জুমুআর খুতবার সারমর্ম

বুরকিনা ফাঁসোর শহীদগণ: আহমদীয়াতের উজ্জ্বল নক্ষত্র সম্পর্কে প্রদত্ত জুমুআর খুতবা ২০ জানুয়ারি ২০২৩

জুমুআর খুতবার সারমর্ম

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ২০ জানুয়ারি ২০২৩ মোতাবেক ২০ সুলাহ ১৪০২ হিজরী শামসীর জুমুআর খুতবাতাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করে বলেন,وَلَا تَقُولُوا لِمَن يُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتٌ ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ وَلَٰكِن لَّا تَشْعُرُونَ وَلَنَبْلُوَنَّكُم بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ ۗ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُم مُّصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ(সূরা আল বাকারা: ১৫৫-১৫৭) “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তোমরা তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা অনুধাবন কর না। আর আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে কতক ভয়ভীতি, ক্ষুধা. ধনসম্পদ এবং প্রাণ ও ফলফলাদির ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা পরীক্ষা করব আর ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। তাদের ওপর যখন কোনো বিপদ আপতিত হয় তখন তারা বলেন, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর আর নিশ্চয় আমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।”আল্লাহর পথে প্রাণ উৎসর্গকারী সম্পর্কে আল্লাহ তা’লার অমোঘ ঘোষণা হলো, তারা মৃত নয় বরং জীবিত। জামা’তে আহমদীয়ায় বিগত শতাধিক বছর যাবৎ আল্লাহ্ তা’লার পথে প্রাণ বিসর্জন দেয়া হচ্ছে। তাদের কুরবানী কি বৃথা গিয়েছে? না, বরং যেখানে আল্লাহ্ তা’লা নিজ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এসব শহীদের মর্যাদাকে সমুন্নত করছেন সেখানে জামা’তকে পূর্বের চেয়ে অধিক উন্নতি দান করেছেন। এসব শহীদ যেখানে পরপারে সেই মর্যাদা লাভ করেছেন যা তাদের প্রাপ্য আর তাদের মর্যাদা সর্বদা বৃদ্ধি পেতে থাকবে সেখানে এ পৃথিবীতেও চিরকালের জন্য তাদের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এছাড়া আল্লাহ্ তা’লার পথে তাদের প্রাণ উৎসর্গ করা কেবল নিজেদের জন্য নয়, বরং জামা’তের জীবন লাভেরও কারণ হচ্ছে। এটিই পরবর্তী প্রজন্মের জীবন এবং উন্নতির মাধ্যম হচ্ছে। তাহলে তারা কীভাবে মৃত হতে পারে? আহমদীয়া জামা’তে এই প্রাণের কুরবানী যা হযরত সাহেবযাদা সৈয়্যদ আব্দুল লতিফ সাহেব (রা.) শহীদের কুরবানীর মাধ্যমে আরম্ভ হয়েছে তা সাধারণত আফগানিস্তান এবং উপমহাদেশীয় আহমদীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। আফ্রিকায়ও ২০০৫ সনে কঙ্গোতে একজন নিষ্ঠাবান আহমদী কেবল জামা’তের জন্য প্রাণের অর্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন কিন্তু অতিসম্প্রতি আফ্রিকা মহাদেশের দেশ বুরকিনা ফাসোতে ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততা, নিষ্ঠা ও ঈমান এবং দৃঢ়বিশ্বাসে পরিপূর্ণ যে দৃষ্টান্ত জামা’তের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে প্রদর্শন করেছেন তা বিস্ময়কর, নিজেই নিজের উপমা। যাদেরকে (একথা বলে) সুযোগ দেয়া হয়েছে যে, “মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সত্যতা অস্বীকার করো এবং এ বিষয়টি মেনে নাও যে, ঈসা (আ.) আকাশে জীবিত আছেন আর আকাশ থেকেই অবতরণ করবেন” তাহলে আমরা তোমাদের প্রাণ ভিক্ষা দিব। কিন্তু ঈমান ও বিশ্বাসে পরিপুর্ণ এসব লোক যাদের ঈমান পাহাড়ের চেয়েও অধিক দৃঢ় মনে হয় তারা জবাব দিয়েছেন, আজ নয় তো কাল, প্রাণ তো একদিন যাবেই। তাই একে বাঁচানোর জন্য আমরা আমাদের ঈমান বিক্রি করতে পারি না। যে সত্যকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা আমরা পরিত্যাগ করতে পারি না। আর এভাবে তারা একজনের পর আরেকজন নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করতে থেকেছেন। তাদের নারী এবং শিশুরাও (লোমহর্ষক) এই দৃশ্য দেখছিল অথচ কেউ কোনো আহাজারি করে নি।অতএব এরাই সেসব লোক যারা আফ্রিকায় বরং আহমদীয়াতের ভুবনে নিজেদের কুরবানীর এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন। অর্থাৎ হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগে হযরত সাহেবযাদা আব্দুল লতীফ সাহেবের কুরবানীর পর। নিজেদের পার্থিব জীবনের কুরবানী করে চিরস্থায়ী জীবনের অধিকারী হয়ে গেছেন। যারা তাদের প্রাণ, সম্পদ ও সময় কুরবানীর যে শর্তে বয়আত করেছেন তা পূর্ণ করেছেন আর এমনভাবে পূর্ণ করেছেন যে, পরে এসেও অগ্রজদের অতিক্রম করে/পেরিয়ে গেছেন। আল্লাহ্ তা’লা তাদের প্রত্যেককে সেসব সুসংবাদের ভাগিদার করুন যেÑসব সুসংবাদ তিনি তাঁর পথে কুরবানীকারীদের জন্য দিয়েছেন।এখন সংক্ষিপ্তভাবে এসব শহীদের জীবনী বর্ণনা করব যা থেকে তাদের ঈমানের দৃঢ়তা সম্পর্কে জানা যায়। প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী বুরকিনা ফাসোর ডোরি শহর যেখানে মেহদিয়াবাদ নামে নতুন একটি জনবসতি গড়ে উঠেছে সেখানকার জামা’ত। ১১ জানুয়ারি এশার সময় ৯জন আহমদী বুযুর্গকে মসজিদ প্রাঙ্গণে অন্য নামাযীদের সামনে ইসলাম আহমদীয়াত অস্বীকার না করার কারণে এক এক করে শহীদ করা হয়, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ।রিপোর্ট অনুযায়ী এশার সময় ৪টি মোটর সাইকেলে মোট ৮জন অস্ত্রধারী ব্যক্তি মসজিদে আসে। এই অস্ত্রধারীরা আহমদীয়া মসজিদে আসার পূর্বে নিকটবর্তী ওহাবী মসজিদে অবস্থান করছিল আর সেখানে তারা মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত সময় অতিবাহিত করে, কিন্তু সেখানে তারা কারো কোনো ক্ষতি করে নি, কেননা তারা আহমদীদের উদ্দেশ্যেই এসেছিল। এই সন্ত্রাসীরা যখন আহমদীয়া মসজিদে আসে তখন মসজিদে এশার আযান হচ্ছিল। ততক্ষণে কিছু নামাযীও এসে গিয়েছিলেন এবং অন্যরাও আসছিলেন। আযান শেষ হওয়ার পর সন্ত্রাসীরা মুয়ায্যিনকে দিয়ে ঘোষণা করায় যে, বন্ধুরা দ্রুত মসজিদে চলে আসুন, কিছু লোক এসেছে তারা কথা বলবে। মানুষ একত্রিত হওয়ার পর সন্ত্রাসীরা জিজ্ঞেস করে, এখানে মসজিদের ইমাম কে? আলহাজ্ব ইব্রাহীম বিদিগা সাহেব বলেন, তিনি হলেন মসজিদের ইমাম। এরপর তারা জিজ্ঞেস করে, নায়েব ইমাম কে? উত্তরে আগ উমর আগ আব্দুর রহমান সাহেব বলেন, তিনি নায়েব ইমাম। নামাযের সময় হয়ে গেলে ইমাম ইব্রাহীম সাহেব সন্ত্রাসীদের বলেন, আমাদেরকে নামায পড়ে নিতে দাও কিন্তু তারা নামায পড়ার অনুমতি দেয় নি। অস্ত্রধারীরা ইমাম সাহেবের কাছে আহমদীয়া জামা’তের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বেশকিছু প্রশ্ন করে যার উত্তর ইমাম সাহেব অত্যন্ত ধীরেসুস্থে এবং সাহসিকতার সাথে প্রদান করেন। ইমাম সাহেব বলেন, আমরা মুসলমান আর আমরা মহানবী (সা.)-এর মান্যকারী। তারা জিজ্ঞেস করে, আপনারা কোন্ ফিরকার সাথে জড়িত? ইমাম সাহেব উত্তরে বলেন, আমরা আহমদীয়া মুসলিম জামা’তের সদস্য। অতঃপর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। তারা অর্থাৎ সন্ত্রাসীরা জিজ্ঞেস করে, আপনাদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী হযরত ঈসা (আ.) জীবিত আছেন না কি মারা গেছেন? ইমাম সাহেব বলেন, হযরত ঈসা (আ.) মৃত্যু বরণ করেছেন। যাহোক, একথা শুনে সন্ত্রাসীরা বলে, না, ঈসা (আ.) জীবিত আকাশে বিদ্যমান আর ফিরে এসে তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন এবং মুসলমানদের সমস্যাদি নিরসন করবেন। এ আশাতেই তারা বুক বেধে বসে আছে। এরপর তারা জিজ্ঞেস করে, ইমাম মাহদী কে? ইমাম সাহেব বলেন, হযরত মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (আ.) ইমাম মাহ্দী ও মসীহ্ মওউদ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। সব কথা শোনার পর অস্ত্রধারীরা বলে, আহমদীরা মুসলমান নয় বরং শক্ত কাফের। এরপর তারা ইমাম সাহেবকে মসজিদ সংলগ্ন আহমদীয়া সিলাই সেন্টারে নিয়ে যায়। সেখানে হযরত মসীহ্ মাওউদ (আ.) এবং খলীফাদের ছবি টানানো ছিল। সেসব ছবি নিয়ে তারা পুনরায় ইমাম সাহেবকে নিয়ে মসজিদে ফিরে আসে। এরপর সেসব ছবি সম্পর্কে ইমাম ইব্রাহীম সাহেবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ইমাম সাহেব হযরত আকদাস মসীহ্ মওউদ (আ.) এবং খলীফাদের নাম বলেন আর প্রতিটি ছবির পরিচয় তুলে ধরেন আর বলেন, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) ইমাম মাহ্দী ও মসীহ্ মওউদ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। একথা শুনে তারা বলে, (নাউযুবিল্লাহ্) মির্যা গোলাম আহমদ-এর নবুয়্যতের দাবি মিথ্যা। এরপর সন্ত্রাসীরা মসজিদে উপস্থিত নামাযীদের মধ্য থেকে শিশু, যুবক এবং বৃদ্ধদের পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত করে। মসজিদে তখন আবালবৃদ্ধবনিতা সবমিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। পর্দার আড়ালে ১০-১২জন লাজনা নামাযের জন্য উপস্থিত ছিলেন। বয়সের দিক থেকে দল গঠনের পর সন্ত্রাসীরা বয়োজ্যেষ্ঠদের বলে, তারা যেন মসজিদের আঙিনায় চলে আসে। তখন মোট ১০জন আনসার মসজিদে উপস্থিত ছিলেন যাদের মধ্যে একজন শারীরিকভাবে অক্ষমও ছিলেন। সেই অক্ষম ব্যক্তিও যখন অন্য আনসার ভাইদের সাথে বাহিরে যেতে উদ্যত হন তখন তাকে একথা বলে বসিয়ে দেয়া হয় যে, তুমি কোনো কাজের নও, বসে থাকো। অবশিষ্ট ৯জনকে সাথে নিয়ে তারা মসজিদের আঙিনায় চলে আসে। মসজিদের আঙিনায় দাঁড় করিয়ে তারা ইমাম ইব্রাহীম বিদিগা সাহেবকে বলে, তিনি যদি আহমদীয়াত পরিত্যাগ করেন তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। ইমাম সাহেব উত্তরে বলেন, আমার শিরোচ্ছেদ চাইলে করো কিন্তু আমি আহমদীয়াত পরিত্যাগ করতে পারব না। যে সত্য আমি পেয়ে গেছি তা থেকে পিছপা হওয়া আমার জন্য সম্ভব নয়। ঈমানের বিপরীতে জীবনের কী মূল্য আছে? সন্ত্রাসীরা তার গলায় ছুরি ধরে এবং তাকে শুইয়ে জবাই করতে উদ্যত হয়। কিন্তু ইমাম সাহেব তাচ্ছিল্যের সাথে বলেন, আমি শুয়ে মরার চেয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণ বিসর্জন দেয়া পছন্দ করব। ফলে ইমাম সাহেবকে তারা গুলি করে শহীদ করে। সর্বপ্রথম শহীদ হন ইমাম আলহাজ্ব ইব্রাহীম বিদিগা সাহেব। ইমাম সাহেবকে নৃশংসভাবে শহীদ করার পর সন্ত্রাসীরা মনে করে, বাকিরা হয়তো ভয় পেয়ে ঈমান থেকে পিছপা হবে। তাই তারা পরবর্তী আহমদী বুযুর্গকে বলে, তুমি আহমদীয়াত ছাড়বে নাকি তোমারও একই অবস্থা করব যা তোমাদের ইমামের করেছি? উত্তরে সেই বুযুর্গ অত্যন্ত সাহসিকতা ও বীরত্বেও সাথে বলেন, আহমদীয়াত ছাড়া সম্ভব নয়। যে পথে চলে আমাদের ইমাম প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন আমরাও সেই পথে চলব। তারপর তাকেও মাথায় গুলি করে শহীদ করা হয়। পরে যারা ছিলেন তাদেরকেও এক এক করে একই কথা বলা হয় যে, ইমাম মাহ্দীকে অস্বীকার করো এবং আহমদীয়াত পরিত্যাগ করো তাহলে তোমাদেরকে কিছুই বলা হবে না, জীবিত ছেড়ে দেয়া হবে। তখন উপস্থিত সকল আহমদী বুযুর্গ পর্বতসম অবিচলতা প্রদর্শন করেন এবং বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে শাহাদাতকে আলিঙ্গন করেন। কোনো একজনও সামান্যতম দুর্বলতা প্রদর্শন করেন নি আর আহমদীয়াতও পরিত্যাগ করেন নি। একের পর এক শহীদ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন কিন্তু কারো ঈমান দোদুল্যমান হয় নি। সবাই একে অপরের চেয়ে অধিক দৃঢ় ঈমান ও সাহসিকতা প্রদর্শন করেন এবং ঈমানের পতাকা উড্ডীন রেখে আল্লাহ্ তা’লার সমীপে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেন। প্রত্যেক শহীদকে কমবেশি তিনটি করে গুলি করা হয়েছে। এই ৯জন শহীদের মাঝে দুজন জমজ ভাইও ছিলেন। ৮জনকে শহীদ করা পর শেষে গিয়ে আগ উমর আগ আব্দুর রহমান সাহেব যার বয়স ছিল ৪৪ বছর তিনি বাকি ছিলেন। সকল শহীদের মধ্যে তিনি বয়সে সবার ছোট ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তাকে বলে, তুমি এখনো যুবক, আহমদীয়াত পরিত্যাগ করে নিজের জীবন বাঁচাতে পার। তখন তিনি অত্যন্ত বীরত্বের সাথে উত্তর দেন, যে পথ অবলম্বন করে আমার বুযুর্গেরা কুরবানী দিয়েছেন, যা সত্যের পথ; আমিও আমার ইমাম এবং বুযুর্গদের পদাঙ্ক অনুসরণে ঈমানের খাতিরে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি। ফলে তাকেও অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করা হয়।হযরত সাহেবযাদা আব্দুল লতীফ শহীদ সাহেবের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) তায্কেরাতুশ্ শাহাদাতাইন পুস্তকের শেষের দিকে একটি স্বপ্নের উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি (আ.) স্বপ্নের উল্লেখ করে লিখেন, ‘খোদা তা’লা তার স্থলাভিষিক্ত অনেক লোককে সৃষ্টি করবেন।’ তিনি তাঁর স্বপ্নের এ ব্যাখ্যা করেছেন যে, আমি আশাকরি সাহেবযাদা সাহেবের শাহাদাতের পর আল্লাহ্ তা’লা তার স্থলাভিষিক্ত অনেক লোককে সৃষ্টি করবেন। আমরা সাক্ষী, আজ আফ্রিকার অধিবাসীরা সম্মিলিতভাবে এর দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করেছেন আর ‘স্থলাভিষিক্ত’ হওয়ার দাবি পূরণ করেছেন।জঙ্গীদের মসজিদে আসা থেকে আরম্ভ করে প্রশ্নোত্তর করা, বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা এবং পুরো কার্য সমাধা করে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সময়ের হিসাব প্রায় দেড় ঘন্টা হয়। এই সময়ে শিশুকিশোর এবং অন্য সদস্যরা যে যন্ত্রণা ও কষ্টে পার করেছে তা সহজেই অনুমেয়। (কেননা) তাদের (চোখের) সামনে তাদের জ্যেষ্ঠদের শহীদ করা হচ্ছিল। মসজিদ থেকে বেরিয়ে জঙ্গীরা তৎক্ষণাৎ পালিয়ে যায় নি বরং দীর্ঘক্ষণ মেহদিয়াবাদই অবস্থান করে। সশস্ত্র জঙ্গীরা মসজিদে উপস্থিত লোকদের এই হুমকিও দেয় যে, তোমরা আহমদীয়াত পরিত্যাগ করো এতেই তোমাদের মঙ্গল নিহিত। আমরা আবারো আসব। তোমরা যদি আহমদীয়াত পরিত্যাগ না করো অথবা কেউ পুনরায় মসজিদ খোলার চেষ্টা করে তাহলে তোমাদের সবাইকে হত্যা করা হবে।এই মেহদিয়াবাদ জামা’তের গোড়াপত্তন কবে হয়েছিল এবং এর পরিচিতি কী? এ সম্পর্কে তারা লিখেছে, ১৯৯৮ সালের শেষদিকে এখানে রীতিমতো মিশন আরম্ভ করা হয়েছিল। জামা’ত দ্রুত উন্নতি করে। ১৯৯৯ সালে একটি গ্রাম তিকনেওয়েলের সংখ্যাগরিষ্ঠ (মানুষ) আহমদী হয়ে যায় এবং একটি নিষ্ঠাবান জামা’ত এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গ্রামের ইমাম আলহাজ্ব ইব্রাহীম বিদিগা সাহেব আহমদীয়াত গ্রহণ করার পূর্বে অত্রাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ওহাবী ইমাম ছিলেন। তিনি অনেক গবেষণা করার পর বয়আত করেছিলেন। বয়আত করার পর একজন উদ্যমী দাঈ বা প্রচারক, একজন নির্ভীক মুবাল্লেগ এবং বীর সৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আমি পূর্বে উল্লেখ করি নি, তিনি আরো বলেছেন, তিনি যখন বয়আত করেন তখন তার সঙ্গী কয়েকজন আলেম তাকে বলেন, তুমি কেন (আহমদীয়াত) গ্রহণ করছ? তিনি উত্তরে বলেন, আমি যখন স্বর্ণ দেখেছি এবং আল্লাহ্ তা’লা একে (গ্রহণ করার) নির্দেশও দিয়ে রেখেছেন, মহানবী (সা.)-এর হাদীস পূর্ণ হচ্ছে, কথাও পূর্ণ হচ্ছে, পবিত্র কুরআন এর সাক্ষ্য দিচ্ছে, তাই এখন আমি এটি অস্বীকার করব আর (এ থেকে) বঞ্চিত থাকব তা কীভাবে সম্ভব! যাহোক, ইমাম সাহেব অনেক একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। এই গ্রামের সব মানুষ তামাশিক গোত্রের সদস্য এবং তামাশিক ভাষায় কথা বলে। তামাশিক লোকদের সংখ্যা দুই লক্ষের কাছাকাছি বলা হয়ে থাকে। এরা বুরকিনা ফাসো, নাইজার, মালি এবং আলজেরিয়াতে বসবাস করে। (এদের) ৯৯.৯% মুসলমান। এদের অধিকাংশই কট্টর ওহাবী বিশ্বাস পোষণ করে। তামাশিক লোকদের মাঝে আহমদীদের সংখ্যা খুব বেশি নেই, তবে বুরকিনা ফাসোতে মেহদিয়াবাদের তামাশিক বাসিন্দারা হযরত আকদাস মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বয়আত করার ক্ষেত্রে এগিয়ে যায়। আর এখন এত বড় কুরবানী দিয়ে নিজেরা একটি বিশেষ মর্যাদাও অর্জন করে নিয়েছে। ২০০৪ সালে অত্রাঞ্চলে স্বর্ণের অনেক বড় বড় খনি আবিষ্কৃত হলে মাইনিং কোম্পানী এই গ্রামের বাসীন্দাদের নিকটস্থ একটি নতুন স্থানে ঘরবাড়ি বানিয়ে দিয়ে বলেছে, সেখানে স্থানান্তরিত হয়ে যান। এসব স্থানান্তরিত লোকের একটি বড় অংশ ছিল আহমদী। অল্প কয়েকটি পরিবার ছিল অন্যদের। নতুন গ্রাম বানানো হয়েছিল যা (বলতে গেলে) প্রায় আহমদীদেরই গ্রাম ছিল। ইব্রাহীম সাহেব প্রস্তাব দেন, এই গ্রামের নাম পুরোনোটা আর রাখব না। তিনি আমাকে লিখেন, আপনি (আমাদের) এই গ্রামের একটি নাম রেখে দিন। এরপর এর নাম মেহদিয়াবাদ রাখা হয়। ২০০৮ সালে এখানে ওঅঅঅঊ (ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অংংড়পরধঃরড়হ ড়ভ অযসধফর অৎপযরঃবপঃং ্ ঊহমরহববৎং) এর অধীনে মডেল ভিলেজ বা আদর্শ গ্রাম নির্মাণ করা হয়। পানি, বিদ্যুতের সুবিধা প্রদান করা হয়। এটি বুরকিনা ফাসো বরং সমগ্র বিশ্বের প্রথম মডেল ভিলেজ প্রজেক্ট ছিল। এর অধীনে গ্রামে বিদ্যুৎ, পানি, সেলাই স্কুল ইত্যাদির সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।শহীদদের দাফনের ব্যাপারে তারা তাদের প্রতিবেদনে লিখেছে, জঙ্গীরা মসজিদে দেড় ঘন্টা অতিবাহিত করে এমন ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যে, যে স্থানে শাহাদাত হয়েছিল সেখানেই শহীদদের লাশগুলো সারারাত পড়ে ছিল। কেননা আশঙ্কা ছিল জঙ্গীরা (এখনো) গ্রামের বাইরে যায় নি আর যদি কেউ লাশ উঠানোর চেষ্টা করে তাহলে তাকেও মেরে ফেলা হবে। নিকটেই সেনা ক্যাম্প ছিল। এই ঘটনার সংবাদ তাদেরকে দেয়া হয় কিন্তু সেখান থেকেও কেউ আসে নি আর সকাল পর্যন্ত নিরাপত্তা বিভাগের কোনো সদস্যও পৌঁছে নি। এরপর ১২ জানুয়ারি সকাল ১০টায় মেহদিয়াবাদে শহীদদের সমাহিত করা হয়।এখন আমি তাদের প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি বর্ণনা করছি। আলহাজ্ব ইব্রাহীম বিদিগা সাহেব, যিনি ইমাম ছিলেন, যার উল্লেখ পূর্বেই করা হয়েছে, শাহাদত বরণের সময় তার বয়স ছিল ৬৮ বছর। শিক্ষার্জনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবেও অবস্থান করেছেন। তামাশিক ভাষার অনেক বড় আলেম ছিলেন এবং এই ভাষায় পবিত্র কুরআনের তফসীরকারকও ছিলেন। তিনি ১৯৯৯ সালে বয়আত করেন। আহমদীয়াত গ্রহণের পূর্বে ইমাম ইব্রাহীম বিদিগা সাহেব অনেকগুলো গ্রামের প্রধান ইমাম ছিলেন। এই অঞ্চলের বিভিন্ন আলেম তার পাশে এসে বসা এবং জ্ঞানার্জন করাকে নিজেদের জন্য সম্মানের কারণ মনে করত। অতএব প্রত্যেক বছর কমপক্ষে একবার অত্রাঞ্চলের আলেম-ওলামা, মুয়াল্লেমীন এবং ইমামেরা তার নিকট এসে অবস্থান করে কল্যাণমণ্ডিত হতেন। এদের সংখ্যা ৫০০ পর্যন্ত পৌঁছে যেত এবং এক সপ্তাহ পর্যন্ত অবস্থান করতেন। বলা যায়, অত্রাঞ্চলের আলেম-ওলামা ও ইমামদের বার্ষিক সভা তার বাড়িতেই হতো। তার একজন শিষ্য বর্ণনা করেন, সেই দিনগুলোতেও ইমাম সাহেব প্রায়শই একথা বলতেন যে, এখনো সত্য প্রকাশিত হয় নি; কেননা সত্যের মান্যকারীরা স্বল্প হয়ে থাকে। যেভাবে শত শত সংখ্যায় এই ইমামরা আমার নিকট এসে বসে এবং বাহ্যত একে অপরকে মুসলমান জ্ঞান করে, কিন্তু যখন সত্য প্রকাশিত হবে তখন মান্যকারীর সংখ্যা স্বল্প হবে, (তখন) এরাও আমার কাছ থেকে উঠে চলে যাবে। পুণ্য ছিল, তাকওয়া ছিল, জ্ঞান ছিল, তাই যুগের নিরিখে ধারণা করে নিয়েছিলেন যে, সত্য প্রকাশিত হবে এবং এরপর যেভাবে সর্বদা নবীদের বিরোধীদের রীতি রয়েছে (সে অনুসারে) এরাও বিরোধিতা করবে। যাহোক তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন, সত্য এলেই আমি মেনে নিব। ১৯৯৮ সালে ডোরিতে রীতিমত আহমদীয়া মিশন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন ইমাম ইব্রাহীম সাহেবের নিকটও এর সংবাদ, অর্থাৎ আহমদীয়াতের বাণী পৌঁছে। তবলীগি কার্যক্রমের সময় একটি বাজারে আলহাজ¦ বিদিগা সাহেব প্রথম আহমদীয়াতের নাম শুনেছিলেন। তিনি জানতে পারেন, আহমদীরা ঈসা (আ.)-এর মৃত্যুতে বিশ্বাসী এবং মসীহ্ ও মাহ্দীর আগমনের সংবাদ প্রদান করে থাকে। তখন ইব্রাহীম বিদিগা সাহেব সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে সত্যের সন্ধানে ডোরি মিশন হাউজে আসেন। অনেক গবেষণার পর তিনি আহমদীয়াত গ্রহণ করেছিলেন। নিজ অঞ্চলে প্রথম আহমদী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। এই যে বিরুদ্ধবাদীরা বলে থাকে, এরা দরিদ্র মানুষ, (অর্থের) প্রলোভন দেখিয়ে তাদের বয়আত করায়, তারা ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানে না, এই শহীদরা তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। ভালোভাবে বুঝে আহমদীয়াত গ্রহণ করেছেন এবং পরবর্তীতে কুরবানীরও উন্নত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যাহোক, ইব্রাহীম সাহেব সম্পর্কে আরো লিখেছেন, পূর্বেও বর্ণনা করা হয়েছে যে, জামা’তের একজন নির্ভীক সৈনিক ছিলেন। সাহসী দাঈ ইলাল্লাহ্ ছিলেন আর সত্যিকার অর্থেই একজন নিবেদিতপ্রাণ আহমদী ছিলেন। তার তবলীগি চেষ্টা-প্রচেষ্টায় গোটা অঞ্চলে আহমদীয়াতের বাণী ছড়িয়ে পড়ে। অনেকগুলো জামা’ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি সর্বাগ্রে বিভিন্ন জামা’তী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। আহমদীয়াত গ্রহণের পূর্বে তার বিশ্বাস অনুযায়ী ওহাবী ছাড়া অন্য সকল ফির্কাই কাফের ছিল। টিভি দেখা, ফুটবল খেলা বা দেখা, স্কুলে যাওয়া, চিত্রাঙ্কন করা এসব কাজই তার মতে হারাম ছিল, যেমনটি ওহাবীদের ধর্মবিশ্বাস। কিন্তু এরপর তিনি যখন আহমদীয়াত গ্রহণ করেন তখন এসব অহেতুক ধ্যানধারণা হতে নিজেকে মুক্ত করেন এবং লোকদেরও বুঝান যে, প্রকৃত সত্য কী। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর যুগে ২০০০ সালে এখানে যুক্তরাজ্যের জলসায় অংশগ্রহণেরও তিনি সৌভাগ্য লাভ করেন। তবলীগ করার ক্ষেত্রে তার উন্মাদনা ছিল। আহমদীয়াত গ্রহণের পূর্বেও (একজন) প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন এবং অনেকগুলো গ্রামের প্রধান ইমাম ছিলেন, যেমনটি আগেই বলা হয়েছে। (আর) আহমদীয়াত গ্রহণের পর নিজেকে তিনি তবলীগের জন্য উৎসর্গ করে দেন। এমন মনে হতো যেন তার অন্য কোনো কিছুর পরোয়াই নেই। তিনি তবলীগের হোয়াটসএ্যাপ গ্রæপ বানিয়ে রেখেছিলেন যাতে বিশেষত তামাশিখ লোকদের জন্য একটি গ্রুপ ছিল। এই গ্রুপে মালি, নাইজার, ঘানা, সৌদি আরব, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আইভরি কোস্ট ইত্যাদি দেশ থেকে মানুষ যোগ দিত। অনবরত তাদেরকে তবলীগ করতেন। দিনরাত অডিও বার্তা রেকর্ড করে প্রেরণ করতে থাকতেন। দিন হোক বা রাত, এই কাজেই মগ্ন থাকতেন। উত্তরে বিরোধীরা তাকে গালিগালাজের বার্তাও পাঠাত। সেখানেও বিরোধিতা হতো। তাকে হত্যার হুমকিও দেয়া হতো। কিন্তু তিনি কখানো কারো সাথে রেগে কথা বলতেন না। বরং যারা হত্যার হুমকি দিত তাদেরকে তিনি বলতেন, আমি তোমাকে (যাতায়াতের) ভাড়া পাঠাচ্ছি, এসে আমাকে হত্যা করে যাও। মুবাল্লেগ এবং মুয়াল্লেমদেরও তিনি বলতেন, তবলীগ করা উচিত। পরিস্থিতি ভালো নয়, তাই আমরা তবলীগি সফরে যেতে পারব না এটি একটি অজুহাত মাত্র। অর্থাৎ যখন পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে (তখন)। তিনি বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে তবলীগ করুন। আর যদি কারো কাছে ফোনে ইন্টারনেট প্যাকেজ নেয়ার মতো অর্থ না থাকে তাহলে আমার কাছ থেকে নিয়ে নিন আর সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ বানিয়ে ঘরে বসে তবলীগের জিহাদে অংশ গ্রহণ করুন। এক প্রকার উন্মাদনা এবং এক বিশেষ আগ্রহ ছিল তার। নাসের সিদ্ধু সাহেব এখানে মুরব্বী ছিলেন, তিনি বলেন, ১৯৯৭ সনে বুরকিনা ফাসো এসেছি। খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.) দাওয়াত ইলাল্লাহ্র কাজের দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি বলেন, আমি ভাষা জানতাম না, তাই পরিকল্পনা প্রণয়নে তিন মাস সময় লেগে যায়। এরপর বিভিন্ন গ্রামে সফর করি। তাদের কাছে এই গ্রামের ইমামের কাছেও যাই। তিনি যখন এই সংবাদ পান যে, অর্থাৎ ঈসা (আ.)-এর মৃত্যু এবং মসীহ্ ও মাহদীর আগমনের সংবাদ, তখন ইব্রাহীম বিদিগা সাহেব ৭জন লোক সাথে নিয়ে ডোরিতে আমাদের মিশন হাউজে আসেন। সেখানে প্রশ্নোত্তর হয়। তিনি বলেন, তিন দিন তিনি আমার কাছে অবস্থান করেন। এই তিন দিন তিনি নিজেও ঘুমান নি আর আমাকেও ঘুমাতে দেন নি। এরপর তারা চলে যান। প্রতিদিন সকাল থেকে নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত আলোচনা হতো। পরের সপ্তাহে তিনি পুনরায় আসেন এবং তাদের নতুন ইমামকে নিয়ে আসেন আর অনুসন্ধানের এই ধারা তিন মাস পর্যন্ত চলমান থাকে। তার কাছে অধিকাংশ প্রশ্নের উত্তর চলে এসেছিল কিন্তু আহমদীয়াত গ্রহণের কথা তিনি কখনো বলেন নি। তিনি বলেন, যাহোক আমি খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-কে দোয়ার জন্য (পত্র) লিখতে থাকি। একদিন ইমাম সাহেব আসেন আর বয়আতের ফরম পূরণ করে দেন। তিনি বলেন, আমি তাকে বলি, বাকি যারা (এতদিন) নিয়মিত এসেছেন তারা কোথায়? তারা কখন (আহমদীয়াত) গ্রহণ করবে? তখন তিনি বলেন, তারা সবাই গ্রহণ করবে কিন্তু সর্বপ্রথম আমি আহমদীয়াত গ্রহণ করতে চাচ্ছিলাম, তাই আমি চলে এসেছি। খিলাফতের প্রতিও তিনি গভীর নিষ্ঠাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন। বুরকিনা ফাসো জামা’তের আমীর সাহেব লিখেন, ৪৫টির মতো গ্রাম তার প্রভাবাধীন ছিল। তিনি হজ করেছেন। সেখানে থেকে শিক্ষা অর্জন করেছেন। খুব ভালো আরবী জানতেন এবং বলতে পারতেন আর এই পুরো অঞ্চলে অনেক তবলীগ করেছেন। সাইকেলে করে গ্রামে গ্রামে যেতেন আর আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় অত্র অঞ্চলে বহু মানুষকে আহমদীয়াতের নূরে নূরান্বিত করেছেন। তার মাধ্যমে এই এলাকার বড় বড় আলেম আহমদীয়াত গ্রহণ করেছে আর (এই) এলাকার অধিকাংশ জামা’ত তার তবলীগের কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যখনই লন্ডন আসা হতো তখন সর্বদা জিজ্ঞেস করতেন, যুগ খলীফা কেমন আছেন? খুবই ভালোবাসা প্রকাশ করতেন। তিনি বলেন, এই ভালোবাসার একটি উদাহরণ হলো, এমটিএ-তে শিশুদের সাথে আমার যে ক্লাস হতো, উর্দু ভাষার কিছুই না জানা সত্ত্বেও অতন্ত নিমগ্নচিত্তে তা দেখতে থাকতেন যেন বুঝতে পারছেন। এছাড়া কেবল একথাই বলতেন যে, আমার জন্য এখানে এই সভায় বসে এ অনুষ্ঠান দেখাই আমার ঈমানে অনেক উন্নতির কারণ হয়। অতিথিপরায়ণ ও নীরব প্রকৃতির (মানুষ) ছিলেন, কিন্তু জামা’তের প্রয়োজনে কিছু বলার প্রয়োজন হলে খুবই আবেগের সাথে কথা বলতেন। একজন পুরোদস্তুর মুবাল্লেগ ছিলেন। অÑআহমদীদের সাথে ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে তিনি অনেক ধর্মীয় বিতর্ক ও প্রশ্নোত্তর করেছেন। অতঃপর সেখানকার আরেকজন মুরব্বী মুহিবুল্লাহ্ সাহেব বলেন, এসব বুযুর্গকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম, কেননা সেখানে আমি প্রায়শ যাতায়াত করতাম। তারা খিলাফতের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা পোষণকারী, অতিথিপরায়ণ ও বিশ্বস্ত লোক ছিলেন। তিনি বলেন, সব যুবকেরা যখন সারা দিন কাজে ব্যস্ত থাকত তখন এই বুযুর্গেরা মসজিদের সামনে ছাউনি দেওয়া জায়গায় বসে এমটিএ দেখতেন। তিনি বলেন, তারা শহীদ হওয়ার অব্যবহিত পর আমার নিকট এক যুবকের ফোন আসে যে, এভাবে আমাদের বুযুর্গদের শহীদ করা হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছিল যদি আপনারা আহমদীয়াত পরিত্যাগ করেন তাহলে আমরা আপনাদের ছেড়ে দিব, কিন্তু তারা শাহাদাত বরণকেই প্রাধান্য দেন, এই যুবক একথাই বলেছে। এই যুবকের ভাষ্য ছিল, এরা যদি আমাদের সবাইকে শহীদ করে তবুও আমরা আহমদীয়াত পরিত্যাগ করব না। এই যুবক ছেলেটি বলে, এখানে তো কেবল ৯জন আনসার ছিলেন, যদি আমাদের সব খোদ্দাম এবং লাজনাদেরকেও শহীদ করে তবুও আমরা আহমদীয়াত ছাড়ব না, ইনশাআল্লাহ্। এটি হলো এই জামা’তের উক্ত নিষ্ঠাবান সদস্যদের প্রেরণা যা তারা (নিজেদের মাঝে) সৃষ্টি করেছেন। যখন বড়দের তরবিয়ত থাকে, তাদের দৃষ্টান্ত থাকে তখনই যুবক ও নারীদের মাঝে এরূপ প্রেরণা ও ঈমান সৃষ্টি হয়। স্থানীয় মুবাল্লেগ মায়েগা তেজান সাহেব বলেন, ইমাম ইব্রাহীম সাহেবকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল। শাহাদাতের কিছুদিন পূর্বে তিনি আমাকে বলেন, আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে, এরা আমাকে মেরে ফেলবে। তার উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে তিনি বলেন, নিজ পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনের সাথে খুবই উত্তম আচরণ করতেন। সবার সাথে সহানুভ‚তি প্রদর্শন করা তার অভ্যাস ছিল। অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা এবং ত্যাগের স্পৃহা দেখানো তার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। নিজ এলাকার অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মানুষ তাকে খুবই শ্রদ্ধা করত। ইব্রাহীম সাহেব কোনো সিদ্ধান্ত দিলে অথবা কোনো কথা বললে মানুষ সেটির সম্মান করত এবং তা মেনে নিত। তার শিষ্যের সংখ্যা অনেক। তাদের মধ্যে থেকে কতক অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে ইমাম ও মুয়াল্লেম হিসেবে কাজ করছে। বুরকিনা ফাসোতেও অনেকেই মুয়াল্লেম এবং স্থানীয় মিশনারী হিসেবে কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, পুণ্য, তাকওয়া এবং সৎকর্মে অগ্রগামী থাকার ক্ষেত্রে অন্যদের জন্য আদর্শ ছিলেন। যখনই জামা’তের সদস্যদের জন্য কোনো তাহরীক করতেন তখন সর্বপ্রথম নিজে তাতে অংশগ্রহণ করতেন। আর্থিক কুরবানীর কোনো তাহরীক হলে সবার আগে নিজে (তাতে) অংশ নিতেন। জামা’তের বিভিন্ন কাজ, জলসা, ইজতেমা এবং অন্যান্য প্রোগ্রামে (অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে) কখনো পিছিয়ে থাকেন নি। পাঁচ বেলার নামাযই তিনি মসজিদে এসে পড়তেন। তাহাজ্জুদ নামাযে অভ্যস্ত ছিলেন। কখনো কোনো জামা’তী অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলে এর অর্থ হচ্ছে হয় তিনি অসুস্থ নতুবা সফরে আছেন। জামা’তী কাজে অংশগ্রহণের জন্য কখনোই তিনি খরচের পরোয়া করতেন না। তিনি দুটি বিয়ে করেছিলেন, যাদের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’লা তাকে ১১জন সন্তান দান করেছেন। মুরব্বী খালেদ মাহমুদ সাহেব লিখেন, তারা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ ছিলেন। খিলাফতের প্রেমিক এবং নিবেদিতপ্রাণ আহমদী ছিলেন। তিনি বলেন, ২০০৮ সনে যখন আমার সফর হয়েছিল, খিলাফত শতবার্ষিকীর বছর ছিল, আমি ঘানায় সফরে গিয়েছিলাম এবং জলসায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখন বুরকিনা ফাসো, মালি প্রভৃতি দেশ থেকেও হাজার হাজার আহমদী আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। এই উপলক্ষ্যে ঘানা জামা’ত আতিথেয়তা ও আবাসনের ভালো ব্যবস্থাই করেছিল কিন্তু তা সত্তে¡ও ডোরি থেকে আগমনকারী কিছু লোক যাদের মাঝে এরাও (অর্থাৎ শাহাদত বরণকারীরাও) অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাদের খাবার পেতে বিলম্ব হয় অথবা তারা খাবার পান নি। এরপর রাতে অনেক দেরীতে বাজার থেকে (খাবার) এনে তাদের দেয়া হয়। এতে আমি সেই মুরব্বী সাহেবকে যার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল বলেছিলাম, তাদের কাছে আমার পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন এবং তাদের মনস্তুষ্টি করবেন। তিনি বলেন, তাৎক্ষণাৎ আমি তাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি। অথবা আপনার বার্তা যখন তাদের কাছে পৌঁছে দিই তখন জামা’তের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলহাজ¦ ইব্রাহীম সাহেব । একই সময়ে তিনি বাকি লোকদের সাথে বলেন, আমরা এখানে এসেছিলাম যুগ খলীফাকে দেখতে এবং তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে। তাই তাঁকে দেখে এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতের পরই আমাদের ক্লান্তি ও ক্ষুধা দূর হয়ে গেছে, আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। বরং আমরা তো একত্রে বসে এই সাক্ষাৎ নিয়েই কথা বলছি এবং এর স্বাদ উপভোগ করছি। যাহোক, তখন আমারও চিন্তা ছিল যে, এত দীর্ঘ সফর করে এসেছেন, অনেকে তখন সাইকেলে করেও এসেছিলেন আর তাদের ব্যবস্থা হয় নি। তাই দ্রæত ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অপরদিকে তাদের নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততা এরূপ ছিল যে, আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তখনও আমি তাদের এ সংবাদই পেয়েছিলাম আর তখনও আমি বিস্মিত ছিলাম যে, এরা কেমন দৃঢ় ঈমানের মানুষ! মুয়াল্লেম আলহাজ্ব মাহমুদ ডিকো সাহেব বলেন, শরীফ ওদে সাহেব বেনিন সফরে আসেন। তখন ইমাম সাহেব বুরকিনা ফাসো থেকে বাসে করে রাতের বেলা এক হাজার কিলোমিটার সফর করে ভোর ৩টায় সেখানে পৌঁছেন। ৩০ ঘন্টার ক্লান্তিকর সফর ছিল, সেখানকার রাস্তাও ভালো না, তথাপি তিনি বেশ উৎফুল্ল ছিলেন। পরে আরো দীর্ঘ সফর করার ছিল, সেটিও তিনি তাদের সাথে করেছেন এবং সব প্রোগ্রামেও অংশগ্রহণ করেছেন। তার মাঝে জামা’তের সেবা করার এক উদ্দীপনা ছিল। বেনিনে বিভিন্ন মসজিদ দেখে খুব খুশি হতেন এবং বলতেন, দেখো! এটিও তো হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সত্যতার একটি প্রমাণ। অনুরূপভাবে অÑআহমদীদের সাথে যে বিতর্ক হতো সেখানে তিনি আরবীতে খুবই জ্ঞানগর্ভ ও প্রাঞ্জল বক্তৃতা করতেন। শরীফ ওদে সাহেবের সাথেও মৌলবীদের বিতর্ক হচ্ছিল। তখন তারা কোনো বাজে কথা বলে বসলে তিনি রাগ করে উত্তর দিতে উদ্যত হন কিন্তু তাকে চুপ করতে বললে সাথে সাথেই তিনি বসে পড়েন। এরপর অ-আহমদীরা বলে, তোমরা যদি আমাদেরকে মুসলমানই মনে করো তবে আমাদের পেছনে নামায পড়ো। তখন তিনি দাঁড়িয়ে বলেন, যারা আমাদেরকে কাফের বলে এবং যুগ ইমামকে গ্রহণ করে না এটি কীভাবে সম্ভব যে, আমরা তাদের পিছনে নামায পড়ব। তাহলে এটি মেনে নাও যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) যুগ ইমাম তবে আমরা নামায পড়ব।বেনিনের একজন অবসরপ্রাপ্ত স্থানীয় মুয়াল্লেম বলেন, তিনি যুগ খলীফার প্রতি ভালোবাসার এক বাস্তব চিত্র ছিলেন। তিনি বলতেন, আমি যখন পাকিস্তানি মুবাল্লেগের কাছ থেকে আহমদীয়াতের সংবাদ পেয়েছিলাম সেদিন থেকেই আহমদী হয়ে গিয়েছি। আমি এটি শিখেছি যে, জগদ্বাসীর কল্যাণ শুধুমাত্র খিলাফত ব্যবস্থার সাথেই সম্পৃক্ত এবং এটিই প্রকৃত পথ আর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি এর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকব। মুয়াল্লেম সাহেব বলেন, তিনি যা বলেছিলেন তা সত্যিকার অর্থেই করে দেখিয়েছেন। এরপর বেনিনের স্থানীয় মুয়াল্লেম ঈসা সাহেব বলেন, তাঁর সাথে আমার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ছিল। তিনি এমন একজন আহমদী ছিলেন যার সাথে কারোই কোনো বিরোধ ছিল না। তিনি সত্যিকার আহমদী ছিলেন, এরূপ আহমদী যিনি সকল পুণ্যকর্মে অগ্রগামী ছিলেন। তবলীগ করা, চাঁদা দেয়া সর্বক্ষেত্রে প্রথম (সারিতে) ছিলেন। তাঁর কারণেই বাকি ৮জন আনসারও তাঁর পিছনে লাব্বাইক বলে খোদার সমীপে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গকারী হয়ে গিয়েছেন। বুরকিনা ফাসোর জামেয়ার প্রিন্সিপাল সাহেব লিখেন, কোনো ব্যক্তি একটি স্বপ্ন দেখে। এতে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহ.) জামা’তের আমীর সাহেবকে একথা লিখে পাঠান যে, এটি একটি শুভ স্বপ্ন আর এর অর্থ হলো, দেশের মাটি সত্য গ্রহণের জন্য ঊর্বর আর আমার সফরের পর ইনশাআল্লাহ্ সত্য গ্রহণ করে (মানুষ) নূরে নূরান্বিত হয়ে উঠবে। আল্লাহ্ করুন, এমনই যেন হয়। আমার জানা মতে, (পরে) সেখানে আর খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর সফর হয় নি। আমি সেখানে ২০০৪ সালে সফরে গিয়েছিলাম। তিনি বলেন, এরপর আপনিও লিখেছিলেন যে, আমার পূর্ণ বিশ্বাস বুরকিনা ফাসোর মাটিতে আহমদীয়াতের যে বীজ বপন করা হয়েছে তা অতি দ্রুত স্থায়ী ফল দিবে। বুরকিনা ফাসোর মানুষ আসলেই অনেক বড় মাপের মানুষ আর আমি আনন্দিত এই কারণে যে, খোদা তা’লা তাদেরকে আহমদীয়াতের নূরে নূরান্বিত করেছেন। আমি বুরকিনা ফাসো জামা’তের সদস্যদের মাঝে যে জাগরণ দেখেছি তা ছিল অবাক করার মত। আমি আশা রাখি, আগামী দুই-তিন বছরে এই সফরের সুমহান ফল প্রকাশ পাবে আর জামা’ত দ্রুত উন্নতি করবে ইনশাআল্লাহ্। আমি আমার সফরের পর তাদেরকে এটি লিখেছিলাম। আফ্রিকার জামা’তগুলোর মধ্যে বুরকিনা ফাসোর আহমদীদের মাঝে আমি এক বিশেষ গুণ লক্ষ্য করেছি আর তা হলো, সাক্ষাতের সময় সবাই আমার সাথে কোলাকুলি করার চেষ্টা করত। এছাড়া তাদের ভালোবাসার যে বহিঃপ্রকাশ তা-ও দেখার মতো ছিল। প্রিন্সিপাল সাহেব লিখেন, আজ মেহদিয়াবাদের নিষ্ঠাবান আহমদীরা তাদের অসাধারণ কুরবানী প্রদানের মাধ্যমে আপনার লেখা “সত্যিই অনেক বড় মাপের মানুষ” এই বাক্যের ওপর সত্যায়নকারী মোহর লাগিয়ে দিয়েছে।দ্বিতীয়জন হলেন আল হাসান আগমালি আয়েল সাহেব। শাহাদাতের সময় তাঁর বয়স ছিল ৭১ বছর। পেশার দিক থেকে তিনি কৃষক ছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। গ্রামের প্রারম্ভিক আহমদীদের মাঝে তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইব্রাহীম সাহেবের সাথে ডোরি মিশনে যাওয়া অনুসন্ধিৎসু দলে তিনিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বয়আত করার পর থেকেই নিষ্ঠা এবং বিশ্বস্ততায় উন্নতি করতে থেকেছেন। খিলাফতের সাথে খুব নিষ্ঠাপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন। বাজামা’ত নামায আদায়কারী, তাহাজ্জুদগুযার, চাঁদায় নিয়মিত (ছিলেন এবং) নিজ পরিবারের জন্য পশ্চাতে এক উত্তম আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সার্বিকভাবে তিনি যে জামা’তের জন্য প্রাণ, সম্পদ এবং সময়ের কুরবানী করেছেন তা ছিল অসাধারণ। তিনি বুরকিনা ফাসোর স্থানীয় ৪/৫টি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। এর ফলে পুরো দেশের জামা’তগুলোতেই তাঁর বন্ধু-বান্ধব ছিল। ভাষা জানার কারণে জলসা সালানায় অন্যান্য প্রদেশ থেকে আসা লোকদের সাথে একদম মিশে যেতেন। লোকেরা তাঁকে খুব পছন্দ করত, তাঁর বৈঠকে বসে সবাই আনন্দ পেত। জামা’তের পক্ষ থেকে যখনই কোনো তাহরীক করা হতো তাতে তিনিই সর্বাগ্রে অংশগ্রহণ করতেন। বিগত বছর জামা’তের পক্ষ থেকে ওয়াকফে আরযী করার তাহরীক হয়। তখন মেহদিয়াবাদ জামা’ত থেকে তিনি সর্বপ্রথম নাম লিখান। মেহদিয়াবাদের এই মর্মান্তিক ঘটনায় তাঁর জমজ ভাই জনাব হুসাঈন আগমালি আয়েল সাহেবও শাহাদাত বরণ করেন।হুসাঈন আগমালি আয়েল সাহেব যিনি তাঁর (তথা আল হাসান আগমালি আয়েল সাহেবের) জমজ ভাই। যেভাবে বলা হয়েছে যে, জামজ ভাই; (তাই) তাঁর বয়সও ৭১ বছর ছিল। তিনিও ১৯৯৯ সালে বয়আত করার সৌভাগ্য লাভ করেন। এভাবে তিনিও নিজ গ্রামের প্রারম্ভিক আহমদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আলহাজ¦ ইব্রাহীম সাহেবের সাথে ডোরি মিশন হাউজে গিয়ে অনুসন্ধানকারী দলে তিনি অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইদানিং তিনি মেহদিয়াবাদে আনসারুল্লার যয়ীম হিসেবে দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য পাচ্ছিলেন। আনসার ভাইদের তিনি উত্তমরূপে সুসংগঠিত করার যোগ্যতা রাখতেন। তাদেরকে জামা’তের বিভিন্ন প্রোগ্রাম এবং কাজে সক্রিয় রাখতেন আর তরবিয়তের জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রামের আয়োজন করাতেন। মসজিদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং অন্যান্য জায়গায় ওয়াকারে আমল বা স্বেচ্ছাশ্রম করাতেন। বিভিন্ন চাঁদা নিয়মিত প্রদান করা এবং পাঁচ বেলার নামায মসজিদে গিয়ে পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন। এছাড়া নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন। মেহদিয়াবাদের মর্মান্তিক ঘটনায় তাঁর জমজ ভাইও শহীদ হয়েছেন; পূর্বেও এর উল্লেখ হয়েছে। একই দিন পৃথিবীতে এসেছেন আর একই দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।হামিদু আগ আব্দুর রহমান সাহেব, (মৃত্যুকালে) তাঁর বয়স ছিল ৬৭ বছর। পেশায় তিনিও একজন কৃষক ছিলেন। তিনিও ১৯৯৯ সালে আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। অত্যন্ত পরিষ্কার হৃদয়ের অধিকারী এবং সহিষ্ণু মানুষ ছিলেন। সর্বদা জামা’তী অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে থাকতেন। কোনো অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলে মনে করা হতো যে, হয় একান্ত অপারগতা রয়েছে নয়তো তিনি অসুস্থ আছেন অন্যথায় তিনি অনুপস্থিত থাকতেন না। তিনি ছিলেন ইমাম ইব্রাহীম সাহেবের সাহায্যকারীদের অন্যতম। নিজ পরিবারকেও জামা’তের নেযাম তথা ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত থাকার জন্য এবং জামা’তী অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করতে সর্বদা উপদেশ প্রদান করতেন। খিলাফতে আহমদীয়ার সাথে একান্ত বিশ^স্ততার সম্পর্ক ছিল। দীর্ঘ সময় মসজিদে কাটাতেন, এমটিএ-তে অনুষ্ঠান দেখতেন। বিশেষত খুতবা রীতিমত এবং গভীর মনোযোগ সহকারে শুনতেন।সুলেহ্ আগ ইব্রাহীম, শাহাদাতকালে তাঁর বয়স ছিল ৬৭ বছর। পেশায় তিনিও একজন কৃষক ছিলেন। বাজামা’ত নামাযের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নিয়মিত ছিলেন এবং রীতিমত চাঁদা দিতেন। মজলিসে আনসারুল্লাহ্র একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং জামা’তের একজন একনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন। ইব্রাহীম সাহেবের ডান হাত ছিলেন এবং সাহায্যকারী ছিলেন। আল্লাহ্ তা’লার ফযলে জ্ঞানী মানুষ ছিলেন আর ধর্মীয় কিংবা জ্ঞানগর্ভ আলাপ-আলোচনা করা তাঁর অভ্যাস ছিল। জামা’তের আনসারদের মাঝে যখনই জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হতো তখন তাঁকে এমন আসরে পাওয়া যেত। অত্যন্ত সহিষ্ণু ও ভদ্র প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ছোটো বড়ো নির্বিশেষে সবার সাথে সদ্ব্যবহার করা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। সালানা জলসা কিংবা ইজতেমায় যাওয়ার সময় যদি তিনি লক্ষ্য করতেন যে, কারো কাছে যাতায়াত ভাড়া নেই অথবা পর্যাপ্ত অর্থ নেই সেক্ষেত্রে তিনি নিজের পক্ষ থেকে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন যেন সেও অংশগ্রহণ করতে পারে। সাম্প্রতি, অর্থাৎ এ বছর ডোরি এলাকা থেকে বেরিয়ে সফর করা অত্যন্ত সাহসিকতার কাজ ছিল, কেননা সন্ত্রাসীরা সর্বোত্র ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিল কিন্তু বিরাজমান শত বিপদসংকুল পরিবেশ সত্তে¡ও মাহদীয়াবাদ থেকে সফর করে বুরকিনা ফাসোতে গিয়ে ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জলসা সালানায় অংশগ্রহণ করেন।পরের জন হলেন উসমান আগ সুদে সাহেব। (শাহাদাতকালে) তাঁর বয়স ছিল ৬৯ বছর। নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ আহমদী ছিলেন। জামা’তের জন্য অর্থ ও সময় উৎসর্গকারী ছিলেন এবং পরিশেষে আল্লাহ্ তা’লা প্রাণ বিসর্জনেরও তৌফিক দান করেছেন। মেহদিয়াবাদের মসজিদ নির্মাণকালে পানি বহন করে নিয়ে আসতেন আর নির্মাণকাজে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সহযোগিতা করেন এবং অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। নিয়মিত নামায পড়ায় অভ্যস্ত ছিলেন। রীতিমত চাঁদা দিতেন। যা-ই আয় করতেন তা থেকে সর্বপ্রথম চাঁদার অর্থ প্রদান করতেন। এমন মানসিকতার মানুষ কি অর্থের লোভে বয়আত করে, যেমনটি বিরোধীরা বলেছে? পেশায় তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। জুতার ব্যাবসা করতেন। কারো জুতা কেনার সামর্থ্য না থাকলে অথবা পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলেও তাকে শূণ্যহাতে যেতে দিতেন না। কাউকে খালি পায়ে ফিরিয়ে দিতেন না। কারো কাছে অর্থ না থাকলে অথবা পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে তিনি বলেতেন, কোনো সমস্যা নেই, পরে দিলেও চলবে।আরেক জন হলেন আলী আগ মাগোয়েল সাহেব। তিনি ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর পিতার সাথে ১৯৯৯ সালে আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। পেশায় তিনি একজন কৃষক ছিলেন। আহমদীয়া মুসলিম জামা’ত, বিল্লারের মুয়াজ্জেন ছিলেন। সন্ত্রাসবাদের কারণে কিছুদিন পূর্বে তাকে নিজ গ্রাম থেকে বসতবাড়ি স্থানান্তরিত করতে হলে তিনি মেহদিয়াবাদে এসে বসতি স্থাপন করেন। খুবই নিষ্ঠাবান আহমদী ছিলেন। বিভিন্ন নামায এবং চাঁদা প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি নিয়মিত ছিলেন। এছাড়া জামা’তের সকল কর্মকাণ্ডে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহণ করতেন। পরের জন হলেন মূসা আগ আদরাহি। শাহাদাতের সময় তার বয়স ছিল ৫৩ বছর। তিনিও কৃষিকাজ করতেন। জামা’তের বিভিন্ন কাজে তিনি অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতেন। আহমদী হওয়ার পূর্বে তিনি ওহাবী ফিরকার অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য ছিলেন। (ফরয) নামাযগুলোতে তিনি খুবই নিয়মিত ছিলেন এবং তাহাজ্জুদ নামাযও রীতিমতো পড়তেন। মাগরিবের নামাযের জন্য মসজিদে এসে এশার নামায পড়েই বাড়ি ফিরতেন। মাগরিব ও এশার সময় মসজিদে অবস্থান করতেন এবং যিকরে এলাহীতে মগ্ন থাকতেন। তার সম্পর্কে সবাই এ সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি একজন সত্যিকার মু’মিন এবং একনিষ্ঠ ও নিবেদিতপ্রাণ আহমদী হওয়ার ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত ছিলেন। আমার কাছে তিনি নিয়মিত দোয়া চেয়ে চিঠি লিখতেন আর বলতেন, আমিও যুগ খলীফার জন্য নিয়মিত দোয়া করে থাকি।নবম জন হলেন, আগ উমর আগ আব্দুর রহমান সাহেব। শাহাদাতের সময় তার বয়স ছিল ৪৪ বছর। তিনি সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন। যেভাবে পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৯৯ সনে ২০ বছর বয়সের তিনি আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। এরপর জামা’তের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার ক্ষেত্রে উন্নতি করতে থেকেন। মেহদিয়াবাদ জামা’তের খুবই নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ একজন সদস্য ছিলেন। ইমাম ইব্রাহীম সাহেবের ডান হাত ছিলেন। মেহদিয়াবাদ (মসজিদ)-এর সহকারী ইমামও ছিলেন। মসজিদে প্রবেশের পর সন্ত্রাসীরা ইমাম ইব্রাহীম সাহেবকে জিজ্ঞাসাবাদের পর জিজ্ঞেস করে, নায়েব ইমাম কে? তখন নির্দ্বিধচিত্তে তিনি বলেন, আমি (নায়েম ইমাম)। যেসব লোক মসজিদে প্রথম আসে সর্বদা তিনি তাদের একজন হতেন। তিনি খুবই ধীরেসুস্থে ও আন্তরিকতার সাথে নামায পড়তেন। তাহাজ্জুদ নামাযেও অভ্যস্ত ছিলেন। ছেলেমেয়েকেও নিজের সাথে মসজিদে নিয়ে আসতেন এবং তাদের তরবিয়তের প্রতি খুবই যতœবান ছিলেন। তিনিও আমার কাছে নিয়মিত পত্র লিখতেন। সাইকেল চালনায় খুব দক্ষ ছিলেন আর গোটা অঞ্চলে বড় বড় সফর করতেন। ডোরি থেকে তিনি চার বার ২৬৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ওয়াগাডোগুতে খোদ্দামুল আহমদীয়ার ইজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। ২০০৮ সনে খিলাফত জুবলীর জলসা উপলক্ষ্যে বুরকিনা ফাসো থেকে যে কাফেলা সাইকেল চালিয়ে ঘানা গিয়েছিল তাতে তিনিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।প্রত্যেক নামের সাথে যে ‘আগ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তাতে তাদের রিপোর্ট থেকে আমি যা বুঝেছি তা হলো এর অর্থ ইবন, অর্থাৎ অমুকের পুত্র। আগ অমুক অথবা অমুক ব্যক্তি তমুকের পুত্র কিংবা ইবনে অমুক। যাহোক তার সম্পর্কে আরো লিখেছেন, ৮জনকে শহীদ করার পর শেষে আগ উমর আগ আব্দুর রহমান সাহেব রয়ে যান। বয়সের দিক থেকে তিনি (তাদের মধ্যে) সবচেয়ে ছোট ছিলেন। সন্ত্রাসীরা তাকে বলে, তুমি যুবক মানুষ, তুমি (চাইলে) আহমদীয়াত অস্বীকার করে নিজের প্রাণ বাঁচাতে পার। কিন্তু অত্যন্ত সাহসিকার সাথে তিনি তাদের বলেন, আমার বয়োজ্যেষ্ঠরা যে পথ ধরে জীবন উৎসর্গ করেছেন আমিও আমার ইমাম ও বয়োজ্যেষ্ঠদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঈমানের খাতিরে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত আছি। একথা শুনে তাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে মুখমণ্ডলে গুলি করে শহীদ করা হয়।বুরকিনা ফাসোতে সার্বিকভাবেই পরিস্থিতি খারাপ। সন্ত্রাসীরা অনেক অঞ্চলেই তাণ্ডব চালিয়ে থাকে। কিছুদিন পূর্বে দ্বীনিয়া মজলিসের কায়েদ সাহেব কেন্দ্র তথা মিশন হাউজে এসে বলেন, গ্রামে আমার মুদিখানা রয়েছে। একদিন সন্ত্রাসীদের একজন তার দোকানে আসে [এটি পুরোপুরি ভিন্ন একটি অঞ্চল] আর সে কিছু ক্রয় করতে আসে। সে এদিক সেদিক দেখছিল। সেখানে তার দোকানে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এবং খলীফাদের ছবি ঝোলানো ছিল। সে কায়েদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করে, এরা কারা? দোকানে তুমি কাদের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছ? তখন কায়েদ সাহেব উত্তর দেন, এগুলো মসীহ্ মওউদ এবং তাঁর খলীফাদের ছবি। সে বলে, মসীহ্ মওউদ না, বরং মুসলমানদের মধ্যে কিছু লোক একজোট হয়ে একটি দল বানিয়েছে, এরাই সেসব লোক আর এরা কাফের। যাবার আগে কায়েদ সাহেবকে হুমকি দিয়ে বলে, এসব ছবি এখান থেকে নামিয়ে ফেল, নতুবা পরের বার আমি যখন আসব তখন যদি এগুলো এখানে থাকে তাহলে তোমার অবস্থা খুব খারাপ হবে। কিন্তু কায়েদ সাহেব সেসব ছবি সেখানেই ঝোলানো থাকতে দেন। কিছুদিন পর সে আবার কিছু কিনতে এসে দেখে, ছবিগুলো সেখানেই ঝোলানো রয়েছে। (এটি) দেখে সে চলে যায়। তিনি বলেন, কায়েদ সাহেব আমাদেরকে এ ঘটনা শোনানোর পর আরো ছবি দিতে বলেন। ভয় পাবার বদলে তিনি বলেন, এখন আমি আরো বিভিন্ন স্থানে এসব ছবি ঝোলাবো। এই পুরো অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে এসব জঙ্গীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অথচ সেখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। এই অঞ্চলটির একদিকের সীমান্ত মালি সংলগ্ন আর আপরদিকে ডোরি অঞ্চলটি নাইজারের সীমান্ত সংলগ্ন; এভাবে এই পুরো অঞ্চলটিই বলতে গেলে তাদের কব্জায় রয়েছে।যাহোক, এঁরা আহমদীয়াতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, নিজেদের পেছনে এক দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’লা তাদের সন্তানসন্ততি এবং বংশধরকেও নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততায় সমৃদ্ধ করুন। শত্রু মনে করে, এঁদেরকে শহীদ করার মাধ্যমে এই অঞ্চল থেকে আহমদীয়াতকে নিশ্চিহ্ন করে দিবে। কিন্তু ইনশাআল্লাহ্, এখানে আহমদীয়াত আগের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাবে ও বিস্তৃতি লাভ করবে। সেখানকার ব্যবস্থাপনা এবং আমীর সাহেবেরও প্রজ্ঞার সাথে তবলীগের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত, সেখানে গিয়ে তাদেরকে সাহসও যোগানো উচিত। আল্লাহ্ তা’লা তাদের আত্মীয়স্বজনকে ধৈর্য ও মনোবল দান করুন এবং তাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা যে মহান উদ্দেশ্যে নিজেদের প্রাণের অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন তার গুরুত্ব বোঝার সামর্থও তাদের দান করুন। যাহোক, এখন সেখানে এক প্রজ্ঞা ও পরিকল্পনার অধীনে আমাদের কাজ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি আগেও তাদের বলেছি, সেখানে যান।শহীদদের পরিবারের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে, তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর জন্য চতুর্থ খলীফার যুগ থেকেই সৈয়্যদানা বেলাল ফান্ড নামে একটি ফান্ড প্রতিষ্ঠিত আছে, যা থেকে শহীদদের জন্য ব্যয় করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এই ঘটনার পর কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবেও এবং বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন ও জামা’তও তাদের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে কিছু অর্থ পাঠাচ্ছে যে, এ অর্থ তাদের জন্য। অথচ একটি ফান্ড যেহেতু ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত আছে, তাই সবার উচিত তারা যে অর্থই দিতে চায় তা সৈয়্যদানা বেলাল ফান্ডে যেন জমা দেয়ার পর জানিয়ে দেয়, আমরা এই অর্থ জমা দিয়েছি এবং আমাদের ইচ্ছা হলো তা যেন বিশেষভাবে ডোরির মেহদিয়াবাদের শহীদদের জন্য ব্যয় করা হয়। তাহলে কেন্দ্র অবশ্যই সে অনুসারে সিদ্ধান্ত নেবে। কোনো অর্থ আসুক বা না আসুক, কেন্দ্র তো তাদের চাহিদার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবে এবং (তা) পূরণ করবেই, ইনশাআল্লাহ্। কিন্তু যারা দিতে চান তারা এই ফান্ডে, অর্থাৎ সৈয়্যদানা বেলাল ফান্ডে অর্থ জমা দিন। এটি এসব শহীদের পরিবারের প্রতি কোনোরূপ অনুগ্রহ নয়, বরং তাদের প্রয়োজনের খেয়াল রাখা এবং তা পূরণ করা আমাদের আবশ্যিক দায়িত্ব। সবশেষে হযরত আকদাস মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর একটি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করছি। তিনি (আ.) বলেন,এটি মনে করো না যে, খোদা তোমাদের বিনষ্ট করবেন। তোমরা খোদার হাতের এক বীজ বিশেষ যা মাটিতে বপন করা হয়েছে। খোদা বলেছেন, এই বীজ উদ্গত হবে, ফুল দেবে এবং চর্তুদিকে এর ডালপালা বিস্তৃতি লাভ করবে আর এক মহা মহিরুহে পরিণত হবে, (ইনশাআল্লাহ্)। সুতরাং সৌভাগ্যবান তারা যারা খোদার কথায় ঈমান রাখে এবং অন্তর্বর্তীকালীন বিপদাপদে ভীত হয় না, কারণ বিপদাপদের আপতিত হওয়াও আবশ্যক যেন খোদা তোমাদের পরীক্ষা করেন। অতএব এসব কুরবানী প্রদানকারী তো এই পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন, এখন তাদের জন্যও নিজ নিজ ঈমান ও একীনে উন্নতি করার পরীক্ষা যারা পিছনে রয়ে গেছে। আল্লাহ্ তা’লা তাদেরকে এবং আমাদেরকেও পূর্ণাঙ্গীন ঈমান ও একীনে অটল থাকার সামর্থ দিন। এসব শহীদের মর্যাদা আল্লাহ্ তা’লা উত্তরোত্তর উন্নিত করুন। তাদের এসব আত্মত্যাগকে তিনি ফুলেফলে সুশোভিত করুন যার ফলে হযরত মুহাম্মদ রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর প্রকৃত শিক্ষাকে আমরা পৃথিবীর বুকে দ্রুততম সময়ে বিস্তার লাভ করতে দেখতে পাই। এছাড়া পৃথিবী থেকে অজ্ঞতা দূরীভ‚ত হোক এবং এক-অদ্বিতীয় খোদার প্রকৃত রাজত্ব পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হোক।নামাযের পর এসব শহীদদের জানাযার সাথে এখন আমি আরো দুজন নিষ্ঠাবান আহমদীর জানাযাও পড়াব। তাদের একজন হলেন ডক্টর করীমুল্লাহ্ যিরভি সাহেব, তিনি সূফী খোদাবখ্শ যিরভি সাহেবের পুত্র ছিলেন এবং (বর্তমানে) আমেরিকা নিবাসী ছিলেন। গত ৪ঠা জানুয়ারি তিনি ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় তিনি ওসীয়্যতকারী ছিলেন। তার পিতা সূফী খোদাবখ্শ সাহেব ১৭ বছর বয়সে ১৯২৮ সনে কাদিয়ানে গিয়ে খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.)-এর হাতে বয়আত করেছিলেন। করীমুল্লাহ্ যিরভি সাহেব হযরত মালেক সাইফুর রহমান সাহেবের জামাতাও ছিলেন। অনেক জ্ঞানী একজন মানুষ ছিলেন, কয়েকটি পুস্তকও তিনি রচনা করেছেন। জামা’তের অনেক সেবা করারও তিনি সৌভাগ্য লাভ করেছেন। আল্লাহ্ তা’লা তার সাথে ক্ষমা ও দয়ার আচরণ করুন।দ্বিতীয় জানাযা হলো যিরভি সাহেবের সহধর্মিণী আমাতুল লতিফ যিরভি সাহেবার। তিনি করীমুল্লাহ্ যিরভি সাহেবে স্ত্রী ছিলেন, আমেরিকায় বসবাস করতেন আর তিনি মালেক সাইফুর রহমান সাহেবের মেয়ে ছিলেন। তিনি ৬ জানুয়ারি নিজ স্বামীর মৃত্যুর দুদিন পরই ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। মরহুমা ওসীয়্যতকারী ছিলেন। যেভাবে আমি পূর্বেই বলেছি, তিনি মালেক সাইফুর রহমান সাহেবের মেয়ে ছিলেন। তার মাতার নাম ছিল রশীদ শওকত যিনি রাবওয়া থেকে প্রকাশিত মিসবাহ্ পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন। তার জন্ম হয়েছিল কাদিয়ানে। খুবই জ্ঞানপিপাসু একজন মহিলা ছিলেন। শিক্ষিতা ছিলেন, এমএসসি পাশ করেছিলেন। জামা’তের সেবা করার সৌভাগ্যও তিনি লাভ করেন। আল্লাহ্ তা’লা মরহুমার সাথেও ক্ষমা ও দয়ার আচরণ করুন।তার ভাই মালেক মুজিবুর রহমান সাহেব তার বোন এবং ভগ্নিপতি সম্পর্কে লিখেন, এই দম্পতির মাঝে গভীর ভালোবাসা ছিল। তারা অনেক কষ্ট সহ্য করা সত্ত্বেও কখনো কোনো বিষয়ে অভিযোগ করেন নি। কখনোই আমি তাদেরকে অন্য কারো সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করতে শুনি নি। তারা উভয়ই জ্ঞানের এক গভীর সমুদ্র ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রত্যেকের সাথে তাদের ভালোবাসাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল; তাদের প্রয়োজন ও চাহিদার প্রতি তারা দৃষ্টি রাখতেন আর ভীষণ আদর ও স্নেহ করতেন। মাশাআল্লাহ্ তারা খুবই পূর্ণাঙ্গীন ও সুন্দর জীবনযাপন করেছেন। নিজেদের সমাজ এবং পরিবেশের অন্যদের ওপর তারা অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব রাখতেন এবং তারা উত্তম প্রভাব বিস্তারকারী পুণ্যবান মানুষ ছিল। আল্লাহ্ তা’লা তাদের সাথে ক্ষমা ও দয়ার আচরণ করুন।