
17 Feb শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এর স্মৃতিচারণ জুমুআর খুতবা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২
যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ মোতাবেক ১১ তবলীগ, ১৪০১ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা
তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
ইতিহাসে মক্কা বিজয়ের প্রেক্ষিতে হযরত আবু বকর (রা.)-এর একটি স্বপ্নের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-এর সমীপে নিজের স্বপ্ন বর্ণনা করতে গিয়ে নিবেদন করেন যে, হে আল্লাহর রসূল (সা.)! আমাকে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে।(স্বপ্নে) আমি স্বপ্নে আপনাকে দেখেছি আর আমরা মক্কার নিকটবর্তী হয়েছি। তখন একটি মাদা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে আমাদের দিকে আসে। যখন আমরা সেটির নিকটবর্তী হই তখন সেটি পিঠে ভর দিয়ে শুয়ে পড়ে আর সেটি থেকে দুধ বইতে থাকে। তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) তা’বীর করে বলেন, তাদের অনিষ্ট দূর হয়ে গেছে আর কল্যাণ নিকটবর্তী হয়েছে। তারা তোমার আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে তোমার আশ্রয়ে আসবে আর তুমি তাদের কতিপয়ের সাথে মিলিত হবে। অতএব তুমি যদি আবু সুফিয়ানকে পাও তাহলে তাকে হত্যা কোরো না। অতএব, মুসলমানরা আবু সুফিয়ান এবং হাকীম বিন হিযামকে মাররুয্ যাহরান নামক স্থানে ধরে ফেলে।
ইবনে উক্ববা বর্ণনা করেন যে, আবু সুফিয়ান এবং হাকীম বিন হিযাম যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন হযরত আব্বাস মহানবী (সা.)-এর সমীপে নিবেদন করেন যে, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আবু সুফিয়ানের ইসলাম (গ্রহণ) সম্পর্কে আমার সন্দেহ রয়েছে। আবু সুফিয়ান কীভাবে মহানবী (সা.) এর আনুগত্য করেছিল এবং ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করেছিল, সেকথা পূর্বেও বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। যাহোক হযরত আব্বাস বলেন, তাকে ফিরিয়ে আনুন যতক্ষণ না সে ইসলামকে ভালোভাবে বুঝে নেয় এবং আপনার সাথে আল্লাহ্র বাহিনীকে দেখতে পায়। অপর এক রেওয়ায়েতে ইবনে আবি শায়বা রেওয়ায়েত করেন যে, আবু সুফিয়ান যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন হযরত আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-এর সমীপে নিবেদন করেন যে, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আপনি যদি আবু সুফিয়ান সম্পর্কে নির্দেশ দেন তাহলে তাকে পথিমধ্যে থামানো যেতে পারে। অরেকটি রেওয়ায়েতে ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন যে, আবু সুফিয়ান যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন রসূলুল্লাহ্ (সা.) হযরত আব্বাসকে বলেন, তাকে অর্থাৎ আবু সুফিয়ানকে উপত্যকায় থামাও। অতএব হযরত আব্বাস আবু সুফিয়ানকে ধরে ফেলেন এবং থামান। এতে আবু সুফিয়ান বলে, হে বনী হাশেম (গোত্র)! তোমরা কী প্রতারণা করছ? হযরত আব্বাস বলেন, নবুওয়্যতের অনুসারীরা প্রতারণা করে না। অপর এক রেওয়ায়েত অনুযায়ী তিনি বলেন, আমরা মোটেই প্রতারণাকারী নই। তুমি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা কর যতক্ষণ না তুমি আল্লাহ্র বাহিনীকে দেখতে পাও আর তাদেরকে দেখতে পাও যাদের আল্লাহ্ তা’লা মুশরিকদের জন্য প্রস্তুত করেছেন। অতএব হযরত আব্বাস আবু সুফিয়ানকে সেই উপত্যকায় আটকে রাখেন যতক্ষণ না সকাল হয়।
ইসলামী বাহিনী যখন আবু সুফিয়ানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তার উল্লেখ করতে গিয়ে সুবুলুল হুদা ওয়ার রশাদ পুস্তকে লেখা আছে যে, আবু সুফিয়ানের সামনে মহানবী (সা.)-এর সবুজ পোশাক পরিহিত বাহিনী দৃশ্যমান হয় যাদের মাঝে মুহাজের ও আনসাররা ছিল আর তাদের হাতে ঝান্ডা এবং পতাকা ছিল। আনসারদের প্রত্যেক গোত্রের কাছে একটি পতাকা এবং ঝান্ডা ছিল আর তারা লোহায় আবৃত ছিল, অর্থাৎ বর্ম ইত্যাদি যুদ্ধের পোশাকে সজ্জিত ছিল। কেবল তাদের চোখ দেখা যাচ্ছিল। তাদের মাঝে কিছুক্ষণ পরপর হযরত উমর (রা.)-এর উচ্চস্বর শোনা যাচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, ধীরে চল যাতে তোমাদের প্রথম অংশ শেষ অংশের সাথে মিলিত হয়ে যায়। বলা হয়, এই বাহিনীতে এক হাজার বর্ম পরিহিত (সেনা) ছিল। মহানবী (সা.) হযরত সা’দ বিন উবাদা (রা.)-এর (হাতে) তাঁর পতাকা তুলে দেন আর তিনি সেনাদলের সম্মুখে ছিলেন। হযরত সা’দ যখন আবু সুফিয়ানের কাছে পৌঁছেন তখন তিনি (রা.) আবু সুফিয়ানকে ডেকে বলেন, আজকের দিন রক্তপাত করার দিন। আজকের দিনে নিষিদ্ধ বস্তুকে বৈধ করে দেয়া হবে। আজকের দিনে কুরাইশরা লাঞ্ছিত হবে। তখন আবু সুফিয়ান হযরত আব্বাস (রা.)-কে বলে, হে আব্বাস! আজ আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমার ওপর ন্যস্ত। এরপর অন্যান্য গোত্র সেখান দিয়ে অতিক্রম করে। তারপর মহানবী (সা.) সেখানে উপস্থিত হন। তিনি তাঁর উটনী কাসওয়ায় আরোহিত ছিলেন। তিনি (সা.) হযরত আবু বকর এবং হযরত উসায়েদ বিন হুযায়ের এর মাঝে তাদের উভয়ের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছিলেন। হযরত আব্বাস (রা.) আবু সুফিয়ানকে বলেন, ইনি হলেন, আল্লাহ্র রসূল (সা.)।
হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর (রা.) বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের সময় যখন মহানবী (সা.) মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তিনি দেখেন, মহিলারা নিজেদের ওড়না দিয়ে ঘোড়াগুলোর মুখে আঘাত করে সেগুলোকে পেছনে সরাচ্ছিল। তখন তিনি (সা.) মুচকি হেসে হযরত আবু বকর (রা.)-এর প্রতি তাকান এবং বলেন, হে আবু বকর! হাস্সান বিন সাবেত কী বলেছে? তখন হযরত আবু বকর (রা.) নিম্নোক্ত পঙ্ক্তিগুলো পাঠ করেন,
عدمت بنیتی ان لم تروھا
تثیر النقع موعدھا کدائ
ینازین الاعنة مصرحات
یلطمھن بالخمر النسائ
অর্থাৎ, আমার প্রিয় কন্যা অপমানিত হবে যদি তুমি এমন সৈন্যদের ধূলি উড়াতে না দেখ, যাদের প্রতিশ্রুতি স্থান হল কাদা পর্বত। সেই দ্রুত ধাবমান অশ্বগুলো নিজেদের লাগামগুলোকে টানছে, (আর) মহিলারা সেগুলোকে নিজেদের ওড়না দিয়ে আঘাত করছে। তখন মহানবী (সা.) বলেন, এই শহরে সেই পথে প্রবেশ কর যেদিক দিয়ে (প্রবেশ করতে) হাস্সান বলেছেন। অর্থাৎ, কাদা নামক স্থান দিয়ে। আরাফাতের অপর নাম হল কাদা। এটি একটি পাহাড়ি পথ, যা মক্কার বহিরাংশ থেকে এসে অভ্যন্তরীণ মক্কায় মিলিত হয়। মক্কা বিজয়ের সময় এই স্থান দিয়েই মহানবী (সা.) মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের সময় মহানবী (সা.) যখন শান্তি ও নিরাপত্তার ঘোষণা দেন তখন হযরত আবু বকর (রা.) মহানবী (সা.)-এর সকাশে নিবেদন করেন যে, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আবু সুফিয়ান সম্মানিত হওয়া পছন্দ করে। তখন তিনি (সা.) বলেন, যে আবু সুফিয়ানের বাড়িতে প্রবেশ করবে বা আশ্রয় নিবে সে-ও নিরাপদ থাকবে। মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা.) হুবল প্রতিমাকে ভূপাতিত করার নির্দেশ দেন। অতএব সেটিকে ভূপাতিত করা হয় এবং তিনি (সা.) সেটির পাশে দন্ডায়মান ছিলেন। তখন হযরত যুবায়ের বিন আওয়াম (রা.) আবু সুফিয়ানকে বলেন, হে আবু সুফিয়ান! হুবলকে ভূপাতিত করা হয়েছে, অথচ উহুদের যুদ্ধের দিন তুমি এর সম্পর্কে অনেক বড়াই করছিলে যখন তুমি ঘোষণা করেছিলে যে, সে তোমাদেরকে পুরস্কৃত করেছে। তখন আবু সুফিয়ান বলে, হে আওয়ামের পুত্র! এসব কথা এখন বাদ দাও, কেননা আমি এখন নিশ্চিৎ যে, যদি মুহাম্মদ (সা.)-এর খোদা ছাড়া অন্য কোন খোদা থাকতো তাহলে আজ যা কিছু ঘটেছে তা ঘটতো না। এরপর মহানবী (সা.) কাবাগৃহের এক কোণায় উপবিষ্ট হন এবং মানুষ তাঁর চতুষ্পার্শ্বে সমবেত ছিল। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) উপবিষ্ট ছিলেন আর হযরত আবু বকর (রা.) উন্মুক্ত তরবারি হাতে তাঁর নিরাপত্তার জন্য তাঁর মাথার পাশে অর্থাৎ তাঁর শিয়রে দন্ডায়মান ছিলেন।
হুনায়েন-এর যুদ্ধ সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় যে, হুনায়েন-এর যুদ্ধের অপর নাম হাওয়াযেন-এর যুদ্ধ। এটিকে আওতাস-এর যুদ্ধও বলা হয়। হুনায়েন মক্কা এবং তায়েফ-এর মাঝামাঝি মক্কা থেকে ত্রিশ মাইল দূরত্বে অবস্থিত একটি উপত্যকা। হুনায়েন-এর যুদ্ধ ৮ হিজরী সনের শাওয়াল মাসে মক্কা বিজয়ের পর হয়েছিল। বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ্ তা’লা যখন নিজ রসূল (সা.)-এর হাতে মক্কা জয় করান তখন হাওয়াযেন এবং সাকীফ গোত্রের নেতারা একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করে। তাদের শঙ্কা ছিল যে, মহানবী (সা.) তাদের সাথেও যুদ্ধ করবেন। মালেক বিন অওফ নাসরী আরব গোত্রগুলোকে একত্র করে। অতএব তার নিকট হাওয়াযেন গোত্রের পাশাপাশি বনু সাকীফ, বনু নাসর, বনু যুশম, সা’দ বিন বকর এবং বনু হেলালের কিছু মানুষ সমবেত হয়। এরা সবাই সম্মিলিতভাবে আওতাস নামক স্থানে একত্রিত হয়। আওতাস হল হুনায়েন-এর নিকটবর্তী একটি উপত্যকা। মালেক বিন অওফ মহানবী (সা.) সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করার জন্য তার গোয়েন্দা প্রেরণ করে। মহানবী (সা.) যখন তাদের একত্রিত হবার সংবাদ পান তখন তিনি (সা.) তাঁর সাহাবীদের মধ্য থেকে আব্দুল্লাহ্ বিন আবু হাদরাদ আসলামী নামক এক ব্যক্তিকে তাদের সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করেন। অতঃপর মহানবী (সা.) হাওয়াযেন গোত্রের মোকাবিলার জন্য যাত্রার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন আর যুদ্ধের জন্য সাফওয়ান বিন উমাইয়া এবং নিজের চাচাতো ভাই নওফেল বিন হারেস-এর কাছ থেকে অস্ত্র ধার নেন। এভাবে মহানবী (সা.) বারো হাজার সৈন্য নিয়ে বনু হাওয়াযেন-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ভোরবেলা হুনায়েন-এর প্রান্তে পৌঁছে উপত্যকায় প্রবেশ করেন। মুশরিক সৈন্যরা এই উপত্যকার গিরিপথে পূর্ব থেকেই লুকিয়ে ছিল। তারা মুসলমানদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে আর এত প্রচন্ড তিরের বারি বর্ষণ করে যে, মুসলমানরা পিছু হটে পলায়ন করে এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, যার কারণে মহানবী (সা.)-এর নিকট কেবল গুটিকতক সাহাবী রয়ে যায়, যাদের মাঝে হযরত আবু বকর (রা.)ও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আবু ইসহাক থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি বারা-এর নিকট এসে বলে, তোমরা হুনায়েন-এর দিন পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করেছিলে। তিনি বলেন, আমি মহানবী (সা.) সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি (সা.) পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করেন নি, কিন্তু ত্বরাপরায়ণ এবং নিরস্ত্র কিছু মানুষ হাওয়ায়েন গোত্রের অভিমুখে যায়, যারা তিরন্দাজ জাতি ছিল। তারা এমনভাবে তির বর্ষণ করেছিল যেন মনে হচ্ছিল পঙ্গপাল (ঝাঁপিয়ে পড়ছে)। এর ফলে তারা তাদের স্থান ছেড়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে মুহাজেরদের মধ্য থেকে হযরত আবু বকর (রা.) এবং হযরত উমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর পাশে অবিচল ছিলেন। আর মহানবী (সা.)-এর পরিবার-পরিজনদের মধ্য থেকে হযরত আলী (রা.), হযরত আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব (রা.), আবু সুফিয়ান বিন হারেস ও তার ছেলে ফযল বিন আব্বাস, রাবিয়া বিন হারেস এবং উসামা বিন যায়েদের উল্লেখ পাওয়া যায় যারা তাঁর সাথে ছিল। হযরত আবু কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, হুনায়েন-এর যুদ্ধের সময় আমি মুসলমানদের মাঝে এক ব্যক্তিকে দেখি যে-কিনা এক মুশরিকের সাথে যুদ্ধরত ছিল এবং অপর এক মুশরিককে দেখি, যে প্রতারণা করে চুপিসারে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পিছন থেকে তার উপর আক্রমণ করতে চায়। আমি লাফিয়ে তার দিকে অগ্রসর হই যে-কিনা একজন মুসলমানের ওপর এভাবে ধোঁকা দিয়ে আক্রমণ করতে চাইছিল। সে আমাকে মারার জন্য হাত উঠালে আমি তার হাতের উপর আক্রমণ করি এবং হাত কেটে ফেলি। সে আমাকে ধরে ফেলে এবং এত জোরে চেপে ধরে যে, আমি নিরুপায় হয়ে যাই। তারপর সে আমাকে ছেড়ে দেয় এবং নিস্তেজ হয়ে যায়। তখন আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই এবং হত্যা করি। অপরদিকে মুসলমানরা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। আমিও তাদের সাথে পিছিয়ে যাই। তিনি বলেন, অতঃপর লোকজন ফিরে এসে মহানবী (সা.)-এর কাছে একত্রিত হতে থাকে। তখন মহানবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করেছে বলে প্রমাণ উপস্থাপন করবে সে-ই নিহত ব্যক্তির জিনিসপত্র হত্যাকারীর হবে। অতএব আমি আমার হাতে নিহত ব্যক্তির বিষয়ে কোন সাক্ষী অন্বেষণ করার জন্য দন্ডায়মান হই কিন্তু এমন কাউকে পাই নি যে আমার সপক্ষে সাক্ষ্য দিবে। আমি বসে পড়ি। হঠাৎ আমার স্মরণ হয় এবং আমি সেই নিহত ব্যক্তির ঘটনা মহানবী (সা.)-কে অবগত করি। তাঁর (সা.) পাশে বসা এক ব্যক্তি বলে, যার বিষয়ে ইনি উল্লেখ করছেন ঐ নিহত ব্যক্তির অস্ত্রসস্ত্র আমার কাছে। [অর্থাৎ যার কাছে সেই অস্ত্রটি ছিল, তিনি বলেন,] এই অস্ত্রগুলোর পরিবর্তে তাকে অন্য কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট করুন। [সে বলে, আমার কাছে যে জিনিস আছে তা আমার কাছেই রাখতে দিন এবং তাকে অন্য কিছু দিয়ে দিন]। হযরত আবু বকর (রা.) সেখানে বসা ছিলেন। তিনি বলেন, অসম্ভব। মহানবী (সা.) কুরাইশের এক ভীতুকে জিনিস দিয়ে দিবেন আর আল্লাহ্র সিংহদের মাঝে এক সিংহকে বঞ্চিত রাখবেন যিনি আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল (সা.)-এর পক্ষে যুদ্ধ করছেন! হযরত আবু কাতাদা (রা.) বলতেন, মহানবী (সা.) উঠে দাঁড়ান এবং সেগুলো আমাকে দিয়ে দেন। তদ্বারা আমি একটি খেজুর বাগান ক্রয় করি এবং ইসলাম (গ্রহণের)-পর এটিই আমার গড়া প্রথম সম্পত্তি।
হযরত মুসলেহ্ মাওউদ (রা.) বর্ণনা করেন, স্মরণ রেখো, ইতিহাস থেকে জানা যায়, হুনায়নের যুদ্ধে মক্কার কাফের সৈন্যরা একথা বলে যখন ইসলামে অনুপ্রবেশ করে যে, আজ আমরা আমাদের বীরত্বের সাক্ষর দেখাব। কিন্তু বনু সাকীফের আক্রমণের তীব্রতা সইতে না পেরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে, তখন এমন এক মুহূর্ত আসে যখন মহানবী (সা.)-এর আশপাশে কেবল বারো জন সাহাবী অবশিষ্ট ছিলেন। ইসলামী সৈন্যদল যাদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার, তারা তখন দিগি¦দিক পলায়ন করতে থাকে। কাফের সেনাদল ছিল তিন হাজার তিরন্দাজ বিশিষ্ট। তারা তাঁর (সা.)-এর ডান-বামের পাহাড়গুলোতে চড়ে তাঁর ওপর তির বর্ষণ করছিল। কিন্তু তখনও তিনি (সা.) পশ্চাৎপদ হতে চান নি বরং সম্মুখে অগ্রসর হতে চান। হযরত আবু বকর (রা.) কিছুটা শঙ্কিত হয়ে মহানবী (সা.)-এর বাহনের লাগাম ধরে ফেলেন এবং নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! আমার প্রাণ আপনার জন্য নিবেদিত, এখন সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার সময় নয়। মুসলিম সৈন্যরা একত্রিত হলে পরে আমরা সম্মুখে অগ্রসর হব। কিন্তু মহানবী (সা.) অত্যন্ত দীপ্তকণ্ঠে বলেন, আমার বাহনের লাগাম ছেড়ে দাও। এরপর তিনি (সা.) গোড়ালি মেরে [তথা বাহন হাঁকিয়ে] সম্মুখে অগ্রসর হন আর বলতে থাকেন
“আনান্ নাবিয়্যু লা কাজিব, আনা ইবনু আব্দিল মুত্তালিব”
অর্থাৎ, আমি প্রতিশ্রুত নবী, যার সুরক্ষার বিষয়ে স্থায়ী প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আমি ভন্ড নবী নই। তাই তোমরা তিন হাজার তিরন্দাজ হও বা ত্রিশ হাজার, আমি তোমাদের কোন পরোয়া করি না। আর আমার এই বীরত্ব দেখে আমায় ঈশ^র মনে করো না। আমি এক মানবমাত্র এবং তোমাদের নেতা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র তথা পৌত্র। মহানবী (সা.)-এর চাচা হযরত আব্বাস (রা.)-এর গলার স্বর উঁচু ছিল। তিনি (সা.) চাচার দিকে তাকিয়ে বলেন, হে আব্বাস! সম্মুখে এসো এবং উচ্চস্বরে ডাক দিয়ে বলো, হে সূরা বাকারার সাহাবীগণ! [অর্থাৎ যারা সূরা বাকারা মুখস্ত করেছে], হে হুদায়বিয়ার দিন বৃক্ষতলে বয়আতকারীগণ! খোদার রসূল তোমাদেরকে আহ্বান করছেন। একজন সাহাবী বলেন, মক্কার সাম্প্রতিক নব-মুসলিমদের ভীরুতার কারণে ইসলামী সৈন্যবাহিনীর সম্মুখ সারি যখন পেছন দিকে পলায়নপর হয় তখন খুতবার মধ্যের অংশ
আমাদের বাহনগুলোও ছুটতে থাকে আর আমরা যতই বাধা দিচ্ছিলাম, সেগুলো ততই পেছন দিকে দৌড়াচ্ছিল। ইতোমধ্যে হযরত আব্বাস (রা.)’র ধ্বনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে অর্থাৎ, হে সূরা বাকারার সাহাবীগণ! হে হুদায়বিয়ার দিন বৃক্ষতলে বয়আ’তকারীগণ! আল্লাহ্র রসূল তোমাদেরকে ডাকছেন। বর্ণনাকারী বলেন, এই ধ্বনি যখন আমার কানে এল তখন আমার মনে হল, আমি জীবিত নই- মৃত। আর ইসরাফিলের শিঙ্গা বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আমি নিজের উটের লাগাম সজোরে টেনে ধরলাম আর এর মাথা পিঠের সাথে লেগে গেল। কিন্তু সেটি এতই উদ্ভ্রান্ত ছিল যে, যেই না আমি লাগাম ঢিল দিলাম অমনি সে পিছনের দিকে দৌড়াতে শুরু করল। এতে আমি এবং আরও অনেক সঙ্গী তরবারি বের করি। কয়েকজন তো উটের পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে যায় আর কয়েকজন উটের গলা কেটে ফেলে মহানবী (সা.)-এর দিকে দৌড়াতে শুরু করে। কয়েক মুহূর্তেই সেই দশ হাজার সাহাবীর বাহিনী- যারা মক্কা অভিমুখে পলায়নপর ছিল, তারা মহানবী (সা.)-এর পাশে সমবেত হয়ে যায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ে আরোহণ করে তারা শত্রুপক্ষকে তছনছ করে ফেলে আর এই ভয়ংকর পরাজয় এক সুমহান বিজয়ে রূপান্তরিত হয়।
তায়েফের যুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তায়েফ মক্কা থেকে পূর্বে প্রায় নব্বই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হেজাযের একটি বিখ্যাত পাহাড়ী শহর। সেখানে আঙ্গুর এবং অন্যান্য ফল প্রচুর পরিমাণে হত। এখানে বনু সাকীফ (গোত্র) বাস করত। হাওয়াযেন এবং সাকীফের বেশিরভাগ পরাজিত সদস্যরা নিজেদের নেতা মালেক বিন অওফ নাসরী’র সাথে পালিয়ে তায়েফেই এসেছিল আর এখানেই দুর্গাবদ্ধ হয়ে যায়। অতএব, মহানবী (সা.) হুনায়েন থেকে কার্য সম্পাদন করে এবং জি’রানাতে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ জড়ো করিয়ে (তা) বণ্টন করেন। আর এই অষ্টম হিজরীর শওয়াল মাসেই তায়েফ অভিমুখে যাত্রা করেন। জি’রানা মক্কা এবং তায়েফের পথে মক্কার নিকটবর্তী একটি কূপের নাম এবং মক্কা থেকে এর দূরত্ব সাতাইশ কিলোমিটার।
মহানবী (সা.) কতদিন তায়েফ অবরোধ করে রেখেছিলেন এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন রেওয়ায়েত পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেছেন, দশরাতের কিছু বেশি কাল অবরোধ করেছিলেন। কয়েকজন বলেছেন, বিশ রাতের চেয়ে কিছু অধিক সময় অবরোধ করে রেখেছিলেন। এটাও বলা হয় যে, বিশ দিন অবরোধ করে রাখেন। একটি রেওয়ায়েতে উল্লেখ করা হয়েছে, মহানবী (সা.) প্রায় ত্রিশ রাত তায়েফবাসীদের অবরোধ করে রাখেন। ইবনে হিশাম বলেন, এটাও বলা হয় যে, [তাদেরকে মহানবী (সা.)] সতেরো রাত অবরোধ করে রেখেছিলেন। সহীহ্ মুসলিম শরীফে হযরত আনাস (রা.) বর্ণিত রেওয়ায়েত হল, আমরা চল্লিশ রাত পর্যন্ত তাদের অবরোধ করে রাখি। মহানবী (সা.) যখন তায়েফে সাকীফদের অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন তখন হযরত আবু বকর (রা.)-কে বলেন, হে আবু বকর! আমি স্বপ্নে দেখেছি, আমাকে মাখনে পূর্ণ একটি পেয়ালা পরিবেশন করা হয়েছে কিন্তু একটি মোরগ তাতে ঠোকর দিল, ফলে পেয়ালাতে যা কিছু ছিল সব পড়ে গেল। হযরত আবু বকর (রা.) নিবেদন করেন, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! তাদেরকে অবরোধের পেছনে আপনার উদ্দেশ্য আজকের দিনে অর্জিত হবে বলে আমি মনে করি না। মহানবী (সা.) বলেন, আমিও তেমনটি হবে বলে মনে করি না। কিছুক্ষণ পর হযরত উমর (রা.) নিবেদন করেন, আমি কি লোকদের মাঝে যাত্রার ঘোষণা করিয়ে দেবো কি? মহানবী (সা.) বলেন, কেন নয়? তখন হযরত উমর (রা.) লোকদেরকে যাত্রা করার ঘোষণা দিলেন অর্থাৎ, প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দিলেন।
তাবুক যুদ্ধ ৯ হিজরীর রজব মাঝে সংঘটিত হয়। এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে যে, তাবুক মদীনা থেকে সিরিয়াগামী সেই রাজপথের পাশে অবস্থিত, যা সাধারণ বাণিজ্যিক কাফেলাগুলোর আসা-যাওয়ার পথ ছিল। এটি ‘ওয়াদিউল কুরা’ এবং সিরিয়ার মধ্যবর্তী একটি শহর ছিল। একে ‘আসহাবুল আয়কা’র শহরও বলা হয়। এর প্রতি হযরত শুআয়েব (আ.) প্রেরিত হয়েছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) তাবুকের যুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর সাথে ছিলেন এবং মহানবী (সা.) তাবুকের যুদ্ধে বড় পতাকা তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। হযরত আবু বকর (রা.) তাবুকের যুদ্ধের সময় নিজের সমস্ত অর্থ-সম্পদ মহানবী (সা.)-এর চরণে উপস্থাপন করেছিলেন যার পরিমাণ ছিল চার হাজার দিরহাম। মহানবী (সা.) যখন সাহাবীদের তাবুকের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন তখন তিনি (সা.) মক্কা এবং অন্যান্য আরব গোত্রগুলোকেও সংবাদ প্রেরণ করেন যে, তারা যেন তাঁর (সা.) সহযাত্রী হয়। আর তিনি (সা.) ধনীদেরকে আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয় করার এবং বাহন সরবরাহ করার আহ্বান জানান। মহানবী (সা.) এ বিষয়ের তাগিদপূর্ণ নির্দেশ প্রদান করেন আর এটি তাঁর সশরীরে অংশগ্রহণ করা শেষ যুদ্ধ ছিল। অতএব, এসময় সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি সম্পদ নিয়ে আসেন তিনি হলেন, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)। তিনি, অর্থাৎ হযরত আবু বকর (রা.) তাঁর গৃহের সব সম্পদ নিয়ে উপস্থিত হন যা চার হাজার দিরহাম মূল্যমানের ছিল। মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, পরিবার-পরিজনের জন্য কিছু রেখে এসেছেন কী? উত্তরে তিনি (রা.) নিবেদন করেন, পরিবারের জন্য আল্লাহ্ এবং আল্লাহ্র রসূলকে রেখে এসেছি। হযরত উমর (রা.) তাঁর ঘরের অর্ধেক সম্পদ নিয়ে আসেন। তখন মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, তোমার পরিবার-পরিজনের জন্যেও কি কিছু রেখে এসেছ? উত্তরে তিনি (রা.) নিবেদন করেন, অর্ধেক সম্পদ রেখে এসেছি। এ উপলক্ষে হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) একশ অওকিয়া প্রদান করেন। এর পরিমান প্রায় চার হাজার দিরহাম হয়। এরপর মহানবী (সা.) বলেন, উসমান বিন আফ্ফান এবং আব্দুর রহমান বিন অওফ হল, ধরাপৃষ্ঠে আল্লাহ্ তা’লার ধনভান্ডারগুলোর মধ্য থেকে দু’টি ধনভান্ডার যারা আল্লাহ্ তা’লার সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করে আর তারা অনেক সম্পদ দিয়েছে। এ সময় মহিলারাও তাদের অলঙ্কারাদি প্রদান করেন এবং হযরত আসেম বিন আদী (রা.) ৭০ ওসাক খেজুর প্রদান করেন, যা প্রায় ২৬২ মণ দাড়ায়। ৪০ কেজিতে এক মণ ধরলে প্রায় এক টনের বেশি হয়। অর্থাৎ, প্রায় দেড় টনের মত হয়।
যায়েদ বিন আসল তার পিতার বরাতে রেওয়ায়েত করেন, আমি হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.)-কে একথা বলতে শুনেছি যে, মহানবী (সা.) আমাদেরকে সদকা করার নির্দেশ দেন। তখন আমার কাছে সম্পদ ছিল, তাই আমি ভাবলাম, কোনদিন যদি আমি তাঁর চেয়ে এগিয়ে যেতে পারি তাহলে সেটি হল আজকের দিন। তিনি (রা.) বলেন, আমি আমার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে আসি। তখন মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করেন, তোমার পরিবারের জন্য তুমি কী রেখে এসেছ? হযরত উমর (রা.) বলেন, আমি নিবেদন করি, আরও এতটুকু। অর্থাৎ, যতটুকু নিয়ে এসেছি এর সমপরিমান পরিবারের জন্য রেখে এসেছি। এরপর হযরত আবু বকর (রা.) সেসব (সম্পদ) নিয়ে আসেন যা তাঁর কাছে ছিল। অর্থাৎ, এরপর হযরত আবু বকর (রা.) আসেন আর হযরত উমর (রা.) বলেন, তাঁর কাছে যা ছিল (তিনি) সেসব কিছুই নিয়ে আসেন। তখন মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আবু বকর! তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি (রা.) নিবেদন করেন, আমি তাদের জন্য আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল (সা.)-কে রেখে এসেছি। হযরত উমর (রা.) বলেন, তখন আমি বলি, আল্লাহ্র কসম! আমি তাঁর থেকে কখনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রগামী হতে পারব না।
হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, “এক ছিল সেই যুগ যখন ঐশী ধর্মের জন্য মানুষ অকাতরে নিজেদের জীবন কুরবানীর পশুর ন্যায় উৎসর্গ করত, ধনসম্পদতো দূরে থাক! হযরত আবু বকর (রা.) তো একাধিকবার নিজের সাকুল্য সম্পদ উৎসর্গ করেছেন, এমনকি বাড়িতে একটি সুঁইও রাখেন নি। অনুরূপভাবে হযরত উমর (রা.) তাঁর সামর্থ্য ও সঙ্গতি অনুসারে এবং হযরত উসমান তাঁর সাধ্য ও অবস্থা অনুসারে একইভাবে পদমর্যাদা অনুপাতে সব সাহাবী তাঁদের জীবন ও সম্পদ এই ঐশী ধর্মের জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে যান। এরপর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) দীক্ষিতদের সম্পর্কে বলেন, এক দল হল তারা যারা বয়আ’ত তো করে যায় এবং অঙ্গীকারও করে যায় যে, ধর্মকে আমরা জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দিব কিন্তু সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন পড়লে নিজেদের পকেট চেপে ধরে রাখে। এমন জগতপ্রীতির মাধ্যমে কেউ কি ধর্মীয় লক্ষ্য অর্জন করতে পারে? আর এমন লোকদের অস্তিত্ব কি আদৌ কল্যাণকর হতে পারে? কক্ষনো নয়, কক্ষনো নয়।” পুনরায় তিনি (আ.) বলেছেন, “আল্লাহ্ তা’লা বলেন, لَن تَنَالُواْ ٱلۡبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُواْ مِمَّا تُحِبُّونَ অর্থাৎ, যতক্ষণ তোমরা সেই সম্পদ ব্যয় না করবে যা তোমাদের প্রিয় ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের পুণ্য (প্রকৃত অর্থে) পুণ্য নয়।”
হযরত আবু বকর (রা.)’র মহানবী (সা.)-এর সাথে একত্রে একজন সাহাবীকে দাফন করার ঘটনা সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসঊদ (রা.) বর্ণনা করেন, তাবুকের যুদ্ধে আমি মহানবী (সা.)-এর সাথে ছিলাম। একদিন মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙলে আমি সেনাশিবিরের একপাশে আগুনের শিখা দেখতে পাই। তাই আমি সেদিকে দেখতে যাই যে, কী হয়েছে। সেখানে গিয়ে আমি মহানবী (সা.), হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (রা.)-কে দেখতে পাই। এছাড়াও আমি দেখি, হযরত আব্দুল্লাহ্ যুলবিজাদাইন মুযনী (রা.) মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তাঁরা তার জন্য কবর খুঁড়ে রেখেছেন। মহানবী (সা.) কবরে নেমেছিলেন আর হযরত আবু বকর ও হযরত উমর (রা.) তার মরদেহ নামিয়ে তাঁর (সা.) হাতে দিচ্ছিলেন আর তিনি (সা.) বলছিলেন, তোমরা দু’জন তোমাদের ভাইকে আমার কাছে নিয়ে এসো। অতএব, তারা দু’জন হযরত আব্দুল্লাহ্ যুলবিজাদাইনের মরদেহ মহানবী (সা.)-এর দিকে এগিয়ে দেন। তিনি (সা.) যখন তাকে কবরে সমাহিত করেন তখন তিনি (সা.) দোয়া করেন, اللَّهُمَّ إِنِّي أَمْسَيْتُ رَاضِيًا عَنْهُ فَارْضَ عَنْهُ অর্থাৎ, হে আল্লাহ্! আমার সন্ধ্যা হয়েছে তার প্রতি সন্তুষ্ট অবস্থায়, তাই তুমিও তার প্রতি সন্তুষ্ট হও। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন মাসঊদ (রা.) বর্ণনা করেন, সেই সময় আমার মনে এই আকাঙ্ক্ষা হচ্ছিল যে, হায়! এই কবরে সমাহিত ব্যক্তি যদি আমি হতাম! হযরত আব্দুল্লাহ্ যুলবিজাদাইন (রা.) বনু মুযায়না গোত্রের সদস্য ছিলেন। তার সম্পর্কে জানা যায়, তার শৈশবেই তার পিতা মারা যান, উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি কিছুই পান নি। তার চাচা সম্পদশালী মানুষ ছিল, সেই চাচা তাকে লালনপালন করে, এভাবে তিনি (রা.)ও সম্পদশালী হয়ে যান। মক্কা বিজয়ের পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে তার চাচা তার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়, এমনকি তার পরনের লুঙ্গিটিও কেঁড়ে নেয়। তখন তার মা এসে নিজের চাদর দু’টুকরো করে তাকে দেন, হযরত আব্দুল্লাহ্ একটি টুকরো লুঙ্গি হিসেবে পরিধান করেন এবং অপর টুকরোটি গায়ে জড়িয়ে নেন। এরপর তিনি মদীনায় আসেন এবং মসজিদে গিয়ে শুয়ে পড়েন আর পরদিন মহানবী (সা.)-এর সাথে ফজরের নামায পড়েন। বর্ণনাকারী বলেন, মহানবী (সা.) ফজরের নামায শেষ করার পর লোকদেরকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন; [লক্ষ্য করতেন, কে কে রয়েছে আর নতুন কেউ আছে কিনা?] মহানবী (সা.) হযরত আব্দুল্লাহ্ (রা.)-কে দেখে আগন্তুক মনে করেন আর হযরত আব্দুল্লাহ্ (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, তুমি কে? হযরত আব্দুল্লাহ্ (রা.) নিজের বংশ পরিচয় তুলে ধরেন। একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি (রা.) বলেন, আমার নাম আব্দুল উয্যা। একথা শুনে মহানবী (সা.) বলেন, তুমি হলে, আব্দুল্লাহ্ যুলবিজাদায়ন, অর্থাৎ দুই চাদরবিশিষ্ট ব্যক্তি। এরপর তিনি (সা.) বলেন, তুমি আমার কাছাকাছিই থাকবে। অতএব, তিনি (রা.) মহানবী (সা.)-এর অতিথিদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মহানবী (সা.) তাকে কুরআন শরীফ শেখাতেন, এভাবে তিনি (রা.) কুরআনের অনেকখানি মুখস্ত করে ফেলেন। এছাড়া তিনি (রা.) উচ্চ কণ্ঠস্বরের অধিকারী ছিলেন।
হজ্জের সময় হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)’র হজ্জের আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.) ৯ম হিজরী সনে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-কে হজ্জের আমীর হিসেবে মক্কায় প্রেরণ করেছিলেন। এর বিস্তারিত বিবরণ হল, মহানবী (সা.) তাবুক থেকে ফিরে এসে হজ্জে যাবার সংকল্প করেন। তখন তাঁকে জানানো হয়, অন্য মানুষের সাথে একত্রে মুশরিকরাও হজ্জ করে; [সেখানে মুশরিকরাও থাকবে] এবং তারা শিরকে কলুষিত বাক্যও উচ্চারণ করে আর উলঙ্গ হয়ে কা’বা শরীফ তওয়াফ করে। এসব কথা শুনে মহানবী (সা.) এ বছর হজ্জের ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন এবং হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-কে হজ্জের আমীর হিসেবে প্রেরণ করেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) তিনশ’ সাহাবীর সাথে মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন এবং মহানবী (সা.) তাদের সাথে বিশটি কুরবানীর পশু প্রেরণ করেন। যেগুলোর গলায় স্বয়ং মহানবী (সা.) নিজ হাতে কুরবানীর চিহ্নস্বরূপ মালা পড়িয়ে দেন এবং চিহ্নিত করে দেন। এছাড়া হযরত আবু বকর (রা.) নিজের সাথে পাঁচটি কুরবানীর পশু নিয়ে যান। রেওয়ায়েত রয়েছে, হজ্জের সময় হযরত আলী (রা.) সূরা তওবার প্রাথমিক আয়াতগুলো পাঠ করে শোনান। রেওয়ায়েতটি হল, আবু জাফর মুহাম্মদ বিন আলী রেওয়ায়েত করেছেন, যখন সূরা বারাআ, অর্থাৎ সূরা তওবা মহানবী (সা.)-এর প্রতি অবতীর্ণ হয় তখন ইতোমধ্যে তিনি (সা.) হযরত আবু বকর (রা.)-কে আমীর হিসেবে হজ্জে প্রেরণ করে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-এর সমীপে নিবেদন করা হয়, হে আল্লাহ্র রসূল (সা.)! এই সূরাটি হযরত আবু বকর (রা.)’র নিকট প্রেরণ করুন যাতে সেখানে তিনি তা পড়ে শোনাতে পারেন তখন মহানবী (সা.) বলেন, আমার আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত কোন ব্যক্তি ছাড়া আমার পক্ষ থেকে এই দায়িত্ব আর কেউ পালন করতে পারবে না। এরপর তিনি (সা.) হযরত আলীকে (রা.)-কে ডেকে এনে তাকে বলেন, সূরা তওবার প্রারম্ভিক আয়াতে (যে শিক্ষা) বর্ণিত হয়েছে তা নিয়ে যাও আর কুরবানীর দিন লোকেরা যখন মিনায় একত্রিত হবে তখন সেখানে ঘোষণা করে দিবে যে, জান্নাতে কোন কাফির প্রবেশ করবে না এবং এ বছরের পর থেকে কোন মুশরিক হজ্জ করার অনুমতি পাবে না আর কাউকে উলঙ্গ অবস্থায় কা’বা শরীফ তওয়াফ করার অনুমতিও দেয়া হবে না। কিন্তু যার সাথে মহানবী (সা.) চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তার চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করা হবে।
হযরত আলী বিন আবু তালেব (রা.) মহানবী (সা.)-এর উট আযবাতে আরোহণ করে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে তিনি (রা.) হযরত আবু বকর (রা.)-এর সাথে মিলিত হন। হযরত আলী (রা.) এর সাথে হযরত আবু বকর (রা.)-এর সাক্ষাৎ হয় আরজ অথবা যুজানান উপত্যকায়। আরজ হল মক্কা থেকে মদীনাগামী রাস্তার পাশে অবস্থিত একটি উপত্যকা যেখানে কাফেলা যাত্রা বিরতি দিত। আর যুজানান মদীনার পথে মক্কার পাশে অবস্থিত একটি স্থান যা মক্কা থেকে ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত। যাহোক হযরত আবু বকর (রা.) যখন রাস্তায় হযরত আলী (রা.)কে দেখেন তখন তিনি (রা.) বলেন, আপনাকে আমীর নিযুক্ত করা হয়েছে নাকি আপনি আমার অধীনস্থ হবেন? বিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখুন! হযরত আবু বকর (রা.) তৎক্ষণাৎ বলেন, মহানবী (সা.) আপনাকে প্রেরণ করেছেন, আপনি আমীর হবেন, নাকি আপনি আমার অধীনে এই কাফেলার সাথে যাবেন। উত্তরে হযরত আলী (রা.) বলেন, আমি আপনার অধীনে থাকব। এরপর দুজনেই যাত্রা করেন। হযরত আবু বকর (রা.) মানুষের হজ্জের বিভিন্ন বিষয়ের তত্ত¡াবধান করেন। সেবছর আরববাসীরা তাদের সেই জায়গায়ই তাবু স্থাপন করেছিল যেখানে তারা অজ্ঞতার যুগে তাবু গাড়তো। কুরবানীর দিন এলে হযরত আলী (রা.) লোকদের মাঝে মহানবী (সা.)-এর সেই নির্দেশের ঘোষণা করে বলেন, হে লোকেরা! জান্নাতে কোন কাফের প্রবেশ করবে না এবং এবছরের পর কোনো মুশরেক হজ্জ করবে না আর কাউকে উলঙ্গ দেহে কা’বা শরীফ তওয়াফ করার অনুমতি দেয়া হবে না। যার সাথে মহানবী (সা.) কোন চুক্তি করেছেন সেটির(অর্থাৎ কৃত চুক্তির) মেয়াদ পূর্ণ করা হবে। এছাড়া লোকদেরকে ঘোষণার দিন থেকে চার মাস পর্যন্ত সুযোগ দেয়া হয় যাতে সকল জাতি তাদের নিরাপদ স্থান অথবা নিজেদের অঞ্চলে ফিরে যেতে পারে। এরপর কোনো মুশরেকের সাথে কোনো চুক্তি হবে না আর কোন দায়-দায়িত্বও থাকবে না, তবে সেই অঙ্গীকার বা চুক্তি ব্যতীত যা রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর পক্ষ থেকে কোনো নির্ধারিত সময় পর্যন্ত রয়েছে। অর্থাৎ যেসব চুক্তির সময় সীমা এখনো বাকি আছে সেগুলো ব্যতীত নতুন কোনো চুক্তি হবে না। এ বছরের পর আর কোনো মুশরেক হজ্জ করে নি এবং কেউ নগ্ন শরীরে কা’বা শরীফর তওয়াফও করে নি।
একটি রেওয়ায়েতে রয়েছে, হযরত আলী বর্ণনা করেন, হযরত আবু বকর (রা.) আরফায় আসেন এবং মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা শেষ করার পর তিনি (রা.) আমাকে লক্ষ্য করে বলেন, হে আলী! দাঁড়িয়ে মহানবী (সা.)-এর বার্তা ঘোষণা করে দাও। অতএব আমি দাঁড়িয়ে যাই আর তাদের সূরা তওবার চল্লিশ আয়াত শুনাই। এরপর হযরত আলী এবং হযরত আবু বকর উভয়ে মহানবী (সা.)-এর সকাশে উপস্থিত হন।
এই স্মৃতিচারণ অব্যাহত থাকবে। এখন আমি একজন প্রয়াত মহিলার স্মৃতিচারণ করতে চাই যিনি গত কিছুদিন পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন। আমি তার (গায়েবানা) জানাযাও পড়াব ইনশাআল্লাহ। তিনি হলেন, মোহতরমা আমাতুল লাতীফ খুরশীদ সাহেবা। তিনি কানাডায় বসবাস করছিলেন। তিনি আল্ ফযল রাবোয়ার সহকারী সম্পাদক মরহুম শেখ খুরশীদ আহমদ সাহেবের সহধর্মিণী ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ৯৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন, ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। তিনি আল্লাহ তা’লার কৃপায় ওসীয়্যত করেছিলেন। তিনি হারসিয়াঁ নিবাসী হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর সাহাবী হযরত মিয়াঁ ফজল মুহাম্মদ সাহেবের পৌত্রী, হযরত হাকীম আল্লাহ্ বখশ তেলওয়ান্ড মুদাররেস ডেউড়ি হযরত হযরত আম্মাজানের দৌহিত্রী এবং কাদিয়ানের দরবেশ মুকাররম আব্দুর রহীম দিয়ানত সাহেব ও আমেনা বেগম সাহেবার জ্যেষ্ঠ কন্যা ছিলেন। কাদিয়ানের নুসরত গার্লস উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি (মাধ্যমিক) পাশ করেন এরপর জামেয়া নুসরতে ৪৩ বা ৪৪ সনে ভর্তি হন। জামেয়া নুসরতে তিনি দুই বছর অধ্যয়ন করেন এরপর প্রাইভেট পড়ে আদীব-আলিম পাস করেন। যেমনটি আমি বলেছি তার বিয়ে হয়েছিল আল-ফজলের সহকারী সম্পাদক শেখ খুরশীদ আহমদ সাহেবের সাথে। তাদের বিয়ে হযরত খলীফাতুল মসীহ সানী (রা.) মসজিদ মুবারকে পড়িয়েছিলেন। আল্লাহ তা’লা তাকে তিন পুত্র এবং দুই কন্যাসন্তান দান করেছেন। তিনি মুরব্বী সিলসিলা আব্দুল বাসেত শাহেদ সাহেবের বোন ছিলেন, যিনি বর্তমানে লন্ডনে বসবাস করছেন আর এখানে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন এছাড়া আফ্রিকাতেও ছিলেন। তার এক পৌত্র ওয়াক্কাস আহমদ খুরশীদ সাহেব আমেরিকাতে মুরব্বী সিলসিলা হিসাবে কর্মরত আছেন। যথেষ্ট শিক্ষিত পরিবার এটি। তার এক বোন হলেন, আমাতুল বারী নাসের সাহেবা। তিনিও জামাতের বই পুস্তক প্রকাশনা ও সম্পাদনার কাজ করে থাকেন। আমাতুল লতীফ সাহেবা তেরো বছর বয়সেই লাজনা ইমাইল্লাহর বিভিন্ন পদে কাজ আরম্ভ করেন এবং সত্তর বছর পর্যন্ত তার এই কাজের ধারা অব্যাহত থাকে। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী (রা.)-এর দিকনির্দেশনা, হযরত উম্মুল মোমেনীন হযরত সৈয়্যদা নুসরত জাহান বেগম সাহেবার তত্ত্বাবধান এবং অন্যান্য বুজুর্গদের নিগরানীতে কাজ করার তার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি কাদিয়ানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার পর হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সানী এবং মরহুমা ছোটি আপার কথানুযায়ী হিজরতকারী নারীদের ইনচার্জ হিসাবে কাজ করার সুযোগ পান। একইভাবে বিভিন্ন পদে থেকে লাজনা ইমাইল্লাহর কাজ করার সুযোগ পান আর দীর্ঘকাল তিনি সেক্রেটারি ইশাআতও ছিলেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি ‘মিসবাহ্’-এর সম্পাদিকা ছিলেন। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি কানাডা বসবাস করছিলেন, সেখানেও তিনি লাজনা ইমাইল্লাহর অনারারি উপদেষ্টা ছিলেন। বইপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে লাজনা ইমাইল্লাহর ইতিহাস-এর প্রথম চার খন্ড, আল-মাসাবীহ্ এবং আল-আযহার সংকলনে তিনি ভরপুর সহযোগিতা করার সুযোগ পেয়েছেন। হযরত ছোটি আপার সাথে ৪৪বছর কাজ করার সৌভাগ্য পান। তার পরামর্শে ও তত্ত্বাবধানে নাসেরাতুল আহমদিয়ার সর্বপ্রথম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। আমাতুল লতীফ সাহেবা যখন সেক্রেটারি নাসেরাত ছিলেন তখন তিনি তার স্বামী শেখ খুরশীদ আহমদ সাহেবের সহযোগিতায় ‘রাহে ঈমান’ এবং জামাতে আহমদীয়ার বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ সংকলন করেন।
তার ছেলে লেইক আহমদ খুরশীদ সাহেব বলেন, আমার মরহুমা মা তার ঘরে সব সন্তানদের একটি গভীর পাঠ এটি দিয়েছেন যে , যদি জামা’ত এবং খেলাফতের বিরুদ্ধে কোন কথা হয় তাহলে কোনভাবেই তা শুনবে না আর কোনভাবে কানে কথা পৌঁছে গেলে সেটাকে ঘুনাক্ষরেও পুনরাবৃত্তি করবে না, সেকথা মুখেও আনবে না কেননা আল্লাহ তা’লার বিশেষ সাহায্য-সমর্থন জামা’ত ও খেলাফতের সাথে রয়েছে। তিনি বলেন, সকল পরীক্ষা ও ফিতনার পর খোদা তা’লার নির্শনাদি জামাতের সপক্ষে প্রকাশিত হয় তাই তোমরা অযথাই এসব ফিতনায় জড়াবে না। এরপর তিনি লিখেন, মরহুমা জামাতের এক জীবন্ত ইতিহাস ছিলেন। খুবই মিশুক এবং সবার শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন,আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থাশীলা ও মানবসেবায় গভীর আগ্রহী ছিলেন। কানাডায় হিজরতকারী পরিবারগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে উৎসাহউদ্দীপনার সাথে অংশ গ্রহণ করতেন।
তার এক সন্তান লিখেছেন, খীলাফতের প্রতি আমাদের আম্মাজানের গভীর ভালোবাসা ছিল। সর্বদা আমাদের সবাইকে যুগ খলীফার জন্য দোয়া করার তাগাদা দিতেন এবং স্মরণ করাতেন। যথাসময়ে ও যত্নসহকারে নামায আদায় করতেন। (আমাদের জন্য) জুমার দিন এক ঈদের দিন হত। পবিত্র কুরআনের প্রতি ভালোবাসার বিষয়ে লিখেন, অগণিত শিশুকে পবিত্র কুরআন পড়িয়েছেন এবং শুদ্ধ উচ্চারণে পবিত্র কুরআন পাঠে জোর দিতেন। তার পৌত্র মুরুব্বী সিলসিলাহ্ ওক্কাস খুরশিদ সাহেব বলেন, তিনি সর্বদা দোয়া এবং পড়ালেখার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। ছোটদের উত্তম তরবিয়তের লক্ষ্যে তিনি বিভিন্ন গল্প শুনিয়ে শিশু-কিশোরদের জামাতের ইতিহাস শেখাতেন।
তার এক পৌত্রী বলেন, দাদি আম্মার নয় পৌত্রী রয়েছেন। তিনি আমরা মেয়েদের লাজনা ইমাইল্লার খাদেমা হওয়ার জন্যই কেবল তরবিয়তই করেন নি বরং ভদ্রতা ও শিষ্টাচার, সঠিক পর্দা কীভাবে করতে হয়, ঘর-সংসার কীভাবে সামলাতে হয়, অতিথি আপ্যায়ন, সেলাই, উর্দুতে লেখাপড়া এসকল বিষয়ে আমাদের সকলের জন্য পথিকৃৎ ছিলেন। আমরা প্রাপ্তবয়স্কা হলে, আমাদেরকে আমাদের স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির যথাযথ খেয়াল রাখার বিষয়ে প্রেরণা জুগিয়েছেন। আমরা আমাদের শ্বশুরবাড়ির (লোকজনের) সাথে সময় কাটিয়েছি শুনলে (মরহুমা) অত্যন্ত আনন্দিত হতেন। এসকল দ্বায়িত্বাবলীর পাশাপাশি তিনি আমাদেরকে উত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া ও ক্যারিয়ার গঠনের বিষয়েও নসীহত করেছেন। জন্মদিন উদ্যাপন না করার ন্যায় অনৈসলামিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে যেখানে তিনি অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন সেখানে তিনি জন্মদিন এবং অন্যান্য বিশেষ উপলক্ষ্যগুলোকে স্মরণীয়ও করে রেখেছেন কেননা তিনি পরিবারের সবাইকে সম্মিলিতভাবে হামদ ও সানা (অর্থাৎ মাহমুদ কী আমীন নযম) পাঠ করা ও বাজামাত দোয়া করতে বলতেন। তিনি আরো বলেন, কানাডায় আহমদী মুসলমান হিসেবে আমাদের তরবিয়্যতের তিনি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। তিনি আমাদেরকে আমাদের ঈমান এবং পশ্চিমা সভ্যতার মাঝে কীভাবে ভারসাম্য বজায় রাখা যায় তা শিখিয়েছেন।
যাহোক, নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই হচ্ছে মায়েদের এবং বুজুর্গদের দায়িত্ব। নতুন প্রজন্মের কীভাবে তরবিয়ত করতে হয়, তাদেরকে ধর্মও শেখাতে হবে এবং এই (পশ্চিমা) সমাজে বসবাস করে কোনরূপ হীনমন্যতায় না ভুগে এখানে খাপ খাইয়ে চলার প্রতিও মনযোগ আকর্ষণ করতে হবে।
মহান আল্লাহ্ তার সাথে দয়া ও কৃপার আচরণ করুন, তার পদমর্যাদা উন্নীত করুন আর তার বংশধরদেরকে তার পুণ্যসমূহকে ধরে রাখার তৌফিক দান করুন। (আমিন)