09 Sep সৈয়দ তালে আহমদ কৃত অঙ্গীকার প্রকৃত অর্থে পালনকারী একজন ০৩সেপ্টেম্বর ২০২১ জুমুআর খুতবা
যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ মোতাবেক ০৩ তাবুক, ১৪০০ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা
তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
সম্প্রতি সৈয়্যদ হাশেম আকবর সাহেবের পুত্র আমাদের অতি প্রিয়ভাজন এবং ওয়াকফে জিন্দেগী স্নেহের সৈয়্যদ তালে’ আহমদ ঘানায় শাহাদত বরণ করেন, إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ। ২৩ ও ২৪ আগস্ট তারিখের মধ্যবর্তী রাতে এম.টি.এ.-র টিম ঘানার উত্তরাঞ্চলে রেকর্ডিং শেষ করে কুমাসীতে ফিরে আসছিল। পথিপধ্যে সন্ধ্যা সোয়া সাতটার সময় ডাকাতের গুলিতে উক্ত তিন সদস্য বিশিষ্ট টীমের দু’জন অর্থাৎ স্নেহের সৈয়্যদ তালে’ আহমদ এবং উমর ফারুক সাহেব আহত হন। প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা পর প্রথমে পলী ক্লিনিকে তাদের চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর টোমালের বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে সৈয়্যদ তালে’ আহমদ মৃত্যু বরণ করেন। অন্যান্য দেশে সম্ভবত এম.টি.এ. ইন্টারন্যাশনালের কর্মীদের কিছু শাহাদাতের ঘটনা ঘটে থাকবে, কিন্তু আমার যতদূর মনে হয় এটি এখানকার তথা যুক্তরাজ্যের ওয়াকফে নওদের মাঝে শাহাদাতের প্রথম ঘটনা ছিল। সৈয়্যদ তালে’ আহমদ মোহতরমা আমাতুল লতীফ বেগম সাহেবা এবং সৈয়্যদ মীর মুহাম্মদ আহমদ সাহেবের দৌহিত্র ছিলেন এবং হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা.)-এর প্রদৌহিত্র ছিলেন। একইভাবে তিনি হযরত ডাক্তার মীর মুহাম্মদ ইসমাঈল সাহেবের প্রপৌত্র, অর্থাৎ পৌত্রের পুত্র ছিলেন। আর হযরত মীর মুহাম্মদ ইসমাঈল সাহেব ছিলেন হযরত আম্মাজান নুসরত জাহান বেগম সাহেবার ছোট ভাই। এ দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত আম্মাজানের সাথেও তার বংশের যোগসূত্রিতা রয়েছে। হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেবের কারণে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) এবং হযরত আম্মাজান উভয়ের সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। একইসাথে তিনি শহীদ মির্যা গোলাম কাদের সাহেবের জামাতাও ছিলেন। আল্লাহ তা’লার কৃপায় তিনি মূসী ছিলেন। আমি যেমনটি বলেছি, তিনি ওয়াকফে নও স্কীমেরও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
বায়ো-মেডিকেল সাইন্সে ডিগ্রী অর্জন করে তিনি সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করেন। ২০১৩ সনে জীবন উৎসর্গ করেন এবং বিভিন্ন দফতরে কাজ করার পর অবশেষে প্রেস ও মিডিয়া বিভাগে তার নিযুক্তি হয়। এর পূর্বে সৈয়্যদ তালে’ সাহেব নিজ জামা’তে স্থানীয় পর্যায়েও কাজ করেছেন। হার্টলিপুল খোদ্দামুল আহমদীয়ায় তবলীগ, তালীম, ইশায়াত এবং আতফাল বিভাগে তিনি কাজ করেছেন। ২০১৬ সালে এম.টি.এ.-র সংবাদ বিভাগে পূর্ণাঙ্গীনভাবে তার পদায়ন হয়। এর পূর্বে রিভিউ অব রিলিজিওন্সে ইন্ডেক্সিং (সূচিবিন্যাস) এবং ট্যাগিং টীমের প্রধান হিসেবেও তিনি কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি এম.টি.এ.-র সংবাদ বিভাগের জন্য বিভিন্ন ডকুমেন্টারী বা প্রামাণ্যচিত্র তৈরী করেছেন এবং আরো তিন চারটি ডকুমেন্টারীতে কাজ করছিলেন। আমার কর্মব্যস্ততাভিত্তিক সাপ্তাহিক প্রোগ্রাম This Week With Huzoor- এর উদ্যোগ তিনিই নিয়েছিলেন, অর্থাৎ তিনি এটি মভাসমঐ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত এতে গভীর আগ্রহের সাথে এডিটিং প্রভৃতি কাজ করতে থাকেন। এম.টি.এ.-র দর্শকদের কাছে এটি একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। ‘তাহের’-ম্যাগাজিন এর সম্পাদনার কাজ ছাড়াও মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়ার প্রকাশনা বিভাগেও তিনি কাজ করতে থাকেন। বিভিন্ন জামা’তী পত্রপত্রিকা যেমন রিভিউ অব রিলিজিওন্স এবং ‘তারেক’- ম্যাগাজিনে নিয়মিত বিভিন্ন প্রবন্ধও লিখতেন এবং প্রেস ও মিডিয়া বিভাগের অধীনে বিভিন্ন দেশে আমার সাথেও এবং অন্য ব্যবস্থাপনার অধীনেও বিভিন্ন সময় তিনি জামা’তী সফর করেছেন।
স্নেহের তালে’ নিজের কাজ সম্পন্ন করার জন্য, বরং বলতে হয় শুধু সম্পন্ন করার জন্য নয়, বরং উৎকর্ষ মানে পৌঁছানোর জন্য নিজের মাঝে এক অসাধারণ উচ্ছাস ও প্রেরণা লালন করতেন আর এজন্য কোন বিপদেরও পরোয়া করতেন না এবং তার শাহাদাতের ঘটনা থেকেও এটিই প্রতিভাত হয় যে, তার এক মুহূর্তের জন্যও এই চিন্তা ছিল না যে, কী বিপদ আসতে যাচ্ছে। চিন্তা কেবল এটি ছিল যে, আমি যে কাজ করতে এসেছি সেটিকে সুচারূরূপে এবং সময়মতো যেন সম্পন্ন করতে পারি। একারণে যাত্রাও এমন সময় শুরু করেছিলেন যখন বিপদের আশঙ্কাও অনেক বেশি ছিল। টোমালের আঞ্চলিক মুবাল্লেগ জনাব আবু বকর ইব্রাহীম সাহেব ঘটনার কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেন যে, ২৩ আগস্ট সকালে যখন এম.টি.এ.-র টিম সালাগা রওয়ানা হচ্ছিল, তখন তিনি তালে’কে তার ব্যাগ গুছাতে দেখে বলেন হোটেল থেকে চেক আউট করছো? সালাগা থেকে এখানেই তো ফিরে আসতে হবে আর থাকতেও হবে। তালে’ উত্তরে বলেন, হাতে সময় কম এজন্য আমাকে কুমাসী ফিরে যেতে হবে। মৌলভী সাহেব তাকে বলেন, আপনার সালাগা থেকে ফিরে আসতে দেরী হয়ে গেলে রাতে যাত্রা করা উচিত হবে না। যাহোক, তালে’ বলেন, দেখা যাবে। কিন্তু একইসাথে মৌলভী সাহেবকে তিনি এটিও বলেন যে, আমাকে এরপর সিয়েরালিওনেও যেতে হবে এবং আমার হাতে শুধু দু’দিন বাকি আছে আর কুমাসী ও আকরাতে অনেক কাজ বাকি আছে, তাই আমার যাওয়াটা জরুরী। তবে আপনি যেহেতু বলছেন, বিষয়টি মাথায় রাখব। যাহোক, তারা যখন (সালাগা থেকে) ফিরে আসেন তখন সিদ্ধান্ত হয়, তারা ফিরতি যাত্রা করবেন এবং সে অনুযায়ী তারা টোমালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। পৌনে সাতটার দিকে তালে’ উমর ফারুক সাহেবকে বলেন, চলুন! আমরা নামায পড়ে নেই। তারা সবাই মাগরিব ও এশার নামায বাজামাত পড়েন। এরপর তালে’ সাহেবের দুশ্চিন্তা ছিল যে, সালাগা থেকে যেসব রেকর্ডিং করে এনেছেন সেগুলো পাছে নষ্ট হয়ে যায়, এজন্য গাড়িতেই সেগুলো ল্যাপটপে সংরক্ষণের চেষ্টায় রত হন এবং সফরের পুরো সময় এ কাজই করছিলেন। কোনভাবে সময় নষ্ট হবে, এটি তিনি সহ্য করতে পারতেন না। একইসাথে তার এ চিন্তা ছিল যে, জামা’তী যন্ত্রপাতিগুলো অত্যন্ত মূল্যবান, কোথাও সেগুলো নষ্ট না হয়ে যায়। যাহোক, মৌলভী সাহেব বলেন, পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী এম.টি.এ.-র গাড়ি যখন পাহা জংশনের নিকটে পৌঁছে তখন ডাকাতরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে দেয়, যার ফলে এম.টি.এ.-র দুই কর্মী আহত হন, যেমনটি আগেও বলা হয়েছে। গাড়ির ড্রাইভার বলেন, বিপরীত দিক থেকে আসা একটি গাড়ি আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদেরকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিল, কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারিনি। যাহোক, যখন আমি রাতের হেডলাইটের আলোয় দেখলাম যে ডাকাতরা একেবারে সামনে, তখন আমি উচ্চস্বরে কলেমা পাঠ করলাম, তবে এর সাথে সাথেই ডাকাতরা গুলিবর্ষণ আরম্ভ করে দেয়। সৈয়দ তালে’ গাড়ির পেছনের সীটে বসা ছিলেন। গুলির শব্দ শুনে তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন যে, সশস্ত্র ডাকাত দল আক্রমণ করেছে। উমর ফারুক সাহেব বলেন, এই গোলাগুলির মাঝে আমার পায়ের ওপরের অংশে বা রানে গুলি লাগে, কিন্তু তখন আমি সেটি অনুভব করতে পারিনি। গুলিবর্ষণ শেষে ডাকাতরা নীরবে বসে থাকে। এর কিছুক্ষণ পর ডাকাতরা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে আসে এবং আমাকে ও ড্রাইভারকে গাড়ি থেকে বের করে আনে। আমাদের কাছে থাকা ফোন ও টাকা পয়সা আমরা তাদের হাতে তুলে দেই। তারা আমাদেরকে গাড়ির পাশে রাস্তায় শুইয়ে দেয় এবং আমার মাথায় লাঠি দিয়ে জোরে আঘাতও করে, যার ফলে আমার মাথা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। এতদসত্ত্বেও আমরা বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম তালে’কে নিয়ে। যাহোক উমর ফারুক সাহেবও অসুস্থ এবং গুলিবিদ্ধও হয়েছেন, মাথায়ও আঘাত পেয়েছেন, আল্লাহ্ তা’লা তাকেও আরোগ্য দান করুন। তার জন্যও আপনারা দোয়া করুন। এরপর তিনি বলেন, উমর ফারুক এবং ড্রাইভার আব্দুর রহমান সাহেব বলেন, ডাকাতরা আমাদেরকে লুট করে চলে গেলে আমরা সাহস করে উঠে যখন গাড়ির নিকট তালে’র অবস্থা দেখার জন্য আসি, তখন দেখতে পাই তারও কোমরে গুলি লেগেছে আর ডানদিকে ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল, যার কারণে গাড়িতেই অনেক রক্তক্ষরণ হয়। মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী এটিই প্রাণঘাতী প্রমাণিত হয়েছে। যাহোক, ঘটনার পর সেই পথ দিয়ে যাওয়া একটি বাসের মাধ্যমে তাকে বুপে পলি ক্লিনিকে নেয়া হয়। সেখানে কিছুটা চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে সেখান থেকে টোমালে টিচিং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়; কিন্তু পথিমধ্যেই তার ইন্তেকাল হয়। হাসপাতালে পৌঁছলে কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করে। ওমর ফারুক সাহেব বলেন, তালে’র মাথা আমার রানের ওপর ছিল আর বারবার সে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল যে, হুযূর কি আমাদের এই ঘটনা সম্বন্ধে অবগত হয়েছেন? দোয়ার জন্য বলে দিয়েছেন কি? তিনি বলেন, এই ঘটনার আমাদের ওপর অতি গভীর চাপ ছিল আর বহু শঙ্কা ও ভয় ছিল যা আমাদেরকে ভীত-উৎকন্ঠিত করছিল। তিনি বলেন, যখন আমাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন সৈয়দ তালে’ এটাও বলেছিলেন যে, গুলিবর্ষণের সময় তিনি দ্রুত ল্যাপটপ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পিছনের সিটের নীচে রেখে দিয়েছিলেন, অর্থাৎ সেখানে সুরক্ষিত রয়েছে, সেখান থেকে বের করে নিবেন। এরপর তিনি আমাকে ক্যামেরা, ফোন, ল্যাপটপ ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন যে, সেগুলো সুরক্ষিত আছে কিনা? কেননা তার চিন্তা ছিল, কোথাও সমস্ত রেকর্ড নষ্ট না হয়ে যায়। আমি তাকে নিশ্চিত করি যে, আল্লাহ্ তালার কৃপায় সংশ্লিষ্ট সমস্ত জিনিসপত্র সুরক্ষিত আছে। তার দুশ্চিন্তা যদি থেকে থাকে তবে তা ছিল, জামা’তের জিনিসপত্র এবং সম্পদের এবং জামা’তী ইতিহাসকে সংরক্ষণ করার জন্য যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা করেছেন তা সংরক্ষণের। যাহোক তিনি বলেন, নয়টা-সাড়ে নয়টার দিকে তার অবস্থার অবনতি হওয়া শুরু হয় যার কারণে পলি ক্লিনিকের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নেয় যেন অতিসত্ত্বর তাকে কোন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। আমি যেমনটি বলেছি, টোমালে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, পথিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে তার মৃত্যু ঘটে। অ্যাম্বুলেন্সে প্রয়োজনীয় সামগ্রীও মজুত ছিল না আর এসব দেশের অবস্থা এমনই। প্রথমে তো অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল আর রক্তপাতও অনেক বেশি হচ্ছিল। যাহোক পরিশেষে তা-ই হয়েছে যা আল্লাহ তা’লার তকদীর ছিল। উমর ফারুক সাহেব বলেন, আমরা যখন আহতাবস্থায় সফর করছিলাম, তালে’ আমাকে বলেন,
Tell Huzur that I love him and tell
my family that I love them
। উমর ফারুক সাহেব বলেন, সামান্য চেতনা ফিরে পেতেই তিনি এই কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করতেন আর এরকম অনেকবার হয়েছে। এটি কেবল একবারই বলেন নি, বরং কয়েকবার এমনটি ঘটেছে। তিনি এটিও বলেন যে, আপনারা আমার অনেক যত্ন নিয়েছেন আর যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন, যে কারণে আমি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। আমি তার মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিলেন আর অবস্থা তখন এমন ছিল যে, আমি প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়ার পরিবর্তে তার নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বৃদ্ধাঙ্গুলি উঁচু করে ইঙ্গিতে বলতেন যে, সব ঠিক আছে। একারণে আমার ভয় হয়। এরপর তার নিঃশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পায় এবং এক দীর্ঘ স্তব্ধতা ছেয়ে যায় আর আমি বুঝতে পারি যে, আমরা যা ঠেকাতে চাচ্ছিলাম তা-ই ঘটে গেছে। তিনি বলেন, পুরুষ নার্স এবং ড্রাইভার নিজেদের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় কথা বলছিল, আমি আঁচ করতে পারছিলাম যে, তারা আমাদের কাছে গোপন করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সৈয়দ তালে’ আহমদের ততক্ষণে প্রয়াণ ঘটে। যাহোক, আমি যেমনটি বলেছি, টোমালে পৌঁছার পর ১ টা ৪৯ মিনিটে হাসপাতালের কর্মকর্তারা তাকে মৃত ঘোষণা করে। তিনি বলেন, এ খবর শুনে টোমালের সবাই শোকাভিভূত হয়ে পড়ে, কেননা কিছুক্ষণ পূর্বেই হাস্যোজ্জ্বল এই ব্যক্তিকে তারা বিদায় জানিয়েছিল।
যাহোক, এই ছিল তাঁর শাহাদাতের ঘটনার কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ। একটি রত্ন ছিলেন যিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আল্লাহ্ তালা এমন বিশ্বস্ত, খিলাফতের সাথে পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সম্পর্ক রক্ষাকারী এবং ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দানকারী মানুষ জামা’তকে সবসময় দান করতে থাকুন। কিন্তু এ ক্ষতি এমন, যা ভীত নাড়িয়ে দিয়েছে। সেই প্রিয় সত্তা ওয়াকফের প্রেরণায় সমৃদ্ধ এবং যে অঙ্গীকার তিনি করেছিলেন তা সত্যিকার অর্থেই পালনকারী ছিলেন। তাকে দেখে আমি বিস্মিত হতাম এবং এখনও বিস্মিত যে, এই বস্তুবাদী পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েও তিনি গভীরভাবে তার ওয়াকফের তাৎপর্য উপলব্ধি করেছেন এবং এর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন আর এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হন যে, সেটিকে পরম মার্গে পৌঁছিয়েছেন! ইতিহাস জানার জন্য বুযূর্গদের ঘটনাবলী বা তাদের কুরবানীর প্রতি কেবল বিস্ময় প্রকাশের জন্য তিনি সেগুলো পাঠ করতেন না, বরং সেগুলোকে তিনি নিজের জীবনের অংশে পরিণত করার জন্য পড়তেন। খিলাফতের সাথে বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার এমন গভীর উপলব্ধি ছিল যা খুব কমই চোখে পড়ে বরং আমি বলব, এত (গভীর উপলব্ধি) ছিল যে, অনেক প্রগাঢ় ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিরাও তা বুঝে না। অনেক সময় এমন লোকদের জ্ঞান তাদের মাঝে অহংকার সৃষ্টি করে, বরং আমি বলব, কতক এমন লোকও তা বুঝে না যারা মনে করে আমরা খিলাফতের পরম মর্যাদা ও এর প্রতি বিশ্বস্ততার মান সম্পর্কে অবগত। খিলাফতের সাথে তিনি বিশ্বস্ততা রক্ষা করেছেন এবং এমন বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করেছেন যে, জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও তার অন্তিম শব্দগুলো হতে প্রতিভাত হয় যে, যুগ খলীফার প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততাই তখন তার চিন্তাচেতনায় বিরাজমান ছিল। (এমন সময়) সন্তানসন্ততি ও নিজ পরিবার-পরিজনের কথা সবার মনে পড়ে। কিন্তু প্রতিবারই নিজ সন্তানসন্ততি ও পরিবারের সাথে বা পূর্বে বার বার যুগ খলীফার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশের চিন্তা কদাচিৎই কারো মাথায় এসে থাকে। সম্ভবত দুই-তিন বছর পূর্বে তিনি একটি কবিতা রচনা করেছিলেন যা তিনি তার কোন বন্ধুকে একথা বলে দিয়েছিলেন যে, এটি নিজের কাছে রেখে দিবে, আর কাউকে দেখাবে না, যা খিলাফতের সাথে সম্পর্ক ও ভালোবাসা সম্বন্ধে লিখা ছিল। তিনি শুরুই করেছিলেন এভাবে যে, যুগ খলীফাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আর শেষ করেছিলেন এভাবে যে, যুগ খলীফার প্রতি আমার যে প্রেম ও ভালোবাসা রয়েছে তা তিনি কখনো জানতে পারবেন না। কিন্তু হে প্রিয় তালে! আমি তোমাকে বলছি, তোমার (কবিতার) এই শেষ বাক্যের পূর্বেও আমি জানতাম যে, খিলাফতের সাথে তোমার গভীর প্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। তোমার প্রতিটি কর্ম ও গতিবিধি হতে, যখন তোমার হাতে ক্যামেরা থাকত এবং আমি সামনে থাকতাম আর যখন ক্যামেরা ছাড়া সাক্ষাৎ করতে, তা হোক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ বা দাপ্তরিক কাজে; তখন তোমার চোখের উজ্জ্বলতায় এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটত আর তোমার চেহারার এক বিস্ময়কর দীপ্তিতে এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হতো। মোটকথা সকলভাবে তোমার সকল কর্মে প্রতীয়মান হতো যে, যুগ খলীফার প্রতি তোমার যে ভালোবাসা রয়েছে তুমি তার বহিঃপ্রকাশ করতে চাইতে। খুব কম মানুষের মাঝেই আমি এমন ভালোবাসা দেখি। ঘরে আমি বলছিলাম, [মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর] বংশে যুবকদের মাঝে এখন কারো মাঝেই এরূপ ভালোবাসা আমার চোখে পড়ে না। মনের খবর আল্লাহ্ই ভালো জানেন, বরং বড়দের মাঝেও সম্ভবত গুটিকতকের মাঝেই তা থাকবে। আমি দোয়া করি, এই দুর্ঘটনার পর আল্লাহ্ তা’লা এই মানের বহু লোক সৃষ্টি করুন। তালের সত্তা তেমনই ছিল যেমনটি তিনি তার নযমে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার এই ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাইতেন না, বরং গোপন করতে চাইতেন, কিন্তু তা গোপন থাকত না। এই সম্পর্ককে আল্লাহ্ তা’লা কোন না কোনভাবে প্রকাশ করে দিতেন। এজন্য তিনি আমার কাছে অনেক প্রিয় ছিলেন। সর্বদা তিনি এই চিন্তায় থাকতেন যে, যুগ খলীফার মুখ থেকে কখন কোন নির্দেশ আসবে এবং আমি তা পালন করব। আর কেবল নিজেই (এর) অনুসরণ করব না, বরং খিলাফতের পরম সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে জগতবাসীকেও অবহিত করব। খলীফার নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য কখনো জীবন উৎসর্গ করতে হলেও তা করব। এরপর নিজ কাজের প্রতি তার যে সুগভীর একাগ্রতা ছিল তা খুব কম মানুষের মাঝেই দৃষ্টিগোচর হয়। নিজের কাজ পছন্দ করত বলেই কাজের প্রতি তার ভালোবাসা বা আন্তরিকতা ছিল না। বহু মানুষ এমন রয়েছে যারা নিজেদের কাজের প্রতি ভালোবাসা ও একাগ্রতা রাখে। নিজ কাজের প্রতি যদি তার আন্তরিকতা থেকে থাকে তা এজন্য ছিল যে, এর মাধ্যমে আমি ইসলাম ও হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর ধর্মের সুরক্ষা করব এবং এই বার্তাকে আমি পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে দিব। আর এজন্য ছিল যে, আমার দায়িত্ব হলো হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বাণীকে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছানো। এছাড়া আমাকে যুগ খলীফার সাহায্যকারী হতে হবে। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ রাবে (রাহে.)-এর দাফন-কার্য সমাধার সময় আমি যখন মাটি দেয়ার পূর্বে মাথার দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন সে আমার ডান পাশে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আমার জানা ছিল না যে, এটি কে দাঁড়িয়ে আছে? এখন ছবি দেখার পর আমি বুঝতে পেরেছি যে, কে ছিল আর কী উপলক্ষ্য ছিল। কিন্তু সেই তেরো বছরের বালক হয়ত তখনই এই প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, আমি একজন ওয়াকফে নও আর এখন আমাকে যুগ খলীফার সাহায্যকারী ও ডান হাত হতে হবে। আর বেশ কয়েক বছর পর সে তার পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর এই অঙ্গীকার পূর্ণ করেছে এবং খুবই উত্তমরূপে পূর্ণ করেছে। আমার পরামর্শক্রমেই সে সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়েছিল এবং এরপর পড়াশোনা সম্পন্ন করেছে আর শহীদ হওয়ার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়ে গেছে যে, আমি খিলাফতের প্রকৃত সাহায্যকারী হয়েছি।
হে প্রিয় তালে’! আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় তুমি তোমার ওয়াক্ফ ও অঙ্গীকার রক্ষার উন্নত সব মান হস্তগত করেছ। তিনি কীভাবে যুগখলীফার প্রতিটি শব্দের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবার চেষ্টা করতেন সেটি এ থেকে অনুমান করা যায় যে, আমি মুরব্বীদের সাথে অনুষ্ঠিত কতিপয় মিটিং-এ তাদেরকে বলেছিলাম, মুরব্বীদের এক ঘন্টার মতো তাহাজ্জুদ পড়ার চেষ্টা করা উচিত। প্রিয় তালে’ কতক মুরব্বীর ন্যায় এই প্রশ্ন করেন নি যে, গ্রীষ্মের ছোট রাতে এত দ্রুত জাগ্রত হয়ে প্রায় ঘন্টাকাল তাহাজ্জুদ কীভাবে পড়া যেতে পারে? বরং তিনি তা পালনের চেষ্টা করেছেন। তার এক মুরব্বী বন্ধু তাকে একদিন খুব ক্লান্ত দেখে কারণ জিজ্ঞেস করেন। তখন তিনি বলেন, যুগখলীফা মুরব্বীদেরকে প্রায় ঘন্টাকাল তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য বলেছেন। আমিও তো ওয়াকফে জিন্দেগী। তাই এই নির্দেশ আমার জন্যও প্রযোজ্য। আজকে তাহাজ্জুদের জন্য ভালোভাবে ঘুমাতে পারি নি, তাই ক্লান্তিবোধ করছি। সেই মুরব্বী সাহেব আমাকে লিখেন যে, তার একথা আমাকে চরমভাবে লজ্জিত করে, কেননা আমি সরাসরি সম্বোধিত ছিলাম অথচ আমি যুগ খলীফার নির্দেশের ওপর সেভাবে আমল করতে পারি নি, কিন্তু তিনি কেবল একজন ওয়াকফে জিন্দেগীর অঙ্গীকার রক্ষার জন্য এই নির্দেশ পালন করেছেন। এ ছিল তার অঙ্গীকার রক্ষার মানদণ্ড। সুতরাং ওয়াকফে জিন্দেগীদের জন্যও তিনি এক আদর্শ ছিলেন এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে খানদানের সদস্যদের জন্যও তিনি বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার এক আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। এখন এটি খানদানের সদস্যদের ওপর নির্ভর করে যে, এই আদর্শের ওপর কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বংশধর হবার দায়িত্ব পালন করবেন। বংশমর্যাদা অথবা দৈহিক আত্মীয়তার সম্পর্কের মাধ্যমে বিশেষ কোন মর্যাদা লাভ হয় না। কেউ যদি তাদেরকে সম্মান করে তবে তা তাদের জাগতিক অবস্থার জন্য নয় আর এমনটি কখনো হবেও না। ধর্মের সেবক হওয়া এবং ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দেয়ার মাঝেই প্রকৃত সম্মান নিহিত। অন্যথায় বস্তুবাদী লোকদের মাঝে কোটি কোটি লোক আর্থিকভাবে তাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে আর যারা জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভালো অবস্থানে নেই তাদের কাছেও এদের কোন সম্মান নেই। অতএব আমি হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর খানদানের সদস্যদেরও বলছি যে, এই বিদায়ী সত্তার কাছ থেকে শিক্ষা নিন এবং নিষ্ঠা ও বিশ্বস্তায় অগ্রসর হোন। এছাড়া যেভাবে এই বিশ্বস্তার মূর্ত প্রতীক তার অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন এবং ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দান করেছেন, খানদানের অন্যদেরও সেই আদর্শ অনুসরণ করা উচিত আর এটিই সম্মানের কারণ এবং খোদা তা’লার অনুগ্রহ লাভের মাধ্যম; নতুবা জাগতিকতা এবং পার্থিব কামনা বাসনা হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বংশের সদস্যদেরকে নূন্যতম সম্মানও দিতে পারে না। কোন বুযূর্গের ছেলে বা মেয়ে হওয়ার মাঝে কোন বিশেষত্ব নেই, যদি নিজের কর্ম সঠিক না হয়। যেমনটি আমি বলেছি, ওয়াকফে জিন্দেগীদের জন্যও তিনি এক বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত ছিলেন। কখনো এই অভিযোগ করতেন না যে, ভাতা কম, এ দিয়ে দিনাতিপাত হয় না। যা পেতেন কৃতজ্ঞতা ভরে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। যদি কোন উৎস হতে অতিরিক্ত অর্থের সমাগম ঘটতো তখন আল্লাহ্ তালার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। আল্লাহ্ তা’লার কাছে তিনি দোয়া করেছিলেন যে, হে আল্লাহ্! তুমি আমাকে কখনো দৈন্যের মাঝে নিপতিত করো না। আল্লাহ্ তা’লাও কখনো তাকে অসচ্ছল করেন নি। নিয়মিত রোযাদার ছিলেন। তার মাঝে অসংখ্য গুণাবলী ছিল। যারা আমাকে সমবেদনামূলক পত্র লিখছেন তাদের অনেকেই তার অগণিত গুণাবলী বর্ণনা করছেন। উদাহরণস্বরূপ ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আত্বীয়স্বজনেরা এমনসব গুণাবলীর উল্লেখ করেছেন যেগুলো আমার কাছেও বিস্ময়কর। আমি তার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে কিছুটা জানতাম, কিন্তু তার পুণ্য এবং তাকওয়ার মান অনেক উন্নত ছিল। তাই তার জীবনী সম্পর্কে আমি যদি লোকজনের ভাষাতেই কতিপয় বিষয় আপনাদের সামনে উপস্থাপন করি তাহলে সেটিই যথার্থ হবে। এগুলোর মাঝে তার স্ত্রী, পিতামাতা, ভাইবোন এবং বন্ধুদের আবেগ-অনুভূতি আর কিছু বাস্তব বিষয় ও ঘটনাবলী অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
রিভিউ অফ রিলিজিওন্সের সম্পাদক আমের সফির সাহেব বলেন, তালে’ চার বছর রিভিউতে কাজ করেছেন। রিভিউ-এর ইন্ডেক্সিং বিভাগে কাজ করেছেন এবং আর্কাইভ ট্যাগিং প্রজেক্টে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সেবা করার তৌফিক পেয়েছেন। অনেক বড় দায়িত্ব ছিল যা তিনি সম্পাদন করেছেন। রিভিউ অফ রিলিজিওন্সের একশ বছরের অধিক সময়ের সূচীপত্র প্রস্তুত করা, বিভিন্ন ক্যাটাগরির সূচী প্রস্তুত করা, প্রবন্ধ ও রচনাবলীর বিষয়ভিত্তিক বিন্যাস বিরাট একটি কাজ ছিল যাতে তিনি অনেক পরিশ্রম ও একাগ্রতার সাথে কাজ করেছেন। এই দলটি ছিল এগারো সদস্য বিশিষ্ট। অনেক পরিশ্রমের কাজ ছিল আর আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় সবাই এ কাজকে ভালোভাবে সম্পন্ন করেছেন যার তত্ত্বাবধান তালে’ করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, আমি স্বচক্ষে দেখেছি, তালে’ বহুবিধ মেধাসম্পন্ন ছিলেন। ব্যবস্থাপনার কাজ অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পাদন করতেন। সেবা করার গভীর প্রেরণা ও একাগ্রতা ছিল। খিলাফতের প্রতি সীমাহীন বিশ্বস্ততা ও ভালোবাসা ছিল। আরো বলেন, তালে’র মাঝে আমি আরেকটি যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখেছি তা হলো, কোন প্রজেক্টেকে একেবারে শূন্যের কোঠা থেকে শুরু করে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে সম্মানজনক মানে নিয়ে যাওয়া। কখনো এই অপেক্ষা করতেন না যে, ব্যবস্থাপনা তাকে কাজে অনুপ্রাণীত করবে অথবা স্মরণ করাবে। এক পাগলপারা ব্যক্তির ন্যায় সাগ্রহে এগিয়ে এসে কাজ করতেন। তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাদের সম্পর্কে হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.) বলেন, তারা উন্মাদনার পর্যায়ের সংকল্প ও নিষ্ঠা নিয়ে ধর্মের কাজ করে। তালে’-র জাগতিকতার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। জামা’ত এবং খিলাফতের জন্য কাজ করার সুযোগ পাওয়াকেই তিনি সবকিছু জ্ঞান করতেন। এরপর তিনি বলেন, আমি যা কিছু দেখেছি তার সারাংশ হলো, তার সবকিছুই খিলাফতকেন্দ্রীক ছিল। যুগ খলীফার সাথে তার একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। কিন্তু যখনই আমি তাকে আপনার কোন নির্দেশনা পৌঁছে দিতাম তখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যেতেন এবং বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন যেভাবে কোন শিশু চকলেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর আপনার নির্দেশনা পৌঁছানোর জন্য আমার কৃতজ্ঞতাও জ্ঞাপন করতেন। তিনি একটি প্রামাণ্যচিত্রের পরিবর্তে একযোগে দু’টি নিয়ে কাজ করতেন আর আমি খুবই অবাক হতাম যে, একসাথে দুটি প্রামাণ্যচিত্রের কাজ তিনি কীভাবে করেন! অনেক সময় আমি জানতামই না যে, তালে’ কোন প্রামাণ্যচিত্রের ওপর কাজ করছেন? আমাদেরকে সারপ্রাইজ দিতে চাইতেন। তালে’র গবেষণা করার দক্ষতা অনেক উন্নত ছিল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, যা তালে’র মাঝে পাওয়া যায় তা হলো সর্বদা নিজ পরিবার এবং আত্মীয়স্বজনকে জামা’তের সাথে সম্পৃক্ত করতে এবং জামা’তের সেবায় রত অবস্থায় দেখতে চাইতেন। যখনই আমি তাকে বলতাম, তোমার অমুক আত্মীয় রিভিউর অমুক উপলক্ষ্যে সেবা করেছে অথবা করছে তখন খুবই আনন্দিত হতেন।
খোদ্দামুল আহমদীয়ার সদর কুদ্দুস আরেফ সাহেব বলেন, শৈশব থেকেই তার সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। তিনি বলেন, আমি দেখেছি তালে’ হযরত মালেক গোলাম ফরিদ সাহেবের শর্ট কমেন্ট্রিতে (বিষয়ভিত্তিক) চিহ্ন লাগিয়ে রেখেছেন এবং ফাইভ ভলিউম কমেন্ট্রিও তিনি বিস্তারিত পড়েছিলেন। আর বিভিন্ন আয়াত হাইলাইট করে রেখেছিলেন এবং স্লিপ লাগিয়ে রেখেছিলেন। ফাইভ ভলিউম কমেন্ট্রি সম্পর্কেও বলে দেই, বি.এস.সি. করার পর তিনি এক বছর গ্যাপ বা বিরতি নিয়েছেন। তখন আমি তাকে কোন ওয়াকফে নও ক্লাসে আর হয়ত এরপরও দপ্তরে মুলাকাতের সময় বলেছিলাম যে, এটি অর্থাৎ ফাইভ ভলিউম কমেন্ট্রি পড়। আমার ধারণা ছিল যে, কয়েক বছর সময় নিবে। কিন্তু কয়েক মাস পরেই তিনি এসে আমাকে বলেন যে, আমি পুরোটা পড়ে নিয়েছি। তখনও এ কথা শুনে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। অনুরূপভাবে তিনি এমনসব প্রামাণ্যচিত্রও প্রস্তুত করতেন যা যুবকরা পছন্দ করে। যেমন- ফুটবল সম্পর্কে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রস্তুত করেন যাতে তরবিয়ত বা শিক্ষামূলক দিকটিকে দৃষ্টিপটে রাখেন। এরপর তিনি বলেন, এম.টি.এ.-তে (তার) প্রস্তুতকৃত প্রামাণ্যচিত্রগুলো একটি অন্যটির চেয়ে উন্নত মানের ছিল। তিনি বলেন, আমার স্মরণ আছে, যখন ‘Brutality and Injustice: Two Trials in a Time’ প্রামাণ্যচিত্রটি সম্প্রচারিত হয় তখন খকসার তালে’-কে খুদেবার্তা প্রেরণ করি যে, প্রামাণ্যচিত্রটি খুবই ঈমানোদ্দীপক ছিল। তিনি উত্তরে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে শুধু এটিই বলেন যে, আমাদেরকে দোয়ায় স্মরণ রাখবেন, এ সবই আল্লাহ্ তা’লার অনুগ্রহ। টুইটারে কেউ প্রমাণ্যচিত্রের নাম নিয়ে আপত্তি করলে তালে’ তার উত্তর প্রদান করেন। তিনি বলেন, আমি তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, যেহেতু যুগখলীফা স্বয়ং এই নামের অনুমোদন দিয়েছেন তাই আমি এটির পক্ষে কথা বলেছি। যদি আবেদ বা আমার পক্ষ থেকে এই নাম রাখা হতো তাহলে আমি কখনো কিছু বলতাম না। কিন্তু যুগখলীফা যেহেতু সেটির অনুমোদন দিয়েছেন, তাই আমাকে অবশ্যই বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে এবং এর সমর্থন করতে হবে। অতঃপর তিনি বলেন, গত বছর ভার্চুয়াল আতফাল র্যালীতে খাকসার মোহতামীম আতফালের মাধ্যমে তালে’-র কাছে অনুরোধ করি যেন তিনি আপনার সাথে অর্থাৎ যুগখলীফার সাথে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা ঘটনাবলী উপস্থাপন করেন। প্রথমে তিনি সম্মত ছিলেন না। এরপর যখন তাকে মজলিসের সদর হিসেবে বলি, তখন তিনি সম্মত হন। আর উক্ত ঘটনাবলীও মানুষ অনেক পছন্দ করেছে, আতফালদের তা খুবই পছন্দ হয়েছে। তিনি তখন সদর খোদ্দামুল আহমদীয়াকে খুদে বার্তায় বলেন যে, আমার এখনও পুরোপুরি সংশোধন হয়নি, আমার ইচ্ছা ছিল যখন আমার সংশোধন হয়ে যাবে তখন আমি মানুষকে নসীহত করব বা ঘটনা শুনাব, অথবা আমি যখন বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাব তখন এসব ঘটনা বলব আর সেসময় পর্যন্ত নীরবেই জীবন কাটানোর আমার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আপনি আমাকে দিয়ে এগুলো বলিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ্ তা’লা জানতেন যে, তখনই সেসব ঘটনা সবার কাছে তুলে ধরার সময় ছিল।
তার স্ত্রী স্নেহের সাতওয়াৎ বলেন, তিনি গভীর ভালবাসাদানকারী ও স্নেহশীল ছিলেন। আমার ও সন্তানদের প্রতি পরম স্নেহশীল ছিলেন। ছোট ছোট কাজের প্রশংসা করতেন। খাবার যেমনই হোক না কেন, তা পছন্দ করতেন। তিনি বলেন, আমার পিতার শাহাদাতের পর আমি কিছুটা দুঃখভারাক্রান্ত থাকতাম। এরপর স্বল্প সময়ের ভিতর আমার বাগদানও হয়ে যায়। তিনি বলেন, পিতা না থাকার কারণে আমি খুবই বিষণ্ন ছিলাম, কিন্তু বিয়ে হওয়ার পর তালে’ আমার গভীর যত্ন নেন এবং আমাকে শূন্যতা বুঝতে দেন নি। তিনি বলেন, যখন আমাদের বাগদান হয় তখন আমি ভাবতাম যে, মহানবী (সা.)-এর প্রতি তার ভালোবাসা কত গভীর! এমনিতে তো যুবক ছিলেন, কিন্তু মহানবী (সা.)-এর কথা বলার সময় শিশুদের ন্যায় কাদতেন। পুত্র তালালকেও মহানবী (সা.) সম্পর্কে গল্প শুনানোর সময় ফুঁপিয়ে কাদতেন। মহানবী (সা.) সম্পর্কে বহু গল্প জানতেন। বিভিন্ন ঘটনা (তার) মুখস্থ ছিল। এ সম্পর্কে আরো অনেকেই লিখেছে যে, ইতিহাস ও মহানবী (সা.)-এর জীবনী সম্পর্কে তার জ্ঞান খুবই গভীর ছিল। তিনি বলেন, আমাকে বলতেন যে, তালালের স্কুলটি খ্রিষ্টানদের একটি স্কুল। আমি যখন স্কুলে যাই তখন পথে তাকে সূরা ইখলাস শোনাতে থাকি আর বলি, তুমি আমার সাথে পুনরাবৃত্তি কর। খিলাফতের প্রতি পরম ভালোবাসা ছিল আর এর জন্য প্রচণ্ড আত্মাভিমানও রাখতেন। কিছু বিষয় নিতান্ত ছোট হলেও নিষ্ঠার পরিচায়ক হয়ে থাকে। তিনি বলেন, অত্যন্ত আনন্দিত হতেন যখন তার এই প্রতীতি হতো যে, আপনি তার প্রতি সন্তুষ্ট বা তার পুত্রের প্রতি সন্তুষ্ট। সর্বদা মুলাকাতের পর আমাদের ট্রীট দিতেন বা তালালকে চকলেট দিতেন যে, তুমি খুবই ভালো ছেলে হয়ে থেকেছ অথবা আমাদের আইসক্রিম ইত্যাদি খাওয়াতে নিয়ে যেতেন। ছোট ছোট বিষয়, যেমন- সন্তানের প্রতি এতে খুশী হতেন যে, যুগখলীফার সামনে আজ তুমি খুব ভালোভাবে আচরণ করেছ বা আমাদের মুলাকাত খুব ভালো হয়েছে। কখনো কখনো তার এই ধারণা হতো যে, আমি (তার) কোন বিষয় অপছন্দ করেছি। এটি তার ধারণাই হবে, কেননা কখনো এমন কোন ঘটনা হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। তিনি বলেন, আমার মনে আছে, যখনই তার এই ধারণা হতো যে, যুগখলীফা (তার) কোন বিষয় অপছন্দ করেছেন, তখন তাহাজ্জুদে কেঁদে কেঁদে আল্লাহ্ তা’লার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন আর শিশুদের ন্যায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদতেন। প্রামাণ্যচিত্র বানানোর পর এটিই হতো, অর্থাৎ যুগখলীফার কাছ থেকে অনুমোদনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। আর ঞযরং বিবশ নামক অনুষ্ঠানটি আরম্ভ করে খুবই আনন্দিত ছিল যে, এর কারণে বেশি বেশি আমার দপ্তরে এসে, আমার কাছে থেকে রেকর্ডিং করতে পারছেন। এরপর তিনি বলেন, তার মাঝে অনেক বড় একটি গুণ ছিল তিনি ধর্মকে জাগতিকতার ওপর প্রাধান্য দিতেন। বস্তুবাদিতার প্রতি সামান্য আকর্ষণও ছিল না। কখনো তিনি কোন জিনিসের বাসনা করেন নি। জাগতিক কোন বস্তুর প্রতি তার হৃদয়ে কখনো লালসা ছিল না। জাগতিক জিনিসপত্রের প্রতি তার কোন আগ্রহই ছিল না। কেউ তাকে মূল্যবান কোন উপহার দিলে বিচলিত হয়ে পড়তেন যে, এমন একটি জিনিস আমার কাছে চলে এসেছে! আল্লাহ্ তা’লার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতেন। খোদা তাকে যা দিয়েছেন তাতেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। তার কাছে যা কিছু ছিল তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতেন। তিনি বলতেন, শৈশবে হযরত খলীফা আউয়াল (রা.)-এর সাথে আর্থিক বিষয়াদিতে কীরূপ আচরণ হতো সে সংক্রান্ত একটি ঘটনা পড়েছিলেন। তিনি বলতেন, আমি তা পড়ে তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহ্ তা’লার কাছে এই দোয়া করি যে, হে আল্লাহ্! আমার সাথেও তুমি এমনই আচরণ করো। আর তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ্ তা’লা আমার দোয়া গ্রহণ করেছেন। তিনি বলতেন, আমার সাথে সর্বদা আল্লাহ্ তা’লার আচরণ হযরত হেকীম মৌলভী নূরুদ্দীন সাহেবের ন্যায় হবে আর এটি বাস্তবেই সত্য। তিনি বলেন, আমি এটি স্বয়ং দেখেছি যে, যখনই কোন জিনিসের প্রয়োজন হতো হঠাৎ তার কাছে অর্থ এসে যেতো। তিনি বলেন, অতি সম্প্রতি দশ বছর পর এক লোন কোম্পানি তাকে ফোন করে বলে যে, আমাদের কাছে তোমার এক হাজার পাউন্ড রয়েছে। তিনি তখন খুবই আনন্দিত হন যে, এখন আমি আমার গাড়ির ইন্সুরেন্সের কিস্তি পরিশোধ করতে পারব আর গাড়ি সচল রাখার জন্য যে প্রয়োজন তা পূর্ণ করতে পারব, এমন নয় যে, এখন আমি জামা’ত থেকে নিব। তিনি বলেন, তার সাথে আল্লাহ্ তা’লার স্নেহপূর্ণ আচরণ আমি নিজেও দেখেছি। পূর্বের ঘটনা ছিল (খোদার) ব্যবহার সংক্রান্ত, কিন্তু নিজের ঘটনাও তিনি শুনিয়েছেন। তিনি নিজে বর্ণনা করেন যে, প্রায় দশ বছর পুরোনো কথা। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, একবার আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগে আর আমার কাছে কোন পয়সা ছিল না। অর্থ পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি নামায পড়ি, আর যখন সালাম ফিরাই তখন দেখি যে, বিছানার নীচে দশ পাউন্ড রয়েছে। তিনি বলেন, আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি যে, এই অর্থ (নিশ্চয়) আল্লাহ্ তা’লা আমার জন্য পাঠিয়েছেন! তার ভেতর গভীর আত্মবিশ্বাসও ছিল। আমি বললাম, মানুষ আর্থিক দিক থেকে কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখে, কিন্তু তার এই বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহ্ তা’লা আমার জন্য রিযিক সরবরাহ করবেন তাই আমার বিনা কারণে জাগতিকতার পিছনে ছোটার কোন প্রয়োজন নেই, আমার বরং ওয়াকফের প্রতি সুবিচার করা উচিত। পুনরায় তিনি বলেন, আমরা যখন পূর্বে ভাড়া বাসায় ছিলাম আর আমাদের ভাড়ার চুক্তি শেষ হয় তখন কাউন্সিল বিল, বিদ্যুৎ বিল ইত্যাদি সম্পর্কে কাউন্সিল লিখে যে, তোমার একাউন্টে কিছু টাকা অর্থাৎ প্রায় দু-তিন শত পাউন্ড বেশি রয়েছে, তখন তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বলেন যে, আমি জামা’তকে তা ফিরিয়ে দিব। অথচ জামা’ত কখনো এত কঠোরভাবে নিয়ম পালন করতে আর পয়সা ফেরত দিতে বলে নি, কিন্তু তিনি তা মেনে নেন নি। তিনি বলেন, আমি জামাতকে এটি ফিরিয়ে দিব এবং আরো বলেন, জামা’তের উপর আমি বোঝা হতে চাই না। তিনি প্রায়ই বলতেন, সম্ভব হলে আমি এসবকিছু নিজ খরচে করতাম। জামা’তের জন্য বোঝা হওয়া কিংবা জামা’তের কাছে কোন আবেদন করা তার কখনো পছন্দ ছিল না। জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও তার এই চিন্তা ছিল যে, জামা’তের এত মূল্যবান জিনিস নিয়ে আমি আফ্রিকা যাচ্ছি, কীভাবে এগুলোর খেয়াল রাখব! নিজের কোন চিন্তা তার ছিল না। খুবই অতিথিপরায়ণ ছিলেন। নিজের পরিবার এবং আমার পরিবারের প্রতি সর্বদা যত্নশীল ছিলেন। সাদামাটা পোশাক পরিধান করতেন। তিনি বলেন, আমার মনে হয় কিছু মানুষ তাকে ভুল বুঝতো কিংবা ভাবতো যে, তার মাঝে অহংকার আছে বা সে ঠোঁটকাটা স্বভাবের, কিন্তু তার মাঝে এরূপ আত্মবিশ্বাস ছিল যে, ভালোবাসার সাথেই তিনি সেসব কথা বলতেন আর অহঙ্কারের লেশ মাত্রও তার মাঝে ছিল না। তালে’ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ব্যক্তি ছিলেন, সবার দোষ ঢেকে রাখতেন এবং কখনো কারো বিরুদ্ধে কোন কথা হৃদয়ে পুষে রাখতেন না।
তার পিতা লিখেন, আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহ্ তা’লা আমাদের ছেলেকে বিশেষ অনুগ্রহ ও কৃপার সাথে শাহাদাতের জন্য বেছে নিয়েছেন। তিনি বলেন, একটি স্বপ্নের ভিত্তিতে আমি আমার স্ত্রী এবং তালে’-কে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা আরম্ভ করেছিলাম। আর তালে’-কে যখন আমি উক্ত স্বপ্নের কথা বলি তখন সে আমাকে বলে, আপনি কি এটি স্বপ্নে দেখেছেন যে, আমি শহীদ হয়ে গিয়েছি? তিনি বলেন, আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করি যে, তুমি কীভাবে বুঝলে? সে বলল, আমিও এটি স্বপ্নে দেখেছি যে, আপনি শহীদ হয়েছেন। যাহোক তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা’লা এক পুত্রকে পিতার প্রতি ভালোবাসা পোষণের যতটা অনুমতি দিয়েছেন তালে’-র মাঝে সেই ভালোবাসা পূর্ণমাত্রায় ছিল। আর আমার ধারণা হলো, এ কারণে সে এই দোয়া করে থাকবে যে, বাবার শাহাদাতের পরিবর্তে যেন সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করে। আর যেহেতু সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভের মানে উপনীত ছিল তাই আল্লাহ্ তা’লা তাকেই এই শাহাদাতের সৌভাগ্য দান করেছেন। আর গুলি লাগার পর সে মুরব্বী সাহেবকে এটিও বলেছিল যে, আমি বেঁচে থাকি বা মারা যাই, আমি আমার মিশন সম্পূর্ণ করেছি। শৈশব থেকে খোদা তার হৃদয়ে এ বিশ্বাস ফুৎকার করেছিলেন যে, তোমাকে এক (বিশেষ) বংশে সৃষ্টি করেছি, তাই এসুবাদে যে দায়িত্ব বর্তায় তা বুঝতে হবে আর এ দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং জেনে রাখ তোমার জীবন এখন আর তোমার নয় বরং আমার। আর কেবল আমার নির্দেশাবলী অনুসারে তোমাকে সারাটি জীবন অতিবাহিত করতে হবে। তিনি বলেন, তালে’ নিজের জীবন ও মৃত্যুর মাধ্যমে এটি প্রমাণ করে গেছে যে, সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে দেখিয়েছে। অতঃপর বলেন, সে এমন এক সত্তা ছিল যার হৃদয় আল্লাহ্ তা’লা তাঁর এবং তাঁর প্রিয়দের প্রতি ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। তার হৃদয় এমন ছিল যে, বাল্যকাল থেকেই মহানবী (সা.)-এর নাম ও তাঁর স্মরণে তার নিষ্পাপ ঠোঁট কাঁপতো এবং চোখ দিয়ে অশ্রু নেমে আসতো। সে ছিল একটি পবিত্র সত্তা যার মাঝে বিন্দু পরিমাণ মন্দ অবশিষ্ট ছিল না। বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যও ছিল। সাদৃশ্য দিতে হলে, আমি তাকে হযরত ইউসুফ (আ.)-এর সাথে সাদৃশ্য দেই। চারিত্রিক দিক থেকেও সে তেমনই দৃঢ় ছিল। মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসায় তার হৃদয় ১৪০০ বছর পূর্বেকার মক্কা ও মদিনার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতো এবং তার দেহ ছিল সেই ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক। তার উঠাবসা, পানাহার, নিঃশ্বাস, (এককথায়) সবকিছু খলীফাতুল মসীহ্কে কেন্দ্র করে ছিল।
তার মা আমাতুশ শুকুর সাহেবা লিখেন, আমি অত্যন্ত ভাগ্যবতী এবং সৌভাগ্যশালিনী যে, আল্লাহ্ তা’লা আমাকে এক মহান সন্তান দান করেছেন। তালে’-র সাথে কাটানো ৩১ বছরের জীবন, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নেয়ামতগুলোর একটি। তিনি এক ভদ্রমহিলার একটি স্বপ্নের কথা উল্লেখ করেন। সেই ভদ্রমহিলা স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, এক শিশু একটি দোলনায় রয়েছে আর তার হাত ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। তিনি বলেন, তিনি সেই শিশুটিকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলতে শুনেছেন। তার কাছে নীল রঙের একটি কার্ড ছিল যাতে আরবী ভাষায় ‘আল্লাহ্’ এবং পাশাপাশি ইংরেজিতে God’ লেখা ছিল। সেই ভদ্র মহিলা বলতেন আমার মনে হয়, নীল রঙের অর্থ হলো পুত্র সন্তান। এই স্বপ্নটি তালে’-র জন্মের পূর্বে জনৈক মহিলা দেখে তাকে বলেছিলেন আর তিনি এই ধারণা ব্যক্ত করেন যে, তোমার ঘরে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করবে; আর এই সন্তান যেখানেই যাবে শান্তি ও নিরাপত্তার বাণী প্রচার করবে। যাহোক, তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা’লা আমাকে সুশ্রী ও খুব আদরের একটি সন্তান দান করেছেন। ২০০৫ সনে তার বয়স যখন পনের বছর ছিল আমরা উভয়ে একসাথে ওসীয়্যত করেছিলাম। ধর্মীয় ব্যাপারে সে খুব বিচক্ষণ ছিল। তিনি বলেন, তিন বছর বয়সে তালে’ কুরআন করীমের কিছু সূরা মুখস্ত করে নিয়েছিল। আমার মাকে জানালে তিনি অত্যন্ত আশ্চর্য হন। এছাড়া এটিও আমার স্মরণ আছে যে, তার বয়স যখন তিন বছর তখন আমি তার সাথে তবলীগী বিষয়ে আলোচনা করতাম আর সেও খুব মন দিয়ে এসব বিষয়ে আমার সাথে আলোচনা করত। পড়ালেখায়ও সে খুব ভালো ছিল এবং পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেত। আমার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে সে একজন চিকিৎসক হবে, কিন্তু আল্লাহ্ তা’লার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। বায়ো-মেডিকেল সাইন্সে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর আল্লাহ্ তা’লা তাকে সাংবাদিকতা বিষয়ে মাস্টার্স করার সৌভাগ্য দান করেন। তিনি বলেন, সন্তানের মৃত্যুর পর আমি এই বিষয়টি আরো বেশি উপলব্ধি করছি যে, আপনার প্রতি তার কতটা ভালোবাসা ছিল! আপনি যখন তাকে এম.টি.এ.-র জন্য ঐতিহাসিক প্রমাণ্যচিত্র নির্মাণ করার কাজ দিয়েছিলেন তখন একথাও বলেছিলেন যে, তুমি নির্দ্বিধায় স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করো। এতে সে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, তার স্ত্রী সাতওয়াৎ আমাকে জানিয়েছে যে, ২০১৯ সালে সে তাকে অর্থাৎ সাতওয়াৎকে ৮টি অনুষ্ঠান সম্পর্কিত পরিকল্পনার বিষয়ে ইমেইল করে এবং সাথে লিখে যে, আমার কিছু হলে তুমি এই অনুষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ করো এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগে পৌঁছে দিও।
তার বোন নুদরত বলেন, তালে’-র সাথে থাকার পর আমি জামা’তের কাজের প্রতি তার একাগ্রতার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। ধর্মীয় কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে প্রায়ই সে দেরিতে বাড়ি ফিরত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে তার বোন এখানে তার কাছেই থাকতেন। তিনি বলেন, কখনো কখনো রাত দশটার পর, কখনো আবার মধ্যরাতের পর বাড়ি ফেরা, খাবার খাওয়া, আবার কাজে লেগে যাওয়া। ছুটির দিনেও প্রকৃতপক্ষে তার জন্য জামা’তের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন ছুটি ছিল না। সর্বদা অত্যন্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে জামা’তের কাজে ব্যস্ত থাকত। অবসর সময়ে প্রায়ই বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র এবং ভিডিও ইত্যাদি দেখতে থাকতো। আমি কাউকে কখনো এত গভীর মনোযোগ দিয়ে কোন অনুষ্ঠান দেখতে ও বিশ্লেষণ করতে দেখি নি; যেন কেউ গভীরভাবে মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। জিজ্ঞেস করলে বলতো, নিজ কাজে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করার জন্য বহু প্রামাণ্যচিত্র ও ভিডিও ইত্যাদি অধ্যয়ন করতে হয়। তার মাঝে জামা’তের জন্য তথ্যভাণ্ডার একত্রিত করে উন্নত ও মানসম্পন্ন ঐতিহাসিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তার ধর্মীয় জ্ঞানও ছিল অতি ব্যাপক। ইসলামী শিক্ষা সংক্রান্ত যে কোন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিক সম্পর্কে আমার মনে প্রশ্ন জাগলে প্রায়ই তার সাথে আলাপ করার প্রতি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হতো। তার হাদীসশাস্ত্রের অধ্যয়নও ছিল অতি ব্যাপক। কোন না কোন স্থান থেকে এমন কোন হাদীস তুলে ধরত যা অধিকাংশ মানুষ জানতই না আর পাশাপাশি এর উদ্ধৃতিও বলে দিত। বিভিন্ন বিষয়ে কুরআনের আয়াতের উদ্ধৃতিও দিতে পারত। সর্ব প্রকার আলোচনায় অবদান রাখার যোগ্যতা ছিল। বিতর্কের সময় এমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরত যে, অপর পক্ষের তা গ্রহণ করা ছাড়া উপায় থাকত না। আরবী ভাষাও পড়েছিল এবং তাতে বেশ ভালো দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করেছে। আরবীর ব্যাকরণ সম্পর্কেও পরিচিত ছিল, কেননা সে আল্লাহ্র কালামকে মূল ভাষায় বুঝতে চাইত। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, সে এত ভালো আরবী কোথায়-কীভাবে পড়েছে? তখন সে আমাকে বিভিন্ন বিষয় সম্বলিত একটি পূর্ণ তালিকা প্রেরণ করে এবং আমাকে দিক-নির্দেশনাও দেয়। সেই তালিকায় ছাব্বিশটি অধ্যায় এবং অন্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি শব্দ ও বাক্যগঠনের বিভিন্ন উদাহরণও ছিল। এই সকল মেধাগত যোগ্যতা তালে’ কেবল খোদা তা’লার নৈকট্য লাভের জন্য এবং জামা’তের সেবার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। তিনি বলেন, দুটি স্বপ্ন বিশেষভাবে এমন, যে দুটির বিষয়ে তালে’ আমাকে সরাসরি বলেছে। মনে হয়, সেগুলোতে তার শাহাদাতের ইঙ্গিত ছিল। তালে’ তার ছেলে তালালের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রথম স্বপ্ন শুনিয়েছিলেন যে, তালালের হৃদয়ে তার পিতামাতার মাঝে কোন একজনের মৃত্যুর বিষয়ে গভীর শঙ্কা ছিল আর এর কারণ হলো, চাচা কাদের সাহেবের শাহাদাতের বিষয়টি সে জানত। এ বিষয়টি বলতে গিয়ে তালে’ কিছুটা গম্ভীর হয়ে যায় এবং কণ্ঠস্বর নামিয়ে কথা বলে। সেই স্বপ্নের বিষয়ে আমার স্মৃতি কিছুটা আবছা, কিন্তু তালের স্বপ্নের মূল বিষয় হলো, তালে’ বলে, আমি আমার সাথে শশুরের ন্যায় কোন ঘটনা ঘটার দাবি করি না, কিন্তু আমি এমন একটি স্বপ্ন দেখেছি যাতে অনুরূপ বিষয়ের উল্লেখ ছিল, অর্থাৎ অনুরূপ কোন ঘটনা ঘটবে। তালে’ স্বপ্নে দেখে, সে খোদ্দামুল আহমদীয়ার পোশাক পরিহিত এবং পতাকা হাতে জান্নাতে প্রবেশ করছে আর প্রত্যেকে তাকে তার শ্বশুরের নামে ডাকছে আর বলছে মির্যা গোলাম কাদের এসে গেছেন।
দ্বিতীয় স্বপ্ন তালে’র এক খুদে বার্তারূপে আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। যখন আমি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অসুস্থ ছিলাম তখন আমার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন ছিল। আমাকে কয়েক দফা হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। সেসময় তালে’ বারবার ফোন করে আমার খোঁজ-খবর নিতো এবং সান্ত¦না দিতো। তখন সে তার এক স্বপ্নের কথা আমাকে বলেছিল আর তা হলো, তালে’র মৃত্যুর পর তার বোনেরা জীবিত থাকবে। তালে বলে, কয়েক বছর পূর্বে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, “আমি জান্নাতে প্রবেশ করছি আর সেখানে আমার আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর উদ্দেশ্যে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমার মৃত্যুতে আমি খুবই আশ্চর্যান্বিত ও ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যে, কোথাও আমার ছোট বোনেরা না আবার আমার পূর্বে মৃত্যুবরণ করে। তাই আমি এদিক সেদিক তাকালাম কিন্তু তাদের মাঝে আমি আমার বোনদের কাউকে খুঁজে পেলাম না।” তিনি তার বোনকে বলেন, যদি আমার এ স্বপ্ন সত্যি হয় তবে তুমি কোন চিন্তা করো না। তাকে হাসপাতালে যেতে হতো আর ডাক্তাররাও অবস্থা সংকটাপন্ন বলে উল্লেখ করে, কিন্তু (তিনি বলেন,) চিন্তা করো না, যদি আমার এ স্বপ্ন সত্যি হয়, তবে চিন্তার কিছু নেই, তুমি ভালো হয়ে যাবে। খোদাতা’লার কৃপায় সে সুস্থ হয়ে যায়। তিনি বলেন, তালে’-র বুদ্ধিমত্তায়ও আমি গর্বিত। খিলাফতের প্রতিও তার অতুলনীয় ভালোবাসা ছিল।
তার সম্পর্কে তার ছোট বোন বলেন, তিনি উত্তম আদর্শ ছিলেন। তার কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়েছে। তিনি বলেন, যখন আমার বয়স তের বা চৌদ্দ বছর, তখন একদিন বাসায় তালে’ আমাকে তার প্রিয় সূরা তিলাওয়াত করে শুনানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি আমাকে সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করে শুনান। তিনি উত্তমরূপে ও সুললিত কন্ঠে তিলাওয়াত করেছিলেন। এটিও বলতেন যে, আমি খলীফাতুল মসীহ রাবে (রাহে.)-এর কুরআনের দরস নিয়মিত শুনি। তার কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতের সময় এ দরস তিনি শুনতেন। তিনি বলেন, একবার আমি তাকে একটি কৌতুক শুনিয়েছিলাম যাতে খ্রিষ্টধর্মের উল্লেখ ছিল আর খ্রিষ্টধর্ম নিয়ে কিছুটা বিদ্রুপ করা হয়েছিল। তখন তিনি আমাকে বলেন, কোন ধর্ম নিয়ে আমাদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা উচিত নয় নতুবা তারাও আমাদের ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে।
আবেদ ওয়াহিদ সাহেব, যিনি একাধারে কেন্দ্রীয় প্রেস সেক্রেটারী এবং তালে’-র মামা হন, তিনি বলেন, তালে’-র সাথে আমার বিশেষ আত্মীয়তা ছিল। শুধুমাত্র এক আত্মীয়তা নয়, বরং বহুমুখী আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। আমি সম্পর্কে তার মামা ছিলাম, কিন্তু আমাদের মাঝে বয়সের খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। সে ছিল আমার ছোট ভাই এবং বন্ধুর মতো। আমাদের বয়সের পার্থক্য ছিল কেবলমাত্র ৭ বছর। তিনি বলেন, আমি সর্বদা তালে’-র মাঝে এই বিষয়টি লক্ষ্য করেছি এবং অভিজ্ঞতা রাখি যে, সে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বংশধরদের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা রাখত। মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বংশের কোন সদস্য কোন ধরনের ভুল কাজ করলে অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হতো, কেননা এটি মসীহ্ মওউদ (আ.) এবং যুগ খলীফার জন্য দুর্নামের কারণ হয়ে থাকে। তাদের প্রতি ভালোবাসা অবশ্যই ছিল, কিন্তু কোনভাবেই অন্ধ ভালোবাসা ছিল না, তাই সে ব্যথিত হতো। তার সহ্য হতো না যে, খানদানের কোন সদস্য এমন কোন কাজ করবে যে কারণে মসীহ্ মাওউদ (আ.), তাঁর বংশধর এবং যুগ খলীফার বদনাম হবে। তিনি বলেন, অধিকাংশ সময় সে আমার সাথে এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করত এবং তার কন্ঠে সবসময় কষ্টের ছাপ স্পষ্ট বুঝা যেত। যদিও সে মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বংশধর হওয়ায় গর্বিত ছিল, কিন্তু এই সম্মানের কথা সে কখনো সবার সামনে বলে বেড়াতো না অথবা কোন ধরনের অবৈধ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করতো না। আর অনেকেই তাকে এ পরিচয়ে [অর্থাৎ হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর খানদানের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার বরাতে] চিনতোও না। তিনি বলেন, এম.টি.এ. সংবাদ বিভাগে কাজ শুরু করার কয়েক মাস পর তালে’ আমার কাছে আসে আর বলে, আমার মনে হচ্ছে এম.টি.এ. সংবাদ বিভাগকে এম.টি.এ.-তে খুবই সাধারণ একটি বিভাগ হিসেবে মনে করা হয়। এম.টি.এ. তে মানুষ সরাসরি বা নিজ আচরণের মাধ্যমে এই বিষয়টি ব্যক্ত করে যে, এম.টি.এ. সংবাদ বিভাগ এম.টি.এ.-র সবচেয়ে দুর্বল একটি বিভাগ। কিন্তু তালে’ এই দুর্বলতা দূর করাকে নিজের লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছিল। আর পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে বলত যে, ইনশাআল্লাহ্ যখন কাজ শেষ হবে তখন মানুষ এম.টি.এ. নিউজ অত্যন্ত আগ্রহের সাথে দেখবে আর বলবে যে, এম.টি.এ.তে এম.টি.এ. সংবাদ বিভাগের অনুষ্ঠানগুলো সবচেয়ে উন্নত মানের। এটি আমার চ্যালেঞ্জ আর আমি এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। এরপর তালে’ কিছু প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছে এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানও শুরু করেছে। তিনি বলেন, প্রামাণ্যচিত্র বানানোর প্রস্তুতির সময় আমি দেখেছি যে, সে প্রায়দিন ১৮ থেকে ১৯ ঘন্টা কাজ করত।
সাম্প্রতিক আফ্রিকা সফরে যাওয়ার জন্য মূলত আমি তাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল এম.টি.এ. সংবাদ বিভাগ আফ্রিকা গিয়ে যেন নুসরাত জাহান স্কীম সম্পর্কে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে। কর্মসূচী অনুযায়ী প্রথমে ঘানা এরপর সিয়েরালিওন আর অতঃপর গাম্বিয়া যাওয়ার কথা ছিল। সে নুসরাত জাহান স্কীমের ওপর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিল। আফ্রিকা যাওয়ার পূর্বে তালে’ পূরো যত্ন সহকারে সার্বিক প্রস্ততি নিয়েছিল। বিস্তারিত সফরসূচী তৈরি করে। পরিপূর্ণ কর্মসূচী তৈরি করে প্রতিদিনের কাজের তালিকা করে নিয়েছিল যাতে কোন সময় নষ্ট না হয়। সত্যিই সে অত্যন্ত সূচারুরূপে প্রস্তুতি নিয়েছিল। তিনি বলেন, অধিকাংশ সময় আমার আর তালে’-র মাঝে মতের অমিল হতো। তার সাথে তর্ক শুরু করার কয়েক মিনিটের মাথায় আমি হার মেনে নিতাম, কেননা আমি জানতাম আমি যতক্ষণ তার কথায় আস্থা না রাখব ততক্ষণ সে তর্ক অব্যাহত রাখবে, যুক্তি দিতে থাকবে। কিন্তু আমি তার মাঝে একটি বিষয় অবশ্যই দেখেছি। যখনই বলা হতো এটি যুগ খলীফার মতামত, তখন সে বলত হুযূরের মতামত আমার মতামত থেকে সামান্য ভিন্ন হলেও আমি আন্তরিকভাবে তা মেনে নিব যে, আমারই ভুল ছিল।
সে হযরত মির্যা বশীর আহমদ সাহেব (রা) সম্পর্কে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছিল। তখন তার এক কাযিন অর্থাৎ হযরত মির্যা বশির আহমদ সাহেবের প্রপৌত্রী তাকে বলেন, আব্বাজানের বিষয়ে খুব ভালো মানের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করো, কেননা তা প্রত্যেক দিন বানানো যায় না। তখন সে বলে যে, আমার মনে হয় ততটা ভালো হবে না, কেননা তা সরাসরি কোন খলীফার বিষয়ে নয়। কিন্তু আল্লাহ্ করুন এটা যেন মানুষ পছন্দ করে। অতএব, এই ছিল তার খিলাফতের সাথে সম্পর্কের মান।
মির্যা তালহা আহমদও লিখেছেন যে চৌধুরী জাফরুল্লাহ্ খান সাহেব (রা.)-কে নিয়েও একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করার পরিকল্পনা তার ছিল, যার জন্য সে আমাকেও কিছু কাজ দিয়েছিল এবং আল্লাহ্ তা’লার কৃপায় সে খুবই সুন্দর প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করত। স্ক্রিপ্ট লেখা ও গল্প বলার ক্ষেত্রেও তার খুব দক্ষতা ছিল।
আদম ওয়াকার সাহেব লিখেন, সম্ভবত আদম ওয়াকার সাহেবই হবেন; তিনি লিখেন, আমি তালে’কে শৈশব থেকেই চিনি, আমরা একসাথে খোদ্দামুল আহমদীয়ায় এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় প্রেস দপ্তর ও এম.টি.এ.-তে কাজ করেছি। এম.টি.এ.-র সাথে সংশ্লিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছি যে, তালে’ সবসময় অত্যন্ত সূক্ষ্মদৃষ্টিতে কাজ বিশ্লেষণ করতো, অনেক গভীরে গিয়ে বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতো। যদি তার মাথায় হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর বাণী প্রচার বা যুগ-খলীফার নির্দেশাবলী ও উপদেশ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া সংক্রান্ত কোন চিন্তার উদ্রেক হতো তাহলে নিঃসংকোচে আমার সাথে আলাপ করতো এবং নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতো। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে কীভাবে (আহমদীয়াতের) বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় তা নিয়ে ভাবতো। এই বিষয়টি থেকে বুঝা যায় যে, আপনার সব দিক-নির্দেশনা সে গভীরে গিয়ে অনুধাবন করতো, আর তারপর তা পালনের পুরো চেষ্টাও করতো। সর্বদা সত্যবাদীতাকে প্রাধান্য দিতো। যদি কোন পরামর্শ দেয়ার থাকতো বা নিজের অভিমত প্রকাশ করার থাকতো তবে সবসময় সততার সাথে বিষয় বর্ণনা করতো, ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলতো না। অন্য কর্মীদের সাথে কাজ করার ক্ষেত্রেও সর্বদা তাদেরকে সঠিক ফিডব্যাক প্রদান করতো।
নাসীম বাজওয়া সাহেব লিখেন, ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমি ব্র্যাডফোর্ডে মুবাল্লেগ হিসেবে দায়িত্বরত ছিলাম, সেই সময়ে হার্টলিপুল জামা’তেও যেতাম। তিনি বলেন, আমি তাকে তিফল হিসেবে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। সময়ানুবর্তী, আন্তরিক, বুদ্ধিমান, ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধি করতে আগ্রহী, ধীরে-স্থিরে নামায আদায়কারী, অনুগত, অতিথিপরায়ণ, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, যুগ-খলীফার প্রতি ভালোবাসা পোষণকারী ও তাঁর কথা গভীর আগ্রহে শ্রবণকারী, উত্তমরূপে দায়িত্ব পালনকারী, গভীর অভিনিবেশকারী, আল্লাহ্ তা’লার স্মরণে মগ্ন, সাগ্রহে তবলীগ সংক্রান্ত কাজে অংশগ্রহণকারী এবং সুললিত কণ্ঠে কুরআন শরীফ তিলাওয়াতকারী তিফল ছিল। পরবর্তীতে যৌবনে এসব বৈশিষ্ট্য আরও বিকশিতরূপে দৃষ্টিগোচর হয়।
মুবারাকা নো’মান নামে তার একজন কাযিন আছেন; তিনি বলেন, তালে’-র একটি গুণ যা আমি সবসময় অনুভব করেছি তা ছিল ওয়াকফে যিন্দেগী হিসেবে তার স্বল্পেতুষ্টি ও আড়ম্বরহীনতা। তার প্রতি খোদা তা’লার কৃপারাজির কথা বারংবার উল্লেখ করতো। কখনো তার মাঝে পার্থিব কোনপ্রকার লোভ দেখি নি, বরং যখন তার সামনে বৈষয়িক ব্যাপারে আলোচনা করা হতো তখন নিজের এক বিশেষ ভঙ্গিমায় হাসতো এবং আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতো যে, ওয়াকফ হওয়ার কারণে খোদা তা’লা তাকে এসমস্ত বিষয়ে ভ্রুক্ষেপহীন করে দিয়েছেন এবং তার যাবতীয় চাহিদা খোদা স্বয়ং পূরণ করেছেন। একজন খাঁটি ওয়াকফে যিন্দেগী ছিল।
তার একজন বন্ধু মুরব্বী নওশেরোয়ান রশীদ; বলেন, বিগত তিন বছর যাবৎ তালে’ ভাইয়ের সাথে আমি এম.টি.এ. বার্তাবিভাগে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এ তিন বছর তালে’ কেবল আমার সহকর্মী-ই ছিলেন না, বরং শিক্ষকও ছিলেন এবং তার চেয়েও বেশি বন্ধু ও ভাই ছিলেন। তিনি বলেন, আমি এই তিন বছর সময়ে তালে’কে নিয়মিত বৃহস্পতিবার রোযা রাখতে দেখেছি; পাঁচবেলার নামাযের বিষয়ে তাকে খুবই সচেতন পেয়েছি। নির্ধারিত সময়ের পূর্বে মসজিদে যেতেন এবং আমি এ-ও দেখেছি যে, সময়ের পূর্বেই চাঁদা প্রদান করতেন। যাহোক, এমন ঘটনা তো অনেক রয়েছে এবং অনেক মানুষ লিখেছে, কিন্তু সময়-স্বল্পতার কারণে কয়েকটিমাত্র আমি বর্ণনা করলাম।
মহানবী (সা.) এবং হযরত মসীহ্ মওউদ (আ.)-এর দৈহিক এবং আধ্যাত্মিক বংশধর হওয়ার যে দায়িত্ব বর্তায়- তা তিনি যথাযথভাবে পালন করেছেন। আল্লাহ্ তা’লাও তাকে এত উত্তমভাবে গ্রহণ করেছেন যে, মুহাররম মাসে তাকে কুরবানীর জন্য মনোনীত করেছেন। ওয়াকফে জীন্দেগী হিসেবে এক হীরা ছিলেন। আল্লাহ্ তা’লা ক্রমাগতভাবে তার মর্যাদা উন্নীত করুন। আমি আশা করি, আল্লাহ্ তা’লা তাকে মহানবী (সা.)-এর পদতলে আশ্রয় দিয়ে থাকবেন। বরং কেউ একজন তার মৃত্যুর পর স্বপ্নও দেখেছে যে, মহানবী (সা.) এক স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন আর তালে’ দৌড়ে গিয়ে তাঁকে (সা.) জড়িয়ে ধরে আর মহানবী (সা.)ও তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন আস আমার পুত্র, সুস্বাগতম। অতএব কতইনা সৌভাগ্যশালী সে যে ধর্মের জন্য জীবন উৎসর্গ করে এই মর্যাদা লাভ করে। আল্লাহ্ তা’লা তার স্ত্রী-সন্তানদের হাফেজ ও নাসের হোন এবং তাদেরকে ধৈর্য্য ও মনোবল দান করুন। তার পিতামাতা এবং ভাই-বোনদেরকেও ধৈর্য্য-শক্তি দিন আর তার ভাই-বোনদেরকে এবং তার সন্তানদেরকেও তার পুণ্যকর্মগুলোকে অব্যাহত রাখার তৌফিক দান করুন।
নামাযের পর ইনশাআল্লাহ্ আজ তার জানাযার নামায হবে, তার শবদেহ এসে গেছে।