বিতীয় আদম ছিলেন। একইভাবে হযরত উমর ফারুক আর হযরত উসমান (রা.) যদি ধর্মের ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে আমীন বা বিশ^স্ত না হতেন তাহলে আজ কুরআনের কোন একটি আয়াত সম্পর্কেও নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন যে তা আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ছিল।
এরপর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, আমাকে আমার প্রভুর পক্ষ থেকে খিলাফত সম্পর্কে নিশ্চিত শিক্ষা দেয়া হয়েছে আর গবেষকদের ন্যায় আমি এই বিষয়ের গভীরে অবগাহন করেছি আর আমার প্রভু আমার কাছে এটি প্রকাশ করেছেন যে, সিদ্দীক ও ফারুক এবং উসমান (রা.) পুণ্যবান এবং মু’মিন ছিলেন। আর সেই সমস্ত লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদেরকে আল্লাহ্ তা’লা মনোনীত করেছেন আর যারা রহমান খোদার বিশেষ দানে ধন্য হয়েছেন। অধিকাংশ তত্ত¡জ্ঞানী তাদের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের অনুক‚লে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা মহা সম্মানিত খোদার সন্তুষ্টির খাতিরে স্বদেশ ত্যাগ করেছেন, প্রত্যেক রণক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করেছেন আর গ্রীষ্মের দুপুরের দাবদাহ এবং শীতের রাতের ঠাÐার পরোয়া করেন নি, বরং সদ্য যৌবনে উপনীত যুবকের ন্যায় ধর্মের পথে অগ্রগামী হয়েছেন, আর স্বজন বিজনের প্রতি আকৃষ্ট হন নি এবং মহা সম্মানিত খোদার খাতিরে সবাইকে পরিত্যাগ করেছেন। তাদের আমলে সৌরভ ও তাদের কর্মে সুগন্ধি রয়েছে, আর এই সবকিছু তাদের পদমর্যাদার বাগান এবং তাদের পুণ্যের গুলিস্তানের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে আর তাদের প্রভাত সমীরণ নিজ সুরভিত বাতাসের ঝাপটায় তাদের রহস্যাবলীর সন্ধান প্রদান করে। আর তাদের জ্যোতি নিজ পূর্ণ দীপ্তির সাথে আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়। অতএব তুমি তাদের সৌরভের মাধ্যমে তাদের পদমর্যাদার ঔজ্জ্বল্য সম্পর্কে অবগত হও আর তড়িঘড়ি করে কুধারণার অনুবর্তী হয়ো না এবং কোন কোন রেওয়ায়েতের ওপর ভরসা করো না, কেননা সেগুলোতে মারাত্মক বিষ এবং অনেক বাড়াবাড়ি রয়েছে। আর সেগুলো নির্ভরযোগ্য হয় না। এসব রেওয়ায়েতের অনেকগুলোই ধ্বংসাত্মক ঝড় এবং বৃষ্টির ভ্রম সৃষ্টিকারী বিদ্যুৎ চমকের ন্যায়। অতএব আল্লাহ্ তা’লাকে ভয় কর আর এসব রেওয়ায়েতের অনুসরণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
তিনি আরও বলেন, খোদার কসম, আল্লাহ্ তা’লা শায়খাইন (অর্থাৎ হযরত আবু বকর এবং উমরকে) আর তৃতীয়ত যিনি যুন্নুরাইন, তাদের প্রত্যেককে ইসলামের দ্বার এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বাহিনীর অগ্রসেনা বানিয়েছেন। অতএব যে ব্যক্তি তাদের মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করে এবং তাদের (সত্যতার) স্পষ্ট প্রমাণকে তুচ্ছজ্ঞান করে আর তাদের প্রতি সশ্রদ্ধ ব্যবহার করে না, বরং তাদের অসম্মান করে এবং তাদের নামে অপালাপ করতে ব্যগ্র থাকে এবং বাজে কথা বলে, এমন ব্যক্তির অশুভ পরিণাম এবং ঈমান নষ্ট হওয়ার বিষয়ে আমার আশঙ্কা রয়েছে। আর যারা তাদেরকে কষ্ট দিয়েছে, তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছে এবং অপবাদ আরোপ করেছে, হৃদয়ের কঠোরতা এবং রহমান খোদার ক্রোধ তাদের পরিণতি হয়েছে। আমার পুনঃ পুনঃ যে অভিজ্ঞতা হয়েছে আর স্পষ্টভাবে যা আমি প্রকাশও করেছি তা হলো, এসব পুণ্যবানের প্রতি ক্রোধ এবং বিদ্বেষ পোষণ করা কল্যাণের উৎস খোদার সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পর্কহীনতার কারণ। আর যে-ই তাদের প্রতি শত্রুতা করেছে এমন ব্যক্তির জন্য রহমত এবং দয়ার সব পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। আর জ্ঞান এবং তত্ত¡জ্ঞানের দ্বার তার জন্য খোলা হয় না। আল্লাহ্ এমন লোকদেরকে জাগতিক ভোগবিলাসের মাঝে ছেড়ে দেন এবং জাগতিক কামনা বাসনার গহ্বরে ঠেলে দেন আর তাকে নিজের দরবার থেকে প্রত্যাখ্যাত এবং বঞ্চিত করে দেন।
তাদেরকে, অর্থাৎ খুলাফায়ে রাশেদীনকে সেভাবে কষ্ট দেয়া হয়েছে যেভাবে নবীদের কষ্ট দেয়া হয়েছিল এবং তাদেরকে সেভাবে অভিসম্পাত করা হয়েছে যেভাবে প্রত্যাদিষ্টদের অভিসম্পাত করা হয়েছে। এভাবে তারা যে রসূলদের উত্তরাধিকারী ছিলেন তা প্রমাণিত হয়ে গেছে আর কিয়ামত দিবসে তাদের পুরস্কার বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের ইমামদের মতো অবধারিত হয়ে যায়, কেননা মু’মিনকে যখন কোন দোষ না থাকা সত্তে¡ও অভিসম্পাত করা হয় আর কাফের আখ্যা দেয়া হয় এবং বিনা কারণে তাদের ব্যঙ্গ করা হয় আর তার নামে আজেবাজে কথা বলা হয় তখন সে নবীদের সদৃশ হয়ে যায় এবং আল্লাহ্র মনোনীত বান্দাদের মতো হয়ে যায়। অতঃপর তাকে প্রতিদান দেয়া হয় যেমনটি নবীদের প্রতিদান দেয়া হয়ে থাকে আর সে প্রত্যাদিষ্টদের ন্যায় পুরস্কার লাভ করে। তারা নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ রসূলের আনুগত্যে মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। আর মহা সম্মানিত খোদা যেভাবে তাদের প্রশংসা করেছেন (সে অনুসারে) তারা অসাধারণ এক উম্মত ছিলেন। আর তিনি স্বয়ং তাদেরকে সেভাবে সমর্থন করেছেন যেভাবে নিজের সব মনোনীত বান্দাদের তিনি সমর্থন ও সাহায্য করেন। সত্যিকার অর্থে তাদের নিষ্ঠার জ্যোতি ও তাদের পবিত্রতার লক্ষণাবলী পূর্ণ দীপ্তির সাথে প্রকাশ পেয়েছে। আর এটি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তারা সত্যবাদী ছিলেন আর আল্লাহ্ তাদের প্রতি এবং তারা আল্লাহ্র প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন আর তিনি তাদেরকে সেসবকিছু দিয়েছেন যা এই বিশ^জগতে অন্য কাউকে দেয়া হয় নি।

শিয়াদের একটি কথা খন্ডন করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, শিয়াদের মাঝে যারা মনে করে যে, আবু বকর সিদ্দীক বা উমর ফারুক আলী মুর্তজা বা ফতেমাতুয যাহরা-র অধিকার হরণ করেছেন এবং তাদের প্রতি অন্যায় করেছেন, এমন ব্যক্তি ন্যায় পরিত্যাগ করে অন্যায়কে ভালোবেসেছে আর সীমালঙ্ঘনকারীদের পন্থা অবলম্বন করেছে। নিশ্চয় সেসব লোক, যারা আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের জন্য প্রিয় স্বদেশ, বন্ধুবান্ধব এবং ধনসম্পদ পরিত্যাগ করেছে আর যাদেকে কাফেরদের পক্ষ থেকে দুঃখকষ্ট দেয়া হয়েছে এবং যারা দুষ্কৃতিপরায়নদের হস্তক্ষেপে বাড়ি ছাড়া হয়েছেন তবুও তারা উত্তম ও পুণ্যবান লোকদের ন্যায় ধৈর্য ধারণ করেছেন, তারা খলীফা মনোনীত হওয়া সত্তে¡ও নিজেদের ঘরবাড়ি সোনা-রুপা দিয়ে ভর্তি করেন নি এবং নিজ ছেলে-মেয়েদেরকে সোনা ও রুপার উত্তরাধিকারী বানান নি বরং যা-কিছু অর্জিত হয়েছে, তা বায়তুল মালে সমর্পণ করেছেন আর বস্তুপূজারী এবং পথভ্রষ্টদের ন্যায় তারা পুত্রদেরকে নিজের খলীফা মনোনীত করেন নি। তারা এ পৃথিবীতে দারিদ্র ও দীনতার মাঝে জীবন অতিবাহিত করেছেন আর তারা আমীর এবং ধনীদের ন্যায় ভোগবিলাসিতার প্রতি ঝুঁকে যান নি। তাদের বিষয়ে কি এমন ধারণা করা যেতে পারে যে, তারা অন্যায়ভাবে মানুষের ধনসম্পদ হস্তগতকারী ছিলেন আর অধিকার হরণ করেছেন, লুটতরাজ করেছেন এবং রাহাজানীর প্রতি তাদের ঝোঁক ছিল? তাদের ওপর বিশে^র গর্ব রসূল (সা.)-এর পবিত্র সাহচর্যের এ ফলাফলই ছিল! অথচ সমস্ত জগতের প্রভু আল্লাহ্, তাদের গুণকীর্তন করেছেন। প্রকৃত বিষয় হল, আল্লাহ্ তা’লা তাদের আত্মাকে পবিত্র করেছেন এবং এবং তাদের হৃদয়কে পবিত্রতা দান করেছেন, তাদের সত্তাকে আলোকিত করেছেন এবং ভবিষ্যৎ পবিত্রাত্মাদের অগ্রজ বানিয়েছেন। তাঁদের সাথে অন্যায়ের কোন সম্পর্ক দেখানো দূরে থাক, আমরা এমন কোন বিষয়ের ক্ষীণ সম্ভাবনাও দেখি না বা আমরা ঘুণাক্ষরেও এমন কোন সন্দেহ পোষণ করতে পারি না যা তাঁদের রুগ্ন মন-মানসিকতা বা তাঁদের সামান্যতম পাপের দিকে ইঙ্গিত করতে পারে। আল্লাহ্র শপথ! তারা ন্যায়পরায়ন মানুষ ছিলেন। এক উপত্যকা পরিমান অবৈধ সম্পদও যদি তাঁদেরকে দেয়া হত, তাঁরা তাতে থু থুও ফেলতেন না। পর্বতসম বা পৃথিবীসম স্বর্ণও যদি থাকত তবুও তাঁরা কামনা-বাসনার পুজারীদের ন্যায় এর প্রতি আকর্ষণ বোধ করতেন না। কোন বৈধ সম্পদ পেলে তাঁরা তা মহা প্রতাপের অধিকারী আল্লাহ্র পথে ধর্মীয় কাজে ব্যয় করতেন।
অতএব আমরা কী করে ভাবতে পারি, তাঁরা নবীজীর কলিজার টুকরো হযরত ফাতেমাতুয যাহরাকে কয়েকটি গাছের জন্য ক্ষিপ্ত করতে ও নবী-কন্যাকে দুষ্কৃতকারীদের মত কষ্ট দিতে পারেন? সত্য কথা হল, সাধুজনরা সদিচ্ছা রাখেন, তাঁরা সত্যের ওপর দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকেন এবং তাঁদের ওপর খোদার পক্ষ থেকে অনেক কল্যাণ বর্ষিত হয়। আল্লাহ্ তা’লা খোদাভীরুদের হৃদয়ের গোপন চিত্র সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।
এরপর তিনি বলেন, ‘সত্য কথা হলো, হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমর (রা.) উভয়েই প্রথম জ্যেষ্ঠ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা অধিকার প্রদানের বিষয়ে কোনরূপ ত্রুটি করেন নি। তাঁরা তাকওয়ার পথকে জীবনের মূলমন্ত্র আর ন্যায়-নীতিকে লক্ষ্য হিসেবে অবলম্বন করেছেন। তাঁরা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করতেন আর রহস্যের মূল উদ্ঘাটনের বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু থাকতেন। ইহজাগতিক কামনাবাসনা চরিতার্থ করা কখনও তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁরা নিজেদের জীবনকে খোদার আনুগত্যের জন্য উৎসর্গ করে রেখেছিলেন। প্রভূত কল্যাণ ও মহানবী (সা.)-এর ধর্মের সাহায্যকারী হিসেবে শায়খাইন [তথা হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (রা.)]-এর মত অন্য কাউকে আমি দেখতে পাই নি। মানবকূল-সূর্য হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরা চন্দ্রের তুলনায় বেশি গতিসম্পন্ন ছিলেন। তাঁরা তাঁর (সা.) ভালবাসায় বিলীন ছিলেন এবং সত্য ও সঠিক পথকে লাভ করার বাসনায় সব কষ্টকে সুমিষ্ট বিষয় বলে জ্ঞান করতেন। তাঁরা অনন্য ও অদ্বিতীয় নবীর জন্য সব লাঞ্ছনাকে সানন্দে বরণ করেছেন।
কাফের বাহিনী ও সত্যবিরোধী শত্রুসেনার মোকাবেলায় তারা সিংহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। এর ফলে এক পর্যায়ে ইসলাম জয়যুক্ত হয়েছে আর বিরোধী বাহিনী পরাজিত হয়েছে, র্শিক বা খোদার অংশীবাদিতা দুর্বল হতে হতে নির্মূল হয়ে গেছে এবং মুসলমান ও ইসলামের সূর্য ঝলমল করে উঠেছে। বহুমুখী ও প্রশংসনীয় ধর্মসেবা এবং মুসলমানদের প্রতি বিভিন্ন ধরনের অনুগ্রহ ও অনুকম্পা প্রদর্শনের পাশাপাশি সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলমান মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্য লাভ ছিল তাঁদের জীবনের শুভ পরিণতি। এটি আল্লাহ্র সেই অনুগ্রহ যে বিষয়ে মুত্তকীরা অনবহিত নন। নিঃসন্দেহে ফযল বা অনুগ্রহ খোদার হাতে, তিনি যাকে চান- তা দান করেন। পুরো নিষ্ঠার সাথে তাঁর আঁচল যে আঁকড়ে ধরে, গোটা জগত তার বিরোধিতা করলেও আল্লাহ্ তাকে কক্ষনও বিফল মনোরথ হতে দেন না।
আল্লাহ্ অন্বেষী কোন ক্ষতি এবং সংকীর্ণতার মুখোমুখি হয় না এবং আল্লাহ্ সত্যবাদীদের কখনও অসহায় ও নিরুপায় অবস্থায় পরিত্যাগ করেন না। আল্লাহু আকবর। তাঁদের [তথা আবু বকর এবং উমর (রা.)-এর] অপ্রকাশিত জীবনের চিত্র এবং তাঁদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা কত মহান! তাঁরা এমন এক বরকতমÐিত সমাধিস্থলে সমাহিত হয়েছেন যে, মূসা (আ.) ও ঈসা (আ.)-ও যদি জীবিত থাকতেন তাহলে তাঁরা উভয়ে শত ঈর্ষায় সেখানে গোরস্থ হবার বাসনা পোষণ করতেন। কিন্তু এ পদমর্যাদা শুধু আকাঙ্খা করলেই পাওয়া যায় না বা চাইলেই দেয়া হয় না বরং তা সম্মানিত প্রভুর পক্ষ থেকে এক চিরস্থায়ী রহমত। এ রহমত শুধু তাঁদেরই লাভ হয় যাঁদের ওপর থাকে খোদার সুদৃষ্টি এবং যাঁদেরকে আল্লাহ্র অনুগ্রহের চাদর আগাগোড়া আবৃত করে রাখে।
তিনি (আ.) আরও বলেন:
মহানবী (সা.)-এর পর ইসলামের যে উন্নতি-ই সাধিত হয়েছে, তা আসহাবে সালাসাহ তথা এই তিনজন সাহাবীর মাধ্যমেই হয়েছে। হযরত উমর (রা.) যা কিছু করে গিয়েছেন, যদিও তা কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখার মত নয়, কিন্তু তাঁর কার্যক্রম কোনভাবেই সিদ্দীকে আকবর তথা সবচেয়ে বড় সত্যবাদী (হযরত আবু বকর) (রা.)-এর কর্মকে ছোট করে দেখাতে পারবে না, কেননা সফলতার মূল ভিত্তি হযরত আবুবকর (রা.)-ই রেখেছিলেন এবং বিশাল বড় যে নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল, তিনিই তা নির্মূল করেছিলেন। সেই সময় যেসকল সমস্যা ও জটিলতার সম্মুখীন হযরত আবু বকর (রা.)কে হতে হয়েছে, তা হযরত উমরকে কখনই হতে হয় নি। সুতরাং হযরত আবু বকর (রা.) পথ সুগম করে দিয়েছেন, আর সেই পথ ধরে হযরত উমর বিজয়ের পর বিজয় অর্জন করেছেন।
হযরত মৌলবী আবদুল করিম শিয়ালকোটি সাহেব হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-এরহৃদয়ে মহানবী (সা.) এবং শায়খাইন তথা হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত উমর (রা.)-এর প্রতি যে ভালবাসা ও সম্মান ছিল এ সম্পর্কে লিখেন, একদা এক ব্যক্তি যিনি মসীহ মওউদ (আ.)-এর প্রেমে বিভোর ছিলেন, হযরত মসীহ মওউদ (আ.)-এর নিকট নিবেদন করেন, আমরা আপনাকে শায়খাইন অর্থাৎ হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (রা.)-এর থেকে মর্যাদার দিক থেকে উত্তম এবং মহানবী (সা.)-এর মর্যাদার নিকটবর্তী মর্যাদার অধিকারী মনে করবো না? হযরত মসীহ মওউদ এর বিনয় ও সততা দেখুন! একথা শুনে হযরত আকদাস মসীহ মওউদ (আ.)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায় এবং আপাদমস্তকে এক অদ্ভ‚ত অস্থিরতা ও ব্যকুলতা ছেয়ে যায়। তিনি (আ.) বলেন, আমি মহাপ্রতাপান্বিত ও অতি পবিত্র আল্লাহ্র কসম খেয়ে বলছি, এই মুহূর্তটি মহানবী (সা.)-এর প্রতি আমার ঈমান আরও দৃঢ় করে দিয়েছে। তিনি (আ.) এরপর বিরতিহীন ৬ ঘন্টা একটি পরিপূর্ণ বক্তৃতা করেন। তিনি বক্তৃতা আরম্ভ করার সময় আমি ঘড়ি দেখেছিলাম এবং যখন তিনি (আ.) বক্তৃতা শেষ করলেন, তখন তাকিয়ে দেখি কাঁটায় কাঁটায় ৬ ঘন্টা তিনি (আ.) বক্তৃতা করেছেন। এক মিনিটও এদিক সেদিক হয় নি। এত দীর্ঘ সময় ধরে একটি বিষয় বর্ণনা করা এবং বিরতিহীনভাবে বক্তৃতা করা একটি অলৌকিক বিষয়ই বটে। পুরো বক্তৃতায় তিনি (আ.) মহানবী (সা.)-এর প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং একজন ভৃত্য ও আজ্ঞাবহ দাস হিসেবে মহানবী (সা.) এবং জনাব শায়খাইন তথা হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (রা.)-এর গুণাবলী বর্ণনা করেন। (তিনি বলেন) এগর্ব আমার জন্য যথেষ্ট যে আমি তাদের স্তুতিগান গাই এবং আমি তাদের পদধূলি তুল্য। আল্লাহ তা’লা তাদের কোন কোন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন কিয়মাত পর্যন্ত অন্য কোন ব্যক্তি তা লাভ করতে পারবে না। মহানবী (সা.) পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আর আগমন করবেন না, যে কেউ তাঁর সেসব সেবা করার সম্মান পাবে যা শায়খাইন তথা হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (রা.) পেয়েছিলেন।
হযরত উমর (রা.)-এর জীবনচরিত বর্ণনা এখানে এসে শেষ হচ্ছে অর্থাৎ আজকের খুতবায়। ইনশাআল্লাহ পরবর্তিতে যদি আল্লাহ তা’লা সৌভাগ্য দান করেন, তাহলে হযরত আবু বকর (রা.)-এর জীবনচরিত বর্ণনা আরম্ভ হবে।