01 Oct শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত উমর (রা.) জুমুআর খুতবা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ মোতাবেক ২৪ তাবুক, ১৪০০ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা
তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
হযরত উমর (রা.)-এর যুগের স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় আজ বায়তুল মুকাদ্দাসের বিজয় সম্পর্কে উল্লেখ করা হবে যা ১৫ হিজরী সনে অর্জিত হয়েছিল। হযরত আমর বিন আস (রা.)-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করে আর তখন হযরত আবু উবায়দা (রা.)-এর বাহিনীও তার সাথে যোগ দেয়। খ্রিষ্টানরা দুর্গে অবরুদ্ধ থেকে অতিষ্ঠ হয়ে যায় আর সন্ধির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তারা শর্ত দেয় যে স্বয়ং হযরত উমর (রা.)কে এসে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করতে হবে। হযরত আবু উবায়দা (রা.) হযরত উমর (রা.)কে এ সম্পর্কে অবগত করেন। হযরত উমর (রা.) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেন আর হযরত আলী (রা.) যাওয়ার পরামর্শ দেন। হযরত উমর (রা.) তার মতামত পছন্দ করেন। এরপর হযরত উমর (রা.) হযরত আলী (রা.)কে মদিনার আমীর নিযুক্ত করেন। অপর রওয়ায়েত অনুসারে, তিনি (রা.) হযরত উসমান (রা.) কে আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। এরপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। হযরত উমর (রা.)-এর এই সফর কোন সাধারণ সফর ছিল না। এর উদ্দেশ্য ছিল শত্রুদের হৃদয়ে ইসলামের প্রতাপ ও প্রভাব প্রথিত করা। কিন্তু রেওয়ায়েতে রয়েছে, যাত্রা করার সময় তাঁর সাথে জাগতিক রাজাবাদশাদের মত কোন ঢাক-ঢোল বা বাদ্যযন্ত্র আর কোন সৈন্য-সামন্তও ছিল না, এমনকি একটি সামান্য তাবুও সাথে ছিল না। হযরত উমর (রা.) একটি ঘোড়ায় আরোহিত ছিলেন আর তাঁর সাথে কয়েকজন মুহাজের ও আনসার সাথী ছিলেন। একটি রেওয়ায়েতে অনুসারে, হযরত উমর (রা.)-এর সাথে কেবল তার একজন ভৃত্য, খাওয়ার জন্য সামন্য ছাতু ও একটি কাঠের পেয়ালা ছিল আর (তিনি) ঘোড়ায় আরোহিত ছিলেন। তথাপি হযরত উমর (রা.) মদিনা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের উদ্দেশ্যে যাত্রার মনস্থির করেছেন মর্মে সংবাদ যেখানেই পৌঁছত সেখানকার মাটি কেঁপে উঠত।
এ সফরের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হয়েছে, বিশদ কোন বিবরণ নেই; তাহলো, এলিয়া একটি শহর ছিল যেখানে বায়তুল মুকাদ্দাস অবস্থিত। এর অবরোধ কে করেছিল আর কে হযরত উমর (রা.)-এর সমীপে বায়তুল মুকাদ্দাস যাওয়ার আবেদন করেছিলেন? এ সম্পর্কে তবারীর ইতিহাসে লিখা আছে যে, হযরত আমর বিন আস (রা.) হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.)কে পত্র লিখেন যাতে তার কাছে তিনি সাহায্য প্রেরণের অনুরোধ জানান। হযরত আমর বিন আস (রা.) এতে এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, আমি এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সম্মুখীন, আর বেশ কয়েকটি শহর রয়েছে যেখানে অভিযান পরিচালনা এখনো বাকি আছে। আপনার নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছি। হযরত উমর (রা.)-এর নিকট হযরত আমর বিন আস (রা.)-এর এই পত্রটি পৌঁছার পর তিনি (রা.) বুঝতে পারেন, হযরত আমর বিন আস (রা.) এ বিষয়টি পুরো খবরাখবর নেয়ার পরই পত্র লিখে থাকবেন। এরপর হযরত উমর (রা.) লোকদের মাঝে তাঁর সফরের ঘোষণা করিয়ে দেন এবং সফরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। হযরত উমর (রা.)-এর সিরিয়ায় আগমন সম্পর্কে তবারীতে আরো লেখা আছে, মূলত এর যে কারণ ছিল তা হলো, হযরত আবু উবায়দা (রা.) বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছার পর সেখানকার লোকেরা তার কাছে সিরিয়ার অন্যান্য শহরের সন্ধিচুক্তিগুলোর আদলে সন্ধি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আর তাদের এ আকাঙ্খাও ছিল যে, এই সন্ধিচুক্তিতে মুসলমানদের পক্ষ থেকে যেন প্রধান হিসেবে হযরত উমর (রা.)ও অংশগ্রহণ করেন। হযরত উমর (রা.)-এর সমীপে হযরত আবু উবায়দা (রা.) এ বিষয়ে লিখলে হযরত উমর (রা.) মদিনা হতে যাত্রা করেন। কিন্তু হযরত আবু উবায়দা (রা.) এর এই রেওয়ায়েতের বিষয়ে কোন কোন ঐতিহাসিক নিশ্চিৎ নন। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ হোসেন হ্যায়কেল লিখেন, এ রেওয়ায়েতটিকে আমাদের অমূলক মনে করা উচিত যার বিবরণ হলো হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ বা হযরত আবু উবায়দা বিন র্জারা এককভাবে বা যৌথভাবে বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেছিলেন, যেমনটি কি-না তবারী, ইবনে আসীর এবং ইবনে কায়সা প্রমুখরা উল্লেখ করেছেন। তবারীর রেওয়ায়েত অনুসারে, বলা হয়ে থাকে, হযরত উমর (রা.)-এর সিরিয়া আসার কারণ এটি ছিল যে, হযরত আবু উবায়দা (রা.) বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেছিলেন। শহরবাসীরা তাকে সেসব শর্তেই তাদের সাথে সন্ধির আবেদন জানায় যেসব শর্তে সিরিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল। কিন্তু এতে আরেকটি যে শর্ত জুড়ে দেয়া হয় তা হলো হযরত উমর বিন খাত্তাব যেন স্বয়ং এসে এই সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন। হযরত আবু উবায়দা এর সংবাদ খলীফার দরবারে প্রেরণ করেন আর হযরত উমর (রা.) মদীনা থেকে রওয়ানা হয়ে যান।
তিনি লিখেন, এই রেওয়ায়েতকে আমরা বাস্তবতা পরিপন্থি মনে করি, কেননা বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধের সময় হযরত আবু উবায়দা এবং হযরত খালেদ হিমস্, আলেপ্পো, আন্তাকিয়া এবং এর পার্শ্ববর্তী শহরগুলো জয় করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন আর হিরাক্লিয়াস রওহা নামক স্থানে অবস্থান করে তার সৈন্যদের একত্রিত করছিল যাতে তাদেরকে সে ফেরত যেতে বাধ্য করতে পারে। এই সমস্ত ঘটনাও বায়তুল মুকাদ্দাসের অবরোধের ন্যায় ১৫ হিজরী মোতাবেক ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দেরই ঘটনা। তার মতে সঠিক বিষয়টি হলো সেই বছরই বায়তুল মুকাদ্দাসের অবরোধ কয়েক মাস পর্যন্ত চলতে থাকে যে বছর এই দুজন সেনাপতি সিরিয়ার শেষ অংশটুকোও জয় করার জন্য অগ্রাভিযানে ব্যস্ত ছিলেন। এমনকি হিরাক্লিয়াসকে তারা তার রাজধানীতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিলেন। এমতাবস্থায় যখন এ দুইজন এদিকে ব্যস্ত ছিলেন তখন একথা বলা যে, তাদের মধ্য থেকে কোন একজন বা দুজনেই বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেছেন, এটি এমন একটি বিষয় যা কোনভাবেই মিলে না। এজন্যই একে অগ্রহণযোগ্য আখ্যা দিতে হয়। এখন শুধু এই একটি রেওয়ায়েতই অবশিষ্ট থাকে যাতে (উল্লেখ রয়েছে) বায়তুল মুকাদ্দাস অবরোধ করেছিলেন হযরত আমর বিন আস যা দীর্ঘদিন চলতে থাকে আর তবারীও প্রথমে এ সম্পর্কে লিখেছেন। অপরদিকে বায়তুল মুকাদ্দাসের অধিবাসীরা গভীর উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অবিচলতার সাথে মুসলিম বাহিনীর মোকাবিলা করে। আমাদের মতে এ রেওয়ায়েতটিই সঠিক। কেননা এটি সেই মোকাবিলার সাথে সামঞ্জস্য রাখে, অর্থাৎ যে মোকাবিলা হচ্ছিল তা বিভিন্ন যুগে প্রত্যেক আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে বায়তুল মুকাদ্দাস যে প্রতিরোধ গড়ে তার সাথে সামঞ্জস্য রাখে। মুহাম্মদ হোসেন হ্যায়কেল আরো লিখেন, আশ্চর্যের বিষয় হলো হযরত উমর (রা.) কেবল সন্ধিচুক্তি বাস্তবায়ন এবং অঙ্গীকারনামা বাস্তবায়নের জন্য সৈন্যদলসহ চলে যান! অনুরূপভাবে আশ্চর্যের বিষয় হলো বায়তুল মুকাদ্দাসের বাসিন্দারা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য হযরত উমর (রা.)কে মদীনা থেকে আসার দাবি জানায়; অথচ তারা জানে যে, কোন কাফেলা যদি মদীনা থেকে বিরামহীন সফরও করে তাদের কাছে আসতে পুরো তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। এজন্য তিনি বলেন, আমার মতে সঠিক কথা হলো অবরোধ দীর্ঘায়িত হওয়া এবং হযরত আমর বিন আস (রা.)-এর এসব চিঠিপত্র থেকে যাতে শত্রু পক্ষের শক্তিমত্তার উল্লেখ করে সাহায্য চাওয়ায় হযরত উমর (রা.)-বিচলিত হয়ে পড়েন। অতএব তাঁর কাছে যখন নতুন করে সাহায্যকারী সৈন্য চাওয়া হয় তখন এর সাথে হযরত উমর (রা.)ও যাত্রা করেন এবং জাবিয়াতে শিবির স্থাপন করেন, যা সিরিয়া মরুভূমি ও জর্ডানের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। ইতোমধ্যে হযরত আবু উবায়দা (রা.) ও হযরত খালিদ (রা.) সিরিয়া বিজয় সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন। হযরত উমর (রা.) তাদের দুজনকেই জাবিয়ায় এসে মিলিত হওয়ার নির্দেশ দেন যেন হযরত উমর (রা.) তাদের সাথে এবং অন্যান্য সেনাপতির সাথে পরামর্শের পর বায়তুল মুকাদ্দাসের অভিযান সফল করার জন্য কোন কার্যকর পন্থা খুঁজে বের করতে পারেন।
আতরাবুন ও সাফ্রনিউস হযরত উমর (রা.)-এর আগমন সম্পর্কে অবগত হয়। এখানেও তাদের নাম সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। আরবী বইপুস্তকে এই নাম আরতাবুন লেখা আছে। কিন্তু হ্যায়কেলের মতে এটি সঠিক নয়, তার গবেষণা অনুসারে সে নামটি আতরাবুন ,আর সাফ্রনিউজের নাম আরবী বইপুস্তকে সাফরুনিউজ লেখা রয়েছে। হযরত আবু উবায়দা এবং হযরত খালিদ (রা.)-এর হাতে সিরিয়ায় যা ঘটেছিল সেটিরও সংবাদ পেলে (পুরো বিষয়টি) তারা বুঝতে পারেন। যাহোক তিনি বলেন, হযরত উমর (রা.) কোন পথ বের করার জন্য, অর্থাৎ কী কৌশল অবলম্বণ করা যায় তা (আলোচনার) জন্য তাদেরকে একত্রিত করেছিলেন। হযরত আবু উবায়দা এবং হযরত খালিদ (রা.) এই দুই সেনাপতির হাতে সিরিয়াতে যা কিছু সংঘটিত হয়েছিল তা-ও অবগত হওয়ার পর তারা, অর্থাৎ শত্রুরা বুঝতে পারে, বায়তুল মুকদ্দাসের প্রতিরোধ আর বেশি দিন টিকবে না, অর্থাৎ মোকাবিলা করা অনেক কঠিন। ফলে আতরাবুন কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে চুপিসারে মিশরে পালিয়ে যায় এবং বৃদ্ধ পাদ্রী নিজের মুক্তির বিষয়ে আশ্বস্ত হওয়ার পর মুসলমানদের সাথে সন্ধির জন্য আলোচনা আরম্ভ করে। সে যেহেতু জানত যে, আমীরুল মু’মিনীন জাবিয়াতে অবস্থান করছেন, অর্থাৎ জাবিয়া পর্যন্ত এসে গিয়েছেন, তাই এই শর্ত দেয় যে, তিনি নিজে যেন সন্ধিচুক্তি লেখার জন্য আসেন। জাবিয়া এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের মাঝে এত বেশি দূরত্ব ছিল না যে, সাফ্রনিউসের এই আবেদনের প্রেক্ষিতে অপারগতা প্রকাশ করা যেতো। অতএব তিনি বলেন, এটি হলো সেই বিষয় যাকে আমি সঠিক মনে করি আর সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনের ওপর আক্রমণের যে ঘটনাপ্রবাহ এটি সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্য রাখে।
যাহোক এসব চিঠি পাওয়ার পর হযরত উমর (রা.) যে পরামর্শ করেন সে সম্বন্ধে লিখা আছে, পত্রগুলো পাওয়ার পর হযরত উমর (রা.) সকল সম্মানিত সাহাবীকে একত্রিত করেন এবং পরামর্শ করেন। হযরত উসমান (রা.) বলেন, খ্রিষ্টানরা ভীতসন্ত্রস্ত ও হতোদ্যম হয়ে গেছে, তাই আপনি তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করলে তারা আরো বেশি লাঞ্ছিত হবে আর ভাববে যে মুসলমানরা আমাদের তুচ্ছ জ্ঞান করে এটি ভেবে তারা বিনাশর্তে অস্ত্র সমর্পণ করবে। কিন্তু হযরত আলী (রা.) এর বিপরীত মতামত ব্যক্ত করেন এবং হযরত উমর (রা.)-কে এলিয়ায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, মুসলমানেরা ঠাণ্ডা, যুদ্ধ এবং দীর্ঘকাল সেখানে অবস্থানের কষ্ট সহ্য করেছে। তাই আপনি সেখানে গেলে এতে আপনার এবং মুসলমানদের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা এবং বরকত নিহিত থাকবে। কিন্তু আপনি যদি তাদেরকে আপনার (দর্শন প্রদান) এবং শান্তিচুক্তির বিষয়ে হতাশ করেন তবে এটি আপনার জন্য ভালো হবে না। তারা, অর্থাৎ শত্রুরা দুর্গে অবরুদ্ধ হয়ে বসে যাবে আর তাদের স্বদেশীদের এবং রোমান সম্রাটের পক্ষ থেকে সেনাসাহায্য এসে যাবে। বিশেষ করে এজন্য যে, বায়তুল মুকাদ্দাস তাদের দৃষ্টিতে গভীর মাহত্ব রাথে এবং এটি তাদের তীর্থস্থান। হযরত উমর (রা.) হযরত আলী (রা.)-এর এই পরামর্শ পছন্দ করেন এবং মেনে নেন।
এই সফরে হযরত উমর (রা.)-এর সাথে অন্যান্য মুহাজের ও আনসার সাহাবী ছাড়াও হযরত আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব (রা.)ও ছিলেন। এ সফর সম্পর্কে আবু সাঈদ মাকবুরীর একটি রেওয়ায়েত রয়েছে তাহলো, হযরত উমর (রা.) এই সফরে ফজরের নামাযের পর, তার সাথীদের মাঝে তাদের দিকে মুখ করে বসতেন এবং তাদেরকে বলতেন, সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা’লার যিনি আমাদেরকে ইসলাম এবং ঈমানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন আর মহানবী (সা.)-এর কল্যাণে আমাদেরকে মর্যাদা দান করেছেন আর তাঁর (সা.) মাধ্যমে পথভ্রষ্টতার বিপরীতে হেদায়েত দান করেছেন এবং দলে উপদলে বিভক্ত করার পরিবর্তে আমাদের একত্রিত করেছেন। এছাড়া আমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেছেন এবং শত্রুর বিপরীতে তাঁর মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করেছেন। তিনি আমাদেরকে বিভিন্ন শহরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন এবং তাঁর (সা.) মাধ্যমে আমাদেরকে এমন ভাই-ভাই বানিয়ে দিয়েছেন যারা পরস্পরকে ভালবাসে। এতএব এসব নিয়ামতের জন্য তোমরা আল্লাহ্ তা’লার গুণকীর্তন কর এবং তাঁর নিকট আরো সাহায্য যাচনা কর। এসব নিয়ামতের জন্য আল্লাহ্র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সামর্থ যাচনা কর এবং যেসব নিয়ামতের মাঝে তোমরা বিচরণ কর সেগুলোর জন্য আল্লাহ্ তা’লার নিকট দোয়া কর যেন তিনি তোমাদের জন্য সেগুলোকে পরিপূর্ণ করে দেন। কেননা মহাসম্মানিত ও মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ্ তাঁর প্রতি অনুরাগ দেখতে চান। কৃতজ্ঞদের জন্য তিনি স্বীয় নিয়ামতরাজি পরিপূর্ণ করে দেন। হযরত উমর (রা.) তার এই সফরের শুরু থেকে ফেরত আসা পর্যন্ত প্রতিদিন ভোরে এসব কথা বলতেন আর এটি পরিত্যাগ করেন নি, অর্থাৎ একই বার্তা প্রতিদিন দিতেন।
মুসলমান নেতাদের অবগত করা হয়েছিল যেন তারা জাবিয়ায় এসে তার সাথে মিলিত হয় । সংবাদ অনুযায়ী ইয়াযিদ বিন আবি সুফিয়ান আর খালেদ বিন ওয়ালিদ প্রমুখ (তাকে) এখানেই স্বাগত জানান। সিরিয়ায় অবস্থান করে এই সেনানায়কদের মাঝে আরবের অনাড়ম্বরতা অবশিষ্ট ছিল না। অতএব হযরত উমরের সামনে তারা যখন আসেন তখন তাদের গায়ে রেশমের উজ্জল ও বিলাসিতাপূর্ণ পোশাক ছিল আর চাকচিক্যপূর্ণ পোশাক ও বাহ্যিক আড়ম্বরতায় তাদেরকে অনারব দেখায়। হযরত উমর এতে খুবই রাগান্বিত হন। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে পড়েন আর কঙ্কর উঠিয়ে তাদের দিকে ছুঁড়ে মারেন যে, এত দ্রুত তোমরা অনারব অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ। তারা বলেন, আমাদের পোশাকের নীচে অস্ত্র রয়েছে অর্থাৎ সৈনিকসুলভ দক্ষতা ও কষ্টসহিষ্ণুতা আমরা বিসর্জন দিই নি। এতে হযরত উমর বলেন, যদি এমনই হয়ে থাকে তাহলে ঠিক আছে যে, এসব বাহ্যিক রূপ তোমরা তাদেরকে দেখানোর জন্য ধারণ করেছ আর ভেতর থেকে তোমরা আরবই আছ। একটি রেওয়ায়েতে উল্লেখ রয়েছে যে, ইয়াযিদ বিন আবি সুফিয়ান তখন নিবেদন করেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! আমাদের কাছে অজস্র পোশাক এবং বাহন রয়েছে। এখানে আমাদের জীবন অতি উন্নত মানের এবং পণ্য খুবই শস্তা, অধিকন্তু মুসলমানদের অবস্থা এমন যেটি আপনি পছন্দ করবেন। আপনি যদি এই শুভ্র পোশাক পরিধান করেন আর এসব উন্নত বাহনে চড়েন আর বিপুল পরিমান খাদ্যশস্য হতে মুসলমানদের খাওয়ার জন্য দান করেন তাহলে তা সুনামের কারণ হবে আর রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আপনার জন্য অধিক সৌন্দর্যের কারণ হবে, এছাড়া অনারবদের কাছে আপনার অধিক মাহত্বের কারণ হবে। এতে হযরত উমর বলেন, হে ইয়াযিদ! না, খোদার কসম, আমি সেই বেশভূষা এবং অবস্থাকে পরিত্যাগ করব না যাতে আমি আমার উভয় সঙ্গীকে ছেড়েছিলাম। অর্থাৎ মহানবী (সা.) এবং হযরত আবু বকর (রা.)-এর সাথে যে অবস্থায় ছিলাম সে অবস্থাতেই আমি থাকব। আমি মানুষের জন্য সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা অবলম্বন করব না, কেননা আমার শঙ্কা হয় কোথাও এমনটি করা আমাকে আমার প্রভুর নিকট পাপী না বানিয়ে দেয়! আর আমি চাই না যে, মানুষের কাছে আমি অনেক মাহত্ব লাভ করবো আর আল্লাহ্ তা’লার দৃষ্টিতে আমি ছোট হয়ে যাব। অতএব হযরত উমর পৃথিবী থেকে বিদায় না নেয়া পর্যন্ত সেই অবস্থাতেই অচিল থাকেন যে অবস্থায় তিনি রসূলুল্লাহ্ (সা.) ও হযরত আবু বকর (রা.)-এর জীবদ্দশায় ছিলেন।
মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের মাঝে সন্ধিচুক্তি কীভাবে হয়েছে, এলীয়াবাসীদের সাথে চুক্তি কোথায় সম্পাদিত হয়েছিল এ সম্পর্কে অধিকাংশ ঐতিহাসিক লিখেছেন যে, জাবিয়া নামক স্থানে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মাঝে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। লিখিত আছে যে, জাবিয়ায় অবস্থানকালে হযরত উমর সেনাপরিবেষ্টিত অবস্থায় বসা ছিলেন এমন সময় হঠাৎ কিছু অশ্বারোহী চোখে পড়ে যারা ঘোড়া ছুটিয়ে আসছিল আর তাদের তরবারি ঝলমল করছিল। মুসলমানরা তাৎক্ষণিকভাবে অস্ত্র হাতে নিয়ে নেয়। হযরত উমর জিজ্ঞেস করেন যে, কী হয়েছে? মানুষ অশ্বারোহীদের দিকে ইঙ্গিত করলে তিনি বলেন, চিন্তা করো না, এরা নিরাপত্তা ভিক্ষা চাওয়ার জন্য এসেছে। তারা ছিল এলীয়ার অধিবাসী। তিনি তাদেরকে সন্ধিচুক্তি লিখে দেন।
আরো একটি রেওয়ায়েত রয়েছে, তাহলো আল্লামা বালাদেরি ও মুহাম্মদ হোসেন হ্যায়কাল লিখেছেন, সন্ধিচুক্তি জাবিয়ার পরিবর্তে এলীয়ায় হয়েছিল। একইসাথে মুহাম্মদ হোসেন হ্যায়কাল নিজ পুস্তকে অপর স্থানে এটিও লিখেছেন যে, চুক্তি জাবিয়ায় হয়েছিল। মুসলমান ও এলীয়াবাসীদের মাঝে সম্পাদিত সন্ধিচুক্তির শব্দাবলী সম্পর্কে তাবারির ইতিহাসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে,
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এটি সেই নিরাপত্তানামা যা আল্লাহ্র বান্দা আমীরুল মু’মিনীন উমর, এলীয়াবাসীদের প্রদান করেছেন। তাদের প্রাণ, সম্পদ, গির্জা, ক্রুশ, সুস্থ-অসুস্থ, বরং তাদের পুরো জাতিকে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। কেউ তাদের গির্জাঘরে অবস্থান করবে না আর সেগুলো ভূপাতিতও করা হবে না এবং তাদের গির্জাঘরের আঙ্গিনাও ছোট করা হবে না। তাদের ক্রুশেরও কোন ক্ষতি করা হবে না। তাদের সম্পদেরও কোন ক্ষতি করা হবে না। ধর্মের বিষয়ে তাদের সাথে কোন জোর-জবরদস্তি করা হবে না আর তাদের মধ্য থেকে কাউকে কষ্ট দেয়া হবে না। এলীয়াতে তাদের সাথে কোন ইহুদি থাকতে পারবে না। এলীয়াবাসীর জন্য অন্যান্য শহরের অধিবাসীদের ন্যায় জিযিয়া কর প্রদান করা আবশ্যকীয় হবে। তাদের উচিত হবে রোমান ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের এলীয়া থেকে বের করে দেয়া। অতএব তাদের মধ্য থেকে যে বের হবে, নিরাপদ জায়গায় পৌঁছা পর্যন্ত তার প্রাণ ও সম্পদ নিরাপদ থাকবে। তাদের মধ্য থেকে যে এলীয়াতে থাকতে চায় সে নিরাপদ থাকবে, তাকেও এলীয়াবাসীদের মতো জিযিয়া কর দিতে হবে। এলীয়াবাসীদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি নিজ প্রাণ ও সম্পদ নিয়ে রোমানদের কাছে যেতে চায়, আর তারা নিজেদের উপাসনাস্থল ও ক্রুশ ছেড়ে চলে যায়, সেক্ষেত্রে তাদের প্রাণ, উপাসনাস্থল এবং ক্রুশ নিরাপদ থাকবে; অর্থাৎ ছেড়ে গেলেও সেগুলোর ক্ষতি করা হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যায়। এলীয়ায় যুদ্ধের পূর্বে যেসব কৃষক ছিল তাদের মধ্য থেকে যারা নিজেদের জমিতে বহাল থাকতে চায় তাদেরকেও এলীয়াবাসীদের ন্যায় জিযিয়া বা কর দিতে হবে। যে রোমানদের সাথে চলে যেতে চায় সে চলে যাক আর যে নিজের পরিবারের কাছে ফিরে আসতে চায় সে ফিরে আসুক। ফসল কাটা পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোন জিযিয়া কর নেয়া হবে না অর্থাৎ তাদের আয় ঘরে আসার পর জিযিয়া বা কর ধার্য হবে। যতক্ষণ তারা তাদের প্রদেয় জিযিয়া কর প্রদান করবে যা কিছু এই সন্ধিচুক্তিতে রয়েছে তার জন্য আল্লাহ তাঁর রসূল ও খলীফাগণ দায়বদ্ধ এবং মুমিনদেরও দায়িত্ব থাকবে, ।
এই সন্ধিতে হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ, হযরত আমর বিন আস, হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ ও হযরত মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের সাক্ষ্য খচিত ছিল। ইবনে খলদুনের ইতিহাসে লিখা আছে যে, এই সন্ধি থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হয়। প্রথম বিষয় হলো, মুসলমানরা নিজেদের ধর্ম অস্ত্রের জোরে প্রসারিত করে নি। দ্বিতীয় বিষয় হলো, তাদের রাজ্যে অন্য ধর্মের লোকদের ব্যাপক ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল। তৃতীয় বিষয় হলো, বি-জাতির কাছ থেকে জোর করে জিযিয়া কর নেয়া হতো না। তাদের অবস্থান করা কিংবা জিযিয়া কর প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ছিল আর উভয় ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছিল।
এই সন্ধির সংবাদ যখন রামলাবাসীর নিকট পৌঁছে তখন তারাও আমীরুল মুমিনীন এর সাথে এরূপ সন্ধি করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। একই অবস্থা ফিলিস্তিনের অন্যান্য লোকদেরও ছিল। লুদবাসীদের হযরত উমর (রা.) এর পক্ষ থেকে একটি পত্র লিখা হয় যার আওতায় ঐ শহরগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয় যারা পরবর্তীতে মুসলমানদের বশ্যতা মেনে নিয়েছে। এই পত্রে হযরত উমর (রা.) লুদবাসীদের প্রাণ, সম্পদ, গির্জা, ক্রুশ, সুস্থ্য, অসুস্থ ও সব ধর্মের লোকদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করেন আর বলেন, তারা যদি সিরিয়ার শহরগুলোর মত জিযিয়া কর প্রদান করে তাহলে তাদের ধর্মের উপর কোন জোর-জবরদস্তি করা হবে না আর ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণে কাউকে কোন কষ্ট দেয়া হবে না।
এই সব কাজ সমাপ্ত করে হযরত আমীরুল মু’মিনীন ফিলিস্তিনে দুইজন শাসক নিযুক্ত করেন আর তাদের প্রত্যেককে রাজ্যের অর্ধেক অর্ধেক অংশের দায়িত্বভার ন্যস্ত করেন। যেমন আলকামা বিন হাকীম এর রাজধানী রামলা আর আলকামা বিন মুজায্যেয এর রাজধানী ছিল এলীয়া ।
হযরত উমর (রা.) বায়তুল মুকাদ্দাসে যান। এই বিষয়ে লিখা হয়েছে যে, হযরত উমর (রা.) যখন এলীয়াবাসীকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করেন আর সৈন্যদের এলীয়াতে অবস্থান করান তখন তিনি জাবিয়া থেকে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে যাত্রা করেন। লেখা আছে, তিনি যখন নিজের ঘোড়ায় আরোহন করেন তখন অনুভব করেন যে, তাঁর ঘোড়া পায়ে আঘাতের কারণে সোজা চলছে না। হযরত উমর (রা.)এর জন্য তুর্কী জাতের একটি ঘোড়া নিয়ে আসা হয়। তিনি সেটির ওপর আরোহন করলে সেটি নিয়ন্ত্রনের বাইরে যেতে থাকে। তিনি সেটি থেকে নেমে যান। কয়েকদিন পর হযরত উমর নিজের ঘোড়াটি চেয়ে পাঠান যেটিতে তিনি আরোহন করা বন্ধ করেছিলেন; সেটির চিকিৎসা চলছিল। সেটিতে চড়ে বায়তুল মুকাদ্দাস যান। তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসের কাছাকাছি পৌঁছলে হযরত আবু উবায়দা ও বাহিনীর নেতৃবৃন্দ তাকে স্বাগত জানাতে আসেন। হযরত উমরের পোশাক-আশাক ও সাজসরঞ্জাম ছিল একেবারেই সাদামাটা। খ্রিষ্টানরা (তাকে দেখে) কী বলবে একথা ভেবে মুসলমানরা তার জন্য মূল্যবান পোশাক-আশাক নিয়ে আসে। কিন্তু তিনি বলেন, খোদা আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন তা হলো ইসলামরূপী সম্মান, আর আমাদের জন্য তা-ই যথেষ্ট। খ্রিষ্টান পাদ্রীরা নিজেরাই শহরের সব চাবি হযরত উমরের কাছে হস্তান্তর করে। হযরত উমর সর্বপ্রথম মসজিদে আকসায় যান। এরপর তিনি খ্রিষ্টানদের গির্জা পরিদর্শন করেন। [হযরত উমর খ্রিষ্টানদের গির্জা ঘুরে দেখেন।] নামাযের সময় হলে খ্রিষ্টানরা গির্জার ভেতরেই নামায পড়ার অনুমতি দেয়, কিন্তু হযরত উমর একথা ভেবে বাইরে এসে নামায পড়েন যে, পাছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এটিকে যুক্তি বানিয়ে খ্রিষ্টীয় উপাসনালয়গুলোতে হস্তক্ষেপ না করে। এলীয়াতে অবস্থানকালে মুসলিমবাহিনীর নেতৃবর্গ হযরত উমরকে খাবারের জন্য নিমন্ত্রণ করে। তারা খাবার প্রস্তুত করে হযরত উমরকে গিয়ে অনুরোধ করতেন যেন তিনি তাদের তাঁবুতে পদধূলি দেন; হযরত উমর তাদের সম্মান রেখে তাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন। অবশ্য হযরত আবু উবায়দা, হযরত উমরকে নিমন্ত্রণ করেন নি। হযরত উমর, হযরত আবু উবায়দাকে বলেন, তুমি ছাড়া বাহিনীর নেতৃবৃন্দের মধ্যে এমন একজন নেতাও নেই যে আমাকে দাওয়াত দেয় নি। একথার উত্তরে হযরত আবু উবায়দা নিবেদন করেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! আমার ভয় হয় যে, যদি আমি আপনাকে নিমন্ত্রণ করি তাহলে আপনি নিজের অশ্রæ সংবরণ করতে পারবেন না। [অর্থাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বেন।] এরপর হযরত উমর তার তাঁবুতে যান; গিয়ে দেখেন যে, সেখানে কিছুই নেই; কেবলমাত্র হযরত আবু উবায়দার ঘোড়ার পিঠে চাপানোর পশমী গদিটি ছাড়া। সেটি-ই ছিল তার বিছানা আর তার (ঘোড়ার) জিন এবং সেটি-ই ছিল তার বালিশ। [জিনটিকে বালিশ বানিয়ে নিতেন আর জিনের নীচে দেয়ার যে পশমী গদি ছিল, সেটি দিয়ে বিছানা বানাতেন।] আর তার তাঁবুর এক কোণায় শুকনো রুটি রাখা ছিল। হযরত আবু উবায়দা সেটি আনেন এবং তা হযরত উমরের সামনে মাটিতে রাখেন। তারপর তিনি লবণ ও মাটির পেয়ালা আনেন যাতে পানি ছিল। হযরত উমর যখন এই দৃশ্য দেখেন তখন তিনি কেঁদে ফেলেন। হযরত উমর এরপর আবু উবায়দাকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলেন, তুমি আমার ভাই, আর আমার (বাকি) সাথীদের মাঝে প্রত্যেকেই পৃথিবী থেকে কিছু না কিছু নিয়েছে আর বিনিময়ে পৃথিবীও তার কাছ থেকে কিছু নিয়ে নিয়েছে; একমাত্র ব্যতিক্রম তুমি! একথা শুনে আবু উবায়দা বলেন, আমি কি আপনার কাছে আগেই নিবেদন করি নি যে, আপনি আমার এখানে এলে নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারবেন না? এরপর হযরত উমর বাইরে গিয়ে জনগণের মাঝে দাঁড়ান ও যেমনটি আল্লাহ্ তা’লার প্রাপ্য সেভাবে তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ প্রেরণ করেন; এরপর বলেন, হে মুসলমানগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের সাথে কৃত নিজ অঙ্গীকার পূর্ণ করে দেখিয়েছেন এবং তিনি শত্রুদের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে সাহায্য করেছেন, আর তোমাদেরকে এসব দেশের উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন ও ভূপৃষ্ঠে তোমাদেরকে শক্তি দিয়েছেন। অতএব নিজ প্রভুর কৃপারাজির জন্য তোমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। তোমরা অবাধ্যতামূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাক, কারণ অবাধ্যতামূলক কর্মকাণ্ড (ঐশী) কৃপারাজির প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশের নামান্তর। বিরলই এমনটি ঘটে থাকবে যে, আল্লাহ্ তা’লা কোন জাতিকে পুরস্কৃত করেন আর তারা অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, এরপর যদি শীঘ্রই তারা তওবা না করে তাদের সম্মান ছিনিয়ে নেয়া হয় না।’ অর্থাৎ যদি অকৃতজ্ঞতা করার পর তওবা না করে, তবে তাদের সম্মান হারিয়ে যায়, নিঃশেষ হয়ে যায়। তাদের পুরস্কাররাজি প্রত্যাহার করা হয় এবং তাদের উপর তাদের শত্রুদেরকে চাপিয়ে দেয়া হয়। যেহেতু এলীয়াতে অধিকাংশ সেনাধ্যক্ষ ও কর্মকর্তারা একত্রিত হয়েছিলেন, তাই হযরত উমর সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশাবলী প্রদান করেন। একদিন হযরত বেলাল এসে অভিযোগ করেন যে, হে আমীরুল মুমিনীন! আমাদের সেনাকর্মকর্তারা পাখির মাংস ও ময়দার রুটি খান, কিন্তু সাধারণ মুসলমানের ভাগ্যে ন্যূনতম খাবারও জোটে না। হযরত উমর (রা.) এ বিষয়ে কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা নিবেদন করেন যে, সবকিছু এখানে খুব স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়। যে মূল্যে হেজাযে রুটি এবং খেজুর পাওয়া যায়, এখানে ঐ একই মূল্যে পাখির মাংস এবং ময়দা পাওয়া যায়। হযরত উমর (রা.) কর্মকর্তাদের বাধ্য করেন নি যে, তোমরা এগুলো খাবে না, তবে তিনি (রা.) আদেশ দিয়ে বলেন, গণিমতের সম্পদ থেকে বেতনভাতার পাশাপাশি প্রত্যেক সৈন্যকে বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করাও বাঞ্ছনীয় হবে। এর বিস্তারিত বিবরণ এক জায়গায় এভাবে দেয়া হয়েছে যে, হযরত ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ান বলেন, আমাদের শহরে জিনিসপত্র খুবই সস্তা অর্থাৎ এমন মূল্যমানের যদ্বারা আমরা এক দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে পারি। এসকল জিনিস যার কথা হযরত বেলাল (রা.) উল্লেখ করছেন, তা এখানে পাওয়া যায়। হযরত উমর ফারুক (রা.) বলেন, বিষয়টি যদি এমনই হয়ে থাকে তাহলে খুব তৃপ্তির সাথে পেট ভরে খাও। আমি ততক্ষণ পর্যন্ত এখান থেকে প্রত্যাবর্তন করব না যতক্ষণ তোমরা আমার সম্মুখে ভোগ্য পণ্যের মূল্যতালিকা উপস্থাপন না করবে। শহর ও গ্রামসমূহে বসবাসকারী দুর্বল মুসলমানদের জন্য আমি বাজেট লিখে দিচ্ছি। এরপর যে মুসলমানের যতটুকু প্রয়োজন হবে, এই বাজেটের মধ্য থেকে প্রত্যেক ঘরের জন্য গম, জব, মধু আর জলপাই (-এর তেল) ইত্যাদির মূল্য আদায় করবে। এরপর তিনি (রা.) ঐ সকল দূর্বল এবং স্বল্পপুঁজির অধিকারী মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেন: ‘আমি তোমাদের জন্য যে তালিকা প্রস্তুত করেছি, তোমাদের কর্মকর্তা তোমাদেরকে এগুলো সরবরাহ করবেন আর আমি তোমাদের জন্য বায়তুল মাল থেকে যা কিছু প্রেরণ করব- এগুলো তার বাইরে হবে। যদি কোন কর্মকর্তা তোমাদেরকে এগুলো সরবরাহ না করে তবে আমাকে অবগত করবে, আমি তৎক্ষণাৎ তাকে অপসারণ করব।
এলিয়াতে অবস্থানকালীন সময় একবার নামাযের সময় হলে লোকেরা হযরত বেলাল (রা.)-কে আযান দেয়ার আদেশ দেয়ার জন্য হযরত উমর (রা.)-কে পীড়াপীড়ি করে। হযরত বেলাল (রা.) বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর কারো নির্দেশে আযান দিব না কিন্তু এখন আপনার আদেশ শিরোধার্য। অতএব হযরত উমর (রা.)-এর নির্দেশে হযরত বেলাল (রা.) যখন আযান দিলেন তখন সকল সাহাবীর মহানবী (সা.)-এর যুগের কথা মনে পড়ে গেল এবং তারা এতটাই আবেগাপ্লুত হলেন যে, ব্যকুল হয়ে কাঁদতে থাকেন। হযরত উমর (রা.)ও এতই ব্যকুল হয়ে গেলেন যে, কাঁদতে কাঁদতে তার হিচকি উঠে গেল এবং দীর্ঘক্ষণ এ অবস্থা কাটে নি। বায়তুল মাকদাস থেকে ফেরার পথে হযরত উমর (রা.) সমস্ত দেশ ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং সীমানাসমূহ নিরীক্ষণ করে দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। হযরত উমর (রা.)-এর বায়তুল মাকদাস আগমনের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়েছে আর যে পথ দিয়ে তিনি আগমন করেছিলেন সেই পথেই মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন আর জাবিয়া পৌঁছে হযরত উমর ফারুক (রা.) কিছুদিন অবস্থান করেন, অতঃপর নিজ ঘোড়ায় চেপে যাত্রা করেন। আমীরুল মু’মিনীন ফিলিস্তিনে যে কাজ করেছিলেন সে সংবাদ হযরত আলী (রা.) এবং অন্যান্য মুসলমানরা অবগত হয়েছিলেন, ফলে মদিনার দ্বারপ্রান্তে তারা তাঁকে জাঁকজমকপূর্ণভাবে স্বাগত জানান। হযরত উমর (রা.) মসজিদে নববীতে প্রবেশ করেন এবং মিম্বরের পাশে দু’রাকাত নামায আদায় করেন। অতঃপর তিনি মিম্বরে আরোহণ করেন আর লোকজন তাঁর আশপাশে সমবেত হয়। তিনি (রা.) মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরূদ প্রেরণের পর বলেন, হে লোকসকল! আল্লাহ্ তা’লা এই উম্মতের প্রতি নিশ্চিতরূপে কৃপা করেছেন যেন তারা আল্লাহ্র প্রশংসাপূর্বক তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। আল্লাহ্ তা’লা এই উম্মতের বাণীকে সম্মান দিয়েছেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন আর তাদেরকে বিজয় দান করেছেন। শত্রুর বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করেছেন। একে সম্মানিত করেছেন, পৃথিবীতে একে শক্তি দিয়েছেন আর তাদেরকে মুশরেকদের এলাকাসমূহ, তাদের ঘরবাড়ি এবং তাদের ধনসম্পদের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব সদা আল্লাহ্ তা’লার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে থাক তাহলে তিনি তোমাদেরকে বর্ধিত দানে ধন্য করবেন আ সেই নেয়ামতসমূহের কারণে আল্লাহ্ তা’লার প্রশংসাগীত গাও, যা তিনি তোমাদের ওপর অবতীর্ণ করেছেন। তাহলে তিনি স্থায়ীভাবে তোমাদের এসব নেয়ামতে ধন্য রাখবেন। আল্লাহ্ আমাকে এবং তোমাদেরকে কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। এরপর হযরত উমর (রা.) মিম্বর থেকে অবতরণ করেন।
হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.) বর্ণনা করেন, জেরুযালেমের অবরোধের সময়ে পাদ্রীরা বলেছিল যে, তোমাদের খলীফা আসলে আমরা শহর তাঁর হাতে তুলে দেব। হযরত উমর (রা.) যে অনাড়ম্বরতার সাথে যাত্রা করেন তার চিত্র হলো, তিনি নিজ দাসের সাথে পালা করে উঠে চড়ে সফর করছিলেন। আবু উবায়দা (রা.) বলেন, কাপড় বদলে ঘোড়ায় আরোহন করুন। তিনি (রা.) অনুরোধ মেনে নেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর ঘোড়া থেকে নেমে যান এবং বলেন, আমার সেই কাপড় এবং সেই উট নিয়ে আস। তিনি (রা.) যখন পৌঁছান তখন পাদ্রীরা প্রতাপান্বিত হয়ে শহরের চাবি দিয়ে দেয় আর বলে, এই মহান সেনাপতির মোকাবিলা করার শক্তি আমাদের নেই। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.) এভাবে বর্ণনা করেছেন।
এই বিষয়ে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, জেরুযালেমে একটি মসজিদ আছে। সেই যায়গাটি ইহুদিদের জন্য সেভাবেই বরকতময় যেভাবে আমাদের জন্য কাবা শরীফ। ইসলামী যুগে যখন জেরুযালেম বিজয় হয় তখন খ্রিষ্টানরা হযরত উমর (রা.)-কে এই পবিত্র স্থানে নামায পড়ার আহবান জানায়। কিন্তু তিনি (রা.) বলেন আমার আশঙ্কা হয় যে, যদি আমি এই মসজিদে নামায পড়ি তাহলে মুসলমানরা এই জায়গাকে নিজেদের উপাসানালয় বানিয়ে নিবে। তাই তিনি (রা.) বাইরে নামায আদায় করেন।
পুনরায় হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) লিখেন, হযরত উমর (রা.)-এর যুগে ফিলিস্তিন বিজয় হয়। আর যখন তিনি (রা.) জেরুযালেম যান তখন জেরুযালেমের পাদ্রীরা শহরের বাইরে এসে শহরের চাবি তার (রা.) হাতে হস্তান্তর করে বলে, এখন আপনি আমাদের শাসক। আপনি মসজিদে এসে দুই রাকাআত নফল আদায় করে নিন। যাতে আপনি আশ্বস্ত হতে পারেন যে, আপনি আমাদের এই পবিত্র জায়গায়, যা আপনাদেরও পবিত্র জায়গা, নামায আদায় করেছেন। হযরত উমর (রা.) বলেন আমি তোমাদের মসজিদে নামায আদায় করতে পারি না, কারণ আমি মুসলমানদের খলীফা (যদি আমি নামায পড়ি) তাহলে ভবিষ্যতে এই মসজিদ মুসলমানরা ছিনিয়ে নিবে এবং বলবে এটি আমাদের পবিত্র জায়গা। এ কারণে আমি বাইরেই নামায পড়ব যাতে তোমাদের মসজিদ হাতছাড়া না হয়।
যাহোক, ১৭ হিজরী সনে রোমানরা শেষ বারের মতো চূড়ান্ত চেষ্টা করে আর এই চেষ্টার কারণেই সিরিয়ায় মুসলমানদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। যেহেতু ইসলামী বিজয়ের গণ্ডি দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছিল এবং ইসলামী সম্রাজ্যের সীমারেখা ক্রমশ বেড়েই চলেছিল এই কারণে পার্শ্ববর্তী সাম্রাজ্য গুলো এই কথা ভেবে নিজেরাই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে যে, একদিন আমাদের পালা আসবে। অতএব, ইয়াযদাজারদ রে’ অভিমুখে পলায়ন করার পর ইরাক ও সিরিয়ার মাঝে বসবাসকারী জযীরাবাসীরা তার বিষয়ে হতাশ হয়ে যায়। এই কারণে তারা হিরাক্লিয়াসের কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি লিখে যে, যদি সে মুসলমানদের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে এবং তাদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে মুক্ত করতে সমুদ্র পথে সেনা প্রেরণ করে তাহলে তারা তাকে সাহায্য করবে। হিরাক্লিয়াস এ বিষয়ে গভীর অভিনিবেশ করে এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, এই বিষয়ে ক্ষতির কোন আশঙ্কা নেই। জযিরাবাসীরা হিরাক্লিয়াসকে পুনরায় চিঠি লিখে যার মাধ্যমে সে বুঝে যায় যে, তাদের ইচ্ছায় কোন ঘাটতি নেই। সে দেখলো যে, তাদের মাঝে বেশিরভাগ আরব খ্রিষ্টান নিজ ধর্মকে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছে এবং ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করাকে সৌভাগ্য মনে করে। হিরাক্লিয়াস সিরিয়া যুদ্ধ ক্ষেত্রে বিতাড়িত হওয়ার পর বছরাধিককাল কেটে গেছে। একারণে তার হৃদয়ে আগের মতো ভয় ছিল না। এছাড়া সে দেখল যে, বেশ কিছু সীমান্তবর্তী এলাকা এখন এতটা মজবুত যে, তারা মুসলমানদের আক্রমণের ভয়াবহতার মোকাবিলা করতে পারবে। তার রণতরী তখনও সুরক্ষিত ছিল এবং সে এটাও জানতো যে, মুসলমানরা সমুদ্র এবং সমুদ্রের দিক থেকে আগত সকল জিনিসকে ভয় পায়। এই কারণে তার সংকল্প আরো দৃঢ় হয়। সে জযিরাবাসীদের অনুরোধ রাখতে সম্মত হয়। সে তার চিঠিতে সেসব গোত্রকে উত্তেজিত করে, তাদের মনোবল চাঙ্গা করে এবং লিখে যে, জাহাজগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেগুলো সেনাবাহিনী ও যুদ্ধের উপকরণ নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আনাতাকিয়ায় আসছে।
হিরাক্লিয়াসের চিঠি পেয়েই গোত্রগুলো তাদের ত্রিশ হাজার সেনাবাহিনী নিয়ে জযিরা থেকে হিমস অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। হযরত আবু উবায়দা (রা.)-র কাছে যাবতীয় বৃত্তান্ত পৌঁছে। তিনি (রা.) পরামর্শের জন্য হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-কে কিনাসরীন থেকে ডেকে পাঠান। উভয় সেনাপতি সম্মিলিতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, শত্রু পক্ষের মোকাবিলার জন্য গোটা মুসলিম সেনাবাহিনী যেন উত্তর সিরিয়ায় সমবেত হয়। যেমন আন্তাকিয়া, হাম্মাত, আলেপ্পো এবং পার্শ্ববর্তী সকল ছাউনিতে অবস্থানরত সমস্ত সেনাবাহিনীকে হিমস নগরীতে একত্রিত করা হয়। এদিকে গোটা দেশে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, হিরাক্লিয়াসের বাহিনী সমুদ্রপথে ধেয়ে আসছে আর জযিরার গোত্রগুলো আক্রমণের উদ্দেশ্যে হিমস অভিমুখে রওয়ানা হয়েছে। মানুষ পরস্পরকে আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করতে থাকে যে, সিজার এবং তার মিত্রপক্ষ দ্বারা রচিত নতুন এই আক্রমণকে কিভাবে প্রতিহত করা যেতে পারে? আর হিরাক্লিয়াসের একটি রণতরী যখন আন্তাকিয়ায় ভিড়ে তখন শহরের ফটক সেনাবাহিনীর জন্য খুলে যায়। প্রজারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় এবং গোটা উত্তর সিরিয়ায় বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ¦লে ওঠে। হযরত আবু উবায়দা (রা.) নিজেকে হিমস নগরীতে চতুর্দিক থেকে বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ অবস্থায় দেখতে পান আর শত্রু পক্ষকে জল-স্থল উভয় দিক থেকে তাঁর (রা.) অভিমুখে ধেয়ে আসতে দেখেন। তিনি (রা.) তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে একত্রিত করেন এবং বলেন, চলমান সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আমীরুল মু’মিনীনের সমীপে আমি সামরিক সাহায্যের জন্য একটি আবেদন পাঠিয়েছি। তারপর তাদের জিজ্ঞেস করেন যে, মুসলমানরা কি দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে শত্রু পক্ষের সাথে লড়াই করবে নাকি মদিনা থেকে আগত সাহায্যকারী সামরিক বাহিনীর অপেক্ষায় দুর্গে অবস্থান করেই লড়াই করবে? কেবলমাত্র হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-ই দুর্গ থেকে বেরিয়ে যুদ্ধ করার পরামর্শ প্রদান করেন, কিন্তু অন্য সব সেনা কর্মকর্তার অভিমত ছিল দুর্গে পরিবেষ্টিত থেকে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে সামরিক সাহায্য হস্তগত করার চেষ্টা করা উচিত। হযরত আবু উবায়দা (রা.) তাঁদের (রা.) পরামর্শ গ্রহণ করেন যারা দুর্গে অবস্থান করার পক্ষে ছিলেন এবং যারা হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-র পরামর্শের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তাই তিনি (রা.) নিরাপত্তা ব্যুহগুলো আরো সুরক্ষিত করে তাঁর (রা.) সঙ্গী-সাথীদের মতামত লিখিতভাবে খলীফার সমীপে প্রেরণ করেন। হযরত উমর (রা.) কখনো এ কথা ভুলতেন না যে, ইরাক এবং সিরিয়ার মুসলিম সেনাবাহিনী যদি কখনো এ ধরনের আশঙ্কার সম্মুখীন হয় তবে মুসলমানদের জয়যাত্রা ব্যাহত হবে; অর্থাৎ খিলাফতের সূচনা থেকেই যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল তা এখনও হতে পারে! এজন্য হযরত উমর (রা.) বসরা এবং কুফা আবাদ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন আর তাই এই দু’টি শহরই মুসলিম সেনাছাউনি হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে কোন অমুসলিমের বসতি ছিল না। এছাড়াও অন্য সাতটি নগরীর মধ্যে প্রত্যেকটিতে ৪০০০ অশ্বারোহী যেদ্ধা নিযুক্ত করেন যারা সর্বদা এধরনের জরুরী পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য সামরিক অস্ত্রে-শস্ত্রে সুসজ্জিত ও তৎপর থাকত। সুতরাং খিলাফতের দরবারে যখন হযরত আবু উবায়দা (রা.)-র চিঠি পৌঁছায় এবং হযরত উমর (রা.) অনুভব করেন যে, মুসলমানদের এই বিরাট সেনাবাহিনী হুমকির সম্মুখীন হয়েছে তখন তিনি তৎক্ষণাৎ হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-কে এই নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করেন যে তোমার কাছে যে দিন এই চিঠি পৌঁছাবে ঐ দিন-ই কাকা’ বিন আমরকে সাহায্যকারী বাহিনীর সাথে হিমস প্রেরণ করবে; আবু উবায়দা সেখানে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন। যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাছে সাহায্যাকারী সেনাবাহিনী পাঠানো উচিত। হযরত সা’দ (রা.) ঐ দিনই আমীরুল মু’মিনীনের আদেশ পালন করেন এবং কাকা’র নেতৃত্বে ৪০০০ অভিজ্ঞ অশ্বারোহী বাহিনী কুফা থেকে হিমসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বিষয়টি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, লড়াই করার জন্য কেবল ৪০০০ অশ্বারোহী নিয়ে কাকা’র সেখানে যাত্রা করা মোটেও যথেষ্ট ছিল না, কেননা জযিরা থেকে হিমস অভিমুখে আগত প্রতিপক্ষ সেনাবাহিনী সংখ্যায় ছিল ৩০০০০; অপরদিকে হিরাক্লিয়াস সামুদ্রিক জাহাজের মাধ্যমে যে বাহিনী আন্তাকিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিল তারা ছিল এর অতিরিক্ত। হযরত উমর (রা.) জানতেন যে, মুসলমানরা সিরিয়ার প্রতিটি শহরেও স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে লড়াই করছে। তারা সবাই যদি একযোগে সেই শহরগুলো ছেড়ে হিমসে চলে যায় তবে গোটা সিরিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এজন্য তিনি কাকা’কে কুফা থেকে রওয়ানা করার নির্দেশ দেয়ার পর আরো কিছু দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন যা তাঁর (রা.) সুপরিকল্পনা ও দূরদর্শীতার পরিচায়ক ছিল।
জযিরা থেকে হিমস অভিমুখে আগমনকারী গোত্রগুলোর এই দুঃসাহস দেখানোর কারণ ছিল, তারা জানতো যে, তাদের জনপদগগুলো ইসলামী সৈন্যবাহীনির আক্রমণের লক্ষ্যস্থলের বাইরে। অতএব, এসব জনপদে যদি হামলা করা হয় তাহলে এরা পিছপা হয়ে ফিরে যাবে আর আবু উবায়দা এবং তার সৈন্যদের ওপর যে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা-ও হ্রাস পাবে, এ উদ্দেশ্যে হযরত উমর (রা.) হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-কে লিখেন, সুহায়েল বিন আদীর নেতৃত্বে একটি সেনাদল জযিরার রিক্কায় পাঠিয়ে দাও, কেননা জযিরার লোকেরাই হিমসে আক্রমণ করতে রোমানদের উস্কে দিয়েছে এবং এর পূর্বে কারকেশিয়ার লোকেরাও একই কাজ করেছে। অপর একটি সেনাদল আব্দুল্লাহ্ বিন উতবানের নেতৃত্বে নাসীবিনের বিরুদ্ধে আক্রমণের জন্য পাঠিয়ে দাও, সেখানকার অধিবাসিদেরও কারকেশিয়ার লোকেরা যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করেছিল। এছাড়া হারান ছিল জযিরার রাজধানী। হারান ও রওহা গিয়ে যেন সেখান থেকে শত্রুদের বিতাড়িত করে। তৃতীয় আরেকটি সেনাদল ওয়ালীদ বিন উকবার নেতৃত্বে জযিরার খ্রিষ্টান আরব গোত্র রাবিআ ও তানুখ অভিমুখে প্রেরণ কর আর এয়ায বিন গানামকেও এই জযিরার অভিযানেই প্রেরণ কর। যদি যুদ্ধ হয় তাহলে অন্যান্য সেনাপতিরা এয়ায বিন গানামের অধীনে থাকবে। অবশেষে এই সব সেনাপ্রধান যখন রওয়ানা হয় তখন জযিরাবাসীরা হিমসের অবরোধ ছেড়ে দিয়ে জযিরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এটি হযরত উমর (রা.)-এর একটি রণকৌশল ছিল যে, নিজেরা একত্র না হয়ে যেসব অঞ্চল থেকে শত্রু সেনারা একত্র হয়েছিল সেসব অঞ্চলের শহর ও নগরে তিনি সেনা পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর ফলাফল যা হয়েছে তা হলো, শত্রুরা যখন দেখলো, মুসলমানরা আমাদের অঞ্চলে, আমাদের শহরগুলোর দিকে যাচ্ছে তখন তারা অবরোধ ছেড়ে দিয়ে সেখানে চলে যায়। কিন্তু হযরত উমর এতেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি অনুমান করে নিয়েছিলেন যে, বারবার পরাজিত হওয়ার পরও সমুদ্র পথে হিরাক্লিয়াসের সৈন্যবাহিনী পাঠানোর মূল কারণ হলো, নিজ ক্ষমতায় তার আস্থা আছে এবং সে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতো যে, সে একাই মুসলমানদের মোকাবিলা করার সক্ষমতা রাখে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, আলেকজান্দ্রীয়া থেকে সামুদ্রিক জাহাযে আগত সৈন্যবাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সে তার ছেলে কনস্টানটাইনকে নিযুক্ত করেছিল। হযরত উমরের পরিকল্পনা অনুযায়ী হযরত কা’কা চার হাজার অশ্বারোহীকে সাথে নিয়ে হিমস অভিমুখে রওয়ানা হন। সুহায়েল বিন আদী, আব্দুল্লাহ্ বিন উতবান, ওয়ালীদ বিন উকবা এবং এয়ায বিন গানাম বিভিন্ন শহরে চলে যান জযিরাবাসীদের সতর্ক করার জন্য। এদিকে হযরত উমর হিমসের উদ্দেশ্যে মদিনা ছাড়েন এবং জাবিয়াতে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। জযিরাবাসীরা হিমস অবরোধে রোমানদের সঙ্গ দেয়। তারা ইরাক থেকে মুসলিম সেনাবাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে যায়, কিন্তু তারা এটি জানতো না যে, এই সেনাবাহিনী তাদের শহরগুলোতে আক্রমণ করবে নাকি হিমসে। তাই তারা নিজেদের শহর এবং ভাইদের সুরক্ষায় নিয়োজিত হয় আর রোমানদের সঙ্গ পরিত্যাগ করে। একদিন আবু উবায়দা যখন ঘুম থেকে উঠেন তখন জানতে পারেন যে, জযিরার গোত্রগুলো স্বদেশে ফিরে গেছে এবং মুসলমানদের মোকাবিলায় কেবল হিরাক্লিয়াসের সৈন্যবাহিনী অবশিষ্ট আছে। তিনি নিজ সৈন্যবাহিনীর সেনাকর্মকর্তাদের ডেকে বলেন যে, তিনি রোমানদের মোকাবিলায় ময়দানে বের হতে চান। একথা শুনে হযরত খালেদ বিন ওয়ালীদ খুবই আনন্দিত হয়ে বলেন, রোমানরা এই উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলার কোন ব্যবস্থা করার পূর্বেই তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ হানা উচিত। হযরত আবু উবায়দা সৈন্যদের উদ্দেশ্যে এক জোরালো বক্তব্য রাখেন এবং বলেন, হে মুসলমানেরা! আজ যে অবিচল থাকবে সে যদি জীবিত থাকে তাহলে সে সম্পদ ও অর্থ লাভ করবে আর যদি মারা যায় তাহলে শাহাদাতের সম্পদ লাভ করবে আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, মহানবী (সা.) বলেছেন, কোন ব্যক্তি যদি এমন অবস্থায় মারা যায় যে, সে মুশরেক নয়, তাহলে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সৈন্যবাহিনী পূর্ব হতেই হামলা করার জন্য উদগ্রীব ছিল। আবু উবায়দার বক্তৃতা তাদেরকে আরো উদ্দীপ্ত করে তুলে এবং মুহূর্তের মধ্যে সকলেই অস্ত্র গুছিয়ে নেয়। হযরত আবু উবায়দা সৈন্যবাহিনীর কেন্দ্রস্থলে, হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ ডানদিকে এবং হযরত আব্বাস (রা.) বাম পার্শ্বের সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। উভয় পক্ষের মাঝে লড়াই হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুসলমানদের প্রতিদ্বন্ধিতায় রোমানদের পা হড়কে যায় এবং তারা পরাজয় বরণ করে। কা’কা বিন আমর কুফার সেনাবাহিনীসহ হিমস পৌঁছার তিন দিন পূর্বেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে হযরত উমর সিরিয়ার পথে যখন জাবিয়ার কাছাকাছি পৌঁছেন তখন হযরত আবু উবায়দার দূতের সাক্ষাৎ পান। দূত বলে, কা’কার হিমস পৌছার তিন দিন পূর্বেই আল্লাহ্ তা’লা মুসলমানদেরকে রোমানদের বিরুদ্ধে বিজয় দান করেছেন এবং সিদ্ধান্ত জানতে চাইল যে, কা’কা এবং তার সেনাবাহিনীকে মালে গণিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) থেকে অংশ দেয়া হবে কি না? হযরত উমর আশ্বস্ত হন এবং সেই সংবাদ শুনার পর সফর অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। সেখান থেকেই তিনি আমীনুল উম্মত হযরত আবু উবায়দাকে পত্র লিখেন যে, কুফাবাসীকে মালে গণিমতের অংশ দেয়া হোক, কেননা তাদের আগমনের সংবাদ শত্রুদর হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করেছে, যে কারণে তারা পরাজিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা’লা কুফাবাসীকে উত্তম প্রতিদান দিন, কেননা তারা নিজেদের এলাকার সুরক্ষা এবং অন্যান্য শহরবাসীকে সাহায্য করে থাকে। এরপর তিনি মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হন।
এই পরাজয়ের পর রোমান সম্রাটের ওপর এতটাই নৈরাশ্য ছেয়ে যায় যে, এরপর সে আর কখনো সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হয় নি। এদিকে বিদ্রোহীরা যখন জানতে পারে যে, রোমান সেনাবাহিনী জাহাজে চড়ে পলায়ন করেছে তখন তাদের বিদ্রোহও উবে যায়। এটি ১৭ হিজরী সনের ঘটনা। এর তিন বছর পর হিরাক্লিয়াস ২০ হিজরী সনে ৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে মারা যায়। যাহোক এই স্মৃতিচারণ ইনশাআল্লাহ্ আগামীতেও চলমান থাকবে।
এখন আমি কয়েকজন প্রয়াত ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করতে চাই যাদের মাঝে প্রথম উল্লেখ হলো অবসরপ্রাপ্ত স্টেশন মাস্টার মুকাররম চৌধুরী সাঈদ আহমদ লক্ষণ সাহেবের, যিনি ইদানিং কানাডায় বসবাস করছিলেন। তিনি ৮৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। তিনি হযরত মসীহ মওউদ (আ.) এর সাহাবী হযরত চৌধুরী সিকান্দার আলী সাহেব এবং গুজরবিবি সাহেবার পৌত্র ছিলেন। হযরত চৌধুরী সিকান্দার আলী সাহেব (রা.) ৩০ মার্চ ১৯০২ সালে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর হাতে বয়আত করেছিলেন এবং ১৯০৪ সাল থেকে ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তালীমুল ইসলাম মাদ্রাসায় শিক্ষকতার দায়িত্ব পালনের তৌফিক পেয়েছেন। তিনি সেই সমস্ত প্রাথমিক শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদেরকে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) নিজ জীবদ্দশায় তালীমুল ইসলাম মাদ্রাসায় শিক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। চৌধুরী সাঈদ সাহেব তার পৌত্র ছিলেন। চৌধুরী সাঈদ সাহেবও যখনই সুযোগ পেয়েছেন আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় ধর্মের কাজে নিয়োজিত থেকেছেন। আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় তিনি ওসীয়্যত করেছিলেন। তিনি তার অবর্তমানে পরিবারে স্ত্রী ছাড়াও ছয় পুত্র ও তিন কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। সন্তানদের সবাই তার উত্তম তরবিয়তের কারণে কোন না কোনভাবে জামা’তের সেবা করার তৌফিক পাচ্ছে। তার এক পুত্র ফাহিম আহমদ লক্ষণ সাহেব মুরব্বী সিলসিলাহ হিসেবে কেনিয়াতে আছেন এবং সেখানে কাজ করার তৌফিক পাচ্ছেন। কর্মক্ষেত্রে থাকার কারণে তিনি তার পিতার জানাযায় অংশ নিতে পারেন নি। আল্লাহ্ তা’লা তাকে ধৈর্য ও মনোবল দান করুন এবং মরহুমের সাথে ক্ষমা ও কৃপার আচরণ করুন। মরহুম গভীর ধর্মীয় আত্মাভিমানী মানুষ ছিলেন। ছাত্রজীবনে ১৯৫৩ সালে সমুন্দরী শহরের উচ্চ বিদ্যালয়ে মজলিসে আহরারের জলসায় অন্যান্য অ-আহমদী ছাত্রদের সাথে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। যখন আতাউল্লাহ্ শাহ বুখারী হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর প্রতি মিথ্যা অপবাদ উত্থাপন করে এবং তার (আ.) সম্পর্কে অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে, সাঈদ সাহেব সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যান এবং সেই মৌলভীকে চ্যালেঞ্জ করেন, তার বক্তৃতা চলাকালেই তাকে সম্বোধন করে বলেন, তুমি কেবল মিথ্যাই বলছ। একথা বলে তাকে চুপ করিয়ে দেন। তখন সেই মৌলভী বলে, এই মির্যাঈকে ধরে প্রহার কর। তার প্রতি কঠোর দৈহিক নির্যাতন করা হয়েছে, কিন্তু যাহোক সেই সময় জলসায় হট্টগোল সৃষ্টি হয়ে যায় এবং জলসা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সর্বদা নিজ সন্তানদেরকে তিনি এই নসীহত করতেন যে, আহমদীয়াতের ব্যপারে কখনো কারো কাছে অবনত হবে না বা কাউকে ভয় পাবে না।
দ্বিতীয় স্মৃতিচারণ হচ্ছে বাংলাদেশের নায়েব ন্যাশনাল আমীর শ্রদ্ধেয় মুহাম্মদ শাহাব উদ্দীন সাহেবের। তিনি গত ১২ জুলাই তারিখে পরলোক গমন করেছেন, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। ১৯৬৪ সনে ১৮ বছর বয়সে এক স্বপ্নের ভিত্তিতে তিনি আহমদীয়াত গ্রহণ করেছিলেন। মরহুম মূসী ছিলেন। জামা’তের একজন প্রবীণ কর্মী ছিলেন। বহু গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। খিলাফতের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, ঈমানদার, বিশ^স্ত, নীরব প্রকৃতির এবং জামা’ত ও সিলসিলাহ্’র স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় খুব ভালোভাবে বুঝতেন। মৃত্যুর পূর্বে নিজের ওসীয়্যতের চাঁদা ইত্যাদি পরিশোধ করে গিয়েছেন। তার বড় ছেলে শামসুদ্দীন আহমদ মাসুম সাহেব মুরব্বী সিলসিলাহ্ হিসেবে কর্মরত আছেন। মরহুমের সন্তানাদির মধ্যে চার ছেলে ছাড়া তিন মেয়ে রয়েছে। মরহুম নিজ চাচার তবলীগে আহমদী হয়েছিলেন এবং নিজ ঘরে চরম বিরোধিতারও সম্মুখীন হয়েছেন। ১৯৬৩ সনে কয়েক মাস অত্যন্ত ধৈর্য্য ও অবিচলতার সাথে এসব বিরোধিতা সহ্য করার পর ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পরবর্তীতে ঢাকা এসে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে পুরাতন আহমদী পরিবারে তার বিয়ে হয়। মরহুমের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল মিতব্যয়িতা ও স্বল্পেতুষ্টি। স্বল্পে তুষ্ট থাকা এবং ধৈর্য্য ও কৃতজ্ঞতার সাথে দিনাতিপাত করা জানতেন। মরহুমের সততার কারণে অ-আহমদী ব্যবসায়ীরাও তাকে অনেক সম্মান করতো এবং সবাই তাকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত পুণ্যবান ও সৎ ব্যবসায়ী জ্ঞান করতো। আল্লাহ্ তা’লা মরহুমের সাথে ক্ষমা ও দয়ার আচরণ করুন।
পরবর্তী স্মৃতিচারণ হচ্ছে আর্জেন্টিনার অধিবাসী মোহতরম রাউল আব্দুল্লাহ্ সাহেবের। তিনি আর্জেন্টিনার অধিবাসী ছিলেন। তিনি গত ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ইহধাম ত্যাগ করেন, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। সেখানকার মুরব্বী সিলসিলাহ্ লিখেন যে, তিনি আর্জেন্টেনিয়ার প্রাথমিক আহমদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর্জেন্টেনিয়ার জামা’ত কয়েক বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত একেবারই নতুন একটি জামা’ত। ২০১৮ সনে একটি বই মেলায় জামা’তে আহমদীয়ার সাথে তার প্রথম পরিচয় হয়েছিল। যখন জামা’তের সাথে তার যোগাযোগ স্থাপিত হয় তখন তার অ-আহমদী মুসলমান বন্ধুরা জামা’ত সম্পর্কে তার মাঝে ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টা করে, কিন্তু এতৎসত্তে¡ও তিনি জামা’তের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে থাকেন। যাহোক, সেসব বন্ধুদের প্রভাবে তার হৃদয়ে কিছু সন্দেহ-সংশয়ও ছিল, যা দূর করার জন্য তিনি যুক্তরাজ্যের বার্ষিক জলসায় যোগদান করেন। ব্যক্তিগত খরচে এখানে আসেন এবং এখানে আমার সাথে তার সাক্ষাৎও হয়। এই সাক্ষাতের পর তার সন্দেহ ও সংশয়ও দূর হয়ে যায় এবং তিনি পুরোপুরি আশ্বস্ত হন এবং বয়আতও করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বয়আতের পূর্বেই তিনি আহমদী-ই ছিলেন এবং মানুষের নিকট আহমদীয়াতের বাণী পৌঁছাতেন, কিন্তু আনুষ্ঠানিক বয়আত তিনি এখানে এসে করেন। তার পরিবারে তিনি একাই মুসলমান ছিলেন। তার বন্ধুরা তাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত জামা’ত থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আহমদীয়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। জামা’তের জন্য গভীর আত্মাভিমান রাখতেন এবং সর্বদা আপন-পর সকলের নিকট অত্যন্ত গর্বভরে নিজেকে একজন আহমদী হিসেবে পরিচয় দিতেন। জামা’তী অনুষ্ঠানাদিতে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও গভীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহণ করতেন। আল্লাহ্ তা’লা তার সাথে ক্ষমা ও দয়ার আচরণ করুন এবং তার আত্মীয়-স্বজনদেরকেও আহমদীয়াত গ্রহণের সৌভাগ্য দান করুন। নামাযের পর তাদের গায়েবানা জানাযার নামায আদায় করবো।