Hazrat Mirza Masroor Ahmad- Khalifatul Masih Al Khames (ABA)

১০ এপ্রিল ২০২০ হুযুর (আই.) এর জুম্মার খুতবার বাংলা অনুবাদ

بسم اللہ الرحمن الرحیم

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ১০ এপ্রিল, ২০২০ মোতাবেক ১০ শাহাদাত, ১৩৯৯ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা

তাশাহ্হুদ, তাঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
বর্তমানে করোনা-ভাইরাসের কারণে উদ্ভ‚ত পরিস্থিতি আপন-পর সবাইকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে রেখেছে। মানুষ চিঠিপত্র লিখে নিজেদের দুশ্চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করে যে, তারা নিজেদের প্রিয়জন, ঘনিষ্টজন ও আত্মীয়স্বজনের অসুস্থতার কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা যে রোগই হোক না কেন। অন্য রোগ হলেও এই অবস্থায় (সবার পক্ষ থেকে) অনেক বেশি দুশ্চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে যে, দুর্বল শরীর কোথাও এই মহামারীতে আক্রান্ত না হয়ে পড়ে। আহমদীদের কয়েকজন এই রোগে আক্রান্তও হয়েছেন। যাহোক, এক উৎকণ্ঠা বিশ্ববাসীকে ঘিরে রেখেছে। একজন মুরব্বী সাহেব আমাকে লিখেছেন, এটি কী হয়ে গেল আর কী হচ্ছে- কিছুই বুঝতে পারছি না! তার কথা সঠিক, বাস্তবতাও তাই। অর্থাৎ বিশ্বের কী হচ্ছে তা বুঝাই যাচ্ছে না। আল্লাহ্ তা’লা বর্তমান যুগের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলেন,
وَقَالَ الْإِنْسَانُ مَا لَهَا (সূরা যিলযাল: ৪) অর্থাৎ মানুষ বলে উঠবে যে, এর কী হয়েছে? হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) আজ থেকে প্রায় শতবছর পূর্বে অর্থাৎ ১৯২০ সনের ফেব্রয়ারি মাসে মহামারি, দুর্ভিক্ষ, বিপদাপদ এবং ঝড়-তুফান বা প্লাবনের উল্লেখ করে এই আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, পূর্বে এক-আধবার মহামারি বা দুর্যোগ দেখা দিত। কিন্তু বর্তমান যুগ এমন যাতে বিপদাপদের (পুরো) দ্বার খুলে গেছে। আমিও বিগত কয়েক বছর ধরে একথা বলছি যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আবির্ভাবের পর আর বিশেষভাবে যখন থেকে তিনি জগদ্বাসীকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং স্বর্গীয় বিপর্যয় সম্পর্কে অবহিত করেছেন, সতর্ক করেছেন তখন থেকে বিশ্বে ঝড়-তুফান, ভুমিকম্প এবং মহামারির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এসব মহামারি এবং বিপদাপদ সামগ্রিকভাবে মানুষকে সতর্ক করার জন্য দেখা দিচ্ছে যে, তোমরা তোমাদের স্রষ্টার প্রাপ্য অধিকারও প্রদান কর আর আল্লাহ্ তা’লার সৃষ্টিকুলের প্রাপ্যও দাও, তাঁর বান্দার প্রাপ্য অধিকারও প্রদান কর। কাজেই এমন পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদেরও আল্লাহ্ তা’লার প্রতি পূর্বের চেয়ে বেশি ঝুঁকতে হবে আর বিশ্ববাসীকেও সতর্ক করতে হবে।

কিছু রোগব্যধি, মহামারি এবং ঝড়-তুফান বা প্লাবন যখন পৃথিবীতে দেখা দেয় তখন স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব প্রত্যেকের ওপর পড়ে। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)ও এটি বলেছেন যে, একথা সঠিক যে, কোন কোন পরীক্ষার সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই, কিন্তু আমরা যেহেতু এ পৃথিবীতে বসবাস করি তাই অনেক বিষয়ে, যেমন মহামারি, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতিতে আমাদেরও কিছুটা অংশীদার হতে হয় অর্থাৎ আমরাও এতে আক্রান্ত হই, আমাদের ওপরও এগুলো প্রভাব বিস্তার করে। তিনি (রা.) বলেন, ঐশী জামা’তকে এ থেকে পুরোপুরি নিরাপদ রাখা হবে এটি কখনো হয় না; কেননা এটি ঐশী প্রজ্ঞা-পরিপন্থী। কিন্তু মু’মিনরা এসব বিপদাপদে আল্লাহ্ তা’লার সমীপে বিনত হয়ে, তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা হিসেবে পার হয়ে যায়। কাজেই যেমনটি আমি বলেছি, এদিনগুলোতে আমাদের বিশেষভাবে আল্লাহ্ তা’লার সমীপে অনেক বেশি বিনত হওয়া উচিত আর তাঁর দয়া ও কৃপার ভিক্ষা চাওয়া উচিত। এজন্য প্রত্যেক আহমদীর পূর্বের চেয়ে বেশি আল্লাহ্র দরবারে বিনত হওয়া উচিত। কেউ কেউ মন্তব্য করে বসে যে, এ মহামারি নিদর্শনস্বরূপ, তাই সাবধানতা অবলম্বনের কোন প্রয়োজন নেই অথবা কোন প্রকার চিকিৎসার প্রয়োজন নেই বা এমন সব মন্তব্য করে বসে যা অন্যদের আবেগ-অনুভূতিতেও আঘাত হানে।


আমরা জানি না যে, এটি নিদর্শন কিনা বা বিশেষ কোন নিদর্শন কিনা। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা অবশ্যই বলতে পারি, যেমনটি আমি এখনও বললাম, আর কয়েক খুতবা পূর্বেও এ ব্যাধির উল্লেখ করার সময় প্রারম্ভেই বলেছিলাম যে, হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর আগমনের পর জাগতিক এবং স্বর্গীয় বা ঐশী বিপর্যয় ও দুর্যোগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং মোটের ওপর এটিকে নিঃসন্দেহে নিদর্শন বলা যেতে পারে, কিন্তু এটিকে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর যুগের প্লেগের সাথে তুলনা করা আবার এ ধরনের কথা বলা যে যেসব আহমদী এই রোগে আক্রান্ত বা এতে মৃত্যু বরণ করেছে তাদের ঈমান দুর্বল বা দুর্বল ছিল নাঊযুবিল্লাহ্, এটি বলার অধিকার কারো নেই। প্লেগ হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর জন্য একটি নিদর্শন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও মহানবী (সা.) এই রোগে মৃত্যুবরণকারীকেও শহীদ আখ্যায়িত করেছেন, কিন্তু তখন প্লেগ যেহেতু নিদর্শন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল আর এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’লা তাঁকে (আ.) বিশেষভাবে অবহিতও করেছিলেন আর তিনি (আ.) এ সম্পর্কে ঘোষণাও করেছিলেন যে, এটি একটি নিদর্শন। অধিকন্তু এ বিষয়ে জামা’তকে দিক-নির্দেশনাও প্রদান করেছিলেন; তাই তাঁর (আ.) যুগের প্লেগের একটি ভিন্ন বিশেষত্ব ছিল। কিন্তু একইসাথে তখনও হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) জামা’তকে এক বিশেষ উপলক্ষ্যে বলেছিলেন, বরং মুফতি সাহেবকে বলেন যে, পত্রিকায় এই ঘোষণা ছাপিয়ে দিন যে, আমি আমার জামা’তের জন্য অনেক দোয়া করি যেন আল্লাহ্ তা’লা জামা’তকে রক্ষা করেন। কিন্তু পবিত্র কুরআন থেকে এটি প্রমাণিত যে, ঐশী কোপানল যখন বর্ষিত হয় তখন পাপাচারীদের সাথে পুণ্যবানরাও প্রভাবিত হয় আর এরপর তাদের বিচার নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী হবে। পুণ্যবানদের ওপর এর কোন প্রভাব পড়বে না তা নয়। হ্যাঁ, পুণ্যবানদের ওপরও এর প্রভাব পড়বে। যেমনটি পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেছেন, এটি প্রকৃতির নিয়ম, প্রভাব পড়ে থাকে। পুনরায় তিনি বলেন, দেখ! হযরত নূহ (আ.)-এর তুফান বা প্লাবন সবাইকে প্রভাবিত করেছে, আর জানা কথা যে, প্রত্যেক পুরুষ, মহিলা ও শিশু এ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিল না যে, নূহ্ (আ.)-এর দাবি এবং তার সত্যতার প্রমাণ কী কী ছিল। কিন্তু তারা প্লাবনের কবলে নিপতিত হয়েছে। অতঃপর তিনি বলেন, জিহাদে যেসব বিজয় লাভ হয়েছে সেগুলো সবই ইসলামের সত্যতার নিদর্শনস্বরূপ ছিল। মহানবী (সা.)-এর সাথে সাহাবীরা জিহাদে অংশ নেন। সেসব জিহাদে বিজয় লাভ হয়। এরপর খুলাফায়ে রাশেদীন এর যুগেও জিহাদ করা হয়েছে। এগুলোতে কখনো কখনো পরাজয়ও হয়; কিন্তু মোটের ওপর বিজয়ই লাভ হয়েছে। তিনি বলেন, এগুলো সবই ইসলামের সত্যতার নিদর্শন ছিল। কিন্তু এর প্রত্যেকটিতে কাফেরদের পাশাপাশি মুসলমানরাও নিহত হয়েছে। কেবল কাফেররাই নিহত হয়েছেন তা নয়। অর্থাৎ সেসব জিহাদ নিদর্শন হলেও সেগুলোতে মুসলমানরাও নিহত হয়েছে; আর নিহত মুসলমানরা শহীদ আখ্যায়িত হয়েছে। তিনি (আ.) বলেন, অনুরূপভাবে প্লেগ আমাদের সত্যতার একটি নিদর্শন, আর এতে আমার জামা’তের কতিপয় সদস্যও শহীদ হতে পারে। এরপর তিনি বলেন, প্রথমে আল্লাহ্র অধিকার প্রদান কর, নিজ মনকে কামনা-বাসনা থেকে পবিত্র রাখ, এরপর সৃষ্টিকুলের অধিকার প্রদান কর। খোদা তা’লার প্রতি সত্যিকার ঈমান আনয়ন কর। আর বিগলিত চিত্তে আল্লাহ্ তা’লার কাছে দোয়ায় রত থাক। কোন দিন যেন এমন না আসে যেদিন তুমি খোদা তা’লার কাছে কেঁদে কেঁদে দোয়া কর নি। তিনি বলেন, এরপর বাহ্যিক বা জাগতিক উপায় উপকরণকে গুরুত্ব দাও। অর্থাৎ যত বাহ্যিক সাবধানতা রয়েছে তা অবলম্বন কর। তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি ঐশী তকদীরের অধীনে প্লেগে আক্রান্ত হয় তার সাথে এবং তার পরিবার-পরিজনের সাথে পূর্ণ সহমর্মিতা প্রদর্শন কর এবং সকল সম্ভাব্য উপায়ে তাদের সাহায্য কর। তার চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রষায় কোন ত্রটি করো না, অর্থাৎ সকল প্রকার চেষ্টা কর। তিনি বলেন, কিন্তু স্মরণ রেখো, সহানুভূতি প্রদর্শনের অর্থ এটি নয় যে, তার বিষাক্ত নিঃশ্বাস বা পোশাকের (বিষয়ে সাবধান হবে না আর) নিজে আক্রান্ত হয়ে পড়বে। সহানুভূতি অবশ্যই প্রদর্শন কর, কিন্তু সবধানতা অবলম্বন করাও আবশ্যক। তাদের (রোগ) থেকে মুক্ত বা নিরাপদ থাকাও আবশ্যক, বরং এর প্রভাব থেকে আত্মরক্ষা কর।
অতএব, এ থেকে আমাদের যে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত তা হলো, যারাই সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়াচ্ছে তাদের উচিত প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যেমন বর্তমানে বলা হচ্ছে, মাস্ক পরিধান কর বা অন্যান্য সতর্কতামূলক বিষয়গুলো সামনে রাখা উচিত। একইভাবে বিনা কারণে মানুষের ঘরে আনাগোনা করা থেকে বিরত থাকা উচিত। সরকারও বারণ করেছে, তাই এটি এড়িয়ে চলা উচিত।
বর্তমানে এখানে অর্থাৎ যুক্তরাজ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বলা সত্তেও বা নিষেধ করা সত্তে¡ও মানুষ পার্ক ইত্যাদিতে গিয়ে একত্রে মেলামেশা করছে। শুধুমাত্র হাঁটতে যাওয়া বা কিছুটা খোলা বাতাসে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু পার্কে বসে পিকনিক বা আনন্দ-উল্লাস আরম্ভ করার বা লোকসমাগমের অনুমতি নেই। এমন কাজ অন্যায়। প্রশাসন বারবার এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। উপরন্তু গাড়িতে বসে তারা সেখানে চলে যায়। প্রশাসন বলেছে, তোমরা যদি বল যে, আমরা মুক্ত বাতাসে হাঁটতে বা ব্যায়াম করতে যাই তাহলে ঘর থেকে পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে পার্কে যাও। গাড়িতে সবাই একসাথে বসে পার্কে যাচ্ছ, এটাও ভ্রান্ত রীতি। কাউন্সিল এখন কিছু কিছু জায়গায় পার্কিং সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে অর্থাৎ গাড়ি আসারই অনুমতি নেই বা গাড়ি পার্ক করার অনুমতি নেই। যাহোক, এধরনের আচরণ থেকে আহমদীদের বিরত থাকতে হবে। সাহায্য-সহযোগিতা করার কাজ যাদের ওপর ন্যস্ত, যেমন খোদ্দামুল আহমদীয়া অনেক স্বেচ্ছাসেবী সরবরাহ করেছে, এছাড়া অন্যান্যরাও সাহায্য করছেন; তাদের উচিত সকল সাবধানতা ও দোয়ার মাধ্যমে সাহায্য করার এই দায়িত্ব পালন করা আর সব ধরনের অসাবধানতা থেকে বিরত থাকা। বিনা কারণে নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবেন না। এটা বীরত্ব নয় বরং এটাকে অজ্ঞতা বলা হয়। অতএব, খুবই সাবধান থাকুন। এরপর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, আল্লাহ না করুন, কেউ যদি এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তাহলে সে শহীদ। তাকে গোসল দেয়াও আবশ্যক নয় এবং নতুন কাফন পরানোরও প্রয়োজন নেই। তার সাথে শহীদের মতোই আচরণ করা হয়। এটি সে সময়ের কথা যখন প্লেগের মহামারি ছিল। এখানে সরকার কিছুটা অনুমতি দিয়ে রেখেছে যে, কেউ চাইলে গোসলও দিতে পারে এবং কাফনও পরাতে পারে। সে যুগে যে মারাত্মক পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল তার নিরিখে তিনি (আ.) বলেছিলেন যে, এসবের প্রয়োজন নেই। এরপর গুরুত্ব সহকারে তিনি বলেন, তোমরা বাড়ি-ঘর খুব ভালোভাবে পরিষ্কার কর। এ বিষয়ে তিনি বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সেই সাথে এ কথাও বলেছেন যে, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করার পাশাপাশি নিজেদের পোষাক-পরিচ্ছদও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখ। নালা-নর্দমাও নিয়মিত পরিষ্কার করাও। এখানে ভূগর্ভস্থ পয়োনিষ্কাষণ ব্যবস্থা রয়েছে। যেসব অনুন্নত দেশে এসব নালা-নর্দমা খোলা, বিশেষভাবে সেখানে নিয়মিত নালা পরিষ্কার করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

এরপর হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বিশেষভাবে এ কথা বলেছেন যে, সবচেয়ে অগ্রগণ্য বিষয় হলো, তোমরা নিজেদের অন্তঃকরণকে পবিত্র কর এবং খোদা তা’লার সাথে পূর্ণ মিমাংসায় আস। অতএব, সম্প্রতি এই মহামারি বিস্তারের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেখানে সবাই প্রভাবিত, যেমনটি কি-না মানুষ লিখছে, আমাদেরকে এসব বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়া উচিত। আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের জন্য দোয়ার পথ উন্মুক্ত রয়েছে। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের জন্য দোয়ার পথ খোলা রেখেছেন এবং তিনি দোয়া গ্রহণ করেন এই দৃঢ়বিশ^াস নিয়ে আল্লাহ্র সামনে আমাদেরকে বিনত হতে হবে। যদি সত্য অন্তঃকরণে তাঁর সামনে ঝুঁকা যায় তাহলে নিশ্চয় তিনি দোয়া কবুল করেন। তিনি তা কীভাবে কবুল করেন তা তিনিই ভালো জানেন। সার্বিকভাবে নিজের জন্য, নিজ আত্মীয়-স্বজনের ও প্রিয়জনদের জন্য, জামা’তের জন্য এবং সর্বোপরি গোটা মানবজাতির জন্য দোয়া করা উচিত।


পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে আর এদের মাঝে আহমদীরাও থেকে থাকবে, যাদের কাছে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য যথেষ্ট উপকরণ নেই, যাদের চিকিৎসা সুবিধা নেই, খাদ্য-পানীয়ের সুব্যবস্থা নেই। আল্লাহ্ তা’লা তাদের এবং আমাদের সবার প্রতি কৃপা করুন। এমন পরিস্থিতিতে আমরা জামা’তীভাবে প্রত্যেক আহমদীর কাছে খাদ্যসামগ্রী ইত্যাদি পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি কিন্তু তা সত্তে¡ও হয়ত ঘাটতি রয়ে যায়। আহমদীদের ঘরে খাদ্যসামগ্রী ও চিকিৎসা-সেবা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা থাকে, কিন্তু তা সত্তে¡ও ঘাটতি থেকে যায়। আমরা বরং অন্যদের কাছেও যেখানে প্রয়োজন রয়েছে খাদ্যসামগ্রী, চিকিৎসা-সেবা প্রভৃতি সুযোগ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করি। আমরা নিঃস্বার্থভাবে পূর্ণ সহমর্মিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব সেবা করে থাকি। তথাপি কতিপয় বিদ্বেষী সংবাদমাধ্যম বা নামসর্বস্ব আলেমরা এই অপবাদ আরোপ করে যে, আহমদীরা সেবা করছে বা খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করছে অথবা চিকিৎসা-সেবা দিচ্ছে, নিজেদের প্রচারের জন্য; যেন আহমদীদের তবলীগের পথ সুগম হয়। যাহোক এসব আপত্তিতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। আল্লাহ্ তা’লা আমাদের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত আছেন। পুনরায় আমি বলব, এদিনগুলোতে আপনারা বেশি বেশি দোয়া করুন, অনেক দোয়া করুন। আল্লাহ্ তা’লা ব্যক্তিগতভাবে জামা’তের প্রতিটি সদস্যকে আর সমষ্টিগতভাবে পুরো জামা’তকে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীয় সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বেষ্টনীতে স্থান দিন। আল্লাহ্ তা’লা আমাকেও এবং আপনাদেরকেও দোয়া করার আর দোয়া কবুলিয়তের কল্যাণে কল্যাণমন্ডিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন।


কতক আহমদী ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্যে আমি আরেকটি কথা বলতে চাই, ব্যাবসা-বাণিজ্যের সাথে জড়িত আহমদীরা এ দিনগুলোতে স্বীয় পণ্যসামগ্রীতে অযৌক্তিক মুনাফা করার চেষ্টা যেন না করে। বিশেষত খাদ্যসামগ্রী ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মুনাফা করার পরিবর্তে তাদের উচিত এসব জিনিস ন্যূনতম লাভে বিক্রয় করা। মানবতার সেবা করার এখনই সময় যার কথা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)ও বলেছেন অর্থাৎ, সহমর্মিতার চেতনা জাগ্রত কর। এ দিনগুলো বান্দার অধিকার প্রদানের দিন আর এটি খোদা তা’লার নৈকট্য লাভের মৌসুমও বটে। আল্লাহ্ তা’লা ব্যবসায়ীদেরকে এমন পরিস্থিতিতে অযৌক্তিক মুনাফা করার পরিবর্তে এক বিশেষ সহমর্মিতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের ব্যাবসাবাণিজ্য করার তৌফিক দিন।


এখন আমি আমাদের একজন খুবই নিষ্ঠাবান কর্মী ও জামা’তের সেবক মোহতরম নাসের আহমদ সাঈদ সাহেবের স্মৃতিচারণ করব, যিনি সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। ঐশী নিয়তির অধীনে তিনি ০৫ এপ্রিল তারিখে মৃত্যুবরণ করেছেন,إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ।
নাসের আহমদ সাঈদ সাহেব ১৯৫১ সনে শিয়ালকোট জেলার ডেস্কায় তাজ দীন সাহেবের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল তাজ দীন। তিনি জন্মগত আহমদী ছিলেন। বেশি পড়াশোনা করেন নি, ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ১৯৭৩ সনে নাযারাতে উমুরে আম্মার অধীনে বিশেষ নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে তাঁর পদায়ন হয়। ১৯৮৪ সনে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রহে.)-এর রাবওয়া থেকে হিজরত করার পর ১৯৮৫ সনে লÐনে তার বদলী হয়ে যায়। এরপর তিনি তার কাজ (সেখানে) অব্যাহত রাখেন। জামা’তের নিয়ম অনুসারে বয়সের দৃষ্টিকোণ থেকে ২০১০ সালের অক্টোবরে তাকে অবসর দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অবসরের পরও তিনি নিজ কাজ চালিয়ে যান এবং দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় তৃতীয় খলীফার যুগ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অর্থাৎ আমার যুগ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য লাভ করেছেন।
নাসের সাঈদ সাহেব বহু গুণের আধার ছিলেন। পরম বিশ্বস্ততা এবং জাগ্রত মনমানসিকত নিয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করতেন। আহমদীয়া খিলাফতের সাথে তাঁর সুগভীর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। মৃত্যুর সময় স্ত্রী কুলসুম বেগম সাহেবা এবং এক পুত্র খালেদ সাঈদ ও খালেদ সাঈদ সাহেবের সন্তানসন্ততি রেখে গেছেন। খালেদ সাঈদ সাহেবও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে হেফাজতে খাস (তথা বিশেষ নিরাপত্তা বিভাগ)-এ ডিউটি দিয়ে থাকেন। আল্লাহ্ তা’লা তাকেও নাসের সাঈদ সাহেবের ন্যায় বিশ্বস্ত করুন এবং তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণের তৌফীক দিন আর নাসের সাঈদ সাহেবের স্ত্রীকে ধৈর্য্য ও মনোবল দান করুন। তাঁর এক আত্মীয় অর্থাৎ মামাতো ভাই হলেন রাবওয়া নিবাসী মাহমুদ সাহেব, যার তিনি সমবয়সীই হবেন আর তিনি পূর্বে সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তিনি বলেন, নাসের সাঈদ সাহেবের পিতামাতাও তাকে বলেছিলেন যে, সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে যাও অথবা অন্য কোন চাকরি কর। তিনি তাদেরকে উত্তরে বলেছিলেন, কোন চাকরি করতে হলে জামা’তের চাকরিই করব অন্যথায় আমাদের এই যে ছোট ফসলি জমি আছে, এতে চাষাবাদ করব। আমি যেমনটি বলেছি, এরপর তিনি এসে জামা’তের কাজে নিযুক্ত হয়ে যান। তার এক আত্মীয় লিখেছেন যে, তিনি সকল আত্মীয়-স্বজনের সাথে খুবই আন্তরিক ভালোবাসাপূর্ণ ব্যবহার করতেন। অনেক অভাবী আত্মীয়কে অন্যের অগোচরে সাহায্যও করতেন।
রাবওয়ার বিশেষ নিরাপত্তা বিভাগের জনাব শকূর সাহেব বলেন, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত লন্ডনে নাসের সাঈদ সাহেবের সাথে আমার ডিউটি দেয়ার সুযোগ হয়েছে। আমি তাঁকে সর্বক্ষেত্রে খিলাফতের এক বিশ্বস্ত এবং অনুগত সেবক হিসেবে পেয়েছি আর খুবই বিশ্বস্ততার সাথে তিনি দায়িত্ব পালন করতেন। সর্বদা ডিউটির জন্য নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই পৌঁছে যেতেন আর কোন গোপন কথা হলে সর্বদা গোপনই রাখতেন। নিজ সহকর্মীদেরও তিনি এ উপদেশই দিতেন যে, গোপন বিষয় গোপন রাখা উচিত। তিনি নিজ সঙ্গীসাথিকেও কখনো উক্ত গোপন বিষয় সম্পর্কে বলতেন না। হেফাজতে খাস বা বিশেষ নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান মেজর মাহমুদ সাহেব লিখেছেন যে, নাসের সাঈদ সাহেব অত্যন্ত বিশ্বস্ত একজন কর্মী ছিলেন। তাঁর আত্মার বিচরণস্থল ছিল খিলাফতে আহমদীয়া। তিনি জগতিক কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ছিলেন। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মের কাজ করা। ধর্মের কাজ ছাড়া তার আর কোন চিন্তাভাবনাই ছিল না। জীবনের অন্তিম নিঃশ^াস তিনি খিলাফতের দোরগোড়ায় নেয়ার আন্তরিক বাসনা রাখতেন আর সেটিই তিনি বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। আতিথেয়তায়ও তিনি (অন্যদের চেয়ে) যোজন যোজন এগিয়ে ছিলেন। এক্ষেত্রে তার দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া ভার। ছোট-বড় সকলের সম্মানের বিষয়ে সচেতন ছিলেন আর নিজের সিনিয়রদের খুবই সম্মান করতেন। কখনো কোন অভিযোগ-অনুযোগ করেন নি। সর্বদা প্রতিটি আদেশ পালন করা নিজের অবশ্যকরণীয় কর্তব্য জ্ঞান করতেন। মেজর সাহেব লিখেন যে, তিনি ওয়াকেফে জীন্দেগীর এক অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন। আর এটিই সত্য, তিনি নিজ জীবনে নিঃস্বার্থভাবে সেবা করে গেছেন।
জামেয়া আহমদীয়া, জার্মানীর এক ছাত্র হারুন সাহেব লিখেন যে, বেশ কয়েকবার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে, দু’দলের মাঝে কোন বিবাদবিসংবাদ দেখলে তিনি মীমাংসা বা আপোস করানোর ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতেন। তিনি বলেন, আমি তাকে একবার জিজ্ঞেস করলাম, ছুটিতে আপনি কি কখনো কোথাও বেড়াতে যান? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, যুগ-খলীফার সকাশে উপস্থিত থাকা এবং ডিউটি দেয়াই ওয়াকেফ জীন্দেগীর ছুটি; অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকা উচিত নয়। এছাড়া বহুলোক তার নৈতিকতা, আতিথেয়তা, হাসিখুশী থাকা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেছেন। যদিও তিনি জামা’তের বড় কোন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না, কিন্তু এক সাধারণ সেবক হওয়া সত্তে¡ও সর্বজনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যার সাথেই সাক্ষাৎ হতো, তার মন কেড়ে নিতেন।
জার্মানীর নাসির বাজওয়া সাহেব বলেন, তিনি অত্যন্ত উন্নত চরিত্র ও স্বভাবের অধিকারী মানুষ ছিলেন। সবার মঙ্গল কামনা করতেন এবং সবসময় অন্যের সেবা করার জন্য প্রস্তুত থাকতেন। অন্যের সাহায্য করে আনন্দ পেতেন আর এতে তিনি আত্মিক প্রশান্তি বোধ করতেন। সকল দেশের মানুষের পত্র আসছে, সবগুলো এখানে উল্লেখ করাও সম্ভব নয়। আমেরিকার এক খাদেম সৈয়দ ওয়ায়েসও লিখেছেন যে, যখনই তিনি আমেরিকা সফরে আসতেন অতি হাস্যবদনে সাক্ষাৎ করতেন, কখনো তার মাঝে ক্লান্তির ছাপ পরিলক্ষিত হতো না আর খোদ্দামের সাথেও তিনি পরম ভালোবাসার সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং ভালোবাসার সাথে তাদেরকে বুঝাতেন আর তাদের সাহস ও মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করতেন; এটি তার অনেক বড় একটি গুণ ছিল।
ফিরোজ আলম সাহেবও তার অনেক গুণাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন- বিশেষভাবে তাঁর বিনয় ও নম্রতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি যখন এখানে একা ছিলেন তখন তার আতিথেয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি তার ইবাদতের কথাও উল্লেখ করেছেন যে, হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর অসুস্থতার দিনগুলোতে তাহাজ্জুদের সময় মসজিদে আমি তাকে অত্যন্ত বিগলিতচিত্তে দোয়া করতে দেখেছি।
জার্মানীর খোদ্দামুল আহমদীয়ার সাবেক সদর হাসনাত সাহেব, একজন ওয়াকেফে জিন্দেগী। তিনিও এটিই লিখেছেন যে, তার নিষ্ঠা, ডিউটিতে একাগ্রতা ও খিলাফতের প্রতি বিশ^স্ততা দেখে সবসময় ঈর্ষা হতো। একদিকে ছিল পরম সরলতা অপরদিকে তার মাঝে এক অদ্ভুত অন্তর্দৃষ্টিও ছিল। তিনি আরো বলেন, খোদ্দামুল আহমদীয়ার সদর হওয়ার সুবাদে ডিউটির বিষয়ে অনেক কিছু তার কাছে শেখার সুযোগ হয়েছে।
তিনি কখনো তার স্বাস্থ্যের কথা বলতেন না বা বয়স বেশি হওয়ার কথা প্রকাশ করেন নি। তার ডিউটির সময় তাকে অন্যদের মতোই যুবক মনে হতো। সদর সাহেব অর্থাৎ হাসনাত সাহেব লিখেন, আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি, বয়স বেশি হওয়ার কারণে তাকে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবে, এটি তিনি সহ্যই করতেন না বা পছন্দ করতেন না। অর্থাৎ অন্যান্য খোদ্দাম যেভাবে ডিউটি দিচ্ছে, অন্যান্য নিরাপত্তা-কর্মীরা যেভাবে ডিউটি দিচ্ছে- আমিও সেভাবেই ডিউটি দিব। তার চেয়ে ছোটদের সাথেও খুব সম্মানসূচক ব্যবহার করতেন, ¯েœহ করতেন। তিনি বলেন, তার ব্যবহার দেখে আমরা খুব লজ্জিত হতাম। আমাদের ডিউটি পালনকারী খোদ্দামের তিনি মনোবল চাঙ্গা করতেন অর্থাৎ তাদের উৎসাহিত করতেন। তিনি খুব ভালো একটি কথা লিখেছেন; তিনি লিখেন, মানুষ কথা বলে বা ক্যাম্পের আয়োজন করে কাউকে প্রশিক্ষণ দেয়; কিন্তু তার প্রশিক্ষণ ছিল নিঃস্বার্থভাবে নিজের ডিউটি পালন করা আর উপস্থিত-বুদ্ধি, নিষ্ঠা এবং দোয়া। তিনি বলেন, কোথাও দেখা হলে, কথা বলার সুযোগ হলে, সবসময় এটি-ই বলতেন যে, দোয়া করবেন আমার পরিণতি যেন শুভ হয়।
অন্যান্যরা যেসব গুণের কথা লিখেছেন রাশিয়ান ডেস্কের খালিদ আহমদ সাহেব সেগুলো ছাড়া এটিও লিখেছেন যে, তিনি কেবল নিজেই অন্যের অজান্তে অভাবীদের সাহায্য করতেন না, বরং জামা’তের বহু সচ্ছল সদস্যকেও নিজেদের দরিদ্র ও অভাবী ভাই-বোনদের সাহায্য করার প্রতি সর্বদা মনোযোগ আকর্ষণ করতেন এবং অনুপ্রাণিত করতেন।
তার আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল অতিথিদের সম্মান করা। বিশেষভাবে জলসার দিনগুলোতে তার এই গুণ পরমরূপে বিরাজমান থাকত। জলসায় আগত অতিথিদের আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা করতেন এবং অনেক অতিথিকে- তারা কেন্দ্র থেকে এসে থাকুক কিংবা অন্য স্থান থেকেই আসুক না কেন তাদেরকে প্রত্যেকদিন সকাল-সন্ধ্যা নিজ ঘরে দাওয়াত করে অকৃত্রিম আসর বসাতেন এবং উপাদেয় ও সুস্বাদু খাবার খাওয়াতেন। সেই সাথে মেহমানদেরকে মসজিদে বিছানো একটি জায়নামায উপহার দিতেন।
জার্মানীর আতহার জুবায়ের সাহেবও অন্যান্য গুণাবলীর পাশাপাশি এ কথাই লিখেছেন যে, খিলাফতের সাথে তাঁর গভীর বিশ্বস্ততার সম্পর্ক ছিল, তিনি খুবই নিষ্ঠাবান ছিলেন। কথাবার্তার ধরন খুবই স্নেহময় ও কোমল ছিল। আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি, পরবর্তী শিফটে আগমনকারী কর্মীর আসতে দেরী হলেও তিনি কোন অভিযোগ করতেন না বরং যুগ খলীফার (নিরাপত্তার) ডিউটিতে কিছুটা বেশী সময় পেয়েছেন বলে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করতেন। সর্বদা ডিউটি দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতেন। অসুস্থ থাকলেও ডিউটি ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার আকাক্সক্ষা করতেন না। এমনকি আমি শুনেছি অন্তিম রোগের সময়ও তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন যে এখন কয়টা বাজে? ছেলে যখন সময় জানাল তখন তিনি বলেন তাহলে আজকের ডিউটি তো গেল, অর্থাৎ আজ আমি ডিউটিতে যেতে পারব না। ভীষণ অসুস্থতার সময়ও তার মাথায় ডিউটির চিন্তা ছিল।
এখানকার এক ভদ্র মহিলা হলেন হামদা রশীদ সাহেবা। তিনি বলেন, মরহুম খুবই স্নেহশীল এবং উৎসাহ দানকারী পুণ্যবান বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। খোদ্দামের জন্য তিনি আদর্শ ছিলেন। কঠোর পরিশ্রম করে এবং একাগ্রতার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করতেন। খিলাফতের সাথে আন্তরিক ভালোবাসা রাখতেন। সর্বদা খোদ্দামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতেন, তোমাদেরকে আন্তরিক ভালোবাসার সাথে যুগ খলীফার ডিউটি পালন করতে হবে এবং এটিকে অন্য সব কিছুর ওপর অগ্রগণ্য করতে হবে।
ইন্দোনেশিয়ার মুরব্বী সিলসিলাহ সৈয়দ ত্বা’হা নূর সাহেব বলেন, যখনই আমার সাথে তার সাক্ষাৎ হতো তিনি ইন্দোনেশিয়ার কথা বলতেন। যখন তিনি ২০০০ সনে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে-র সাথে ইন্দোনেশিয়া গিয়েছিলেন, তখনকার স্মৃতি রোমন্থন করতেন।
তিনি বলেন, সেখানে কাপড় ধোয়ার ব্যবস্থা ছিল না। একবার মসজিদে আসলে আমরা তাকে বললাম, আমাদেরকে দিন, বাইরে থেকে ধুয়ে এনে দিচ্ছি। কিন্তু তিনি এবং তার সঙ্গীরা বলেন, আমরা নিজেরাই কাপড় ধুই। আরো বলেন, আমরা তো চাকর-বাকর মানুষ; অন্যরা আমাদের কাপড় ধুয়ে দিবে আমরা এত বড় হইনি। অনেক বলার পরও তিনি নিজের কাপড় দেন নি। বাহ্যত এগুলো ছোট ছোট সাধারণ বিষয়, কিন্তু একজন ওয়াকেফে জিন্দেগীর মৌলিক চেতনা কেমন হওয়া উচিত তা এসব বিষয় থেকে বুঝা যায়, অর্থাৎ একজন ওয়াকেফে জিন্দেগীর কেমন হওয়া উচিত তা বুঝা যায় আর যুবকদের জন্যও এতে শিক্ষা রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের সাবেক মোহতামীম মোকামী আদনান জাফর সাহেব লিখেন, ডিউটি দেয়ার প্রতি আমাদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতেন, ডিউটির সময় খাদ্য-পানীয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন। অন্যান্য কথার সাথে তিনি বিশেষ যে বিষয় লিখেছেন তা হলো, তিনি আমাকে খিলাফতের প্রতি শিষ্টাচার শিখিয়েছেন, খিলাফতের সাথে দৃঢ় সম্পর্কের মর্ম শিখিয়েছেন। অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। যখনই কোন বিষয়ে তার কাছে পরামর্শ চেয়েছি সবসময় উপকৃত হয়েছি। হেফাজতে খাস-এর (বিশেষ নিরাপত্তা বিভাগের) কর্মচারী আতহার সাহেব লিখেন, আমি নয় বছর তার সাথে ডিউটি করেছি অর্থাৎ ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত। উমুমী বিভাগে কর্মরত ছিলাম, এরপর হেফাজতে খাস-এ যোগ দেই। আতহার সাহেব নাসের সাঈদ সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন যে, আপনি আটচল্লিশ (৪৮) বছর যাবৎ তিন খলীফার সাথে ডিউটি করেছেন, আমাকে কোন উপদেশ দিন যাতে আমিও আপনার মতো ডিউটি দিতে পারি। তিনি বলেন, এখানে কাজ করার নিয়ম হলো, তোমার চোখ ও কান খোলা রাখবে আর মুখ বন্ধ রাখবে, আর সেই সাথে দোয়াতে রত থাকবে। এই উপদেশ মেনে চলা সাধারণভাবে সকল ওয়াকেফে জিন্দেগীর জন্য আবশ্যক, বরং জামা’তের সকল কর্মচারী ও জামা’তের বিভিন্ন পর্যায়ে সেবা দানকারী এবং কর্মকর্তাদের জন্যও এটি আবশ্যক। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা। তাকে সবাই লালাজী বলে ডাকত। যিনি এই চিঠি লিখেছেন তিনি বলেন, লালাজীর সাথে কাজ করে বুঝতে পেরেছি যে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যে কাজটি যেভাবে সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ দিবে তা সেভাবেই করতে হবে। কোন কাজ যেভাবে করার নির্দেশ দেয়া হয় তিনি সেভাবেই করতেন এবং অন্যদের দিয়েও সেভাবেই করাতেন। এ নির্দেশে নিজের মনগড়া কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন না অর্থাৎ কাজটি অন্য ভাবেও করা যেতে পারে এটি বলতেন না। তিনি লিখেন, তাকে যতটুকু বলা হতো বা যেভাবে করতে বলা হতো, তিনি কাজটি ঠিক সেভাবেই করতেন এবং আমাদের দিয়েও কাজটি সেভাবেই করাতেন। যদি কেউ বলত যে, অমুক শিফট-ইনচার্জ তো এভাবে করেন, এতে তিনি বলতেন যে, তিনি কীভাবে করেন তা আমি জানি না। আমাকে যেভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমি সেভাবেই করবো। তিনি আরও লিখেন, মরহুম সর্বদা দোয়া করার কথা বলতেন আর বলতেন যতদিন জীবিত আছি, আল্লাহ্ তা’লা যেন সুস্থ-সবল রাখেন আর যখন মৃত্যুর সময় হবে, তখনও যেন আল্লাহ্ সুস্থ-সবল অবস্থাতেই নিয়ে যান, কারো মুখাপেক্ষি যেন না হতে হয়। আল্লাহ্ তা’লা তার সাথে এমনই আচরণ করেছেন। আল্লাহ্ তা’লা মরহুমের সাথে ক্ষমার আচরণ করুন, তাঁর মর্যাদা উন্নীত করুন। তাঁর স্ত্রীকেও সুস্থ-সবল জীবন দিন এবং ধৈর্য ও মনোবল দান করুন। আর আমি যেমনটি পূর্বেও বলেছি, তাঁর ছেলেকেও বিশ^স্ততার সাথে খিলাফত ও জামা’তের সাথে সম্পৃক্ত রাখুন, অধিকন্তু তার সন্তানসন্ততি ও বংশধরদেরও।
তিনি যখন জামা’তের কাজ করার উদ্দেশ্যে রাবওয়ায় এসেছিলেন আমি তাকে তখন থেকেই চিনি। যারা-ই আমাকে তার গুণাগুণ সম্পর্কে যা-ই লিখেছেন, সবই সঠিক। তিনি অত্যন্ত নিঃস্বার্থ ও নিবেদিত প্রাণ কর্মী ছিলেন এবং শতভাগ আনুগত্যকারী ছিলেন। এমন এক সময় তার মৃত্যু হয়েছে যখন জানাযার নামাযে খুব বেশি মানুষ যোগ দিতে পারবে না।
কিছুদিন তিনি হৃদরোগে ভুগেছেন, এনজিয়োপ্লাস্টিও হয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন আর হাসপাতালে যান। ডাক্তাররা হাসপাতালে ভর্তি করে বলে, গুরুতর হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় করোনা ভাইরাসেরও আক্রমণ হয়। তিনি পূর্বেই কারো মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন নাকি বর্তমান পরিস্থিতে হাসপাতালেই আক্রান্ত হয়েছেন তা আল্লাহ্ তা’লাই ভালো জানেন। যাহোক, কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন। এখানকার আইনগত বিধি-নিষেধের কারণে লাশ এখানে আনাও সম্ভব নয় এবং কয়েকজন নিকটাত্মীয় ছাড়া জানাযায় অংশগ্রহণ করাও সম্ভব নয়। জানাযার জন্যও শর্ত হলো, লাশঘর বা কবরস্থানেই জানাযা হবে। যাহোক, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আমিও অন্য কোন সময় তার গায়েবানা জানাযা পড়াবো, ইনশাআল্লাহ্। আমি যেমনটি বলেছি, অগণিত মানুষ মরহুমের অনেক গুনের কথা লিখেছেন আর যা যা লিখেছেন তা সত্য লিখেছেন, তার ভেতর আসলেই সেসব গুণ ছিল যেমনটি আমি পূর্বেই বলেছি, তিনি তার অঙ্গীকার এবং কর্তব্য বিশ^স্ততার সাথে পালন করে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’লার সাথে যে অঙ্গীকারই তিনি করেছেন তা তিনি পূর্ণ করেছেন বলেই আমরা তার জীবনে দেখতে পাই। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি সেসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) শহীদ আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা’লা তাকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করুন। অন্য যেসব আহমদী এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন আল্লাহ্ তা’লা তাদের সাথেও কৃপা ও ক্ষমার আচরণ করুন। কার অবস্থা কেমন তা আল্লাহ্ তা’লাই সবচেয়ে ভালো জানেন। প্রত্যেকেই যেন আল্লাহ্ তা’লার কৃপা ও ক্ষমা লাভ করে- আমরা এ দোয়াই করছি।