শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ, হযরত উমর (রা.) জুমুআর খুতবা ৮ অক্টোবর ২০২১

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ৮ অক্টোবর, ২০২১ মোতাবেক ৮ইখা, ১৪০০ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা

তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
হযরত উমর (রা.)-এর যুগের বিজয়াভিযানের আলোচনা অব্যাহত আছে। হযরত উমর (রা.)-এর জীবনীকার আল্লামা শিবলী নো’মানী হযরত উমর (রা.)-এর বিজয়সমূহ এবং বিজয়ের কারণ ও নেপথ্য-কাহিনীর উল্লেখ করতে গিয়ে লেখেন: একজন ঐতিহাসিকের হৃদয়ে স্বভাবতই এই প্রশ্ন জাগবে যে, মুষ্টিমেয় মরুবাসী কীভাবে পারস্য এবং রোমান সম্রাটের সিংহাসন উল্টে দিল? এটি কি পৃথিবীর ইতিহাসের কোন ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ছিল? এসব জয়ের নেপথ্যে কারণ কী ছিল? এসব বিজয় কি সেকেন্দার এবং চেঙ্গিস খানের বিজয়ের সাথে তুলনা করা যায়? যা কিছু ঘটেছে এতে আদেশ দেয়ার মালিক খলীফার ভূমিকা কতটুকু? এক্ষেত্রে আমরা ঐসকল প্রশ্নের উত্তর দেয়া আবশ্যক কিন্তু সংক্ষেপে এটি বলাও আবশ্যক যে, হযরত ওমর ফারুকের বিজয়ের ব্যাপ্তি এবং এর চতুঃসীমার বিস্তৃতি কোন্ পর্যন্ত ছিল। হযরত উমর (রা.)-এর অধিকৃত দেশসমূহের মোট আয়তন বাইশ লক্ষ একান্ন হাজার ত্রিশ বর্গমাইল। অর্থাৎ পবিত্র মক্কা নগরী থেকে উত্তর দিকে এক হাজার ছত্রিশ মাইল, পূর্ব দিকে এক হাজার সাতাশি মাইল এবং দক্ষিন দিকে চারশত তিরাশি মাইল ছিল। এই সব বিজয় ছিল মূলত হযরত উমর (রা.)-এর বিজয় আর এসব ঘটেছে সর্বমোট দশ বছরের কিছু বেশি সময়ে। ইতিহাসের বরাতে এতক্ষণ আমি যা তুলে ধরলাম, ঐসকল বিজয়ের কারণগুলো বুঝতে গেলে এ প্রেক্ষাপট জানা আবশ্যক। যাহোক, এখন আমি ঐসকল বিজয়ের বিষয়ে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মতামত বর্ণনা করছি। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, তৎকালীন পারস্য এবং রোমান সাম্রাজ্য তাদের শৌর্যবীর্য হারিয়ে বসেছিল অর্থাৎ তারা তাদের উন্নতির চরম মার্গে পৌঁছে গিয়েছিল। আর ঐশী তকদীর অনুযায়ী সেখান থেকে তাদের পতন হওয়ার-ই ছিল। এরপর তারা বলেন, পারস্যে খসরু পারভেজের পর রাজ্য-ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছিল কেননা সরকার পরিচালনার যোগ্য কোন ব্যক্তি তখন ছিল না। দরবারের হর্তাকর্তা এবং সভাসদদের মাঝে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর এই ষড়যন্ত্রের ফলে ক্ষমতার হাতবদল হতো। মোটকথা তিন-চার বছরের মাঝেই ক্ষমতার বাগডোর ছয় থেকে সাত জন শাসকের হাতে আসে আর বেরিয়ে যায়। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা বলেন, এর আরও একটি কারণ ছিল, নওশেরওয়াঁর কিছু পূর্বে মায্দাকিয়া ফির্কার দুরন্ত উত্থান হয় যারা নাস্তিক্য ও যিন্দিক্যের প্রতি ঝুঁকে ছিল। [ ইসলামের মৌলিক ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক ধারণা রাখে এমন লোকদের জন্য মুসলমানরা ‘যিন্দিক’ শব্দটি ব্যবহার করত। এছাড়া ম্যানচাইয়ান, জরাথ্রুষ্টিয়ান, ধর্মত্যাগী, কাফের এবং ইসলাম বিরোধী কিছু দার্শনিককে মুসলমানরা ‘যিন্দিক’ বলে অভিহিত করত। কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মান্ধ বুঝাতেও ‘যিন্দিক’ শব্দ ব্যহার করা হয়- উইকিপিডিয়া দ্রষ্টব্য ] এই ফির্কার বিশ্বাস ছিল, মানুষের হৃদয় থেকে লোভ এবং অন্যান্য মতভেদ দূর করা উচিত এবং নারীসহ সমস্ত সহায়সম্পত্তিকে এজমালী সম্পত্তি আখ্যা দেয়া উচিত (তথা তখন মহিলাদের কোন সম্মান ছিল না) যেন ধর্ম পাক-পবিত্র হয়ে যায়। এই ছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। অনেকের দৃষ্টিতে এটি ছিল সামাজিক আন্দোলন যার উদ্দেশ্য ছিল জরাতুশ্ত ধর্মকে পরিশোধন করা। নওশেরওয়াঁ অস্ত্রবলে এই ধর্ম দমন করলেও একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হন নি। ইসলাম যখন পারস্যে গিয়ে উপনীত হল, তখন এই ধর্মের অনুসারীরা মুসলমানদেরকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে পৃষ্ঠপোষক মনে করল যে, ইসলাম অন্য কোন ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ^াসের বিরুদ্ধে আগ্রাসী নয়। এই ছিল ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকদের মতামত।
এরপর তারা লেখেন, খ্রিষ্টানদের মাঝে নেস্টোরিয়ান ফির্কা, যারা অন্য কোন দেশে আশ্রয় পেত না, তারা ইসলামের পতাকাতলে আশ্রয় নিয়ে বিরোধীদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়।
এভাবে সহজেই দু’টি বৃহৎ সম্প্রদায়ের সহমর্মিতা ও সাহায্য-সহযোগিতা মুসলমানদের হস্তগত হয়। রোমান সাম্রাজ্য স্বয়ং দুর্বল হয়ে পড়েছিল। একইসাথে সে সময় খৃষ্টানদের পারস্পরিক মতবিরোধ তুঙ্গে ছিল। আর যেহেতু সে সময় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় হস্তক্ষেপ ছিল, এজন্য এই মতবিরোধের প্রভাব কেবলমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এই কারণে স্বয়ং সাম্রাজ্য ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। আল্লামা ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের এই অভিমতের অপনোদন করেতে গিয়ে বর্ণনা করেন যে, যদিও এই উত্তর বাস্তবতা বিবর্জিত নয় কিন্তু বাস্তবতার চেয়ে যুক্তি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে অতিশায়োক্তি বৈ কিছু নয়, যা ইউরোপের একটি বিশেষ রীতি। নিঃসন্দেহে সে সময় পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য ক্ষমতার তুঙ্গে ছিল না, কিন্তু এর পরিণামে তারা হয়তো কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্যের মোকাবিলা করার সামর্থ্য রাখতো না; এটি নয় যে আরবের ন্যায় দুর্বল জাতির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। রোমান ও পারসীরা রণকৌশলে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল। গ্রীসে বিশেষ রণকৌশল সম্পর্কিত যে সকল পুস্তকাদি রচিত হয়েছিল এবং যা এখনও বিদ্যমান আছে, রোমানদের মধ্যে একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এর ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রচলন ছিল। একইসাথে রসদসামগ্রীর প্রাচুর্যতা ছিল, দ্রব্যসামগ্রীর আধিক্য ছিল, বিভিন্ন প্রকারের সমরাস্ত্র ছিল, সৈন্যসংখ্যায়ও কোন প্রকারের স্বল্পতা আসে নি আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, কোন দেশ অতিক্রম করার প্রয়োজন ছিল না, বরং নিজ দেশে, নিজস্ব দুর্গে, আপন ঘাঁটিতে থেকে নিজ দেশকে সুরক্ষা করতে হত। মুসলমানদের আক্রমণের স্বল্পকাল পূর্বে খসরু পারভেজের রাজত্বকালে, যা ইরানের শৌর্যবীর্য ও আভিজাত্যের স্বর্ণালী যুগ ছিল, রোমান সম্রাট ইরানের ওপর আক্রমণ করে এবং প্রতি পদক্ষেপে ক্রমাগত বিজয় লাভ করে ‘ইসফাহান’ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সিরিয়ার প্রদেশসমূহ যা ইরানীরা ছিনিয়ে নিয়েছিল সেগুলো পুনরুদ্ধার করে এবং নতুনরূপে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। ইরানে সাধারণভাবে এটি স্বীকৃত বিষয় যে, খসরু পারভেজ পর্যন্ত (ইরানী) সাম্রাজ্যের যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। খসরু পারভেজের মৃত্যুকাল থেকে মুসলমানদের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত সময় ছিল মাত্র তিন-চার বছর। এত স্বল্প সময়ে একটি জাতি ও প্রাচীন সাম্রাজ্য কতটুকু-ই বা দুর্বল হতে পারে? অবশ্য শাসকদের পরিবর্তনের ফলে ব্যবস্থাপনায় পার্থক্য এসেছিল। কিন্তু যেহেতু রাজ্যের পরিচালনার বিভিন্ন বিভাগে যেমন ধনভাণ্ডার, সৈন্যসংখ্যা ও কর আদায়ের ক্ষেত্রে কোন প্রকার ঘাটতি আসে নি, এজন্য যখন ইয়াযদ্যারদ ক্ষমতায় আসীন হয় এবং সভাসদরা সংশোধনের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে তখন অতি দ্রুততার সাথে পুনরায় সেই জাঁকজমক ফিরে আসে। মুযদাকিয়াহ সম্প্রদায় যদিও ইরানে বিদ্যমান ছিল, তথাপি সমগ্র ইতিহাসে তাদের পক্ষ হতে কোন প্রকারের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের কথা জানা যায় না। অর্থাৎ মুসলমানরা কোন সাহায্য লাভ করেছে (তা পরিলক্ষিত হয় না)। তদ্রুপ নাসতুরী সম্প্রদায়েরও কোন প্রকারের সাহায্য-সহযোগিতা করার বিষয়ে আমাদের জানা নেই। নাসতুরী একটি খৃষ্টান ফিরকা যাদের ধর্মবিশ্বাস ছিল, হযরত ঈসা (আ.)-এর সত্ত্বায় ঈশ্বরত্ব ও মনুষ্যত্ব পৃথক পৃথক বিদ্যমান ছিল। খৃষ্টানদের পারস্পরিক ধর্মীয় মতবিরোধের প্রভাব সম্পর্কে স্বয়ং ইউরোপের ইতিহাসবিদরা কোন ঘটনা প্রসঙ্গেও কোথাও বর্ণনা করে নি। এখন আরবদের অবস্থা দেখুন! পুরো সৈন্যবাহিনী যারা মিশর, ইরান ও রোমানদের সাথে যুদ্ধে রত ছিল, তাদের মোট সংখ্যা কখনও এক লক্ষ পর্যন্ত পৌঁছায় নি। রণকৌশল সম্পর্কিত জ্ঞানের অবস্থা দেখুন, ইয়ারমুকের যুদ্ধেই সর্বপ্রথম আরবরা তাবিয়্যাহ্ রীতি অনুযায়ী সারি বিন্যাস করে। তাবিয়্যাহ হচ্ছে যুদ্ধের সময় সৈন্যবাহিনীর এমন সারি বিন্যাস যেখানে সেনাপতি বা বাদশাহ্, যিনি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন, তিনি সেনাবাহিনীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকেন এটিকে তাবিয়্যাহ্ বিন্যাস বলে।
শিরস্ত্রাণ, লৌহবর্ম, বর্ম (লোহা বা ইস্পাতনির্মিত পোশাক), জোশান (এক প্রকারের লৌহবর্ম), সাজোয়া, চার আয়না অর্থাৎ ইস্পাতের চারটি প্লেট যা বক্ষে, পিঠে ও দুই উরুতে বাঁধা হতো, লোহার মোজা, ঝিলাম (শিরস্ত্রাণ-এ লাগানো লোহার কড়া বা নিকাব), মোজা- যা প্রত্যেক ইরানী সৈন্যের আবশ্যকীয় যুদ্ধ পোশাক ছিল। এর মধ্যে আরবদের নিকট শুধুমাত্র বর্ম ছিল, আর তা-ও অধিকাংশ চামড়ার হতো। প্রতিপক্ষের সমগ্র নিরাপত্তাজনিত সাজ-সরঞ্জাম লোহার হতো আর আরবদের নিকট যদি কিছু থেকেও থাকতো তবে তা চামড়ার হতো। রিকাব (উট বা ঘোড়ার জিনের সাথে লাগানো আংটা) লোহার পরিবর্তে কাঠের হতো।
যুদ্ধাস্ত্রের মাঝে লৌহগদা ও ফাঁদ সম্বন্ধে আরবরা একেবারে অজ্ঞ ছিল। লৌহগদা একটি হাতিয়ারের নাম যা উপরের দিকে গোল ও মোটা এবং নিচে হাতল লাগানো থাকে যা দ্বারা শত্রæর মাথায় আঘাত করে। কমান্দ হল ফাঁদ বা জাল বা রশি। আরবদের কাছে তির ছিল, কিন্তু এত ছোট এবং নি¤œমানের ছিল যে, কাদিসিয়ার যুদ্ধে ইরানীরা যখন প্রথম প্রথম আরবদের তির দেখল তখন সেগুলোকে এক প্রকার লৌহ দন্ড এবং বড় সুঁই মনে করল।
লেখক আল্লামা সাহেব তাদের প্রকৃত কারণ বর্ণনা করে লিখেন যে, আমাদের কাছে এই প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর কেবল এতটুকু যে, মুসলমানদের মাঝে সেই সময় মহানবী (সা.)-এর কল্যাণে যে উদ্দীপনা, দৃঢ়সংকল্প, প্রত্যয়, অবিচলতা, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস, সাহসিকতা সৃষ্টি হয়েছিল এবং যাকে হযরত উমর (রা.) আরও শক্তিশালী এবং দৃঢ় করে তুলেছিলেন যে, রোমান এবং পারস্য সাম্রাজ্য ক্ষমতার তুঙ্গে থাকা অবস্থায়ও এর প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারত না। অবশ্য এর সাথে আরও কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছিল যা বিজয়ে নয়, বরং রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে মুসলমানদের পুণ্য ও সততা ছিল। যে দেশ বিজিত হত সেখানকার লোকেরা মুসলমানদের পুণ্য ও সততার এতটা আসক্ত হয়ে যেত যে, ধর্মীয় মতবিরোধ সত্ত্বেও তাদের রাষ্ট্রক্ষমতার পতন চাইত না।
ইয়ারমুকের যুদ্ধের পূর্বে লড়াইয়ের জন্য যখন মুসলমানরা সিরিয়ার বিভিন্ন জেলা থেকে বের হল তখন সমস্ত খ্রিষ্টান প্রজারা চিৎকার করে বলে, খোদা তোমাদেরকে পুনরায় এ দেশে ফিরিয়ে আনুন এবং ইহুদিরা তওরাত হাতে নিয়ে বলেছিল, আমাদের জীবিত থাকা অবস্থায় রোমানরা এখানে প্রবেশ করতে পারবে না। সিরিয়া এবং মিশরে রোমানদের যে শাসন ছিল তা ছিল স্বৈরাচারিতামূলক। তাই রোমানরা যে যুদ্ধ করেছে তা রাষ্ট্রক্ষমতা ও সেনাবাহিনীর শক্তিতে করেছে, প্রজারা তাদের সাথে ছিল না। মুসলমানরা যখন রাজত্বের শক্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয় এরপর দিগন্ত ছিল পরিষ্কার, কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। অর্থাৎ প্রজাদের পক্ষ থেকে কোন প্রকার প্রতিরোধ ছিল না। যদিও ইরানের অবস্থা এ থেকে ভিন্ন ছিল, সেখানে রাষ্ট্রের অধীনে অনেক বড় বড় রইসরা ছিল যারা বড় বড় জেলা ও প্রদেশের মালিক ছিল। তারা রাজত্বের জন্য নয় বরং নিজেদের ব্যক্তিগত ক্ষমতার জন্য লড়াই করত। এ কারণেই রাজধানী বিজয় করার পরও পারস্যে মুসলমানদের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু সাধারণ প্রজারা সেখানেও মুসলমানদের প্রতি দুর্বল হয়ে যেত আর এ কারণে বিজয়ের পর রাষ্ট্রক্ষমতার স্থায়িত্বে তাদের অনেক সাহায্য লাভ হত। রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় সুবিধা হত।
আরেকটি বড় কারণ ছিল যে, মুসলমানদের প্রথমদিকের আক্রমণ সিরিয়া এবং ইরাকে হয়েছে আর উভয় স্থানে ব্যাপকভাবে আরব বসবাস করত। সিরিয়াতে দামেস্কের শাসক গাসসানি বংশের ছিল, যে শুধু নামেমাত্র কায়সার কর্তৃক শাসিত ছিল। ইরাকে লাখনি বংশ দেশের মালিক ছিল। যদিও কিসরাকে টেক্স হিসেবে কিছু দিত। এই আরবরা খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়ার কারণে প্রথমদিকে মুসলমানদের সাথে লড়াই করেছে কিন্তু জাতিগত একতার প্রেরণা বৃথা যেতে পারে না। ইরাকের বড় বড় নেতা অনেক দ্রæত মুসলমান হয়ে গেছে এবং মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর তারা মুসলমানদের সাহায্যকারী হাতে পরিণত হয়ে গেল। সিরিয়াতে অবশেষে আরবরা ইসলাম গ্রহণ করল এবং রোমানদের রাজত্ব থেকে মুক্ত হয়ে গেল।
আলেকজান্ডার এবং চেঙ্গীস প্রমুখদের নাম নেয়া এখানে একেবারে অযৌক্তিক। নিঃসন্দেহে এই দুইজন অনেক বড় বড় বিজয় লাভ করেছে কিন্তু কীভাবে? কঠোরতা, অত্যাচার ও গণহত্যার মাধ্যমে। চেঙ্গীসের অবস্থা তো সবাই জানে। আলেকজান্ডার প্রমুখদের বিজয়ের সাথে যদি তুলনা করা হয় তাহলে আলেকজান্ডারের অবস্থা হলো, যখন সে সিরিয়ার সুর শহর জয় করল সে সেখানকার লোকদের গণহত্যার আদেশ দিয়েছিল কেননা সেখানকার লোকেরা দৃঢ়তার সাথে লড়াই করেছে। এক হাজার নাগরিকের মাথা শহররক্ষা প্রচীরে টাঙ্গিয়ে দেয়া হয়েছিল। এর পাশাপাশি ৩০ হাজার বাসিন্দাকে দাস দাসি বানিয়ে বিক্রয় করে দিয়েছে। যারা আদিবাসী এবং স্বাধীনচেতা ছিল তাদের একজনকেও জীবিত ছাড়ে নি।
একইভাবে যখন পারস্যের প্রাচীন শহর ইস্তাখার জয় করে তখন সব পুরুষকে হত্যা করে। এমনই আরো অনেক নিষ্ঠুর কর্মকান্ড আলেকজান্ডারের বিজয়গাঁথায় উল্লিখিত আছে। তাই ইসলামী বিজয়ের সাথে এসবের তুলনা করা কীভাবে যুক্তিযুক্ত হতে পারে? এটি সর্বজনবিদিত কথা যে, অত্যাচার ও নিপীড়নে রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। এটি এ দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক যে, অন্যায়ের স্থায়িত্ব নেই। যেমন আলেকজান্ডার ও চেঙ্গিসের রাজত্বও দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। কিন্তু তাৎক্ষণিক বিজয়ের জন্য এ ধরনের রক্তপাত ও পৈষাচিকতা কার্যকরী সাব্যস্ত হয়েছে। এর ফলে দেশের পর দেশ ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে আর নাগরিকদের অধিকাংশই যেহেতু মারা যায় তাই বিদ্রোহ এবং বিশৃঙ্খলার কোন আশঙ্কা থাকে না। একারণেই চেঙ্গিস, নবুকদ নযর, তৈমুর, নাদের শাহদের মত যত বড় বড় বিজয়ী গত হয়েছে তাদের সবাই নৃশংস ছিল কিন্তু হযরত উমর (রা.)-এর বিজয়গুলোর মাঝে কখনো নীতি ও ন্যায়নিষ্ঠাকে বিসর্জন দেয়া হতো না। মানুষ হত্যা করা তো দূরের কথা বৃক্ষ কাটারও অনুমতি ছিল না। শিশুকিশোর ও বৃদ্ধদের কোনরূপ ক্ষতিসাধন করা হতো না। যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ নিহত হয়ে গেলে সেকথা ভিন্ন। অর্থাৎ যুদ্ধ চলাকালে এদের কেউ যদি নিহত হয়ে যায় তাহলে হতে পারে কিন্তু এছাড়া কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা হতো না। শত্রুদের সাথে কোন ক্ষেত্রে চুক্তিভঙ্গ বা প্রতারণা করা যেত না। কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হতো যে, শত্রু যদি তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তাহলে তোমরা তাদের সাথে প্রতারণা করবে না, কারো নাক-কান কাটবে না, কোন শিশুকে হত্যা করবে না- এ শর্ত মেনে প্রকাশ্যে যুদ্ধ কর। যারা অনুগত হয়ে আবার বিদ্রোহী হয়ে যেত অর্থাৎ একবার আনুগত্য করে আবার বিদ্রোহী হয়ে যায় তাদের কাছ থেকে পুনরায় চুক্তির নবায়ন করে ক্ষমা করে দেয়া হতো। এমনকি আরাবাসুসবাসীরা যখন পরপর তিনবার চুক্তি করে তা ভঙ্গ করে তাদেরকে কেবল সেখান থেকে দেশান্তরিত করে দিয়েছে কিন্তু একই সাথে অধিকৃত পুরো সম্পত্তির মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। টাকা তাদেরকে দিয়ে দিয়েছে। আরবাবুস সিরিয়ার শেষ সীমান্তে অবস্থিত একটি শহরের নাম, এর সীমান্ত এশিয়া মাইনরের সাথে সংযুক্ত ছিল। এরপর লিখেন, খয়বারের ইহুদীদেরকে ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহের কারণে যদি দেশান্তরিত করা হয়ে থাকে তাহলে তাদের কাছ থেকে অধিকৃত সম্পত্তির মূল্য আদায় করা হয়েছিল সেই সাথে জেলাগুলোতে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে যে, এরা যে পথে যাবে তাদেরকে যেন পূর্ণ সাহায্য-সহযোগিতা করা হয় এবং তারা কোন শহরে অবস্থান করলে এক বছর পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে কোনরূপ কর আদায় করা হবে না। এরপর লিখেন, যারা উমর (রা.)-এর যুগের বিস্ময়কর বিজয়গাঁথার অপনোদনে বলে যে, পৃথিবীতে এমন আরো অনেক বিজয়ী গত হয়েছে। তাদেরকে এটি দেখানো উচিত যে, এত সাবধানতা, এমন নিয়মনীতি মেনে এবং এমন ক্ষমা-মার্জনার মাধ্যমে পৃথিবীতে কোন্ শাসক এক ইঞ্চি ভূখন্ডও জয় করেছে।? এছাড়া আলেকজান্ডার ও চেঙ্গিস প্রমুখ নিজেরা প্রতিটি উপলক্ষে এবং প্রতিটি যুদ্ধে যোগদান করতো এবং নিজেরা সেনাপতি হয়ে সৈন্যদেরকে যুদ্ধ করাতো আর এর ফলে একদিকে যেমন তারা এক সুদক্ষ সেনাপতি পেতো, মনোবলও দৃঢ় থাকতো আর স্বাভাবিকভাবেই তাদের মাঝে মনিবের জন্য আত্মবিলীন করে দেয়ার প্রেরণা সৃষ্টি হতো। হযরত উমর (রা.) তার পুরো খেলাফতকালে একটি যুদ্ধেও যোগদান করেন নি। তার সৈন্যরা সব জায়গায় কাজ করছিল। অবশ্য তাদের লাগাম হযরত উমর (রা.)-এর হাতেই থাকতো। আরেকটি বড় ও সুস্পষ্ট পার্থক্য হলো, আলেকজান্ডার প্রমুখের বিজয়সমূহ প্রবহমান মেঘের ন্যায় ছিল। একবার প্রবল বেগে এসে আবার চলে গেছে। তারা যে সমস্ত দেশ জয় করেছে সেগুলোতে কোন প্রকার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করে নি। এর বিপরীতে হযরত উমর ফারুক (রা.)-এর বিজয়সমূহের দৃঢ়দিক হলো, যেসব দেশ সেসময় বিজিত হয়েছে তেরশ’ বছর অতিবাহিত হওয়া সত্তে¡ও আজও মুসলমানদের অধীনে রয়েছে এবং স্বয়ং হযরত উমর (রা.)-এর খেলাফতকালেই সেসব দেশে সব ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
এরপর বিজয়সমূহে হযরত উমর (রা.)-এর বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে লিখেন, সাধারণের মতানুসারে শেষ প্রশ্নের উত্তর হলো, এসব বিজয়ে যুগ-খলীফার তেমন কোন অবদান নেই বরং তখন বিরাজমান উচ্ছাস-উদ্দীপনা ও দৃঢ়-সংকল্পের ফলে এসব বিজয় লাভ হয়েছে। এটি একটি প্রশ্ন। কিন্তু তিনি বলেন, খলিফার সক্রিয় ভূমিকা নেই কথাটি আমার মতে সঠিক নয়। হযরত ঊসমান (রা.) এবং হযরত আলী (রা.)’র যুগেও তো একই মুসলমান ছিলেন কিন্তু ফলাফল কী হয়েছে? তাঁদের উদ্দীপনা, প্রভাব, নিঃসন্দেহে বৈদ্যুতিক শক্তি কিন্তু এসব শক্তি তখনই কার্যকর সাব্যস্ত হয় যখন কার্যনির্বাহকও সেই একই বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতার অধিকারী হয়। কোন ধরণের অনুমান ও যুক্তি-প্রমাণের প্রয়োজন নেই; বাস্তব ঘটনাই এর সিদ্ধান্ত দিতে পারে। বিজয়াভিযানগুলোর বিস্তারিত বৃত্তান্ত পড়ে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, গোটা সেনাবাহিনী ক্রীড়নকের ন্যায় হযরত উমর (রা.)’র দিক-নির্দেশনায় চলতো আর সেনাবাহিনীর নিয়ম-শৃঙ্খলাও ছিল তাঁর বিশেষ (রা.) বিচক্ষণ রাষ্ট্রনীতি ও পরিকল্পনার ফল। হযরত উমর (রা.) সেনাবাহিনীর কাঠামো বিন্যাস, সৈন্যদের প্রশিক্ষণ, সেনানিবাস বা ব্যারাকসমূহের নির্মাণ, যুদ্ধে ব্যবহৃত ঘোড়ার প্রশিক্ষণ, দুর্গের নিরাপত্তা, শীত ও গ্রীষ্মের নিরীখে আক্রমণের সিদ্ধান্ত প্রদান, সেনাদের নিযুক্তি ও রিপোর্টিং এর ব্যবস্থা, সেনাকর্মকর্তা মনোনয়ন , দুর্গ ভাঙ্গার অস্ত্রাদি ব্যবহার এসব জিনিস এবং এধরনের আরো বিষয়াদি নিজেই উদ্ভাবন করেন আর এগুলোকে কী বিস্ময়কর দৃঢ়তার সাথে সুপ্রতিষ্ঠিত রেখেছেন! এই হলো হযরত উমর (রা.)-এর বৈশিষ্ট্য। ইরাক বিজয়ের সময় প্রকৃতপক্ষে হযরত উমর (রা.) স্বয়ং সেনাপ্রধানের ভূমিকা পালন করেছেন। সেনাবাহিনী যখন মদীনা থেকে রওনা হয় তখন প্রতিটি মঞ্জিল বরং রাস্তা পর্যন্ত নিজে সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, এখান থেকে যাবে আর এই পথ ব্যবহার করবে; এখানে এই কাজ করবে এবং তদনুযায়ী তিনি (রা.) নিয়মিত লিখিত দিক-নির্দেশনা প্রেরণ করতেন। সেনাবাহিনী যখন কাদসীয়া’র কাছাকাছি পৌঁছে তখন তিনি (রা.) রণক্ষেত্রের মানচিত্র চেয়ে পাঠান এবং তদানুযায়ী সেনাবাহিনীর বিন্যাস ও সারির শৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রেরণ করতেন। সেনা কর্মকতারা যে যে কাজে নিযুক্ত হতেন তারা মূলত তাঁরই বিশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী সেই দায়িত্বে নিযুক্ত হতেন। তাবারীর ইতিহাসে ইরাক যুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ গভীরভাবে লক্ষ্য করলে সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হয় যে, দূর থেকে এক মহান সেনানায়ক গোটা সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করছেন এবং আর সব-ই তাঁর ইশারায়ই ঘটছে। দশ বছরে সংঘটিত এ সব যুদ্ধাভিযানে দু’টি রণক্ষেত্র ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ; প্রথমতঃ নাহাওয়ান্দের যুদ্ধ যখন ইরানীরা পারস্যের প্রতিটি প্রদেশে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ পাঠিয়ে গোটা দেশে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল এবং লক্ষ লক্ষ সৈন্য জড় করে মুসলিম শিবির অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল। আর দ্বিতীয়তঃ যখন রোমান বাদশাহ জাযিরা’র অধিবাসীদের সহযোগিতায় দ্বিতীয় বার হিমসের ওপর আক্রমণ করেছিল। এ দু’টি যুদ্ধেই কেবল হযরত উমর (রা.)’র বিচক্ষণ ও সুচৌকস রণকৌশলই ছিল যা একদিকে সৃষ্ট তুফানকে স্তিমিত করে দেয় আর অন্যদিকে একটি দুর্গম পর্বতকে ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছে। এসব ঘটনার বিবরণ থেকে এই দাবি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পৃথিবীর জানা ইতিহাসে, হযরত উমর ফারুক (রা.)’র মত আজ পর্যন্ত কোন এমন বিজয়ীও দেশ করতলগতকারী জন্মে নি যে যুগপৎ বিজয় এবং ন্যায়পরায়ণতার সমাহার হবে। অর্থাৎ বিজয়ও অর্জন করেছে পাশাপাশি ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও সুবিচারও করেছে।
হযরত উমর (রা.)-এর শাহাদতের বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর দোয়া দেয়া সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। তিনি (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ বলেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর থেকে বর্ণিত, একবার মহানবী (সা.) হযরত উমর (রা.)-কে শুভ্র পোষাক পরিহিত দেখতে পান। তিনি (সা.) জিজ্ঞেস করেন, তোমার এই পোষাকটি কি নতুন নাকি ধোয়া পোষাক? হযরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমার ঠিক মনে নেই, হযরত উমর (রা.) এর কী জবাব দিয়েছেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তাঁকে দোয়া দিতে গিয়ে বলেন, নতুন পোষাক পরিধান কর এবং প্রশংসনীয় জীবনযাপন কর; শহীদের মৃত্যু লাভ কর। হযরত ইবনে উমর (রা.) বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে, মহানবী (সা.) এ কথাও বলেছেন, আল্লাহ্ তা’লা তোমাকে ইহ ও পরকালে চোখের স্নিগ্ধতা দান করুন।
হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) হযরত আবু বকর (রা.), হযরত উমর (রা.) এবং হযরত উসমান (রা.) কে সাথে নিয়ে উহুদ পাহাড়ে উঠেন তখন তাদের নিয়ে উহুদ পাহাড় কাঁপতে থাকে। তিনি (সা.) বলেন, হে উহুদ! থেমে যাও, তোমার ওপর একজন নবী, একজন সিদ্দিক এবং একজন দুইজন শহীদ রয়েছেন। হযরত উবাই বিন কা’ব বর্ণনা করেন যে, মহানবী (সা.) বলেছেন, জিবরাঈল আমাকে বলেছেন, হযরত উমরের মৃত্যুতে গোটা ইসলামী বিশ্ব কাঁদবে। হযরত উমরের শাহাদতের আকাঙ্খা সম্পর্কে একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সা.) এর পবিত্র সহধর্মিনী উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা (রা.) বর্ণনা করেন যে, আমি আমার বাবা-কে একথা বলতে শুনেছি যে,
اللهمارزقنىقتلافيسبيلكوفاتافيبلادنبيك আরবী ঠিক করতে হবে
অর্থাৎ হে আল্লাহ্ আমাকে তোমার রাস্তায় শাহাদতের সৌভাগ্য দাও এবং আমাকে তোমার নবী (সা.)-এর শহরে মৃত্যু দাও। তিনি বলেন যে, আমি বললাম এটি কিভাবে সম্ভব? তখন হযরত উমর (রা.) বলেন,
اناللهياتيبامرهاناشاء আরবী ঠিক করতে হবে
অর্থাৎ নিশ্চয় আল্লাহ্ যেভাবে চান তার আদেশ কার্যকর করেন। হযরত উমর (রা.) শাহাদত সম্পর্কে যে দোয়া করেছিলেন তার উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) বলেন, হযরত উমর (রা.) আল্লাহ্ তা’লার কত নৈকট্যভাজন ছিলেন! মহানবী (সা.) বলেন, আমার পর যদি কেউ নবী হত, তাহলে উমর হত। এখানে আমার পর কথার মর্মার্থ হল অব্যবহিত পর। অতএব সেই ব্যক্তি যাকে মহানবী (সা.)ও এই সম্মানের যোগ্য মনে করতেন যে, যদি আল্লাহ্ তা’লার এই যুগের প্রয়োজনে কোন ব্যক্তিকে শাহাদতের মর্যাদা থেকে উন্নীত করে নবুওয়তের উচ্চ মর্যাদায় আসীন করার থাকতো তাহলে হযরত উমর (রা.) এর যোগ্য ছিলেন। সেই উমর (রা.), যার আত্মত্যাগ দেখে ইউরোপের কঠোর বিরোধীও স্বীকার করে যে, এই ধরনের ত্যাগ স্বীকারকারী এবং এভাবে আত্মপেষণকারী মানুষ খুব কমই পাওয়া যায়। এমনকি তারা তার অবদানের বিষয়ে এতটা অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়ে ইসলামের উন্নতি কেবল তার সাথেই সম্পৃক্ত করে বসে। সেই উমর (রা.) দোয়া করতেন যে, হে খোদা! আমার মৃত্যু যেন মদিনায় হয় এবং যেন শাহাদতের মৃত্যু হয়। হযরত মুসলেহ মাওউদ (রা.) লিখেন, হযরত উমর (রা.) এই দোয়া ভালবাসার আতিশয্যে করেছেন অন্যথায় এই দোয়া অত্যন্ত মারাত্মক ছিল। এর অর্থ দাড়ায়, কোন এমন ভয়াবহ আক্রমণকারী সৃষ্টি কর যে সমস্ত ইসলামী দেশসমূহ বিজয় করে মদিনায় আসবে এরপর সেখানে তাকে (রা.) শহীদ করবে। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা যিনি হৃদয়ের অবস্থা জানেন তিনি হযরত উমর (রা.)-এর এই ইচ্ছাও পূরণ করেছেন এবং মদিনাকেও সেই বিপদ থেকে সুরক্ষিত রেখেছেন যা মূলত এই দোয়ার অন্তরালে লুক্কায়িত ছিল। আর এটি এভাবে হয়েছে যে, তিনি মদিনাতেই এক কাফিরের হাতে তাকে (রা.) শহীদ করিয়েছেন। যাহোক, হযরত উমরের দোয়া থেকে জানা যায় যে, তার (রা.) নিকট খোদা তা’লার নৈকট্যের লক্ষণ হলো, নিজের প্রাণ তার রাস্তায় উৎসর্গের সুযোগ লাভ করা। হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) তার এক খুতবায় আহমদীদের নসীহত করতে গিয়ে বলেন,আজ খোদার কোন বান্দার প্রাণ রক্ষা করাকেই খোদার নৈকট্যের লক্ষণ বলে মনে করা হয় ।
অন্য একস্থানে হযরত উমর (রা.) এর শাহাদতের ঘটনা এবং দোয়ার ঘটনা উল্লেখ করতে গিয়ে হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) বলেন, হযরত উমর (রা.) সম্পর্কে উল্লিখিত আছে যে, তিনি (রা.) সর্বদা দোয়া করতেন তার মৃত্যু যেন মদিনায় হয় এবং যেন শাহাদতের মৃত্যু হয়। দেখ, মৃত্যু কত ভয়ংকর বিষয়! মৃত্যুর সময় একান্ত আপনজনরাও সঙ্গ ছেড়ে দেয়। মানুষ মৃত্যুকে কতটা ভয় পায় এ সম্পর্কে মুসলেহ মওউদ (রা.) একটি গল্প শুনিয়ে বলছেন। ভয়ের এই ঘটনাটি হলো, একবার জনৈক মহিলার মেয়ে অসুস্থ হয়ে যায় সে দোয়া করত, হে আমার আল্লাহ্! আমার মেয়ে যেন প্রাণে বেঁচে যায় আর তার স্থলে আমি মরে যাই। মেয়ের প্রতি সে গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করছিল। কাকতালীয়ভাবে এক রাতে সেই মহিলার গাভীর (গলা থেকে) রশি খুলে যায় আর সেই গাভী কোন পাত্রে মুখ ঢুকিয়ে দেয়। ফলে এতে তার মাথা আটকে যায় আর মটকা মাথায় লাগানো অবস্থায়ই সেটি এদিক সেদিক দৌড়াতে থাকে। গাভী অস্থির হয়ে যায়, কেননা মাথা আটকে গেছে, দৌড়াতে থাকে। গাভীর শরীরে মাথার পরিবর্তে অন্য কোন বড় জিনিস এটি দেখে সেই মহিলা ভয় পেয়ে যায়। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর সে দেখে, এটি কী! গাভী দৌড়াচ্ছে আর এর মাথার পরিবর্তে অন্য কিছু দেখা যাচ্ছে। ফলে সে ভয় পেয়ে যায়। সে মনে করে, হয়তো আমার দোয়া কবুল হয়ে গেছে আর আজরাঈল আমার জান কবয করতে এসেছে। তাই সে অবলীলায় বলে উঠে, হে আজরাঈল! অসুস্থ আমি নই বরং সে শুয়ে আছে, তার জান কবয কর। অর্থাৎ মেয়ের দিকে ইঙ্গিত করে। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, জীবন এত প্রিয় জিনিস যে, একে বাঁচানোর জন্য মানুষ যথাসম্ভব চেষ্টাপ্রচেষ্টা করে। প্রথমে তো সে দোয়া করছিল কিন্তু যখন দেখল, আসলেই তেমন আশঙ্কার সৃষ্টি হয়ে গেল তখন মেয়ের দিকে ইশারা করে বলে দিল, তার জান কবয কর। তিনি (রা.) বলেন, জান বাঁচানোর জন্য মানুষ সব ধরণের চেষ্টা তদবির করে, চিকিৎসা করতে করতে নিঃস্ব হয়ে যায়। কিন্তু এই প্রিয় প্রাণই খোদার তরে উৎসর্গ করতে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এত বেশি আকাঙ্খী ছিলেন যে, হযরত উমর (রা.) দোয়া করতেন আমি যেন মদিনায় শাহাদত বরণ করতে পারি। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) বলেন, আমি ভাবি হযরত উমর (রা.)-এর এ দোয়া কেমন ভয়ঙ্কর ছিল! এর অর্থ হলো শত্রুরা মদিনায় চড়াও হোক আর মদিনার পথে হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করুক। কিন্তু খোদা তা’লা তার দোয়াকে অন্যভাবে কবুল করেন আর মুসলমান আখ্যায়িত এক ব্যক্তির হাতে মদিনায় শহীদ হন। বলা হয়ে থাকে, যে শহীদ করে সে কাফের ছিল, কিন্তু কোন কোন স্থানে এ রেওয়ায়েতও বিদ্যমান যে, সম্ভবত মুসলমান আখ্যায়িত হত। যাহোক, সাধারণ ধারণা হলো সে কাফের ছিল। হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) প্রথমে তাকে কাফের হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং অন্য স্থানে বলেন যে, সে মুসলমান আখ্যায়িত হতো। তিনি (রা.) নিজেও পুরোপুরি আশ^স্ত নন যে, সে মুসলমান ছিল কিনা? হ্যাঁ! তিনি (রা.) নিজেই লিখছেন, অনেকের দৃষ্টিতে সেই ব্যক্তি মুসলমান ছিল না। মোটের ওপর সে একজন দাস ছিল, যার মাধ্যমে খোদা তা’লা হযরত উমর (রা.)-কে শহীদ করিয়ে দিয়েছেন। অতএব মানুষ নিজে যেসব জিনিসের আকাঙ্খা করে এবং প্রত্যাশা করে সেগুলো তার জন্য বিপদ হয় না। এ ঘটনাও হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.) একটি খুতবাতে বর্ণনা করেছিলেন।
হযরত উমর (রা.)-এর শাহাদত ও মৃত্যু সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর স্বপ্ন: হযরত আবু বুরদা (রা.) তার পিতা হতে বর্ণনা করেন, হযরত অওফ বিন মালিক (রা.) এক স্বপ্ন দেখেন, একটি মাঠে লোকদের একত্র করা হয়েছে। তাদের মাঝে এক ব্যক্তি তাদের চেয়ে তিন হাত উঁচু। আমি জিজ্ঞেস করি, ইনি কে? বলা হয়, ইনি উমর বিন খাত্তাব। আমি জিজ্ঞেস করি, তিনি অন্য লোকদের তুলনায় এত উঁচু কেন? (উত্তরে বলা হয়) তার মাঝে (বিশেষ) তিনটি গুণ রয়েছে, (১) আল্লাহ্র বিষয়ে তিনি কোন তিরষ্কারকারী তিরষ্কারকে ভয় করেন না, (২) তিনি আল্লাহ্র পথে শাহাদতবরণকারীর এবং (৩) যাদেরকে খলীফা বানানো হবে তিনি তাদের একজন। এরপর হযরত অওফ (রা.) তার স্বপ্ন শোনানোর জন্য হযরত আবু বকর (রা.)-এর নিকট আসেন এবং তাকে এসব কথা বলেন। তখন হযরত আবু বকর (রা.) খলীফা ছিলেন। এটি বলার পর হযরত আবু বকর (রা.) হযরত উমর (রা.)-কে ডেকে পাঠান এবং তাকে সুসংবাদ দেন আর হযরত অওফ (রা.)-কে বলেন, তোমার স্বপ্ন শুনাও। রেওয়ায়েতকারী বলেন, তিনি যখন বলেন, তাকে খলীফা বানানো হবে তখন হযরত উমর (রা.) তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। কেননা এটি হযরত আবু বকর (রা.)-এর জীবনের ঘটনা। এরপর হযরত উমর (রা.) যখন খলীফা মনোনীত হন তখন তিনি সিরিয়া যান। তিনি (রা.) বক্তৃতা করছিলেন, এমন সময় হযরত অওফ (রা.)-কে দেখতে পেলেন। তিনি তাকে ডেকে মিম্বরে দাঁড় করিয়ে স্বপ্ন শুনাতে বলেন। তিনি তার স্বপ্নের কথা শোনালেন। শুনে হযরত উমর (রা.) বলেন, এ বিষয়ের যতটুকু সম্পর্ক যে আমি আল্লাহ্ তা’লার বিষয়ে কোন সমালোচনাকারীর সমালোচনাকে ভয় পাই না, আমি আশা রাখি, আল্লাহ্ তা’লা আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করবেন। আমাকে খলীফা বানানো হবে মর্মে যে কথা রয়েছে সে অনুসারে আমি খলীফা নির্বাচিত হয়েছি এবং আমি আল্লাহ্র নিকট এই দোয়া করি, তিনি আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন সেকাজে আমাকে যেন সাহায্য করেন। আর আমাকে শহীদ করা হবে এ বিষয়টি সম্পর্কে কথা হলো, আমার শাহাদত বরণ করা কীভাবে সম্ভব হতে পারে! কেননা আমি আরব ভূখন্ডে বাস করি এবং আশপাশের লোকদের সাথে যুদ্ধ করি না। অতঃপর তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা’লা যদি চান তবে শাহাদতের ঘটনা ঘটাবেন, অর্থাৎ বাহ্যত যদিও পরিস্থিতি নেই কিন্তু আল্লাহ্ চাইলে তা হতে পারে।
হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত আবু মূসা আশআরী (রা.) বর্ণনা করেন, আমি স্বপ্নে দেখি, আমি অনেক পথ অবলম্বন করেছি কিন্তু সবগুলোই নিশ্চিন্ন [বানানটি ঠিক করতে হবে, আমার কম্পিউটারে হচ্ছে না] হয়ে গেছে কেবল একটি ছাড়া। আমি সেটি ধরে চলা শুরু করলাম। এক পর্যায়ে আমি একটি পাহাড়ে পৌঁছলাম। তাতে মহানবী (সা.)-কে দেখতে পাই। তাঁর (সা.) পাশে হযরত আবু বকর (রা.) দাঁড়িয়ে আছেন এবং তিনি হযরত উমর (রা.)-কে ইঙ্গিতে আসার জন্য ডাকছেন। আমি বললাম, إِنَّالِلَّهِوَإِنَّاإِلَيْهِرَاجِعُونَ। আল্লাহ্র কসম! আমীরুল মু’মিনীন ইন্তেকাল করেছেন। তিনি মনে মনে এমনটি বলছিলেন। হযরত আনাস (রা.) বলেন, আমি বললাম, আপনি এই স্বপ্নের কথা হযরত উমর (রা.)-কে লিখবেন না। তিনি বলেন, আমি এমন নই যে, হযরত উমর (রা.)-কে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ দিব।
হযরত সাঈদ বিন আবু হেলাল (রা.) হতে বর্ণিত, হযরত উমর (রা.) জুমুআর দিন লোকদের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করছিলেন। তিনি (রা.) আল্লাহ্ তা’লার যথাযথ প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন। অতঃপর বলেন, হে লোকসকল! আমাকে একটি স্বপ্ন দেখানো হয়েছে যা থেকে আমি মনে করি, আমার মৃত্যু সন্নিকটে। আমি দেখি, একটি লাল মোরগ যেটি দুইবার আমাকে ঠোকর মেরেছে। আমি এই স্বপ্নটি হযরত আসমা বিনতে উমায়েস (রা.)-এর নিকট বর্ণনা করি। তিনি বলেন, অর্থাৎ এর ব্যাখ্যা করেন যে, অনারব কোন ব্যক্তি আমাকে হত্যা করবে। হযরত উমর (রা.)-এর শাহাদতের ঘটনা সম্পর্কে লেখেন, হযরত উমর (রা.)-এর ওপর কোন্ দিন আক্রমণ হয় এবং কবে তার দাফন হয় এ সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েত পাওয়া যায়।
তাবাকাতুল কুবরাতে লেখা আছে, হযরত উমর (রা.)-এর উপর বুধবার হামলা করা হয় এবং বৃহষ্পতিবার তিনি মৃত্যুবরণ করেন। হযরত উমর (রা.)-কে ২৩ হিজরীর ২৬ যুল হাজ্জ হামলা করে আহত করা হয় এবং ২৪ হিজরী ১ মহররম ভোরে তাঁর দাফনকার্য সম্পাদিত হয়। উসমান আখনাস বলেন, তাঁর (রা.) মৃত্যু ২৬ যুল হাজ্জ রোজ বুধবারে হয়। আবু মা’শার বলেন, হযরত উমর (রা.)-কে ২৭ যুল হাজ্জ শহীদ করা হয়েছে। তাবরী এবং ইবনে কাসীর-এর ইতিহাস ছাড়াও অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে হযরত উমর (রা.) ২৬ যুল হাজ্জ ২৩ হিজরীতে আহত হন এবং ১ মহররম ২৪ হিজরীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন আর সেদিনই তাঁর কাফন-দাফন সম্পন্ন হয়।
শাহাদতের ঘটনাটি বিস্তারিত ভাবে সহীহ্ বুখারীতে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আমর বিন মাইমুন (রা.) বর্ণনা করেন, আমি হযরত উমর (রা.)-কে তাঁর আহত হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে মদীনায় দেখি যে, তিনি হযরত হুযায়ফা বিন ইয়ামান এবং হযরত উসমান বিন হোনাইফ যাদের ওপর খিলাফতের পক্ষ থেকে ইরাকের ভূমি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল তাদের কাছে দাড়ান এবং বলেন, তোমরা উভয়ে কী কী করেছো? কোথায়ও এমনটি নয়তো যে, তোমরা দু’জন জমির উপর এমন কর নির্ধারণ করেছ যা আদায়ের সামর্থ তাদের নেই? তারা দু’জন বললেন, আমরা ততটুকু কর নির্ধারণ করেছি যা আদায়ের সামর্থ তারা রাখে। অর্থাৎ জমি সে পরিমাণ ফসল উৎপাদনে সক্ষম। এক্ষেত্রে কোন অন্যায় করা হয় নি। হযরত উমর (রা.) বলেন, পুনরায় যাচাই করে দেখ যে, কোথাও তোমরা ভূমির ওপর এমন কর ধার্য কর নি তো যা তারা পরিশোধ করতে অপারগ? বর্ণনাকারী বলেন, তারা উভয়েই জবাবে বলে, না। হযরত উমর (রা.) বলেন, আল্লাহ্ যদি আমাকে সুস্থ-সবল রাখেন তবে অবশ্যই আমি ইরাকের বিধবাদের এমন অবস্থায় রেখে যাব যে আমার পরে তারা আর কোন ব্যক্তির প্রতি মুখাপেক্ষি হবে না। বর্ণনাকারী বলেন, এই কথোপকথনের পর হযরত উমর (রা.)-এর জীবনে চতুর্থ রাত আসার পূর্বেই তিনি আহত হন। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি যেদিন আহত হন সেদিন আমি তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং আমর ও তাঁর মাঝে কেবল হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন আব্বাস (রা.) ছিলেন। আর দুই সারির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ‘সারিগুলো সোজা করে নাও’ বলতে থাকা তাঁর অভ্যাস ছিল। যখন সারির মাঝে কোন খালি স্থান থাকত না তখন তিনি সামনে গিয়ে আল্লাহু আকবার বলতেন। প্রায় সময় ফজরের নামাযে তিনি সূরা ইউসুফ বা সূরা নাহাল অথবা এ ধরণের কোন সুরা প্রথম রাকা’তে পাঠ করতেন যাতে লোকেরা একত্রিত হতে পারে। তিনি (রা.) সবেমাত্র আল্লাহু আকবার বলেছিলেন, এমন সময় আমি তাঁকে বলতে শুনি, আমাকে মেরে ফেলেছে অথবা বলেছেন, কুকুর আমাকে কামড় দিয়েছে। সে, অর্থাৎ সেই অনারব আততায়ী তাঁর ওপর আক্রমণ করার পর দোধারী ছুরি নিয়ে পালাতে থাকে। সে ডানে বামে যাকেই পাচ্ছিল তাকে আহত করছিল, অর্থাৎ সে যেদিক দিয়েই যাচ্ছিল ভয়ে কিংবা কেউ যদি ধরার চেষ্টা করলে সেই ছুরি দিয়েই তার ওপরও আক্রমণ করছিল এবং লোকদেরকে আহত করছিল। এভাবে সে ১৩ জনকে আহত করে আর তাদের মধ্য থেকে ৭জন মৃত্যুবরণ করে। মুসলমানদের এক ব্যক্তি যখন এ অবস্থা দেখল তখন সে তার কোট কোটটি আততায়ীর ওপর ছুড়ে মারে। বুখারীতে এর জন্য বুর্নুস শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, এটি এমন কাপড় যাতে মাথা ঢাকার অংশও থাকে। এক ধরণের লম্বা জুব্বা যার সাথে মাথা ঢাকার জন্য টুপিসদৃশ অংশ যুক্ত থাকে। লম্বা টুপিকেও (বুর্নুস) বলা হয়। সে যখন নিশ্চিত হয়ে যায় যে, সে ধরা পড়ে গেছে তখন সে তার নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়। অপরদিকে হযরত উমর (রা.) আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.)-এর হাত ধরে সামনে নিয়ে আসেন আর বর্ণনাকারী বলেন, যারাই হযরত উমর (রা.)-এর কাছে ছিলেন তারাও তা দেখেছে যা আমি দেখেছিলাম। কিন্তু যারা মসজিদের প্রান্তভাগে ছিল তারা হযরত উমর (রা.)-এর (এ অবস্থা সম্পর্কে) জানত না, তারা শুধু হযরত উমর (রা.)-এর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল না, তাই তারা সুবহানাল্লাহ্, সুবহানাল্লাহ্ বলছিল। এ অবস্থায় হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফ (রা.) লোকদের সংক্ষিপ্ত নামায পড়ান। নামায শেষ করার পর হযরত উমর (রা.) বলেন, ইবনে আব্বাস দেখ! কে আমাকে আঘাত করেছে? হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে খোঁজখবর নিয়ে ফিরে এসে বলেন, মুগিরার দাস। হযরত উমর (রা.) বলেন, এটি কি সেই কারিগর? উত্তরে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, হ্যাঁ। হযরত উমর (রা.) বলেন, আল্লাহ্ তাকে ধ্বংস করুন, অথচ আমি তার সাথে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছিলাম। আমি আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ, কেননা আল্লাহ্ আমার মৃত্যু এমন ব্যক্তির হাতে ঘটান নি যে মুসলমান হওয়ার দাবি করে। অর্থাৎ এখান থেকেও প্রমাণিত হলো, সে মুসলমান ছিল না। হে ইবনে আব্বাস! তুমি ও তোমার পিতা মদিনায় বেশি বেশি অনারব দাস থাকা পছন্দ করতে। হযরত আব্বাস (রা.)-এর নিকট সবচেয়ে বেশি কৃতদাস ছিল। তখন হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আপনি অনুমতি দিলে আমি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাই। অর্থাৎ আপনি চাইলে আমরাও মদিনায় বসবাসকারী অনারব দাসদের হত্যা করতে চাই। তিনি বলেন, এমনটি করা ঠিক হবে না। হযরত উমর (রা.) বলেন, এমন করা ঠিক নয়। তিনি (রা.) বলেন, বিশেষ করে এখন তারা তোমাদের ভাষায় কথা বলে এবং তোমাদের ক্বিবলামুখী হয়ে নামায পড়ে আর তোমাদেরই মত হজ্জব্রত পালন করে। অনেক দাস এমনও ছিল যারা মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। এরপর আমরা তাঁকে, অর্থাৎ হযরত উমর (রা.)-কে সেখান থেকে উঠিয়ে তাঁর ঘরে নিয়ে যাই। আমরাও তাঁর সাথে ঘরে চলে যাই। মনে হচ্ছিল যেন ইতোপূর্বে আর কখনো মুসলমানদের ওপর এমন কোন বিপদ আপতিত হয় নি। কেউ বলছিল, কিছুই হবে না আবার কেউ বলছিল, তাঁর বিষয়ে আমি শঙ্কিত যে, তিনি বাঁচবেন না।
অবশেষে তাঁর কাছে ‘নাবিয’ আনা হয় এবং তিনি তা পান করেন, যা তাঁর পেট দিয়ে বেরিয়ে যায়। অতঃপর তাঁর কাছে দুধ আনা হয়। তিনি তা পান করেন। তা-ও তাঁর ক্ষতস্থান দিয়ে বেরিয়ে গেলে মানুষ নিশ্চিৎ হয়ে যায় যে, তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। আমর বিন মায়মুন বলেন, এরপর আমরা তাঁর কাছে যাই এবং অন্যরাও আসে, যারা তাঁর প্রশংসা করা আরম্ভ করে। এরপর এক যুবক আসে। সে বলে, হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনি আল্লাহ্ তা’লার এই সুসংবাদে আনন্দিত হোন যা আপনি রসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাহাবী হওয়ার কারণে এবং প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণের সম্মানের কারণে লাভ করেছেন, যা আপনি খুব ভালো করেই জানেন। এরপর আপনি খলীফা নিযুক্ত হয়েছেন আর আপনি ন্যায়বিচার করেছেন। এরপর রয়েছে শাহাদতের (মর্যাদা)। হযরত উমর (রা.) বলেন, আমার বাসনা হলো এই কথাগুলো সমান সমানই থাক। আমার যেন হিসাব নেয়া না হয় আর আমি প্রতিদানও চাই না। যখন সেই যুবক ফিরে যাচ্ছিল তখন তার লুঙ্গি ভূমি স্পর্শ করছিল। হযরত উমর বলেন, এই ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে আন। তিনি (তাকে) বলেন, হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! নিজের কাপড় ওপরে উঠিয়ে রেখো, এতে তোমার কাপড়ও বেশি দিন টিকবে এবং মাটিতে হেঁচড়ানোর ফলে ফাটার যে আশংকা থাকে তাও থাকবে না। আর এই কাজটি তোমার প্রভুর কছে তাক্বওয়ার অধিক নিকটতর হবে। অর্থাৎ অহেতুক অহংকার দানা বাধতে পারে। সেযুগে মানুষ বিত্তশালীতার [এই শব্দ ব্যবহার হয় কিনা?] নিদর্শন হিসেবে লম্বা কাপড় পরিধান করতো তাই তিনি বলেন, অহংকার যেন সৃষ্টি না হয়, এটি তাকওয়ার অধিক নিকটে।
অতঃপর আব্দুল্লাহ্ বিন উমরকে তিনি বলেন, (হিসাব করে) দেখ আমার মোট ঋণ কত? তিনি হিসাব করে দেখেন যে, ৮৬ হাজার দিরহাম বা এর কাছাকাছি হবে। হযরত উমর বলেন, যদি উমরের পরিবারের সহায়-সম্পত্তি দ্বারা তা পরিশোধ হতে পারে তাহলে তাদের সম্পত্তি থেকে তা পরিশোধ করে দাও। নতুবা বনু আদি বিন কা’ব গোত্রের কাছে চাইবে। যদি তাদের সম্পত্তিও এর জন্য যথেষ্ট না হয় তাহলে কুরায়েশদের কাছে চাইবে, আর এছাড়া আর কারো কাছে যাবে না। আমার পক্ষ থেকে এই ঋণ পরিশোধ করে দিও। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা (রা.)-এর কাছে যাও এবং তাকে বল, উমর আপনাকে সালাম বলেছেন, আমীরুল মু’মিনীন বলো না, কেননা আজ আমি মু’মিনদের আমীর নই। তাকে বল যে, উমর বিন খাত্তাব তাঁর দুই সাথীর সাথে সমাহিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করছেন। বুখারীর ব্যাখ্যাপুস্তক ‘উমদাতুল ক্বারী’-তে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত উমর এ কথা তখন বলেছিলেন যখন মৃত্যুর বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন। আর হযরত আয়েশার জন্য এতে ইঙ্গিত ছিল যেন আমীরুল মু’মিনীন বললে তিনি ভয় পেতে পারেন। অতএব আব্দুল্লাহ্ সালাম বলেন এবং ভেতরে আসার অনুমতি প্রার্থনা করেন। অতঃপর তিনি তার কাছে ভেতরে গেলে তাকে বসে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পান। হযরত আব্দুল্লাহ্ বলেন, উমর বিন খাত্তাব আপনাকে সালাম বলেছেন আর তার উভয় সাথীর সাথে দাফন হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেছেন। হযরত আয়েশা বলেন, আমি এই জায়গাটি আমার নিজের জন্য রেখেছিলাম, কিন্তু আজ আমি নিজ সত্তার ওপর তাকে অগ্রগণ্য করব। হযরত আব্দুল্লাহ্ যখন ফিরে আসেন তখন হযরত উমরকে বলা হয় যে, আব্দুল্লাহ্ বিন উমর ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, আমাকে উঠাও। তখন এক ব্যক্তি তাকে ধরে উঠায়। তিনি জিজ্ঞেস করেন যে, কী সংবাদ নিয়ে এসেছ? আব্দুল্লাহ্ বলেন, হে আমীরুল মু’মিনীন তা-ই যা আপনি পছন্দ করেন, হযরত আয়েশা অনুমতি প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ্, কোন বিষয়ে এর চেয়ে বেশি চিন্তা আমার ছিল না। আমি যখন মারা যাব তখন আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যেও। এরপর সালাম বলো এবং বলবে, উমর বিন খাত্তাব অনুমতি প্রার্থনা করছেন। তিনি যদি অনুমতি প্রদান করেন তাহলে আমাকে কক্ষের ভেতরে দাফন করার জন্য নিয়ে যেও। আর তিনি যদি আমাকে ফিরিয়ে দেন তাহলে আমাকে মুসলমানদের কবরস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যেও। (এরপর) উম্মুল মু’মিনীন হযরত হাফসা আসেন। আর অন্যান্য মহিলারাও তার সাথে আসেন। তাঁদেরকে দেখে আমরা বেরিয়ে যাই। তিনি তাঁর কাছে ভেতরে যান এবং কিছুক্ষণ তাঁর কাছে বসে অশ্রুপাত করেন। এরপর কিছু পুরুষ ভেতরের অংশে আসার অনুমতি প্রার্থনা করলে পুরুষদের আসতেই তিনি ভেতরে চলে যান আর আমরা ভেতর থেকে তার কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই। মানুষ বলে, হে আমীরুল মু’মিনীন! ওসীয়্যত করুন, কাউকে খলীফা নিযুক্ত করে যান। তিনি (রা.) বলেন, আমি সেই কয়েকজন ব্যক্তি ছাড়া আর কাউকে এই খিলাফতের অধিক যোগ্য মনে করি না, যাদের ওপর রসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর মৃত্যুর সময় পর্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন। আর তিনি (রা.) হযরত আলী, হযরত উসমান, হযরত যুবায়ের, হযরত তালহা, হযরত সা’দ ও হযরত আব্দুর রহমান বিন অওফের নাম উল্লেখ করেন এবং বলেন, আব্দুল্লাহ্ বিন উমর তোমাদের সাথে উপস্থিত থাকবেন, কিন্তু এই বিষয়ে [অর্থাৎ খিলাফতের দায়িত্ব পাওয়ার] তার কোন অধিকার থাকবে না। যদি সা’দ খিলাফতের দায়িত্ব পান তবে তিনিই খলীফা হবেন; নতুবা তোমাদের মধ্য থেকে যে-ই আমীর নির্ধারিত হবে, সে যেন সা’দের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে, কেননা আমি তাকে এজন্য অপসারণ করিনি যে, তিনি কোন কাজ করতে অপারগ ছিলেন কিংবা কোন অবিশ্বস্ততা করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমার পরে যে খলীফা হবে, তাকে আমি প্রথম যুগের মুহাজিরদের বিষয়ে ওসীয়্যত করছি, যেন তিনি তাদের প্রাপ্য তাদেরকে প্রদান করেন, তাদের সম্মানের প্রতি

যত্নবান হন। আমি আনসারদের বিষয়েও হিতসাধনের ওসীয়্যত করছি, যারা আগে থেকেই মদিনায় বসবাস করে আসছিল এবং মুহাজিরদের আসার পূর্বে ঈমান আনয়ন করেছিল; তাদের মধ্য থেকে যে পুণ্যকর্মশীল, তাকে যেন মূল্যায়ন করা হয় এবং তাদের মধ্য থেকে যে দোষী সাব্যস্ত হবে, তাকে যেন ক্ষমা করা হয়। আর আমি তাকে সকল শহরের অধিবাসীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার ওসীয়্যত করছি, কেননা তারা ইসলামের পৃষ্ঠপোষক ও সম্পদ লাভের উৎস এবং শত্রুদের গাত্রদাহের কারণ; আর এ-ও (ওসীয়্যত করছি) যে তাদের সম্মতিক্রমে তাদের কাছ থেকে তা-ই নেয়া হয়, যা তাদের প্রয়োজনের চেয়ে উদ্বৃত্ত থাকে। আর আমি তাকে [অর্থাৎ পরবর্তী খলীফাকে] বেদুঈন আরবদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার ওসীয়্যত করছি, কারণ তারা আরবদের আদিবাসী এবং ইসলামের মূল উৎস; তাদের সম্পদ থেকে যেন সেটি নেয়া হয় যা উদ্বৃত্ত থাকে এবং এরপর (তা) তাদের অভাবীদের জন্য ব্যয় করা হয়। আর আমি তাকে আল্লাহ্র ও তাঁর রসূল (সা.) প্রদত্ত নিরাপত্তার বিষয়ে দায়িত্বশীল হওয়ার ওসীয়্যত করছি অর্থাৎ তাদের সাথে কৃত অঙ্গীকারসমূহ যেন পূর্ণ করা হয় ও তাদের সুরক্ষার্থে যুদ্ধ করা হয় এবং তাদের সাধ্যাতীত কোন ভার যেন তাদের ওপর অর্পণ না করা হয়। যখন তিনি মৃত্যুবরণ করেন তখন আমরা তাকে নিয়ে বের হই এবং পায়ে হেঁটে অগ্রসর হই। হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন উমর, হযরত আয়েশাকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলার পর বলেন, উমর বিন খাত্তাব অনুমতি চাইছেন। তিনি (অর্থাৎ হযরত আয়েশা) বলেন, তাকে ভেতরে নিয়ে আস। অতঃপর তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তার দুই বন্ধুর পাশে সমাহিত করা হয়। যখন তার দাফনকার্য সমাধা হয় তখন সেই ব্যক্তিবর্গ খিলাফতের নির্বাচন করার জন্য একত্রিত হন, যাদের নাম হযরত উমর উল্লেখ করেছিলেন। আর এরপর পরবর্তী কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। এই বিষয়ে অবশিষ্ট বিবরণ পরবর্তীতে দেয়া হবে, ইনশাআল্লাহ্; এটি এখনও চলমান রয়েছে।
আজ জার্মানীর বার্ষিক জলসাও আরম্ভ হতে যাচ্ছে; আল্লাহ্ তা’লা সেটিকে কল্যাণমন্ডিত করুন, অধিক সংখ্যক জার্মান আহমদীকে এর দ্বারা উপকৃত হওয়ার সুযোগ দান করুন। এটি দুদিবসীয় জলসা; আগামীকাল বিকেলে তাদের সমাপনী অধিবেশনে আমি ভাষণও প্রদান করব, ইনশাআল্লাহ্, যা এম.টি.এ.-তে সম্প্রচার করা হবে; এখানকার সময় অনুযায়ী আনুমানিক সাড়ে তিনটায়। বাকি জলসা যা জার্মানীতে আজ থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, জার্মানদের জন্য সেটির সরাসরি স্ট্রীম করা হচ্ছে; জার্মানরা সেখানে দেখতে পারবেন। তাই এর দ্বারা বেশি বেশি উপকৃত হোন।
নামাযের পর আমি দু’ব্যক্তির গায়েবানা জানাযাও পড়াব, তাদেরও স্মৃতিচারণ করছি। প্রথম জানাযা হলো ইন্দোনেশিয়া জামা’তের মুবাল্লেগ কমরুদ্দীন সাহেবের, যিনি সম্প্রতি পঁয়ষট্টি বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, إِنَّا لِلهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। ১৯৭২ সালে তিনি পনের বছর বয়সে বয়আত গ্রহণ করেন এবং প্রাথমিক শিক্ষার পর জামা’তের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। এরপর তিনি ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তান চলে যান। ১৯৮৬ সালের ৩০ জুন শাহেদ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে মুবাল্লেগ হিসেবে তার পদায়ন হয়। অত্যন্ত সুললিত ও দরদভরা কণ্ঠে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন। অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এবং জামা’তের একজন তেজোদীপ্ত সেবক ছিলেন। তার সেবাকাল প্রায় ৩৫ বছর বিস্তৃত। তার স্ত্রী বলেন, আমাকে বলতেন, আপনি শুধু একজন মুরব্বীর স্ত্রী নও, বরং আপনাকে জামা’তের কাজেও ক্ষেত্রেও অগ্রসর থাকতে হবে। অতঃপর তার ব্যাপারে লিখেন, খিলাফতের প্রতি তার আনুগত্য ও ভালোবাসা লক্ষনীয় ছিল। ছোট-বড় সবার সাথে অত্যন্ত সম্মানপূর্ণ আচরণ করতেন। যখনই কোন আহমদীর সাথে কথা বলতেন, সবর্দা জামা’তের প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততার উপদেশ দিতেন আর অধিকহারে জামা’তের সেবা করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতেন। যখনই কোন অ-আহমদীর সাথে সাক্ষাৎ হতো, তাকে অবশ্যই তবলীগ করতেন আর একান্ত ভালোবাসা ও আন্তরিকতার সাথে কথা বলতেন, যাতে অন্যরাও আনন্দিত হতো। অসুস্থতার দিনগুলোতেও ফজরের নামাজের দেড়-দুই ঘণ্টা পূর্বে উঠে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন এবং কুরআন তিলাওয়াত করতেন। এরপর যতদিন শক্তি-সামর্থ্য ছিল পায়ে হেঁটে মসজিদে গিয়ে নামায পড়তেন। তার ছেলে উমর ফারুক সাহেব জামা’তের মুরব্বী সিলসিলা ও জামেয়া আহমদীয়া ইন্দোনেশিয়ায় শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি বলেন,ঘরে এবং বাইরেও চলাফেরার সময় প্রায়ই কুরআন করীমের কোন না কোন অংশ সুললিত কন্ঠে পড়তে থাকতেন। হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পুস্তকের অনুবাদ ও প্রুফ রিডিং-এর কাজও তিনি করেছেন। আর এই সময়, বিশেষত যখন অনুবাদের কাজ করতেন তখন অধিকহারে কাসীদা পাঠ করতেন। মহানবী (সা.)-এর জীবনী ও ঘটনা শুনানোর সময় চক্ষু অশ্রুসজল হয়ে যেত। তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন সময় আমাকে আহমদীদের বিভিন্ন পরীক্ষা, দুঃখ-দুর্দশা ও কুরবানীর ঘটনা শুনাতেন। অনেক সময় নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সমূহ বর্ণনা করতেন যে, কীভাবে তিনি কষ্ট সহ্য করেছেন। তার ছোট ছেলে জাফর উল্লাহ খান বলেন, অত্যন্ত বড়মনা ও নির্ভীক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন কাটিয়েছেন। সর্বদা স্বল্পেতুষ্টিকে প্রাধান্য দিতেন। আল্লাহ্তা’লা মরহুমের প্রতি ক্ষমা ও দয়ার আচরণ করুন, তার মর্যাদা উন্নীত করুন।
পরবর্তী জানাযা সাবিহা হারুন সাহেবার, যিনি মরহুম সুলতান হারুন খান সাহেবের স্ত্রী ছিলেন। সম্প্রতি তিনি ৭৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন, إِنَّا لِلهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। সাবিহা হারুন সাহেবার বংশে আহমদীয়াত তার পিতার বয়আতের মাধ্যমে এসেছিল। তিনি নিজে বুঝেশুনে ১৮ বছর বয়সে হযরত মুসলেহ্ মওউদ (রা.)-এর হাতে বয়আত করেছিলেন। অতঃপর তার দাদা পুত্রের বয়আত করার পর বয়আত করেন। আল্লাহ্ তা’লা তাকে তিন পুত্র ও তিন কন্যা দান করেছেন। তার এক ছেলে হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর জামাতা। তার বড় ছেলে সুলতান মুহাম্মদ খান সাহেব বলেন, আমার মাতার সবচেয়ে বড় ছেলে দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে মাত্র দুই বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ সালেস (রাহে.) তার জানাযার সময় বলেছিলেন যে, আল্লাহ্ তা’লা তোমাকে উত্তম পরিপূরক পুত্র সন্তান দান করবেন, যে সুদর্শন হবে আর একইসাথে দীর্ঘজীবন লাভ করবে। তিনি তাঁর স্বামীকে বলেন আমি সেই পুত্রকে এক যুবক হিসেবে তোমার কাঁধ বরাবর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। অতঃপর তার ছেলে সুলতান আহমদ খান বলেন, আমার সৌভাগ্য যে, শিশুকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত আমার অনেকটা সময় মায়ের সাথে অতিবাহিত হয়েছে। তিনি অনেক স্নেহশীল আর মার্জনাশীল মা ছিলেন । কখনো কারো গীবত করতেন না। তার মেয়ে মাহমুদা সুলতানা বলেন, আমার মা নেক ও নীরব প্রকৃতির এবং উন্নত বৈশিষ্ট্যের অধিকারিণী ছিলেন। জামা’তের প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা পোষণকারিণী ও খিলাফতের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার পরম মার্গে উপনীত একজন নারী ছিলেন আর অন্যদেরও এই উপদেশই দিতেন। সর্বদা হাসি-খুশি ও আত্মীয়স্বজনের দেখাশোনাকারী ছিলেন। তার আতিথেয়তা পুরো বংশের মাঝে বিখ্যাত ছিল। কারো মনে আঘাত দিতেন না। গীবতকে খুবই অপছন্দ করতেন আর আমাদেরকে সবসময় তা এড়িয়ে চলার নসীহত করতেন। এমন আসর যেখানে গীবত করা হতো সেখান থেকে তৎক্ষনাৎ উঠে যেতেন আর তার চেহারায় অসন্তুষ্টির ছাপ প্রকাশ পেত। সর্বদা ক্ষমাসুলভ ব্যবহার করতেন। তিনি বলেন, আমার পিতার ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণকারীর জন্যও তিনি কখনো বদ দোয়া করেন নি। সর্বদা বলতেন, আমি দোয়া করি আল্লাহ্ যেন তাদেরকে হেদায়েত দান করেন। দরিদ্র রোগীদের জন্য তার হৃদয় ছিল অত্যন্ত কোমল আর তাদেরকে এমনভাবে সাহায্য করতেন যেন বাম হাতও তা জানতে না পারে।
তার দ্বিতীয় কন্যা ওয়াজিহা সাহেবা বলেন, নীরব প্রকৃতির অধিকারী একজন নারী ছিলেন, অনেক বেশি দান-খয়রাতকারী ছিলেন আর দান-খয়রাত নীরবে করতেন এবং এর উল্লেখ করা পছন্দ করতেন না। আল্লাহ্ তা’লা মরহুমার সাথে ক্ষমা ও দয়ার আচরণ করুন। তার সন্তানদেরও তার পুণ্যসমূহ অব্যাহত রাখার তৌফিক দিন। (আমীন)