শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হযরত উমর (রা.) ১ অক্টোবর জুমুআর খুতবা

যুক্তরাজ্যের (টিলফোর্ড, সারেস্থ) ইসলামাবাদের মুবারক মসজিদে প্রদত্ত সৈয়্যদনা আমীরুল মু’মিনীন হযরত মির্যা মসরূর আহমদ খলীফাতুল মসীহ্ আল্ খামেস (আই.)-এর ০১ অক্টোবর, ২০২১ মোতাবেক ০১ ইখা, ১৪০০ হিজরী শামসী’র জুমুআর খুতবা

তাশাহ্হুদ, তা’ঊয এবং সূরা ফাতিহা পাঠের পর হুযূর আনোয়ার (আই.) বলেন:
হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) কোন এক উপলক্ষে এক বক্তৃতায় তবলীগ সংক্রান্ত বিষয় উপস্থাপন করছিলেন তখন হযরত উমর (রা.)-এর যুগের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে বলেন,
মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর যেসব যুদ্ধ-বিগ্রহ সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশের মাঝে মুসলমানদের সৈন্যসংখ্যা কম থাকত। সিরিয়ার যুদ্ধে বেশ সেনাসংকট ছিল। হযরত আবু উবায়দা হযরত উমর (রা.)-কে লিখেন, শত্রুরা সংখ্যায় অনেক বেশি তাই আরো সৈন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। হযরত উমর (রা.) নিরীক্ষা করে দেখলেন নতুনভাবে সৈন্য ভর্তি করা অসম্ভব কেননা আরবের আশপাশের গোত্রগুলোর যুবকরা হয় নিহত হয়ে গিয়েছিল কিম্বা তাদের সবাই পূর্বেই সেনাবাহিনীতে ছিল। তিনি (রা.) পরামর্শের জন্য একটি সভার আয়োজন করেন এবং এ সভায় বিভিন্ন গোত্রের লোকদের আহবান জানিয়ে তাদের সামনে উক্ত বিষয়টি উপস্থাপন করেন। তারা বলে, একটি এমন গোত্র আছে যেখানে কিছু লোক পাওয়া যেতে পারে। হযরত উমর (রা.) একজন কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিকভাবে সেই গোত্রের যুবকদের একত্র করার নির্দেশ দেন। আর হযরত আবু উবায়দাকে লিখে পাঠান, তোমার সাহায্যে আমি ছয় হাজার সৈন্য পাঠাচ্ছি। এই সৈন্যবাহিনী কিছুদিনের মধ্যেই তোমার কাছে পৌঁছে যাবে। এর মাঝে তিন হাজার লোক ওমুক ওমুক গোত্র থেকে তোমার কাছে যাবে এবং অবশিষ্ট তিন হাজারের সমান আমর বিন মা’দী কারবকে পাঠাচ্ছি।
হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) বলেন, আমাদের কোন যুবককে যদি তিন হাজার লোকের মোকাবিলায় পাঠানো হয় তাহলে সে বলবে, এ কেমন কাণ্ড জ্ঞান বিবর্জিত কথা!! খলীফার কি বিবেক লোপ পেয়েছে? একজন কি তিন হাজার লোকের মোকাবিলা করতে পারে! কিন্তু লক্ষ্য করুন, তাদের ঈমান কত দৃঢ় ছিল! হযরত আবু উবায়দা হযরত উমর (রা.)-এর পত্র পেয়ে তিনি উক্ত পত্র পাঠ করে সৈন্যদের বলেন, তোমরা আনন্দিত হয়ে যাও কাল আমর বিন মা’দী কারেব তোমাদের কাছে পৌঁছে যাবেন। সৈন্যরা পরদিন অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে আমর বিন মা’দী কারবকে স্বাগত জানায় এবং নারা উচ্চকিত করে। শত্রæরা মনে করে, মুসলমানদের সাহায্যের জন্য হয়তো এক লক্ষ বা দুই লক্ষ সৈন্য এসেছে আর একারণেই মুসলমানরা এত উদ্দীপ্ত। অথচ একা হযরত আমর বিন মা’দী কারব এসেছিলেন। অনন্তর সেই তিন হাজার সৈন্যও পৌঁছে যায় আর মুসলমানরা শত্রæদের পরাস্ত করে অথচ তরবারির যুদ্ধে একজন মানুষ তিন হাজার লোকের মোকাবিলা কিভাবে করতে পারে! তিনি বলেন, বাকযুদ্ধে একজন মানুষ কয়েক হাজার লোকের কাছে নিজের কথা পৌঁছাতে পারে কিন্তু তারা যুগ খলীফার কথাকে এতটাই গুরুত্ব দিত যে, হযরত উমর (রা.) আমর বিন মা’দী কারবকে তিন হাজার সৈন্যের স্থলাভিষিক্ত করে পাঠালে সৈন্যরা এই আপত্তি উত্থাপন করে নি যে, একা একব্যক্তি কীভাবে তিন হাজার লোকের মোকাবিলা করতে পারে। এই আপত্তি না করে তারা তাকে তিন হাজার লোকের সমতুল্যই জ্ঞান করেছে এবং অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণভাবে তাকে স্বাগত জানায়। এভাবে স্বাগত জানানোর ফলে শত্রæদের মন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে আর তারা মনে করে যে, সম্ভবত লক্ষ দুই লক্ষ সৈন্য মুসলমানদের সাহায্যের জন্য এসে গেছে। একারণেই যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের পা হড়কে যায় আর তারা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। তিনি (রা.) বলেন, আমাদেরও আপাতত এভাবেই নিজেদের মনকে আশ^স্ত করতে হবে।
ইউরোপের স্পেন ও সিসিলী প্রভৃতি স্থানে তবলীগের পন্থা সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি (রা.) এ ঘটনা বর্ণনা করেন।
এখন মিশরের বিভিন্ন অঞ্চল জয়ের উল্লেখ করবো। এর মধ্যে একটি যুদ্ধের নাম ছিল ফারামার যুদ্ধ। ফারামা মিশরের একটি প্রসিদ্ধ শহর ছিল। এটি ভূমধ্যসাগর ও পালুজির (মুখের) নিকটবর্তী এক পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল, যা নীল নদের শাখাগুলির একটি শাখা। আল্লামা শিবলী নোমানীর মতে, বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের পর হযরত আমর বিন আসের অনুরোধে হযরত উমর (রা) হযরত আমর বিন আসকে চার হাজার সৈন্যসহ মিশর অভিমুখে প্রেরণ করেন, কিন্তু একই সাথে এ নির্দেশও দেন, যদি মিশর পৌঁছার পূর্বে আমার পত্র হস্তগত হয় তবে ফেরত চলে আসবে। কাফেলা আরিশ পৌঁছলে, হযরত উমরের পত্র হস্তগত হয়। তাতে সামনে অগ্রসর হবার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, যেহেতু নির্দেশনা শর্তযুক্ত ছিল তাই হযরত আমর বলেন, এখন আমরা মিশরের সীমান্তে এসে গিয়েছি তাই তিনি আরিশ থেকে অগ্রসর হয়ে ফারামা পৌঁছান।
ইসলামী যুদ্ধ-সম্বলিত একটি গ্রন্থ রয়েছে, এর নাম হলো আল ইকতাফা। তাতে লিখা আছে, যখন হযরত আমর বিন আস রাফা নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন তিনি হযরত উমরের পত্র পান। কিন্তু তিনি এই আশঙ্কায় যে পত্রে ফিরে যাবার নির্দেশ থাকতে পারে যেমনটি হযরত উমর পূর্বেই বলেছিলেন- দূতের কাছ থেকে সেই পত্র গ্রহণ করেন নি আর যাত্রা অব্যহত রাখেন, এমনকি রাফা ও আরিশের মধ্যবর্তী একটি ছোট্ট গ্রামে পৌঁছলেন এবং এ স্থানের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। বলা হল, এটি মিশরের সীমানার অন্তর্গত এলাকা। এরপর তিনি পত্র আনিয়ে তা পাঠ করলেন। তাতে লিখা ছিল, পত্র পাওয়া মাত্রই আপনি মুসলিম সৈন্যদের নিয়ে ফিরে আসুন। এতে তিনি তার সঙ্গীদের বললেন, আপনারা কী জানেন না এটি মিশরের অন্তর্ভুক্ত এলাকা? তারা বলল: হ্যাঁ, ঠিক তাই। তিনি বললেন, আমিরুল মু’মিনীনের নির্দেশ হলো, যদি তার পত্র মিশরীয় সীমান্ত শুরুর পূর্বেই আমি পাই, তবে যেন ফেরত চলে যাই। কিন্তু এই পত্র আমি মিশরে প্রবেশের পর পেয়েছি তাই এখন আল্লাহ্র নামে এগিয়ে চল। অপর এক রেওয়ায়েতে এটিও বলা হয় যে, হযরত আমর বিন আস ফিলিস্তিনে ছিলেন। আর তিনি অনুমতি ছাড়াই তার সঙ্গীদের নিয়ে মিশরে চলে গিয়েছিলেন। এ বিষয়টি হযরত উমর পছন্দ করেন নি। হযরত উমর তাকে পত্র লিখেন। হযরত উমরের পত্র হযরত আমর সেই সময় পান যখন তিনি আরিশের নিকটবর্তী ছিলেন। কিন্তু আরিশ পৌঁছার আগ পর্যন্ত তিনি সেই পত্র পাঠ করেন নি। আরিশ পৌঁছে পত্র পাঠ করেন। তাতে লিখা ছিল, উমর বিন খাত্তাবের পক্ষ থেকে আমর বিন আসের নামে। আম্মা বাদ, তুমি তোমার সাথীদের সাথে মিশরে গিয়েছ আর সেখানে রোমানদের এক বিশাল বাহিনী আছে। আর তোমার সাথে খুব কম সংখ্যক সৈন্যবাহিনী আছে। আমার জীবনের কসম, আল্লাহ্ তোমার মঙ্গল করুন। খুব ভালো হত, যদি তুমি তাদেরকে তোমার সাথে না নিয়ে যেতে। তুমি যদি মিশরে না পৌঁছে থাক তবে ফিরে আস। এ সফরে ফারামার পূর্বে মুসলিম সেনাবাহিনী কোথাও রোমান বাহিনীর মুখোমুখি হয় নি। মিশরীয়রা বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের স্বাগতম জানিয়েছে। সর্বপ্রথম ফারামাতে দুই বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হয়। এই বর্ণনাই সঠিক বলে মনে হয় যে, আরিশ অর্থাৎ মিশরের সীমান্তে পৌঁছার পর তিনি পত্র পেয়ে থাকবেন। এটি হতে পারে না যে, অজুহাত দাঁড় করানোর জন্য মিশরের সীমান্তে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিলেন। যাহোক যখন তারা মিশর পৌঁছল তখন সামনেই অগ্রসর হতেই হত, কেননা মু’মিন পিছপা হয় না। রোমানরা এ সংবাদ পেয়ে যে, হযরত আমরের সাথে আগত সৈন্য সংখ্যা নিতান্তই কম এবং তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি খুবই দুর্বল, তাই তারা দীর্ঘদিন অবরোধ টিকিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা সংখ্যায় তাদের চেয়ে অনেক বেশি আর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছি তাই তাদের পিছু হটাতে বা পরাস্ত করতে সক্ষম হবো। এ ভেবে রোমানরা দুর্গবন্দী হয়ে যায়। অন্যদিকে হযরত আমর বিন আস রোমান সেনাবাহিনীর শক্তি-সামর্থ সম্পর্কে জানতে পারেন যে, তারা অস্ত্র ও সৈন্যরা সংখ্যায় মুসলমানদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি শক্তিশালী। তাই তিনি ফারামার দখল করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেন যে, অতর্কিতে আক্রমণ করে দুর্গের ফটক খুলে দিতে হবে অথবা সে সময় পর্যন্ত ধৈর্য সহকারে অবরোধ অব্যহত রাখতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না শহরবাসীর খাবার সামগ্রী ফুরিয়ে যায় আর তারা ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বেরিয়ে না আসে। সুতরাং তিনি অবরোধ করেন। এদিকে মুসলমানদের অবরোধ ক্রমশ কঠোর হচ্ছিল আর অন্যদিকে রোমানরাও নিজেদের অবস্থানে অনড় ছিল। এভাবে অবরোধ কয়েক মাস চলতে থাকে। কখনো কতক রোমান সৈন্য বাইরে আসলে ক্ষুদ্র বা খন্ড লড়াই করে পেছনে সরে যেতো। এই ক্ষুদ্র যুদ্ধগুলোতে মুসলমানরাই জয়ী হত। একদিন রোমান সেনাবাহিনীর একটি দল গ্রাম থেকে বাইরে বের হয়ে মুসলমানদের সাথে লড়াই করতে আসে, প্রতিদ্ব›িদ্বতায় মুসলমানরা জয় লাভ করে এবং রোমানরা পরাজিত হয়ে গ্রামের দিকে ছুটতে থাকে। মুসলমানরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে এবং দৌড়ে দ্রুত তার সাক্ষর রাখে এবং রোমানদের দরজায় পৌঁছার পূর্বেই কিছু মুসলমান ফটকে পৌঁছে যায়। সেখানে পৌঁছে দুর্গের ফটক খুলে দেয় এবং মহান বিজয়ের পথ উন্মোচন করে।
বিলবিসের বিজয় কিভাবে হয়েছিল? ফারামার পর হযরত আমর বিন আস বিলবিস অভিমুখে যাত্রা করলে রোমান সেনাবাহিনী তাঁর পথে বাধা সৃষ্টি করে। বিলবিস ফুসতাত থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরে সিরিয়ার পথে অবস্থিত একটি শহর। রোমানরা পথ অবরোধ করে যেন মুসলমানরা বেবিলনের দুর্গ পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে। প্রাচীন অভিধানে বেবিলন নামটি মিশরের এলাকার জন্য ব্যবহৃত হত। বিশেষভাবে যেখানে ফুসতাত জনবসতি গড়ে উঠেছিল এটিকে পূর্বে বেবিলন বলা হত। রোমান সেনাবাহিনী এখানেই লড়াই করতে চাইত, কিন্তু হযরত আমর বিন আস তাদেরকে বলেন, তোমরা তাড়াহুড়া করে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না যতক্ষণ আমরা আমাদের কথা তোমাদের কাছে উপস্থাপন না করি যেন ভবিষ্যতে মনস্তাপ ও আক্ষেপ করতে না হয়। এরপর বলেন, তোমরা নিজেদের পক্ষ থেকে আমার কাছে আবু মরিয়ম এবং আবু মারিয়ামকে দূত হিসাবে প্রেরণ কর। সুতরাং তারা লড়াই করা থেকে বিরত হয় এবং দূতদ্বয়কে প্রেরণ করে। এই উভয় দূত বিলবিসের খ্রিষ্টান যাজক ছিল। হযরত আমর তাদের সামনে হয় ইসলাম গ্রহণ কিংবা জিযিয়া কর প্রদানের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এবং একইসাথে মিশরীয়দের সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর এই উক্তিও শুনালেন যে, তুমি মিশর জয় করবে। সেটি এমন এক শহর যেখানে কিরাতের প্রচলন রয়েছে। সুতরাং যখন তুমি সে দেশ জয় করবে সে দেশের অধিবাসীদের সাথে দয়াদ্র আচরণ করবে কেননা তাদের প্রতি দায়িত্ব ও আত্মীয়তা রয়েছে। অথবা তিনি (সা.) বলেন, দায়িত্বশীলতা এবং শশুরপক্ষীয় আত্মীয়তা রয়েছে। উভয় দূত এ কথা শুনে বলল, এটি অনেক দূরের সম্পর্ক। তাকে নবীগণই পূর্ণ করতে পারেন। আমাদেরকে যেতে দাও, আমরা ফিরে এসে বলছি। হযরত আমর বিন আস বলেন, আমার মত ব্যক্তিকে ধোঁকা দেয়া সম্ভব নয়। আমি তোমাদেরকে তিন দিনের সুযোগ দিচ্ছি। তোমরা ভালভাবে বিষয়টি ভেবে দেখ। উভয় দূত বলল, আরো একদিনের অতিরিক্ত সময় দিন। তিনি তাদেরকে আরো একদিনের সময় দিলেন। উভয় দূত ফিরে এসে কিবতী সর্দার মুকাওকিস এবং রোমান কর্মকর্তার মিশরের শাসক আরতাবুনের কাছে আসে এবং মুসলমানদের প্রস্তাব তাদের সামনে উপস্থাপন করে। আরতাবুন মানতে অস্বীকার করে এবং যুদ্ধের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রাতারাতি মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে বসে। আরতাবুনের সৈন্যসংখ্যা ১২ হাজার বলা হয়ে থাকে। মুসলমানদের একটি বড় সংখ্যক সেনা এই যুদ্ধে শহীদ হন এবং রোমানদের এক হাজার সেনা নিহত হয় এবং তিন হাজার সেনা বন্দী হয় এবং আরতাবুন রণক্ষেত্র ছেড়ে পলায়ন করে আর কেউ কেউ বলে যে, সে এই যুদ্ধেই মারা গেছে। মুসলমানরা তাকে তার সেনাবাহিনীসহ আলেকজান্দ্রীয়া পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করে। ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত যে, মুসলমানরা বিলবিসে এক মাস পর্যন্ত অবস্থান করেছিল। সেই সময় যুদ্ধ অব্যহত থাকে এবং পরিশেষে মুসলমানরা বিজয়ী হয়, এই যুদ্ধটি ভয়াবহ না কি সামান্য সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
এই যুদ্ধ চলাকালে একটি এমন ঘটনা ঘটে যা মুসলমানদের বিচক্ষণতা এবং উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাক্ষ্য বহন করে। ঘটনা হল, বিলবিসে আল্লাহ্ তা’লা যখন মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেন তখন এতে মুকাওকিসের কন্যা বন্দী হয় যার নাম আরমানুসা ছিল। সে তার পিতার প্রিয়তমা কন্যা ছিল। তার পিতা হিরাক্লিয়াসের পুত্র কনস্টান্টাইনের সাথে তার বিয়ে দিতে চাইত। কিন্তু সে এই বিয়েতে সম্মত ছিল না, তাই সে তার সেবিকার সাথে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বিলবিস এসেছিল। যাহোক, মুসলমানরা তাকে গ্রেফতার করলে হযরত আমর বিন আস (রা.) সকল সম্মানিত সাহাবীদের নিয়ে একটি বৈঠক ডাকেন এবং সেখানে তিনি আল্লাহ্ তা’লার এ বাণী পড়ে শোনান, هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ অর্থাৎ, অনুগ্রহের প্রতিদান কি অনুগ্রহ ব্যতীত আর কিছু হতে পারে? পুনরায় এ আয়াত هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, মুকাওকিস আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর সমীপে উপহার সামগ্রী পাঠিয়ে ছিলেন। আমার মতে এই মেয়ে এবং তার সাথে যেসব মহিলা ও তার সেবিকারা রয়েছে আর যেসমস্ত ধনসম্পত্তি আমরা পেয়েছি সেই সবকিছু মুকাওকিসের কাছে পাঠিয়ে দিব। সবাই আমর বিন আস (রা.)-এর মতামত সঠিক আখ্যা দেয়। এরপর হযরত আমর বিন আস (রা.) মুকাওকিসের কন্যা আরমানুসাকে তার সকল অলঙ্কারাদি, অন্যান্য মহিলা এবং সকল সেবিকাসহ অত্যন্ত সম্মানের সাথে তার পিতার কাছে পাঠিয়ে দেন। ফেরার সময় আরমানুসার দাসী তাকে বলে, আমরা সব দিক থেকে আরবদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। উত্তরে আরমানুসা বলে, আরব তাবুতে আমি আমার জীবন ও সম্মানকে সুরক্ষিত মনে করি কিন্তু আমার পিতার দুর্গে নিজ জীবনকে সুরক্ষিত মনে করি না। এরপর সে তার পিতার নিকট পৌঁছলে তার সাথে মুসলমানদের আচরণ দেখে সে (তার পিতা) খুব আনন্দিত হয়।
এরপর উম্দুনায়েন’ এর বিজয়ের উল্লেখ রয়েছে। বিলবিসের বিজয়ের পর হযরত আমর বিন আস (রা.) মরুভ‚মির সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে উম্দুনায়েন জনপদের নিকট গিয়ে পৌঁছেন যা নীল নদের তীরে তিরাজান উপসাগরের উৎপত্তিস্থলের কাছে অবস্থিত। এ উপসাগরটি সুয়েজ খালের নিকট মিশর শহরকে ভূমধ্যসাগরের সাথে যুক্ত করত। বর্তমানে যেখানে কায়রোর মহল্লা আযবুকিয়া সেখানেই সে যুগে উম্দুনায়েনের জনপদ ছিল আর যেটিকে রোমানরা দুর্গাবদ্ধ করে রেখেছিল। এর নিকটে নীল নদের ঘাট ছিল আর সেই ঘাটে অনেক নৌকা নোঙ্গর করা থাকত। এই জনপদ ব্যাবিলনের উত্তরে ছিল যা মিশর শহরের সবচেয়ে বড় দুর্গ ছিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে উম্দুনায়েনকে যা মিশরীয়দের সেসব প্রিয় অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল যেগুলো অতীতে ফেরাউনের রাজধানীও ছিল, সর্বপ্রথম প্রতিরক্ষা চৌকি বলা যেতে পারে। উম্দুনায়েনের কাছে গিয়ে মুসলমানেরা শিবির স্থাপন করে। রোমানরা ব্যাবিলনের দুর্গে তাদের সর্বোত্তম সৈন্যদের পৌঁছে দিয়েছিল আর উম্দুনায়েন দুর্গকে খুব ভালোভাবে সুদৃঢ় করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। গোয়েন্দা খবরের ভিত্তিতে হযরত আমর বিন আস (রা.) বুঝতে পেরেছেন যে, তার বাহিনী ব্যাবিলনের দুর্গ বিজয় বা অবরোধের জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি (রা.) একজন দূতের হাতে একটি পত্র মদিনায় প্রেরণ করেন আর তাতে তার মিশর সফরের বিবরণ, দুর্গের বিস্তারিত বিবরণ এবং তাদেরকে আক্রমণ করার জন্য সহায়ক-সৈন্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। এদিকে সেনাবাহিনীর মাঝে ঘোষণা করিয়ে দেন, খুব শীঘ্রই সহায়ক-সৈন্য পৌঁছে যাবে। এরপর উম্দুনায়েন অভিমুখে অগ্রসর হন এবং একে অবরোধ করে দুর্গের ভিতরে খাদ্যসামগ্রী ও সামরিক সাজসরঞ্জাম যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেন। ব্যাবিলনের দুর্গে যেসব রোমান অবস্থান করছিল তারা এদিকে আসার চেষ্টা করে নি। কেননা তারা বিলবিসে র্আতাবুনের পরিণতি প্রত্যক্ষ করেছিল আর তারা জানত যে, আরবদের সাথে খোলা মাঠে যুদ্ধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও উম্দুনায়েনের সৈন্যরা কখনো কখনো বের হত এবং ব্যর্থ আক্রমণের পর ফিরে যেত। এভাবে বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে যায়। ইত্যবসরে খিলাফতের দরবার থেকে সংবাদ আসে, প্রথম সহায়ক সেনাদল প্রেরণ করা হয়েছে আর তারা আজ কালের মধ্যে পৌঁছে যাবে। এ সংবাদ পাওয়ার পর মুসলমানদের শক্তি ও সাহস আরো বৃদ্ধি পেয়ে যায়। হযরত উমর (রা.) মুসলমান সেনাবাহিনীকে সাহায্যের জন্য ৪০০০ সৈন্য প্রেরণ করেন। হযরত উমর (রা.) প্রতি এক হাজার সৈন্যের জন্য একজন আমীর নিযুক্ত করেন। এসব আমীর ছিলেন, হযরত জুবায়ের বিনুল আওয়াম, হযরত মিকদাদ বিন আসওয়াদ, হযরত উবাদা বিন সামেত এবং হযরত মাসলেমা বিন মাখাল্লেদ (রা.)।
এক ভাষ্য অনুসারে হযরত মাসলামা বিন মুখাল্লেদ (রা.)-এর স্থলে খারযা বিন হুযাফা আমীর ছিলেন। হযরত উমর (রা.) এই সহায়ক-সৈন্যদল প্রেরণের পাশাপাশি হযরত আমর বিন আস (রা.)-কে পত্র লিখেন, এখন তোমার সাথে ১২,০০০ মুসলিম যোদ্ধা রয়েছে। সংখ্যা-স্বল্পতার কারণে এ সংখ্যা কখনো পরাজিত হবে না। রোমান যোদ্ধারা কিবতী সৈন্যদের সাথে নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বের হয়। উভয় বাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। হযরত আমর বিন আস (রা.) সমরকৌশল হিসেবে নিজ সেনাদলকে তিন ভাগে বিভক্ত করেন। একাংশকে জাবালে আহমারের নিকট একটি স্থানে নিযুক্ত করেন, দ্বিতীয় অংশকে উম্দুনায়েনের নিকট নীল নদের তীরে একটি স্থানে মোতায়েন করেন এবং অবশিষ্ট সৈন্যদল নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য বের হন। উভয় সেনাদলের মধ্যে যখন তুমুল যুদ্ধ হচ্ছিল তখন জাবালে আহমার-এ লুকিয়ে থাকা সৈন্যবাহিনী বের হয়ে পিছন থেকে আক্রমণ করে, যার ফলে শত্রু দলের সামরিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে আর তারা উম্দুনায়েনের দিকে পলায়ন করে। সেখানে মুসলিম সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় অংশ প্রস্তুত ছিল, তারা তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। এভাবে রোমান সৈন্যরা মুসলমানদের তিন সৈন্যদলের মাঝখানে ফেঁসে যায় এবং শত্রুরা পরাজিত হয়।
বিবিধ বিজয় সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে যে, উম্দুনায়েন বিজয়ের পর হযরত আমর বিন আস (রা.) সর্বপ্রথম ‘ফাইউম’ এলাকায় জয় লাভ করেন আর এ অঞ্চলের নেতা এই যুদ্ধে নিহত হয়। এরপর ‘আইনুশ্ শামস’- এ রোমানদের সাথে মুসলমানদের লড়াই হয়। এর পূর্বে ৮,০০০ সৈন্য সম্বলিত এক সাহায্যকারী সৈন্যদল হযরত আমর বিন আস (রা.)-এর সাথে গিয়ে যুক্ত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন হযরত যুবায়ের বিন আওয়াম (রা.) আর এতে হযরত উবাদাহ্ বিন সামেত, হযরত মিক্বদাদ বিন আসওয়াদ ও মাসলামা বিন মুখাল্লাদ (রা.) প্রমুখও ছিলেন। এ যুদ্ধেও মুসলমানরা বিজয় লাভ করে। এরপর মুসলমানরা সমগ্র ‘ফাইউম’ প্রদেশে বিজয় লাভ করে। মুসলমান সৈন্যবাহিনীর একটি অংশ ‘মনুফিয়া’ প্রদেশের দুই শহর ‘ইসরীব’ ও ‘মানুফ’ বিজয় লাভ করে। ব্যাবিলন দুর্গের যুদ্ধ বা ‘ফুসতাত’ বিজয় সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আমর বিন আস (রা.) উম্দুনায়েন বিজয়ের পর ব্যাবিলন দুর্গের দিকে অগ্রসর হন এবং কঠোর অবরোধ করেন।
এই অঞ্চলের নাম ফুসতাত। এমন নামকরণের কারণ হলো আরবী ভাষায় তাবু-কে ফুসতাত বলা হয়। দুর্গ জয়ের পর হযরত আমর বিন আস (রা.) যখন এখান থেকে যাত্রা করার নির্দেশ দেন তখন কাকতালীয়ভাবে হযরত আমর (রা.)-এর তাবুতে একটি কবুতর এসে বাসা বাঁধে। এটি দেখার পর তিনি (রা.) নির্দেশ দেন, এই তাবুটি এখানেই থাকতে দাও। পরবর্তীতে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ফিরে আসার পর হযরত আমর (রা.) এই তাবুর নিকটেই শহর গড়ে তুলেন। এজন্য এই শহর ফুসতাত নামে পরিচিতি লাভ করে। দুর্গে আনুমানিক ৫-৬ হাজার প্রতিরক্ষা সৈন্য ছিল আর তারা সব দিক থেকে সশস্ত্র ছিল। হযরত আমর (রা.) ব্যাবিলনের দুর্গ অবরোধ করেন। আলেকজান্দ্রিয়ার পর এটি ছিল খুবই মজবুত এবং পাকা ইট দিয়ে নির্মিত একটি দুর্গ আর চতুর্দিক থেকে নীল নদের পানি দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। এটি যেহেতু নীল নদের তীরেই অবস্থিত ছিল আর জাহাজ ও নৌকা দুর্গের ফটকে এসে ভিড়ত, তাই সরকারী প্রয়োজনীয়তা পূরণের নিরিখে খুবই উপযুক্ত একটি স্থান ছিল। আরবরা মজবুত এই দুর্গে আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রসস্ত্রে সুসজ্জিত ছিল না আর না তারা এর জন্য প্রস্তুতও। হযরত আমর (রা.) প্রথমে এটি অবরোধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মিশরের শাসক মুকাওকিস হযরত আমর বিন আস (রা.)-এর আগমনের পূর্বেই দুর্গে পৌঁছে গিয়েছিল এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। হযরত যুবায়ের (রা.) ঘোড়ায় চড়ে পরিখার চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং যেখানে যেমন প্রয়োজন ছিল উপযুক্ত সংখ্যক অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য মোতায়েন করেন। জয়-পরাজয় কোন প্রকার ফলাফল ছাড়াই দুর্গটি টানা সাত মাস অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। সেই সময়ের ভেতর রোমান সৈন্যরা কখনো কখনো দুর্গের বাইরে এসে যুদ্ধ করতো, কিন্তু আবার ফিরে যেত। ঐ দিনগুলোতে মুকাওকিস কখনো কখনো সমঝোতার উদ্দেশ্যে, আবার কখনো হুমকি দেয়ার জন্য হযরত আমর বিন আস (রা.)-এর নিকট দূতদের প্রেরণ করতো।
হযরত আমর বিন আস (রা.) হযরত উবাদা বিন সামেত (রা.)-কে প্রেরণ করেন এবং সমঝোতা করার জন্য কেবল তিনটি শর্ত আরোপ করে দেন হয় ইসলাম গ্রহণ কর কিংবা জিযিয়া প্রদান কর নতুবা যুদ্ধ হবে। তিনি (রা.) বলে দেন, এগুলো ছাড়া অন্য কোন শর্তে সন্ধি হবে না। মুকাওকিস জিযিয়া প্রদানে সম্মত হয় এবং এ বিষয়ে হিরাক্লিয়াসের কাছে অনুমতি চাইতে নিজেই হিরাক্লিয়াসের কাছে যায়। কিন্তু হিরাক্লিয়াস তা প্রত্যাখ্যান করে, বরং মুকাওকিসের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হয় এবং তাকে শাস্তিস্বরূপ দেশান্তরিত করিয়ে দেয়। ব্যাবিলন দুর্গ জয় যখন বিলম্বিত হয় তখন হযরত যুবায়ের বিন আওয়াম (রা.) বলেন, এখন আমি আমার প্রাণ আল্লাহ্র পথে উৎসর্গ করতে যাচ্ছি। আমি আশা করি, আল্লাহ্ তা’লা এর মাধ্যমেই মুসলমানদেরকে বিজয় দান করবেন। একথা বলেই তিনি নগ্ন তরবারি হাতে নেন এবং মই লাগিয়ে দুর্গের প্রাচীরের ওপর আরোহন করেন। গুটিকতক অন্য সাহাবীও তার সাথে যান। প্রাচীরের ওপর উঠে সমস্বরে সবাই ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চকিত করেন আর একইসাথে পুরো মুসলিম বাহিনীও তকবির ধ্বনি উচ্চকতি করে, যার ফলে দুর্গের মাটি কেঁপে ওঠে। খ্রিষ্টানরা বুঝতে পারে, মুসলমানরা দুর্গের ভেতর ঢুকে পড়েছে। তখন তারা দিশেহারা হয়ে পালাতে থাকে আর হযরত যুবায়ের (রা.) প্রাচীর থেকে নেমে দুর্গের ফটক খুলে দেন এবং পুরো বাহিনী ভেতরে ঢুকে পড়ে আর লড়াই করতে করতে দুর্গ জয় করে নেয়। হযরত আমর বিন আস (রা.) তাদেরকে এই শর্তে নিরাপত্তা প্রদান করেন যে, রোমান সেনা নিজেদের সাথে কয়েক দিনের রসদ নিয়ে এখান থেকে চলে যাবে এবং ব্যাবিলন দুর্গে যে ধনসম্পদ ও সমরাস্ত্র রয়েছে তাতে হাত দেবে না, কেননা এগুলো মুসলমানদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ। এরপর হযরত আমর বিন আস (রা.) ব্যাবিলন দুর্গের গম্বুজ এবং উঁচু ও দৃঢ় প্রাচীরগুলো গুঁড়িয়ে দেন। ব্যাবিলন দুর্গ জয়ের পর মুসলিম বাহিনী মিশরের বিভিন্ন অঞ্চল ও দুর্গ জয় করে, যার মধ্যে তারনুত, নাকিউস, সুলতায়েস, কিরিয়োন প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আলেকজান্দ্রিয়া কীভাবে বিজিত হয় সে সম্পর্কে বর্ণিত আছে, ফুসতাত জয়ের পর হযরত উমর (রা.) আলেকজান্দ্রিয়া জয় করারও অনুমতি প্রদান করেন। আলেকজান্দ্রিয়া ও ফুসতাতের মধ্যবর্তী স্থান কিরিয়োন-এ রোমানদের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ হয় যাতে মুসলমানরা জয়লাভ করেন। এরপর আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত রোমান সেনারা আর মুখোমুখি হয় নি। মুকাওকিস জিযিয়া দিয়ে সন্ধি করতে চেয়েছিল; কিন্তু রোমানরা তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে মুকাওকিস হযরত আমর বিন আস (রা.)-এর নিকট এই মর্মে সংবাদ পাঠায় যে, সে এবং কিবতী জাতি এই যুদ্ধের অংশ নয়, তাই আমাদের যেন কোন ক্ষতি না হয়। কিবতীরা এই যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে, বরং তারা মুসলিম বাহিনীকে সহায়তা করে এবং মুসলমানদের জন্য পথ সুগম করতে থাকে আর পুল মেরামত করে দেয়। আলেকজান্দ্রিয়া অবরোধের সময়ও কিবতীরা মুসলমানদেরকে রসদ সরবরাহ করতে থাকে। আলেকজান্দ্রিয়ার গুরুত্ব এবিষয় থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, মুসলমানরা যখন আলেকজান্দ্রিয়া জয় করে তখন এই শহরটি (রোমানদের) রাজধানী হিসেবে গণ্য হত। কনস্টান্টিনোপোলের পর এটি রোমান সামজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বলে পরিগণিত হতো। উপরন্তু এটি পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক শহর ছিল। বাইযেনটাইন তথা রোমানরা একথা খুব ভালোভাবে জানত যে, এই শহরে যদি মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হয়ে যায় তাহলে এর ফলাফল হবে অত্যন্ত ভয়ংকর। এমনই উদ্বেগজনক অবস্থায় হিরাক্লিয়াস এতদূর বলে বসে যে, আরবরা যদি আলেকজান্দ্রিয়ায় জয়ী হয়ে যায় তবে রোমানরা ধ্বংস হয়ে যাবে! হিরাক্লিয়াস স্বয়ং আলেকজান্দ্রিয়ায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল, কিন্তু এই প্রস্তুতির মাঝেই সে মারা যায় এবং তার পুত্র কনস্টান্টিন সম্রাট হয়। আলেকজান্দ্রিয়া এর প্রাচীরের দৃঢ়তা ও পুরুত্ব, অবস্থান ও রক্ষীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে এক অনন্য মর্যাদা রাখত। আলেকজান্দ্রিয়ার অবরোধ নয় মাসব্যাপী চলতে থাকে। হযরত উমর (রা.) উদ্বিগ্ন হন এবং চিঠি লিখে বলেন, তোমরা সম্ভবত সেখানে থেকে আরামপ্রিয় হয়ে গিয়েছ, অন্যথায় বিজয় অর্জনে এতটা বিলম্ব হতো না! এই বার্তা দিয়ে মুসলমানদের জিহাদে অনুপ্রাণিত কর এবং আক্রমণ কর। হযরত উমর (রা.)-এর এই পত্র পড়ে শোনানোর পর হযরত আমর বিন আস (রা.) হযরত উবাদা বিন সামেত (রা.)-কে ডেকে এনে তার হাতে পতাকা তুলে দেন।
মুসলমানরা প্রচন্ড আক্রমণ করে এবং শহর জয় করে নেয়। তখনই হযরত আমর মদিনায় দূত প্রেরণ করেন এবং তাকে বলেন, যত দ্রুত যেতে পার যাও আর আমীরুল মু’মিনীনকে সুসংবাদ শোনাও। দূত উঁটে চড়ে একের পর এক গন্তব্য মাইলফলক অতিক্রম করে মদিনায় পৌঁছে। যেহেতু দুপুরবেলা ছিল, তাই এটি বিশ্রামের সময় ভেবে খলীফার দরবারে যাওয়ার পূর্বে সে সোজা মসজিদে নববীর দিকে যায়। ঘটনাক্রমে হযরত উমরের সেবিকা সেখানে আসে এবং জিজ্ঞেস করে যে, তুমি কে এবং কোথা থেকে এসেছ? দূত বলে, আলেকজান্দ্রিয়া থেকে এসেছি। সেই সেবিকা তখনই গিয়ে সংবাদ দেয় এবং একইসাথে ফিরে এসে বলে, চল! আমীরুল মু’মিনীন তোমাকে ডেকেছেন। হযরত উমর অপেক্ষা না করে নিজে আসতে উদ্যত হন আর চাদর ঠিক করছিলেন, এমন সময় দূত পৌঁছে যায়। বিজয়ের অবস্থা শুনে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং কৃতজ্ঞতামূলক সিজদা করেন। এরপর তিনি উঠে মসজিদে আসেন এবং এই ঘোষণা করান যে, ‘আস্সালাতুল জামেয়া’। এই ঘোষণা শুনতেই পুরো মদিনা দৌঁড়ে আসে। দূত সবার সামনে বিজয়গাঁথা বর্ণনা করে। এরপর দূত হযরত উমরের সাথে তাঁর ঘরে যায়। তার সামনে খাবার পরিবেশন করা হয়। এরপর হযরত উমর দূতকে জিজ্ঞেস করেন যে, সোজা আমার কাছে কেন আস নি? সে বলে, আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়ত বিশ্রাম নিচ্ছেন। তিনি বলেন, তুমি আমার ব্যাপারে এমনটি কেন ভাবলে? আমি যদি দিনের বেলা ঘুমাই তাহলে খিলাফতের বোঝা কে বইবে?
আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের মাধ্যমে পুরো মিশর বিজয় হয়ে যায়। এসব যুদ্ধে বহুল পরিমাণে যুদ্ধবন্দী করা হয়। হযরত উমর সকল যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে হযরত আমরকে পত্রযোগে নির্দেশ প্রদান করেন যে, সবাইকে ডেকে বলে দাও, তাদের এই অধিকার রয়েছে যে, তারা চাইলে মুসলমান হতে পারে অথবা নিজ ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। ইসলাম গ্রহণ করলে তারা সেই সমস্ত অধিকার লাভ করবে যা মুসলমানদের রয়েছে নতুবা জিযিয়া কর দিতে হবে, যা সকল জিম্মি প্রজার কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়। হযরত উমরের এই নির্দেশ যখন যুদ্ধবন্দীদের সম্মুখে পাঠ করা হয় তখন বহু যুদ্ধবন্দী ইসলাম গ্রহণ করে নেয় আর অনেকেই নিজ ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকে। যখন কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিত তখন মুসলমানরা ‘আল্লাহু আকবর’ নারা উচ্চকিত করত। আর যখন কোন ব্যক্তি খ্রিষ্ট ধর্মের ঘোষণা দিত তখন সকল খ্রিষ্টানের মাঝে শুভেচ্ছার গুঞ্জন শোনা যেত আর মুসলমানরা দুঃখিত হতো।
আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী পোড়ানোর ঘটনাও কতিপয় প্রাচ্যবিশারদ বেশ জোরেসোরে বর্ণনা করে থাকে। এর বাস্তবতা কী? আলেকজান্দ্রিয়ার এই বিজয়ের প্রেক্ষিতে বিরোধীরা, বিশেষত খ্রিষ্টান লেখকদের পক্ষ থেকে একটি আপত্তি করা হয় যে, হযরত উমর আলেকজান্দ্রিয়ার অনেক বড় একটি লাইব্রেরীকে পোড়ানোর আদেশ দিয়েছিলেন। আর এই আপত্তির মাধ্যমে এই ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয় যে, মুসলমানরা নাঊযুবিল্লাহ্ কতটা বুদ্ধি ও জ্ঞানচর্চার বিরোধী ছিল! অর্থাৎ তারা আলেকজান্দ্রিয়ার বিশাল লাইব্রেরীকে পুড়িয়ে দেয় যার আগুন ছয় মাস পর্যন্ত জ¦লতে থাকে! অথচ যুক্তি ও লেখনী উভয় দিক থেকে এই আপত্তি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও জাল বলে প্রতিভাত হয়, কেননা যে জাতিকে তার নেতা ও পথপ্রদর্শক রসূলুল্লাহ্ (সা.) এই কথা বলেছেন যে, ‘তালাবুল ইলমে ফারিযাতুন আলা কুল্লে মুসলিম’। অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। আর যিনি এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, ‘উতলুবুল ইলমা ওয়া লাউ বিস্সীন’। অর্থাৎ, জ্ঞান অর্জন কর যদিওবা (এর জন্য) চীন পর্যন্ত যেতে হয়। আর যাদের জন্য পবিত্র কুরআনে জ্ঞান ও বুদ্ধি এবং প্রণিধানের বিষয়ে বহু নির্দেশ ও আয়াত রয়েছে, এমন লোকদের ওপর লাইব্রেরী পোড়ানোর অভিযোগ আরোপ করা যুক্তি এবং প্রজ্ঞার নীতি বিরোধী। এছাড়াও বহু গবেষক, যাদের মাঝে স্বয়ং খ্রিষ্টান ও ইউরোপিয়ান গবেষকরাও রয়েছে, তারা এই বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন আর প্রমাণ করেছেন যে, আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী পোড়ানোর ঘটনা সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা গল্প। অতএব মিশরের একজন আলেম মুহাম্মদ রেযা তার পুস্তক ‘সীরাত উমর ফারুক’-এ উক্ত ঘটনার উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন যে, আলেকজান্দ্রিয়ায় আগুন দেয়ার যে আপত্তি করা হয় তার উল্লেখ আবুল ফারাজ্ মালাতী করেছেন। তিনি এই ঘটনা ‘মুখতাসারুদ্ দুআল’ নামক ইতিহাসগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এই ঐতিহাসিক ১২২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৮৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি লিখেন যে, বিজয়ের সময় ইউহান্না আন নাহভী নামক এক কীবতি পাদ্রী ছিল, যে-কিনা মুসলমানদের মাঝে ইয়াহিয়া নামে খ্যাতি লাভ করে আর বিশ্বাসগত দিক থেকে সে খ্রিষ্টানদের ইয়াকুবিয়্যা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, পরবর্তীতে খ্রিষ্টানদের ত্রিত্ববাদের বিশ্বাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, সে হযরত আমর বিন আস (রা.)-এর কাছে রাজভান্ডার থেকে চিকিৎসা শাস্ত্রের কিছু বই চাইলে হযরত আমর বিন আস (রা.) উত্তরে বলেন, হযরত উমর (রা.)’র কাছ থেকে অনুমতি পাওয়ার পরই আমি তোমাকে কিছু বলতে পারব। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কাহিনী, কিন্তু তারপরও আমি আপত্তি খন্ডনের জন্য তা উল্লেখ করছি। হযরত উমর (রা.) লিখেন, আপনি যেসব বইয়ের উল্লেখ করেছেন সেগুলোর বিষয়বস্তু যদি আল্লাহ্র কিতাব অনুযায়ী হয় তাহলে আল্লাহ্ তা’লার কিতাবে যাকিছু আছে তা আমাদের জন্য যথেষ্ট আর এসব বইয়ের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আর এগুলোর বিষয়াদি যদি আল্লাহ্র কিতাবের বিপরীত হয় তাহলেও এসব বইয়ের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। অতএব আপনি এরূপ পুস্তকাদি নষ্ট করিয়ে দিন। হযরত আমর বিন আস (রা.) আলেকজান্দ্রিয়ার হাম্মাম সন্নিবেশিত অগ্নিকুণ্ড এসব বইয়ের বাছাই আরম্ভ করেন এবং সেগুলো ভাটায় জ্বালিয়ে দেন, এভাবে সেসব পুস্তক ছয় মাসে শেষ হয়ে যায়। এই রেওয়ায়েতের উল্লেখ তাবারীর ইতিহাসেও নেই, ইবনে আসীরেও নেই, ইয়াকুবী ও কিন্দীতেও নেই, ইবনে আব্দুল হাকাম ও বালাজেরীতেও নেই এবং ইবনে খলদুন-ও এটি বর্ণনা করেন নি। কেবল আবুল ফারাজ ত্রয়োদশ খ্রিষ্ট শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এবং সপ্তম হিজরী শতাব্দীর প্রারম্ভে কোন তথ্যসূত্র ছাড়াই এটি উল্লেখ করেছেন।
প্রফেসর বাটলার এই ইউহান্না নাহভী সম্পর্কে গবেষণা করেছেন এবং লিখেছেন যে, সে ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে, যাতে লাইব্রেরীতে আগুন দেয়ার কথা বলা হয়ে থাকে জীবিতই ছিল না। ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’ উল্লেখ করেছে যে, ইউহান্না পঞ্চম শতাব্দীর শেষে এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভে জীবিত ছিল। আর এটিও জানা কথা যে, মিশর বিজয় হয়েছিল সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে। এদিক থেকে প্রফেসর বাটলার সঠিক বলেছেন যে, তখন সে প্রয়াত ছিল। অর্থাৎ যার বরাত টেনে কথা বলা হচ্ছে সে তো সেই অলীক ঘটনা, যার কথা বলা হচ্ছে তা ঘটার অনেক পূর্বেই মারা গিয়েছিল। এছাড়া ড. হাসান ইব্রাহীম হাসান প্রফেসর ইসমাঈল-এর বরাতে তার পত্রিকা ‘তারীখে আমর বিন আস’-এ লিখেছেন যে, আলেকজান্দ্রিয়ার পাঠাগার তখন ছিলই না, কেননা এর দুটি অংশের মধ্য থেকে একটি বড় অংশ জুলিয়াস সিজারের সৈন্যরা উদ্দেশ্যহীনভাবে এবং বিনা কারণে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ সনে জ্বালিয়ে দিয়েছিল আর এর দ্বিতীয় অংশও একইভাবে উল্লিখিত যুগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আর এই ঘটনা তিউফিল পাদ্রীর নির্দেশে চতুর্থ শতাব্দীতে হয়েছিল।
প্রফেসর বাটলার লিখেন, আবুল ফারাজের কাহিনী ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিত্তিহীন ও হাস্যকর। বই যদি জ্বালাতেই হতো তবে তা সংক্ষিপ্ত সময়ে একবারেই জ্বালানো যেত। আর যদি তা ছয় মাসে জ্বালানো হয়ে থাকে তবে সেগুলোর মধ্য থেকে অনেক বই চুরিও হতে পারতো। আরবদের সম্পর্কে এটি জানা নেই যে, তারা কোন কিছু নষ্ট করেছে। গীবন লিখেছেন যে, ইসলামী শিক্ষা এই রেওয়ায়েতটির বিরোধিতা করে, কেননা ইসলামের শিক্ষা হলো, যুদ্ধলব্ধ ইহুদী ও খ্রিষ্টানদের বইপুস্তক জ্বালানো বৈধ নয়। আর জ্ঞান, দর্শন, কাব্য এবং ধর্ম ছাড়া অন্যান্য জ্ঞানমূলক বইপুস্তকের যতটুকু সম্পর্ক রয়েছে, ইসলাম সেগুলো থেকে লাভবান হওয়াকে বৈধ আখ্যা দিয়েছে। মুসলমানেরা বিজিত অঞ্চলগুলোতে গীর্জাসমূহ এবং তদসংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রের ক্ষতি সাধনে বারণ করেছে, বরং বিধর্মী প্রজাদেরও ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করেছিল। তাহলে কি বিবেক এটি মেনে নিতে পারে যে, আমীরুল মু’মিনীন আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী জ্বালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিবেন?
হযরত খলীফাতুল মসীহ আউয়াল (রা.) সময়ে পুস্তক ‘তাসদীক্ব বারাহীনে আহমদীয়া’-তে এই আপত্তির উল্লেখ করে উত্তর দিয়েছেন। তিনি (রা.) বলেন, জ্ঞানী ফেলুনাস হাকীম এর নিবেদনের প্রেক্ষিতে সেনাপতি আমর বিন আস আমীরুল মু’মিনীন খলীফা সানী উমর (রা.)-এর নিকট ঐ লাইব্রেরীর বিষয়ে নির্দেশনা চাইলে খলীফা লিখেন, তাৎক্ষণিকভাবে পুড়িয়ে ফেলা হোক। ছয় মাস পর্যন্ত সেসব অগ্নিকুণ্ড জ্বলতে থাকে। তিনি (রা.) লিখেন, এই আপত্তি তো পাদ্রী সাহেবদের চাটুকারিতার ফলাফল, এতে কোন বাস্তবতা নেই। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.) বলেন, শ্রোতাবর্গ! চিন্তা করে দেখুন, প্রথমতঃ যদি এটি ইসলামের রীতিনীতিতে থাকত তাহলে মুসলমানরা ও হযরত খলীফা উমর (রা.) তাঁর কল্যাণমন্ডিত খিলাফতের প্রাথমিক অবস্থায় ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের পবিত্র পুস্তকাবলী পুড়িয়ে ফেলত। কারণ এই দুই ধর্মই পবিত্র গ্রন্থের অনুসারী ইসলাম ধর্মের সর্বপ্রথম সম্বোধিত ছিল। অতঃপর ইসলাম অগ্নিপূজারীদের উপর পূর্ণ আধিপত্য লাভ করে। কিন্তু কোন ইতিহাস এটি বলে না যে, ইসলাম তাদের বইপুস্তক পুড়িয়েছে। যদি এ কাজ ইসলাম অথবা ইসলামের খলীফাদের বৈশিষ্ট্য হতো, অর্থাৎ যদি এই রীতি থাকত তাহলে এই কাজের চিহ্নাবলী সর্বদা ইসলামে বিদ্যমান থাকার কথা, আর ইসলামের জন্য এর পথে কোন বাধা ছিল না। হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.) বলেন, দ্বিতীয়তঃ যদি ধর্মীয় পুস্তকাবলী পোড়ানো ইসলামী শাসক ও সাধারণ মুসলমানদের কাজ হতো তাহলে গ্রীক দর্শন, গ্রীক চিকিৎসাবিদ্যা ও গ্রীক জ্ঞানবিজ্ঞান সংক্রান্ত পুস্তকাদির অনুবাদ আরবী ভাষায় অসম্ভব ছিল। তৃতীয়তঃ যদি মুসলমানরা বইপুস্তক পোড়ানোর রীতি অবলম্বন করত তাহলে বারাহীনে আহমদীয়া খন্ডনকারী নিজের দেশের কোন দৃষ্টান্ত অবশ্যই উপস্থাপন করতো, হযরত খলীফাতুল মসীহ্ আউয়াল (রা.) বারাহীনে আহমদীয়ার খন্ডন লেখকের উত্তরে এ কথাগুলো লিখছেন যে, তাকে পৃথিবীর অপর প্রান্তে বা আলেকজান্দ্রিয়ায় যেতে হতো না। তিনি (রা.) লিখেন, এখানে অর্থাৎ হিন্দুস্তানে কোন্ পুস্তক পোড়ানো হয়েছে? চতুর্থতঃ ইসলাম হিন্দুস্তানে সাতশ’ বছরেরও অধিক সময় রাজত্ব করেছে। এই সময়ে ভগবত, রামায়ণ, গীতা, মহাভারত এবং এগুলোর অনুরূপ লিং পুরাণ, মারকুন্ডি ইত্যাদি প্রসিদ্ধ পুস্তক রয়েছে; যা আজও ধর্মীয় ও পবিত্র পুস্তক হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। এদের একটিও পোড়ানোর সংবাদ কানে আসে নি, বরং সেসব গ্রন্থসমূহের মধ্য থেকে অনেকগুলোর অনুবাদ হয়েছে। তাই অবাক হতে হয়, কেন এই হিন্দুরা ভাবল যে, মুসলমানরা তাদের গ্রন্থসমূহ পুড়িয়ে দিয়েছে। ন্যায়সঙ্গতভাবে ভেবে দেখ!
এই আপত্তির উত্তরে ‘তাসদীক্ব বারাহীনে আহমদীয়া’ পুস্তকে হযরত মওলানা আব্দুল করিম সাহেবও নোট লিখেছেন। তিনি লিখেন, যদিও তখন পর্যন্ত যখন এই ঘটনার কোন গবেষণা করা হয়নি আর প্রকৃত চিত্র সামনে আসেনি, যখন মুসলমানদের ওপর এ অপবাদ আরোপ করা হতো, কিন্তু এখন ন্যায়পরায়ণ এবং সত্যপ্রিয় আলেমগণের মাঝে এমন লোক অনেক কম রয়েছে যারা এই মিথ্যা অপবাদ মুসলমানদের প্রতি আরোপ করে। এই অপবাদের কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছিল বিদ্বেষ ও অজ্ঞতা। কিন্তু এখনও এই আপত্তিকারীদের কাছে কোন সঠিক সনদ ছিল না, অর্থাৎ এই ঘটনার বর্ণনাকারী দুইজন ঐতিহাসিক উক্ত ঘটনার পাঁচশত আশি বছর পর জন্মগ্রহণ করেছে আর পূর্বের কোন সনদ তাদের কাছে ছিল না। সেন্ট ক্রয় যিনি আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরীর গবেষণায় অনেক পুস্তক লিখেছেন, এই রেওয়ায়েতকে পুরোপুরি মিথ্যা আখ্যায়িত করেছেন। আর জানা যায় যে, এসব পুস্তিকাদি জুলিয়াস সিজারের যুদ্ধে পুড়ে গিয়েছিল। যেমন প্লুটার্ক ‘দি লাইফ অফ সিজার’ পুস্তকে লিখেছেন যে, জুলিয়াস সিজার শত্রæদের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় নিজ জাহাজসমূহে আগুন লাগিয়ে দেয় আর সেই আগুন বিস্তৃত হয়ে এমন স্থানে পৌঁছে যে তা আলেকজান্দ্রিয়ার প্রসিদ্ধ লাইব্রেরীকে সম্পূূর্ণভাবে ভস্মীভ‚ত করে ফেলে।
হেইডেন তার পুস্তক ‘ডিক্শনারী অফ ডেটস রিলেটিং টু অল এজেস’-এ যেখানে এই মিথ্যা রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন, সেখানে নিজ গবেষণার প্রেক্ষিতে এই নোট লিখেছেন যে, এই ঘটনা পুরোপুরি সন্দেহযুক্ত। হযরত উমরের বক্তব্য, “যদি সেই গ্রন্থসমূহ ইসলামবিরোধী হয়ে থাকে তাহলে (সেগুলো) জ্বালিয়ে দেয়া উচিত”। মুসলমানরা এ উক্তির সত্যতা স্বীকার করে নি। কেউ কেউ এই কথাকে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ থিওফ্লিসের প্রতি আরোপ করেছে যিনি ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন আর কেউ কেউ এটিকে কার্ডিনাল জেমিনিজের সাথে সম্পৃক্ত করেছে যিনি ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন। তিনি আরও লেখেন, আমাদের প্রসিদ্ধ যুবক ডাক্তার লাইটনার তার পুস্তক সানিনুল ইসলামে এই ভ্রান্ত রেওয়ায়েতটি গ্রহণ করেছেন। আক্ষেপের সাথে বলতে হয়, উক্ত ডাক্তার সাহেব নিজের গবেষণায় ভুল করেছেন। জন উইলিয়াম ডারপার তার প্রসিদ্ধ বইয়ে প্রথমত এই উক্তিকে ভুল রেওয়ায়েতকারীদের পক্ষ থেকে উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে গিয়ে এর রেওয়ায়েতের ভ্রান্তি তিনি স্বীকার করেছেন এবং তিনি লিখেছেন, সত্যিকার অর্থে এসব বই জুলিয়াস সিজারের যুদ্ধে জ¦লে গেছে। এখন দৃঢ়বিশ্বাসের সাথে বলা যেতে পারে যে, এই উক্তি নিঃসন্দেহে অলীক ও ভ্রান্ত কাহিনী। অশ্রু বিসর্জন দিতে হলে কেবল এই সত্য বিষয়ের জন্য দেয়া যেতে পারে বা পরিতাপ করতে চাইলে এর জন্য করা যেতে পারে যে, বিদ্বেষী কার্ডিনাল জেমিনেজ ৮০ হাজার আরবী হস্তলিখিত বই গ্রানাডার ময়দানে জ্বালিয়ে ভষ্মীভূত করেছে যখন স্পেন মুসলমানদের কাছ থেকে এরা ছিনিয়ে নেয় অর্থাৎ খ্রিষ্টানরা দখল করে সেখানে গ্রানাডার লাইব্রেরীর ৮০ হাজার বই তারা পুড়িয়ে ভষ্মীভূত করেছে। ইসলামের ওপর অপবাদ আরোপ করার পরিবর্তে এস্থলে অশ্রু বিসর্জন দেয়া উচিত। কনফ্লিক্ট বিটুইন রিলিজিয়াস এন্ড সাইন্স-পুস্তক দ্রস্টব্য। যাহোক, এগুলো পাঠাগার জ্বালানো সংক্রান্ত রেফারেন্স যে বিষয়ে ইসলামের ওপর অপবাদ আরোপ করা হয়।
এরপর আছে বারকা এবং ত্রিপলি বিজয়ের ঘটনা। মিশর বিজয়ের পর সেখানে শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয় আর আমর বিন আস পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন যেন বিজিত এলাকা থেকে কোন শঙ্কা অবশিষ্ট না থাকে। বারকা এবং তারাবলুসের দুর্গে কিছু রোমান বাহিনী ছিল। এ সুযোগে স্থানীয় লোকদের প্ররোচিত করে মিশরে মুসলমানদের ওপর হামলা করতে পারত। আলেকজান্দ্রিয়া এবং মরক্কোর মধ্যবর্তী যে এলাকা, সেটিকে বলা হয় বারকা। এই অঞ্চলে বেশ কিছু শহর এবং জনপদ ছিল। আমর বিন আস ২২ হিজরীতে তার বাহিনী নিয়ে বারকার দিকে অগ্রসর হন। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে বারকা পর্যন্ত পথ খুবই সবুজ-শ্যামল এবং ঘন জনবসতিপূর্ণ ছিল। তাই সেখানে পৌঁছানোর সময় তাঁকে শত্রুর কোন ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হতে হয় নি। সেখানে যখন পৌঁছেন তখন মানুষ কর আদায়ের শর্তে শান্তিচুক্তি করে। এরপর বারকার লোকেরা মিশরের গভর্ণরের কাছে নিজেরাই গিয়ে নিজেদের আয়কর জমা করে আসত। মুসলমানদের পক্ষ থেকে কাউকে তাদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হতে না। এরা পশ্চিমের সবচেয়ে সহজ-সরল মানুষ ছিল। তাদের এলাকায় কোন ফিতনা বা নৈরাজ্য ছিল না। আমর বিনুল আস এখান থেকে বের হয়ে ত্রিপলির দিকে অগ্রসর হন যা নিরাপদ দুর্গবিশিষ্ট শহর ছিল। সেখানে রোমান বাহিনীর একটি বিরাট সংখ্যা অবস্থান করছিল। তারা মুসলমানদের আগমানের সংবাদ শুনে নিজেদের দুর্গের দরজা বন্ধ করে দেয়। মুসলমানদের অবরোধ সহ্য করতে থাকে। এই অবরোধ এক মাস পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মুসলমানরা খুব একটা সাফল্য লাভ করে নি। ত্রিপলি শহরের পেছনের অংশে শহরসন্নিবেশিত সমুদ্র প্রবহমান ছিল। সমুদ্র এবং শহরের মাঝে কোন প্রতিবন্ধক দেয়াল ছিল না। মুসলমানদের একটি দল এই রহস্য সম্বন্ধে অবগত হয়। পেছন থেকে তথা সমুদ্রের দিক থেকে শহরে প্রবেশ করে উচ্চস্বরে নারা ধ্বনিত করে। তখন সেনাবাহিনীর নিজেদের নৌকায় বসে পালানো ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা ছিল না। তাই তারা পেছনে ছুঁটতেই পেছন থেকে আমর বিন আস তাদের ওপর হাম্লা করেন। তাদের অধিকাংশের জীবন সাঙ্গ করা হয় কেবল তারা ব্যতীত যারা নৌকায় চড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। শহরের ধনসম্পদ মুসলমানরা মালে গণিমত হিসেবে হস্তগত করে। ত্রিপলি বিজয়ের পর আমর বিনুল আস তার বাহিনীকে নিকটবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে দেন। তার ইচ্ছা ছিল, পশ্চিমে বিজয়ের কাজ সমাপ্ত করে তিউনিশিয়া এবং আফ্রিকার দিকে অগ্রসর হবেন। এ প্রসঙ্গে হযরত উমর বিন খাত্তাব (রা.)-এর বরাবর তিনি পত্র লেখেন। অথচ হযরত উমর ইসলামী বাহিনীকে নতুন রণক্ষেত্রে প্রেরণের বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিলেন আর বিশেষতঃ তিনি (রা.) যখন সিরিয়া থেকে ত্রিপলি পর্যন্ত দ্রুত গতিতে বিজয়াভিযানের কারণে বিজিত অঞ্চলগুলোর বিষয়ে তিনি শতভাগ আশ্বস্ত ছিলেন না; এজন্য তিনি (রা.) ইসলামী সেনাবাহিনীকে ত্রিপোলিতে অবস্থান করতে আদেশ দেন। হযরত উমর ফারুক (রা.)’র খেলাফতকালে মুসলিম সাম্রাজ্যের গন্ডি দূর-দূরান্তের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মুসলিম সাম্রাজ্যের পূর্বে জিহুন এবং সিন্ধু নদ থেকে নিয়ে পশ্চিমে আফ্রিকার ধূসর মরুভূমি পর্যন্ত আর উত্তরে এশিয়া মাইনরের (অর্থাৎ বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত তৎকালীন সাইলেসিয়া প্রদেশ) পাহাড় ও আর্মেনিয়া থেকে নিয়ে দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগর এবং নুবিয়া পর্যন্ত একটি বিশ^ময় বিস্তৃত দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। নুবিয়া দক্ষিণ মিশরের একটি সুবিস্তৃত এলাকা যেখানে নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সভ্যতা ও কৃষ্টি কালচারের অভ্যুদয় ঘটে। কেবল মিশরীয় অঞ্চলেই নয় বরং মুসলিম শাসিত গোটা অঞ্চলে বৈচিত্রপূর্ণ নানা জাতি, ধর্ম ও সভ্যতার বসতি ছিল আর সবাই ইসলামের ন্যায় ও দয়ামায়ার সুশীতল ছায়াতলে পরম শান্তিতে বসবাস করে। সেই ইসলাম ধর্ম যা ধর্মীয় বিশ্বাস, ইবাদতের রীতি-নীতি, সভ্যতা ও কৃষ্টি কালচারের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন লোকদের হাজার বিরোধিতা সত্ত্বেও পৃথিবীতে পূর্ণ অধিকার প্রদান করেছে এবং তাদের জীবনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল ছিল।
যুদ্ধ চলাকালে মুসলমানদের ইবাদতের মান কেমন ছিল সে প্রসঙ্গ বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) বলেন, পৃথিবীর সবকিছু ক্রমান্বয়ে উন্নতি করে। বড় বড় কাজও নিমিষেই হয় না বরং ধীরে ধীরে হয়। মহানবী (সা.)-এর যুগেও সব মুসলমান তাহাজ্জুদ পড়ত না। ধীরে ধীরে তাদের মাঝে তাহাজ্জুদের অভ্যাস সৃষ্টি করা হচ্ছিল। এমনকি এক যুগ আসল যখন কিনা হযরত উমর (রা.)-এর খেলাফতকালীন সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও মুসলমানগণ তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। অথচ এটি প্রমাণিত সত্য যে রসূল করীম (সা.)ও যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কখনো কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন না। সম্ভবত রসূলে করীম (সা.) যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন কিন্তু এটি প্রমাণিত যে, তিনি কখনও কখনও এরূপ মুহূর্তে তাহাজ্জুদ নামাজে উঠতেন না। অথচ হযরত উমর (রা.)-এর খেলাফতকালীন সময়ে মুসলমানগণ যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করত। এমনকি একবার হিরাক্লিয়াস যখন মুসলমানদের ওপর রাতের আধারে আক্রমণ চালানোর জন্য মনস্থির করল তখন এ বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণের পর পরিশেষে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, এভাবে আক্রমণ করা ঠিক হবে না। রাতের আধারে হাম্লা করা বৃথা কেননা তারা তো রাতে ঘুমায় না বরং তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ে রত থাকে। এটিও উন্নতির চিহ্ন যা প্রাথমিক যুগে ছিল না। প্রাথমিক যুগে রসূলে করীম (সা.)-কে এর জন্য অনেক অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করতে হয়েছে কিন্তু পরবর্তীতে দুর্বল প্রকৃতির লোকেরাও ধীরে ধীরে এতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
খোলাফায়ে রাশেদীনদের যুগে সংঘটিত যুদ্ধগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে মুসলেহ মওউদ (রা.) বলেন, ইসলাম কেবলমাত্র মোকাবিলা করার নির্দেশই প্রদান করে নি বরং কোন কোন যুক্তির অধীনে অন্যায়কে সহ্য করার শিক্ষা দিয়েছে। অতএব যেখানে আল্লাহ্ তা’লার পক্ষ থেকে চড়ের বিপরীতে চড় মারার অনুমতি দেয়া আছে সেখানে ইসলাম এ-ও বলেছে যে, যদি তোমরা তা শান্তির পরিপন্থী বলে মনে কর তবে তোমরা নিরব থাক ও চড়ের বিপরীতে চড় মেরো না। তাই এসব যুদ্ধ সম্পর্কে সচরাচর যে যুক্তি উপস্থাপন করা হয় যার মাধ্যমে হযরত আবু বকর, উমর ও উসমানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত শত্রুর অভিযোগের খন্ডন হয়ে যায়। এটি জানা যায় যে, হযরত আবু বকর (রা.) কোন অন্যায়-অত্যাচার করেন নি বরং কায়সার অত্যাচার করেছে, হযরত উমর (রা.) অন্যায়-অত্যাচার করেন নি বরং ইরানের সম্রাট অত্যাচার করেছে। হযরত উসমান (রা.) অন্যায়-অত্যাচার করেন নি বরং আফগানিস্তান ও বুখারার সীমান্তবর্তী গোত্রগুলো, কুর্দি ও অন্যান্যরা করেছে। কিন্তু এ কথার কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না যে, হযরত আবু বকর, উমর ও উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুম তাদের ক্ষমা কেন করেন নি? যখন তারা যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল তখন তারা রোমান সম্রাট কায়সারকে বলতে পারত যে, তোমার সেনাদের দ্বারা অমুক ভুল হয়ে গিয়েছে। এ সম্বন্ধে তোমার সরকার যদি আমাদের নিকট ক্ষমা চায় তবে আমরা ক্ষমা করে দিব আর ক্ষমা না চাইলে আমরা যুদ্ধ করব। তারা রোমান সম্রাট কায়সারের সমীপে এমন কথা বলেন নি যে, তুমি বা তোমার সেনাবাহিনীর একাংশের হাতে অমুক সময়ে এ অন্যায় সাধিত হয়েছে এবং যেহেতু আমাদের শিক্ষার মাঝে শত্রুদের ক্ষমা করার শিক্ষা বিদ্যমান, এ কারণে যদি তোমরা ক্ষমা চাও তবে আমরা ক্ষমা করতে প্রস্তুত আছি। মুসলমানরা এমনটি বলে নি বরং যখন সে অন্যায় করে বসল তখন তৎক্ষণাৎ মুসলমানরা যুদ্ধের জন্য দাঁড়িয়ে যায় এবং মুসলমান সৈন্যবাহিনী সেই যুদ্ধ অব্যাহত রাখে। ইরানী সেনাবাহিনী যখন ইরাকের সীমান্তে হামলা করে, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এরপর সাহাবী এবং ইরানীদের মাঝে যুদ্ধ করা বৈধ হয়ে যায় তবে উন্নত নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হযরত উমর ইরানের বাদশাহ্কে এটিও বলতে পারতেন যে, তুমি হয়তো এই আক্রমণ করার আদেশ দাও নি, হয়তো সৈন্যদল নিজে থেকেই এই আক্রমণ রচনা করেছে; এ কারণে আমরা এই আক্রমণকে উপেক্ষা করতে প্রস্তুত আছি তবে শর্ত হলো, তুমি এই আক্রমণের জন্য ক্ষমা চাও এবং অনুশোচনা কর, কিন্তু হযরত উমর (রা.) এমনটি করেন নি। একইভাবে হযরত উসমানের খিলাফতকালে শত্রুদের এটি বলেন নি যে, নিঃসন্দেহে তোমরা অন্যায় করেছ তবে যেহেতু আমাদের ধর্ম অন্যায় ক্ষমা করার শিক্ষাও প্রদান করে, তাই আমরা তোমাদের ক্ষমা করে দিচ্ছি। বরং তিনি তৎক্ষণাৎ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং সেনাদল প্রেরণ করেন, যুদ্ধ করেন এবং সেই যুদ্ধকে অব্যাহত রাখেন- এর কারণ কী ছিল? হযরত মুসলেহ মওঊদ (রা.) বলেন, যদি আমরা লক্ষ্য করি তবে বুঝা যাবে যে, এর কারণ একমাত্র এটিই ছিল যে, হযরত আবু বকর (রা.) জানতেন যে, যখনই বাইরের আক্রমণের আশংকা কমে আসে, তখন অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরম্ভ হয়ে যায়। তিনি এই আক্রমণকে কায়সারের আক্রমণ হিসেবে না ভেবে আল্লাহ তা’লার আক্রমণ মনে করতেন যেন মুসলমান এর মাধ্যমে নিজেদের সংশোধনের দিকে মনযোগ দেয় এবং নিজেদের মাঝে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে ও নুতন পরিবর্তন আনয়ন করে। হযরত উমর (রা.) জানতেন যে, রোমান সম্রাট সিজার হামলা করে নি, প্রকৃতপক্ষে এই আক্রমণ আল্লাহ্ তা’লা রচনা করেছেন যেন মুসলমানরা অলস ও উদাসীন হয়ে বস্তুবাদী না হয়ে পড়ে। বরং প্রতি মুহূর্তে তারা যেন সজাগ ও সচেতন থাকে। হযরত উসমান (রা.) জানতেন, কোন কোন গোত্র মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করে নি বরং প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা’লা এই আক্রমণ করেছেন যেন মুসলমানরা সজাগ হয় এবং তাদের মাঝে এক নবজীবন ও নব প্রাণের সঞ্চার ঘটে।
এটি মুসলেহ মওউদ (রা.)-এর এক খোতবা থেকে নেয়া। তিনি জামাতকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, বিপদ-আপদ আসে এবং সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে হয় আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনের জন্য। উক্ত নীতিকে আমরা যদি আজও স্মরণ রাখতে চাই তবে এই সকল বিপদাপদ যা আমাদের ওপর আপতিত হয়েছে তা আমাদের জন্য আল্লাহ্ তা’লার নৈকট্যের কারণ হওয়া চাই আর পরবর্তিতে এগুলোই বিজয়ের মূল কারণ হয়ে থাকে। যদি এসব বিষয়ে আমরা শুধু ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পিছিয়ে থাকি এবং আত্মশুদ্ধির দিকে দৃষ্টি না দেই তবে উন্নতি লাভ করা সম্ভব নয়। তবে বিপদাবলী যখন দূর হয়ে যাবে এবং উন্নতি সাধন হবে তখনও আমাদের আল্লাহ্ তা’লার সাথে সম্পর্ক থাকা উচিত। কিন্তু বর্তমানে আমাদেরকে বিশেষভাবে আল্লাহ্ তা’লার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করা উচিত এবং আমাদেরকে নিজেদের আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতি মনোযোগী হওয়া উচিত। হযরত মুসলেহ মওউদ (রা.) এটিই লিখেছেন যে, আমরা যদি এই বিষয়টি না বুঝি তবে প্রকৃত অর্থে আমরা কিছুই বুঝি নি এবং বর্তমানে এই বিষয়টিই প্রত্যেক আহমদীকে বুঝতে হবে।