জুমুআর খুতবার সারমর্ম

শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রো.) এর স্মৃতিচারণ জুমুআর খুতবা ২৪ ডিসেম্বর ২০২১

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ২৪ ডিসেম্বর, ২০২১ মোতাবেক ২৪ ফাতাহ্, ১৪০০ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা

তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র স্মৃতিচারণ অব্যাহত আছে। আকাবার দ্বিতীয় বয়’আত সম্পর্কে লেখা আছে যে, আকাবার দ্বিতীয় বয়’আতের সময় মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন হযরত আবু বকর (রা.), হযরত আলী (রা.) এবং মহানবী (সা.)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা.)। বলা যায় হযরত আব্বাস (রা.) ছিলেন এই অনুষ্ঠান বা সভার প্রধান ব্যবস্থাপক। তিনি হযরত আলী (রা.)-কে একটি উপত্যকায় পাহারাদার হিসেবে দাঁড় করান এবং আরেকটি উপত্যকায় হযরত আবু বকর (রা.)-কে তিনি প্রহরা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের জন্য দাঁড় করিয়েছিলেন। যখন মহানবী (সা.)-এর মদীনায় হিজরত হয় তখন তাতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র সঙ্গী হওয়ার উল্লেখ রয়েছে। লেখা আছে, মক্কায় বসবাসরত মুসলমানদের ওপর মক্কার কাফিরদের নিপীড়ন ও নির্যাতন ক্রমাগত বেড়েই চলছিল। সে সময় মহানবী (সা.)-কে একটি স্বপ্ন দেখানো হয়, যাতে দু’জন মুসলমানকে সেই জায়গা দেখানো হয় যেখানে তাঁর হিজরত করার ছিল। সেটি খেজুর বাগানে পরিবেষ্টিত একটি লোনা ভূমি ছিল। কিন্তু এই (জায়গার) নাম দেখানো হয় নি এবং বলাও হয় নি। যাহোক, এর ভৌগলিক অবস্থান ও নকশার ধারণা করে মহানবী (সা.) স্বয়ং ব্যাখ্যা করে বলেন, হাজর বা ইয়ামামা হবে। যেমনটি সহীহ্ বুখারীর একটি হাদীসে উল্লেখ পাওয়া যায়Ñ সে অনুসারে তিনি (সা.) বলেন, فذھب وھلی الی انھا الیمامة او الحجر فاذا ھی المدینۃ یثرب অর্থাৎ, আমার ধারণা হল, সেই স্থানটি হবে ইয়ামামা কিংবা হাজর। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে, সেটি ইয়াসরেব বা মদীনা। ইয়েমেনের একটি প্রসিদ্ধ শহরের নাম ইয়ামামা। আর আরব ভ‚-খÐের বিভিন্ন অংশে হাজর নামের শহর পাওয়া যেত। বাহরাইনের একটি অংশকেও হাজর বলা হতো। যাহোক, কিছুদিন পরেই পরিস্থিতি একটি দিকে মোড় নিতে থাকে আর মদীনার সৌভাগ্যবান আনসার সদস্যরা ইসলাম গ্রহণ করতে আরম্ভ করেন। তখন ঐশী এলকা বা ঐশী প্রেরণায় তাঁর সামনে সুস্পষ্ট হয় যে, সেই অঞ্চলটি তো ছিল ইয়াসরেব অঞ্চল যা পরবর্তীতে মদীনা নামে প্রসিদ্ধ হওয়ার ছিল।
মহানবী (সা.)-এর এই এজতেহাদ বা ব্যাখ্যার উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, যে হাদীসে এই বাক্য فذھب وھلی الی انھا الیمامة او الحجر فاذا ھی المدینۃ یثرب রয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করছে যে, মহানবী (সা.) নিজ ব্যাখ্যায় ভবিষ্যদ্বাণীর (পূর্ণতার) জায়গা ও সত্যায়নস্থল বলতে যা কিছু ধরে নিয়েছিলেন তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
অতএব, মহানবী (সা.) মক্কার নির্যাতিত ও নিপীড়িত সাহাবী এবং মুসলমানদের মদীনা অভিমুখে হিজরত করার জন্য অনুমতি ও নির্দেশনা প্রদান করেন। এর ফলে মক্কার মুসলমানরা মদীনার উদ্দেশ্যে হিজরত করতে আরম্ভ করেন। অপরদিকে আকাবার দ্বিতীয় বয়’আতের পর এই হিজরতেও গতি সঞ্চারিত হয়। ফলে বাড়ির পর বাড়ি এবং পাড়ার পর পাড়া খালি হয়ে যেতে থাকে। এই অবস্থা মক্কার অত্যাচারী নেতাদের আরো উত্তেজিত করে আর তারা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায়। তখন তারা আরো একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, অর্থাৎ এই নির্যাতিতদের হিজরত করতেও বাধা দিতে আরম্ভ করে আর অত্যাচার ও নিপীড়নের নিত্যনতুন পথ আবিষ্কার করতে থাকে। কখনও স্বামীকে যেতে দেওয়া হলেও তার স্ত্রী-সন্তানদের তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আবার কখনও কারও মূলধন বা সম্পদ এই অজুহাতে হাতিয়ে নেওয়া হতো যে, তুমি এই (সম্পদ) আমাদের শহর মক্কায় উপার্জন করেছ, তাই এখান থেকে যেতে হলে পুরো সহায়-সম্পদ আমাদের দিয়ে যাও। কখনও বা মায়ের মমতার দোহাই দিয়ে বাধা দিয়েছে। অর্থাৎ তোমার মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করে যাও আর এরপর পথিমধ্যেই তাকে রশি দিয়ে বেঁধে গৃহবন্দী করে রাখা হতো। কিন্তু ঈমানের সম্পদে সম্পদশালী, ইসলাম ধর্মের ভালোবাসায় বিভোর এবং ধৈর্যধারণকারী ও কৃতজ্ঞ মু’মিনদের দল পাগলপারা হয়ে একের পর এক মদীনায় হিজরত করতে থাকে। যাহোক, মক্কা যখন এমন সব মুসলমান থেকে প্রায় শূন্য হয়ে যায়, যাদের জন্য হিজরত করা সম্ভব ছিল তারা যখন হিজরত করে তখন অল্প কিছু চরম দুর্বল ও অসহায় মুসলমানই পিছনে রয়ে গিয়েছিল যাদের উল্লেখ পবিত্র কুরআন এভাবে করেছেÑ
إِلَّا الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاءِ وَالْوِلْدَانِ لَا يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلَا يَهْتَدُونَ سَبِيلًا
অর্থাৎ, কেবল সেসব নরনারী ও শিশু ছাড়া যাদের দুর্বল বানিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং যাদের কোন উপায় ছিল না আর তারা বের হওয়ার কোন পথও খুঁজে পাচ্ছিল না। (সূরা আন্ নিসা: ৯৯) এদের ছাড়াও মহানবী (সা.) তখনও খোদার অনুমতির অপেক্ষায় মক্কায় অবস্থান করছিলেন। হযরত আলী (রা.)ও মক্কাতেই ছিলেন। অবশ্য হযরত আবু বকর (রা.) হিজরতের অনুমতি নেয়ার জন্য মহানবী (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হলে তাঁকে বলা হয়, অপেক্ষা করুন; আশা করছি আমাকেও অনুমতি দেয়া হবে। অথবা আরেকটি রেওয়ায়েত অনুসারে তিনি (সা.) বলেন, আপনি তাড়াহুড়ো করবেন না, হতে পারে আল্লাহ্ তা’লা আপনার জন্য একজন সঙ্গীর ব্যবস্থা করে দিবেন। একথা শুনে হযরত আবু বকর (রা.) বলেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমার পিতামাতা আপনার জন্য নিবেদিত, আপনিও কি হিজরতের অনুমতি পেয়ে যাবেন? (মনে হচ্ছিল) যেন মহানবী (সা.)-এর হিজরতের কারণে {আবু বকর (রা.)’র} বিচ্ছেদ-বেদনা দূরীভূত হতে থাকে। হযরত আবু বকর (রা.) খুশির এই সুসংবাদ শুনে ফিরে আসেন এবং হিজরতের ইচ্ছা স্থগিত করেন। অবশ্য তিনি বুদ্ধিকরে দু’টি উটনী ক্রয় করেন, যেগুলোকে ভালোভাবে খাইয়ে-দাইয়ে হিজরতের অজানা সফরের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন।
এসব কথার উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীরা হিজরতের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। পরিবারগুলো একের পর এক মক্কা থেকে উধাও হতে থাকে। সেসব লোক যারা ঐশী রাজত্বের অপেক্ষায় ছিল তারা সাহসি হয়ে উঠে। অনেক সময় একই রাতে মক্কার কোন একটি পুরো গলির সবক’টি বাড়িতে তালা লেগে যেত আর সকালবেলা যখন শহরবাসীরা পুরো গলি নীরব ও নিস্তব্ধ দেখতে পেত তখন জিজ্ঞেস করে অবগত হতো, এই গলির সকল বাসিন্দা মদীনায় হিজরত করেছে। ইসলামের এমন গভীর প্রভাব দেখে যা ভেতরে ভেতরে মক্কার লোকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছিল, তারা বিস্মিত হয়ে যাচ্ছিল। পরিশেষে মক্কা মুসলমান শূন্য হয়ে যায়। শুধু কিছু সংখ্যক ক্রীতদাস, মহানবী (সা.) নিজে এবং হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত আলী (রা.) মক্কায় রয়ে যান।
পুনরায় তিনি (রা.) বলেন, মক্কার কাফিররা স্বভাবতই অন্য লোকদের তুলনায় মহানবী (সা.)-এর প্রতি বেশি বিদ্বেষ ও শত্রæতা পোষণ করত। কেননা তারা দেখত যে, মহাবনী (সা.)-এর শিক্ষার ফলেই মানুষের মাঝে র্শিক-এর বিরোধিতা ছড়িয়ে পড়েছে। তারা জানত, তারা যদি তাঁকে হত্যা করতে পারে তাহলে অবশিষ্ট জামা’ত এমনিতেই শৃংখলা হারিয়ে ফেলবে। তাই তারা অন্যদের তুলনায় মহানবী (সা.)-কে বেশি কষ্ট দিত আর তারা চাইত তিনি (সা.) যেন কোনভাবে তাঁর দাবি থেকে বিরত হয়ে যান। এসব সমস্যার কারণে তিনি (সা.) সাহাবীদেরকে হিজরতের অনুমতি দিয়ে দেন কিন্তু এসব দুঃখকষ্ট সত্তে¡ও তিনি (সা.) মক্কা থেকে হিজরত করেন নি। কেননা খোদা তা’লার পক্ষ থেকে তিনি অনুমতিপ্রাপ্ত হন নি। যেমন হযরত আবু বকর (রা.) যখন জিজ্ঞেস করেন, আমি (কি) হিজরত করব? তখন তিনি (সা.) উত্তরে বলেন, علی رسلک فانی ارجو ان یؤذن لی অর্থাৎ, আপনি অপেক্ষা করুন, আশা করি আমাকেও অনুমতি দেয়া হবে।
দ্বারুন্ নাদওয়াতে কাফিররা মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে গোপন শলাপরামর্শের জন্য সমবেত হয়। এ সম্পর্কে লিখা রয়েছে, মক্কার নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে ভীষণ রাগান্বিত ছিল এবং ক্ষোভে ফুঁসছিল কেননা, মুসলমানরা তাদের হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে। এ প্রেক্ষিতে তারা দ্বারুন্ নাদওয়াতে একত্রিত হয়। আল্লামা ইবনে ইসহাক বলেন, কুরাইশরা যখন দেখে, মহানবী (সা.)-এর সাথে কিছু লোকের একটি দল যোগ দিয়েছে যারা মক্কার মুসলমান না আর তাদের অঞ্চলেরও না। অধিকন্তু কুরাইশরা দেখে, মহানবী (সা.)-এর সাহাবীরা হিজরত করে তাদের কাছে চলে যাচ্ছে। কুরাইশরা বুঝতে পারে, তারা একটি নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছে আর তারা তাদের, অর্থাৎ মদীনাবাসীর পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করেছে। কাজেই, তাদের শঙ্কা হয় পাছে কোথাও না আবার মহানবী (সা.) হিজরত করে তাদের কাছে চলে যান। কুরাইশরা বুঝে যায় যে, কুরাইশদের সাথে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তারা সমবেত হচ্ছে। অতএব, তাঁর বিরুদ্ধে পরিকল্পনার জন্য তারা দ্বারুন্ নাদওয়ায় একত্রিত হয়। এটি কুসাই বিন কিলাবের সেই বাড়ি যেখানে কুরাইশদের সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। যখনই তারা তাঁর বিষয়ে শঙ্কিত হত তখন তারা পরামর্শের জন্য এখানে আসতো। অপর একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) সম্পর্কে পরামর্শ করার জন্য তারা দারুন্ নাদওয়ায় প্রবেশ করার বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। যে দিনের বিষয়ে তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় সেদিন তারা যায় আর সেদিনকে ইয়াওমুয্ যাহ্মা বলা হয়। তাদের সামনে এক বয়স্ক বৃদ্ধের রূপে ইবলিসের আবির্ভাব ঘটে। এর অর্থ হল, সে এমন মানুষ ছিল যে ইবলিসী বৈশিষ্ট্যের মানুষ ছিল। যাহোক, সে চাদর মুড়ি দিয়ে দারুন্ নাদওয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। লোকেরা তাকে চিনত না। তাকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা জিজ্ঞেস করে এই বৃদ্ধ লোকটি কে? সেই ব্যক্তি উত্তরে বলে, আমি নাজাদ নিবাসী এক বৃদ্ধ মানুষ। সে আরও বলে, আমি তোমাদের সেই কথা শুনেছি যে বিষয়ে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলে। অতএব, তোমরা কী বল তা শোনার জন্য আমি এখানে এসেছি। সে নিজের সম্পর্কে বলে আশা করি এ থেকে তোমরা কল্যাণকর কিছু পেয়ে যাবে। তারা বলে, ঠিক আছে ভেতরে আসুন। সে তাদের সাথে ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানে কুরাইশের নেতৃস্থানীয়দের একটি বড় দল উপস্থিত ছিল যাদের মাঝে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছে, উতবা বিন রবিয়্যা, শেয়বা বিন রবিয়্যা, আবু সুফিয়ান বিন হারব, তায়েম্মা বিন আদী, আবু জাহল বিন হিশাম, হেজাযের দুই ছেলে ছাড়াও আরও অনেক মানুষ ছিল। এছাড়াও এমন কয়েকজন নেতা ছিল যারা কুরাইশ ছিল না। সবাই যখন একত্রিত হয় এবং পরামর্শ দেয়ার সময় আসে তখন একজন পরামর্শ দেয় তাঁকে, অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.)-কে লোহার শিকলাবদ্ধ করে কারারুদ্ধ করে রাখ আর বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দাও। এরপর তাঁর জন্য সেই মৃত্যুর অপেক্ষা কর যা ইতোপূর্বে তাঁর মত দু’জন কবির ওপর আপতিত হয়েছে। যেমনÑ যোহায়ের ও নাবগাহ্ এবং আরো অন্যান্য কবি যারা ইতোপূর্বে গত হয়েছে। অর্থাৎ, পরিণতির অপেক্ষায় থাক, যেভাবে ইতোপূর্বে দু’জন কবি যোহায়ের ও নাবেগাহ্’র ক্ষেত্রে ঘটেছে, অর্থাৎ মৃত্যু তাঁকে ধ্বংস করা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। অতএব, যেভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছিল সেভাবে মহানবী (সা.)-এর জন্যও একই পরিকল্পনা করা হয়। একথা শুনে সেই নাজাদবাসী বৃদ্ধ বলে, না। আল্লাহ্র কসম! আমার দৃষ্টিতে তোমাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। আল্লাহ্র কসম! তোমরা যদি তাকে কারারুদ্ধ কর তাহলে তাঁর খবর বন্ধ দরজা থেকে বেরিয়ে তাঁর সঙ্গীদের কাছে অবশ্যই পৌঁছে যাবে আর এটি অসম্ভব নয় যে, তারা তোমাদের ওপর আক্রমণ করে তোমাদের কাছ থেকে তাঁেক ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে এবং তাঁর সাহায্যে নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে তোমাদের পরাজিত করবে; তাই অন্য কোন ফন্দি আঁটো। তখন একজন এই পরামর্শ দেয় যে, আমরা এই ব্যক্তিকে আমাদের মধ্যে থেকে বের করে দেই এবং আমাদের এই শহর থেকে দেশান্তরিত করি দেই, এরপর সে কোথায় গেল, কোথায় থাকল তা নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা থাকবে না। সে

যখন আমাদের মধ্য থেকে বিদায় হবে এবং তাঁর কারণে সৃষ্ট মাথাব্যথা থেকে (আমরা) অব্যহতি পাব তখন আমাদের বিষয়ে শৃংখলা ফিরে আসবে। আমরা পুনরায় আগের মত জীবনযাপন করতে পারব। তখন সেই পৌঢ় নাজদী বলে যে, না! আল্লাহ্র কসম! এই মতামতও ঠিক না। তোমরা কি দেখ না এই ব্যক্তির কথা কতটা উৎকৃষ্ট মানের এবং তাঁর কথা কতটা সমধুর, আর সে যাই বলে তার মাধ্যমে সে লোকদের হৃদয় কীভাবে জয় করে নেয়? আল্লাহ্র কসম! যদি তোমরা এরূপ করো তাহলে তোমরা নিরাপদে থাকতে পারবে না। কেননা, সে আরবের যে গোত্রেই যাবে এবং সেখানেই নিজ কথার মাধ্যমে তাদের মন জয় করে নিবে আর সেসব লোক তাঁর আনুগত্য করতে শুরু করবে। এরপর তাঁর সাথে একত্রিত হয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে এবং তোমাদেরকে তোমাদেরই শহরে পদপিষ্ট করবে। তোমাদের বিষয়াদি তোমাদের হাত থেকে কেড়ে নিবে, এরপর যেমন ইচ্ছা তোমাদের সাথে ব্যবহার করবে। অতএব, এটি বাদ দিয়ে অন্য কোন প্রস্তাব নিয়ে ভাব। তখন আবু জাহল বলে, আমার মতামত হল, কুরাইশ বংশের সকল গোত্র থেকে একজন করে তরুণ বয়সের, শক্তপোক্ত এবং সম্ভ্রান্ত বংশীয় যুবক নির্বাচিত করা হোক। এরপর তাদের সবার হাতে ধারালো তরবারি তুলে দেয়া হোক, এরপর তারা মুহাম্মদ (সা.)-এর সন্ধানে বের হোক এবং যথোচিত আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করুক। এভাবে সেই ব্যক্তি থেকে আমাদের মুক্তি মিলবে। এভাবে হত্যা করার ফলে তাঁর হত্যায় সকল গোত্রের ভূমিকা থাকবে আর বনূ আব্দে মনাফ সকল গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতে পারবে না। যারফলে তারা রক্তপন গ্রহণে সম্মত হয়ে যাবে আর আমরা রক্তপন পরিশোধ করে দিব। এর প্রেক্ষিতে বৃদ্ধ নাজদী বলে, এটাই পরিকল্পনার মত পরিকল্পনা বাকি সব অযথা কথাবার্তা। অতএব, এই পরিকল্পনায় সবাই একমত হয়ে চলে যায়। অন্যদিকে আল্লাহ্ তা’লা মহানবী (সা.)-কে এসব বিষয়ে অবগত করে দেন। যেভাবে আল্লাহ্ বলেন,
وَإِذْ يَمْكُرُ بِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِيُثْبِتُوكَ أَوْ يَقْتُلُوكَ أَوْ يُخْرِجُوكَ ۚ وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
আর স্মরণ কর! যখন কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল, যেন তারা তোমাকে অবরুদ্ধ করতে পারে অথবা তোমাকে হত্যা করতে পারে অথবা তোমাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করতে পারে। এবং তারা কৌশল আঁটছিল আর আল্লাহ্ও পরিকল্পনা করছিলেন। বস্তুতঃ আল্লাহ্ কৌশলকারীগণের মধ্যে উত্তম। (সূরা আল্ আনফাল: ৩১) একই সাথে জিব্রাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে মহানবী (সা.)-কে হিজরতের অনুমতি দিয়ে দেন।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, মক্কার কাফিররা মহানবী (সা)-কে হত্যা করার সংকল্প করে। তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ তাঁর পবিত্র নবী (সা.)-কে এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবগত করেন এবং মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের আদেশ দেন। এরপর বিজয়ী বেশে ও ঐশী সমর্থনপুষ্ট হয়ে ফেরত আসার সুসংবাদ দেন। ভরা গ্রীস্মের এক তপ্ত দুপুরে রোজ বুধবার আল্লাহ্র পক্ষ থেকে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়।
হিজরতের অনুমতি পাবার পর মহানবী (সা.) অত্যন্ত সতর্কতার সাথে হযরত আবু বকর (রা.)’র বাড়িতে ঠিক দুপরে অর্থাৎ ঠিক সে সময়ে যান যখন মক্কাবাসী সাধারণত নিজ ঘরেই থাকে এবং কেউ কারও বাড়িতে যাওয়া আসা করে না। অতিরিক্ত সতর্কতাস্বরূপ এবং প্রচÐ গরমের কারণেও {তিনি (সা.)} নিজের চেহারা ও মাথা ইত্যাদি কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন। যখন তিনি (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)’র বাড়ির কাছে পৌঁছান তখন কেউ একজন বলল, মহানবী (সা.) এসেছেন বলে মনে হচ্ছে; তিবরানী ও ফাতহুল বারীর বর্ণনা মোতাবেক হযরত আসমা (রা.) একথা বললেন। আবু বকর (রা.) বলেন, আমার পিতামাতা তাঁর জন্য নিবেদিত। আল্লাহ্র কসম! মহানবী (সা.) এই সময়ে নিশ্চিত কোন বিশেষ কারণে এসেছেন। একইসাথে হযরত আবু বকর (রা.) ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তির ন্যায় বাহিরে বের হন। আর মহানবী (সা.) যখন ভেতরে প্রবেশ করেন তখন কামরায় হযরত আয়েশা (রা.) ও হযরত আসমা (রা.) ছিলেন। মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)-কে বলেন, ‘তোমার সাথে যারা আছে তাদের বাইরে পাঠিয়ে দাও।’ হযরত আবু বকর (রা.) নিবেদন করেন, ‘হুযূর! কেবল আমার এই দুই মেয়ে-ই এখন এখানে আছে, আর কেউ নেই।’ অপর এক বর্ণনা মতে তিনি (রা.) নিবেদন করেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল! এখানে কেবল আপনার পরিবারের লোকজনই রয়েছে, অন্য কেউ নেই।’ অতঃপর মহানবী (সা.) বলেন, ‘আবু বকর! আমি হিজরতের অনুমতি পেয়ে গেছি।’ হযরত আবু বকর (রা.) তৎক্ষণাৎ অবলীলায় নিবেদন করেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল! আপনার সঙ্গ পাবো কি?!’ অর্থাৎ ‘আমিও কি আপনার সাথে যেতে পারব?!’ মহানবী (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ।’ এটি বুখারী শরীফের হাদীস। একথা শুনে হযরত আবু বকর (রা.) আনন্দে কেঁদে ফেলেন। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি সেদিন-ই সর্বপ্রথম জানলামÑ আনন্দেও কেউ কাঁদতে পারে!’ এরপর সেখানে হিজরতের যাবতীয় পরিকল্পনা ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়। হযরত আবু বকর (রা.) নিবেদন করেন, ‘হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমি এই উদ্দেশ্যেই দু’টি উটনী কিনে রেখেছিলাম, তাত্থেকে আপনি একটি নিয়ে নিন।’ তিনি (সা.) বলেন, ‘মূল্য পরিশোধ করে নেব।’ যখন তিনি (সা.) মূল্য পরিশোধের বিষয়ে অনড় থাকেন তখন হযরত আবু বকর (রা.) মূল্য গ্রহণ না করে পারলেন না। হযরত আবু বকর (রা.) দু’টি উটনী আটশ’ দিরহাম দিয়ে কিনেছিলেন, তা থেকে চারশ’ দিরহাম মূল্যে একটি উটনী মহানবী (সা.) কিনে নেন। অপর এক বর্ণনামতে মহানবী (সা.) আটশ’ দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করে ছিলেন। এরপর ঠিক করা হয়, প্রথম বিরতি হবে সওর গুহায় এবং তিনদিন সেখানেই অবস্থান করা হবে। সেই সাথে এ-ও ঠিক করা হয়, এমন কোন দক্ষ ব্যক্তিকে সাথে নিতে হবে, যে মক্কার চতুর্দিকের সব চেনা-অচেনা মরুপথের বিষয়ে অবগত। এ কাজের জন্য আব্দুল্লাহ্ বিন উরায়কিতের সাথে কথা হয়; সে যদিও মুশরিক ছিল, কিন্তু ভদ্র, দায়িত্বশীল ও আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিল। জীবনীকারকগণ তার সম্পর্কে বলেন, সে মুসলমান ছিল না, তবে এক বর্ণনামতে পরবর্তীতে সে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। যাহোক, তার হাতে তিনটি উটনী তুলে দেওয়া হয় এবং ঠিক করা হয়, সে ঠিক তিনদিন পর প্রত্যুষে সওর গুহায় চলে আসবে। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আবু বকর যিনি একজন বুদ্ধিদীপ্ত যুবক ছিলেন, তার ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়Ñ তিনি প্রতিদিন মক্কার বিভিন্ন আড্ডা-আলোচনায় ঘুরে ঘুরে খোঁজ-খবর নেবেন যে, কী শলাপরমর্শ হচ্ছে; তারপর রাতের বেলা তিনি সওর গুহায় গিয়ে সবকিছু অবহিত করবেন। হযরত আবু বকর (রা.)’র একজন বুদ্ধিমান ও দায়িত্বশীল দাস আমের বিন ফুহায়রা’র ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়Ñ তিনি নিজের ছাগপাল সওর গুহার আশেপাশেই চরাবেন এবং রাতের বেলা দুধেল ছাগলের টাটকা দুধ (তাঁদের কাছে) পৌঁছে দেবেন। মক্কা থেকে যাত্রার দিনক্ষণ ঠিক করার পর মহানবী (সা.) দ্রæত হযরত আবু বকর (রা.)’র বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফিরে আসেন। বাড়ি এসে তিনি (সা.) হযরত আলী (রা.)-কে নিজের হিজরতের পরিকল্পনার বিষয়ে অবগত করে তাঁকে এক মহান বীরত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন; তা হলÑ সে রাতে তিনি মহানবী (সা.)-এর পবিত্র বিছানায় সেই সবুজ বা আরেক বর্ণনামতে লাল রংয়ের হাযরামী (হাযারামওতে প্রস্তুতকৃত) চাদর গায়ে দিয়ে ঘুমাবেন, যা মহানবী (সা.) স্বয়ং গায়ে দিয়ে ঘুমাতেন। মহানবী (সা.) নিজের সেই মহান নিবেদিতপ্রাণ সেবককে ঐশী সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করতে গিয়ে বলেন, ‘চিন্তা করবে না, আর নিশ্চিন্তে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাকবে; শত্রæ তোমার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না।’ একই সাথে আল্লাহ্ তা’লার সাদেক ও আমীন (সত্যবাদী ও বিশ^স্ত) রসূলের যেহেতু তাঁর কাছে গচ্ছিত মক্কাবাসীদের জিনিসপত্রের বিষয়েও চিন্তা ও দায়িত্ববোধ ছিল, তাই তিনি (সা.) {হযরত আলী (রা)-কে} বলেন, মানুষের আমানত প্রত্যার্পণ করে (মদীনায়) চলে এসো। অর্থাৎ হযরত আলী (রা.)-কে বলেন, ‘গচ্ছিত জিনিসপত্র ফিরিয়ে দিয়ে মদীনা চলে আসবে।’ বস্তুতঃ হযরত আলী মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে মানুষজনকে গচ্ছিত জিনিসপত্র ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তিনদিন মক্কায় অবস্থান করেন। যখন তিনি (রা.) এই কাজ সম্পন্ন করেন তখন তিনিও কুবায় গিয়ে মহানবী (সা.)-এর সাথে মিলিত হন। “এরপর মহানবী (সা.) নিজের বাড়ি থেকে বাইরে বের হন যখন মক্কার কাফিরদের চয়নকৃত বীরেরা, রাগে যাদের চোখ রক্তিমবর্ণ ছিল, তারা তরবারি হাতে নিয়ে ঠিক মহানবী (সা.)-এর বাড়ির বাইরে পূর্ণ সতর্কতার সাথে পাহারা দিচ্ছিল যে, ‘কখন রাত গভীর হবে আর আমরা একযোগে আক্রমণ করে এক আঘাতেই রসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভবলীলা সাঙ্গ করে দেব।’ আর আবু জাহল যে তাদের নেতা ছিল, সে অত্যন্ত অহংকার ও বিদ্রæপাত্মক স্বরে বলছিল, ‘মুহাম্মদ তো বলে, যদি তোমরা তাঁর কাজে তাঁর অনুগামী হও তবে তোমরা আরব ও অনারবদের বাদশাহ্ হয়ে যাবে। এরপর তোমাদের মৃত্যুর পর তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করা হবে, তখন আদনের বাগানের মত (স্থায়ী) বাগান তোমাদের জন্য প্রস্তুত করা হবে। কিন্তু যদি তোমরা এমনটি না কর তবে তোমাদের মাঝে খুনোখুনি-রাহাজানি ছড়িয়ে পড়বে।’ মহানবী (সা.) বাইরে আসেন এবং বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি এমনটিই বলে থাকি।’ এবং সূরা ইয়াসিনের নি¤েœাক্ত আয়াতগুলো পাঠ করেন:
يسٓ (২) وَٱلۡقُرۡءَانِ ٱلۡحَكِيمِ (৩) إِنَّكَ لَمِنَ ٱلۡمُرۡسَلِينَ (৪) عَلَىٰ صِرَٲطٍ۬ مُّسۡتَقِيمٍ۬ (৫) تَنزِيلَ ٱلۡعَزِيزِ ٱلرَّحِيمِ (৬) لِتُنذِرَ قَوۡمً۬ا مَّآ أُنذِرَ ءَابَآؤُهُمۡ فَهُمۡ غَـٰفِلُونَ (৭) لَقَدۡ حَقَّ ٱلۡقَوۡلُ عَلَىٰٓ أَكۡثَرِهِمۡ فَهُمۡ لَا يُؤۡمِنُونَ (৮) إِنَّا جَعَلۡنَا فِىٓ أَعۡنَـٰقِهِمۡ أَغۡلَـٰلاً۬ فَهِىَ إِلَى ٱلۡأَذۡقَانِ فَهُم مُّقۡمَحُونَ (৯) وَجَعَلۡنَا مِنۢ بَيۡنِ أَيۡدِيہِمۡ سَدًّ۬ا وَمِنۡ خَلۡفِهِمۡ سَدًّ۬ا فَأَغۡشَيۡنَـٰهُمۡ فَهُمۡ لَا يُبۡصِرُونَ (১০)
অর্থাৎ: ‘ইয়া সীন- (হে নেতা)! প্রজ্ঞাপূর্ণ কুরআনের শপথ! নিশ্চয়ই তুমি রসূলগণের অর্ন্তভুক্ত, সরল-সুদৃঢ় পথে প্রতিষ্ঠিত। এটি মহা পরাক্রমশালী, পরম দয়াময়ের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ; যেন তুমি সেই জাতিকে সর্তক কর যাদের পিতৃপুরুষগণকে সর্তক করা হয়নি, যার ফলে তারা উদাসীন। নিশ্চয়ই তাদের অধিকাংশের বিষয়ে (ঐশী) বাক্য পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, অতএব তারা ঈমান আনবে না। নিশ্চয় আমরা তাদের গলায় বেড়ি পরিয়ে দিয়েছি যা তাদের চিবুক পর্যন্ত বিস্তৃত, এজন্য তারা মাথা উঁচু করে রেখেছে। আর আমরা তাদের সামনেও এক প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে দিয়েছি এবং তাদের পেছনেও এক প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে দিয়েছি এবং তাদের পর্দা দিয়ে ঢেকে দিয়েছি, ফলে তারা দেখতে পায় না।’ (সূরা ইয়াসীন: ২-১০)
এই আয়াতগুলো পাঠ করতে করতে তিনি (সা.) তাদের চোখে ধুলো দিয়ে তাদের সামনে দিয়ে বের হয়ে যান। অথচ খোদার মহিমা, তাঁর (সা.) বের হয়ে যাওয়াটা কারও দৃষ্টিগোচর হয়নি। বরং তারা একটু পরপর ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখতো আর নিশ্চিন্ত থাকতো যে, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বিছানাতেই শুয়ে আছেন। এ ঘটনাটি সীরাত খাতামান্ নবীঈন পুস্তকে হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) এভাবে উল্লেখ করেছেন:
অন্ধকার রাত ছিল এবং অত্যাচারী কুরাইশরা, যারা বিভিন্ন গোত্রের সাথে সম্পর্ক রাখত, তারা হত্যার অভিসন্ধি নিয়ে তাঁর (সা.) বাড়ির চতুর্দিকে সমবেত হয়ে তাঁর বাড়ি অবরোধ করে রেখেছিল। তারা অপেক্ষা করছিল, সকাল হলে কিংবা তিনি (সা.) নিজের ঘর থেকে বের হলে তাঁর ওপর আকস্মিক আক্রমন করে তাঁকে তাকে হত্যা করা হবে। মহানবী (সা.)-এর কাছে কতক কাফিরের আমানত গচ্ছিত ছিল। কারণ প্রচÐ বিরোধিতা সত্তে¡ও অধিকাংশ মানুষ তাঁর (সা.) সততা ও বিশ্বস্ততার কারণে নিজেদের ধন-সম্পদ তাঁর কাছে গচ্ছিত রাখত। এজন্য তিনি (সা.) হযরত আলী (রা.)-কে সেসব গচ্ছিত জিনিসের হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর জোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, গচ্ছিত জিনিসপত্র ফিরিয়ে না দিয়ে তিনি যেন মক্কা ত্যাগ না করেন। এরপর তিনি (সা.) তাঁকে বলেন, ‘তুমি আমার বিছানায় শুয়ে পড়;’ আর তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে, খোদার কৃপায় তাঁর কোন ক্ষতি হবে না। তিনি বিছানায় শুয়ে পড়েন এবং মহানবী (সা.) নিজের লাল রঙের চাদর তাঁর গায়ে জড়িয়ে দেন। এরপর তিনি (সা.) আল্লাহ্র নাম নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। সে সময় অবরোধকারীরা তার বাড়ির দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু যেহেতু তারা ধারণা করতে পারেনি যে, মহানবী (সা.) এভাবে রাতের প্রথম প্রহরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবেন, তাই তারা সে সময় এতটাই উদাসীন ছিল যে, তিনি (সা.) তাদের চোখে ধুলো দিয়ে তাদের সামনে দিয়েই বের হয়ে আসেন, অথচ তারা টেরই পেল না।
সেসব কুরাইশ, যারা তাঁর (সা.) বাড়ি অবরোধ করে রেখেছিল, তারা কিছুক্ষণ পর পর তাঁর ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখতো আর হযরত আলী (রা.)-কে তাঁর (সা.) স্থলে শায়িত দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে যেতো। কিন্তু প্রভাত হলে তারা জানতে পারে যে, তাদের শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে। এতে তারা এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে আর মক্কার অলিগলিতে সাহাবীদের বাড়িঘরে অনুসন্ধান করে, কিন্তু কোন খোঁজ পায় নি। এই ক্রোধে তারা হযরত আলী (রা.)-কে ধরে আর কিছুটা প্রহারও করে।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এর উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন,
মহানবী (সা.) যখন অকস্মাৎ নিজের মাতৃভ‚মি ছেড়ে যাচ্ছিলেন, আর বিরোধীরা হত্যার মানসে চতুর্দিক থেকে এই বরকতমÐিত বাড়িটি ঘেরাও করে, তখন এক অত্যন্ত প্রিয়ভাজন, যার প্রকৃতি ছিল ভালোবাসা ও বিশ^াসে সমৃদ্ধ, জীবনবাজি রেখে মহানবী (সা.)-এর বিছানায় তাঁরই নির্দেশে এই উদ্দেশ্যে মুখ ঢেকে শুয়ে থাকেন যেন বিরোধীদের গুপ্তচরেরা মহানবী (সা.)-এর বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কোন খোঁজখবর না নেয় আর তাকেই মহানবী (সা.) ভেবে হত্যার উদ্দেশ্যে অপেক্ষায় থাকে।
کس بہر کسے سر ندہد جان نہ فشاند
عشق است کہ ایں کار بصد صدق کناند
(উচ্চারণ: কাস বেহরে কাসে সার নাদাহাদ জাঁ নাফেশানাদ
ইশক আস্ত কেহ্ ঈঁ কার বাসাদ সিদক কুনানদ)
অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি কারও জন্য প্রাণবিসর্জন দেয় না, আর না জীবনবাজি রাখে। এটি ভালোবাসাই, যা গভীর নিষ্ঠার সাথে মানুষের হাতে এই কাজ করিয়ে থাকে।
{মহানবী (সা.)-এর} বের হওয়ার সময় সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে, কেউ কেউ বলে থাকে প্রথম প্রহরে, কেউ বলে মধ্যরাতে, কেউ কেউ বলে শেষরাতে। যাহোক, মহানবী (সা.) কখন নিজ ঘর থেকে বের হন এ সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েতে যে মতপার্থক্য রয়েছে তার উল্লেখ করছি।
একটি রেওয়ায়েতে উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি (সা.) রাতের শেষ তৃতীয়াংশে বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়েছিলেন। যেমন মুহাম্মদ হোসেন হ্যায়কল লিখেন যে, রাতের শেষ তৃতীয়াংশে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এই মুশরিকদের উদাসীনতার ঘোরে হযরত আবু বকর (রা.)’র বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হন আর সেখান থেকে উভয়ে বাড়ির পিছন দিকের দরজা দিয়ে বের হয়ে দক্ষিণ দিকে সওর গুহা অভিমুখে যাত্রা করেন। আরেক রেওয়ায়েতে উল্লেখ রয়েছে যে, তিনি (সা.) মধ্যরাতে বের হন। যেমন ‘দালায়েলুন্ নবুওয়্যা’-তে লেখা আছে, মহানবী (সা.) এবং হযরত আবু বকর (রা.) মধ্যরাতে সওর গুহা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। ‘মাদারেজুন নবুওয়্যা’-তে লেখা আছে, মহানবী (সা.) প্রভাতে হিজরত করার মনস্থ করেন, আর সন্ধ্যায়ই হযরত আলী মুর্তজা (কারামাল্লাহু ওয়াজহাহু’কে) বলেন, আজ রাতে তুমি এখানেই শোবে যেন মুশরিকরা সন্দেহ-সংশয়ের ঘোরে প্রকৃত অবস্থা অবগত না হয়।
হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.) যা লিখেছেন তা হল, মহানবী (সা.) রাতের প্রথম প্রহরে নিজের বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। যেমন, এর বিস্তারিত বিবরণে তিনি (রা.) লিখেন যে,
অবরোধকারীরা তাঁর (সা.) বাড়ির সামনেই উপস্থিত ছিল, কিন্তু যেহেতু তাদের এই ধারণা ছিল না যে, মহানবী (সা.) এভাবে রাতের প্রথম প্রহরেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবেন, তাই তখন তারা এতটাই উদাসীন ছিল যে, তিনি (সা.) তাদের চোখে ধুলো দিয়ে তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে যান, অথচ তারা টেরও পায় নি। এরপর মহানবী (সা.) নীরবে কিন্তু দ্রæত পদক্ষেপে মক্কার অলিগলি পেরিয়ে স্বল্পক্ষণের মাঝেই লোকালয় থেকে বেরিয়ে সওর গুহার পথ ধরেন। হযরত আবু বকর (রা.)’র সাথে সমস্ত কথাবার্তা পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল। তিনিও পথিমধ্যে এসে মিলিত হন।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বিভিন্ন রেওয়ায়েতের আলোকে যা বর্ণনা করেছেন তা হল, মক্কাবাসীরা যখন তাঁকে (সা.) হত্যার মানসে তাঁর (সা.) বাড়ির সামনে সমবেত হচ্ছিল তখন তিনি (সা.) রাতের অন্ধকারে হিজরতের উদ্দেশ্যে নিজের বাড়ি হতে বাইরে বের হচ্ছিলেন। মক্কাবাসীরা নিশ্চয় সন্দেহ করে থাকবে যে, তাদের উদ্দেশ্যের সংবাদ মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ (সা.)ও হয়ত পেয়ে গেছেন, কিন্তু তারপরও যখন তিনি (সা.) তাদের সামনে দিয়ে যান তখন তারা এটিই ভাবে যে, ইনি অন্য কোন ব্যক্তি হবেন আর তাঁর (সা.) ওপর আক্রমণ করার পরিবর্তে একদিকে পাশ কাটিয়ে তাঁর কাছ থেকে লুকানোর চেষ্টা করে যাতে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.) জানতে না পারেন। এই রাতের আগের দিনেই তাঁর (সা.) সাথে হিজরত করার জন্য হযরত আবু বকর (রা.)-কে সংবাদ দেয়া হয়েছিল। অতএব, তিনিও এসে তাঁর (সা.) সাথে মিলিত হন এবং উভয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই একসাথে মক্কা হতে যাত্রা করেন।
হযরত আকদাস মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর ভাষ্যমতে মহানবী (সা.) সকাল বেলা ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। যেমন তিনি (আ.) বলেন, যাবার সময় মহানবী (সা.)-কে কোন বিরোধী দেখতে পায় নি, অথচ সকাল বেলা ছিল এবং সকল বিরোধী মহানবী (সা.)-এর বাড়ি অবরোধ করে রেখেছিল। কাজেই খোদা তা’লা, যেমনটি সূরা ইয়াসীনে এর উল্লেখ করেছেন, সেসব হতভাগার চোখ পর্দাবৃত করে দেন এবং মহানবী (সা.) তাদের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে যান। যাহোক, বিভিন্ন রেওয়ায়েত রয়েছে, কিন্তু সারকথা হল, কাফিররা বুঝতে পারে নি।
এ ছাড়া নিজের বাড়ি হতে বের হয়ে মহানবী (সা.) কোন দিকে গিয়েছেন সে সম্পর্কেও ভিন্ন রেওয়ায়েত রয়েছে। একটি বিবরণ থেকে এই ধারণা পাওয়া যায় যে, মহানবী (সা.) নিজের বাড়ি থেকে বের হয়ে থাকবেন এবং হযরত আবু বকর (রা.) নিজের ঘর হতে আর পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় উভয়ে মিলিত হয়ে সওর গুহা অভিমুখে যাত্রা করেন। একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) নিজের ঘর হতে সওর গুহার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং কিছুক্ষণ পর হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর (সা.) ঘরে পৌঁছেন, তখন হযরত আলী (রা.) তাঁকে বলেন যে, তিনি (সা.) তো রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন এবং সওর গুহার দিকে যাচ্ছেন, তাই আপনিও তাঁর (সা.)-এর পিছন পিছন রওয়ানা হয়ে যান। অতএব, হযরত আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-এর পিছনে রওয়ানা হয়ে যান। যাহোক, এই বর্ণনা অনেক দুর্বল বলে মনে হয়, কেননা এটি থেকে এই ধারণা জন্মে যে, মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)’র জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন এবং তিনি (রা.) বিলম্বে আসেন। সেইসাথে হযরত আবু বকর (রা.) এটিও জানতেন না যে, মহানবী (সা.) কোন দিকে গিয়েছেন আর হযরত আলী (রা.) এখন তাঁকে সবকিছু অবগত করছেন। হিজরতের ন্যায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় সফর এবং হযরত আবু বকর (রা.)’র ন্যায় বিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি এরূপ উদাসীনতা প্রদর্শন করবেনÑ এটি কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই এই রেওয়ায়েতের বিপরীতে অপর রেওয়ায়েত যা অধিকাংশ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে, তা-ই অধিক সঠিক ও অনুমেয় বলে মনে হয়, কেননা সেটি অনুযায়ী মহানবী (সা.) নিজের বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা হযরত আবু বকর (রা.)’র বাড়ি যান এবং সেখান থেকে হযরত আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে করে সওর গুহার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সে সময় হযরত আবু বকর (রা.)’র দু’জন বিশ^স্ত ও সাহসী কন্যা হযরত আয়েশা (রা.) ও হযরত আসমা (রা.) সফরের জন্য দ্রæত খাবারও প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন, যাতে ছাগলের ভুনা মাংসও ছিল। পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতা ও তাড়াহুড়োর কারণে চামড়ার তৈরী খাবারের পাত্র বাঁধার জন্য, কোন কিছু না পেয়ে হযরত আসমা (রা.) তাঁর নিতাক অর্থাৎ কোমরবন্ধনী খুলে তা দু’টুকরো করেন এবং খাবার বেঁধে দেন। তিনি একটি টুকরা দিয়ে খাবারের থলি এবং অন্য টুকরা দিয়ে মশক বা পানির পাত্রের মুখ বেঁধে দেন। মহানবী (সা.) ভালোবাসা ও বিস্তততার এ মূহুর্তগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন বলে উঠেন, হে আসমা! আল্লাহ্ তা’লা তোমার এই নিতাক বা কোমরবন্ধনীর বিনিময়ে জান্নাতে তোমাকে দু’টি নিতাক দান করবেন। অর্থাৎ সেই কোমরবন্ধ যা তার কোমরে বাধা ছিল। মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে এই উক্তির কারণে পরবর্তীতে হযরত আসমা (রা.)-কে ‘যাতুন নিতাকায়ন’ (তথা দুই কোমরবন্ধী বিশিষ্ট) বলা হত। হিজরতের এই সফরে মহানবী (সা.)-এর মুখে সদা যে আয়াত উচ্চারিত হচ্ছিল তা হল:
وَقُل رَّبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَل لِّي مِن لَّدُنكَ سُلْطَانًا نَّصِيرًا
অর্থাৎ, তুমি বল, হে আমার প্রভু! আমাকে এমনভাবে প্রবেশ করাও যেন আমার প্রবেশ সত্যসহকারে হয় আর আমাকে এমনভাবে বের কর যেন আমার বের হওয়া সত্যসহকারে হয় আর তুমি নিজ সন্নিধান থেকে আমার জন্য শক্তিশালী সাহায্যকারী দান কর। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮১)
একইভাবে এ দোয়ারও উল্লেখ পাওয়া যায় যে,
الحمد لله الذي خلقني ولم أن شيئا اللهم اعنی علی هول الدنيا وبوائق الدهر ومصائب الليالي والأيام. اللهم اصحبني في سفری و اخلفني في اهلی و بارک لی فيما رزقتني ولك فذللتی و علی صالح خلقی فقوني واليک ربی فحبنی والی الناس فلا تكلني انت رب المستضعفين وانت ربی اعوذ بوجهك الكريم الذي اشرکت له السماوات والأرض و كشفت به الظلمات وصلح اليه الأمر الأولين والآخرين ان يحل به غضبک او ينزل الى سخطک اعوذبک من زوال نعمتك وفجاة الحكمتك وتحول العاقبتك وجميع سخطك. لك العقبی خير ما سطعت ولا حول ولا قوة الا بک.
অর্থাৎ, সকল প্রশংসা সেই মহান আল্লাহ্র যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন অথচ (এক সময়) আমি কিছুই ছিলাম না। হে আল্লাহ্! জগতের ভয়, যুগের বিপদাবলী এবং রাত ও দিনের বিপদাবলীতে আমাকে সাহায্য কর। হে আল্লাহ্! আমার সফরে তুমি আমার সাথী হও এবং আমার পরিবারে আমার স্থলভিষিক্ত হও আর তুমি আমাকে যা দিয়েছ তাতে আমার জন্য প্রভূত কল্যাণ দান কর আর আমাকে তোমার অনুগামী করে দাও এবং আমার উত্তম গঠনকে শক্তিধর বানাও আর আমার প্রভুকে আমার প্রিয় বানিয়ে দাও এবং আমাকে মানুষের হাতে ছেড়ে দিও না। তুমি দুর্বলেরও প্রভু আর আমারও প্রভু। তোমার পবিত্র চেহারা, যদ্বারা আকাশ ও পৃথিবী আলোকিত হয়েছে এবং যদ্বারা অন্ধকার বিদূরিত হয়েছে আর যদ্বারা পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের বিষয় সঠিক খাতে পরিচালিত হয়েছে, তোমার ক্রোধ এবং তোমার অসন্তুষ্টি আমার প্রতি অবতীর্ণ হওয়া থেকে আমি এর (অর্থাৎ তোমার পবিত্র চেহারার) আশ্রয়ে এলাম। তোমার নিয়ামত প্রত্যাহৃত হওয়া থেকে এবং হঠাৎ করে নেমে আসা তোমার শাস্তি থেকে আর আমার বিষয়ে তোমার শেষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমি তোমার আশ্রয়ে এলাম।
যুরকানীর ব্যাখ্যায় ‘তাহাওওলে আকেবাতেক’-এর স্থলে ‘তাহাওওলে আফিয়াতেক’ শব্দ লেখা হয়েছে। এর অর্থ হল, তোমার প্রদত্ত নিরাপত্তা উঠে যাওয়া থেকে (তোমার আশ্রয় চাচ্ছি)। আর তোমার সব ধরনের অসন্তুষ্টির মুখে তোমার সন্তুষ্টিই যেন সকল পুণ্যে আমার সহায়ক হয়। তোমার সাহায্য ছাড়া কোন পাপ থেকে রক্ষা পাবার কোন উপায় নেই এবং কোন পুণ্যকর্ম করারও শক্তি নেই।
কা’বা গৃহের পেছন দিয়ে যাওয়ার সময় মহানবী (সা.) নিজের পবিত্র চেহারা কা’বামুখী করে মক্কাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আল্লাহ্র শপথ, হে মক্কা! আল্লাহ্র পৃথিবীতে তুমি আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আর পৃথিবীর সব জায়গার তুলনায় তুমি আল্লাহ্র কাছে সর্বাধিক প্রিয়। তোমার অধিবাসীরা যদি আমাকে বলপূর্বক বের করে না দিত, তবে আমি কখনও এখান থেকে বের হতাম না।
ইমাম বায়হাকী লিখেন, সওর অভিমুখে সফরকালে হযরত আবু বকর (রা.) কখনও মহানবী (সা.)-এর অগ্রে কখনও পশ্চাতে আবার কখনও ডানে আর কখনও বামে হাঁটতেন। মহানবী (সা.) এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমার যখন ধারণা হয় যে, কেউ সম্মুখ থেকে না এসে যায় তখন আমি আপনার সামনে চলে যাই আবার যখন আশংকা হয় যে, কেউ পেছন থেকে না আক্রমণ করে বসে, তখন আমি আপনার পেছনে চলে যাই আর একইভাবে কখনও ডানে আবার কখনও বামে যাই যেন আপনি চতুর্দিক থেকে সুরক্ষিত ও নিরাপদ থাকেন। এক রেওয়ায়েত অনুযায়ী সওর গুহা পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে পাহাড়ি রাস্তায় সফরের কারণে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। আবার আরেকটি রেওয়ায়েত অনুযায়ী, পথিমধ্যে একটি পাথরে হোঁচট খাওয়ার কারণে তাঁর (সা.) পবিত্র পা ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। সওর গুহায় যখন পৌঁছান তখন হযরত আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-কে বিনীতভাবে বলেন, আপনি এখানে দাঁড়ান, প্রথমে আমাকে ভেতরে যেতে দিন যাতে আমি গুহার ভেতরটা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে পারি এবং কোন ভয়ঙ্কর কিছু থাকলে আমি যেন প্রথমে সেটির মোকাবিলা করতে পারি। অতএব, তিনি (রা.) প্রথমে ভেতরে যান এবং গুহাটি পরিষ্কার করেন। সেখানে যেসব ছিদ্র এবং কোঠর ইত্যাদি ছিল, তা নিজের কাপড় দিয়ে বন্ধ করেন। অতঃপর মহানবী (সা.)-কে ভেতরে আসার আহŸান জানান। তিনি বলেন, মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)-এর উরুর ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন আর একটি ছিদ্র যা বন্ধ করার কাপড় ছিল না কিংবা সম্ভবত তখন চোখে পড়ে নি, সেটির ওপর হযরত আবু বকর (রা.) নিজের পা রেখে দেন। রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে, সেই গর্ত থেকে কোন বিচ্ছু কিংবা সাঁপ বেরিয়ে দংশন করছিল কিন্তু হযরত আবু বকর (রা.) এই ভয়ে কোন নড়াচড়া করেন নি পাছে মহানবী (সা.)-এর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। মহানবী (সা.)-এর যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন হযরত আবু বকর (রা.)’র বিবর্ণ চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার? তখন তিনি (রা.) সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। তখন মহানবী (সা.) তাঁর (মুখের) পবিত্র লালা সেখানে লাগিয়ে দেন, ফলে পা এমন হয়ে যায় যেন এর কিছুই হয় নি। অন্যদিকে মক্কার কুরাইশরা যারা মহানবী (সা.)-এর গৃহ পরিবেষ্টন করে রেখেছিল, তাদেরকে দেখে এক ব্যক্তি পাশ দিয়ে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করে, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? তারা কারণ বললে সেই ব্যক্তি বলল, আমি তো মুহাম্মদ (সা.)-কে গলি দিয়ে যেতে দেখেছি। একথা শুনে তারা সেই ব্যক্তির সাথে ঠাট্টাচ্ছলে বলে, সে তো বিছানায় শুয়ে আছে আর আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে তার ওপর চোখ রেখেছি। অতঃপর গভীর রাতে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী যখন তারা হঠাৎ করে ভেতরে গিয়ে চাদর টান দেয় তখন তারা দেখে যে, তিনি তো হযরত আলী (রা.)। তাঁকে জিজ্ঞেস করল, মুহাম্মদ কোথায়? উত্তরে তিনি বলেন, আমার জানা নেই। একথা শুনে মুশরিকরা তাঁকে বকাঝকা ও মারধোর করে। তারপর কিছুক্ষণ আটকে রাখার পর তাঁকে ছেড়ে দেয়।
যাহোক, এই রেওয়ায়েত অনুযায়ী তারা সেখান থেকে ক্রোধ ও রাগের ঘোরে হযরত আলী (রা.)-কে গালাগালি ও মারধোর করে ফেরত চলে আসে আর মক্কার অলিগলি ও প্রতিটি বাড়িতে তাঁকে (সা.) খুঁজতে থাকে। তখন তারা হযরত আবু বকর (রা.)’র বাড়িতেও যায়। হযরত আসমা (রা.)’র মুখোমুখী হয়। আবু জাহল সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার পিতা আবু বকর (রা.) কোথায়? তিনি বলেন, আমি জানি না তিনি কোথায়। অতঃপর সেই নোংরা প্রকৃতির (মানুষ) আবু জাহল নিজের হাত উঠায় এবং হযরত আসমা (রা.)’র মুখে এত জোরে চড় মারে যে, তাঁর কানের দুল ছিঁড়ে পড়ে যায় আর রাগান্বিত হয়ে সবাই ফেরত চলে যায়। গোটা মক্কা চষে বেড়িয়েও তারা সফল হয় নি তখন দক্ষ খোঁজীদের মক্কার চতুর্দিকে রওয়ানা করিয়ে দেয়। মক্কার এক নেতা উমাইয়্যা বিন খালফ নিজে একজন অভিজ্ঞ খোঁজী এবং নিজ সঙ্গীদের নিয়ে একদিকে যাত্রা করে। আর এই খোঁজী যে সত্যিই অনুসন্ধানে অভিজ্ঞ ছিল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তার দক্ষতার যতই প্রশংসা করা হোক না কেন তা যথেষ্ট হবে না কেননা, এই ব্যক্তি একমাত্র গোয়েন্দা ছিল যে কিনা মহানবী (সা.)-এর পায়ের ছাপ অনুসরণ করে ঠিক সওর গুহার মুখ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছিল এবং বলেছিল, মুহাম্মদ (সা.)-এর পায়ের ছাপ এ পর্যন্তই এসে সমাপ্ত হয়েছে। এর সামনে আর যায় নি। আল্লামা বিলাজুরী এই খোঁজীর নাম বলেছেন আলকামা বিন কুরছ। তিনি লিখেন, মক্কা বিজয়ের সময় তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সওর গুহার মুখে তারা দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। আর দু’জন হিজরতকারী ঠিক সেই গুহায় কেবল লুকিয়েই ছিলেন না বরং তাদের কথোপকথনও শুনছিলেন। বরং হযরত আবু বকর (রা.) বর্ণনা করেন, আমি তাদের পা-ও দেখতে পাচ্ছিলাম আর আল্লাহ্র শপথ করে বলছি, তাদের কেউ একজনও যদি ভেতরে উঁকি মেরে দেখত, তাহলে আমরা ধরা পড়ে যেতাম। কিন্তু বিপদসঙ্কুল সেই সময় তাঁরা কেবল দু’জনই ছিলেন না বরং তাদের সাথে তৃতীয়জন ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ্ তা’লাÑ আকাশ ও পৃথিবী যাঁর হাতের মুঠোয় এবং যিনি সর্বশক্তিমান। তিনি নিজ অলৌকিক ক্ষমতাবলে তাদের আসার পূর্বেই সেখানে একটি চারাগাছ উদগত করে দিয়েছিলেন, মাকড়শা পাঠিয়ে গুহার মুখে একটি জাল বুনিয়ে দেন, আর এক জোড়া কবুতর প্রেরণ করেন যেন তারা সেখানে বাসা বেধে ডিম পেড়ে রাখে, রেওয়ায়েতে এটিই উল্লেখিত আছে।
যাহোক, এরপর আল্লাহ্ তা’লা মহানবী (সা.)-কে কীভাবে সান্ত¡না দেন, অথবা আল্লাহ্ তা’লার আদেশে এসব বিষয় দেখার পর কীভাবে আবু বকর (রা.)-কে তিনি সান্ত¡না দেন- আগামীতে ইনশাআল্লাহ্ এ বিষয়ে উল্লেখ করা হবে।

(সূত্র: কেন্দ্রীয় বাংলাডেস্কের তত্ত¡াবধানে অনূদিত)