25 Sep শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত উমর (রা.) জুমুআর খুতবা ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১
যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ মোতাবেক ১৭ তাবুক, ১৪০০ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা
তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
হযরত উমর (রা.)-এর যুগের ঘটনাবলীর স্মৃতিচারণ করা হচ্ছিল। আজ ইয়ারমুকের যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করব। ইয়ারমুকের যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে রেওয়ায়েত সমূহে মতভিন্নতা রয়েছে। একটি রেওয়ায়েত হলো, এই যুদ্ধ ১৫ হিজরী সনে হয়েছিল। কারো কারো মতে ১৩ হিজরীতে দামেস্ক বিজয়ের পূর্বে এই লড়াই হয়েছিল। একটি রেওয়ায়েত অনুসারে হযরত উমর সর্বপ্রথম যে যুদ্ধের বিজয় সম্পর্কে সুসংবাদ লাভ করেন তা ছিল ইয়ারমুকের যুদ্ধ। তখন হযরত আবু বকর (রা.)-এর মৃত্যুর পর ২০দিন অতিবাহিত হয়েছিল। কারো কারো মতে দামেস্ক বিজয়ের সুসংবাদ সবার আগে লাভ হয়েছিল। যাহোক, দামেস্ক বিজয় প্রথমে হওয়ার কথাটি অধিক সঠিক বলে মনে হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে এটিই প্রতিভাত হয় যে, ইয়ারমুকের যুদ্ধ হযরত উমর (রা.)-এর যুগেই হয়েছিল। রোমানরা বারংবারের পরাজয়ের ফলে দামেস্ক এবং হিমস ইত্যাদি স্থান থেকে বের হয়ে আনতাকিয়া পৌঁছে। আনতাকিয়া সিরিয়ার সীমান্তবর্তী একটি শহর। (তারা) হিরাকেলের কাছে নিবেদন করে যে, আরবরা পুরো সিরিয়াকে পদদলিত করেছে। হিরাকেল তাদের মধ্য থেকে কতক বিচক্ষণ এবং সম্মানীত ব্যক্তিকে নিজ দরবারে তলব করে এবং বলে, আরবরা শক্তি, সংখ্যা এবং অস্ত্রেশস্ত্রের দিক থেকে তোমাদের তুলনায় দুর্বল, তাহলে তোমরা কেন তাদের মোকাবিলা করতে পারছ না, কেন তাদের মোকাবিলায় তোমরা অবিচল থাকতে পার না। এতে তারা সবাই লজ্জায় মাথা নীচু করে নেয়, কেউ কোন উত্তর প্রদান করে নি। কিন্তু এক অভিজ্ঞ বৃদ্ধ ব্যক্তি বলে যে, আরবদের চরিত্র আমাদের চরিত্রের চেয়ে উত্তম। তারা রাতে ইবাদত করে, দিনের বেলায় রোযা রাখে। কারো প্রতি অন্যায় করে না। পরস্পরের সাথে সাম্যের সাথে মেলামেশা করে। আর আমাদের অবস্থা হলো, (আমাদের লোকেরা) মদ পান করে, অপকর্মে লিপ্ত থাকে, প্রতিশ্রুতি পালন করে না, অন্যদের প্রতি অন্যায় করে। এরই এটি ফলাফল যে, তাদের কাজে উচ্ছাস ও উদ্দীপনা আছে আর অবিচলতা বিদ্যমান, আর আমাদের কাজ মনোবল ও অবিচলতাশূন্য হয়ে থাকে। সিজার আসলে সিরিয়া ছেড়ে যাওয়ার সংকল্প করে নিয়েছিল। কিন্তু সকল শহর এবং জেলা থেকে দলে দলে অনবরত খ্রিষ্টান সাহয্যপ্রার্থীরা আসছিল। সিজারের প্রচণ্ড আত্মাভিমান জেগে উঠে আর একান্ত উচ্ছাসের সাথে সে নিজের রাজত্বের পুরো শক্তি আরবদের মোকাবিলায় ব্যয় করতে উদ্যত হয়। রোম, কস্তুনতুনিয়া, এন্তিনিয়া, আর্মেনিয়া দ্বীপসহ সকল স্থানে সে বার্তা প্রেরণ করে যে, সকল সেনাদল যেন আনতাকিয়ায় একটি নির্দিষ্ট তারিখ এর পূর্বে উপস্থিত হয়। সকল জেলার কর্মাকর্তাদের সে লিখে পাঠায় যে, যেখান থেকে যত বেশি লোক পাঠানো সম্ভব প্রেরণ করা হোক। সেসব বার্তা পৌঁছতেই সেনাদলের এক তুফান ধেয়ে আসে। আনতাকিয়ার চতুর্দিকে যত দূর চোখ যেতো সেনাদল পঙ্গপালের ন্যায় বিস্তৃত ছিল। অসংখ্য সেনাদল ছিল সেখানে। হযরত আবু উবায়দা যেসব স্থান জয় করেছিলেন সেসব স্থানের ধনাঢ্য ও নেতাদের মাঝে তার ন্যায় ও সুবিচারের কারণে মুসলিমপ্রীতি এতটা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, ধর্মীয় বিরোধ সত্তে¡ও স্বয়ং নিজেদের পক্ষ থেকেই তারা শত্রুদের খবর সংগ্রহের জন্য গোয়েন্দা নিযুক্ত করে রেখেছিল। অতএব তাদের মাধ্যমে হযরত আবু উবায়দা সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে অবগত হন। তিনি সব সেনাধ্যক্ষকে একত্রিত করেন এবং দাঁড়িয়ে একটি প্রভাব বিস্তারী বক্তৃতা করেন, যার সারাংশ ছিল: হে মুসলমানেরা! খোদা তা’লা তোমাদের বারবার পরীক্ষা করেছেন, আর তোমরা তাঁর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছ। একারণে খোদা তা’লা সর্বদা তোমাদের সাফল্যমণ্ডিত ও সাহায্যপুষ্ট রেখেছেন। তোমরা সর্বদা সাফল্য অর্জন করেছ। এখন তোমাদের শত্রুর এমন প্রস্তুতি নিয়ে তোমাদের মোকাবিলায় বেরিয়েছে যে, ভূমি কেঁপে উঠেছে। এখন বল, তোমাদের পরামর্শ কী? আমীর মুআবিয়ার ভাই ইয়াযিদ বিন আবি সুফিয়ান দণ্ডায়মান হন এবং বলেন, আমার অভিমত হলো, নারী ও শিশুদের শহরের ভেতর থাকতে দিন, আর আমরা নিজেরা শহরের বাইরে সেনাসারি বিন্যস্ত করি। সেইসাথে খালেদ ও আমর বিন আস-কে পত্র প্রেরণ করা হোক যেন তারা দামেস্ক ও ফিলিস্তিন থেকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। এই ঘটনা থেকেও এটিই প্রমাণ হয় যে, দামেস্ক জয় এর পূর্বে হয়েছিল। শারাহবিল বিন হাসানা বলেন, এই বিষয়ে প্রত্যেকের স্বাধীন মতামত প্রকাশ করা উচিত। ইয়াযিদ যে অভিমত দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে হিতাকাক্সক্ষা থেকেই দিয়েছেন, কিন্তু আমি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করি। শহরের বাসিন্দারা সবাই খ্রিষ্টান; হতে পারে যে, তারা বিদ্বেষবশত আমাদের পরিবার-পরিজনদের ধরে নিয়ে সিজারের হাতে তুলে দেবে, কিংবা নিজেরাই তাদের হত্যা করবে, নিজেরাই তাদের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যাবে। হযরত আবু উবায়দা বলেন, এর সমাধান হলো, আমরা খ্রিষ্টানদের শহর থেকে বের করে দিই, তাহলেই আমাদের স্ত্রী-সন্তানরা নিরাপদ হয়ে যাবে। শারাহবিল দাঁড়িয়ে বলেন, হে আমীর! কোনক্রমেই আপনার এই অধিকার নেই! আমরা এই খ্রিষ্টানদের এ শর্তে নিরাপত্তা দিয়েছি যে, তারা শহরে নিশ্চিন্তে বসবাস করবে; তাই আমরা কীভাবে অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে পারি? আমরা তাদের সাথে একটা অঙ্গীকার করেছি, তাই তাদেরকে শহর থেকে বের করে দিয়ে কীভাবে অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে পারি ? হযরত আবু উবায়দা নিজের ভুল স্বীকার করেন, কিন্তু উক্ত আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় নি যে, তাহলে কী করা যায়? সাধারণ জনগণ এই মতামত ব্যক্ত করে যে, হিমসে অবস্থান করে সামরিক সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করা হোক। আবু উবায়দা বলেন, এত সময় কোথায়? অবশেষে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, হিমস ছেড়ে দামেস্ক অভিমুখে যাত্রা করা হোক; সেখানে খালেদ উপস্থিত রয়েছেন এবং আরবের সীমান্তও সেখান থেকে কাছে। এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে হযরত আবু উবায়দা কোষাধ্যক্ষ হাবীব বিন মাসলামাকে ডেকে বলেন, খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে যে জিযিয়া বা খিরাজ নেয়া হয়, অর্থাৎ কর হিসেবে যা-ই আদায় করা হয় (তা তাদেরকে ফিরিয়ে দাও।) এই মুহূর্তে আমাদের অবস্থা এতটা শোচনীয় যে, আমরা তাদের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব পালন করতে অপারগ; তা তাদের নিরাপত্তার জন্যই নেয়া হতো, তাদের কল্যাণের জন্য নেয়া হতে, কিন্তু তা তো আমরা করতে পারছি না। এজন্য যা-ই তাদের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে, সব তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হোক এবং তাদেরকে বলে দাও তোমাদের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক ছিল তা এখনও আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে যেহেতু আমরা তোমাদের নিরাপত্তা বিধান করতে অপারগ, তাই নিরাপত্তা প্রদানের নিমিত্তে গৃহীত জিযিয়া তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে কয়েক লক্ষ পরিমাণ মুদ্রা, যা আদায় করা হয়েছিল, সম্পূর্ণ ফিরিয়ে দেয়া হয়। খ্রিষ্টানদের ওপর এই ঘটনার এতটা প্রভাব পড়ে যে তারা কাঁদতে থাকে এবং আবেগের সাথে বলতে থাকে, খোদা তোমাদের ফিরিয়ে আনুন। ইহুদিদের ওপর এর চেয়েও গভীর প্রভাব পড়েছিল। তারা বলে, তওরাতের শপথ! যতক্ষণ আমরা বেঁচে আছি, সিজার হিমস দখল করতে পারবে না। একথা বলে তারা শহরের নিরাপত্তা-ফটক বন্ধ করে দেয় এবং সবখানে প্রহরা-চৌকি বসায়। আবু উবায়দা কেবল হিমসবাসীদের সাথেই এরূপ ব্যবহার করেন নি, বরং যতগুলো অঞ্চল বিজিত হয়েছিল সকল স্থানেই লিখে পাঠান যে, জিযিয়া হিসেবে আদায়কৃত পুরো অর্থ যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়। অতঃপর আবু উবায়দা দামেস্ক অভিমুখে যাত্রা করেন এবং এই সকল বৃত্তান্ত সম্পর্কে হযরত উমরকে অবগত করেন। মুসলমানরা রোমানদের ভয়ে হিমস ছেড়ে চলে এসেছে একথা শুনে হযরত উমর খুবই দুঃখ ভারাক্রান্ত হন। কিন্তু যখন তিনি জানতে পারেন যে, সমগ্র বাহিনী ও সেনাধ্যক্ষরা ঐকমত্যের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, তখন তিনি পুরোপুরি আশ্বস্ত হন এবং বলেন, হয়ত খোদা তা’লা কোন প্রজ্ঞার অধীনে সকল মুসলমানকে এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে একমত করেছেন। এরূপ বর্ণনাও পাওয়া যায় যে, প্রথমে হযরত উমরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এবং হযরত উমর-ই বলেছিলেন যে, যদি তোমরা তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে না পার, তবে তোমরা জিযিয়া ইত্যাদি যা-ই তাদের কাছ থেকে নিয়েছ, সবকিছু ফিরিয়ে দাও। হযরত উমর আবু উবায়দাকে প্রত্যুত্তরে লিখেন, আমি সাহায্য করার জন্য সাঈদ বিন আমরকে পাঠাচ্ছি, কিন্তু জয়-পরাজয় সৈন্যদের সংখ্যাস্বল্পতা বা সংখ্যাধিক্যের উপর নির্ভর করে না। দামেস্ক পৌঁছে আবু উবায়দা সকল সেনাকর্মকর্তাকে একত্রিত করেন এবং তাদের সাথে শলা-পরামর্শ করেন। ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ান, শারাহবিল বিন হাসানা, মু’আয বিন জাবাল সবাই ভিন্ন ভিন্ন মতামত দেন। ইতোমধ্যেই আমর বিন আস-এর দূত পত্র নিয়ে পৌঁছে, যার বিষয়বস্তু এরূপ ছিল জর্ডানের অঞ্চলগুলোতে গণবিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে এবং রোমানদের আগমনবার্তা চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে আর হিমস ছেড়ে চলে আসাটা নিতান্তই প্রভাব খর্ব হওয়ার কারণ হয়েছে। আবু উবায়দা উত্তরে লিখেন, আমরা ভয়ের কারণে হিমস ছেড়ে আসি নি, বরং উদ্দেশ্য ছিল, শত্রুর যেন সুরক্ষিত স্থানগুলো থেকে বের হয়ে আসে এবং ইসলামী সৈন্যরা যারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা যেন একস্থানে সমবেত হয়। এছাড়া পত্রে তিনি এও লিখেন যে, তোমরা নিজেদের স্থান পরিত্যাগ করো না, আমি সেখানে এসেই তোমাদের সাথে একত্রিত হব। দ্বিতীয় দিন আবু উবায়দা দামেস্ক থেকে রওয়ানা হলেন এবং জর্ডানের সীমান্তে ইয়ারমুকে পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। ইয়ারমুক সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী নীচু উপত্যকা ছিল, যেখানে জর্ডান নদী প্রবাহিত হতো। আমর বিন আসও এখানে এসেই মিলিত হয়েছেন। এই সুযোগ যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার দৃষ্টিকোণ থেকে একারণে যথার্থ ছিল যে, আরবের সীমান্ত অন্যান্য সকল স্থানের চেয়ে এখান থেকে নিকটে ছিল। পেছনেই আরবের সীমান্ত পর্যন্ত উন্মুক্ত ময়দান ছিল যার ফলে এই সুযোগ ছিল যে, প্রয়োজনে যতদূর ইচ্ছা পেছনে সরে আসার সুযোগ ছিল। হযরত উমর, সাঈদ বিন আমেরের সাথে যে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন, তা তখনও এসে পৌঁছে নি। এদিকে রোমানদের আগমনবার্তা এবং তাদের সাজসরঞ্জামের বিবরণ শুনে মুসলমানরা বিচলিত ছিল। আবু উবায়দা হযরত উমর (রা.)-এর কাছে আরেকজন দূতকে প্রেরণ করেন এবং লিখেন, রোমানরা জলস্থল সকল দিক থেকে উপচে পড়েছে আর তাদের উচ্ছাস-উদ্দীপনার অবস্থা এমন যে, যেপথেই সেনাবাহিনী যায়, যারা কখনো ঘর থেকে বের হয়নি এমন সন্যাসী ও খানকানশীন বের হয়ে এসে সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দিচ্ছে। এই পত্র পৌঁছলে হযরত উমর মুহাজের ও আনসারদের একত্রিত করেন এবং পত্র পড়ে শুনান। সাহাবীরা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি এবং অত্যন্ত উদ্দীপনার সাথে উচ্চস্বরে বলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! খোদার খাতিরে আমাদেরকে আমাদের ভাইদের জন্য জীবন বাজি রাখার অনুমতি দিন। খোদা না করুন, তাদের যদি সামান্যতম ক্ষতিও হয় তাহলে আমাদের জীবিত থাকা অর্থহীন। মুহাজের ও আনসারদের আবেগ-উচ্ছাস ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, এমনকি আব্দুর রহমান বিন অউফ বলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনি নিজে সেনাপতি হোন এবং আমাদেরকে সাথে নিয়ে চলুন। কিন্তু অন্য সাহাবীরা এই মতের বিরোধিতা করেন এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, আরও সাহায্যকারী বাহিনী প্রেরণ করা হোক। হযরত উমর দূতকে জিজ্ঞেস করেন যে, শত্রæরা কতদূর এসেছে? সে বলে, ইয়ারমুক থেকে তিন চার মনযিল দূরত্বে আছে। হযরত উমর অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হন এবং বলেন, আফসোস! এখন কী হতে পারে? এত কম সময়ে কীভাবে সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে? তিনি তখন হযরত আবু উবায়দার নামে নিতান্ত প্রভাব বিস্তারী শব্দাবলীতে একটি পত্র লিখেন এবং দূতকে বলেন, নিজে প্রতিটি সারির কাছে গিয়ে এই পত্র পড়ে শুনাবে এবং নিজ মুখে বলবে যে, উমর তোমাদেরকে সালাম বলেছেন এবং আরো বলেছেন, হে মুসলমানরা! প্রানান্তকর লড়াই কর এবং নিজ শত্রুদর উপর বাঘের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড় আর তরবারি দ্বারা তাদের মাথা কেটে ফেল এবং তারা যেন তোমাদের কাছে পিপীলিকার চেয়েও তুচ্ছ হয়ে যায়। তাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদেরকে যেন ভীত-ত্রস্ত না করে এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখনও তোমাদের সাথে এসে মিলিত হয়নি তাদের জন্য চিন্তিত হবে না। এটি এক অদ্ভুত দৈব ঘটনা যে, যেদিন দূত আবু উবায়দার কাছে আসে সেদিনই সাঈদ বিন আমেরও সহস্র সেনাসহ পৗঁছে যান। এতে মুসলমানদের অসাধারণ শক্তি লাভ হয় এবং তারা অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ততার সাথে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ আরম্ভ করে। তিনি মুআয বিন জাবালকে, যিনি অনেক বড় মর্যাদাবান সাহাবী ছিলেন, সেনাবাহিনীর ডান পার্শ্বে নিযুক্ত করেন। কুবাস বিন আশইয়ামকে বাম পার্শ্বে এবং হাশেম বিন উতবাকে পদাতিক বাহিনীর অফিসার নিযুক্ত করেন। নিজ অশ্বারোহী বাহিনীকে তিনি চার ভাগে ভাগ করেন। একটি অংশকে নিজ কর্তৃত্বে রাখেন, বাকিগুলোর জন্য কায়েস বিন হুবায়রা, মায়সারা বিন মাসরুক এবং আমর বিন তোফায়েলকে নিযুক্ত করেন। উক্ত তিন জনই পুরো আরবে বীর হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন, অর্থাৎ অনেক সাহসী হিসেবে পরিচিত ছিলেন আর এ কারণে তাদেরকে ‘ফারিসুল আরব’ বলা হতো। রোমানরাও পূর্ণ প্রস্তুতির সাথে বের হয়েছিল। দুই লাখের অধিক সেনাসদস্য ছিল এবং চব্বিশটি সারি ছিল যাদের সামনে তাদের ধর্মীয় নেতারা হাতে ক্রুশ নিয়ে তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করছিল। উভয় সেনাদল মুখোমুখি হলে এক ‘বেতারিক’ সারি ভেদ করে সামনে অগ্রসর হয়ে বলে, (খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় নেতাকে বেতারিক বলা হয়) আমি একা লড়তে চাই। মায়সারা বিন মাসরুক ঘোড়া নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে গেলে প্রতিপক্ষ যেহেতু খুব শক্তিশালী যুবক ছিল, তাই খালেদ তাকে বাধা দেন এবং কায়েস বিন হুবায়রার দিকে তাকান। তিনি রণসঙ্গীত গেয়ে সামনে অগ্রসর হন। কায়েস প্রতিপক্ষের উপর এমন ক্ষীপ্র গতিত ঝাপিয়ে পড়েন যে বেতরীক অস্ত্র হাতে নেয়ারও সময় পায় নি; তার আঘাত মোক্ষম প্রমাণিত হয়। তরবারি মাথায় লাগে আর হেলমেট কেটে ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বেতরিক দোদুল্যমান হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। এর সাথেই মুসলমানরা ‘নারায়ে তাকবীর’ ধ্বনি উচ্চকিত করল। খালেদ বলে উঠলেন, ল²ণ শুভ! এখন আল্লাহ্ চাইলে বিজয় আমাদের পদচুম্বন করবে। খ্রিস্টানরা খালেদের সহযোদ্ধা অফিসারদের মোকাবিলায় পৃথক পৃথক সেনাদল মোতায়েন করে, কিন্তু সবগুলো পরাস্ত হয় আর দিনের শেষে যুদ্ধ মুলতবি হয়। রোমানরা যখন দেখল তারা পরাজিত হচ্ছে তখন রাতের বেলা রোমান সেনাপতি ‘বাহান’ সেনাপ্রধানদের একত্রিত করে বলে, আরবরা সিরিয়ার সম্পদের মোহে পড়ে গেছে। যুদ্ধ করার পরিবর্তে তাদেরকে সম্পদ ও স্বর্ণের লালসা দিয়ে এখান থেকে অপসারণ করাই উত্তম হবে। সবাই এই সিদ্ধান্তে ঐকমত্য পোষণ করে। পরবর্তী দিন হযরত আবু উবায়দা (রা.)-এর কাছে দূত প্রেরণ করে বার্তা পাঠায় যে, তোমাদের কোনো সম্মানিত অফিসারকে আমাদের কাছে প্রেরণ কর, আমরা তার সাথে সন্ধি-চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। আবু উবায়দা (রা.) হযরত খালেদ’কে মনোনীত করলেন। বার্তাসহ আগমনকারী রোমীয় বার্তাবাহক দূতের নাম ছিল জর্জ। আরবী ভাষাভাষীদের জন্য বলছি, উর্দূ সীরাত প্রণেতাগণ তার নাম জর্জ বলে উল্লেখ করেছেন কিন্তু আরবী পুস্তকাদীতে তার নাম ‘জারজাহ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মোটকথা সেই বার্তাবাহক-দূত যখন এসে উপস্থিত হয় তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে গিয়েছিল এবং কিছুটা বিলম্বে মাগরিবের নামায শুরু হয়। মুসলমানরা যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে দাঁড়াল এবং যে একাগ্রতা, প্রশান্তি, ভাবগাম্ভীর্য এবং কাকুতি-মিনতির সাথে নামায আদায় করল, তা বার্তাবাহক-দূত অবাক-বিষ্ময়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে। নামায শেষ হতেই সে হযরত আবু উবায়দা (রা.)-এর কাছে কয়েকটি প্রশ্ন করল যার মাঝে একটি প্রশ্ন হল, ‘তোমরা ঈসা (আ.)-এর বিষয়ে কী বিশ্বাস রাখ? হযরত আবু উবায়দা (রা.) পবিত্র কুরআনের যে আয়াতসমূহ পড়ে শুনালেন তা নিম্নরূপ:
إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ ۖ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُونُ (সূরা আলে-ইমরান: ৬০)
অনুবাদ: নিশ্চয় ঈসার অবস্থা আল্লাহ্র দৃষ্টিতে আদমের ন্যায়। তাকে (অর্থাৎ আদমকে) তিনি শুষ্ক মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এরপর তার সম্পর্কে বললেন অস্তিত্ব পরিগ্রহ কর, তখন সে অস্তিত্ব লাভ করল।
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ ۚ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَىٰ مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِّنْهُ ۖ فَآمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۖ وَلَا تَقُولُوا ثَلَاثَةٌ ۚ انتَهُوا خَيْرًا لَّكُمْ ۚ إِنَّمَا اللَّهُ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۖ سُبْحَانَهُ أَن يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ ۘ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ وَكَفَىٰ بِاللَّهِ وَكِيلًا لَّن يَسْتَنكِفَ الْمَسِيحُ أَن يَكُونَ عَبْدًا لِّلَّهِ وَلَا الْمَلَائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ ۚ(সূরা আন-নিসা: ১৭২-১৭৩)
অনুবাদ: হে আহলে কিতাব! তোমরা নিজেদের ধর্মের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ্র বিষয়ে সত্য বৈ অন্য কথা বলো না। নিশ্চয় মরিয়মের পুত্র ঈসা মসীহ্ আল্লাহ্র এক রসূল মাত্র এবং তাঁর কালাম (-এর প্রতিশ্রুতি পূর্ণকারী) ছিল যা তিনি মরিয়মের প্রতি অবতীর্ণ করেছিলেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে একটি রূহ (তথা রহমত) ছিল; অতএব তোমরা আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলগণের প্রতি ঈমান আনো আর বলো না- (আল্লাহ) তিন। তোমরা (এমন বলা থেকে) বিরত হও, তোমাদের জন্য এটিই উত্তম, নিশ্চয় আল্লাহ্ এক-অদ্বিতীয় প্রভু। তিনি পুত্র গ্রহণ করার মত বিষয় থেকে পবিত্র, যা কিছু আকাশসমূহ এবং পৃথিবীতে আছে সবই তাঁর এবং কার্যনির্বাহক হিসেবে আল্লাহ্ যথেষ্ট আর আল্লাহ্র সুরক্ষা লাভের পর অন্য কারও সুরক্ষার প্রয়োজন নেই।
মসীহ্ আল্লাহ্র বান্দা হওয়া কখনো অপছন্দ করবে না এমনকি আল্লাহ্র নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতাগণও নয়।
মোটকথা অনুবাদক যখন আয়াতগুলোর অনুবাদ করে শোনাল তখন জর্জ নামক সেই বার্তাবাহক-দূত অবলীলায় বলে উঠল, আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, ‘ঈসার সঠিক বৈশিষ্ট্য এগুলোই আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তোমাদের নবী সত্য। একথা বলে তিনি কলেমায়ে তওহীদ পাঠ করেন ও মুসলমান হন এবং তাঁর জাতির কাছে ফিরে যেতে সম্মত ছিল না কিন্তু রোমীয়রা কোথাও অঙ্গীকার ভঙ্গের সন্দেহ না করে এ আশংকায় হযরত আবু ঊবাদা (রা.) তাঁকে বাধ্য করেন এবং তিনি (রা.) বলেন, আগামীকাল এখান থেকে আমাদের পক্ষ থেকে যে দূত যাবে তার সঙ্গে চলে এসো, এখন ফিরে যাও। পরদিন হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) রোমীয়দের সেনানিবাসে যান। রোমীয়রা তাদের শৌর্য-বীর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পূর্ব থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে রেখেছিল; আর তা হলো পথের দু’ধারে অনেক দূর পর্যন্ত সারি সারি অশ্বোরোহী আপাদমস্তক লৌহবর্মে আবৃত ছিল কিন্তু হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) তাদের দিকে ভ্রুক্ষোভহীনতা ও নেহায়েৎ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকান আর এমনভাবে তিনি (রা.) তাদের দিকে তাকান, যেভাবে সিংহ ছাগলের পালকে লণ্ডভণ্ড করে এগিয়ে যায়। তিনি (রা.) বাহানের তাঁবুতে পৌঁছালে সে খুব সম্মানের সাথে তাঁকে (রা.) স্বাগত জানায় এবং এনে তাঁকে (রা.) তার পাশে বসায়। দোভাষীর মাধ্যমে আলোচনা আরম্ভ হয়। সাধারণ কথপোকথনের পর বাহান ভাষণের রীতিতে বক্তব্য আরম্ভ করে। হযরত ঈসা (আ.)-এর প্রশংসার পর কায়সারের নাম নিয়ে অহংকার করে বলে, আমাদের বাদশাহ্ রাজাধিরাজ। দোভাষী তার এই বাক্যের পুরো অনুবাদ করার পূর্বেই হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) বাহান-কে থামিয়ে দেন এবং বলেন, তোমাদের সম্রাট এমনই হবে কিন্তু যে ব্যক্তিকে আমরা নেতা বানিয়েছি, এক মুহূর্তের জন্যও যদি তার মাথায় বাদশাহ্ হবার মনোবাসনা জাগে তবে তৎক্ষণাত আমরা তাকে পদচ্যুত করে দিব। বাহান পুনরায় ভাষণ আরম্ভ করে এবং দম্ভভরে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সম্পদের বর্ণনা দিয়ে বলে, আরবের অধিবাসী তোমাদের জাতি আমাদের দেশে এসে বসতি স্থাপন করেছে। আমরা তাদের সাথে সর্বদা বন্ধুসুলভ ব্যবহার করেছি। আমরা ভেবেছিলাম, এই সুযোগসুবিধা প্রদানের কারণে গোটা আরব কৃতজ্ঞ হবে কিন্তু উল্টো তোমরা আমাদের দেশের বিরুদ্ধে সেনাসমাবেশ করছ আর আমাদেরকে আমাদের-ই দেশ থেকে বিতাড়িত করতে চাইছ! তোমাদের জানা নেই যে, ইতোপূর্বে বহু জাতি এমন আকাঙ্খা করেছে কিন্তু কখনও সফল হয় নি। পৃথিবীতে তোমাদের মত অজ্ঞ, বর্বর আর সহায়সম্বলহীন কোন জাতি নেই, এখন তোমাদের এত স্পর্ধা হল যে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী আচরণ করছ! এরপরও আমরা তোমাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখছি উপরন্তু যদি তোমরা এখান থেকে চলে যাও তবে পুরষ্কার হিসেবে সেনাপ্রধানকে দশ হাজার দিনার, সেনা-অফিসারদের হাজার দিনার এবং সাধারণ সেনাদেরকে শত দিনার করে দেয়া হবে। প্রকৃতপক্ষে, তারাই মুসলমানদের হত্যা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে এক বিশাল সৈন্য-সমাবেশ ঘটিয়েছিল। কিন্তু তারা যখন অনুধাবন করল যে, এ যুদ্ধে জয় লাভ করা সহজসাধ্য হবে না তখন এসব শর্ত উপস্থাপন করল। যাহোক, বাহান যখন তার বক্তব্যের ইতি টানল তখন খালিদ উঠে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহ্র গুণকীর্তনের পর বললেন, নিঃসন্দেহে তোমরা অত্যন্ত ধনী ও সম্পদশালী এবং ক্ষমতার বাগডোর তোমাদের হাতে। আর তোমরা তোমাদের প্রতিবেশী আরবদের সাথে যে ব্যবহার করেছ সে বিষয়েও আমরা অবগত আছি। কিন্তু এটি তাদের প্রতি তোমাদের কোন অনুগ্রহ ছিল না বরং তোমাদের ধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র একটি কৌশল ছিল মাত্র। তোমরা তোমাদের ধর্মের প্রসার করতে চাচ্ছিলে যার ফলে সেই আরবরা ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছে এবং আজ তারা স্বয়ং আমাদের বিরুদ্ধে তোমাদের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। এ কথা সত্য যে আমরা পূর্বে দরিদ্র, অভাবী ও যাযাবর ছিলাম। আমাদের অজ্ঞতা ও অমানিশা এমন পর্যায়ের ছিল যে, যারা শক্তিশালী ছিল তারা দুর্বলদের পিষে ফেলত। গোত্রগুলো পরস্পর লড়াই করে নিঃশেষ হয়ে যেত। কিন্তু খোদা তা’লা আমাদের প্রতি দয়া করেন আর আমাদের জাতির মাঝ থেকেই এক নবী আমাদের প্রতি প্রেরণ করেন যিনি আমাদের মাঝে সর্বাপেক্ষা ভদ্র, সর্বাধিক উদার এবং সবচেয়ে পবিত্র মনমানসিকতার অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আমাদের তওহীদ শিখিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেন যে, আল্লাহ্র কোন শরীক নেই। তিনি স্ত্রী-সন্তান লালন করেন না, তিনি এক-অদ্বিতীয়। তিনি আমাদের এ নির্দেশও প্রদান করেছেন, আমরা যেন এসব শিক্ষা পুরো জগতের সামনে উপস্থাপন করি। যে ব্যক্তি এ শিক্ষা মেনে নিবে, সে মুসলমান ও আমাদের ভাই। আর যে ব্যক্তি ইসলামের এ শিক্ষা মানবে না কিন্তু জিযিয়া কর প্রদান করবে, আমরা তার তত্ত্বাবধায়ক এবং সুরক্ষাকারী। আর যারা এ দুটির কোনটিই মানতে প্রস্তুত নয়, তার জন্য তরবারি ধারণের বিকল্প নেই। মানবে না আবার যুদ্ধও করবে এমতাবস্থায় আমরাও প্রস্তুত আছি। বাহান জিযিয়া করের কথা শুনে এক দীর্ঘশ্বাস নেয় এবং নিজ সৈন্যদের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, এরা মরবে তবু জিযিয়া কর প্রদান করবে না। আমরা জিযিয়া নেই, দেই না। বস্তুত কোন নিষ্পত্তি হয় নি আর খালিদ উঠে চলে আসেন। তারপর সেই শেষ যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হল যার পর রোমানরা আর সামলে উঠতে পারে নি। হযরত খালিদ (রা.) চলে আসলে বাহান সর্দারদের একত্রিত করে বলল, তোমরা শুনেছ, আরবদের দাবি হল, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাদের প্রজা না হবে ততক্ষণ তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে না। তোমরা কি তাদের দাসত্ব বরণ করে নিতে রাজি আছ? সকল সেনাকর্মকর্তা অত্যন্ত আবেগের সাথে বলল, আমরা মরব তবুও এই লাঞ্ছনা বরণ করতে পারব না। ভোর হলে রোমানরা সেই উচ্ছাস ও সাজসরঞ্জাম নিয়ে বের হল যা দেখে মুসলমানরাও অবাক হয়। হযরত খালিদ (রা.) এটি দেখে আরবের সাধারণ রীতির বাইরে গিয়ে নতুনভাবে সৈন্যবাহিনী সাজালেন। হযরত খালিদ (রা.) যখন দেখলেন, রোমানরা সেই জোশের সাথে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বের হয়েছে তখন তিনি আরবের যে সাধারণ যুদ্ধরীতি ছিল তার বিপরীতে একটি নতুন পদ্ধতিতে সৈন্যবাহিনী সামনে সাজালেন। আর ৩০-৩৫ হাজারের মত যে সৈন্যসংখ্যাই ছিল সেটিকে ৩৬ ভাগে বিভক্ত করেন এবং সামনে পিছনে সুসজ্জিত সারি তৈরি করেন। মধ্যবর্তী বাহিনীর দায়িত্ব হযরত আবু উবায়দাকে দেন, ডানদিকের দায়িত্বে হযরত আমর বিন আস (রা.) এবং শারাহবিল (রা.) নিযুক্ত হন আর বামদিকের নেতৃত্বে ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ান ছিলেন। এছাড়া প্রতিটি সারিতে বাছাইকরা পৃথক পৃথক অফিসার তাদের নিযুক্ত করেন যারা বীরত্ব এবং যুদ্ধকৌশলে বিশেষ খ্যাতি রাখতেন। বক্তাগণ যারা নিজেদের বক্তৃতার জোরে মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করতেন অর্থাৎ এমন সুবক্তা ছিলেন যারা মানুষকে উজ্জীবিত করতেন তাদেরকে নিযুক্ত করা হয় যাতে তারা তাদের জোরাল ভাষণের মাধ্যমে সৈন্যবাহিনীকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। তাদের মাঝে আবু সুফিয়ানও ছিলেন যিনি সৈন্যদের সামনে এই বাক্যাবলী বলতেন, খোদার কসম! তোমরা আরবদের প্রতিরক্ষক ও ইসলামের সাহায্যকারী পক্ষান্তরে তারা কেবল রোমের প্রতিরক্ষক এবং শিরকের সাহায্যকারী। হে আল্লাহ্! এই দিনটি তোমার দিবসসমূহের মাঝে একটি। হে আল্লাহ্! তোমার বান্দাদের প্রতি তুমি সাহায্য অবতীর্ণ করো। হযরত আমর বিন আস (রা.) বলতেন, হে লোকসকল! তোমরা নিজ দৃষ্টি অবনমিত রাখ এবং হাঁটু গেড়ে বসে যাও। আর নিজেদের বর্শাগুলোকে তাক করে ধরো এবং নিজ নিজ স্থানে ও সারিতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হও। শত্রুরা যখন আক্রমণ করে তখন তোমরা তাদেরকে ততক্ষণ অবকাশ দাও যতক্ষণ না তারা বর্শার ডগায় আসে। অতঃপর তাদের উপর সিংহের মত ঝাপিয়ে পড়ো। সেই খোদার কসম! যিনি সত্যকে ভালবাসেন এবং তাতে পুণ্য প্রদান করেন; যিনি মিথ্যায় অসন্তুষ্ট হন এবং এর জন্য শাস্তি প্রদান করেন আর তিনি অনুগ্রহের প্রতিদান দিয়ে থাকেন। নিশ্চয়ই আমি এই সংবাদ লাভ করেছি যে, মুসলমানেরা গ্রামের পর গ্রাম এবং অট্টালিকার পর অট্টালিকা বিজয় করে এই দেশ জয় করবে। সুতরাং তাদের জনবল এবং তাদের সংখ্যা দেখে তোমরা ভয় পেয়ো না। তোমরা যদি অবিচলতার সাথে যুদ্ধ করো তাহলে এরা তিতির পাখির বাচ্চার মত ভয় পেয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। মুসলমান সেনাসংখ্যা যদিও কম ছিল অর্থাৎ ৩০-৩৫ হাজারের বেশি ছিল না কিন্তু সমস্ত আরবের মধ্যে বাছাইকৃত লোকগুলোই ছিল। তাদের মধ্যে বিশেষ বুযূর্গ যারা মহানবী (সা.)-এর পবিত্র চেহারা দর্শন করেছিল তাদের সংখ্যা ছিল ১ হাজার। বদরের যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাথে অংশগ্রহণ করা সাহাবীর সংখ্যা ছিল ১ শত। আরবের বিখ্যাত গোত্রগুলোর মাঝে কেবল আযদ গোত্রেরই ১০ হাজার মানুষ ছিল। হিমীর গোত্রের একটি বৃহৎ দল ছিল। হামদান, খওলান, লাহাম, জুযাম প্রভৃতি গোত্রের বিখ্যাত সাহসী ব্যক্তিরা ছিল। এই যুদ্ধাভিযানের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল, মহিলারাও এতে অংশগ্রহণ করেছিল এবং অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে। আমীর মুআবিয়া’র মা, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী, হিন্দ অর্থাৎ হযরত হিন্দ যিনি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি আক্রমণ করতে করতে সামনে অগ্রসর হতেন আর বলতেন, তোমরা এসব কাফেরকে নিজেদের তরবারী দিয়ে টুকরো টুকরো করে দাও। একইভাবে আবু সুফিয়ানের মেয়ে এবং আমীর মুআবিয়া’র বোন জোআয়রিয়া একটি দলের সাথে বেরিয়ে তার স্বামীর সাথে মিলে রোমান সেনাদের মোকাবিলা করেন আর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহীদ হন। মিকদাদ যার কণ্ঠ ছিল খুবই সুললিত, তিনি সেনাদের সম্মুখভাগে থেকে সূরা আনফালের যেসব আয়াতে জিহাদের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে সেগুলো তিলাওয়াত করছিলেন।
অপরদিকে রোমানদের উত্তেজনার যে চিত্র ছিল তা হলো, ত্রিশ হাজার সৈন্য নিজেদের পায়ে শেকল পরে নিয়েছিল যেন পিছু হটার চিন্তাও না আসে। অর্থাৎ নিজেদের পা একে অপরের সাথে বেঁধে নেয়। যুদ্ধের সূচনা রোমানদের পক্ষ থেকে হয়। পঙ্গপালের ন্যায় দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে একযোগে অগ্রসর হয়। হাজার হাজার পাদ্রী এবং বিশপ হাতে ক্রুশ নিয়ে সামনে অগ্রসর হয় এবং ‘হযরত ঈসার জয়’ ঈসার জয় ¯েøাগান দিয়ে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এইরূপ অবস্থা দেখে একজনের মুখ থেকে অবলিলায় বেরিয়ে পড়ে যে, আল্লাহু আকবার কী বিশাল সৈন্যবাহিনী! হযরত খালেদ জোশের সাথে বলেন, চুপ কর। খোদার কসম! আমার ঘোড়ার খুর যদি ভালো থাকতো তাহলে আমি বলে দিতাম, খ্রিস্টানরা যেন সমপরিমাণ সৈন্য আরো বৃদ্ধি করে। মোটকথা খ্রিস্টানরা প্রচণ্ড উদ্দীপনা নিয়ে আক্রমণ করে এবং তিরের বৃষ্টি বর্ষণ করে সামনে এগিয়ে আসে। মুসলমানরা অনেকক্ষণ অবিচল থাকে কিন্তু এত প্রকট আক্রমণ ছিল যে, মুসলমান সৈন্যবাহিনীর ডান পাশের উইং বিচ্ছিন্ন হয়ে সৈন্যবাহিনী থেকে আলাদা হয়ে যায় আর তারা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটে যায়। ছত্রভঙ্গ পরাজিত এই দলটি পিছু হটতে হটতে মহিলাদের তাবুর কাছে গিয়ে পৌঁছে। মহিলারা মুসলমানদের এই অবস্থা দেখে চরম রাগান্বিত হয় আর তাবুর কাঠ-খড়ি উঠিয়ে হাতে নেয় এবং বলে যে, অকৃতকার্যের দল! এদিকে আসলে এই কাঠ-খড়ি দিয়ে তোমাদের মাথা ফাটিয়ে দিব। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা লাঠি হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন তার সাথে অন্যান্য মহিলারাও তার অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে আসে। হিন্দা আবু সুফিয়ানকে পলায়ন করতে দেখে তার ঘোড়ার মুখে চোখা খুঁটির আঘাত মেরে বলে যে, কোথায় যাচ্ছ? ফিরে আস আর যুদ্ধক্ষেত্রে যাও। একইভাবে এক রেওয়ায়েত অনুযায়ী, হিন্দা লাঠি হাতে নিয়ে আবু সুফিয়ানের দিকে যায় এবং বলে, খোদার কসম! তুমি সত্য ধর্মের বিরোধিতা করায় এবং খোদার সত্য রসূলকে অস্বীকার করায় খুবই কঠোর ছিলে। সত্য ধর্মের নাম সমুন্নত করা এবং আল্লাহ্র রসূলের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজ প্রাণ উৎসর্গ করা ও খোদার দৃষ্টিতে সফলকাম হওয়ার আজই সুবর্ণ সুযোগ। আবু সুফিয়ানের আত্মসম্মানবোধে প্রচÐ আঘাত আসে আর উল্টোপায়ে হাতে নগ্ন তরবারি নিয়ে পঙ্গপালসদৃশ শক্রসেনার মাঝে ঢুকে যায়। আরেকজন সাহসী নারী যার নাম ছিল খওলা। তিনি এই পঙক্তি পাঠ করে মুসলিম সেনাবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করতেন যে,
হে মুত্তাকী নারীদের ছেড়ে পলায়নকারী! অচিরেই তুমি তাদেরকে বন্দী দেখতে পাবে। তারা উন্নত মর্যাদাশালী হবে না আর তারাও পছন্দনীয় হবে না। এই অবস্থা দেখে হযরত মুয়ায বিন জাবল যিনি সৈন্যবাহিনীর ডান দিকের এক অংশের সেনাপতি ছিলেন নিজ ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং বলেন, আমি পদাতিক হিসাবেই যুদ্ধ করবো কিন্তু কোন বাহাদুর যদি এই ঘোড়ার প্রতি সুবিচার করতে পারে তবে ঘোড়া উপস্থিত আছে। তার ছেলে বলল, হ্যাঁ আমি এ দায়িত্ব পালন করবো। কেননা আমি আরোহী অবস্থায় ভালো যুদ্ধ করতে পারি। অবশেষে পিতা পুত্র উভয়েই সৈন্যদের মাঝে ঢুকে যান আর এমন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে যে, মুসলমানদের দোদুল্যমান পা সুদৃঢ় হয়ে যায়। সেই সাথে যবায়দা গোত্রের নেতা হিজাজ পাঁচশত সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হয় এবং যে খ্রিস্টানরা মুসলমানদের পিছু ধাওয়া করছিল তাদেরকে থামিয়ে দেয়। সেনাবাহিনীর ডান দিকে আযদ গোত্র আক্রমণের সূচনা থেকেই অবিচল ছিল। খ্রিস্টানরা যুদ্ধে পুরো শক্তি তাদের পেছনে লাগিয়ে দেয় কিন্তু তারা পর্বতের ন্যায় অবিচল থাকে। এমন ঘোরতর যুদ্ধ হচ্ছিল যে, সেনাবাহিনীর চতুর্দিকে মাথা, হাত, বাহু প্রভৃতি কর্তিত হয়ে একের পর এক ঝরছিল কিন্তু মুসলমানদের অবিচলতায় কোন চিড় ধরে নি। আমর বিন তোফায়েল যিনি গোত্রের নেতা ছিলেন তরবারি দিয়ে আঘাত করছিলেন আর হুঙ্কার দিচ্ছিলেন যে, আযদীরা দেখো, তোমাদের কারণে মুসলমানদের ওপর যেন কলঙ্ক লেপিত না হয়। বিশিষ্ট নয়জন বীর সৈনিক তার হাতে নিহত হয় এবং অবশেষে তিনি নিজেও শহীদ হয়ে যান।
হযরত খালিদ তার বাহিনীকে পেছনে লাগিয়ে রেখেছিলেন। অকস্মাৎ বুহ্য ভেদ করে তারা বাইরে বেরিয়ে আসে এবং এত প্রবল আক্রমণ হানে যে, রোমানদের সারিসমূহের শৃংখলা নষ্ট করে দেয়। আবু জাহলের পুত্র ইকরামা ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে আসেন আর বললেন, হে খ্রিষ্টানেরা! আমি এক সময় আমার অবিশ্বাসের যুগে রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বিপক্ষে লড়াই করেছি। এখন তোমাদের প্রতিদ্বন্দ্বতায় আমি পশ্চাদপসরণ করবো এটি কী কোনভাবে সম্ভব? এটি বলে সৈন্যবাহিনীর দিকে তাকালেন এবং বললেন, মৃত্যুর শর্তে কে বয়আত করতে চায়? চারশত ব্যক্তি যাদের মাঝে যিরার বিন আযাদও ছিলেন মৃত্যুর শর্তে বয়আত করলেন এবং এতটা অবিচলতার সাথে লড়াই করেন যে, প্রায় সকলেই সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইকরামার মৃতদেহ লাশের স্তুপে পাওয়া যায়। তখনো কিছুটা শ্বাসপ্রশ্বাস চলছিল, খালিদ নিজ উরুতে তার মাথা রাখেন এবং মুখে সামান্য পানি ঢেলে বলেন, খোদার কসম! উমর (রা.)-এর ধারণা ভুল ছিল যে, আমরা শহীদের মৃত্যু মরব না। মোটকথা ইকরামা এবং তার সাথী যদিও মৃত্যুবরণ করেছেন কিন্তু রোমানদের সহস্র সহস্র লোককে হত্যা করেছেন। খালিদের আক্রমণ তাদের শক্তি আরো চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়, এমনকি শেষ পর্যন্ত তাদেরকে পিছু হটতে হয় আর খালিদ তাদের পিছু হটাতে হটাতে সেনাপ্রধান দুরানজারের কাছে পৌঁছে যায়। দুরানজার ও রোমান সেনা অফিসাররা চোখে রুমাল বেধে দেয় যেন এই চোখ বিজয় প্রত্যক্ষ না করলে পরাজয়ও যেন অবলোকন না করে। ঠিক সেই সময় যখন ডান বাহুতে চরম যুদ্ধ হচ্ছিল তখন রোমানদের ডান উইং-এর সর্দার ইবনে কানাতির মুসলিম বাহিনীর বাম বাহুর ওপর আক্রমণ করল।
দুর্ভাগ্যবশত এই অংশে অধিকাংশ লাহাম ও গুসসান গোত্রের লোক ছিল যারা সিরিয়ার বিভিন্ন দিকে বসবাস করত এবং এক সময় পর্যন্ত রোমানদের কর দিত। রোমানদেরকে ট্যাক্স দিত। তাই রোমানভীতি যা তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল ছিল তার এমন প্রভাব পড়ে যে, প্রথম আক্রমণেই তাদের পা ভড়কে যায়। মুসলমান হওয়া সত্তে¡ও সেই পুরোনো ত্রাস বিদ্যমান ছিল। এতে ভীত হয়ে তাদের পা ভড়কে যায়। কিন্তু যাহোক অফিসাররা সাহস দেখায়। যদি অফিসাররা ভীতি প্রকাশ করত তাহলে লড়াই সেখানেই শেষ হয়ে যেত। রোমানরা ধাওয়া করতে করতে শিবিরের কাছে পৌঁছে যায়। মহিলারা এই অবস্থা দেখে অবলীলায় বেরিয়ে আসে এবং তাদের সাহসিকতা খ্রিষ্টানদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়। সেনাবাহিনীর শৃংখলা যদিও হারিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অফিসারদের মধ্যে কুবাস বিন আশিয়াম, সাইদ বিন যায়েদ, ইয়াযিদ বিন আবি সুফিয়ান, আমর বিন আস, শারাহবিল বিন হাসানা প্রমুখ বীরত্বের প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। কুবাসের হাত থেকে তরবারি এবং বর্শা ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছিল, কিন্তু তার অবিচলতায় এতটুকু চিড় ধরতো না। বর্শা ভেঙ্গে পড়ে গেলে বলতেন, কেউ আছে কি যে সে ব্যক্তিকে অস্ত্র সরবরাহ করবে? যে খোদার সাথে অঙ্গীকার করেছে যে, সে রণক্ষেত্র থেকে বের হলে মরেই বের হবে। মানুষ দ্রæত তার হাতে তরবারি বা বর্শা এনে দিত এবং এরপর তিনি সিংহের ন্যায় ক্ষিপ্রগতিতে শত্রুদের উপর হামলে পড়তেন। আবুল আওয়ার ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন এবং নিজ অধীনস্ত সেনাবাহিনীকে সম্বোধন করে বললেন, ধৈর্য ও অবিচলতা পৃথিবীতে সম্মান বয়ে আনে এবং এর পরিণামে কৃপা রয়েছে। স্মরণ রেখ! এই সম্পদ যেন হাতছাড়া না হয়। সাইদ বিন যায়েদ রাগান্বিত হয়ে হাঁটুগেড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রোমানরা তার দিকে অগ্রসর হলে সিংহের ন্যায় আক্রমণ করেন এবং সামনের অফিসারকে মেরে ভূপাতিত করেন। মুয়াবিয়ার ভাই ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ান অনেক দৃঢ়তার সাথে লড়াই করছিলেন। ঘটনাচক্রে তার পিতা আবু সুফিয়ান যিনি সেনাদের উজ্জীবিত করছিলেন তার দিকে আসলেন এবং পুত্রকে দেখে বললেন, হে আমার পুত্র! এখন রণক্ষেত্রে প্রত্যেক সেনা বীরত্বের সাক্ষর রাখছে। তুমি সেনাপ্রধান আর সাধারণ সেনাদের তুলনায় বীরত্ব প্রদর্শনের দায়িত্ব তোমার বেশি। তোমার বাহিনীর কোন এক সৈন্যও যদি এই রণক্ষেত্রে তোমার চেয়ে অধিক নৈপুণ্য প্রদর্শন করলে তা তোমার জন্য লজ্জার কারণ হবে। শারাহবিলের অবস্থা ছিল, চতুর্দিক থেকে রোমান কর্তৃক পরিবেষ্টিত ছিলেন আর তিনি মাঝখানে পাহাড়ের ন্যায় দণ্ডায়মান ছিলেন এবং কুরআনের এই আয়াত পড়ছিলেন,
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ۚ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيَقْتُلُونَ وَيُقْتَلُونَ –
(সূরা তওবা: ১১১)
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’লা মু’মিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের ধন-সম্পদ এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছেন যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত; কেননা তারা আল্লাহ্’র পথে যুদ্ধ করে। সুতরাং হয় তারা আপন শত্রুদের হত্যা করে নতুবা স্বয়ং (শত্রুর হাতে) নিহত হয়। আর এই নারা বা শ্লোগান দিচ্ছিল যে, খোদার সাথে (যারা) ব্যবসা করতে চায় এবং (যারা) খোদার ছায়ায় থাকতে চায়, তারা কোথায়? এই ধ্বনি যে কানে পড়েছে সে-ই ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি উপড়ে পড়া সৈন্যবাহিনী পুনরায় সুসজ্জিত হয়ে যায় এবং শুরাহ্বিল তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এমন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন যে, রোমানরা, যারা যুদ্ধের ময়দানে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছিল, (তারা) থেমে যায়। এদিকে মুসলমান নারীরা তাদের তাঁবু থেকে বের হয়ে (মুসলিম) সৈন্যবাহিনীর পিছনে এসে দাঁড়ায় এবং চিৎকার করে বলতো যে, যদি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন কর তবে আমাদেরকে মুখ দেখাবে না। তখন পর্যন্ত উভয়পক্ষ সমানতালে যুদ্ধ করছিল, বরং জয়ের পাল্লা রোমানদের দিকেই অধিক ঝুঁকে ছিল। কায়েস বিন হুওয়াইরা, যাকে খালিদ সৈন্যবাহিনীর একাংশ দিয়ে বাম উইং-এর পিছনের অংশে নিযুক্ত করেছিল, তারা আকস্মিকভাবে পিছন দিক হতে বের হয়ে এরূপ প্রচন্ড আক্রমণ চালান যে রোমান নেতারা (এই আক্রমণ) প্রতিহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও তাদের সৈন্যবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ্য হয় নি। পুরো সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং বিচলিত হয়ে পিছু হটে যায়। একইসাথে সাঈদ বিন যায়েদ মাঝখান থেকে বের হয়ে আক্রমণ চালান। রোমানরা অনেক দূর পর্যন্ত পিছু হটতে থাকে, এমনকি মাঠের একপ্রান্তে যে নর্দমা ছিল তার কিনারায় চলে আসে। মুহূর্তের মধ্যে সেই নর্দমা তাদের লাশে পূর্ণ হয়ে যায় এবং যুদ্ধের ময়দান সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যায়। এভাবে আল্লাহ্ তা’লা মুসলমানদেরকে এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে মহান বিজয় দান করেন। এ যুদ্ধের এই ঘটনা স্মরণ রাখার যোগ্য যে, যখন প্রচন্ড যুদ্ধ হচ্ছিল তখন হাব্বাস বিন কায়েস, যিনি একজন সাহসী সৈনিক ছিলেন, প্রাণপনে লড়াই করে যাচ্ছিলেন, সে সময় তার পায়ে কেউ তরবারী দিয়ে আঘাত করে এবং এক পা কেঁটে গিয়ে পৃথক হয়ে যায়। হাব্বাস তা ঘুনাক্ষরেও অনুধাবন করতে পারে নি। কিছুক্ষণ পর যখন সম্বিত ফিরে পান তখন খুঁজে বেড়ান যে, আমার পায়ের কী হল? মনে পড়ল যে, দেখি তো আমার পা কোথায়, (অর্থাৎ) পায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, পা নেই। তার গোত্রের লোকেরা এই ঘটনার জন্য সর্বদা গর্ববোধ করতো। রোমানদের নিহতের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তাবারীর ও আযদীর মতে এই সংখ্যা লক্ষাধিক এবং বালাযুরী সত্তর হাজার বলে উল্লেখ করেছেন। মুসলমানদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা তিন হাজার, যাদের মধ্যে ছিলেন ইকরামা, যিরার বিন আযহার, হিশাম বিন আসী, আবান বিন সাঈদ প্রমুখ ছিলেন। রোমান সম্রাট সিজার আন্তাকিয়ায় থাকা অবস্থাতেই পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে তৎক্ষণাৎ কনস্টানটিনোপোল চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। যাওয়ার সময় সিরিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বিদায় হে সিরিয়া।’ আবু উবায়দা বিজয়ের সুসংবাদ দিয়ে হযরত উমর (রা.)-এর নিকট পত্র লিখেন এবং ছোট একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন, যাদের মধ্যে হুযায়ফা বিন ইয়ামান-ও ছিলেন। হযরত উমর (রা.) ইয়ারমুকের যুদ্ধের সংবাদপ্রাপ্তির অপেক্ষায় কয়েকদিন ধরে ঘুমান নি। বিজয়ের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে তিনি তৎক্ষণাত সিজদাবনত হন এবং খোদার নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
ইয়ারমুকের যুদ্ধের কারণে হিমস থেকে ইসলামী সেনাবাহিনীকে সাময়িকভাবে পিছু হটতে হয়েছিল, আর তাই তাদের কাছ থেকে নেয়া জিযিয়া ফেরত দিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই বিষয়টি হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এভাবে উল্লেখ করেছেন :
“সাহাবীরা যখন রোমান সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং অগ্রসর হতে হতে খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্থান জেরুজালেম করায়ত্ব করে নেয়, আর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন তখন খ্রিস্টানরা দেখল যে তাদের ধর্মীয় কেন্দ্রও মুসলমানদের করতলগত হয়ে যাচ্ছে। তাই তারা সেখান থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চূড়ান্ত চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানোর সংকল্প করে এবং চতুর্দিকে ধর্মীয় যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে খ্রিস্টানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে আর বিশাল সৈন্যবাহিনী একত্রিত করে ইসলামী সৈন্যবাহিনীর ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। রোমানদের এরূপ তীব্র আক্রমণের মুখে মুসলমান যাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই স্বল্প , সাময়িকভাবে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। আর ইসলামী সেনাপ্রধান হযরত উমর (রা.)- কে লিখেন, শত্রæদের সংখ্যা এত বিশাল এবং আমাদের সংখ্যা এতই নগণ্য যে তাদের সাথে লড়াইয়ে যাওয়া নিজ বাহিনীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার নামান্তর। কাজেই আপনি অনুমতি দিলে সঠিক রণপ্রস্তুতি এবং যুদ্ধক্ষেত্র ছোট করার উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনী পিছু হটে আসবে যাতে পুরো বাহিনীকে একত্র করে মোকাবিলা করা যায় আর একই সাথে লিখেন, যেসব অঞ্চল আমরা জয় করেছি সেখানকার মানুষের কাছ থেকে করও নিয়ে রেখেছি, এখন যদি আপনি এসব অঞ্চল ছেড়ে দেয়ার অনুমতি দেন তাহলে এটিও বলে দিবেন যে, এই কর সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কী? হযরত উমর (রা.) উত্তর দেন, যুদ্ধক্ষেত্র ছোট করতে এবং মুসলমানদের শক্তিকে সুসংহত করার জন্য পিছু হটা ইসলামী শিক্ষা বহির্ভূত নয় কিন্তু স্মরণ রাখবেন! এসব অঞ্চলের লোকদের কাছ থেকে এই শর্তে কর আদায় করা হয়েছিল যে, মুসলিম সেনাবাহিনী তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে। কিন্তু মুসলিম সেনাবাহিনী যখন পিছু হটবে তখন এর অর্থ হবে, তারা এসব অঞ্চলের নিরাপত্ত দিতে পারবে না। এজন্য যার কাছ থেকেই যা কিছু নেয়া হয়েছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। হযরত উমর (রা.)-এর এ নিদের্শ পৌঁছার পর মুসলিম সেনাপ্রধান সেসব অঞ্চলের দায়িত্বশীল লোক, ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য লোকদের ডেকে তাদের কাছ থেকে নেয়া অর্থ ফেরৎ দিয়ে দেন আর তাদেরকে বলেন, আপনাদের সুরক্ষার জন্য মুসলিম সেনাবাহিনী আপনাদের কাছ থেকে এই অর্থ নিয়েছিল কিন্তু এখন যেহেতু শত্রুর মোকাবিলায় নিজেদেরকে আমরা দুর্বল পাচ্ছি এবং কিছু দিনের জন্য সাময়িকভাবে পিছু হটে যাচ্ছি আর এজন্য আপনাদের নিরাপত্তা বিধান করতে পারছি না, তাই এসব অর্থ আমাদের কাছে রাখা সঙ্গত নয়। এটি এমন একটি দৃষ্টান্ত ছিল যা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কোন রাজা বাদশাহ দেখায় নি। কোন বাদশাহ যখন কোন অঞ্চল ছেড়ে দিয়ে চলে যায় তখন আদায়কৃত কর ও এধরণের জিনিস ফিরিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সেসব অঞ্চলে আরো লুটতরাজ চালায়। তারা মনে করে, এখন তো এসব অঞ্চল অন্যের হাতে চলে যাবে তাই আমরা এখান থেকে যতটা লাভবান হতে পারি হওয়া উচিত। এছাড়া তারা যেহেতু সেখানে থাকবে না, তাই দুর্নামেরও কোন ভয় থাকে না আর যদি কোন চরম পর্যায়ের সুশৃঙ্খল সরকার হয়ে থাকে তাহলে তারা সর্বোচ্চ যা করে তাহলে নীরবে সেনাবাহিনীকে পিছু হটিয়ে দেয় এবং খুব একটা লুটতরাজ করতে দেয় না। কিন্তু মুসলিম সেনাবাহিনী যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা পৃথিবীর সৃষ্টি অবধি কেবল হযরত উমর (রা.)-এর যুগেই দৃষ্টিগোচর হয়, বরং পরিতাপের বিষয় হলো পরবর্তী যুগও যদি এর সাথে যুক্ত করা হয় তবে এমন কোন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে পাওয়া যায় না যে, কোন বিজয়ী বাদশাহ কোন অঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার সময় সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা কর, জিযিয়া এবং অর্থসম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছে। খ্রিষ্টানদের ওপর এর এত গভীর প্রভাব পড়ে যে, যদিও তাদের স্বধর্মীয় সেনাবাহিনী অগ্রসর হচ্ছিল এবং হামলাকারী তাদের স্বজাতির জেনারেল , কর্ণেল ও সেনাকর্মকর্তা সমন্বয়ে ছিল আর সৈন্যরা তাদের ভাই ছিল; এছাড়াও এ যুদ্ধকে খ্রিষ্টানদের জন্য ধর্মীয় যুদ্ধে রূপ দেয়া হয়েছিল আর খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় কেন্দ্র যা তাদের হাত থেকে মুসলমানদের হাতে চলে গিয়েছিল এখন সেটির স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল তা সত্তে¡ও খ্রিষ্টান নারীপুরুষেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কেঁদে কেঁদে মুসলমানদের পুনরায় ফিরে আসার জন্য দোয়া করছিল।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) ইতিহাসের গভীর জ্ঞান রাখতেন। তিনি মনে করতেন, হযরত উমর (রা.) কে জিজ্ঞেস করেই পিছিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে এবং কর ও অর্থসম্পদ যা ছিল তা ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) হযরত ইকরামা (রা.) সম্পর্কে বলেন,
হযরত উমর (রা.)-এর যুগে ইয়ারমুকের যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাহাবীদের জীবন যখন সঙ্কটাপন্ন ছিল এবং বহু মুসলমান মারা যাচ্ছিল তখন মুসলিম বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হযরত আবু উবায়দা বিনুল জারাহ্ বলেন, আমি চাই এমন কিছু বীর যোদ্ধা বেরিয়ে আসুক যারা সংখ্যায় কম হলেও জীবন বাজি রেখে রোমান সেনাবাহিনীর মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করবে। তখন হযরত ইকরামা (রা.) সামনে এগিয়ে এসে হযরত আবু উবায়দা (রা.)-এর নিকট নিবেদন করেন, আমাকে আমার মর্জি মত কিছু মানুষ নির্বাচন করতে দিন। আমি সেই লোকদের সাথে নিয়ে শত্রু সেনার মূলকেন্দ্রে আক্রমণ করব এবং চেষ্টা করব আর তাদের জেনারেলকে হত্যা করার চেষ্টা করব। সে সময় রোমান বাহিনীর জেনারেল খুব আক্রমনাত্মকভাবে লড়াই করছিল আর বাদশাহ তার সাথে ওয়াদা করেছিল যে, যদি সে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারে তবে সে তার কাছে তার মেয়ে দিবে এবং তার অর্ধেক রাজ্য তার নামে লিখে দিবে। এই লালসার কারণে সে খুবই উত্তেজিত ও উজ্জীবিত ছিল আর নিজস্ব ও শাহী সেনাদল নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়েছিল, এছাড়া সে সৈন্যদের সাথে বড় অঙ্কের প্রতিশ্রুতিও দিয়ে রেখেছিল। তাই রোমান বাহিনীও প্রাণপণ যুদ্ধ করছিল। রোমান সেনাবাহিনী যখন মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করে তখন সেই জেনারেল সৈন্যবাহিনীর মূলকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছিল। হযরত ইকরামা চারশত লোক নিয়ে সেনাবাহিনীর ঠিক কেন্দ্র বরাবর আক্রমণ করে এবং তার সাথীদের মধ্যে হতে একজন সেই জেনারেলের ওপর আক্রমণ করে তাকে ভূ-পাতিত করে। অপর দিকে ছিল লক্ষাধিক সৈন্য ছিল কিন্তু এরা ছিলেন মাত্র চারশত জন মুসলমান। এ কারণে মোকাবিলা করা সহজ ছিল না। এই জেনালেরকে তো তারা হত্যা করেন আর তার মৃত্যুর ফলে সেনাবাহিনীও বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু শত্রুর এদের ওপর হামলে পড়ে, ফলে অল্প কয়েকজন ছাড়া বাকি সবাই শহীদ হয়ে যান। এদের মধ্যে বারোজন গুরুতর আহত ছিলেন। মুসলিম বাহিনীর বিজয় অর্জনের পর এসব লোকের সন্ধান করা আরম্ভ হয়। এই বারোজন আহত লোকের মাঝে হযরত ইকরামাও ছিলেন। এক মুসলিম সৈনিক তার কাছে আসে, তখন তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিল। সে বলে, ইকরামা আমার কাছে পানির মশক আছে, তুমি একটু পানি পান করে নাও। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, কাছেই হযরত আব্বাসের পুত্র ফযল পড়ে ছিলেন। তিনিও গুরুতর আহত ছিলেন। ইকরামা বলেন, আমার আত্মাভিমান এটি সহ্য করতে পারে না যে, আমি যখন রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ঘোর বিরোধী ছিলাম তখন যারা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন আজ তারা এবং তাদের সন্তানরা পিপাসায় মৃত্যুবরণ করবে আর আমি পানি পান করে জীবিত থাকব। প্রথমে তাদেরকে পানি পান করাও। এরপর কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা আমার কাছে নিয়ে এসো। সুতরাং সেই মুসলমান ফযলের কাছে যায়, কিন্তু তিনি আরেক আহত ব্যক্তিকে দেখিয়ে দিয়ে বলেন, প্রথমে তাকে পান করাও, কেননা আমার চেয়েও তার বেশি প্রয়োজন। তখন সে পরবর্তী আহত ব্যক্তির নিকট গেলে সে তাকে বলে, আমার চেয়ে তার দরকার বেশি, আগে তাকে পান করাও। এভাবে সে যে সৈন্যের কাছেই যায় সে তাকে আরেকজনের কাছে পাঠিয়ে দেয় আর কেউই পানি পান করে নি। সে যখন শেষ আহত ব্যক্তির কাছে যায় তখন সে মৃত্যুবরণ করেছিল। তাই সে যখন ইকরামার কাছে ফিরে যায় ততক্ষণে তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। অবশিষ্ট আহতদের অবস্থাও একই হয়েছিল। যার কাছেই সে যায় তাকে মৃত পায়। এটি ছিল এই যুদ্ধের ফলাফল। আল্লাহ্ তা’লা এভাবে বিজয় দান করেন। যাহোক এই স্মৃতিচারণ এখনো চলছে আর ভবিষ্যতেও অব্যহত থাকবে ইনশাআল্লাহ্।