23 Oct শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত উমর (রা.) জুমুআর খুতবা ১৫ অক্টোবর ২০২১
যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ১৫ অক্টোবর, ২০২১ মোতাবেক ১৫ ইখা, ১৪০০ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা
তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন,
হযরত উমর (রা.)’র শাহাদতের ঘটনা গত খুতবায় বর্ণিত হয়েছিল। এ সম্পর্কে বর্ণনা করার মতো আরো কিছু কথা রয়েছে। সহীহ্ বুখারীর যে রেওয়ায়েতটি শোনানো হয়েছিল তা থেকে এটি বুঝা যায় যে, হযরত উমর (রা.)’র ওপর আক্রমণের অব্যবহিত পরেই ফজরের নামায পড়ে নেয়া হয়েছিল আর হযরত উমর (রা.) তখন মসজিদেই ছিলেন। যেখানে কিনা অন্যান্য রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তাৎক্ষণিকভাবে হযরত উমর (রা.)-কে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় আর নামায পরে আদায় করা হয়। যেমনটি সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকারী আল্লামা ইবনে হাজর এই রেওয়ায়েতের নীচে অপর একটি রেওয়ায়েত লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে লিখেন যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন হযরত উমর (রা.)’র অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে থাকে আর তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন তখন আমি মানুষের সাহায্য নিয়ে তাঁকে ঘরে পৌঁছে দেই। প্রভাতের আলো পরিস্কার ভাবে ফুঠে উঠা পর্যন্ত তিনি অচেতন ছিলেন। জ্ঞান ফিরে আসলে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, মানুষ কি নামায পড়ে নিয়েছে? তখন আমি নিবেদন করি, জ্বী, হ্যাঁ। তখন তিনি বলেন, তার ইসলাম ইসলাম নয় যে নামায পরিত্যাগ করেছে। এরপর তিনি ওযু করেন এবং নামায পড়েন। এছাড়া তাবাকাতে কুবরাতেও এটিই বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত উমর (রা.)-কে তুলে বাড়িতে পৌঁছানো হয় আর হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) নামায পড়ান। সেইসাথে এটিও উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত আব্দুর রহমান (রা.) পবিত্র কুরআনের সবচেয়ে ছোট্ট দু’টি সূরা وَالْعَصْرِ এবং إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ পাঠ করেন। অন্যত্র وَالْعَصْرِ এবং قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ পড়ার উল্লেখ রয়েছে।
হযরত উমর (রা.)’র ঘাতকের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তাবাকাতে কুবরাতে লেখা হয়েছে যে, হযরত উমর (রা.)’র ওপর আক্রমণ হলে তিনি হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রা.)-কে বলেন, যাও এবং খোঁজ নাও যে, কে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে? হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, আমি বের হই এবং ঘরের দরজা খুললে মানুষকে সমবেত দেখতে পাই, যারা হযরত উমর (রা.)’র অবস্থা সম্পর্কে অনবহিত ছিল। আমি জিজ্ঞেস করি, কে আমীরুল মু’মিনীনকে খঞ্জরাঘাত করেছে? তারা বলে, আল্লাহ্র শত্রু আবু লুলু তাঁকে খঞ্জর মেরেছে, যে মুগীরা বিন শো’বা-র ক্রীতদাস। সে আরও লোককে আহত করেছে, কিন্তু যখন ধরা পড়ে তখন সেই একই খঞ্জর দিয়ে সে আত্মহত্যা করেছে। হযরত উমর (রা.)’র শাহাদত কি কোন ষড়যন্ত্রের ফলাফল ছিল নাকি সেই ব্যক্তির ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিল এ সম্পর্কে পরবর্তী কালের কতিপয় ঐতিহাসিক এটিও লিখেছেন যে, হযরত উমর (রা.)’র শাহাদতের কারণ কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা নয়, বরং এটি এক ষড়যন্ত্র ছিল। যাহোক আমরা দেখি যে, তাদের মতামত হলো, হযরত উমর (রা.)’র মতো বীর খলীফাকে যেভাবে শহীদ করা হয়েছে, সাধারণত আমরা দেখি যে, ঐতিহাসিক এবং জীবনীকারগণ শাহাদতের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করার পর নীরব হয়ে যান। এতে এই ধারণা জন্মে যে, আবু লুলু ফিরোয এক সাময়িক উত্তেজনা ও ক্রোধবশবর্তী হয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল। কিন্তু বর্তমান কালের কতিপয় ঐতিহাসিক ও জীবনীকারগণ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, এটি নিছক এক ব্যক্তির ক্রোধের কারণে ঘটিত প্রতিশোধমূলক কাজ হতে পারে না, বরং এটি এক ষড়যন্ত্র ছিল আর রীতিমতো পূর্বপরিকল্পিত এক ষড়যন্ত্রের অধীনে হযরত উমর (রা.)’কে হত্যা করা হয়েছিল। আর প্রসিদ্ধ ইরানী সেনাপতি হুরমুযান, যে কিনা তখন বাহ্যত মুসলমান হয়ে মদীনায় বসবাস করছিল, সে-ও এই ষড়যন্ত্রে অংশীদার ছিল। বর্তমান কালের এসব লেখকরা প্রাচীন ঐতিহাসিক ও জীবনীকারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যে, এটি যে একটি ষড়যন্ত্র ছিল, এমর্মে তারা কেন গুরুত্বপূর্ণ এই হত্যার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন নি? যদিও ইতিহাস ও জীবনী বিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’-তে কেবল এতটুকু পাওয়া যায় যে, সন্দেহ করা হয়, হযরত উমর (রা.)’র হত্যার পেছনে হুরমুযান এবং জুফাইনার হাত ছিল। অতএব, এই সন্দেহের ভিত্তিতেই হযরত উমর (রা.)’র জীবনীকার বিস্তারিত আলোচনা করতে গিয়ে এটিকে রীতিমতো এক ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়েছেন। এই লেখকদের মধ্য থেকেই একজন মুহাম্মদ রেযা সাহেব নিজ পুস্তক ‘সীরাত উমর ফারুক’-এ লিখেন, হযরত উমর (রা.) কোন প্রাপ্তবয়স্ক যুদ্ধবন্দীকে মদীনায় আসার অনুমতি প্রদান করতেন না। এমনকি কূফার গভর্নর হযরত মুগীরা বিন শো’বা, তাঁর নামে একটি পত্র লিখেন যে, তার কাছে একজন ক্রীতদাস রয়েছে যে খুবই কুশলী আর তিনি তাকে মদীনায় নিয়ে আসার অনুমতি প্রার্থনা করছেন। হযরত মুগীরা বিন শো’বা (রা.) বলেন, সে অনেক কাজ জানে যাতে মানুষের কল্যাণ হবে। সে কামার, কারুকার্যে দক্ষ, কাঠমিস্ত্রির কাজও জানে। হযরত উমর (রা.) হযরত মুগীরার নামে পত্র লিখেন এবং তিনি তাকে মদীনায় প্রেরণের অনুমতি প্রদান করেন। হযরত মুগীরা তার জন্য মাসিক একশত দিরহাম কর নির্ধারণ করেন। সে হযরত উমর (রা.)’র সমীপে উপস্থিত হয় এবং অভিযোগ করে যে, তার ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করা হয়েছে। হযরত উমর (রা.) জিজ্ঞেস করেন, তুমি কোন কোন কাজ ভালোভাবে করতে পার? সে তাঁকে সেসব কাজের কথা বলে যেগুলোতে সে খুবই দক্ষ ছিল। হযরত উমর (রা.) বলেন, তোমার কাজের দক্ষতার নিরিখে তোমার কর খুব একটা বেশি নয়। সে তখন তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায়। স্বল্পকাল পর একদিন সেই একই ক্রীতদাস হযরত উমর (রা.)’র পাশ দিয়ে গেলে তিনি তাকে ডেকে বলেন, আমি জানতে পেরেছি, তুমি বায়ুচালিত চাক্কি খুব ভালো বানাতে পার। সেই ক্রীতদাস ক্রোধ এবং ঘৃণার সাথে হযরত উমর (রা.)’র প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে এবং বলে, আমি আপনার জন্য এমন এক চাক্কি বানাব যে, মানুষ তা সম্পর্কে বলাবলি করে বেড়াবে। সেই ক্রীতদাস যখন ফিরে যায় তখন তিনি (রা.) তাঁর সাথে থাকা সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, এই ক্রীতদাস এইমাত্র আমাকে হুমকি দিয়েছে। কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আবু লুলু নিজ চাদরে লুকিয়ে রাখা দু’ধারী চাকু দ্বারা হযরত উমর (রা.)’র ওপর আক্রমণ করে যার বাট তার হাতে ছিল, যেমনটি শাহাদতের ঘটনায় বর্ণিত হয়েছে। তার একটি আঘাত নাভির নীচে লেগেছিল। একদিক থেকে হযরত উমর (রা.)’র প্রতি আবু লুলু’র বিদ্বেষ এবং ঘৃণাও ছিল, কেননা আরবরা তার অঞ্চল জয় করে নিয়েছিল এবং তাকে যুদ্ধবন্দি বানিয়েছিল আর তার বাদশাহ্কে অপমানিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায় দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল। সে যখনই যুদ্ধবন্দি কোন ছোট্ট শিশুকে দেখতো, তখন তাদের কাছে গিয়ে তাদের মাথায় হাত বুলাতো এবং কেঁদে কেঁদে বলতো, আরবরা আমার প্রিয়দের হত্যা করেছে। যখন আবু লুলু হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করার দৃঢ় সংকল্প করে, তখন সে খুব যত্নের সাথে দু’ধারী খঞ্জর বানায়, সেটিকে ধার দেয়, এরপর সেটিকে বিষাক্ত করে, অতঃপর তা নিয়ে হুরমুযান-এর কাছে যায় এবং বলে, এই খঞ্জর সম্পর্কে তোমার ধারণা কী? সে বলে, আমার ধারণা হলো, তুমি এর মাধ্যমে যার ওপরই আক্রমণ করবে, তাকে হত্যা করবে। হুরমুযান পারস্যবাসীদের সেনাপ্রধানদের একজন ছিল। মুসলমানরা তাকে তুসতার নামক স্থানে বন্দি করেছিল এবং মদীনায় প্রেরণ করেছিল। সে যখন হযরত উমর (রা.)-কে দেখে তখন জিজ্ঞেস করে, তাঁর দেহরক্ষী দারোয়ান কোথায়? যেমনটি পূর্বে বর্ণিত হয়েছে। সাহাবীগণ রিযওয়ানুল্লাহ্ আলাইহিম বলেন, তাঁর কোন দেহরক্ষী নেই, কোন দারোয়ান নেই, কোন সেক্রেটারী নেই, কোন দরবারও নেই। তখন সে বলে, তাঁর তো নবী হওয়া উচিত। যাহোক, এরপর সে মুসলমান হয়ে যায় আর হযরত উমর (রা.) তার ভাতা দু’ হাজার (দেরহাম) নির্ধারণ করেন এবং তাকে মদীনায় বসবাসের অনুমতি দেন।
তাবাকাত ইবনে সা’দ পুস্তকে নাফে’র বরাতে একটি রেওয়ায়েত রয়েছে যে, হযরত আব্দুর রহমান সেই ছুরি দেখেছিলেন যার মাধ্যমে হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমি গতকাল এই ছুরিটি হুরমুযান ও জুফাইনার কাছে দেখেছিলাম, তখন আমি তাদেরকে জিজ্ঞস করি যে, তোমরা এই ছুরি দিয়ে কি কর? তখন তারা উভয়ে বলে, আমরা এটি দিয়ে মাংস কাটি, কেননা আমরা মাংস স্পর্শ করি না। এ কথা শুনে হযরত উবায়দুল্লাহ্ বিন উমর হযরত আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি এই ছুরিটি তাদের দু’জনের কাছে দেখেছিলেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ। অতএব, হযরত উবায়দুল্লাহ্ বিন উমর নিজ তরবারি হাতে তুলে নেন এবং উভয়ের কাছে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করেন। হযরত উসমান (রা.) হযরত উবায়দুল্লাহ্কে ডেকে পাঠান। যখন তিনি (অর্থাৎ উবায়দুল্লাহ্) তাঁর (অর্থাৎ হযরত উসমানের) কাছে আসেন, তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন, উক্ত দুই ব্যক্তিকে হত্যা করতে কোন বিষয়টি আপনাকে প্ররোচিত করেছে, যখন কিনা তারা দু’জনই আমাদের নিরাপত্তায় ছিল? এ কথা শুনতেই হযরত উবায়দুল্লাহ্, হযরত উসমান (রা.)-কে ধরে মাটিতে ফেলে দেন, এমনকি লোকজন এগিয়ে আসে এবং তারা হযরত উসমান (রা.)-কে, হযরত উবায়দুল্লাহ্র হাত থেকে রক্ষা করে। যখন হযরত উসমান (রা.) তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তখন তিনি অর্থাৎ হযরত উবায়দুল্লাহ্ তরবারি গলায় ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু হযরত অব্দুর রহমান (রা.) তাকে কঠোরভাবে বলেন যে, তুমি এটি (তরবারি) নামিয়ে রাখ, তখন তিনি তরবারি নামিয়ে রাখেন। এ রেওয়ায়েতটি অর্থাৎ, হযরত উসমান (রা.)-কে ভূপাতিত করা সংক্রান্ত ঘটনা কতটুকু সঠিক তা আল্লাহ্ তা’লাই ভালো জানেন।
সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব বর্ণনা করেন যে, যখন হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করা হয়, হযরত আব্দুর রহমান বিন আবি বকর বলেন, আমি হযরত উমর (রা.)’র ঘাতক আবু লুলু’র পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম সেখানে জুফাইনা এবং হুরমুযান-ও তার সাথে ছিল আর তারা ফিসফিস করে কথা বলছিল। আমি আচমকা তাদের কাছে পৌঁছলে তারা দৌড়ে পালাতে আরম্ভ করে আর একটি ছুরি তাদের মাঝে পড়ে যায়। এর দু’টি ফলা ছিল, আর এর বাট ছিল মাঝখানে। একটু দেখ, যে ছুরি দিয়ে হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছে সেটি কেমন ছিল? অতএব তারা দেখলো যে, সেই ছুরিটি হুবহু তেমনই ছিল যেমনটি হযরত আব্দুর রহমান বিন আবি বকর বর্ণনা করেছিলেন। হযরত উবায়দুল্লাহ্ বিন উমর যখন হযরত আব্দুর রহমান বিন আবি বকরের কাছে একথা শুনেন তখন তিনি তরবারি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, আর হুরমুযানকে ডাকেন। যখন সে (অর্থাৎ হুরমুযান) তার কাছে আসে তখন তিনি তাকে বলেন, আমার সাথে চল, আমরা আমার ঘোড়া দেখতে যাব, এবং নিজে তার পেছনে হাঁটতে থাকেন। যখন সে তার সম্মুখে হাঁটতে থাকে তখন তিনি তার (অর্থাৎ হুরমুযানের) ওপর তরবারি দিয়ে আঘাত করেন। হযরত উবায়দুল্লাহ্ বিন উমর বর্ণনা করেন, যখন সে তরবারির তীক্ষèতা অনুভব করে তখন সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ পাঠ করে। হযরত উবায়দুল্লাহ্ বলেন, এরপর আমি জুফাইনাকে ডাকি। সে হীরার খ্রিষ্টানদের একজন খ্রিষ্টান ছিল আর সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাসের সাহায্যকারী ছিল। তিনি তাকে চুক্তির অধীনে মদীনায় প্রেরণ করেছিলেন যা কিনা তার ও জুফাইনা’র মাঝে সম্পাদিত হয়েছিল। সে মদীনায় লেখা শেখাত। যখন আমি তাকে তরবারি দিয়ে আঘাত করি তখন সে তার চোখের সামনে ক্রুশের চিহ্ন আঁকে। অতঃপর হযরত উবায়দুল্লাহ্ সামনে অগ্রসর হন এবং আবু লুলু’র কন্যাকেও হত্যা করেন, যে মুসলমান হবার দাবি করত। হযরত উবায়দুল্লাহ্র সংকল্প ছিল যে, আজ তিনি মদীনার বুকে কোন কয়েদি বা যুদ্ধবন্দিকে জীবিত রাখবেন না। মুহাজিররা তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে বাধা দেয় এবং তাকে সাবধান করেন। তখন তিনি বলেন, আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তাদেরকে হত্যা করব আর তিনি মুহাজিরদেরও সমীহ করেন নি। এমনকি হযরত আমর বিন আস (রা.) তার সাথে অনবরত কথা বলতে থাকেন যতক্ষণ না তিনি হযরত আমর বিন আস (রা.)-এর কাছে তরবারি সমর্পণ করেন। অতঃপর হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.) তার কাছে আসেন। তখন তারা দু’জন একে অপরের ললাটের চুল ধরে ফেলেন। মোটকথা তিনি হুরমুযান, জুফাইনা ও আবু লুলু’র কন্যাকে হত্যা করেন।
এখন সকল বিষয় এ বিতর্কে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, হযরত উমর (রা.)-কে হত্যা করতে যে ব্যক্তি আবু লুলু’কে উস্কানি দিয়েছিল আর আমাদের কাছে যেসব রেওয়ায়েত রয়েছেÑ সেগুলো এই কথার প্রমাণ বহন করে যে, হযরত উমর (রা.)’র হত্যা একটি (গভীর) ষড়যন্ত্র ছিল। এই লেখক লিখেছেন (এবং) যিনি এ কথার পক্ষে যে, এটি এক (পূর্বপরিকল্পিত) ষড়যন্ত্র ছিল।
এসব ষড়যন্ত্রের হোতা ছিল হুরমুযান। সে হযরত উমর (রা.)’র বিরুদ্ধে আবু লুলু’র হিংসা-বিদ্বেষ আরও উস্কে দেয়। তারা উভয়ে ছিল অনারব। এছাড়া হুরমুযানকে যখন বন্দী করা হয় এবং তাকে মদীনা প্রেরণ করা হয় তখন সে এই আশংকার বশবর্তী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে যে, খলীফা তাকে হত্যা করবেন। তাবাকাত ইবনে সা’দ-এ নাফে’র রেওয়ায়েতে উল্লিখিত আছে যে, আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) সেই ছুরিটি দেখেছিলেন যেটি দিয়ে হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছিল। তাবারীতে সাঈদ বিন মুসাইয়্যেবের বর্ণনায় উল্লিখিত আছে যে, আব্দুর রহমান বিন আবু বকর সেই খঞ্জর দেখেছিলেন যেটি আবু লুলু, জুফাইনা এবং হুরমুযানের মাঝে পড়ে গিয়েছিল, ঘটনাক্রমে তিনি (তথা আব্দুর রহমান বিন আবু বকর) হঠাৎ তাদের কাছে এসেছিলেন। হাঁটার সময় সেটি পড়ে গিয়েছিল। উবায়দুল্লাহ্ বিন উমর, হযরত আব্দুর রহমান বিন আবু বকরের কাছে একথা শুনতেই তাদের উভয়ের কাছে যান এবং তাদেরকে হত্যা করেন। কেবল তাদের উভয়কে হত্যা করেই ক্ষান্ত হন নি বরং তিনি প্রতিশোধের স্পৃহার কাছে পরাস্ত হয়ে আবু লুলু’র কন্যাকেও হত্যা করেন। সেই খঞ্জরটি, যেটির বিষয়ে হযরত আব্দুর রহমান বিন আবু বকর বলেছিলেন, তা অবিকল সেটিই ছিল যেটি দিয়ে হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছিল। হযরত উবায়দুল্লাহ্ বিন উমর যদি হুরমুযান এবং জুফাইনা’কে হত্যা করার ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি না করতেন তাহলে তাদের উভয়কে ঘটনার তদন্তের জন্য ডাকা যেতো এবং এভাবে ষড়যন্ত্রের রহস্য উন্মোচিত হতো। এসব বিষয় যদি দৃষ্টিপটে রাখা হয় তাহলে এ বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় বুঝা যায় যে, এটি ছিল ঠাণ্ডা
মাথায় পরিকল্পিত একটি ষড়যন্ত্র ছিল আর যে সেই ষড়যন্ত্রকে কার্যে রূপান্তর করেছে এবং হযরত উমর (রা.)-কে হত্যা করেছিল সে ছিল আবু লুলু। এ হত্যাকে যারা ষড়যন্ত্র মনে করে এটি তাদের মত।
এমনিভাবে আরেকজন জীবনীকার ড. মোহাম্মদ হোসেন হ্যায়কল নিজ পুস্তকে লিখেন, প্রকৃত ঘটনা হলো, মুসলমানরা যখন ইরানি ও খ্রিস্টানদের বিপক্ষে বিজয়ী হয় এবং সেসব দেশের শাসনব্যবস্থা নিজেদের হাতে তুলে নেয় আর ইরানের বাদশাহকে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করে পলায়নে বাধ্য করে, তখন থেকে ইরানি ইহুদী এবং খ্রিস্টানরা নিজেদের হৃদয়ে মোটের ওপর আরবদের বিরুদ্ধে এবং বিশেষত হযরত উমর (রা.)’র বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষের অগ্নি লুকিয়ে রেখে ছিল। তখন জনগণ পারস্পরিক কথাবার্তায় এই হিংসা-বিদ্বেষের উল্লেখও করেছিল। এছাড়া তাঁর ওপর আক্রমনকারী আবু লুলু একজন ইরানি, এটি জানার পর হযরত উমর (রা.)’র সেই কথাও তাদের মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, আমি তোমাদেরকে বারণ করতাম যে, আমাদের কাছে কোন বিধর্মীকে টেনে-হিঁচড়ে আনবে না, কিন্তু তোমরা আমার কথায় কর্ণপাত করো নি। মদীনায় অনারব বিধর্মীদের সংখ্যা স্বল্পই ছিল কিন্তু একটি দল ছিল তারা, যাদের হৃদয় ক্রোধ এবং প্রতিশোধের নেশায় পরিপূর্ণ ছিল, যাদের হৃদয়ে হিংসা-বিদ্বেষের আগুন প্রজ্জ্বলিত ছিল। হতে পারে এটি তাদেরই ষড়যন্ত্র ছিল আর হয়ত আবু লুলু’র উক্ত কৃতকর্ম সেই ষড়যন্ত্রের পরিণাম, যার জাল ঐসব ইসলামের শত্রুরা নিজেদের হিংসা-বিদ্বেষ এবং শত্রু তর পিপাসা নিবারণের জন্য বুনেছিল। আর তারা ভেবেছিল, এভাবে আরবদের একতা টুকরো টুকরো করে মুসলমানদের ক্ষমতা খর্ব করা যাবে। ঘটনার আসল রহস্য জানার জন্য হযরত উমর (রা.)’র পুত্ররা সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠিত ছিলেন। রহস্য উন্মোচন করে ঘটনার গভীরে তারা প্রবেশ করতে পারতেন যদি আবু লুলু ফিরোয আত্মহত্যা না করত কিন্তু সে আত্মহত্যা করে সেই রহস্য নিজের সাথে কবরে নিয়ে যায়। প্রশ্ন হলো এটিই কি বিষয়ের অবসান? এ রহস্য উদঘাটনের কি কোন উপায় নেই? এই লেখক যিনি এর রহস্য উদঘাটনের পক্ষে তিনি লিখেন, না বরং ঐশী তকদীর চেয়েছে যে, আরবের এক সর্দার সেই রহস্য সম্বন্ধে যেন অবগত হন এবং সেই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে পথ প্রদর্শন করেন। হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) যখন সেই ছুরিটি দেখেন যেটি দিয়ে হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছিল, তিনি বলেন, আমি গতকাল এই ছুরি হুরমুযান এবং জুফাইনার হাতে দেখেছিলাম। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- এই ছুরি দিয়ে কী করবে? তারা বলে, মাংস কাটব কেননা, আমরা মাংসে হাত লাগাই না আর হযরত আব্দুর রহমান বিন আবু বকর বলেন, আমি হযরত উমর (রা.)’র ঘাতক আবু লুলু’র পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জুফাইনা এবং হুরমুযান উভয়েই তার সাথে ছিল; তারা পরস্পর কানাঘুষা করছিল। হঠাৎ করে আমি তাদের কাছে গেলে তারা দৌড়ে পালায় আর অমনি ঘটনাচক্রে তাদের কাছে থাকা একটি দু’ধারী খঞ্জর পড়ে যার হাতলটি ছিল এর মধ্যবর্তী স্থানে। তিনি বলেন, ভালো করে দেখ তো! হযরত উমর (রা.)’র হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত খঞ্জরটি দেখতে কেমন? মানুষজন দেখল, হুবহু সেই খঞ্জরটি-ই; যেমনটি হযরত আব্দুর রহমান বিন আবু বকর বর্ণনা করেছেন। লেখক বলছেন, এ বিষয়ে তাই আর সংশয়-সন্দেহের মোটেও অবকাশ থাকে না। তাদের দু’জনের উভয়েই সত্য সাক্ষ্যদাতা বরং মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি আর সাক্ষ্য দিচ্ছেন, যে ছুরিটি দিয়ে হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করা হয় সেটি হুরমুযান এবং জুফাইনার কাছে ছিল। তাঁদের এক সাক্ষীর মতে, তিনি (রা.) হত্যাকারী আবু লুলু’কে হত্যাকান্ডের পূর্বে সেই দু’জনের সাথে চক্রান্ত করতে দেখেছেন আর উভয়ের মতে, এসব-ই ছিল সেই রাতের ঘটনা যার পরদিন ভোরবেলা হযরত উমর (রা.)’র ওপর আক্রমণ করা হয়। এতকিছুর পরেও কেউ কি এ বিষয়ে সন্দেহ করতে পারে যে, আমীরুল মু’মিনীন যে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন তার মূল নায়ক ছিল এই তিনজন। তবে এটিও হতে পারে যে, অন্য কোন ইরানী অথবা অন্যান্য জাতির ব্যক্তিবর্গ এতে জড়িত থাকতে পারে যাদের বিরুদ্ধে মুসলমানরা জয়যুক্ত হয়েছিল। হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) এবং হযরত আব্দুর রহমান বিন আবু বকরের সাক্ষ্য শোনামাত্রই হযরত উবায়দুল্লাহ্ বিন উমরের দৃষ্টিতে সমগ্র পৃথিবী রক্তে রঞ্জিত বলে মনে হলো। তাঁর হৃদয়ে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, মদীনা নগরীতে বসবাসরত সমস্ত অভিবাসীরা এই নেক্কারজনক ষড়যন্ত্রে শামিল এবং তাদের সবার হাত এ অপরাধের রক্তে রঞ্জিত। তিনি তৎক্ষণাৎ তরবারী ধারণ করেন এবং সর্বপ্রথমে হুরমুযান এবং জুফাইনা’কে শেষ করে দেন। রেওয়ায়েতে রয়েছে, তিনি প্রথমে হুরমুযানকে ডাকেন। সে যখন বেরিয়ে আসে তখন তিনি (রা.) বলেন, “আমার সাথে একটু আসো তো! আমার ঘোড়াটি দেখ এই বলে তিনি খানিকটা পিছনে সরে দাঁড়ান। সে যখন তার সম্মুখ দিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি তরবারী দিয়ে তাকে সজোরে আঘাত করেন। ইরানী সেই ব্যক্তি (অর্থাৎ হুরমুযান) যখন তরবারীর প্রখরতা অনুভব করে তখন সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে। রেওয়ায়েতে রয়েছে, হযরত উমর (রা.)’র পুত্র উবায়দুল্লাহ্ বিন উমর বলেন, অতঃপর আমি জুফাইনা’কে ডাকি। সে ছিল হিরা নগরীর একজন খ্রিস্টান এবং হযরত সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.)’র দুধভাই। এই আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণেই হযরত সা’দ (রা.) তাকে মদীনাতে নিয়ে এসেছিলেন যেখানে সে লোকদের পড়ালেখা শিখাতো। যখন আমি তরবারি দিয়ে তাকে আঘাত করি তখন সে তার দু’চোখের মধ্যবর্তী স্থানে ক্রুশের চিহ্ন আঁকে। হযরত আব্দুল্লাহ্’র অন্য ভাইও নিজ পিতৃহত্যার জেরে তার চেয়ে কোন অংশে কম উত্তেজিত ছিলেন না এবং সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রা.)।
যাহোক, তিনি (রা.) যা করেছেন এর কোন আইনি সনদ ছিল না। স্বয়ং প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে অথবা নিজের প্রাপ্য বুঝে নেয়ার জন্য দাঁড়ানোর কারও কোন অধিকার নেই। যেখানে বিষয়ের সিদ্ধান্ত মহানবী (সা.)-এর যুগে তিনি স্বয়ং এবং তাঁর তিরোধানের পর তাঁর খলীফাগণের জন্য নির্ধারিত ছিল। তারা মানুষের মাঝে ন্যায়সম্মত সিদ্ধান্ত দিতেন আর অপরাধীর বিরুদ্ধে কিসাসের সিদ্ধান্ত জারি করতেন। কাজেই হযরত উবায়দুল্লাহ্’র কর্তব্য ছিল তিনি (রা.) যখন সেই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে পারেন যার ফলে তাঁর পিতার প্রাণহানী ঘটে; আমীরুল মু’মিনীনের কাছে এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করা। তাঁর দৃষ্টিতে এটি যদি ষড়যন্ত্র বলে প্রতীয়মান হত তাহলে তিনি কিসাসের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেন বা প্রমাণিত না হলে অথবা এ বিষয়ে আমীরুল মু’মিনীনের হৃদয়ে কোন সন্দেহ সৃষ্টি হলে অর্থাৎ নতুন খলীফার হৃদয়ে সৃষ্ট সন্দেহের কারণে সে অনুপাতে দন্ড হ্রাস করতেন কিংবা এই রায় দিতেন যে, কেবল আবু লুলু’ই অপরাধী। মোটকথা, তিনি যা-ই করেছেন, আইনের দৃষ্টিতে এর কোন অধিকার ছিল না। সারকথা হলো, যদিও এটি একেবারে অমূলক নয় যে, এ হত্যাকান্ডটি রীতিমত ষড়যন্ত্র ছিল। কিন্তু সে সময়কার পরিস্থিতির দাবি অনুসারে হযরত উসমান (রা.) তৎক্ষণাত তদন্ত করাতে সক্ষম হন নি অথবা পরিস্থিতি যা-ই থাকুক না কেন, প্রাথমিক যুগের ঐতিহাসিকরা এই সম্পর্কে নীরব ছিলেন। এই যুগের কিছু ঐতিহাসিক লক্ষণাবলীর নিরিখে এ নিয়ে তর্ক করছে আর তাদের যুক্তিতে কিছুটা ওজন আছে বলেও মনে হয়। কেননা এই ষড়যন্ত্রকারীরা এখানেই থেমে থাকে নি। বরং পুনরায় হযরত উসমান (রা.)ও একই ধরণের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন। আর এ কারণে এই সন্দেহ আরও দৃঢ়তা পায় যে, ইসলামের ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও বিজয়কে প্রতিহত করার জন্য এবং নিজেদের প্রতিশোধের আগুন নিভানোর জন্য বহিঃশক্তির একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অধীনে হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করা হয়েছিল। বাকী আল্লাহ্ই ভালো জানেন।
সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমার পিতার ওপর যখন আক্রমন হয় তখন আমি তাঁর পাশে উপস্থিত ছিলাম। লোকেরা তাঁর প্রশংসা করেছিল এবং বলেছিল জাযাকাল্লাহু খাইরান। অর্থাৎ, আল্লাহ্ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। তিনি (রা.) বলেন, আমি আল্লাহ্কে ভালোবাসি এবং আমি ভয়ও করি। লোকেরা বলল, আপনি খলীফা নিযুক্ত করে দিন। তিনি (রা.) বলেন, আমি কি আমার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরও তোমাদের বোঝা বহন করব। আমার ভাগ সমান সমান হোক, এটিই আমি চাই। অর্থাৎ আমাকে যেন পাকড়াও করা না হয় আর আমি পুরস্কারও চাই না। যদি আমি কাউকে স্থলাভিষিক্ত করে যাই তাহলে তিনিও স্থলাভিষিক্ত বানিয়ে ছিলেন যিনি আমার থেকে উত্তম ছিলেন অর্থাৎ হযরত আবু বকর (রা.)। যদি স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করি তাহলে কোন ক্ষতি নেই। যদি আমি তোমাদেরকে কোন স্থলাভিষিক্ত নির্বাচন করা ছাড়াই রেখে যাই তাহলে যিনি আমার থেকে উত্তম ছিলেন তিনিও তোমাদেরকে স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করা ছাড়াই রেখে গিয়েছিলেন অর্থাৎ দ্বিতীয় উদাহরণ হযরত মহানবী (সা.)-এর দিয়েছিলেন তিনি (সা.) কোন স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেন নি। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) বলেন, যখন তিনি (রা.) মহানবী (সা.)-এর নাম উল্লেখ করেন তখন আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে, তিনি (রা.) স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করবেন না।
সহীহ্ মুসলিমের অন্য এক রেওয়ায়েতে রয়েছে হযরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমি হযরত হাফসা (রা.)’র কাছে যাই। তিনি বলেন, তুমি কি জান, তোমার পিতা স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করবেন না? তিনি (অর্থাৎ, ইবনে উমর) বলেন, আমি বললাম তিনি এমনটি করবেন না। তিনি অর্থাৎ হযরত হাফসা (রা.) বলেন, তিনি এমনটিই করবেন। তিনি (অর্থাৎ, ইবনে উমর) বলেন, আমি কসম খেয়ে বললাম, আমি হযরত উমর (রা.)’র সাথে পুনরায় কথা বলব। তিনি (অর্থাৎ, ইবনে উমর) বলেন যে, আমি সকাল পর্যন্ত নিরব থাকি আর তাঁর সাথে কোন কথা বলি নি। আমার অবস্থা এমন ছিল যে, আমি আমার শপথের কারণে পাহাড়সম বোঝা অনুভব করছিলাম। এরপর আমি ফিরে আসি এবং তাঁর (রা.) কাছে যাই। তিনি (রা.) আমার কাছে মানুষের কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। এরপর আমি তাঁকে হাফসা (রা.) যা বলেছিলেন তা বলি। এরপর আমি বলি, আমি লোকেদের একটি কথা বলতে শুনেছি আর আমি শপথ করে বলেছি যে, আমি আপনার কাছে সে কথা অবশ্যই বলব। মানুষের ধারণা হলো, আপনি স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করবেন না। বিষয় হলো, যদি কেউ আপনার উট বা বকরি দেখাশোনাকারী হয় আর সে সেগুলো ছেড়ে আপনার কাছে চলে আসে তাহলে আপনি দেখবেন যে, সে সেগুলো নষ্ট করেছে। অতএব, মানুষের তত্ত্বাবধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি (অর্থাৎ, ইবনে উমর) বলেন, হযরত উমর (রা.) আমার সাথে একমত হন এবং কিছুক্ষণের জন্য মাথা নত করেন। এরপর তিনি মাথা তুলেন আর আমার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলেন, মহান আল্লাহ্ নিজেই তাঁর ধর্মের সুরক্ষা করবেন। যদি আমি কাউকে খলীফা মনোনীত না করি তাতে কী হবে? মহানবী (সা.)-ও তো কাউকে খলীফা মনোনীত করেন নি। আর যদি আমি খলীফা মনোনীত করি সেক্ষেত্রে স্মরণ রাখবে হযরত আবু বকর (রা.) খলীফা মনোনীত করেছিলেন। ইবনে উমর তথা হযরত উমর (রা.)’র পুত্র বলেন, আল্লাহ্র শপথ! তিনি (রা.) যখন হযরত মহানবী (সা.)-এর নাম এবং হযরত আবু বকর (রা.)’র নাম উল্লেখ করেন তখন আমি বুঝে গিয়েছিলাম, তিনি (রা.) কাউকে মহানবী (সা.)-এর সমকক্ষ করবেন না এবং তিনি কাউকে স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করবেন না।
হযরত মেসওয়ার বিন মাখরামা (রা.) বর্ণনা করেন , হযরত উমর (রা.)-কে যখন আহত করা হয় তিনি বেদনায় বিমূঢ় ছিলেন হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁকে সান্ত¡না দেওয়ার ভঙ্গিমায় বলেন, আমীরুল মু’মিনীন! যদি এমনই হয়ে থাকে তাহলে আপনি তো মহানবী (সা.)-এর সাহচর্যে ছিলেন এবং অতি উত্তমরূপে আপনি তাঁর সঙ্গ দিয়েছেন। আর আপনি এমন অবস্থায় তাঁর থেকে পৃথক হয়েছেন যখন তিনি (সা.) আপনার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। অতঃপর আপনি হযরত আবু বকর (রা.)’র সাথেও ছিলেন আর অতি উত্তমরূপে তাঁর সঙ্গ দিয়েছেন। এরপর তাঁর থেকেও আপনি এমন অবস্থায় পৃথক হয়েছেন যখন তিনি (রা.) আপনার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন। এরপর আপনি তাঁদের সাহাবীদের সাথে ছিলেন আর আপনি অতি চমৎকারভাবে তাদের সঙ্গ দিয়েছেন, আজ যদি আপনি তাদের ছেড়ে যান তাহলে আপনি এমন অবস্থায় তাদের ছেড়ে যাবেন যখন তারা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট। হযরত উমর (রা.) বলেন, এই যে তুমি মহানবী (সা.)-এর সাহচর্য এবং তাঁর সন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করলে এটা আমার প্রতি কেবলমাত্র আল্লাহ্র অনুগ্রহ এবং তুমি যে হযরত আবু বকর (রা.)’র সাহচর্য ও তাঁর সন্তুষ্টির কথা বললে এটিও আমার প্রতি মহান আল্লাহ্র অপার অনুগ্রহ। আর তুমি যে আমার দুঃচিন্তা বা উদ্বেগ দেখছ এই উৎকণ্ঠা মূলত তোমার ও তোমার সঙ্গীদের জন্য। আমি আমার ব্যাপারে চিন্তিত নই বরং আমি তো তোমার ও তোমার সঙ্গীদের চিন্তা করছি। আল্লাহ্র কসম! আমার কাছে যদি পৃথিবীসম সোনাও থাকতো তবে আমি অবশ্যই তা ফিদিয়াস্বরূপ দিয়ে হলেও মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ্র শাস্তি দেখার পূর্বেই তা থেকে মুক্তি নিয়ে নিতাম।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا আয়াতের তফসীর করতে গিয়ে বলেন,
“খলীফারা এমন কোন বিপদের সম্মুখীন হন নি যেটিকে তারা ভয় পেয়েছেন। আর যদি এমন কোন বিপদ এসে থাকে তাহলে আল্লাহ্ সেটিকে শান্তি ও নিরাপত্তায় বদলে দিয়েছেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, হযরত উমর (রা.) শহীদ হয়ে গেছেন কিন্তু ঘটনা প্রবাহ দেখলে বুঝা যায়, এই শাহাদতের বিষয়ে হযরত উমর (রা.)’র কোন ভয়ই ছিল না বরং তিনি সবসময় দোয়া করতেন যে, ‘হে আল্লাহ! আমাকে শাহাদতের সৌভাগ্য দাও আর আমাকে মদীনাতেই শহীদ করো’। অতএব, যে ব্যক্তি তাঁর সারা জীবন এই দোয়া করে কাটান যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মদীনায় শাহাদতের সৌভাগ্য দিও, তিনি যদি শহীদও হয়ে যান তাহলে আমরা একথা কীভাবে বলতে পারি যে, তিনি এক ভীতিপ্রদ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন অথচ আল্লাহ্ এটিকে শান্তি ও নিরাপত্তায় রূপান্তরিত করেন নি। এতে সন্দেহ নেই, যদি হযরত উমর (রা.) শাহাদত বরণকে ভয় পেতেন আর তিনি শহীদ হয়ে যেতেন তাহলে বলা যেতে পারতো যে, তাঁর ভয়কে আল্লাহ্ শান্তি ও নিরাপত্তায় বদলে দেন নি। কিন্তু তিনি তো অনবরত দোয়া করতেন, হে আল্লাহ্ আমাকে মদীনায় শাহাদত দান কর। অতএব, তার শাহাদতবরণ থেকে একথা কীভাবে সাব্যস্ত হতে পারে যে, তিনি শাহাদত বরণকে ভয় পেতেন! যেক্ষেত্রে তিনি শাহাদত বরণকে ভয়ই পেতেন না বরং শাহাদত লাভের জন্য দোয়া করতেন যা আল্লাহ তা’লা গ্রহণ করেছেন সেক্ষেত্রে বুঝা গেল, এই আয়াত সংশ্লিষ্ট এমন কোন ভয়ের তিনি সম্মুখীন হন নি যেটিকে তাঁর হৃদয় অনুভব করেছেন আর এই আয়াতে যেমনটি আমি ইতোমধ্যে বলেছি, এটিই উল্লিখিত হয়েছে যে; খলীফারা যে বিষয়কে ভয় পাবেন তা কখনও সংঘটিত হতে পারে না আর আল্লাহ্ তা’লার প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, তিনি তাদের ভয়কে শান্তি ও নিরাপত্তায় বদলে দিবেন। কিন্তু কোন বিষয়কে খলীফা যখন ভয়ই পান না বরং সেটিকে নিজের সম্মান ও উন্নত পদমর্যাদার কারণ মনে করছেন সেক্ষেত্রে সেটিকে ভয় আখ্যা দিয়ে একথা বলা যে, এই ভয়কে কেন শান্তি ও নিরাপত্তায় বদলে দেয়া হলো না- অবান্তর কথা। এ বিষয়টিও বুঝার বিষয়।”
তিনি (রা.) বলেন, “আমি যখন হযরত উমর (রা.)’র উক্ত দোয়া পড়েছি তখন আমি মনে মনে বলেছি, বাহ্যত এ দোয়ার অর্থ ছিল, শত্রæ মদীনায় আক্রমন করবে এবং তার আক্রমন এত ভয়াবহ হবে যে, সব মুসলমান মারা যাবে এরপর তারা যুগ-খলীফার কাছে এসে তাঁকেও শহীদ করবে কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা হযরত উমর (রা.) দোয়াকেও কবুল করেছেন আর এমন উপকরণ বা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন যার ফলে ইসলামের সম্মান বজায় থেকেছে। বাস্তবে মদীনায় বহিরাগত কোন শত্রুর আক্রমণ না হয়ে মদীনার ভেতর থেকেই এক নোংরা ব্যক্তি দন্ডায়মান হয় এবং সে ছুরিকাঘাতে তাঁকে শহীদ করে দেয়।”
হযরত উমর (রা.)’র শাহাদতের ঘটনা এবং এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) ক্রীতদাস মুক্তি সম্পর্কে ইসলামী শিক্ষা উপস্থাপন করতঃ বলেন,
“সর্বপ্রথম এই নির্দেশ দিয়েছে যে, তোমরা অনুগ্রহ করে কোন মুক্তিপণ ছাড়াই তাদেরকে তথা ক্রীতদাসদের মুক্ত করে দাও। এরপর এটি বলেছে যে, এমনটি যদি না করতে পার তবে মুক্তিপণ পরিশোধ করে স্বাধীন করে দাও। আর যদি কোন ব্যক্তি এমন রয়ে যায় অর্থাৎ কোন দাস যদি নিজে মুক্তিপণ পরিশোধ করার সামর্থ্য না রাখে আর তার রাষ্ট্র অর্থাৎ যে দেশের সাথে তার সম্পর্ক সেই রাষ্ট্রের যদি তাকে স্বাধীন করার বিষয়ে কোন আগ্রহ না থাকে; আবার তার আত্মীয়স্বজনেরাও যদি ভ্রুক্ষেপহীন হয় তবে সে তোমাদের অনুমতি সাপেক্ষে কিস্তি আকারে মুক্তিপণ নির্ধারণ করাতে পারে। বন্দি নিজেও তার মুক্তিপণের কিস্তি নির্ধারণ করাতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে যতটুকু সে উপার্জন করবে, কিস্তির অংশ বাদ দিয়ে বাকীটা তারই প্রাপ্য হবে অর্থাৎ বাস্তবে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন হবে। অর্থাৎ সে যা আয় করবে তা থেকে সে মুক্ত হবার জন্য নির্ধারণকৃত কিস্তি প্রদান করবে এবং অবশিষ্ট অর্থ তারই থাকবে আর এটি এক ধরণের স্বাধীনতা বৈকি। হযরত উমর (রা.)-কে এমনই এক দাস হত্যা করেছিল যে মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি। সেই দাস যে মুসলমান ব্যক্তির নিকট থাকতো তাকে সে একদিন বলে, আমার এতটুকু সামর্থ্য আছে। আপনি আমার ওপর মুক্তিপণ নির্ধারণ করুন যা আমি মাসিক কিস্তি আকারে ধীরে ধীরে সবটুকু পরিশোধ করবো। তিনি অত্যন্ত সামান্য অংকের একটি কিস্তি নির্ধারণ করেন এবং সে তা পরিশোধ করতে থাকে। একবার হযরত উমর (রা.)’র কাছে সে অভিযোগ করে, আমার মালিক আমার ওপর মোটা অঙ্কের কিস্তি নির্ধারণ করে রেখেছে, তাই আপনি সেটি কমিয়ে দিন। হযরত উমর (রা.) তার আয়-উপার্জনের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেন, যতটুকু উপার্জন হওয়ার কথা ভেবে কিস্তি নির্ধারণ করা হয়েছিল তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সে আয় করে থাকে। হযরত উমর (রা.) এটি দেখে বলেন, এই পরিমাণ আয়ের বিপরীতে তোমার কিস্তি তো খুবই নগণ্য, তাই এরচেয়ে কমানো সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্তের কারণে সে ভীষণ রাগান্বিত হয় এবং সে ভাবে, আমি যেহেতু ইরানী তাই আমার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে আর আমার মালিক যেহেতু আরব তাই তাকে সমীহ করা হয়েছে। কাজেই, এই রাগের বশে পরের দিন সে তাঁর (রা.) ওপর খঞ্জরের আক্রমন করে এবং তিনি (রা.) সেই আঘাতের ফলে শহীদ হয়ে যান।”
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) আরও বলেন,
“পৃথিবীতে কেবল দু’টি জিনিস সততা থেকে দূরে ঠেলে দেয়, হয় চরম বিদ্বেষ নয়তো সীমাহীন ভালোবাসা। অনেক সময় একটি তুচ্ছ ঘটনা থেকেও চরম বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে যায়। হযরত উমর (রা.)’র সময়ে দেখ! কত সামান্য ঘটনা থেকে বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেয়েছে যা ইসলামী বিশ্বকে কত বড় ক্ষতির সম্মুখীন করেছে। আমি মনে করি, এ ঘটনার জের এখনো চলমান রয়েছে। হযরত উমর (রা.)’র যুগে তাঁর কাছে একটি মামলা উপস্থাপিত হয়। (বিষয় হলো,) কোন ব্যক্তির ক্রীতদাস আয় করতো অনেক কিন্তু তার মালিককে কম দিতো। হযরত উমর (রা.) এই ক্রীতদাসকে ডেকে বলেন, মালিককে বেশি প্রদান করো। সে সময় পেশাজীবি মানুষ কম ছিল তাই কামার এবং কাঠমিস্ত্রির খুব কদর ছিল। সেই ক্রীতদাস আটা পেষার চাক্কী বানাতো এবং এর ফলে সে ভালো আয়-রোজগার করতো। হযরত উমর (রা.) তার জন্য সাড়ে তিন আনা নির্ধারণ করে বলেন, মালিককে এই পরিমান দিবে। এটি খুবই সামান্য অঙ্ক কিন্তু তার ধারণা ছিল, হযরত উমর (রা.) ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এর ফলে তার হৃদয়ে বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। একবার হযরত উমর (রা.) তাকে বলেন, আমাকেও একটি চাক্কী বানিয়ে দাও। উত্তরে সে বলে, এমন চাক্কী বানিয়ে দিবো যা খুব ভালো চলবে। এটি শুনে কেউ একজন হযরত উমর (রা.)-কে বলে, আপনাকে হুমকি দিচ্ছে। পূর্বে বর্ণিত ঘটনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কিংবা একই ঘটনা এটি। মোটকথা, তারই ঘটনা এটি অর্থাৎ সেই ক্রীতদাসের। তিনি (রা.) বলেন, তার শব্দ থেকে এমনটি প্রকাশ পায় না। প্রথম রেওয়ায়েতে রয়েছে, হযরত উমর (রা.) নিজেই বলেছিলেন, সে হুমকি দিচ্ছে। সে বলে, তার কন্ঠ হুমকির সুর ছিল। অবশেষে একদিন উমর (রা.) নামায পড়ছিলেন, এমন সময় সেই দাস তাঁকে খঞ্জর দিয়ে হত্যা করে। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) লিখেন, সেই উমর (রা.) যিনি কোটি কোটি মানুষের বাদশাহ্ ছিলেন, যিনি বিশাল রাজত্বের শাসক ছিলেন, মুসলমানদের সর্বোত্তম পথপ্রদর্শক ছিলেন, তাঁকে মাত্র সাড়ে তিন আনার জন্য হত্যা করা হয়। কিন্তু বিষয় হলো, যাদের প্রকৃতিতে হিংসা ও বিদ্বেষ থাকে সে সাড়ে তিন আনা কিংবা দুই আনা দেখে না বরং তারা তাদের মনের জ্বালা মিটাতে চায়। তাদের প্রকৃতি প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে থাকে। এমন অবস্থায় তারা দেখে না, আমাদের বা অন্যের জন্য এটি কী পরিণতি বয়ে আনবে। হযরত উমর (রা.)’র হন্তারককে যখন জিজ্ঞেস করা হয়, সে এই পাশবিক কাজটি কেন করেছিল? তখন সে উত্তরে বলেছিল, আমার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছিল, তাই আমি তার প্রতিশোধ নিয়েছি।”
এটি পূর্বে সবিস্তারে বর্ণিত হয় নি। হতে পারে, তাকে ধরার সময় সে যে সময়টুকু পেয়েছে তখন বলেছিল, আমি এ কারণে এই হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছি আর এরপর সে আত্মহত্যাও করে বসে। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, আমি এই হৃদয় বিদারক ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছি, ইসলাম এখনও এর জের কাটিয়ে উঠতে পারে নি। আর সেটি এভাবে যে, যদিও মৃত্যু সবসময় মানুষের সাথে লেগেই আছে, তথাপি এমন সময় মৃত্যুর কথা ভাবাও হয় না যখন অঙ্গপ্রতঙ্গ সুদৃঢ় থাকে, কিন্তু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যখন দুর্বল হয়ে যায় এবং স্বাস্থ্য অবনতির দিকে ধাবিত হয় তখন মানুষ নিজে থেকেই ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা করতে আরম্ভ করে। তারা একে অপরের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে না কিন্তু আপনা আপনি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায় যা ভবিষ্যত ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করে। এজন্য ইমামের মৃত্যুর সময় মানুষ সচেতন থাকে। বয়স ৬৩ বছর হওয়া সত্তে¡ও যেহেতু হযরত উমর (রা.)’র অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মজবুত ছিল তথাপি সাহাবীদের মাথায় এটি ছিল না যে, হযরত উমর (রা.) এত তাড়াতাড়ি তাদের ছেড়ে চলে যাবেন। এজন্য তারা ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি বেখবর ছিলেন। অর্থাৎ অকস্মাৎ হযরত উমর (রা.)’র মৃত্যুর বিপদ আপতিত হয়। সেই সময় জামা’ত অন্য কোন ইমামকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তখন প্রস্তুতি না থাকার ফলাফল যা দাঁড়ায় তা হলো, হযরত উসমান (রা.)’র সাথে মানুষের তেমন গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয় নি যেমনটি হওয়া উচিত ছিল। এ কারণে ইসলামের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে যায় এবং হযরত আলী (রা.)’র যুগে আরো বেশি দুর্বল হয়ে যায়। পরবর্তীতে যেসব নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল সেগুলোর কারণ তাঁর দৃষ্টিতে এটিও হতে পারে যার উল্লেখ তিনি করেছেন।
হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) এটিও বলেছেন যে, নৈরাজ্যের যুগে নামাযের স্থানে কিছু লোক নিরাপত্তার জন্য দাঁড়ানো আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে তিনি হযরত উমর (রা.)’র শাহাদতের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি (রা.) বলেন, পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ হলো, নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের মধ্য থেকে অর্ধেক লোক দন্ডায়মান থাকবে। যদিও এটি যুদ্ধের সময়কার কথা যখন নিরাপত্তার জন্য একটি দলের প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু এ থেকে এই ব্যাখ্যাও করা যায় যে, ছোটোখাটো বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করতে যদি কিছু সংখ্যক লোককে নামাযের সময় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় তাহলে এটি আপত্তির কোন বিষয় নয় বরং এটি করা অত্যাবশ্যক। তিনি (রা.) বলেন, যুদ্ধের সময় যদি এক হাজারের মধ্যে পাঁচশ’ জনকে নিরাপত্তার জন্য দাঁড় করানো যেতে পারে তাহলে কী ছোটোখাটো শঙ্কার সময় এক হাজারের মধ্যে থেকে ৫-১০জন লোককেও নিরাপত্তার জন্য দাঁড় করানো যাবে না? বিপদ নিশ্চিত নয় এটি বলা বৃথা কাজ। হযরত উমর (রা.)’র সাথে কী হয়েছে? তিনি (রা.) নামায পড়ছিলেন এবং মুসলমানরাও নামায পড়ায় মগ্ন ছিল, এমন সময় এক দুর্বৃত্ত মনে করে, আক্রমণের জন্য এটিই উপযুক্ত সময়। তাই সে সামনে অগ্রসর হয় আর খঞ্জর দিয়ে আক্রমণ করে বসে। এই ঘটনার পরও যদি কেউ বলে, নামাযের সময় পাহারা দেয়া নামাযের নিয়মনীতি বা মর্যাদা পরিপন্থী কাজ তাহলে সে তার মূর্খতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো ছাড়া আর কিছুই করে না। এর দৃষ্টান্ত সেই মূর্খ ব্যক্তির ন্যায় যে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আর একটি তির এসে তার গায়ে বিদ্ধ হওয়ায় রক্ত বের হতে থাকে। তখন সে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করে এবং রক্ত মুছতে মুছতে একথা বলছিল, হে আল্লাহ্! এটি যেন একটি স্বপ্নই হয়। এটি যেন সত্য ঘটনা না হয় যে, আমি তির-বিদ্ধ হয়েছি। ইতিহাস হতে এটিও প্রমাণিত যে, একবার সাহাবীরা নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন নি, যার ফলে তাঁদেরকে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন হযরত আমর বিন আস (রা.) যখন মিশর বিজয়ের উদ্দেশ্যে যান এবং সে অঞ্চল জয় করেন তখন তিনি নামায পড়ানোর সময় পাহারার ব্যবস্থা করতেন না। শত্রু পক্ষ যখন লক্ষ্য করে, মুসলমানরা এ অবস্থায় সম্পূর্ণ অন্যমনষ্ক থাকে তখন তারা একটি দিন নির্ধারণ করে কয়েক’শ সশস্ত্র ব্যক্তিকে ঠিক সেই সময় প্রেরণ করে যখন মুসলমানরা সিজদারত ছিল আর পৌঁছামাত্রই তারা তরবারি দিয়ে মুসলমানদের শিরচ্ছেদ করতে শুরু করে। ইতিহাস সাক্ষী, শত শত সাহাবী সেদিন হয় নিহত হয় নতুবা আহত হয়। এক জনের পর আরেকজন এবং দ্বিতীয়জনের পর তৃতীয়জন মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল কিন্তু সাথের জন বুঝতেই পারছিল না যে, এসব কী হচ্ছে! ততক্ষণে সেনাবাহিনীর মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যায়। হযরত উমর (রা.) বিষয়টি অবগত হওয়ার পর তাকে অনেক ভর্ৎসনা করেন এবং বলেন, আপনি কি জানতেন না যে, নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু তিনি, অর্থাৎ হযরত উমর (রা.) কি জানতেন যে, মদীনাতে তাঁর সাথেও এমনটিই ঘটবে! এই ঘটনার পর থেকে সাহাবীরা (নিরাপত্তার) ব্যবস্থা করেন অর্থাৎ, যখনই নামায পড়তেন সর্বদা নিরাপত্তার খাতিরে পাহারাদার নিযুক্ত করতেন।
হযরত উমর (রা.)’র ঋণ সম্পর্কে পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে। তিনি (রা.) জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং তাঁর পুত্রকে এ সম্পর্কে বলেছিলেন। এ সম্পর্কে আরও কথা হলো, তিনি তাঁর পুত্রকে বলেন, হে আব্দুল্লাহ্ বিন উমর! দেখ তো আমার ঋণের পরিমাণ কত? তিনি হিসাব করে দেখেন, (ঋণের পরিমাণ হলো) ৮৬ হাজার দিরহাম। তিনি (রা.) বলেন, হে আব্দুল্লাহ্! যদি উমরের বংশধরদের সম্পদ এর জন্য যথেষ্ট সাব্যস্ত হয় তবে তাদের সম্পদ হতে আমার এই ঋণ পরিশোধ করে দিবে, কিন্তু তাদের সম্পদ যদি যথেষ্ট না হয় তবে বনু আদী বিন কা’ব গোত্রের কাছ থেকে চেয়ে নিবে আর যদি তাও যথেষ্ট না হয় তবে কুরাইশদের কাছে চাইবে। এছাড়া অন্য কারও কাছে যাবে না। সাহাবীগণ জানতেন, অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্থ আমাদের এই ইমাম এত বড় অংক নিজের জন্য ব্যয় করেন নি, (বরং) তাঁরা জানতেন, এই অর্থও তিনি অভাবী ও দরিদ্রদের পেছনেই ব্যয় করেছিলেন, যে কারণে এ পরিমান ঋণ হয়ে গেছে। এজন্য হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) হযরত উমর (রা.)-কে বলেন, আপনি বায়তুল মাল থেকে ঋণ নিয়ে আপনার এই ঋণ পরিশোধ করে দেন না কেন? হযরত উমর (রা.) বলেন, আমি আল্লাহ্র আশ্রয়ে আসছি! তুমি কি চাও, তুমি ও তোমার সঙ্গীরা আমার (মৃত্যুর) পর একথা বলে বেড়াও যে, আমরা তো আমাদের অংশ উমরের জন্য উৎসর্গ করেছি। এখন তো তুমি আমাকে সান্ত¡না দিবে, কিন্তু আমার (মৃত্যুর) পর এমন বিপদ আপতিত হতে পারে যেখান থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত আমার মুক্তি লাভের কোন উপায় থাকবে না। অতঃপর হযরত উমর (রা.) তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রা.)-কে বলেন, আমার ঋণ পরিশোধের দায়িত্বভার গ্রহণ কর। অতএব, তিনি এই দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। হযরত উমর (রা.) সমাহিত হবার পূর্বেই তাঁর ছেলে শূরার সদস্যবৃন্দ ও কতক খ্রিস্টানকে তাঁর এই জামানতের বিষয়ে সাক্ষী রাখেন, অর্থাৎ ঋণ (পরিশোধের) যে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন (তার ওপর)। হযরত উমর (রা.) সমাহিত হওয়ার পর এক জুমু’আ অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রা.) ঋণের অর্থ নিয়ে হযরত উসমান (রা.)’র নিকট উপস্থিত হন এবং কয়েকজন সাক্ষীকে সামনে রেখে এই বোঝা থেকে তিনি অব্যাহতি লাভ করেন।
ঋণ পরিশোধ সংক্রান্ত আরেকটি রেওয়ায়েত ‘ওয়াফাউল ওয়াফা’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। হযরত ইবনে উমর (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, যখন হযরত উমর (রা.)’র মৃত্যুর ক্ষণ ঘনিয়ে আসে তখন তিনি ঋণগ্রস্ত ছিলেন। তিনি (রা.) হযরত আব্দুল্লাহ্ এবং হযরত হাফসা (রা.)-কে ডেকে এনে বলেন, আমার ওপর কিছু ঋণ রয়েছে যা আল্লাহ্র সম্পদ হতে নেয়া। আল্লাহ্র সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে চাই যখন আমার ওপর কোন ঋণ থাকবে না। অতএব, এ ঋণ পরিশোধের জন্য তোমরা এই বাড়িটি বিক্রি করে দিবে, অর্থাৎ যেখানে তিনি থাকতেন সেটি। এরপর যদি কিছু ঘাটতি থেকে যায় তাহলে বনু আদী গোত্রের কাছে চাইবে আর এরপরও যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে কুরাইশের কাছে ছাড়া অন্য কারো কাছে চাইবে না। হযরত উমর (রা.)’র মৃত্যুর পর হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রা.) হযরত মুয়াবিয়া (রা.)’র কাছে যান আর তিনি, অর্থাৎ মুয়াবিয়া (রা.) হযরত উমর (রা.)’র বাড়িটি কিনে নেন। এটিকে ‘দারুল কাযা’ বলা হয়। তিনি (রা.) সেই বাড়িটি বিক্রি করে দেন এবং হযরত উমর (রা.)’র ঋণ পরিশোধ করেন। এজন্য এই বাড়িটি ‘দারুল কাযায়ে দায়নে উমর’ নামে অভিহিত হতে থাকে, অর্থাৎ সেই বাড়ি যা বিক্রির মাধ্যমে হযরত উমর (রা.)’র ঋণ পরিশোধ করা হয়েছিল।
স্মৃতিচারণ এখনও চলছে আর আগামীকে অব্যাহত থাকবে, ইনশাআল্লাহ্।