কোভিড ১৯ (২য় পর্ব )

 

কোভিড ১৯ (২য় পর্ব )

ব্যক্তিগত ডায়েরী

আবিদ খান

ভূমিকা

গত বছরের মতো কঠিন সময় আমরা ইতোপূর্বে প্রত্যক্ষ করিনি। কোভিড-১৯ আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত করেছে, অনেক মানুষ এর কারণে মৃত্যুবরণ করেছে। সারা বিশ্ব অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের সম্মূক্ষীণ হয়েছে।

২০২০ সালের গ্রীষ্মকালে মনে হচ্ছিল যে পরিস্হিতি হয়ত কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারী মাসে এই ডায়েরী লিখছি। এখনো মহামারী পরিস্হিতি খুব কমই উন্নতি হয়েছে।

ইউকেতে করোনা ভ্যকসিন অনুমোদনের এক মাস সময় অতিবাহিত হচ্ছে। আমি হুজুর(আইঃ) কে জিজ্ঞেস করি যে এর ফলে শীঘ্রই ইসলামাবাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হতে পারে কিনা।

হুজুর বলেন :

“সরকার যতদিন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে খুলে দেবার ঘোষণা দিচ্ছে ততদিন আমরাও সতর্ক থাকব। কোন অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি নেব না। বরং এ সময় আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ভ্যাকসিন এসেছে, তার মানে এই নয় যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সকল পরিস্হিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। ”

গত বছর জলসা, ইজতেমা সহ অন্যান্য জামাতী অনুষ্ঠান বন্ধ থাকলেও আহমদীয়া জামাতের উন্নতি থেমে থাকেনি। হযরত খলীফাতুল মসীহ খামেস(আইঃ) এর দিক নির্দেশনায় জামাত ক্রমাগত উন্নতি করে চলেছে।

হুজুর তার প্রতিটি মুহুর্ত ইসলামের সেবায় ব্যয় করেন। প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এর মিশনকে পূর্ণ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য।

মহামারীর কারণে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যহত হয়েছে এটি সত্য। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে যুগ খলীফার সাথে বিশ্বব্যাপী জামাতের সদস্যদের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়েছে।

জুন মাসে আমি মহামারীর প্রাথমিক পরিস্হিতি নিয়ে একটি ডায়েরী লিখেছিলাম। এই ডায়েরীতে আমি ২০২০ সালের পরবর্তী সময়ের কিছু ঘটনা এবং হুজুরের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা সম্বন্ধে লিখব।

নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা

জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে আমি হুজুরকে একজন আহমদী বন্ধুর কথা উল্লেখ করি। তিনি জানতে চেয়েছেন যে নিকট ভবিষ্যতে হুজুরের সাথে পারিবারিক মোলাকাতের কোন সুযোগ রয়েছে কিনা।

হুজুর বলেন :

“এখনই পারিবারিক মোলাকাত শুরু করা সম্ভব নয়। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই অনলাইন মিটিং এর মাধ্যমে আমি মোলাকাত শুরু করব।  যাদের মার্চ-এপ্রিল মাসে ইউকেতে আসার কথা ছিল, কিন্তু কোভিড এর কারণে আসতে পারেন নি, তাদের সাথে অনলাইন মিটিং এ মোলাকাত শুরু করা হবে। যখন মিটিং হবে তখন তুমি উপস্হিত থাকবে। ”

এই নতুন পরিকল্পনায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলাম। একই সাথে হুজুর আমাকে মিটিং এ থাকার অনুমতি দিয়েছেন এজন্য আমি হুজুরের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। মার্চের লকডাউন থেকে আমি প্রতি সপ্তাহে একদিন ইসলামাবাদ সফর করছি। আমি আনন্দিত ছিলাম যে এর ফলে আমি আরো নিয়মিত সেখানে যাবার সুযোগ পাব। আরও একটি বিষয় আমি চিন্তা করছিলাম। যদি প্রথম মিটিং সফলভাবে সমাপ্ত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এটি একটি নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হতে পারে। এর ফলে আরো বেশি মানুষ হুজুরের সাথে মোলাকাতের বরকত লাভ করবে।

কয়েক সপ্তাহ প্রস্তুতির পর ১৫ আগস্ট, ২০২০ তারিখে প্রথম ভার্চুয়াল মোলাকাত অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে কানাডার ২০০ জন আতফাল উপস্হিত ছিলেন।

হুজুরের অফিসে প্রবেশ করে আমি দেখলাম যে হুজুরের ডেস্কের বিপরীতে এক বিশাল টেলিভিশন রাখা হয়েছে। ডেস্কের পাশে একটি চেয়ার রাখা হয়েছে। আমি প্রবেশ করার পর হুজুর বলেন :

“এই চেয়ার তোমার জন্য । তুমি এখানে বসতে পার।”

মুনীর ওদেহ সাহেব( প্রোডাকশন ডিরেকটর, এমটিএ ইন্টারন্যাশনাল) হুজুরকে ভলিউম নিয়ন্ত্রন করার জন্য একটি রিমোট প্রদান করেন। তিনি ভিডিও কল শুরু করার জন্য হুজুরের অনুমতি প্রার্থনা করেন। হুজুর অনুমতি দেবার পর তিনি ভিডিও কল করেন।

সাথেসাথেই কানাডার পিস ভিলেজের বায়তুল ইসলাম মসজিদের আতফালগণ সকলেই দাড়িয়ে যান। হুজুর তাদের দেখে হাসেন।

হুজুর সবাইকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেন।

কয়েক মিনিট পর মুনীর ওদেহ সাহেব এবং মুনীর জাভেদ সাহেব দুজনেই হুজুরের অফিস থেকে বেরিয়ে যান। হুজুরের সাথে সেখানে থাকতে পেরে আমি নিজেকে সত্যিই অনেক সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। এটি জামাতের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহুর্ত। আমার মনে হচ্ছিল আমাদের চোখের সামনেই এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস রচিত হচ্ছে।

হুজুর মিটিং পরিচালনা করেন এবং আতফালদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করার অনুমতি দেন। আমি চিন্তা করছিলাম যে অনলাইন মিটিং এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আহমদীগণ হুজুরের সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ করতে পারবেন।

বিশেষভাবে পাকিস্তানের আহমদীগণ, যাদের সফর করার সামর্থ্য নেই। তারাও এখন হুজুরের সাথে মোলাকাতের আশা করতে পারে। কয়েকবার হুজুর কিছু প্রশ্ন সঠিকভাবে শুনতে পারে নি। কিন্তু সেটি কোন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নয়। বরং আতফালদের কানাডায়িান উচ্চারণের জন্য প্রশ্ন সঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। সৌভাগ্যবশত আমি তাদের কথা বুঝতে পারি এবং হুজুরকে বুঝিয়ে বলি।

মিটিংএ হুজুর কখন কানাডা আসবেন এর উত্তরে হুজুর বলেন :

“এই মিটিং এর মাধ্যমে আমি কানাডা চলে এসেছি বলেই মনে হচ্ছে। কানাডার মসজিদ এবং যেখানে বসে আমি সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম সেই স্হান পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। তোমরা যেই হলে বসে আছ সেটিও দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি তোমাদের সাথেই রয়েছি।  ”

অনলাইন মিটিং এর সৌভাগ্য আমরা ভবিষ্যতেও জারী রাখতে পারব আমার মনে হচ্ছিল, ইনশাল্লাহ্ । এর ফলে বিশ্বের আহমদীদের সাথে খিলাফতের বন্ধন আরো দৃঢ় হবে।

কিন্তু, মুনীর ওদেহ সাহেব এবং আমি দুজনেই মিটিং এর পর হুজুরের প্রতিক্রিয়া শোনার জন্য রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলাম। হুজুর যখন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেন তখন আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।

আমি হুজুরকে জানাই যে ‘হুজুরের এই সপ্তাহ’ প্রোগ্রামে আমরা এই মিটিং এর কিছু অংশ প্রদর্শন করতে চাই। যেন বিশ্বের সকল আহমদীগণ অনলাইন মিটিং থেকে লাভবান হতে পারে।

হুজুর বলেন :

“হ্যা। এটি দেখাতে পার। এটি একটি ভাল ব্যাপার হবে।”

মহামারীর সময়ে বিশ্বভ্রমণ

আলহামদুলিল্লাহ্, প্রথম অনলাইন মিটিংএর পর আমরা ‘হুজুরের এই সপ্তাহ’ প্রোগ্রামটি পুনরায় শুরু করি। গত কয়েক মাসে হুজুর অনলাইনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আমেলা, মোবাল্লেগ, ওয়াকফে নও ও অন্যান্যদের সাথে অনলাইনে সাক্ষাৎ করেন।

মাঝে মধ্যে মিটিংএ কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সার্বিকভাবে সকল মিটিং সাবলীলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। প্রতি সপ্তাহেই আমার মনে হচ্ছিল যে আমি হুজুরের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করছি।

জামেআ আহমদীয়া ইন্দোনেশিয়ার সাথে অনলাইন মিটিং এর একদিন পূর্বে হুজুর আমাকে বলেন :

“আগামীকাল জামেআ আহমদীয়া ইন্দোনেশিয়ার সাথে অনলাইন মিটিং হবে। তাই তুমি এখানে বসেই আমার সাথে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ করতে পারবে।”

আমি বলি :

“জাযাকাল্লাহ্ হুজুর! আমি দোয়া করি একদিন যেন আমি আপনার সাথে স্বশরীরে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণের সুযোগ লাভ করি। ”

প্রতিটি মোলাকাতের মাধ্যমে সদস্যগণ যুগখলীফার প্রজ্ঞা, দিক নির্দেশনা ও দোয়া লাভের বরকত লাভ করে। জামাতের আমেলা সদস্যগণ তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান লাভ করে উজ্জীবীত হয়।

মোবাল্লেগগণ যারা পাশ করেছেন এবং যারা এখনো পড়াশোনা করছেন তারাও হযরত খলীফাতুল মসীহর কাছ থেকে সরাসরি দিক নির্দেশনা লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন।

পরম ভালবাসা ও ধৈর্য্যের সাথে হুজুর সকলের কথা শুনেন, তাদের তাদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন।

বেশীরভাগ সময়েই মিটিং নির্ধারিত সময়ের পরে শেষ হতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও অংশগ্রণকারীদের ইচ্ছা ছিল যে মিটিং আরও একটু বেশি লম্বা হলে ভাল হতো।

হুজুর মিটিং এর অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তার প্রতিও লক্ষ্য রাখতেন। মিটিং এর পূর্বে হুজুর নিশ্চিত করতেন যে সকল সদস্য সেই দেশের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সকল আইন মেনে চলছেন। তারা সকলেই খাবার খেয়েছে কিনা সেটিও জানতে চাইতেন।

সম্প্রতি, অনলাইন মিটিং এর একজন আতফাল তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সে লিখে যে মোলাকাতের দুই ঘন্টা পূর্বে তাদেরকে আসতে বলে হয়। যেই হলে তাদেরকে বসতে দেয়া হয়েছিল সেটি খুব ঠান্ডা ছিল। কিন্তু যখনই মিটিং শুরু হয় তখন সে তার সকল কষ্টের কথা ভুলে যায়। হুজুরের সাথে বরকতময় সাক্ষাতের প্রতিটি মুহুর্তই সে উপভোগ করে।

পরবর্তীতে আমি হুজুরকে বিষয়টি উল্লেখ করি। আমি তার মন্তব্যকে হুজুরের প্রতি ভালাবাসার দৃষ্টিতে বিবেচনা করছিলাম। যে এই মোলাকাত তার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং তার ঈমানকে আরো দৃঢ় হয়েছে।

কিন্তু, হুজুর তার মন্তব্যকে জামাতের বাচ্চাদের প্রতি খিলাফতের ভালাবাসার দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন।

হুজুর বলেন:

“সেই দেশের সদর খোদ্দামের সাথে এখনই যোগাযোগ কর। তাকে জিজ্ঞেস কর যে কেন বাচ্চাদেরকে ঠান্ডার মধ্যে বসানো হয়েছিল। রুম গরম করার পর্যাপ্ত ব্যবস্হা তাদের রাখতে হবে। প্রতিটি বাচ্চার সাথেই ভালবাসা পূর্ণ আচরণ করা আবশ্যক। ”

মহান আল্লাহ্‌পাকের অশেষ রহমতে, প্রতি সপ্তাহেই বিভিন্ন জামাতের প্রতিনিধিগণ হুজুরের সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ করেন। আমি সবসময়ই পরবর্তী মোলাকাতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। আলহামদুলিল্লাহ্, হুজুরও ভার্চুয়াল মোলাকাত উপভোগ করেন। ।

ন্যাশনাল মজলিস আমেলা মরিশাসের সাথে মোলাকাতের সময় হুজুর বলেন :

“ভার্চুয়াল মোলাকাত অনেক উপকারী বলে প্রমাণিত হচ্ছে। কারণ এর ফলে আমি বিভিন্ন দেশের আহমদীগণের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি। তারা তাদের সমস্যাবলী সরাসরি আমার সাথে আলোচনা করতে পারছে। আমিও তাদেরকে সরাসরি দিন নির্দেশনা প্রদান করছি। এর ফলে জামাত আরো একতাবদ্ধ হচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে জামাতের অগ্রযাত্রা সকল পরিস্হিতিতেই এমনকি মহামারীর মধ্যেও অব্যাহত থাকবে, ইনশাল্লাহ্‌।   ”

প্রকৃত বিনয়

সেপ্টেম্বর মাসে আমি হুজুরের কাছে আমার বাবা (মৃত ড. হামিদ আহমদ খান) বিষয়ে একটি আর্টিকেল লিখে হুজুরের অনুমোদনের জন্য তার কাছে জমা দেই। হুজুরের নির্দেশেই আমি সেটি লিখেছিলাম। আমি আশা করছিলাম লেখাটি হুজুর পছন্দ করবেন।

অতীতে আমি যখনই হুজুরের অনুমোদনের জন্য কোন লেখা পাঠিয়েছি, হুজুর সেটি দ্রুতই দেখে দিয়েছেন। কিন্তু, এই লেখাটি কয়েক সপ্তাহ হুজুরের কাছে ছিল। আমি চিন্তা করছিলাম যে হুজুর তার কাজের ব্যস্ততার জন্য হয়ত সেটি দেখার সময় পাচ্ছেন না। কিন্তু আমার মনে কিছুটা দুশ্চিন্তাও কাজ করছিল। হুজুর হয়ত লেখাটি পড়েছেন, কিন্তু সেটি হুজুরের পছন্দ হয়নি।

অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে, আমি আমার ডেস্কে বসে কাজ করছিলাম। তখন প্রাইভেট সেক্রেটারীর অফিস থেকে একটি মেইল আসে। মেইলে একটি পিডিএফ ফাইল এটাচ করা ছিল। তার প্রথম পাতায় উর্দুতে লেখা অনেকগুলো নোট। আমি হুজুরের হাতের লেখা তৎক্ষনাত চিনতে পারি। এত বড় নোট দেখে আমার মনে হয় যে নিশ্চয়ই হুজুর আমার লেখাটি পছন্দ করেন নি।

উর্দু লেখাটি পড়তে আমার কিছুটা সময় লেগে যায়। যেহেতু আমি উর্দুতে বিশেষ করে হাতে লেখা উর্দু পড়ায় পারদর্শী নই। আমি আমার দলের একজন সদস্যকে সেটি পড়তে অনুরোধ করি। হুজুর কি লিখেছেন সেটি জানতে পেরে আমি অত্যন্ত আবেগ আপ্লুত হয়ে যাই। সেখানে হুজুর আমার বাবা ও আমার জন্য দোয়া করে এক অসাধারণ চিঠি লিখেছেন। হুজুরের বক্তব্য অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও হদয়স্পর্শী।

আমি এখানে হুজুরের পুরো চিঠিটি শেয়ার করতে চাচ্ছি না। কিন্তু চিঠির প্রথম লাইনই আমাকে অশ্রুসিক্ত করার জন্য যথেষ্ট।

হুজুর লিখেন :

“প্রিয় আবিদ, আমি এখন তোমার লেখাটি পড়ছি এবং লেখাটি পড়তে দেরী হবার জন্য আমি দুঃখিত।”

বিশ্বের কোন নেতা তার গোলামের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন?

আমার কোন লেখা হুজুর পড়ে দিবেন, এটি দাবি করার কোন অধিকার আমার নেই। আর এখানে হুজুর দেরী হবার জন্য আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছেন। মহান আল্লাহ্‌পাক আমাদের তৌফিক দান করুন যেন আমরাও আমাদের প্রিয় খলীফার মতো বিনয় এবং দয়া থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারি।

সেদিন বিকেলে আমি হুজুরের সাথে ইসলামাবাদে সাক্ষাৎ করি। আমি যখন হুজুরের অফিসের চেয়ারে বসি তখন আমি কেবল নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আমি হুজুরের সেই চিঠি পেয়ে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলাম। আমার প্রতি হুজুরের ভালবাসা দেখিয়েছেন সেটি সত্যই অনন্য।

এক মুহুর্ত পর হুজুর বলেন :

“তুমি কি আমার নোট পেয়েছ?”

তখন আমার হৃদয়ে অনেক কিছুই চলছিল। সে মুহুর্তে আমি বলতে চাইছিলাম যে আমার কাছে সেই নোটের গুরুত্ব কতখানি। আমি হুজুরকে কতটা ভালবাসি। আমার সারাজীবনের একটিই আকাঙ্খা আর সেটি হল হুজুরের সেবা করা। আমি আমার সকল দুর্বলতা ও ভুলের জন্য হুজুরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাইছিলাম।

কিন্তু আমার প্রবল আবেগের কারণে আমি কেবল এতটুকুই বলতে সক্ষম হই :

“জী হুজুর, আমি নোটটি পেয়েছি। জাযাকাল্লাহ্‌।”

হুজুর অত্যন্ত দয়াপরবশ হয়ে আমার লেখা সম্বন্ধে কিছু বিষয় আলোচনা করেন।

একটি বিষয়ে হুজুর বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। যেখানে আমি আমার বাবার বিষয়ে লিখেছিলাম। আমার মায়ের মৃত্যুর কয়েক বছর পর, ১৯৯৯ সালে আমার বাবা আর একটি বিয়ে প্রায় করেই ফেলেছিলেন। একদম শেষ পর্যায়ে, হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) হস্তক্ষেপ করেন। তিনি আমার বাবাকে পুনরায় বিয়ে করতে নিষেধ করেন।

হুজুর সে সময়ের উল্লেখ করে বলেন :

“তোমার বাবার কিছু কাছের মানুষ তাকে পুনরায় বিয়ে করার উপদেশ দেয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল তিনি যদি সেসময় আবার বিয়ে করতেন তাহলে সেটি তার এবং তোমাদের পরিবারের জন্য দুঃখের কারণ হতো। এক ভয়ংকর পরিক্ষা থেকে রক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহ্‌পাকের প্রতি তোমার শোকরিয়া আদায় করা উচিৎ। ” 

হুজুর আরও বলেন :

“মাঝেমধ্যে, পরিবারের নিকট সদস্যগণও এমন উপদেশ দিয়ে থাকেন যেটি প্রকৃত পক্ষে ভাল ফলাফল নিয়ে আসে না। তাদের উপদেশ সবসময় ভাল করার জন্যও হয়ে থাকে না। অনেক সময় এতে তাদের নিজেদের স্বার্থও জড়িত থাকে। একারণেই পবিত্র কোরআন বলে যে উপদেশ প্রদান করার সময় ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে উপদেশ দেয়া উচিৎ। এ সময় নিজের সকল স্বার্থকে একপাশে সরিয়ে রেখে চিন্তা করতে হবে। পবিত্র কোরআনের এই মানদন্ড সকলকেই মেনে চলা উচিৎ। ”

কেনাকাটা করার সময় হুজুরের ফোনকল

শরতের শুরুর দিকে কোভিড-১৯ পরিস্হিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছিল। বসন্তের তুলনায় এসময় দৈনন্দিন মৃতের সংখ্যাও তুলনামূলক কম ছিল। আমাদের বড় দুইজন সন্তান তখন স্কুলে ছিল। এখন সুপারশপে যেয়ে কিছু কেনাকাটা করা সঠিক হবে কিনা এ বিষয়ে আমি ও আমার স্ত্রী চিন্তা করছিলাম। অনেক চিন্তা ভাবনা ও বিতর্কের পর আমরা বাজারে যাবার সিদ্ধান্ত নেই।

আমরা সকাল ১১টার সময় সুপারশপে পৌছাই। বিভিন্ন জিনিস দেখতে দেখতে কেনাকাটা শেষ করে কাউন্টারে যেয়ে আমরা লক্ষ্য করি যে তখন দুপুর ১ টা বেজে গিয়েছে। বাসায় যেতে আমাদের দেরী হয়ে যাবে দেখে আমি চিন্তা করছিলাম। কারণ আমাকে হুজুরের সাথে মোলাকাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।

আমরা বিল পরিশোধের জন্য লাইনে দাড়িয়েছিলাম। তখন আমি গুগোল ম্যাপসে রাস্তায় ট্রাফিকের অবস্হা দেখছিলাম। বিল পরিশোধের সময় একদমই অপ্রত্যাশিতভাবে আমার ফোন বেজে উঠল।

ফোনটি ইসলামাবাদ থেকে এসেছিল। ফোনের অপর প্রান্তে আমি হুজুরের প্রাইভেট সেক্রেটারী মুনীর জাভেদ সাহেবের কথা শুনতে পাই। সালাম দেবার পর তিনি বলেন :

“হুজুর তোমার সাথে কথা বলতে চান। তাই আমি এখন হুজুরের সাথে তোমার কল কানেক্ট করছি। ”

আমি প্রস্তুতি নেবার জন্য এক সেকেন্ডও সময় পাইনি। আমি আমার স্ত্রী মালাকে বিল পরিশোধ করার জন্য ইশারা করি। আমার ফোন নিয়ে আরো ভাল সিগন্যালের জন্য গাড়ী পার্কের নির্ধারিত স্হানের দিকে দৌড় দেই। সেখানে ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজও কম। কিন্তু তাড়াহুড়োয় আমি কেনাকাটার ট্রলি আমার সাথে নিয়ে যাই। সেগুলো স্ক্যান করা হয়েছিল কিন্তু বিল পরিশোধ করা হয়নি।

মালা পরবর্তীতে আমাকে বলে যে আমার আচরণ দেখে সে বুঝে গিয়েছিল যে হুজুর আমাকে কল করেছেন। কিন্তু তার দুশ্চিন্তা ছিল যদি গেট অতিক্রম করার সময় এলার্ম বেজে উঠে তাহলে নিরাপত্তা কর্মীগণ আমাকে আটকে ফেলবে। সৌভাগ্যবশত আল্লাহ্‌পাকের অশেষ রহমতে এরকম কিছু ঘটেনি। কয়েক মিনিট পর সকল বিল পরিশোধ করে সে আমার কাছে চলে আসে।

হুজুর আমাকে বলেন যে তিনি ‘হুজুরের সাথে এই সপ্তাহ’ যেটি পরের দিন এমটিএতে প্রচারিত হবে সেটি দেখেছেন। সেখানে জার্মানীর ন্যাশনাল আমেলার সাথে ভার্চুয়াল মোলাকাতের একটি অংশ রয়েছে।

সেটি রিভিউ করার পর হুজুর জানতে চান যে কেন আমি মিটিংএর একটি অংশ বাদ দিয়েছি। যেখানে হুজুর জার্মানীর ন্যাশনাল উমর এ খারীজা( এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স) এর সাথে আহমদী মুসলমানদের জার্মানীতে এ্যাসাইলাম বিষয়ে কথা বলেন।

আমি অংশটি ইচ্ছে করেই কেটে দিয়েছি। আমার মনে হয়েছে বিষয়টি অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং জামাতের আভ্যন্তরীন বিষয়।

সেখানে হুজুর এ্যাসাইলাম বিষয়ে জার্মান জামাত এবং ন্যাশনাল উমর এ খারীজার প্রতি তার অসন্তুষ্টি ব্যক্ত করেন। আমি বলি :

“হুজুর, আমি সেটি অন্তর্ভূক্ত করিনি। কারণ আমার মনে হয়েছে এটি আভ্যন্তরীন বিষয় এবং এটি সম্প্রচার হলে জার্মানীর আমীর সাহেব এবং ন্যাশনাল উমর এ খারীজা সাহেব বিব্রত হবেন। ”

হুজুর বলেন :

“জার্মানীর কিছু আহমদী আমাকে চিঠিতে লিখেন। তারা চিন্তা করেন তাদের দুর্বিষহ জীবন সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই। অনেকে এমনও মনে করেন, যে নাউযুবিল্লাহ্, তাদের দুঃখ-কষ্ট ও সমস্যাবলী আমার জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এ জন্য আমি তাদেরকে সাহায্য করার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। খিলাফত সম্বন্ধে এই মিথ্যা ধারণা দূর করার জন্য তোমাকে অবশ্যই সেই অংশটি প্রচার করতে হবে। ”

হুজুর আরও বলেন :

“প্রতিটি আহমদীর জীবনই আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। আমি ন্যাশনাল জামাত আমেলাকে নিয়মিতভাবে জার্মানীতে আশ্রয়প্রাপ্ত আহমদীদেরকে সাহায্য করার নির্দেশ দিয়েছি। জার্মানীর আহমদীদের বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত থাকা প্রয়োজন।  ”

হুজুরের নির্দেশমতো পুরো অংশটি প্রচার করা হয়। এর ফলে বিভিন্ন আহমদী যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তার ফলে হুজুরের কথা সম্পূর্ণ সত্য বলে প্রমাণিত হয়।

কিছু আহমদী সদস্য জানায় যে জার্মান জামাতের প্রতি হুজুরের নির্দেশে তারা অত্যন্ত আনন্দিত ও আশ্বস্তবোধ করছেন। তারা এখন জানেন যে যুগখলীফার সাহায্য এবং দোয়া তাদের সাথে রয়েছেন। এটি তাদের ভবিষ্যতে সাহস যোগাবে।

হুজুরের সাথে আমি প্রায় দশ মিনিট ধরে কথা বলি। আমি মনে করছিলাম কোনভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ হুজুরের কানে পৌছায়নি।

কিন্তু সকল নির্দেশনা প্রদানের পর হুজুর বলেন :

“চারপাশে এত কিসের শব্দ? তুমি কি ফোনে কথা বলার সময় তোমার বাচ্চাদের সাথে খেলছ? ”

আমি বলি :

“না হুজুর, আমি এখন সুপারশপে বাজার করতে বের হয়েছি এবং এখন গাড়ী পার্ক করার স্হান থেকে ফোনে কথা বলছি! ”

হুজুর আমার সাথে আরো কয়েক মিনিট কথা বলেন। আমি কি বাজার করেছি সেটিও জানতে চান।

অদ্ভূত উপহার

পরের শুক্রবার আমি এক অদ্ভূত উপহার নিয়ে ইসলামাবাদ যাই। হুজুরকে উপহার দেবার জন্য আমি কিছু ভাল মানের কোট হ্যাঙ্গার কিনেছি। আমি বুঝতে পারছিলাম যে উপহার দেবার জন্য কোট হ্যাঙ্গার দেখে সকলেই খুব অবাক হবে। এ কারণেই আমি সেগুলো লুকিয়ে রাখি, যেন কেউই ব্যাপারটি লক্ষ্য না করে।

কয়েক সপ্তাহ ধরেই আমি লক্ষ্য করছি যে হুজুরের কোট হ্যাঙ্গারগুলো প্লাস্টিকের তৈরী। আমি অনুমান করছিলাম যে হুজুর সেখানে তার আচকান কোট রাখেন। আমার মনে হলো প্লাস্টিকের হ্যাঙ্গারের কারণে হুজুরের কোটের আকার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এজন্য আমি এই নতুন কোট হ্যাঙ্গার নিয়ে আসি।

আমি হুজুরের অফিসে প্রবেশ করেই অবাক হয়ে যাই। কারণ হুজুরের পূর্বের প্লাস্টিক কোট হ্যাঙ্গারগুলো আর নেই। সেখানে এখন যে কোট হ্যাঙ্গার লাগানো হয়েছে সেগুলো অবিকল আমারগুলোও মতই। সেগুলো দেখে আমি আমার উপহারকে লুকানোর চেষ্টা করি। কারণ এখন আর এগুলোর কোন প্রয়োজন নেই।

যেকোন পরিস্হিতিতেই যুগখলীফাকে হ্যাঙ্গার উপহার প্রদান করা খুবই অদ্ভূত বিষয়। আর এখন তো সেটি দেবার কোন কারণই নেই। কারণ প্লাস্টিকের হ্যাঙ্গারগুলো পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে।

কিন্তু আমার সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও হুজুর আমার পাশে রাখা ব্যাগ লক্ষ্য করেন ও বলেন :

“তোমার সাথে এগুলো কি নিয়ে এসেছো? ”

আমি হুজুরকে পুরো ঘটনা ব্যক্ত করি। আমি পুরো ব্যাপারটি নিয়ে কিছুটা বিব্রতবোধ করছিলাম। কিন্তু হুজুর অত্যন্ত দয়া পরবশ হয়ে আমার তারিফ করেন।

হুজুর বলেন :

“উপহারের জন্য জা’যাকাল্লাহ্। আমার বাসায় এত হ্যাঙ্গার রয়েছে যে সেগুলো অফিসে আনা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি আমার কোটকে সেখানে ঝুলিয়ে রাখি না। তাই তুমি এগুলো তোমার কাছেই রেখে দাও। মনে কর আমি তোমাকে এগুলো উপহার দিয়েছি। ”

হুজুর আমার কাছে দাম জানতে চান। আমি বলি :

“হুজুর, ৮ টির দাম হল ৪.৫ পাউন্ড।”

হুজুর হেসে বলেন :

“আমি যেমনটি পূর্বেই বলেছি যে আমার বাসায় প্রচুর হ্যাঙ্গার পড়ে রয়েছে। তাই আমি তোমাকে এর চাইতেও ভাল অফার দিতে পারব। ৮ টির দাম হবে ৩.৫ পাউন্ড। ”

হুজুরের কথায় আমিও হেসে ফেলি। আমার সামান্য ও তুচ্ছ উপহারের প্রতিও হুজুর আমার প্রতি গভীর ভালবাসা প্রদর্শন করেন। এটি তার দয়া ও বিনয়ের এক অনুমপ নিদর্শন।

ঈমানের দৃঢ়তা

হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করেন আর কোন অফিসিয়াল বিষয়ে হুজুরের দিক নির্দেশনা প্রয়োজন রয়েছে কিনা।

আমি হুজুরকে একটি মিডিয়া রিপোর্টের কথা উল্লেখ করি। যেখানে পোপ ফ্রান্সিস গেয়ে বিবাহের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। হুজুর পূর্বে পোপ ফ্রান্সিসের বিভিন্ন বিবৃতির সাথে সহমত পোষণ করে প্রশংসা করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে হুজুর দ্বিমত পোষণ করেন।

হুজুর বলেন :

“সকল মানুষের মতো, গেয়ে মানুষদেরও সাধারণ অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু গেয়ে বিবাহকে বিশ্বের সকল ধর্মসমূহ পরিস্কারভাবে অবৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছে। পোপ ফ্রান্সিসের বক্তব্য এটিই প্রমাণ করে যে বর্তমান সমাজ ধর্ম থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। বিভিন্ন ধর্মসমূহ সমাজের চাপে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। মানবজাতিকে নির্দেশনা দেবার পরিবর্তে তারা নিজেরাই মানুষের নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে। কাজেই মিডিয়া যদি এ ব্যাপারে আমাদের মতামত জানতে চায় তাহলে উত্তরে বলবে ‘আমরা পবিত্র কোরআনের অনুসরণ করি এবং এর ফলে আমরা গেয়ে বিবাহকে সমর্থন করতে পারি না।’   ”

হুজুর আরো বলেন :

“মিডিয়ার সাথে আলোচনায় তুমি এবং তোমার দলকে সাহসিকতা প্রদর্শন করতে হবে। কিন্তু একইসাথে প্রজ্ঞার সাথেও কাজ করবে। কিছু মানুষ এবং সংগঠন ইসলামের প্রতি আমাদের দৃঢ়তার কারণে আমাদের বিরোধিতা করবে। কিন্তু কখনোই আল্লাহ্‌ ব্যতীত কাউকেই ভয় করবে না। এটিই প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এর জামাতের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আমরা প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত। আমরা আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীকে রক্ষা করব। সবসময় মনে রাখবে, সত্য আমাদের সাথে রয়েছে।”

ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলা এবং প্রকৃত ইসলামী প্রতিক্রিয়া

অক্টোবরের মাঝামঝি সময়ে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। ফ্রেঞ্চ শিক্ষক স্যামুয়েল প্যাটিকে একজন নামধারী মুসলমান নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর নাইস এলাকায় আর একটি সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। যেখানে তিনজন মানুষকে ছুরিকাঘাত করা হয়।

ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রন একটি বক্তব্যে ইসলামকে এক সংকটাপন্ন ধর্ম বলে আখ্যায়িত করার কিছুদিনের মধ্যেই এইসব হামলা সংঘটিত হয়। এছাড়াও ফ্রান্সের ম্যাগাজিন চার্লি হেবডো তে মহানবী(সাঃ) এর কুরুচিপূর্ণ কার্টুন এই সংকটকে আরো ঘনীভূত করে। সন্ত্রাসী হামলা পিছনে কুরুচীপূর্ণ কার্টুনের হাত রয়েছে এ ধরণের ইঙ্গিত পাবার পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বলেন :

“আমরা কোন অবস্হাতেই আমাদের কার্টুন পরিত্যাগ করব না।”

হুজুর পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ইসলামের সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষার উপর আমল করে সম্পূর্ণ বিষয়টির উপর প্রতিক্রিয়া দেখান।

সন্ত্রাসী হামলার পরপরই হুজুর ফ্রান্সের জামাতকে আক্রান্তদের প্রতি সহানুভূতি জানানোর এবং হামলার প্রতি তীব্র নিন্দা প্রকাশের নির্দেশ প্রদান করেন। যেহেতু তখন ফ্রান্সের জনগণ শোক ও ব্যথার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তাই সেসময় ইসলামের সহানুভূতি ও সৌহার্দ্যের শিক্ষার উপর আমল করা হয়।

কিন্তু হুজুর এক মুহুর্তের জন্যও কুরুচিপূর্ণ কার্টুনের কথা ভুলে যাননি। যা পুরো মুসলিম বিশ্বের জন্য তীব্র কষ্টের কারণ হয়েছে।

কাজেই, নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হবার পর হুজুর ইসলামের ব্যাপারে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের তীব্র সমালোচনা করেন। হুজুর অত্যন্ত সঠিক পন্থায় মহানবী(সাঃ) এর সম্মানকে রক্ষা করেন।

প্রথম সন্ত্রাসী হামলার পর হুজুরের নির্দেশে ফ্রান্সের খোদ্দামগণ স্যামুয়েল প্যাটিকে যেখানে হত্যা করা হয়েছে সেখানে যান। মহামারীর কারণে তারা বেশি সংখ্যায় সেখানে যেতে পারেন নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা মানুষের উপর গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হন। তারা ‘ভালবাসা সবার ত’রে, ঘৃণা নয়কো কারো প’রে ’ ব্যানার নিয়ে রাস্তায় হেটে যান। স্যামুয়েল প্যাটিকে যে স্কুলে হত্যা করা হয়েছে সেখানে ফুল দিয়ে আসেন। তারা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এই হামলাকে নিন্দা জানিয়ে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। তাদের এই প্রচেষ্টায় ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। নন মুসলিম এবং নন আহমদী সকলেই জামাতের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে স্বাগত জানান।

সবচাইতে উত্তম পরিকল্পনাকারী

নাইসে যখন দ্বিতীয় হামলা ঘটে, তখন কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমরা হুজুরের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করতে সক্ষম হই। আমরা একটি বিস্তারিত আর্টিকেলও প্রচার করি। যেখানে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে কিভাবে মহানবী(সাঃ) এর সম্মানকে সঠিক উপায়ে রক্ষা করতে হবে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত লেখা রয়েছে।

এ বিবৃতি পূর্বের দিন সন্ধ্যায় হুজুরের ডিকটেশনে লেখা হয়েছিল। আর্টিকেলটিও আমি হুজুরের নির্দেশে একদিন আগে লিখেছিলাম। ২৯ অক্টোবর ২০২০ তারিখে , প্রেস ও মিডিয়া ওয়েবসাইটে পাবলিশের কয়েক মুহুর্ত পূর্বেই নাইসে হামলার ঘটনা ঘটে।

কাজেই হুজুরের নির্দেশে সেই বিবৃতি কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। সেখানে নাইসের হামলার ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এভাবে মোক্ষম সময়ে হুজুরের বিবৃতি ও আর্টিকেলটি প্রচার করা হয়।

নাইসের হামলাটি প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমেই বহুল প্রচারিত হয়। এ কারণে আমরাও সেদিন অনেক প্রচারণা লাভ করি।

আলহামদুলিল্লাহ্‌, হুজুরের বিবৃতি অনেক সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করা হয়। একইসাথে, আমাদের প্রচারিত আর্টিকেলটি, যেখানে মহানবী(সাঃ) এর সম্মানকে সঠিক উপায়ে রক্ষা করার ব্যাপারে লেখা হয়েছে, সেটিও অমুসলমানগণ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে।

পরের দিন আমি হুজুরকে আমার কাছে এ ব্যাপারে যেসব প্রতিক্রিয়া এসেছে সে ব্যাপারে জানাই।

হুজুর বলেন :

“গতকাল আমি তোমাকে ফ্রান্সের হামলার উপর একটি বিবৃতির ডিকটেশন দিয়েছিলাম। একইসাথে তোমাকে একটি বিশদ আর্টিকেল লেখার জন্যও বলেছিলাম। গতকাল যেভাবে সকল ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, মনে হচ্ছে সবকিছুই মহান আল্লাহ্‌পাক ব্যবস্হা করে রেখেছিলেন। আল্লাহ্‌পাক জানতেন যে ভবিষ্যতে আর একটি বর্বর সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হতে যাচ্ছে। এবার আমার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই মহান আল্লাহ্‌তা’লা সব তৈরী করে রেখেছিলেন এবং এটি খুবই ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। অনেক মানুষ আমাদের জামাত সম্বন্ধে জানতে পেরেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে ইসলামের সাথে সন্ত্রাসী বা মৌলবাদের কোন সম্পর্ক নেই। ”

মহান আল্লাহ্‌পাক কিভাবে আমাদের সামান্য প্রচেষ্টাকে বরকতমন্ডিত করেছেন। সে ব্যাপারে হুজুরের মুখ থেকে বড়ই ঈমানউদ্দীপক। এটি নিশ্চিতভাবেই বোঝা যাচ্ছিল যে মহান আল্লাহ্‌পাকের সাহায্য আমাদের সাথে রয়েছে। কিন্তু হুজুরের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে শোনার পর আমি একইসাথে আনন্দিত হই এবং আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।

আমি হুজুরকে বলি যে কিছু মানুষ আমাকে বলেছেন যে সেদিন প্রেস ও মিডিয়া অফিস অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করেছে!

হুজুর আমাকে বিনয় এবং ক্রমাগত উন্নতি করার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। হুজুর বলেন :

“হ্যা, এটি সত্য যে আমরা সঠিক সময়ে বিবৃতি তৈরী করতে পেরেছিলাম। কিন্তু, এটি মহান আল্লাহ্‌পাকের সাহায্যের কারণেই সম্ভব হয়েছে। তুমি বলেছ যে কিছু নন মুসলিম আমার বিবৃতির প্রশংসা করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, তুমি কি তাদের সাথে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছো? তুমি কি স্হানীয় জামাতকে তাদের সম্বন্ধে তথ্য প্রদান করেছো; যেন জামাত তাদের মাঝে তবলীগ করতে পারে? আমার বিবৃতির যতগুলো অনুবাদ করা সম্ভব সেটি কি করা হয়েছে? আমি এটি আশা করি না যে তুমি তোমার বর্তমান কাজে সন্তুষ্ট হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে। বরং, প্রতিটি সাফল্যের পরই তোমার পরবর্তী অর্জনের প্রতি চিন্তা করা উচিৎ। অতীতের সফল্যের কথা চিন্তা না করে, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে ভাবা উচিৎ। ”

হুজুর আরো বলেন :

“সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য স্হানে যদি কোন অমুসলমান বা নন-আহমদী আমাদের কোন বার্তার প্রশংসা করে। তাহলে দায়িত্বরত ব্যক্তির তাদের সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ। যদি তার পক্ষে যোগাযোগ করা সম্ভব না হয় তাহলে স্হানীয় জামাতের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। যেন তারা জামাতের ব্যাপারে আরও আগ্রহী হয়। যেন তারা প্রকৃত ইসলাম সম্বন্ধে জানতে পারে। যদি এই উদ্দেশ্য, আবেগ ও একাগ্রতার সাথে কাজ কর, একমাত্র তখনই বলা যাবে যে তোমরা দক্ষতার সাথে কাজ করছ! ”

হুজুরের বক্তব্য আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় শিক্ষা। যেভাবে হুজুর বলেছেন যে আমাদের তবলীগী কার্যক্রমের সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রকৃত ইসলাম প্রচারে অতীতের সাফল্যে সন্তুষ্ট হয়ে কখনো অলস হয়ে বসে থাকা যাবে না। বরং হুজুরের ইচ্ছা, আমরা যেন ভবিষ্যতে ক্রমাগত উন্নতি লাভ করতে থাকি।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি

ফ্রান্সের হামলার প্রেক্ষিতে আমাদের খলীফার প্রতিক্রিয়া অন্যান্য নেতাদের প্রতিক্রিয়ার চাইতে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী।

এখানে বিশেষভাবে মিশরের প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্য। স্যামুয়েল প্যাটির হত্যার পর কুরুচিপূর্ণ কার্টুন প্রচারের প্রতিবাদে মিশরের প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সের সকল পণ্য বয়কট করার আহবান জানান।

হুজুরের সাথে এক মোলাকাতের সময় আমি হুজুরকে এ বিষয়ে উল্লেখ করি। হুজুর বলেন :

“ফ্রান্সের সকল পণ্য বয়কট করা কোন যুক্তিযুক্ত সমাধান নয়। বর্তমানে পুরো বিশ্ব ওতোপ্রতোভাবে সকলের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে এই প্রচেষ্টা অবশ্যই ব্যর্থ হবে। এছাড়া লাখ লাখ মুসলমান ফ্রান্সে বসবাস করে। তারা কি করবে? তারা তো  নিজেদের দেশের সকল পণ্য কেনা বন্ধ করতে পারে না। ডেনিশ পত্রিকায় মহানবী(সাঃ) এর কার্টুন প্রকাশ হবার পরও এরকম বয়কটের আহবান জানানো হয়েছিল। কিন্তু, তখনও আমি বলেছিলাম যে এটি একটি আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত। এটি কোন যুক্তিযুক্ত সমাধান নয়।  ”

একজন প্রকৃত মুসলমান কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে এ ব্যাপারে হুজুর বলেন :

“আমাদের প্রতিক্রিয়া হবে মহানবী(সাঃ) এর প্রকৃত চরিত্রকে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্হাপন করা। আর এটি কোন নতুন বিষয় নয়। বরং প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ)এর সময়ে উম্মাহাতুল মোমেনীন যেখানে মহানবী(সাঃ) ও তার সম্মানিত স্ত্রী গণকে নিয়ে অত্যন্ত বাজে বক্তব্য দেয়া হয়েছে। তার প্রতিক্রিয়াতে প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এই পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন।  ”

হুজুর বলেন :

“একইভাবে, হযরত মুসলেহ মাউদ(রঃ) এর সময়েও রঙ্গিলা রাসূল নামে এক ভয়ংকর বই লেখা হয়। যেখানে মহানবী(সাঃ) এর পবিত্র চরিত্র নিয়ে বাজে মন্তব্য করা হয়েছে। সে সময় বয়কট ও অরাজকতা সৃষ্টি না করে হযরত মুসলেহ মাউদ(রঃ) জলসা ও সমাবেশের মাধ্যমে মহানবী(সাঃ) এর পবিত্র চরিত্র বিশ্বের সামনে উপস্হাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ”

হুজুর মিশরের প্রেসিডেন্টের আচরণের পিছনে তার সুপ্ত আকাঙ্খার কথা উল্লেখ করেন। হুজুর বলেন :

“প্রকৃত কথা হল মিশরের প্রেসিডেন্ট এই বিষয় নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছেন। তিনি এ সুযোগে মুসলিম বিশ্বে তার নিজের অবস্হানকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছেন। এটি পরিস্কার যে তিনি নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। ”

হুজুর বলেন :

“আহমদী হিসেবে, মানব সৃষ্ট খিলাফত অথবা ইসলামের নামধারী কোন রাজনীতিবিদকে গ্রহণ করার কোন ইচ্ছা আমাদের নেই। আমরা সকল বিষয়ে একমাত্র মহান আল্লাহ্‌পাকের নির্দেশই পালন করব। সেটি হল মহানবী(সাঃ) কে মানা এবং প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এর শিক্ষার অনুসরণ করা। যিনি মহানবী(সাঃ) এর ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী পৃথিবীতে এসেছেন।  ”

ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে বার্তা

মহানবী(সাঃ) এর পবিত্র চরিত্রের উপর যে আক্রমণ করা হয়েছে যেখানে তাকে নাউযুবিল্লাহ্ সন্ত্রাসী ও যুদ্ধবাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে; কারো মনে যেন এই ভুল ধারণা না আসে যে এ নিয়ে হুজুরের মনে কোন কষ্ট নেই।

কাজেই, ৫ নভেম্বর ২০২০, তারিখে হুজুর আমাকে বলেন যে এবার সমগ্র অমুসলিম বিশ্বকে একটি শক্তিশালী বার্তা দেবার সময় চলে এসেছে।

হুজুর বলেন :

“আমরা অমুসলমানদের পক্ষে যথেষ্ট বক্তব্য প্রদান করেছি। নন-মুসলমান বিশ্ব মুসলমানদের উপর যে অত্যাচার করছে তার জবাব দেবার সময় হয়েছে।  ”

হুজুর আমাকে আর কিছু বলেন নি। কিন্তু আমার মনে হল  এ ব্যাপারে হুজুর সামনের জুমআর খুৎবায় বক্তব্য দেবার পরিকল্পনা করছেন।

হুজুর অত্যন্ত দক্ষতা ও আবেগের সাথে ইসলামের পক্ষে বক্তব্য দেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের উক্তি যে ইসলাম সংকটে রয়েছে এর জবাবে হুজুর বলেন :

“তার বক্তব্যে তিনি (ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট) বলেছেন যে ইসলাম হচ্ছে ‘সংকটপূর্ণ’ ধর্ম। কিন্তু একটি বিষয় আমি পরিস্কারভাবে বলে দিতে চাই। যদি কোন সংকট থেকে থাকে, তাহলে সেটি তাদের নিজেদের ধর্মেই রয়েছে। অবশ্য যদি তারা কোন ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকে তাহলেই। ইসলামের সম্বন্ধে আমি বলছি যে এটিই একমাত্র জীবন্ত এবং ক্রমবর্ধমান ধর্ম। মহান আল্লাহ্‌পাক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে ইসলাম পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এর জামাতের প্রচেষ্টায় এই জামাত বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।  ”

হুজুর আরো বলেন :

“একজন ব্যক্তির ভুল কর্মকান্ডকে ইসলামের সাথে জুড়ে দেয়া, ইসলামকে সংকটের ধর্ম বলে আখ্যায়িত করা, জনগণকে ইসলামের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া, এসকল কাজ কোন দেশের প্রেসিডেন্টের পক্ষে শোভা পায় না। ”

মহানবী(সাঃ) এর চরিত্র নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কার্টুন সম্বন্ধে হুজুর বলেন :

“নিঃসন্দেহে, এ ধরণের কার্টুন প্রত্যেক মুসলমানের হদয়কেই ক্ষত বিক্ষত করে। যদি তারা এ ধরণের ঘৃণ্য কাজ অব্যাহত রাখে , তাহলে তারাই উস্কানীমূলক কর্মকান্ড করছে বলে প্রমাণিত হবে। আইনের মধ্য থেকে আমরা সবসমই এ ধরণের কাজের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছি। ইসলাম ও মহানবী(সাঃ) এর উপর আরোপিত সকল আপত্তির জবাব দিয়ে আসছি এবং ভবিষ্যতেও দিয়ে আসব। ”

হুজুর মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর ব্যর্থতা সম্বন্ধেও বলেন:

“মুসলমানগণ যদি কোন স্হায়ী সমাধান চায় তাহলে সকল মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যদি সকল মুসলিম দেশসমূহ একটি কন্ঠের মাধ্যমে কথা বলত, তাহলে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ক্ষমা প্রার্থনা করতে এবং তার বিবৃতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হতেন। যাহোক, আমি একটি বিষয়ে পরিস্কারভাবে বলতে চাই যে সকল মুসলিম বিশ্বকে, অন্ততপক্ষে নন মুসলিম বিশ্বের সাথে কথা বলার সময় ঐক্যবদ্ধ হয়ে কথা বলা উচিৎ। তাহলে দেখা যাবে তারা কিরকম ইতিবাচক ফলাফল আনতে সক্ষম হয়!  ”

হুজুরের সামনে অনুবাদ পেশ করা

হুজুরের খুৎবার পর আমাদের অফিস ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের সম্বন্ধে যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটির অনুবাদ নিরীক্ষার জন্য হুজুরের সামনে পেশ করি।

হুজুর বলেন :

“আমি যা বলেছি তুমি তো সেটিই অনুবাদ করেছো। তাহলে আমার নিরীক্ষা করার কি প্রয়োজন?”

আমি হুজুরকে বলি :

“হুজুর, প্রচারের পূর্বে আমার অনুবাদ সঠিক আছে কিনা সেটি আমি নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম। ”

নিরীক্ষার পর হুজুর অনুমোদন দেন এবং বলেন :

“আমার খুৎবা লাইভ সম্প্রচার করা হয়েছিল। আমি নিশ্চিত কিছু মানুষ ইতোমধ্যেই সে অংশের অনুবাদ করেছে এবং শেয়ার করেছে।  ”

আমি বলি :

“হুজুর, আমি কেবল আমার অফিসের জন্যই দায়বদ্ধ। হুজুর এখানে অত্যন্ত কঠোর বক্তব্য দিয়েছেন। কিছু নন-মুসলিম যারা বাকস্বাধীনতার কথা বলে তারা এর সমালোচনা করতে পারে। এ কারণেই, আমি আপনার অনুমোদন ব্যতীত এটি প্রচার করতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করছি না।”

হুজুর হেসে বলেন “ঠিক আছে।”

এরপর হুজুর বলেন :

“আমার বক্তব্যের জন্য আমি কোন ব্যক্তি বা সরকারের কোন পরোয়া করি না। আমি কারো সমালোচনার জন্য ভীত নই। সত্য প্রচার করাই আমার একমাত্র লক্ষ্য। আমাদের বিশ্বাসের প্রতি সাহস থাকা প্রয়োজন। মনে রাখবে, সবাইকে কখনোই সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। কেউ আমার বক্তব্য পছন্দ করবে, কেউ করবে না। কিন্তু, আমার একমাত্র লক্ষ্য হল মহানবী(সাঃ) এর সম্মানকে রক্ষা করা। নিজেদের ভুল সম্বন্ধে পশ্চিমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া। তাদেরকেও সততার সাথে কাজ করা উচিৎ। মুসলিম বিশ্বের প্রতিও আমার একই বার্তা।  ”

আমার মনে হল হুজুর হয়ত আমার প্রতি কিছুটা হতাশ হয়েছেন। হুজুর হয়ত মনে করেছেন আমি নন মুসলমানদের সমালোচনার ব্যাপারে কিছুটা ভীত। পুরো সন্ধ্যায় আমার মাথায় এটিই ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমি সেদিন ইসলামাবাদ থেকে অত্যন্ত ভারী হৃদয় নিয়ে বাসায় ফিরলাম।

সুইজারল্যান্ডের ন্যাশনাল আমেলার সাথে ভার্চুয়াল মোলাকাত

পরদিন সুইজারল্যান্ডের ন্যাশনাল আমেলা এবং মোবাল্লেগদের সাথে ভার্চুয়াল মোলাকাতের জন্য আমি ইসলামাবাদ যাই। আলহামদুলিল্লাহ্, মিটিং সফলভাবেই সমাপ্ত হয়।

হুজুরকে একজন প্রশ্ন করেন যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আহমদীগণ কিভাবে ক্ষতিগ্রস্হ হবেন।

হুজুর বলেন :

“এটি একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। আল্লাহ্‌ না করুন, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে আহমদীগণও কিছু পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্হ হবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগের যুদ্ধের প্রতি লক্ষ্য করুন। মহান আল্লাহ্‌পাক মুসলমানদের বিজয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলমান সাহাবাগণ কি শাহাদাত লাভ করেন নি? কাজেই প্রকৃতির নিয়মকে কোনভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়।  ”

হুজুর আরো বলেন :

“বর্তমান যুগে প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এর সত্যতা এবং মানজাতিকে সতর্কতা প্রদানের নিদর্শন স্বরূপ এসকল প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও মহামারীর আগমন হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে কিছু আহমদীও ক্ষতিগ্রস্হ হচ্ছে। কিন্তু, আমরা যদি মহান আল্লাহ্‌পাকের সাথে দৃঢ় ও অবিচল সম্পর্ক স্হাপন করি, তাহলে অন্যানদের তুলনায় জামাতের ক্ষতিগ্রস্হ সদস্যদের সংখ্যা অত্যন্ত কম হবে, ইনশাল্লাহ্‌।  ”

বিশ্বের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে হুজুর বলেন :

“নিশ্চিতভাবেই অন্যান্যদের সতর্ক করা আমাদের দায়িত্ব। মানবজাতিকে মহামারী, যুদ্ধ এসব ভয়ংকর পরিক্ষার প্রকৃত কারণ সম্বন্ধে অবহিত করতে হবে। কারণ মানবসমাজ তাদের স্রষ্টাকে ভুলে গিয়েছে। পারস্পরিক অধিকার প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে যুদ্ধ হলেও তারা এটি মনে করবে। যে অন্তত একটি জামাত তাদেরকে এ ব্যপারে সতর্ক করেছিল। পরিশেষে তারা মহান আল্লাহ্‌পাকের প্রতি মনোনিবেশ করবে।   ”

সত্যের পথকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরো

মিটিং এর পর মুনীর জাভেদ সাহেব হুজুরের সাথে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করার জন্য হুজুরের রুমে আসেন। এ কারণে আমি হুজুরকে সালাম দিয়ে দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু এক মিনিট পর মুনীর জাভেদ সাহেব বেরিয়ে এসে আমাকে বলেন যে হুজুর আমাকে ডাকছেন।

হুজুর আমাকে ‘হুজুরের সাথে এ সপ্তাহে’ প্রচারিত পর্বে বিষয়ে কোন প্রতিক্রিয়া আছে কিনা সেটি জানতে চান। এই পর্বে জামেআ আহমদীয়া ইন্দোনেশিয়ার সাথে হুজুরের মিটিং সম্বন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে।

হুজুরকে এ ব্যাপারে জানানোর পর আমি বলি যে গত দিনের জুমআর খুৎবার বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।

হুজুর বলেন :

“আমার বিবৃতি নিয়ে তোমার অস্বস্তির কারণ আমি এখনো বুঝতে পারছি না?”

হুজুরের বক্তব্যে আমার আশংকাই সত্য বলে প্রমাণিত হল। হুজুর মনে করেছেন যে আমি হুজুরের বিবৃতি প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছি। এতে আমি লজ্জিত হলেও এই চিন্তা করে খুশি হলাম যে এখন আমি আমার মনের প্রকৃত কথা বলতে পারব।

আমি হুজুরকে বললাম :

“হুজুর আমি আপনার কোন বক্তব্য প্রকাশ করতে কোনরকম দ্বিধা বা অস্বস্তিবোধ করি না, নাউযুবিল্লাহ্‌। আমি আপনার কোন বাক্য ভুল বুঝেছি কিনা সেটিই আমার একমাত্র ভয়। সঠিক অনুবাদ করতে পেরেছি কিনা সেটির কারণেই আমার কিছুটা অস্বস্তি থেকে গিয়েছিল।  ”

এটি শুনে হুজুর হাসেন এবং আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।

হুজুর অত্যন্ত দয়া পরবশ হয়ে বলেন :

“মাশাআল্লাহ্‌, তোমার অনুবাদের মান এখন অনেক উন্নত। তুমি আমার কথার অর্থ সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পেরেছো। ”

প্রকৃত সত্য হল বহু বছর ধরে হুজুরের প্রশিক্ষণের ফলেই আমি উর্দু থেকে ইংরেজী অনুবাদ করার সামর্থ্য অর্জন করেছি। আমার পরিচিত সকল মানুষই জানেন যে কথা বলার সময় আমি প্রচূর ভুল উর্দু বলে থাকি।

এরপর হুজুর বলেন :

“যদিও আমি আশা করব, আমার প্রশংসার পরও তুমি বিনয়ী থাকবে। কারণ অহংকার মানুষের পতনের কারণ হয়।”

হুজুর বলেন :

“মহান আল্লাহ্‌পাক ব্যতীত কাউকেউ ভয় পাবার কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের কেবল সত্য বলতে হবে। ”

ফোনের মাধ্যমে এডিট

২৯ অক্টোবর ২০২০ তারিখ সকালে হুজুর আমাকে ফোন করেন। গত দিন আমি হুজুরের অনুমোদনের জন্য ‘হুজুরের সাথে এ সপ্তাহ’ এর একটি পর্ব পেশ করেছিলাম। হুজুর ফোনের মাধ্যমে সে ব্যাপারেই দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।

সেখানে মরিশাসের মজলিসে আমেলার সাথে হুজুরের ভার্চুয়াল মোলাকাতের কিছু অংশ ছিল। কিছু অংশে এডিটিং এর প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে হুজুর আমার মতামত জানতে চান। ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন মতামত ছিল না। কিন্তু আমার দলের একজন সদস্য হুজুরের কাছে একটি বিষয়ে মতামত চাইতে বলেন। এক স্হানে হুজুর বাগানে কোন ফল গাছ লাগানো যায় সে বিষয়ে বলছিলেন। সেখান হুজুর বলেন :

“আমার মতে লিচু ফলনের প্রতি তোমাদের মনোযোগ দেয়া উচিৎ। লিচু আমার খুব পছন্দ। কাজেই অন্যান্য ফলের চাইতে বেশি করে লিচু লাগানো উচিৎ। এছাড়া, অন্যান্য ফলের চাইতে লিচুতে লাভও বেশি। ”

হুজুর জানতে চান যে এ মন্তব্যে কি সমস্যা রয়েছে। হুজুর বলেন :

“এটি এডিট করার কোন প্রয়োজন নেই। হ্যা, আমি বলেছি যে লিচু আমার পছন্দের একটি ফল। কিন্তু একইসাথে আমি এটিও উল্লেখ করেছি যে এটি অন্যান্য ফলের তুলনায় জামাতের জন্য বেশি লাভ নিয়ে আসবে। কারণ মরিশাসের লিচু অত্যন্ত উন্নতমানের।”

“আমি এখন তোমাকে যা বলছি সেটি স্মরণ রাখবে – মাঝে মধ্যে আমি এমটিএ কে কিছু শব্দ বা বাক্য এডিট করার অনুমতি দেই। কারণ সেখানে কোন ব্যকরণগত ভুল, লম্বা বিরতি অথবা পুনরাবৃত্তি থেকে থাকে। কিন্তু আমি কখনো অন্যদের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে কোন অংশ এডিট করতে বলি না। যদি কেউ আমার এই বক্তব্যের সাথে একমত না হয়, সেটি তাদের সমস্য। সেটি আমার কোন সমস্যা নয়। ”

“তুমি কি বুঝতে পেরেছো?”

আল্লাহ্‌র নূর

প্রোগাম নিয়ে আলোচনার পর আমি মনে করছিলাম হুজুর এবার ফোন রেখে দিবেন। কিন্তু হুজুর আমার প্রতি অত্যন্ত দয়া করে আরো কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলেন। হুজুর মোবারক মসজিদের একটি ছবি পাঠান যেখানে মসজিদের উপরে অত্যন্ত সুন্দর একটি রংধনু উঠেছে। ছবিটি একজন তরুণ মোবাল্লেগ উঠিয়েছেন।

এরপর হুজুর আরো কয়েকটি ছবি প্রেরণ করেন। যার মধ্যে একটি হল ইসলামাবাদের ভোরের সময়ে উঠানো। সেটি আমার খুবই পছন্দ হয়। আমি বলি

“হুজুর এটিতো পুরস্কার পাবার যোগ্য।”

হুজুর বলেন :

“রংধনুর ছবিটিও পুরস্কার পাবার যোগ্য।”

হুজুর আর একটি ছবি শেয়ার করেন যেটি ছিল রাতের সময়ে মোবারক মসজিদের ছবি। সেখানে মসজিদের ডোমের উপর সুন্দর আলো বের হচ্ছিল। হুজুরকে আমি বলি যে আমার মনে হচ্ছে মোবারক মসজিদের ছাদে একটি লাইটবাল্ব লাগানো রয়েছে।

হুজুর বলেন :

“যে আলো তুমি দেখছো সেটি কোন কৃত্তিম আলো নয়। বরং মহান আল্লাহ্‌পাক মসজিদকে আলোকিত করে রেখেছেন। ”

আমি আরো গভীরভাবে ছবিটি লক্ষ্য করি এবং বুঝতে পারি যে আলোটি প্রকৃতপক্ষে চাঁদের আলো।

কথা শেষ করার কয়েক মিনিট পর আমি পুনরায় ছবিটির প্রতি দৃষ্টি দেই এবং হুজুরের সুন্দর মন্তব্যের কথা চিন্তা করি। নিঃসন্দেহে, মহান আল্লাহ্‌পাকের আলো সর্বদাই খলীফাকে নির্দেশনা দিয়ে আসছে এবং নিরাপত্তা প্রদান করছে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২০

৩ নভেম্বর ২০২০ তারিখে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দিন যতই এগিয়ে আসতে থাকে, আমার তখন চার বছর পূর্বের নির্বাচনের কথা মনে হয়। যখন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন হুজুর ৬ সপ্তাহের বরকতময় কানাডা সফরের জন্য ক্যালগেরিতে পৌঁছেছিলেন।

এ বছর আমেরিকার জামাত আশা করছিল যে হুজুর হয়ত শরতের শেষ দিকে আমেরিকায় সফর করবেন। কারণ এ বছর আমেরিকাতে আহমদীয়া জামাতের শতবর্ষ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। মহামারীর পূর্বে আমি চিন্তা করছিলাম যে হুজুর হয়ত নির্বাচনের সময় আমেরিকা সফরে যেতে পারেন।

কিন্তু, দ্রুতই এটি পরিস্কার হয়ে যায় যে এ বছর বিদেশ ভ্রমণের কোন সম্ভাবনাই নেই। অন্যান্য অনেকের মতো আমিও আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে হুজুরের মতামতের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম।

গত বছর, কয়েকবার আমি আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে হুজুরকে প্রশ্ন করেছি। মহামারীর পূর্বে হুজুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে যদি সবকিছু এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে তাহলে ট্রাম্প হয়তো পুনরায় নির্বাচিত হবেন। কিন্তু কোভিড পরিস্হিতিতে একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে যায়। ট্রাম্প মহামারী পরিস্হিতি সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারেন নি। তিনি করোনাভাইরাসকে গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করেননি। এর ফলে তিনি এর বিস্তার রোধে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। হুজুর ইঙ্গিত দেন যে এবার নির্বাচনে কঠিন লড়াই হবে।

নির্বাচনের দিন হুজুরের সাথে ফোনে কথা বলার সময় আমি হুজুরকে জানাই যে ফাইনাল পোল দেখে মনে হচ্ছে জো বাইডেন এবার প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন।

হুজুর বলেন :

“পোলের হিসাব যাই হোক না কেন; আমি মনে করি এবারের নির্বাচন ৫০-৫০ হবে। ফলাফল তাৎক্ষনাত সামনে আসবে না। যেই নির্বাচিত হোক না কেন, আমেরিকার ভবিষ্যত খুব ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে না। যদি বাইডেন জিতে যান তাহলে ট্রাম্প সেটি মেনে নিবেন না। তার সমর্থনকারীরা উত্তেজিত হয়ে উঠবে। কিছু উগ্রপন্থী রাস্তায় নেমে আসতে পারে। এতে ঘৃণা ও বিভেদ আরো বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে, যদি ট্রাম্প জিতে যায় , তাহলে সে দাবি করবে তার নীতির কারণেই সে জয়লাভ করেছে। এর ফলে সে অভিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি আরো কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করবে।  ”

নির্বাচনের তিন দিন পর, ৬ নভেম্বর তারিখেও প্রেসিডেন্টের কোন ঘোষণা আসে নি। খুব ধীর গতিতে বিভিন্ন ফলাফল আসছিল। যদিও মনে হচ্ছিল যে বাইডেনই হয়ত এবার জয়লাভ করছেন। সেদিন শুক্রবারের মোলাকাতের সময় হুজুর বলেন :

“আমার মনে হয় ইচ্ছে করেই নির্বাচনের ফলাফল ধীর গতিতে প্রকাশ করা হচ্ছে। এর ফলে বিভিন্ন স্টেটের গভর্নর ও পুলিশ যে কোন বিশৃঙ্খলার জন্য প্রস্তুতি নেবার সময় পাবে। এছাড়া, এখানে ট্রাম্পবিরোধী সরকারি কর্মকর্তার প্রতিশোধের কোন ব্যাপার থাকতে পারে। তারা হয়ত ইচ্ছে করেই নির্বাচনকে দীর্ঘায়িত করছেন। কারণ তারা জানেন যে ট্রাম্পের জন্য এই ধীর গতির হারকে মেনে নিতে আরো বেশি কষ্ট হবে। ”

হুজুরের বিশ্লেষণ অত্যন্ত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন। নির্বাচনের রাতে , ট্রাম্প অনেক স্টেটে এগিয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল তিনি আবারও জয়লাভ করবেন। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দিনে বাইডেন এগিয়ে যান এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাই বলা যায় যে পোলের তুলনায় কঠিন লড়াই হয়েছিল।

ধীর গতিতে নির্বাচনের ফলাফলও উপকারী বলে প্রমাণিত হয়। প্রথম দিনই যদি বাইডেন নির্বাচিত হতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই আবেগপ্রবণ ট্রাম্প সমর্থকগণ রাস্তায় নেমে আসতেন।  

যদিও , পরবর্তী সপ্তাহে ট্রাম্প ও তার সমর্থকগণ নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে দাবী করেন। ৬ জানুয়ারী, ২০২১ তারিখে ক্যাপিটল হিলের আমেরিকার কংগ্রেসে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। পুরো বিশ্ব সেই অরাজকতা প্রত্যক্ষ করে যা আমেরিকার জন্য লজ্জ্বার কারণ হয়।

আল্লাহ্‌র প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস – হুজুরের দাদার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

তখন ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিক। আমি হুজুরকে একটি ডকুমেন্টারী সম্বন্ধে জানাই। যেটি প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এর ছেলে হযরত মির্যা বশীর আহমদ(রঃ) কে নিয়ে তৈরী করা হচ্ছে। আমি বলি যে সেটি প্রায় প্রস্তুত।

আমি জানাই যে সেখানে প্রতিশ্রুত মসীহ মাউদ(আঃ) এর পরিবারের একজন বয়স্ক সদস্যের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। সেখানে তিনি বর্ণনা করেন যে হুজুরের দাদা, হযরত মির্যা শরীফ আহমদ(রঃ) মুক্ত হস্তে অর্থ দান করতেন।

তিনি বলেন যে ব্যাপারটি হযরত মির্যা বশীর আহমদ(রঃ) কে চিন্তিত করে তুলে। যে এর ফলে তিনি দেনায় ডুবে যেতে পারেন।

হুজুর বলেন :

“হযরত মির্যা বশীর আহমদ(রঃ) এ ব্যাপারে কতটা চিন্তিত ছিলেন সেটি আমার জানা নেই। কিন্তু আমি জানি যে আব্বা জান (হযরত মির্যা শরীফ আহমদ(রঃ)) অনেক দানশীল ছিলেন। মহান আল্লাহ্‌পাকের প্রতি তার অসাধারণ বিশ্বাস ছিল। তিনি সবসময় নিশ্চিত থাকতেন যে মহান আল্লাহ্‌পাক তার সকল আর্থিক চাহিদা পূর্ণ করবেন।  ”

হুজুরের দাদা হযরত মির্যা শরীফ আহমদ(রঃ) এর একটি ঘটনা সম্বন্ধে হুজুর বলেন :

“আব্বাজানের জমির ফার্ম ম্যানেজার আমাকে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। একবার তিনি আখ বিক্রির একটি মোটা অর্থ আব্বাজানকে প্রদান করেন। একজন দরিদ্র, ছোট কৃষক দূর থেকে সেটি লক্ষ্য করেন। তাই আব্বাজান যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন তিনি তার রাস্তার সামনে এসে দাড়ান। সে আব্বাজানের কাছে তার চরম আর্থিক দুরবস্হার কথা ব্যাখ্যা করে। সে বলে যে তার মেয়ে বিয়ে দিতে হবে এবং এ জন্য খরচ করার জন্য তার হাতে কোন অর্থই নেই। এটি শুনে কোনরকম চিন্তা না করেই আব্বাজান তার কাছের সকল অর্থ প্রায় ৬০০ রুপী তাকে দিয়ে দেন। সে সময় এটি অনেক মোটা অর্থ ছিল। এটি তার জীবনের দানশীলতার একটি মাত্র ঘটনা। তার জীবনে এ ধরণের আরো অনেক ঘটনা রয়েছে।”

হুজুর বলেন :

“একইভাবে, আব্বাজান কোন কাজের জন্য ১৯৪০ সালে ইউকে তে আসেন। কাজের জন্য তিনি একজন সহকারী নিয়োগ দেন। কাজের সকল বিল জমা হচ্ছিল এবং একদিন সহকারী তাকে জানান যে বিল পরিশোধ করার কোন অর্থ অবশিষ্ট নেই। সে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্হ ছিল। কিন্তু আব্বাজান তাকে শান্তভাবে বলেন ‘দুশ্চিন্তার কিছু নেই, আল্লাহ্‌পাক সব ব্যবস্হা করে দিবেন। ’ ”

হুজুর পরম ভালবাসার সাথে তার দাদার এই ঘটনা বর্ণণা করছিলেন। হুজুর বলেন :

“পরবর্তীতে, তিনি রাস্তায় হাটছিলেন। একজন অপরিচিত ব্যক্তি তাকে দেখতে পান। তিনি আব্বাজানের চেহারা ও জ্যোতি দেখে আভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি আব্বাজানের দিকে নির্দেশ করেন এবং জোরে জোরে বলতে থাকেন ‘সাধু! সাধু!’ এরপর সেই ব্যক্তি আব্বাজানের হাতে একটি খাম ধরিয়ে দেন। আব্বাজান সেটি তার সহকারীকে দিয়ে বলেন যে এতে সকল বিল পরিশোধ হয়ে যাবে। খামটি খুলে সে অত্যন্ত অবাক হয়ে যায়। কারণ সেখানে বিল পরিশোধের জন্য যত অর্থ প্রয়োজন ঠিক সে পরিমাণ অর্থই ছিল। এভাবে মহান আল্লাহ্‌পাক আব্বাজানের প্রয়োজনীয়তার ব্যবস্হা করে দেন। ”

ইসলামের খলীফা নিয়ে সমালোচনা

গত কয়েক মাসে পাকিস্তানের আহমদীদের অবস্হা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে। জামাতের সদস্যদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছিল। জামাতের যে কোন পাবলিকেশন এবং অনুষ্ঠানের উপর সংঘবদ্ধভাবে বাধা প্রদান করা হচ্ছিল।

ডিসেম্বর মাস থেকে পুরো বিশ্বের চোখে জামাতকে ছোট করার নতুন এক প্রচেষ্টা শুরু করা হয়। গুগোলের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে জামাতের সাথে জড়িত ইসলামিক বিষয়কে বন্ধ করার অপচেষ্টা চালানো হয়।

এতে কোন সন্দেহ নেই, যে এই ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের জন্য হুজুরের মনে তীব্র কষ্ট ও ব্যথা ছিল। এ জন্য হুজুর নিয়মিতভাবে বিশ্বের আহমদীদেরকে পাকিস্তান ও আলজেরিয়ার আহমদী ভাই-বোনের জন্য দোয়ার আহবান জানান।

কিন্তু, মহান আল্লাহ্‌পাকের প্রতি হুজুরের দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। হুজুর নিশ্চিতভাবেই মনে করেন যে একমাত্র আল্লাহ্‌পাকের দয়া ও অনুগ্রহের কারণেই আমাদের বিজয় লাভ হবে।

সম্প্রতি আহমদীর বিরুদ্ধবাদীগণ এক নতুন অভিযান শুরু করে। অনলাইনে ইসলামের খলীফা লিখে সার্চ দিলে হুজুরের নাম সবার প্রথমে চলে আসে। বিষয়টিতে তারা অত্যন্ত রাগান্বিত হয়।

কয়েক সপ্তাহ পূর্বে আমি গুগোল ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতে যোগাযোগ করার জন্য হুজুরের অনুমতি প্রার্থনা করি। আমার চিন্তা ছিল আমরা যদি আমাদের দাবি পেশ না করি তাহলে তারা মনে করতে পারে যে আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তিগুলো কোন জবাব আমাদের কাছে নেই।

হুজুর বলেন :

“হ্যা, তুমি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পার। আমাদের পরিচিতি, বিশ্বাস এবং আমাদের উপর যে অত্যাচার চালানো হচ্ছে সে সম্বন্ধে তাদেরকে জানাও। তাদেরকে একটি বিষয় পরিস্কারভাবে জানিয়ে দাও। যদি তারা এসকল উগ্রপন্থীদের সামনে মাথা নত করে তাহলে তারাও নিরপরাধ আহমদীদের বিরুদ্ধে অত্যাচারে সামিল হবে।”

আমি হুজুরকে বলি যে মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়া ইউকে এক নতুন সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন শুরু করতে যাচ্ছে। যেখানে খিলাফতের বরকত সম্বন্ধে আলোকপাত করা হবে। তারা সেখানে ‘ইসলামের খলীফা’ শব্দটি ব্যবহার করতে চাইছে। পূর্বে হুজুর তার জন্য এই শব্দটি ব্যবহার করতে নিষেধ করেছিলেন।

হুজুর বলেন :

“তারা সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন করতে পারে। কিন্তু ‘ইসলামের খলীফা’ বা ‘খলীফা অফ ইসলাম’ এগুলো ব্যবহার করা যাবে না। বিরুদ্ধবাদীরা আমাকে এই পরিভাষা থেকে দূর করতে চাচ্ছে। তার মানে এই নয় যে আমি এখন সেটি ব্যবহার করব। আমি তোমাকে পূর্বেও বলেছি যে আমার উপাধি হল ‘খলীফাতুল মসীহ’। আমি কখনো পুরো মুসলিম উম্মাহ্‌র নেতৃত্ব দাবি করিনি। পবিত্র কোরআন ও ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী আমি কথা বলি এবং কাজ করি। এ কারণে কিছু নন মুসলিম আমাকে ‘ইসলামের খলীফা’ বলে থাকে। এটি করার অধিকার তাদের রয়েছে। কিন্তু আমি এরকম কিছু বলি না এবং আমরা এই ব্যাপারটিকে প্রচার করব না।  ”

আল্লাহ্‌র প্রতি ঝুঁকে যাওয়া

কিছুদিন পর, পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ জামাতী ওয়েবসাইট ও এমটিএ কে ব্যান করার জন্য তাদের প্রচেষ্টা আরো জোরদার করে। এসময় হুজুর আমাকে ফোন করেন।

প্রথমে আমি মনে করেছিলাম যে এটি অন্যান্য ফোনকলের মতোই। যেখানে আমি হুজুরকে নিউজ ব্রিফিং করব। কিন্তু হুজুর সাম্প্রতিক অত্যাচারের বিষয়ে আমাকে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন।

হুজুর একজন ব্যক্তির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি সম্প্রতি জামাতের উপর অত্যাচার বৃদ্ধির জন্য পাকিস্তানী সরকারকে চাপ প্রয়োগ করছেন।

হুজুর তার ব্যাপারে বলেন :

“একদিকে সে দাবী করছে যে সে মহানবী(সাঃ) এবং ইসলামকে রক্ষার জন্য কাজ করছে। কিন্তু, সে মহানবী(সাঃ) নির্দেশ ও শিক্ষার বিপরীত কাজ করে ইসলামকে রক্ষার দাবী জানাচ্ছে। বরং, আমি ব্যক্তিগতভাবে জেনেছি যে সে অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ন একজন মানুষ। সামান্য সততাও তার মাঝে নেই। সে সর্বদা ঘুষ ও অন্যান্য অবৈধ আয়ের সুযোগ খুঁজে বেড়ায়। ”

এটি শুনে আমি স্বভাববশত বলে ফেলি :

“আল্লাহ্‌পাক দয়া করুন।”

হুজুর বলেন :

“তুমি কেন বলছো যে মহান আল্লাহ্‌পাক তাদের উপর দয়া করুন? এ ধরণের মানুষের উপর দয়া করার সময় অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। বরং, দোয়া কর যেন মহান আল্লাহ্‌পাক আমাদের উপর দয়া করেন। আর যারা অত্যাচার ও অবিচারের সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। আমরা কখনো হাতে অস্ত্র তুলে নিব না, সহিংস আচরণ করব না। কিন্তু আমাদের দোয়া করতে হবে যেন মহান আল্লাহ্‌পাক আমাদের হয়ে ন্যায়বিচার করে দেন। যেন বিরুদ্ধবাদীদের সকল অত্যাচারের সমাপ্তি ঘটে। ”

হুজুরের এই প্রতিক্রিয়ায় আমি চমকে উঠি। হুজুরের বক্তব্যের আবেগ ও শক্তি আমার হৃদয়ে এক তাড়না সৃষ্টি করে।

হুজুর বলেন :

“যাহোক, এ কয়েকটি কথাই আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। আল্লাহ্‌ হাফেয। ”

সারারাত আমি হুজুরের কথাগুলো চিন্তা করি।

পরদিন, নতুন বছরের জুমআর খুৎবার শেষে হুজুর অত্যন্ত শক্তিশালী এক বার্তা প্রদান করেন। হুজুর বলেন যে বিশ্ব মহামারী থেকে কোন শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মানবজাতি প্রতিনিয়তই তাদের স্রষ্টা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

হুজুর জামাতের প্রতি অত্যাচারের কথা বর্ণনা করেন। যারা অত্যাচার করছে তারা মহানবী(সাঃ) এর সম্মানে এসব করার দাবি জানাচ্ছে।

হুজুর বলেন :

“এসব মানুষ, যারা আমাদের উপর অত্যাচার করছে, তারা সেই পবিত্র সম্মানিত মানুষের চরিত্রকে কলঙ্কিত করছে। যাকে মানবজাতির জন্য ‘সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত’ উপাধি দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আহমদীগণই মহানবী(সাঃ) এর সম্মান রক্ষার্থে তাদের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। এসকল মানুষ পার্থিব ক্ষমতা ও অর্থের সাহায্যে আমাদের উপর অবিচার করছে। কিন্তু, তাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা সেই খোদার উপর বিশ্বাস রাখি, যিনি সর্বোত্তম সাহায্যকারী এবং সর্বোত্তম রক্ষাকারী। ”

হুজুরের দিক নির্দেশনা ও খুৎবা শোনার পর একটি বিষয় পরিস্কার। যদিও জামাত আইনের মধ্য থেকে বিভিন্ন সমাধানের চেষ্টা করছে। কিন্তু যুগ খলীফা একমাত্র খোদার দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। হুজুর একমাত্র আল্লাহ্‌পাকের প্রতিই নির্ভর করেন এবং মহান আল্লাহ্‌পাককেই আহমদীদের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেন।

পরবর্তীতে আমি হুজুরকে একজন আহমদীর করা একটি প্রশ্ন করি। তিনি জানতে চান পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্হিতিতে হুজুর কি মোবাহালার ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন কিনা?

হুজুর বলেন :

“হযরত খলীফাতুল মসীহ রাবে(রঃ) জেনারেল জিয়ার প্রতি মোবাহালার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কেননা জিয়া ব্যক্তিগতভাবে আহমদীদের অত্যাচারের নেতৃত্ব দিচ্ছিল। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অনেক সীমাবদ্ধ। তিনি নিজেই অনেক ক্ষেত্রে উগ্রপন্থী মোল্লাদের দ্বারা চালিত । তাই পরিস্হিতি পুরোপুরি একরকম নয়। এ কারণে মোবাহালা ঘোষণা করার সময় এটি নয়। ”

হুজুরের উত্তর অত্যন্ত পরিস্কার। এখন প্রত্যেক আহমদীর উচিৎ আল্লাহ্‌পাকের সাহায্য চাওয়া। যেন তাদের উপর অত্যাচার ও অবিচার সমাপ্ত হয়। কিন্তু জামাতের বিরুদ্ধে কোন একজন নেতা উঠে দাড়ায় নি।

বরং, অনেক উগ্রপন্থী মোল্লা এবং দুর্নীতিবাজ নেতাসমূহ নিজদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য জামাতের বিরুদ্ধে অত্যাচারের ইন্ধন যোগাচ্ছে। 

উপযুক্ত সময়

মহামারীর সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আহমদীগণ ভার্চুয়াল মোলাকাতের মাধ্যমে হুজুরের সাথে সাক্ষাতের সৌভাগ্য লাভ করেছেন। একইসাথে, ইউকের আহমদীগণ যারা পূর্বে হুজুরের পিছনে নামায আদায় করার সৌভাগ্য লাভ করতেন তাদের সফরের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

এটি অনেকের জন্যই এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা। আমি শুনেছি যে এই সময় কিছু আহমদী ১০০ মাইল সফর করে আসতেন। ইসলামাবাদের বাইরের গেটে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকতেন। যেন তারা যুগ খলীফার সাথে একই বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারেন। তারা এই ভেবে স্বান্তনা পেতেন যে যদিও তারা তাদের প্রিয় খলীফাকে দেখতে পারছে না। কিন্তু তারা খলীফার কাছেই রয়েছে। কয়েক মিনিট দোয়া করার পর তারা গাড়িতে করে তাদের বাসায় ফিরে যান।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মহামারীর সময়েও হুজুরের সাথে সাক্ষাত করার সৌভাগ্য লাভ করেছি। অনেকবার ফোনে কথা বলার বরকত লাভ করেছি। যেটি আমি কখনোই কল্পনা করিনি। কিন্তু তারপরও প্রতিদিন হুজুরের সাথে দেখা করার আকাঙ্খা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে।

২০২০ সালের শেষ দিকে এমটিএর একটি কাজে আমি কিছুটা ভুল করি। আমার ভুলের জন্য আমি লজ্জ্বিত ছিলাম। কিন্তু একইসাথে আমি হুজুরের প্রতি কৃতজ্ঞ যে প্রচারের পূর্বেই হুজুর সেটি আমার নজরে নিয়ে আসেন।

অনেক মাস থেকেই আমি হুজুরকে একটি কথা জিজ্ঞেস করার চিন্তা করছিলাম। আমার প্রশ্ন ছিল কবে থেকে আমি দৈনন্দিন মোলাকাতের জন্য ইসলামাবাদ আসা শুরু করতে পারব। এমটিএর ভুলের পর আমি সাহস করে আমার মনের কথা হুজুরের কাছে ব্যক্ত করি।

আমি হুজুরকে বলি যে আমার মাঝে যেহেতু ভুলের আশংকা রয়েছে, হুজুরের সাথে দৈনন্দিত মোলাকাতের ফলে সেগুলো দূর হয়ে যাবে।

হুজুর হেসে বলেন :

“তুমি কি প্রতিদিন এখানে আসতে পারার জন্য ইচ্ছে করেই ভুল করছ?”

“তুমি (ভুল করা) চালিয়ে যেতে পার – আমরা উপযুক্ত সময়েই দেখা করব।”

আমি আশা করছিলাম যে হুজুর হয়ত আমাকে নিয়মিত সাক্ষাত করার অনুমতি দিবেন। কিন্তু আমি জানতাম যে হুজুর আমার অনুরোধে রাজি হবেন না।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই হুজুর জামাতের জন্য যেটি সর্বোত্তম সেটিই করেন। আবেগপ্রবণ হয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেন না।

গত কয়েক সপ্তাহে ইউকে সহ অন্যান্য দেশে কোভিড-১৯ আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে মানুষ স্বভাবতই হতাশ হয়ে যেতে পারে। যে পরিস্হিতি আদৌ কখনো স্বাভাবিক হবে কিনা।

কিন্তু, হুজুরের বক্তব্যে আমি আশার আলো দেখতে পাই। যে একটি সময় আসবে যখন আমি প্রতিদিন হুজুরের সাক্ষাত লাভের বরকত লাভ করব। একটি সময় আসবে যখন আমাদের মসজিদ পুনরায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে, ইনশাল্লাহ্‌। হুজুরের উপস্হিতিতে আমাদের জলসা ও ইজতেমা শুরু হবে এবং হাজার হাজার মানুষ এক হাতের উপর বয়াত করবে।

হুজুরের সাথে শুরু হওয়া ভার্চুয়াল মোলাকাত ইনশাল্লাহ্ কোভিড পরবর্তী সময়েও জারী থাকবে। একইসাথে, জলসা, ইজতেমা , বিশ্বব্যাপী হুজুরের সফরও শুরু হবে, ইনশাল্লাহ্।

ততদিন পর্যন্ত হুজুরের বক্তব্যই আমাদের জন্য শান্তি ও আশার আলো।