হুজুরের স্ক্যান্ডেনেভিয়া সফর (প্রথম পর্ব)

[হুযুর (আইঃ) এর স্ক্যান্ডেনেভিয়া সফরঃ আবিদ খান সাহেবের ব্যক্তিগত ডায়েরী। ইংরেজী থেকে বাংলায় অনুবাদকৃত]

 

ভুমিকা

৪ মে ২০১৬, হুজুর ও তার কাফেলা ১৯ দিনের সফরের জন্য জন্য রওনা দেন। এ সময় হুজুর দুইটি স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ ডেনমার্ক ও সু্‌ইডেন সফর করবেন। হুজুর ও তার স্ত্রী সহ মোট কাফেলা সদস্য ছিল ১০ জন। চার জন নিরাপত্তা সদস্য ও চার জন হুজুরের ব্যক্তিগত অফিস কর্মী। আমি কেন্দ্রীয় প্রেস ও মিডিয়া অফিসের দায়িত্বে ছিলাম। হুজুরের সফরের কিছুদিন পূর্বেই নিরাপত্তা দলের সদস্যদের মধ্যে মাহমুদ আহমদ খান সাহেব ও নাযির সাহেব ডেনমার্ক চলে যান।

 

সফরের পূর্বাভাস

সফরের কয়েক সপ্তাহ পূর্বে মার্চ মাসের প্রথম দিকে মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়া ইউএসএ তাদের বার্ষিক ইজতেমায় অংশ নেবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেটি ক্যালিফোর্নিয়াতে মে মাসের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত হবে।

তারা হুজুরকে সরাসরি আমার আমন্ত্রণপত্র পাঠায়। হুজুর কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আমাকে সেখানে অংশ নেবার জন্য অনুমতি দেন। কিন্তু কিছুদিন পর হুজুর আমাকে বলেন “ইউএসএর খোদ্দাম তোমাকে মে মাসে ইজতেমায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু আমি মে মাসে ডেনমার্ক ও সুইডেন সফরে যাচ্ছি। তাই যদি দুই সফর একই সময়ে পড়ে যায় তাহলে তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তুমি কোন সফরে যাবে।”

এটি বলার সময় হুজুর হাসছিলেন। কারণ হুজুর খুব ভালভাবেই জানতেন যে সে অবস্হায় আমি কোনটি বেছে নিব। আমি দ্রুত উত্তর দেই “অবশ্যই আমি কেবল হুজুরের সাথে সফরের কথাই চিন্তা করতে পারি।”

 

হুজুরের কথা শুনে আমি বুঝি যে আরো একবার আমি খলীফাতুল মসীহর সাথে সফরের সুযোগ পাচ্ছি। আমার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হয়ে যায়। পরবর্তীতে দেখা যায় যে দুটো সফর একই তারিখে হয়নি। তাই হুজুরের সাথে সফর শেষে আমি ক্যালিফোর্নিয়ার ইজতেমাতেও অংশ নিতে পারি।

 

বাড়ি থেকে বিদায়

হুজুরের পূর্বের সফরের(জাপান সফর ২০১৫) পর মহান আল্লাহ পাক আমার স্ত্রী মালা ও আমাকে দ্বিতীয় ছেলে সন্তান দান করেন। হুজুর তার নাম দেন মোশাহিদ। স্ক্যান্ডেনেভিয়া সফরের এক সপ্তাহ পূর্বেই আমার দুই ছেলেই অসুস্হ হয়ে পড়ে। প্রথমে তাদের জ্বর ও ঠান্ডা লেগেছিল এবং পরে চিকেন পক্স হয়। তাই সফরের পূর্বে আমি দোয়া করতে থাকি যাতে তারা সম্পূর্ণ সুস্হ হয়ে যায় এবং আমি যখন সফরে থাকব তখন যেন তারা নিরাপদে থাকে। আল্লাহর রহমতে আমার সফরের সময় তারা সুস্হই ছিল।

৪ মে, সকাল ১০ টার সময় আমি সালাম জানিয়ে আমার পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেই। আমার মনে হল যখন আমি ফিরে আসব তখন হয়ত মোশাহিদ আমাকে ভুলেই যাবে।

অন্যদিকে আমি যখন কোথাও বের হই তখন আমার বড় ছেলে মাহিদের মন খারাপ হয়ে যায়। সৌভাগ্যবশত এই যুগে ফেসটাইম ও হোয়াটসঅ্যাপের সাহায্যে পরিবারের কাছাকাছিই থাকা যাই। তাই সফরে আমি নিয়মিতভাবেই তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি।

 

এক বন্ধুর বক্তব্য

আমি পূর্বে কখনো ডেনমার্ক বা সুইডেন যাইনি। হুজুর ২০০৫ সালে সুইডেন ও ২০১১ সালে ডেনমার্ক সফরে গিয়েছিলেন। সেটি খুব সংক্ষিপ্ত সফর ছিল।

হুজুরের সফরের কথা শুনে আমার ইউএস এর একজন বন্ধু আমাকে মেসেজ পাঠায় যে আমি যদি এই সফরের কোন ডায়েরী লিখি তাহলে আমি যেন বিশেষভাবে উল্লেখ করি যে স্ক্যান্ডেনেভিয়া বিশ্বের কোথায় অবস্হিত; কারণ তার মতো আমেরিকানদের এ ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই।

আমি ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না; যে সে আমার সাথে কৌতুক করছে নাকি। তারপরও বলে রাখি স্ক্যান্ডেনেভিয়া উত্তর ইউরোপের চারটি দেশ ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন নিয়ে গঠিত।

 

মসজিদ ফযল থেকে ডেনমার্কের উদ্দেশ্যে রওনা

দুপুর ১২.৩০ মিনিটে হুজুর ও তার স্ত্রী তাদের বাসস্হান থেকে বের হন। গাড়ীতে উঠার পূর্বে হুজুর সেখানে উপস্হিত আহমদীদের হাত নেড়ে বিদায় জানান; এরপর নীরব প্রার্থনার পর আমরা সফর শুরু করি।

আমাদের কাফেলা সরাসরি হিথ্রো এয়ারপোর্টে চলে যায়। সেখান থেকে আমরা ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বিমানে উঠি। দুপুর ২.৫৫ মিনিটে প্লেন ছাড়ে এবং ৯০ মিনিটের ফ্লাইটের পর আমরা ডেনমার্কের স্হানীয় সময় বিকেল ৫.২৫ মিনিটে কোপেনহেগেন পৌঁছাই। প্লেন অবতরণের পূর্বে আমি দেখি যে ডেনমার্কের আশেপাশে শত শত ছোট দ্বীপ রয়েছে। আমি কখনো এত ছোট দ্বীপ দেখিনি।

 

হুজুরের স্ত্রীর জন্য হুজুরের উদ্বেগ

ডেনমার্কের আমীর মোহাম্মাদ জাকারিয়া খান সাহেব হুজুরকে স্বাগত জানান। হুজুরকে জানানো হয় যে কাফেলা সদস্যদের ইমিগ্রেশন চেকিং এর প্রয়োজন নেই। কাছেই হুজুর ও কাফেলার সদস্যদের জন্য গাড়ী তৈরী আছে। কিন্তু সেখানে যাবার জন্য বেশ কিছু সিড়ি বেয়ে নামতে হবে।

আমি সবসময়ই দেখেছি যে; হুজুর তার স্ত্রীর সুবিধা অসুবিধার প্রতি যেভাবে লক্ষ্য রাখেন তা সকলের জন্যই অনুকরণীয়। হুজুরের স্ত্রীর হাটুঁতে অনেকদিন ধরেই সমস্যা রয়েছে। তাই হুজুর এয়ারপোর্টের কর্মীদের জিজ্ঞেস করেন যে নিচে নামার জন্য কোন লিফট রয়েছে কিনা। কিন্তু লিফটও অনেক দুরে রয়েছে। তাই হুজুরের স্ত্রী অনেক ধৈর্য্য সহকারে সিড়ি দিয়ে নামতে থাকেন এবং হুজুর ঠিক তার পেছনেই থাকেন।

গাড়ীর কাছে পৌঁছানোর পর একজন পরিচিত মুখ তাদের স্বাগত জানান। তিনি হলেন হুজুরের নিরাপত্তা কর্মী মাহমুদ খান সাহেব। তিনি এই সফরে হুজুরের গাড়ী চালানোর দায়িত্বে ছিলেন।

নুসরাত জাহান মসজিদ এয়ারপোর্টের কাছেই অবস্হিত। কিন্তু রাস্তায় অনেক ট্রাফিক থাকার কারণে সেখানে পৌঁছাতে প্রত্যাশিত সময়ের চেয়ে বেশিই লেগেছিল।

 

একটি অসাধারণ মসজিদ

আমরা বিকেল ৬টায় নুসরাত জাহান মসজিদে পৌঁছাই। সেখানে অনেক আহমদী ও ছোট ছোট বাচ্চা হুজুরকে স্বাগত জানানোর জন্য উপস্হিত ছিল। আমি তাদের চেহারায় আনন্দ ও খুশি দেখতে পাচ্ছিলাম। হুজুর যখনই কোথাও সফর করতে যান তখনই আমি এরকম আনন্দময় চেহারা দেখতে পাই।

আমি নুসরাত জাহান মসজিদের অনন্য সৌন্দর্য দেখে অবাক হয়ে যাই। আমি পূর্বে যেসব আহমদী মসজিদ দেখেছিলাম এটি তার চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন ডিজাইনের। পুরো মসজিদ তামাটে রং এর ডোম দিয়ে ঢাকা রয়েছে। এটি দেখতে অনেকটা সামুদ্রিক ঝিনুকের মতো। যদিও এই তুলনা পুরোপুরি সঠিক নয়; কিন্তু মসজিদটি দেখতে আসলেই অত্যন্ত সুন্দর। মসজিদের ভিতরেও সুন্দরভাবে ডিজাইন করা রয়েছে।

সফরের সময় হুজুর ও তার স্ত্রী মসজিদের পাশেই ছোট একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। মসজিদ প্রাঙ্গনে বিভিন্ন অফিস ও হল রুম রয়েছে। মসজিদের পিছনে কিছু নতুন জায়গা কেনা হয়েছে। সেখানেও কিছু অফিস বানানো হয়েছে। আমি পূর্বে ডেনমার্ক আসিনি; তাই এখানে কি কি পরিবর্তন হয়েছে আমি তা বুঝতে পারছিলাম না। মাজিদ সাহেব ও মুবারক সাহেব পূর্বে এখানে এসেছিলেন। তারা আমাকে বললেন যে মাশআল্লাহ এখানে জামাত অনেক উন্নতি করেছে। ডেনমার্ক জামাতের সদস্যগণও এই উন্নতির জন্য অনেক আনন্দিত।

 

নুসরাত জাহান মসজিদ

নুসরাত জাহান মসজিদ

 

 

নামায এবং মসজিদ পরিদর্শন

কয়েক মিনিট পর হুজুর জোহর ও আসরের নামায আদায় করান। নামাযের পর হুজুর মসজিদ কমপ্লেক্স পরিদর্শনে বের হন। হুজুরকে বেসমেন্টের একটি স্হান দেখানো হয়। যদি মসজিদে স্হান সংকুলান না হয় তখন এখানে অতিরিক্ত মুসল্লীগণ নামায আদায় করেন। স্হানটি দেখার পর হুজুর বলেন যে “এখানে যারা নামায আদায় করে তারা কি মসজিদের ইমামের সামনে দাড়াচ্ছে কিনা?”

আমীর সাহেব বলেন “কোন নামাযী যেন ইমামের সামনে না দাড়ায় এ ব্যাপারটি নিশ্চিত করার জন্য বেসমেন্টের কেবল পিছনের অংশ ব্যবহার করা হয়।” তিনি দেয়ালে কলম দিয়ে দেয়া একটি চিহ্ন দেখান এবং বলেন যে নামাযীগণ এই চিহ্ন পর্যন্ত এখানে দাড়াতে পারবে; এর সামনে নয়।

হুজুর বলেন “এই চিহ্নটি খু্বই ছোট। বেশীরভাগ মানুষই এটি লক্ষ্য করবে না। তাই এখানে শক্ত কোন প্রতিবন্ধক রেখে দেয়া উচিৎ যেন কেউ ভুলক্রমে ইমামের সামনে চলে না যায়। প্রতিবন্ধকটি কমপক্ষে এক বছর থাকবে। এতে আশা করা যায় নামাযীগণের মধ্যে একটি ধারণা হয়ে যাবে যে কোন পর্যন্ত দাড়াতে হবে।”

এটি আর একটি দৃষ্টান্ত যে খলীফাতুল মসীহ কিভাবে জামাতকে সবসময় সকল ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। হুজুর সবসময় গভীরভাবে লক্ষ্য রাখেন যেন জামাত সকল ইসলামিক শিক্ষা সঠিকভাবে পালন করে।

 

আতিথেয়তা সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষা

হুজুরকে বিভিন্ন রুম দেখানো হয়। একটি রুম দেখানোর সময় ডেনমার্ক জামাতের একজন বলেন যে এটি পূর্বে অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো কিন্তু এখন এটি এমটিএ দল দখল করে নিয়েছে। তিনি এক্ষেত্রে উর্দু শব্দ ‘কবযা’ করে নিয়েছে ব্যবহার করেন।

হুজুর বলেন “কবযা শব্দটি তখনই ব্যবহৃত হবে যখন কেউ কোনরকম আমন্ত্রণ এবং প্রয়োজন ছাড়াই আসবে। তাই যদি আপনাদের এমটিএর কোন প্রয়োজন না থাকে আমি তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারি এবং আপনারা শুক্রবারের খুৎবার সম্প্রচারের ব্যবস্হা করবেন। তাই এমটিএ আপনাদের অফিস দখল করে নিয়েছে না বলে আপনার বলা উচিৎ ছিল যে আমাদের অতিথি এমটিএ এখন তাদের কাজের জন্য রুমটি ব্যবহার করছে।”

হুজুরের বক্তব্যে এমটিএ দলের প্রতি হুজুরের ভালবাসা এবং আতিথেয়তার গুরুত্ব প্রকাশ পায়। অতিথি যেন কখনোই নিজেকে অবাঞ্ছিত বা বোঝা বলে মনে না করে। হুজুরের বক্তব্য সকলের জন্যই একটি উপদেশ।

হুজুর কখনো এমন কিছু বলেন না যা তিনি নিজে পালন করেন না। অনেক আহমদী ও নন আহমদীই অতিথিদের প্রতি হুজুরের সম্মান ও আতিথেয়তার প্রমাণ প্রত্যক্ষ করেছেন। হুজুর আতিথেয়তার বিষয়ে মহানবী(সাঃ) ও তার গোলাম প্রতিশ্রুত মসীহ(আঃ) এর দেখানো পথ অনুসরণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন।

হুজুরের বক্তব্যের পর জামাতের সে ব্যক্তিকে তার কথার জন্য অনুতপ্ত মনে হল।

 

 

প্রতিদিন মাংস খাওয়া

ডেনমার্ক সফরের সময় নরওয়ে জামাতের জিয়াফত দল আমাদের জন্য খাবার রান্না করেছিল। তারা এই কাজের জন্যই এখানে এসেছিল। তাদের তৈরী খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু ছিল।

কিন্তু একটি জিনিস আমরা সকলেই লক্ষ্য করেছি যে সুইডেন ও ডেনমার্ক এর প্রত্যেক বেলার খাবারেই একটি ভেড়ার মাংসের খাবার থাকত। কখনো কখনো একাধিকও থাকত। কখনো আমরা আলু গোশত, সবজি গোশত ও অন্যান্য মাংসের খাবার খেতাম। আমার মাংস খেতে সমসবময়ই ভাল লাগত। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতে হবে; যে কয়েকদিন প্রতিনিয়ত মাংস খাবার পর আমি সাধারণ খাবার ডাল ও অন্যান্য খাবারের অভাববোধ করছিলাম।

অতিরিক্ত পনের মিনিট

সন্ধ্যার খাবারের পর হুজুর মসজিদে মাগরিব ও এশার নামায আদায়ের জন্য আসেন। এরপর হুজুর মসজিদের অন্যান্য স্হান পরিদর্শন করেন যেটি আগে করেননি। যেমন তিনি তার নিরাপত্তা সদস্যদের থাকার স্হান পরিদর্শন করেন। এক পর্যায়ে হুজুর আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চান যা আমি কোথায় থাকছি। আমি বলি যে মসজিদে পর্যাপ্ত থাকার স্হান না থাকায় আমি অন্যান্য সদস্যদের সাথে কাছের একটি হোটেলে থাকছি। হুজুর জানতে চান যে সবকিছু ঠিক আছে কিনা। আমি সাথেসাথেই বলি যে সবকিছু ঠিক আছে।

এটি আমাকে সবসময়ই অবাক করে। অত্যন্ত ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও হুজুর তার সফরসঙ্গীদের ছোট ছোট ব্যাপারেও খোঁজ খবর নেন; যে তাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা।

হুজুর তার রুমে যাবার পূর্বে জানতে চান যে ফযরের নামাযের সময় কখন। আমীর সাহেব জানান যে ৪ টার সময়। এপর হুজুর সূর্যোদয়ের সঠিক সময় জানতে চান। জানার পরে হুজুর বলেন “আমরা ৪ টার পরিবর্তে ৪.১৫ মিনিটে নামায আদায় করতে পারি। এতে মানুযের মসজিদে এসে নামায আদায় করতে কিছুটা সুবিধা হবে।”

হুজুর সবসময়ই এটা চেষ্টা করেন যে আহমদীগণ যেন মসজিদে যেয়ে নামায আদায় করেন। আমি এই অতিরিক্ত ১৫ মিনিটের জন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

ডেনিশ পেস্ট্রি

পরদিন সকালে আমি হোটেলে নাশতা করি। নাশতা ব্যুফে পদ্ধতিতে ছিল। আমার চোখ পড়ল সাজিয়ে রাখা এক সারি পেস্ট্রির উপর। সেগুলো অত্যন্ত ভারী ও ক্যালরিযুক্ত খাবার মনে হল। তাই প্রথমে আমি ভাবলাম যে এগুলো খাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু আমার মনে হল যে ডেনিশ পেস্ট্রি খুবই বিখ্যাত। তাই আমার অন্তত একটি হলেও চেখে দেখা উচিৎ। একটি খাবার পর আমি আরো একটি নেই; এবং তারপর আরো একটি। সেগুলো সত্যিই খুব সুস্বাদু ছিল।

 

বাসায় ফোন

সেদিন সকালে আমি ‘ফেসটাইম’ আ্যপের সাহায্যে বাসায় আমার স্ত্রী মালার সাথে কথা বলি। সে আমাকে বলে আমি আসার কয়েকঘন্টা পর আমাদের ছেলে মোশাহিদ প্রথমবারের মতো নিজে থেকে উপর হতে পেরেছে। আমি এটি শুনে খুবই খুশি হলাম। মাশাআল্লাহ সে ছোটবেলার একটি মাইলফলক অতিক্রম করেছে।

সে আমাকে আরো বলে যে আমার ছেলে মাহিদ রাতের বেলা হঠাৎ জেগে উঠে কাদঁতে শুরু করে এবং জিজ্ঞেস করে যে আমি কোথায়। আমার স্ত্রী বলে যে আমি হুজুরের সাথে আছি। এটি শুনে সে সাথেসাথেই শান্ত হয়ে যায় ও ঘুমিয়ে পড়ে।

 

স্হানীয় মেয়র হুজুরকে স্বাগত জানান

বৃহস্পতিবার ৫ মে স্হানীয় মেয়র মিসেস হেলে অ্যাডেলবর্গ এবং স্হানীয় কাউন্সিলের আরো চার সদস্য মসজিদে আসেন এবং হুজুরকে ডেনমার্কে আসার জন্য স্বাগত জানান। একজন কাউন্সিলর আহমদী ছিলেন; তার নাম হল কাশিফ আহমদ।

৩০ মিনিট ধরে মিটিং হয়েছিল। সেখানে তারা বর্তমান বিশ্ব পরিস্হিতি নিয়ে হুজুরের মতামত জানতে চান। হুজুর বলেন “বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল সকল মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্ব শান্তি স্হাপনের জন্য চেষ্টা করা।”

হুজুর মসজিদের পরিকল্পনা পাশ করার জন্য মেয়র ও কাউন্সিলরদের ধন্যবাদ জানান। মেয়র বলেন “নুসরাত জাহান মসজিদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক মসজিদ। কারণ এটি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে তৈরী প্রথমদিকের মসজিদের মধ্যে একটি।”

হুজুর বলেন “স্হাপত্যশিল্পের ক্ষেত্রে এটি একটি অনন্য ও অত্যন্ত সুন্দর একটি মসজিদ।” তিনি এটিকে স্হাপত্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ যেসব স্হাপনা রয়েছে তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন।

হুজুরকে পাকিস্তানে জামাতের উপর যে অত্যাচার চলছে সে সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়। তারা জানতে পারেন যে ভিত্তিহীন অভিযোগে হুজুরকেও ১৯৯৯ সালে ১১ দিন জেলে থাকতে হয়েছিল। একজন কাউন্সিলর বলেন যে তিনি কোনভাবেই বুঝতে পারছেন না যে এরকম একটি শান্তিপূর্ণ জামাতের বিরুদ্ধে কিভাবে এরকম অত্যাচার হতে পারে।

হুজুর তাকে তার মন্তব্য ও সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান।

একজন কাউন্সিলর বলেন যে ডেনমার্ক হল একটি দেশ যেখানে একজনের মত প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। হুজুর বলেন “এই বক্তব্য পুরোপুরি সঠিক নয়। পশ্চিমা দেশে অনেক মানুষই মত প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলে থাকে। কিন্তু বাস্তবে পশ্চিমা দেশও এ ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাধীন নয়। যেমন এখানে ইহুদীবিরোধী কোন মন্তব্য সহ্য করা হয় না।”

হুজুর মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে বলেন “মত প্রকাশের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানেও একটি সীমারেখা টানতে হবে। এমন কথা বলা ঠিক নয় যা অন্যের অনুভুতিকে আঘাত দিবে। আমাদের একটি সাম্যাবস্হা খুঁজে বের করতে হবে যেন আমরা বিশ্বে শান্তি স্হাপন করতে পারি।”

 

মেয়রের বক্তব্য

মিটিং এর পর আমি মেয়রের কাছে যাই। তিনি বলেন যে হুজুরকে দেখে তিনি আভিভূত। তার সাথে কথা বলতে পেরে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছেন। তিনি বলেন “খলীফা (হযরত মির্যা মাশরুর আহমদ) অনেক দয়ালু ও জ্ঞানী। তার হাসি অত্যন্ত সুন্দর। তিনি অনেক সম্মানিত ধর্মীয় নেতা হয়েও অনেক বিনয়ী।”

“তিনি তার বক্তব্যে বিশ্বশান্তি স্হাপনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। আমি অনেক গর্বিত যে তার মতো একজন শান্তিপ্রিয় ও সম্মানিত মুসলিম নেতা আমাদের শহরে এসেছেন। আমরা খুবই ভাগ্যবান এবং আজকের দিনকে আমি অনেকদিন মনে রাখব।”

 

আহমদীদের আবেগ

সন্ধ্যার সময় হুজুর কিছু আহমদী পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেমসয় আমি স্হানীয় জামাতের কিছু সদস্যের সাথে দেখা করি। তারা আমাকে হুজুরের ডেনমার্ক সফর ও খিলাফতের বরকতের ব্যাপারে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে।

আমি এক তরুণ দম্পত্তির সাথে কথা বলি। তারা হলেন হামিদ উর রহমান(২৯ বছর) ও তার স্ত্রী সাজিয়া আহমদ। কথা বলার সময় হামিদ সাহেব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন ও তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন “আমি অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি কারণ পৃথিবীতে হুজুর হলেন আল্লাহর প্রতিনিধি। আজ আমি তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছি। আমি সত্যিই মনে করি যে হুজুরের দোয়া ছাড়া আমার এই জীবনে আর কিছু প্রয়োজন নেই।”

তার স্ত্রী সাজিয়া আহমদের চোখেও পানি ছিল। তিনি বলেন “হুজুরের সাথে কাটানো মুহুর্তগুওলো আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। আমাদের খলীফা অত্যন্ত বিনয়ী ও নরম হৃদয়ের মানুষ। আমি দেখলাম হুজুর কতো পবিত্র ও ধার্মিক এবং আমার মনে হল হুজুরের নূর আমার আধ্যাত্মিক রোগ ব্যাধি দূর করে দিচ্ছে।”

আমি একজন আহমদী পরিবারের সাথে কথা বলি যারা ৩০ বছর ধরে ডেনমার্কে রয়েছেন। তারিক মাহমুদ বাটার, তার স্ত্রী ফৌজিয়া বাটার এবং তাদের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। আমরা প্রায় ১০ মিনিট কথা বলি। পুরো পরিবার বিশেষভাবে ফৌজিয়া সাহিবা ও তার দুই মেয়ে অনেক আবেগপ্রবণ ছিলেন। তিনি বলেন “আমার মনে এখন যে তৃপ্তি রয়েছে আমি যদি সেটিকে আমার হৃদয়ে সারাজীবনের জন্য বন্দী করে রাখতে পারতাম। আমরা একটি স্বপ্নের মধ্যে রয়েছি যেটি থেকে আমরা কখনো জেগে উঠতে চাই না।”

আমি এরপর তার বড় মেয়ে আওরাজ মাহমুদ সাহিবার সাথে কথা বলি। আমার মনে তার বয়স ২০ এর কাছাকাছি হবে। কথা বলার পুরো সময় তার চোখে পানি ছিল এবং সে হুজুরের ভালবাসায় পুরোপুরি আভিভূত ছিল। কয়েক সেকেন্ড কথা বলার পরই সে চোখ মুছছিল এবং তারপর আবার কথা বলছিল। তিনি বলেন “আমার হৃদয়ে যে আবেগ ও অনুভূতি রয়েছে সেটি বর্ণনা করা সম্ভব নয়। হুজুর অনেক অনেক আগে এখানে এসেছিলেন। তাই আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে তিনি অবশেষে আবার এখানে এসেছেন। আমি এটিও বিশ্বাস করতে পারছি না যে আমি হুজুরকে প্রতিদিন তার বাসা থেকে মসজিদে হেঁটে যেতে দেখতে পারছি।”

এ পর্যন্ত বলেই তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না এবং কান্নায় ভেঙে পড়েন। আমি মনে করি আমার কথার জন্যই তিনি কষ্ট পেয়েছেন তাই আমি তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। তিনি বলেন যে আমার চিন্তা করার কোন প্রয়োজন নেই কারণ এটি আনন্দের অশ্রু।

তার মা ফৌজিয়া সাহিবা বলেন “হুজুরের প্রতি ভালবাসার জন্যই আমার মেয়ে কাঁদছে। আমাদের জীবনে একটিই ভয় রয়েছে। সেটি হল কোন কারণে খলীফা যদি আমাদের উপর মনোক্ষুন্ন হন। তিনি যদি খুশি থাকেন তাহলেই আমাদের জীবন সফল।”

আমি সৈয়দ যাকি আহমদ(৩৭ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি বলেন যে হুজুরের উপস্হিতি তাকে ও অন্যানদের অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি বলেন “মাঝেমাঝে আমরা আমাদের কর্তব্য ও জামাতের কাজে আলস্য প্রদর্শন করে থাকি। কিন্তু যখন আমরা হুজুরের কর্তব্যনিষ্ঠা দেখি সেটি আমাদের অনুপ্রাণিত করে ও আমাদের নতুন শক্তি দান করে। হুজুরের উপস্হিতিতে আমরা জামাতের কাজ করার জন্য এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রচার করার জন্য দৃঢ় সংকল্প করি। খিলাফত হলো চুম্বকের মতো এবং এর আকর্ষণ ক্ষমতা এত বেশি যে একজন যতই হুজুরকে দেখবে ততই সে হুজুরের আরো কাছে যেতে চাইবে।”

 

হুজুরের জ্ঞানগর্ভ উপদেশ

আমি একজন আহমদী মাশহুদ আহমেদ(৩২ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি কয়েক বছর পূ্র্বে হুজুরের সাথে দেখা করেছিলেন। সে সম্বন্ধে তিনি বলেন “মোলাকাতের আগের দিন রাতেই আমার ঘরে চুরি হয়েছিল। আমার বেশীরভাগ মূল্যবান জিনিস ও কাপড় চুরি হয়েছিল। আমার নতুন কাপড় কেনার কোন পয়সা ছিল না। তাই আমি খুব সাধারণ কাপড় পড়েই হুজুরের সাথে মোলাকাতের জন্য যাই। এজন্য আমি খুব বিব্রতবোধ করছিলাম। ”

“তাই আমি হুজুরের রুমে প্রবেশ করেই চুরির ঘটনা জানাই এবং আমার সাধারণ পোশাকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।” আমার ঘটনা শুনে হুজুর বলেন “এ নিয়ে একদম চিন্তা করবে না। হতে পারে তোমার চেয়ে  চোরেরই কাপড় বেশী দরকার ছিল।”

মাশহুদ সাহেব বলেন যে তিনি হুজুরের দয়া ও প্রজ্ঞা দেখে আভিভূত হয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন “হুজুরের কথা শুনে আমি আর চুরির ঘটনা নিয়ে কোন চিন্তা করিনি। যদিও আমার অনেক মূল্যবান জিনিস চুরি হয়েছিল এবং সেগুলোর কোন বীমা করা ছিল না। সেদিনের পর থেকে আমি দেখেছি যে আমার জীবন অনেক বরকতপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং আল্লাহপাক আমাকে বহুবার সাহায্য করেছে।”

 

কোপেনহেগেনে জুমুআর খুৎবা

৬ মে ২০১৬ তারিখে হুজুর কোপেনহেগেন এর নুসরাত জাহান মসজিদ থেকে জুমআর খুৎবা প্রদান করেন। হুজুর বলেন যে তিনি ১১ বছর পূর্বে এখানে সফর করেছিলেন। এ সময়ের মধ্যে জামাত বিভিন্নভাবে উন্নতি করেছে। আল্লাহ পাক তাদের অনেক বরকত দান করেছেন। এজন্য আহমদীদের আবশ্য কর্তব্য তারা যেন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপায় হল ইসলামিক শিক্ষার উপর নিজের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করা। হুজুর বলেন “প্রতিনিয়ত আল্লাহর আশিস ও সাহায্য পাওয়ার উপায় হল আমাদের নিজেদের কাজ ও আচরণ উন্নত করা। যদি আমরা আমাদের ধর্মীয় উন্নতির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ি তাহলে আমাদের সন্তানগণও ধর্ম থেকে ও আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে দূরে চলে যাবে। আর এজন্য দায়ী হব আমরাই।”

যেসকল আহমদী নিজের দেশের সমস্যার কারণে ডেনমার্কে মাইগ্রেশন করেন; তাদেরকে হুজুর বলেন “যারা নিজেদের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য এদেশে এসেছেন; তাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিৎ যে উন্নত জীবনযাত্রা কি তাদেরকে ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে?”

“এটি উচিৎ নয় যে আরাম-আয়েস পেয়ে আহমদীদেগণ বস্তুবাদীতার দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং ইসলামের শিক্ষাকে ভুলে যাবে। তাদের আল্লাহর প্রতি আরো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং তার নৈকট্য পাবার চেষ্টা করা উচিৎ।”

 

আহমদীদের আবেগ

৬ মে, ২০১৬ সন্ধ্যার সময় হুজুর আহমদীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের একজন ছিলেন কাহওয়ার আহমেদ(৩৫ বছর)। তিনি ২০১২ সালে পাকিস্তান থেকে ডেনমার্ক আসেন। তিনি প্রথমবারের মতো হুজুরের সাথে দেখা করেন। তিনি খুবই আবেগপ্রবণ ছিলেন। তিনি বলেন “হুজুরের মধ্যে আমি শুধুই পবিত্রতা, ভালবাসা ও দয়া দেখতে পাই। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের সময় আমার যে অনুভূতি হয়েছে সেটি পূর্বে কখনো হয়নি। আমি ও আমার স্ত্রী সত্যিই মনে করি যে খলীফায়ে-ওয়াক্তের দোয়া জান্নাতের দরজা খুলে দিতে পারে। ”

আমি একজন ডেনিশ আহমদী মহিলা মিসেস মুনিরা সাহিবার সাথে কথা বলি। তিনি খলীফাতুল মসীহ সালেস(রাঃ) এর সময় বয়াত করেন। তার স্বামী কামাল সাহেব ১৯৬০ এর দশকে বয়াত করেন এবং সেক্রেটারী তবলীগ হিসেবে জামাতের খেদমত করেন। তিনি ২ বছর পূর্বে ইন্তেকাল করেন। মুনিরা সাহিবা সফরের সময় ব্যক্তিগতভাবে ও অফিসিয়ালভাবে হুজুরের সাথে দু’বার সাক্ষাৎ করেন। অফিসিয়ালভাবে তিনি হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করেন; কারণ তিনি পবিত্র কোরআনের ডাচ অনুবাদ নিয়ে কাজ করছেন। এ ব্যাপারে তিনি হুজুরের দিক নির্দেশনা নিয়েছেন। তার সাথে সাক্ষাৎ করা আমার জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় ছিল। তিনি বলেন “আমি নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি, কারণ আমি তৃতীয় খলীফা, চতুর্থ খলীফা ও পঞ্চম খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করতে পেরেছি। আমার তৃতীয় খলীফার চেহারা স্পষ্ট মনে আছে। তাঁর মুখাবয়ব অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও স্নেহময় ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্যই আমি মূলত আহমদীয়াত গ্রহণ করি। তাঁর সাথে যখন আমার দেখা হয় আমি তখন একজন তরুণী ছিলাম। তাঁর সাথে সাক্ষাৎ আমার পুরো জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। ”

“আমি প্রতি শুক্রবার খলীফার খুৎবা শুনি। প্রতিদিন আমি লক্ষ্য করছি যে জামাতের উপর আল্লাহপাকের অশেষ রহমত রয়েছে। আমরা অনেক ভাগ্যবান কারণ আমাদের খিলাফত ব্যবস্হা রয়েছে। অন্যান্য মুসলিম দল ও ফিরকাসমূহ খুবই বিচ্ছিন্ন। কিন্তু আহমদীয়া মুসলিম জামাত এক খলীফার হাতে ঐক্যবদ্ধ।”

আমি কাশিফ আহমেদ ও তার স্ত্রী হিনা আহমেদ এর সাথে কথা বলি। কাশিফ সাহেব সম্প্রতি স্হানীয় সরকারের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। হিনা আহমেদ একজন ডেনিশ মহিলা। তিনি দুই বছর পূর্বে বয়াত করে আহমদী হয়েছেন। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর কাশিফ সাহেব বলেন “হুজুরের সাথে সাক্ষাত করা একটি অসাধারণ ব্যাপার। এটিকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কিভাবে যেন এক-দুই মিনিটের মধ্যেই হুজুর আমাদের হদয়কে স্পর্শ করতে সক্ষম হন। কোরআনের শিক্ষার উপর কিভাবে আমাদের জীবনকে অতিবাহিত করতে হবে তার জন্য হুজুরই আমাদের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা।”

হুজুরের সাথে প্রথম সাক্ষাতের পর তার স্ত্রী হিনা সাহিবা বলেন “হুজুরের সাথে প্রথম সাক্ষাত একটি অনন্য অভিজ্ঞতা। হুজুরকে দেখে আমার হদয়ে প্রশান্তি অনুভব করি। কয়েক মুহুর্ত হুজুরের সাথে থেকে, আহমদীয়াতের সত্যতার উপর আমার ঈমান আরো দৃঢ় হয়েছে। আহমদীয়াতই এখন আমার ঘর। এই ঘরেই আমার থাকার কথা ছিল। আমি এ জীবনেই আমার জান্নাত পেয়ে গেছি। আমরা অনেক ভাগ্যবান যে আমাদের প্রিয় হুজুর এখন আমাদের সাথে ডেনমার্ক আছেন।”

 

খিলাফতের বরকত

পরদিন সকালে আমি একজন আরব আহমদী তারিক আল বাবা(৫৪ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি বৈরুতের অধিবাসী হলেও অনেক বছর ধরেই ডেনমার্কে বসবাস করছেন। তিনি ১৯৮৬ সালে আহমদীয়াত গ্রহণ করেছেন। তিনি আমাকে বলেন যে, কতগুলো সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহপাক তাকে আহমদীয়াতের দিকে নিয়ে এসেছেন। হুজুরের সাথে মোলাকাত সম্বন্ধে তিনি বলেন “এটি শুনে আশ্চর্য মনে হতে পারে; কিন্তু হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর মনে হচ্ছে আমি আকাশে উড়ছি। আল্লাহতা’লা সকল উম্মতকে একত্র করার জন্য হুজুরকে পাঠিয়েছেন। বর্তমান বিশ্ব পরিস্হিতিতে মুসলমানদের খিলাফত ব্যবস্হাপনা থাকা অপরিহার্য। বর্তমানে মুসলমানগণ হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের কোথাও তাদের কোন প্রভাব নেই। একমাত্র খিলাফত ব্যবস্হার মাধ্যমেই তারা তাদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে।”

“আমরা অনেক ভাগ্যবান কারণ আমাদের খলীফা আমাদের সবার। আমি অন্যান্য মুসলমানদের জন্য দুঃখ অনুভব করি কারণ তারা খিলাফতের বরকত থেকে বঞ্চিত।”

 

একটি ঈমানবর্ধক ঘটনা

আমি একজন তরুণ আরব আহমদীর সাথে কথা বলি। তিনি ডেনমার্কেই জন্ম গ্রহণ করেন এবং এখানেই প্রতিপালিত হন। তিনি আমাকে বলেন যে তিনি এখানেই আহমদী হিসেবে বেড়ে উঠেন। কিন্তু কিছু নন-আহমদী বন্ধুর প্রভাবে তিনি আহমদীয়াত থেকে দূরে সরে যান। তারা তাকে বলত যে আহমদীগণ প্রকৃত মুসলমান নয়। এতে ধীরে ধীরে তিনি জামাতের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন এবং মসজিদে আসা ছেড়ে দেন। তিনি আমাকে বলেন যে তার দুইজন বন্ধু তাকে আহমদীয়াত থেকে দূরে সরিয়ে নিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। তিনি বলেন “তারা আমার অনেক কাছের বন্ধু ছিল এবং আমি তাদের বিশ্বাস করতাম। একদিন মাঝরাতে তাদের একজন আমাকে ফোন করে। সে পুরোপুরি মাতাল ছিল এবং নিয়ন্ত্রনহীনভাবে কথা বলছিল। এতে আমি খুবই হতাশ হই।”

“কিছুদিন ধরে আমার অন্য বন্ধুরও কোন খোঁজ খবর পাচ্ছিলাম না। তাই তার খোঁজ নেবার জন্য আমি তার মায়ের কাছে যাই। তার মা অনেক দুঃখিত ছিলেন। তিনি জানালেন যে তার ছেলে সন্ত্রাসী দল দায়েশ-এ যোগ দেবার জন্য সিরিয়া অথবা ইরাকে চলে গেছে। কয়েক সপ্তাহ পর আমরা জানতে পারি যে সে হয়ত মারা গিয়েছে।”

তিনি বলেন যে তার দুই বন্ধুর পরিণতি তার চোখ খুলে দেয়। তিনি চিন্তা করেন; যে দুইজন বন্ধু তাকে বুঝিয়েছিল যে আহমদীগণ মুসলমান নয় তারা নিজেরাই অনৈসলামিক কাজ করে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তাই সে আবার আহমদী মসজিদে আসতে শুরু করে। অতীতে জামাত থেকে দূরে সরে যাবার জন্য তাকে কোনরকম ভৎর্সনা করা হয়নি বরং সকলে তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। এতে তিনি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে বলেন তার অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছেন যে আহমদীরাই প্রকৃত মুসলমান। আহমদীয়াতকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই; একজন আহমদী হতে পারা সত্যিই গর্বের বিষয়। তিনি আমাকে খলীফার সাথে আমার অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞেস করেন।

আমি তাকে বলি “আমি কোন ধর্মীয় পন্ডিত নই এবং আমি খুব বেশী ধর্মীয় বইও পড়িনি। বরং ইসলাম ও আহমদীয়াতের সত্যতার প্রতি আমার যে বিশ্বাস তা হল খলীফাতুল মসীহ’র সাথে আমার যোগাযোগের কারণে। ছোটবেলায় আমার খলীফাতুল মসীহ(রাবেঃ) এর সাথে দেখা করার সুযোগ হয়েছিল। বড় হয়ে আমি অনেক বছর খলীফাতুল মসীহ আল খামেস(আইঃ) কে দেখি। তাদেরকে দেখে একটি জিনিস আমি বুঝতে পারি যে খলীফাতুল মসীহ হলেন পরম সত্য ও সততার প্রতীক। তাদের মধ্যে যে সততা ও গুণাবলী আমি দেখতে পাই, তা অন্য কোথাও আমি পাইনি। তাই আমি কখনো খিলাফতে আহমদীয়াতের সত্যতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করিনি।”

 

হুজুরের সাথে মোলাকাত সম্বন্ধে তিনি বলেন “হুজুরের সাথে দেখা করার অনুভূতি সত্যিই অবর্ণনীয়। সে সময় আমার হৃদস্পন্দন বেশী ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। আমার মতো একজন মানুষ খলীফার সাথে দেখা করতে পারছে, এটি সত্যাই আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানের বিষয়; আলহামদুলিল্লাহ্‌। এ মুহুর্তগুলো আমার ঈমানকে আরো দৃঢ় করেছে। আল্লাহ আমাদের খলীফাকে অশেষ বরকত দিন।”

হুজুরের সাথে কিছু মুহুর্ত

পারিবারিক মোলাকাতের পর হুজুর আমাকে তার অফিসে ডাকেন। আমি অফিসে প্রবেশ করা মাত্রই হুজুর হাসেন এবং বলেন “আবিদ, তোমার সফর কেমন হচ্ছে?”

আমি বলি যে আল্লাহর রহমতে সবকিছু ভালই হচ্ছে। হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমি কার কার সাথে কথা বলেছি। হুজুর বিশেষভাবে ডেনমার্কের তরুণদের কথা জানতে চান। আমি সবসময়ই লক্ষ্য করেছি যে জামাতের তরুণদের প্রতি হুজুরের বিশেষ ভালবাসা ও চিন্তা রয়েছে। তিনি আশা করেন যে জামাতের তরুণ সদস্যগণ মহান আল্লাহতা’লার সাথে সম্পর্ক তৈরী করবে। হুজুর প্রত্যেক আহমদীর পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উন্নতি নিয়ে সবসময় চিন্তা করেন এবং একজন আহমদীও যেন বিপথে চলে না যায় সেজন্য চেষ্টা করেন।

আমি হুজুরকে সেই তরুণ আরব আহমদীর কথা বলি যার সাথে আমি কিছুক্ষণ আগেই কথা বলেছি। আমি হুজুরকে বলি কিভাবে তিনি জামাত থেক দূরে সরে যান এবং নিজের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতাই তাকে পুনরায় জামাতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। হুজুর বলেন “এটি একটি উদাহরণ যে মহান আল্লাহপাক সবসময়ই যারা স্বভাবগত ভাবে ধার্মিক তাদের সঠিক পথে চালনা করেন এবং তাদের ঈমানকে রক্ষা করেন।”

 

একটি মজাদার ঘটনা

আমি হুজুরকে গতদিনের একটি মজাদার ঘটনার কথা বলি। মাজিদ সাহেব, মোবারক সাহেব ও আমাকে প্রথমে মসজিদের অপর পাশে একটি বিল্ডিং এ অফিসের ব্যবস্হা করা হয়। কিন্তু সেখানে যেতে হলে আমাদের লাজনাদের একটি নিরাপত্তা প্রহরা অতিক্রম করে যেতে হয়। আমরা লাজনাদের কোনরকম বিরক্ত করতে চাচ্ছিলাম না। তাই আমরা মেজর মাহমুদ সাহেবকে (হুজুরের নিরাপত্তা দলের প্রধান) বলি যে আমাদের অফিসে যাবার অন্য কোন রাস্তা আছে কিনা? মেজর সাহেব আমাদের পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন যে আমরা “সালাম” বলে কোনরকম সমস্যা ছাড়াই লাজনাদের চেকপয়েন্ট পার হয়ে যেতে পারব। এরপর আমরা মেজর সাহেবের নেতৃত্বে চেকপয়েন্টের দিকে এগিয়ে যাই। যেহেতু আমরা মেজর সাহেবের সাথে আছি; তাই আমরা মনে করছিলাম যে আমরা কোনরকম তল্লাশি ছাড়াই বেরিয়ে যাব।

 

কিন্তু যে দুজন লাজনা সদস্য চেকপয়েন্টের দায়িত্বে ছিলেন তারা মেজর সাহেব বা আমাদের কাউকেই চিনতে পরালেন না। তারা ভদ্রভাবে আমাদের বললেন যে আমাদের চেক করেই অপর পাশে যেতে হবে। তাই প্রথমে তারা মেজর সাহেব, তারপর মাজিদ সাহেব ও সবশেষে আমাকে স্ক্যানার দিয়ে চেক করেন। তাদেরকে চেক করার সময় আমি অনেক কষ্টে আমার হাসিকে দমিয়ে রেখেছিলাম। তারা ঠিকভাবেই স্ক্যানার চেক পরা হয়ে গেলেন; কিন্তু আমার চেকের সময় স্ক্যানার বিপ শব্দ করে উঠল। তাই লাজনা সদস্য বললেন যে আমাকে আমার পকেট খালি করতে হবে। আমি আমার পকেট খালি করে পুনরায় স্ক্যানের পর চেকপয়েন্ট পার হয়ে গেলাম। আমার ঘটনা শুনে হুজুর হাসলেন ও জিজ্ঞেস করলেন “তারা মেজর সাহেবেরও পুরো নিরাপত্তা তল্লাশি নিয়েছে?”

আমি বললাম যে “তারা পুরো তল্লাশি নিয়েছে।”। আমার উত্তর শুনে হুজুর আরো আনন্দ পেলেন ও হাসলেন। লাজনা সদস্যরা আমাদের চেকের সময় আমরা কিছুটা বিব্রতবোধ করছিলাম। কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। আমার মনে হয় হুজুরও তাদের সতর্কতার তারিফ করবেন।

নিশ্চিতভাবেই আমি আমার শিক্ষা পেয়ে গিয়েছিলাম এবং সফরের বাকি সময় আমি আমার পকেট খালি রেখেছিলাম। সৌভাগ্যজনকভাবে সেদিন মুনির জাভেদ সাহেব আমাদের বললেন যে আমরা তার অফিস ব্যবহার করতে পারি। তাই আমাদের আর ভীতিকর চেকপয়েন্ট অতিক্রম করতে হয়নি।

 

হুজুরের দৃষ্টান্ত

অন্যান্য মসজিদের মতো নুসরাত জাহান মসজিদে ইমামের প্রবেশের জন্য পাশের কোন আলাদা দরজা ছিল না। তাই হুজুর প্রধান প্রবেশপথ দিয়েই মসজিদে আসতেন। তাই নামায শেষে হুজুর অন্যান্য নামাযীদের অতিক্রম করে বের হয়ে যেতেন।

হুজুর যেহেতু সফরে ছিলেন তাই তিনি নামায কসর করছিলেন। তাই মাঝেমাঝে এরকম হতো যে হুজুরের নামায শেষ হলেও স্হানীয় নামাযীদের কারো নামায তখনো শেষ হয়নি। হুজুর সেসময় ধৈর্য্যের সাথে তাদের নামায শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করতেন; যাতে তাদের নামাযের কোন অসুবিধা না হয়। তাদের নামায শেষ হবার পর হুজুর মসজিদ থেকে বের হতেন।

আমি মনে করি এটি সকল আহমদীদের জন্য একটি শিক্ষা। আমরা অনেক সময়ই দেখি যে কেউ নামায পড়ছে, কিন্তু তারপরও আমরা অপেক্ষা না করে তাকে অতিক্রম করে বা অনেক সময় তার সামনে দিয়েও হেঁটে চলে যাই। আমাদের যতই ব্যস্ততা থাকুক না কেন আমরা নিশ্চয়ই খলীফায়ে ওয়াক্তের চেয়ে বেশি ব্যস্ত নই।

মজলিস আনসারুল্লাহ আমেলার সাথে মিটিং

৭ মে ২০১৬ হুজুর ডেনমার্কের মজলিস আনসারুল্লাহ আমেলার সাথে মিটিং করেন। মিটিং এ হুজুর তবলীগের গুরুত্ব সম্বন্ধে বলেন এবং অতীতে তবলীগের যে সুযোগসমূহ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন।

হুজুর বলেন “যেসকল মুসলমানগণ প্রথমে ডেনমার্কে এসেছিলেন তাদের মধ্যে আহমদীরাও রয়েছেন। যদি সেসময় তবলীগের প্রতি সঠিকভাবে চেষ্টা করা হতো তাহলে এ দেশে আরো সফলভাবে প্রকৃত ইসলামের বার্তা ছড়িয়ে দেয়া যেত।”

আমি সবসময়ই লক্ষ্য করেছি যে কাজের ব্যাপরে হুজুর খুবই দক্ষ। তিনি এক মুহুর্ত সময়ও নষ্ট করেন না। হুজুর আহমদীদের দক্ষতাও বৃদ্ধি করতে চান। হুজুর ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন সময় আমাকে কর্মদক্ষতার গুরুত্বের কথা বলেছেন।

একজন আমেলা সদস্য বলেন যে ১ জানুয়ারী নতুন আমেলা গঠিত হয়েছে। তাই তারা এখনো তাদের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে। হুজুর বলেন “আপনারা কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? প্রায় অর্ধেক বছর পার হয়ে গেছে এবং এখনো আপনারা ঠিকমতো কাজ শুরুই করতে পারেননি। আমাদের দায়িত্ব পালনের জন্য কোনরকম সময় নষ্ট করা উচিৎ হবে না।”

সফরের সময় বিভিন্ন মিটিং এ হুজুর তরবিয়ত বিভাগের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। হুজুর বলেন যে জামাতের মধ্যে তরবিয়ত বিভাগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং তরবিয়ত সেক্রেটারীকে তার দায়িত্বের কথা সঠিকভাবে বুঝতে হবে।

তরবিয়ত সেক্রেটারীকে উদ্দেশ্য করে হুজুর বলেন “জামাতের সদস্যদের প্রতি কঠোর আচরণ না করে তাদের সাথে সবসময় ভালবাসাপূর্ণ আচরণ করবে। তাদের প্রতি দয়ার সহিত আচরণ করবে। ভালবাসার সাথে মানুষকে অনুপ্রণিত করবে। তোমার দায়িত্ব হলো মানুষকে জামাতের আরো কাছে নিয়ে আসা। তোমার আচরণ যেন তাদেরকে জামাত থেকে দূরে সরিয়ে না দেয়। এটি করার উপায় হল আহমদীদের সাথে দয়া ও ভালবাসাপূর্ণ আচরণ করা।”

মিটিং এর সময় হুজুর সেক্রেটারী এশায়াতের কাছে আনসারুল্লাহর পরবর্তী ম্যাগাজিনের নাম জানতে চান। প্রথমে হুজুর জানতে চান এ ব্যাপারে আমেলার কোন মতামত আছে নাকি। দুই একজন কিছু নাম প্রস্তাব করেন; কিন্তু হুজুর তাদের দেয়া নামে সন্তুষ্ট হলেন না। হুজুর নির্দেশ দেন যে ম্যাগাজিনের নাম হবে “আনসার-উদ্‌-দীন”।

একজন আমেলা সদস্য তার আশংকার কথা জানান যে এখন কিছু আহমদী তরুণ জামাত থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তারা মসজিদে এবং জামাতের কেন্দ্রে কম সময় কাটাচ্ছে। হুজুর বলেন “যদি তারা জামাত থেকে দূরে সরে যায় তার মানে হলো তাদের গুরুজন তাদের জন্য কোন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্হাপন করছে না। মাঝে মাঝে দেখা যায় কেউ নিজের ঘরে জামাতের কোন কর্মকর্তা বা সিদ্ধান্তের প্রতি বিরূপ কথা বার্তা বলে থাকে। এটি খুবই বিপজ্জনক; কারণ এটি তাদের সন্তানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অভিভাবক তাদের নিজেদের দুঃখ ও গর্বের কারণে সন্তানের ঈমানকে ধ্বংস করে দিতে পারে।”

“যদি কারো জামাতের প্রতি কোন অভিযোগ থাকে; তাহলে তার উচিৎ হবে না যে এজন্য নিজের বা সন্তানের ঈমানকে নষ্ট করা। বরং তাদের উচিৎ আল্লাহর সামনে নত হয়ে তার সাহায্য প্রার্থনা করা। মনে রাখবে আল্লাহতা’লা এখনো সেভাবেই শুনে থাকেন যেভাবে পূর্বে সবসময় শুনেছেন।”

“যদি কেউ মনে করে যে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাহলে তার উচিৎ আমাকে চিঠি লিখে জানানো। এরপর এটি খলীফার দায়িত্ব। খলীফা যদি মনে করে তাহলে তিনি এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিবেন। যদি তিনি কোন পদক্ষেপ নাও নেন তাহলেও তার দায়িত্ব সে পালন করেছে। এরপর তার কাজ হবে নিজের ঈমানের হেফাযত করা।”

একজন আমেলা সদস্য বলেন যে তার মাঝে মাঝে মনে হয় কিছু কিছু ব্যাপারে ন্যাশনাল আমীর সাহেব কঠোর অবস্হান নিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে হুজুর বলেন “আমি কখনো বলিনি যে সকল কর্মকর্তাই সবসময় পুরোপুরি সঠিক সিদ্ধান্ত দিবে। সকলেই মানুষ। কিন্তু আপনাদের উচিৎ হবে না যে ছোটখাট সমস্যার জন্য ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস করা। মনে রাখবেন আপনারা ন্যাশনাল আমীরের হাতে বয়াত করেন নি বরং আপনারা খলীফায়ে ওয়াক্তের হাতে বয়াত করেছেন। ”

 

লন্ডন ভ্রমণ

হুজুর উপদেশ দেন যে যেসব আহমদীরা দূরে সরে যাচ্ছে জামাতের উচিৎ তাদেরকে লন্ডনে নিয়ে এসে হুজুরের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করিয়ে দেয়া। এতে তারা খিলাফতের সাথে সরাসরি ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরী করার সুযোগ পাবে।

আমি আশা করি জামাত হুজুরের এই উপদেশ যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করবে। গত দুই বছর ধরে ইউকে ও অন্যান্য দেশ থেকে আহমদীগণ হুজুরের সাথে দেখা করার জন্য লন্ডনে আসেন। খিলাফতে ওয়াক্তের সাথে সময় কাটানোর পর তাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্যণীয়। আমি কিছু তরুণের সাথে কথা বলেছি যাদের জামাতের সাথে অল্পই সম্পর্ক ছিল। কিন্তু লন্ডনে হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর তাদের জীবন পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। তারা বিশ্বাস করতে পারেনি যে হুজুর এত বিনয়ী, দয়ালু এবং তাদের জন্য কত ভালবাসা রাখেন। এমন আধ্যাত্মিক বরকতের পর তারা প্রতিজ্ঞা করেছে যে তারা নিজেদের বাড়ীতে যেয়ে সবসময় জামাতের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখবে।

 

একটি আমন্ত্রণপত্র

জোহর ও আসরের নামাযের পর হুজুর তার বাসস্হানের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় এমটিএর ডিরেক্টর প্রোডাকশন মুনীর ওদেহ সাহেব হুজুরের কাছে আসেন। তিনি সেদিন সকালে সুইডেনের মালমো শহরে ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই হুজুর সেখানে মাহমুদ মসজিদ উদ্বোধন করতে যাবেন। তিনি হুজুরকে বলেন “মসজিদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু যে হলরুমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে সেটি এখনো সম্পন্ন হয়নি। এটি সময়মতো শেষ হবে এ ব্যাপারেও কোন নিশ্চয়তা দেয়া যাচ্ছে না।” তিনি হুজুরের কাছে জানতে চান যে অনুষ্ঠানের জন্য অন্য কোন স্হান খোঁজা হবে কিনা?

হুজুর বলেন “জামাতের উচিৎ ছিল সবকিছু শেষ হবার পর আমাকে মসজিদ উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের স্হানের জন্য আমি সুইডেনে যেয়ে সিদ্ধান্ত দিব।”

 

একজন আবেগপ্রবণ খাদেম

আমি একজন আহমদী খাদেম কানজ আনোয়ার (৩৭ বছর) সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি ডেনমার্কেই বড় হয়েছেন। সফরের সময় তিনি ডেনমার্কে মসজিদের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আমাকে বলেন যে কয়েক বছর পূর্বে তিনি জামাত থেকে দূরে সরে যান। সেমসয় তিনি অন্তরে কখনো শান্তি বা সন্তুষ্টি অনুভব করেন নি। তাই কয়েক বছর পর তিনি আবার মসজিদে আসা শুরু করেন। তিনি ভেবেছিলেন জামাত থেকে দূরে সরে যাবার কারণে সবাই তাকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখবে অথবা বকাবকি করবে। কিন্তু তিনি অবাক হন কারণ ন্যাশনাল আমীর সাহেব ও জামাতের অন্যান্য সদস্য সকলেই তাকে স্বাগত জানান। হুজুরের ডেনমার্ক সফরের কয়েক সপ্তাহ পূর্বে তিনি হুজুরের সাথে দেখা করার জন্য লন্ডন যান। সেখানে তার অনুভুতি সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমি যখন লন্ডনে হুজুরের সাথে দেখা করি তখন বুঝতে পারি যে জামাত থেকে দূরে সরে যেয়ে আমি কি বড় ভুলই না করেছিলাম। আমাদের খলীফা প্রত্যেক আহমদীকেই ভালবাসেন। এমনকি আমার মতো মানুষের জন্যও হুজুরের হৃদয়ে ভালবাসা রয়েছে। এই বরকতময় জামাত থেকে দূরে সরে যাবার জন্য আমি ইসতেগফারের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব।”

তিনি আমাকে বলেন যে খলীফা ও জামাতের সাথে পুনরায় সম্পর্ক স্হাপনের পর তিনি নিজের মধ্যে এক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। তিনি বলেন “আমি যখন আমার পূর্বের অবস্হা চিন্তা করি তখন আমি নিজেকে চিনতে পারি না। পূর্বে আমার হৃদয় তিক্ততায় পরিপূর্ণ ছিল। আমার এক তরুণ ছেলে রয়েছে। সে বলে যে আমি যখন থেকে জামাতের মসজিদে আসা শুরু করেছি তখন থেকে সে আমার মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন দেখতে পেয়েছে। সে এখন আমাকে আরো বেশি ভালবাসে। সে যেরকম আশা করে আমি এখন সেরকম বাবা হতে পেরেছি।”

আহমদী মহিলার আবেগ

আমি একজন আহমদী মহিলার সাথে কথা বলি। তার নাম কানিতা লাইক। তিনি কিছুক্ষণ পূর্বেই প্রথমবারের মতো হুজুরের সাথে দেখা করেছেন। আগের দিন তিনি হুজুরের সম্মানিত স্ত্রীর সাথে দেখা করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তিনি চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন “আজ আমার জীবনে প্রথমবারের মতো আমি যুগ খলীফার সাথে দেখা করি। আমি কখনো ভাবিনি যে কেউ এত সুন্দর ও অমূল্য হতে পারে। হুজুরের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো সবসময় আমার মনে থাকবে। ”

হুজুরের স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তিনি বলেন “যখন আমি আপা জান এর সাথে দেখা করি তখন তিনি এত ভালবাসা ও দয়ালু ব্যবহার করেন যে আমার মনে হলো আমি আমার মায়ের সাথে দেখা করছি। তিনি অনেক জ্ঞানী এবং পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দেন। যেমন তিনি বলেন যে যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা যায় তাহলে বাচ্চাদের সামনে সেটা নিয়ে আলোচনা বা রাগারাগি করা যাবে না।”

“আমরা আপা জান কে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করি। তিনি বলেন যে তিনি এবং হুজুর দুজনেই খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন এবং নিজেদের ঘরের কাজ নিজেরাই করেন। এটি শুনে আমি অনেক অবাক হয়েছি।”

একটি সাধারণ জীবন

কানিতা সাহিবার কথা শুনে আমি তাকে বললাম যে আমিও দেখেছি হুজুর ও তার স্ত্রী খুবই সাধারণ জীবনযাপন করেন। এত ব্যস্ততা এবং দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও তা বাসার সাধারণ কাজকর্ম নিজেরাই করেন। যেমন হুজুর আমাকে বলেছেন মাঝেমাঝে ঘরের কিছু ঠিকঠাক করার প্রয়োজন হয়। তখন কাউকে না ডেকে হুজুর নিজের হাতেই সেটি ঠিক করেন এবং অন্যান্য কাজকর্মও করে থাকেন।

অনেকে ভেবে থাকেন হুজুরের স্ত্রীর ঘর ও রান্নার কাজের জন্য অনেক সাহায্যকারী থাকে। কিন্তু এটি আসলে সঠিক নয়। লন্ডনে হুজুরের অফিসের পিছনে হুজুরের একটি ছোট বাগান রয়েছে। হুজুর দয়া করে আমাকে কয়েকবার তার সাথে বাগানে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। গ্রীষ্মকালে হুজুর চেরী ও অন্যান্য গাছ লাগিয়ে থাকেন। আমি দেখেছি হুজুর অত্যন্ত ভালবাসার সাথে তার বাগানের পরিচর্যা করেন। হুজুর আমাকে মাঝেমাঝে কোন গাছের ডাল ধরে রাখতে বলেন এবং তিনি তা ছেটে দেন; পাকা ফল আমাকে ব্যাগের মধ্যে রাখতে বলেন; তিনি সেগুলো আমাকে খেয়েও দেখতে বলেন। হুজুরের সাথে একসাথে বাগানে কাজ করার মুহুর্তগুলো আমার জন্য খুবই মূল্যবান। হুজুর অন্যদের উপর নির্ভর করার চেয়ে নিজের কাজ নিজে করতেই পছন্দ করেন।

 

সত্যবাদীতার গুরুত্ব

আমি ডেনমার্কের লাজনা ইমাইল্লাহর সেক্রেটারী জিয়াফত শাহিস্তা নিগাই সাহিবার সাথে কথা বলি। তিনি হুজুরের স্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন। তিনি বলেন “আপা জান অনেক সাধারণ এবং বিনয়ী মনের মানুষ। আমরা তার সাথে সময় কাটিয়ে অনেক উপকৃত হয়েছি। তিনি আমাদের প্রতি অনেক ভালবাসাপূর্ণ আচরণ করেছেন। তিনি লাজনাদের জন্য জ্ঞানের ঝরণা। তিনি আমাদের একটি ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে বলেন। সেটি হল সকল ব্যাপারেই পুরোপুরি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। তিনি যখন কোন কথা বলেন সেটি আমরা সকলেই পালন করার চেষ্টা করি; কারণ আমরা দেখতে পাই যে তিনি একজন সত্যবাদী মহিলা।”

 

কসোভোর আহমদীদের সাথে সাক্ষাত

এই সফরে আমি কসোভোর বেশ কিছু আহমদীর সাথে কথা বলি। ১৯৯০ সালে যখন তাদের দেশে সমস্যা দেখা দিয়েছিল তখন তারা ডেনমার্কে চলে আসে। দক্ষিণ ডেনমার্কে ছোট একটি শহর নাকসভে অনেক কসোভো আহমদী বাস করেন।

আমি একজন কসোভোর আহমদী মোহারাম কুনজিজি সাহেবের সাথে কথা বলি। তিনি ১৯৯২ সালে ডেনমার্কে আসেন এবং পরের বছর আহমদীয়াত গ্রহণ করেন। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের পর তিনি বলেন “আমি কেবল আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারি। কারণ লাখ লাখ আহমদী হুজুরের সাথে দেখা করার ইচ্ছা রাখে। আজকে আল্লাহতা’লা আমাকে এই সুযোগ ও সৌভাগ্য দান করেছেন। হুজুরের সাথে সাক্ষাতের মুহুর্তগুলো, তার বরকতময় চেহারা, তার বক্তব্য সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। ”

আর একজন কসোভোর আহমদী আদম সুজে সাহেব বলেন “হুজুর অত্যন্ত সুন্দর ও ভালবাসাপূর্ণ, তিনিই আমাদের সবকিছু। তার সাথে দেখা করে আমার ঈমান আরো দৃঢ় হয়েছে। আমি ডেনিশ পাসপোর্ট পাবার সাথেসাথেই লন্ডনে যেয়ে হুজুরের সাথে পুনরায় দেখা করব।”

 

মজলিদ খোদ্দামুল আহমদীয়ার সাথে মিটিং

হুজুর মে ৮, ২০১৬ তারিখে মজলিস খোদ্দামুল আহমদীয়া ডেনমার্কের সাথে মিটিং করেন। মিটিং এ হুজুর আমেলা সদস্যদের তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দেন। হুজুর বলেন “আমেলার সদস্য হিসেবে তোমাদের উচিৎ সর্বোৎকৃষ্ট আচরণ প্রদর্শন করা যেন সকল খোদ্দামগণ তোমাদের নিজেদের আদর্শ মনে করতে পারে। নিজেদেরকে খোদ্দামদের নেতা মনে করবে না বরং তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী করবে। ইনশাল্লাহ এরকম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ফলে তারা স্বাভাবিকভাবেই মসজিদ ও জামাতের দিকে আকৃষ্ট হবে।”

খোদ্দাম এশায়াত সেক্রেটারী বলেন যে খোদ্দামদের একটি ম্যাগাজিন আছে। কিন্তু সেটি নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয় না। হুজুর বলেন “একটি সফল সংগঠন অনিয়মিতভাবে কোন কাজ করে না বরং তারা একই উদ্যমে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সর্বদা কাজ করে যায়। যদি আমরা আমাদের কাজ নিয়মিত না করি তাহলে আহমদীয়াতকে গ্রহণ করতে পুরো বিশ্বের হাজার বছর লেগে যাবে।”

মিটিং এর শেষে একজন আমেলা সদস্য হুজুরকে অনুরোধ করেন যে হুজুর যেন পরবর্তী ডেনমার্ক সফরের জন্য ১১ বছর অপেক্ষা না করেন। হুজুর হাসেন এবং বলেন “সত্যিই এগার বছর পার হয়ে গেছে। সময় কিভাবে উড়ে চলে যায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে জামাত বিশ্বের সকল প্রান্তে ছড়িয়ে গিয়েছে। আফ্রিকান ও দক্ষিণ আমেরিকার আহমদীরাও আমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। জামাত সেখানে অনেক উন্নতি করেছে।”

“কিন্তু আমি যদি চার ঘন্টার নোটিশে ডেনমার্ক আসতে চাই তোমরা কি সব ব্যবস্হা করতে পারবে?”

তিনি সাথে সাথেই বলে উঠেন “জি হুজুর; আমরা তৈরী থাকব।”

 

জামাতের ইতিহাস সংরক্ষণ

হুজুর নুসরাত জাহান মসজিদে ডেনমার্ক আতফালদের সাথে ক্লাসে বসেন। সেখানে আতফালরা ডেনমার্ক জামাত সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়। সেখানে বলা হয় যে খলীফাতুল মসীহ সালেস(রহঃ) ১৯৬৭ সালে ট্রেনে ডেনমার্ক এসেছিলেন।

হুজুর জানতে চান যে খলীফাতুল মসীহ সালেস(রহঃ) কোন স্হান হতে ট্রেনে আসছিলেন। কিন্তু আমীর সাহেব ও অন্যান্যরা কেউই এর উত্তর দিতে পারেন নি। হুজুর বলেন যে তার মনে হয় তিনি জার্মানী থেকে ট্রেনে এসেছিলেন। কয়েক মুহুর্ত পর আতাউল আব্বাসী সাহেব যিনি একজন ওয়াকফে জিন্দেগী এবং এমটিএ ইন্টারন্যাশনাল এর সাথে সফর করছেন; হুজুরকে বলেন যে তিনি এমটিএর জন্য এ বিষয়ে কিছু পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি জানতে পেরেছেন যে খলীফাতুল মসীহ সালেস(রহঃ) জার্মানীর হামবুর্গ শহর থেকে ট্রেনে করে ডেনমার্ক এসেছিলেন।

তারপর হুজুর জামাতের বুজুর্গদের দিকে তাকিয়ে বললেন “প্রত্যেক জামাতের তাদের নিজেদের ইতিহাস জানা ও সংরক্ষণ করা উচিৎ। ইতিহাসের অর্ধেক বা কিছু অংশ জানা যথেষ্ট নয়। ”

 

আতফালদের প্রশ্ন

ক্লাসে আতফালগণ হুজুরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। একজন আতফাল হুজুরকে জিজ্ঞেস করেন যে হুজুর কেন সাদা রঙের শেরওয়ানী পরেন নি। হুজুর হাসেন এবং বলেন “প্রত্যেক মানুষের নিজের পছন্দের রঙের কাপড় পরার অধিকার রয়েছে।”

 

বিরতিহীন কর্মসূচি

একজন ছেলে হুজুরকে জিজ্ঞেস করে যে হুজুরের সাপ্তাহিক ছুটির দিন কোনটি। হুজুর বলেন “আমি সপ্তাহের সাত দিনই কাজ করি। হয়ত মাঝেমধ্যে ৫-৬ মাস পর কয়েক ঘন্টার জন্য বিরতি নিয়ে থাকি। ”

বেশির ভাগ ওয়াকফে জিন্দেগীদের জামাত থেকে সপ্তাহে একদিন ছুটি দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু হুজুর প্রতিটি দিনই কাজ করেন। সম্প্রতি একজন আমাকে বলেন যে হুজুর প্রতি শুক্রবার জুমআর নামাযের পর ছুটি নিয়ে থাকেন, এটি সঠিক নয়। বরং জুমআর নামাযের দুই ঘন্টার মধ্যেই হুজুর তার অফিসে যান এবং বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব রিপোর্ট আসে সেগুলো দেখেন; জামাতের লোকজন যে ব্যক্তিগত চিঠি দেয় সেগুলো পড়েন অথবা অন্য কোন জামাতী কাজ করেন।

হুজুরের কাজ করার যে ক্ষমতা তা আমি আমার জীবনে কারো মধ্যে দেখিনি। হুজুরের লম্বা সফরগুলো যখন শেষ হতো যেমন দূরপ্রাচ্য বা অষ্ট্রেলিয়া সফর তখন কাফেলা সদস্যরা তদের ঘরে যেয়ে বিশ্রাম নিত। কিন্তু হুজুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই লন্ডনের অফিসে ফিরে আসতেন।

হুজুরের আরো একটি বিশেষ ক্ষমতা হচ্ছে একই সাথে কয়েকটি কাজ করা। বিভিন্ন সময়ে আমি হুজুরের অফিসে গিয়েছি। আমি দেখেছি হুজুর অফিসের চিঠি পড়ছেন ও নির্দেশনা লিখছেন এবং একই সাথে আমি যে রিপোর্ট দিয়েছি সে ব্যাপারে মৌখিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। মাঝেমাঝে আমি যখন দেখি যে হুজুর মনোযোগ দিয়ে কোন চিঠি বা রিপোর্ট পড়ছেন তখন আমি চুপ হয়ে যাই যেন হুজুর তার কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন। কিন্তু হুজুর আমাকে বলেন যে আমি যেন আমার রিপোর্ট বলা চালিয়ে যাই।

 

সেক্রেটারী উমর এ খারিজা(এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স) এর সাথে সাক্ষাৎ

৯ মে, ২০১৬ তারিখে হুজুর কোপেনহেগেনে কিছু সম্মানিত অতিথির উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিবেন। এজন্য আগের দিন আমি সেক্রেটারী উমর এ খারিজা(এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স) সাহেবের সাথে এই বিষয় নিয়ে আলাপ করি। তিনি আমাকে বলেন যে জামাত ১২-১৩ জন অতিথি বক্তার তালিকা তৈরী করেছেন। যারা হুজুরের বক্তৃতার পূর্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিবেন। আমার মনে হলো অতিথি বক্তাদের সংখ্যা অনেক বেশী। তাই আমি তাকে উপদেশ দেই যে অতিথি বক্তার সংখ্যা যেন ৫-৬ জনে কমিয়ে আনা হয়। আমি পূর্বে এরকম অনেক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। আমার অভিজ্ঞতা বলে যে যদি অনুষ্ঠান বেশী লম্বা হয়ে পড়ে তাহলে অতিথিরা ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়ে। আমাদের জামাতের উদ্দেশ্য হল অতিথিরা যেন খলীফাতুল মসীহর কথা শুনে তা হৃদয়ে অনুধাবণ করতে পারে। কিন্তু যদি হুজুরের বক্তব্যের পূর্বেই তারা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে তাহলে আমাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হবে না। পরবর্তীতে স্হানীয় জামাত অতিথি বক্তার সংখ্যা কমিয়ে এনেছিল।

 

কানাডা সম্বন্ধে হুজুরের মতামত

৯ মে ২০১৬ তারিখে কানাডার জামাতের সদস্য আমাকে একটি অনুষ্ঠানের ছবি পাঠায়। এটি কানাডার জামাতের ৫০ বছর পূর্তি হিসেবে টরোন্টো শহরের একটি খোলা স্হানে আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে অনেক আহমদী, সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও অতিথিবৃন্দ উপস্হিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের পর আহমদীগণ সেই খোলা স্হানেই নামায আদায় করেন। আমি হুজুরকে সেই ছবিটি দেখাই। হুজুর বলেন “মাশআল্লাহ এরকম অনুষ্ঠান আয়োজনের দিক দিয়ে কানাডার জামাত অনেক অভিজ্ঞ।” আলহামদুলিল্লাহ, আমার মনে হল হুজুর এতে সন্তুষ্ট হয়েছেন।

 

আমার নতুন ট্রাউজার উদ্বোধন

সফরের পূর্বে আমি লন্ডনের বিখ্যাত শোরুম ‘মার্কস এন্ড স্পেনসার’ এ কিছু কাপড় কিনতে যাই। সেখানে আমি একজোড়া ট্রাউজার কিনি। সেটি আমার পছন্দের চেয়ে একটু বেশী দামের ছিল। আমি চিন্তা করছিলাম যে কোথায় আমি আমার নতুন ট্রাউজার উদ্বোধন করব। অনেক চিন্তা ভাবনার পর আমি ঠিক করলাম যে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠানে আমি নতুন ট্রাউজার পরব।

তাই সেদিন জোহর ও আসরের নামাযের পর আমি তৈরী হবার জন্য আমার রুমে আসি। আমি গর্বের সাথে লাগেজ থেকে ট্রাউজার বের করে তা সাবধানতার সাথে আয়রন করি। যদিও আমি খুব ভাল আয়রন করতে পারি না; কিন্তু তারপরও আমি ট্রাউজারের সকল কোনা অত্যন্ত যত্নের সাথে আয়রন করি। অবশেষে আমি আমার আয়রন করার কাজে সন্তুষ্ট হই। এরপর আমি ট্রাউজার পরে বোতাম লাগাই; কিন্তু সেটি সাথে সাথেই নিচে পড়ে যায়। আমি বুঝতে পারলাম নে; যে কেন এরকম হল। আমি আবারো ট্রাউজার উঠিয়ে বোতাম লাগালাম; কিন্তু আবারো তা মাটিতে পড়ে গেল। এরপর আমি ট্রাউজার উঠিয়ে তার লেবেল চেক করলাম। আমি আতঙ্কিত হয়ে দেখলাম যে ট্রাউজার এর সাইজ হল ৪২ ইঞ্চি। যেখানে আমি সাধারণত ৩০-৩২ ইঞ্চি ট্রাউজার পরে থাকি, সেখানে ৪২ ইঞ্চি ট্রাউজার মাটিতে পড়ে যাবে এটিই স্বাভাবিক।

যাহোক এরপর আমি লাগেজ থেকে অন্য ট্রাউজার বের করে সেটি আয়রন করি। আমার মন তখন স্বভাবতই খারাপ ছিল এটা ভেবে যে এখন সফরের পুরো সময় নতুন ট্রাউজারগুলো লাগেজেই থাকবে। ট্রাউজার নিয়ে বিপত্তি সত্ত্বেও আমি অনুষ্ঠানে হুজুরের বক্তৃতা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম।

 

অনুষ্ঠানের পথে যাত্রা

৯ মে, বিকেল ৫.৩০ মিনিটে হুজুর ধূসর রঙের শেরোয়ানী কোট পরে তার বাসস্হান থেকে বেরিয়ে গাড়ীর দিকে এগিয়ে যান। হুজুরের গাড়ীর ঠিক পিছনের গাড়ীতেই ছিলাম আমি, মোবারক জাফর সাহেব ও নাসির আহমদ সাহেব। তালহা মাজোকা নামে একজন লোকাল খাদেম আমাদের গাড়ী চালাচ্ছিল। আমরা বিকেল ৫.৫৫ মিনিটে কোপেনহেগেনের হোটেল হিলটনে পৌছলাম।

 

সম্মানিত অতিথিদের সাথে হুজুরের সাক্ষাৎ

হোটেলে যেয়ে হুজুর সম্মানিত অতিথিদের সাথে একটি রুমে সাক্ষাৎ করেন। অতিথিদের মধ্যে ছিলেন ডেনমার্কের সংস্কৃত ও ধর্মীয় মন্ত্রী, সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং একজন খ্রিষ্টান ধর্মযাজক। তারা হুজুরকে স্বাগত জানানোর জন্য পূর্ব থেকেই রুমে অপেক্ষা করছিলেন। হুজুর প্রায় ২৫ মিনিট তাদের সাথে কথা বলেন। এসময় তারা বিভিন্ন বৈশ্বিক বিষয়াবলী সম্বন্ধে হুজুরের মতামত জানতে চান।

 

শান্তির বার্তা

একজন মহিলা সংসদ সদস্য উলা স্যান্ডবেক হুজুরকে বলেন যে তিনি হুজুরের একটি ভিডিও মেসেজ তৈরী করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করতে চান। তিনি বলেন “অনেক মানুষের ইসলাম সম্বন্ধে ভুল ধারণা রয়েছে। আমি চাই প্রকৃত ইসলামের একজন প্রতিনিধি হিসেবে আপনি ইসলামের সঠিক শিক্ষা মানুষের সামনে তুলে ধরবেন।” হুজুর ভিডিও বার্তা তৈরী করতে সম্মতি দেন।

তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন যে তার ফোন দিয়ে ভিডিও রেকর্ড করবেন। কিন্তু আমাদের এমটিএ তাদের ক্যামেরা ব্যবহার করে তার জন্য ভিডিও মেসেজ তৈরী করে দেবার প্রস্তাব দেন। এরপর হুজুর ২-৩ মিনিট অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রকৃত ইসলামের শান্তির বার্তা সম্বন্ধে বলেন। হুজুর বলেন “ইসলামের শাব্দিক অর্থ শান্তি। তাই যারা শান্তির বিরুদ্ধে কোন কাজ করছে তারা ইসলামের প্রকৃত অনুসারী নয়। ইসলাম হল শান্তি, ভালবাসা ও সৌহার্দ্য। আমি মনে করি মানবীয় মূল্যবোধ সবকিছু থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত ইসলাম বলতে আমি এটিই বুঝি।”

হুজুরের বক্তব্যের পরে সেই সংসদ সদস্যাকে আবেগপ্রবণ মনে হচ্ছিল। তিনি হুজুরকে বলেন “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনার বার্তা অনেক সুন্দর। আমি ইসলাম বলতে যা আশা করি আপনি তাই প্রচার করেছেন। আমি আপনার বার্তাকে বিশ্বে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করব।”

আমি পরবর্তীতে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তিনি কেন হুজুরের ভিডিও বার্তা রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন “আমি খলীফার ভিডিও রেকর্ডিং করেছি; কারণ আমি বিশ্বকে জানাতে চাই যে ইসলাম হচ্ছে শান্তির ধর্ম। খলীফা সত্যিই অনুপ্রেরণীয়। বর্তমান বিশ্বে যে অস্হিরতা চলছে তার মাঝে একমাত্র তিনিই সুবিবেচকের মতো কথা বলছেন। আমি তার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।”

 

সমবেদনার বার্তা

কয়েক মিনিট পর বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত মিটিং রুমে আসেন। তার সাথে পরিচয়ের পর হুজুর তাকে বলেন “বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে সন্ত্রাসী হামলার জন্য আমি আন্তরিকভাবে সমবেদনা জানাচ্ছি। সন্ত্রাসী হামলার পর স্হানীয় আহমদী মুসলমানগণ সাথেসাথেই দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হয় এবং বেলজিয়াম সরকারও তাদের প্রশংসা করেছে। আহমদী মুসলমানরা যে দেশেই থাকুক না কেন তারা সবসময় তাদের দেশের প্রতি বিশ্বস্ত।”

 

কোপেনহেগেন অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান

সম্মানিত অতিথিদের সাথে মিটিং শেষে হুজুর হিলটন হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে যান যেখানে অনুষ্ঠান শুরু হবে। সেখানে ১২৫ জনের মতো অতিথি উপস্থিত ছিলেন। কুরআন তিলাওয়াতের পর কয়েকজন অতিথি শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। অতিথিরা সকলেই হুজুরকে ডেনমার্কে স্বাগত জানান এবং জামাতের শান্তিপূ্র্ণ কর্মকান্ডের প্রশংসা করেন। সংস্কৃত ও ধর্মীয় মন্ত্রী বেরটেল হারডার বলেন “আমি বলতে চাই যে আহমদীয়া মুসলিম জামাত একটি বিশেষ জামাত। কারণ এই জামাতের সদস্যরা ডেনিশ সমাজের খুবই ভালভাবে সাথে একীভূত হয়ে গিয়েছে।”

আর একজন সংসদ সদস্য বলেন “হযরত মির্যা মাশরুর আহমেদ ইসলামের পক্ষে শান্তি, ভালবাসা ও ঐক্যবদ্ধতার কথা বলছেন। আমি আজ এখানে এসেছি আপনার কথা শুনে অনুপ্রেরণা পাবার জন্য; যেন আমি আপনার বার্তাকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারি।”

 

হুজুরের বক্তব্য

হুজুর তার বক্তব্যে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সম্বন্ধে আলোকপাত করেন। তিনি বলেন যে মানবজাতির উচিৎ একে অপরের বিশ্বাসকে সম্মান জানানো। ডেনমার্কেই এক দশক পূর্বে মহানবী(সাঃ) কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ কার্টুন ছাপানো হয়েছিল। এরপর অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশেও এই রকম কর্মকান্ডের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এটি সারা বিশ্বের মুসলমানদের অপরিসীম কষ্ট দিয়েছে।

একে অপরের বিশ্বাসকে সম্মানের ব্যাপরে হুজুর বলেন “বর্তমান বিশ্বে বাকস্বাধীনতার নামে নবী ও সাধু-সন্ন্যাসীদের নিয়মিতভাবে উপহাস করা হয়। এমনকি ডেনমার্কেও কয়েক বছর পূর্বে মহানবী(সাঃ) কে নিয়ে একটি কার্টুন ছাপানো হয়েছিল। যেখানে তাকে নাউজুবিল্লাহ একজন যুদ্ধপ্রিয় ও সাম্রাজ্যবাদী নেতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। ”

“মহানবী(সাঃ) এর এরকম প্রতিচ্ছবি ইতিহাস পরিপন্থী এবং পুরোপুরি মিথ্যা। প্রকৃত সত্য হল মহানবী(সাঃ) সবসময় শান্তি ও মানবাধিকার প্রচেষ্টা করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ”

“যদি আমরা সত্যিই বিশ্বে শান্তি স্হাপন করতে চাই; তাহলে আমাদের কাজের ফলাফল কি হবে সেটা চিন্তা করা উচিৎ। অন্যদের বিশ্বাস ও চিন্তাধারাকে আমাদের সম্মান করতে হবে। এটিই হল সেই উপায় যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন স্হানে শত্রুতা ও ঘৃণার যে দেয়াল আছে তা ভেঙ্গে যাবে। ”

“যদি মানুষ কোনরকম পক্ষপাতিত্ব ছাড়া ন্যায়বিচারকের দৃষ্টিতে ইসলামকে বিচার করে, তাহলে তারা অনুধাবন করবে যে, ইসলাম হল শান্তির ধর্ম।”

“ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর(রাঃ) এর যুগে সিরিয়ান খ্রিষ্টানরা রোমান শাসকদের তুলনায় ইসলামিক শাসকদের অধীনেই থাকতে পছন্দ করেছিল। কারণ তারা দেখেছিল যে মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় ও নাগরিক সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে।”

হুজুর যুদ্ধের সতর্কবার্তা দিয়ে তার বক্তব্য শেষ করেন। হুজুর বলেন “বিশ্বের বিভিন্ন স্হানে সংঘাত বেড়েই চলেছে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে আমরা একটি যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছি। আমাদের চোখের সামনেই বিভিন্ন জোট তৈরী হচ্ছে। আমার সবচেয়ে বড় ভয় যে আমরা পাগলের মতো কোন চিন্তাভাবনা না করেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।”

 

হুজুরের বক্তব্যের প্রভাব

হুজুরের বক্তব্যের পরে আমি কিছু অতিথির সাথে কথা বলি। আমি দেখতে পারি যে হুজুরের বক্তব্য আরো একবার অনেক মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে এবং ইসলাম সম্বন্ধে তাদের ভুল ধারণাকে দূর করেছে। লারস নামে একজন ডেনিশ বলেন “খলীফা বিস্তারিতভাবে বলেছেন যে মোহাম্মদ(সাঃ) একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। যাকে ভুলভাবে উপস্হাপন করা হচ্ছিল। তিনি তার ধর্মকে এত সুন্দরভাবে রক্ষা করলেন যে আমাদের আর কিছু বলার নেই।”

ক্যারল নামে আর একজন অতিথি বললেন “আমি আজ একজন শান্তিপ্রিয় মানুষের দেখা পেয়েছি। তিনি প্রমাণ করেছেন যে মিডিয়া ইসলাম সম্বন্ধে যা অপপ্রচার করছে তা সম্পূর্ণ ভুল। আমি অনেক আবেগপ্রবণ ও অনুপ্রাণিত হয়েছি। আমি আজ জ্ঞানী একজনের দেখা পেয়েছি। আমার ভাল লেগেছে যেভাবে উনি বাকস্বাধীনতা ও বিশ্ব-শান্তির মধ্যে সাম্যাবস্হা স্হাপন করেছেন।”

হেনরিক গেমেলহফ নামে একজন ডেনিশ অতিথি বলেন “সত্যি কথা বলতে ডেনিশদের ইসলাম সম্বন্ধে ভয় রয়েছে। এর কারণ হল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সংঘাতসমূহ। কিন্তু আজকের পরে আমরা এটা জানতে পেরেছি যে বিশ্বে ইসলামের নামে যা হচ্ছে তার সাথে মোহাম্মদ(সাঃ) বা ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।”

মানবাধিকার সংস্হায় কর্মরত একজন মহিলা বলেন “আহমদীয়া মুসলিম জামাতের কর্মকান্ড সম্বন্ধে আমরা খুব কমই জানি। দেখা যাচ্ছে মিডিয়া কেবল নেতিবাচক খবরই প্রকাশ করে। ডেনমার্কের সকল মিডিয়ার উচিৎ ছিল খলীফার শান্তিপ্রিয় বাণী শুনতে এখানে আসা। ”

আর একজন অতিথি বলেন “খলীফা কয়েক বছর পূর্বে মোহাম্মদ(সাঃ) নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে কথা বলেছেন। এই বিষয়ে কথা বলা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। কিন্তু খলীফা সর্বোত্তম উপায়ে কারো মনে আঘাত না দিয়ে; কি ভুল হয়েছে তা ব্যাখ্যা করেছেন।”

 

 

একটি মজাদার কথোপকথোন

আমি উলিয়া ফিন উলরিক নামে একজন ডেনিশ মহিলার সাথে কথা বলি। তিনি বলেন “আমার স্বামী মুসলমানদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে আসতে অত্যন্ত ভীত ছিল। কারণ সে ভয় করছিল যে এখানে সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করবে অথবা আত্মঘাতী হামলা হবে।”

কিন্তু মুসলমানদের অনুষ্ঠান কেমন হয় সেটি জানার জন্য তিনি অত্যন্ত কৌতুহলী ছিলেন। তাই তিনি তার স্বামীকে জোর করে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠানের পর তাদের অনুভূতি সম্বন্ধে তিনি বলেন “আমি আমার জীবনে কখনো এরকম অনুষ্ঠান দেখিনি। আমি এখন মেনে নিয়েছি যে ইসলাম একটি শান্তিপূর্ণ ধর্ম। আমি আশা করি অন্যান্য মানুষরাও খলীফার কথা শুনবে। আমার স্বামীও এখানে এসে অত্যন্ত আনন্দিত, আমার মনে হয় সে একটু আবেগপ্রবণও হয়ে পড়েছে। আমি এখানে আসতে পেরে গর্বিত। যদি কেউ এখানে না এসে থাকে তাহলে তারা সত্যিই ভুল করেছে। কারণ আমরা যেই বার্তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তারা সেটা শুনতে পারেনি।”

 

একটি মজাদার ব্যুফে

অনুষ্ঠানের পর লম্বা টেবিলে ব্যুফে খাবারের ব্যবস্হা করা হয়। বেশির ভাগ সময় আমি অতিথিদের সাথে কথা বলেই কাটাই। শেষের দিকে আমি গ্রিল স্যালমন ও আলু রোস্ট নেই। স্যালমন অত্যন্ত সুস্বাদু ছিল। টেবিলে আরো অনেক প্রকার খাবার ছিল। যদিও আমি সেগুলো খেতে পারিনি কিন্তু সব খাবারই অত্যন্ত সুস্বাদু মনে হচ্ছিল।

 

মসজিদে ফিরে এসে চাঁদ দেখার দোয়া

আলহামদুলিল্লাহ, কোপেনহেগেনের অনুষ্ঠান সবদিক দিয়েই অত্যন্ত বরকতময় ছিল। আমরা যখন মসজিদে ফিরে আসলাম হুজুর তার গাড়ী থেকে নেমে আমাকে অনুষ্ঠান সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। আমি হুজুরকে বললাম যে অনেক অতিথিই হুজুরের বক্তৃতার ডেনিশ অনুবাদ চেয়েছেন। আমার কথা শুনে হুজুর আমীর সাহেবকে বললেন যে ইংরেজী থেকে ডেনিশ ভাষায় অনুবাদ করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি কে হতে পারে।

আমীর সাহেব একজনের নাম বললেন। কিন্তু হুজুর বললেন যে ফালাহ উদ দীন সাহেব কয়েক বছর পূর্বে জামেআ আহমদীয়া ইউকে থেকে পাশ করে মোবাল্লেগ হয়েছেন। তার ইংরেজীর মান ভাল, তিনিই অনুবাদ করার জন্য যোগ্য ব্যক্তি।

হুজুর যখন তার রুমে ফেরত যাচ্ছিলেন, তখন মেজর সাহেব হুজুরকে বললেন যে নতুন চাঁদ দেখা যাচ্ছে। সাথেসাথেই হুজুর চাঁদের দিকে দেখলেন এবং দোয়ার জন্য হাত উঠালেন। আমারাও দোয়ায় সামিল হলাম। এভাবে হুজুর মহানবী(সাঃ) এর সুন্নত পালন করলেন।

 

রেডিও ২৪ সেভেন কে সাক্ষাৎকার

অনুষ্ঠানের সময় জনপ্রিয় ডেনিশ সাংবাদিক রুশে রশিদ সাহিবা হুজুরের সাথে দেখা করেন। তিনি রেডিও ২৪ সেভেনে একটি অনুষ্ঠান উপস্হাপনা করেন। তিনি হুজুরকে ডেনমার্ক থেকে যাবার পূর্বে একটি সাক্ষাৎকার দেবার জন্য অনুরোধ করেন। যদিও পরের দিনই হুজুর ডেনমার্ক থেকে চলে যাবেন, তবুও হুজুর তাকে পরদিন সকালে সাক্ষাৎকারের জন্য মসজিদে আসতে বলেন।

তাই ১০ মে, ২০১৬ তারিখ সকাল ১০.৩০ মিনিটে নুসরাত জাহান মসজিদে হুজুর রেডিও ২৪ সেভেন কে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকার ৩০ মিনিট হবার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেটি ৫০ মিনিট স্হায়ী হয়। এর কারণ হল সাংবাদিক হুজুরকে ইংরেজীতে প্রশ্ন করতেন এবং তার প্রশ্ন ও হুজুরের উত্তর ডেনিশ ভাষায় অনুবাদ করে দিতেন।

 

সকল দিকেই হুজুরের মনোযোগ

আমি একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি যে হুজুর সবসময়ই সকল জিনিসের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখেন। যেসব জিনিসের প্রতি আমার বা অন্য কারো লক্ষ্য রাখার কথা; মাঝেমাঝেই আমরা তা ভুলে যাই, কিন্তু হুজুর ঠিকই তা লক্ষ্য রাখেন। সাক্ষাৎকারের সময়ও এরকম একটি ঘটনা ঘটে।

সাক্ষাৎকারের সময় রেকর্ডিং রুমে আমি, মাজিদ সাহেব ও এমটিএর কয়েকজন সদস্য উপস্হিত ছিল। কিন্তু আমরা কেউই ডেনিশ ভাষা জানতাম না। যখন জানা গেল যে সাংবাদিক হুজুরের উত্তর ডেনিশ ভাষায় অনুবাদ করবেন তখন হুজুর বাইরে একটি নোট পাঠালেন যেন ডেনমার্কের আমীর সাহেব রেকর্ডিং রুমে আসেন এবং সাক্ষাৎকার পর্যবেক্ষণ করেন।

সাধারণত যখন হুজুর সফরে কোন সাক্ষাৎকার দিয়ে থাকেন তখন সেখানে ন্যাশনাল আমীর সাহেব উপস্হিত থাকেন। আমি পরে চিন্তা করলাম যে সাংবাদিক হুজুরের উত্তরগুলো তার যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে অনুবাদ করতে পারতেন এবং আমাদের কারো এ ব্যাপারে কোন ধারণাই থাকতা না যে তিনি ঠিকভাবে অনুবাদ করছেন কিনা। আমি কেন এই ব্যপারটা চিন্তা করলাম না এটা ভেবে আমি লজ্জ্বিতবোধ করলাম। কিন্তু হুজুর মনে করে আমীর সাহেবকে ডেকেছেন এজন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

 

করমর্দন সমস্যা

সাক্ষাৎকারের সময় সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন যে হুজুর কেন মহিলাদের সাথে করমর্দন করেন না। আম এই প্রশ্নে মোটেও অবাক হইনি। কারণ সফরের এক সপ্তাহ পূর্বেই সুইডেনে মুসলমান পুরুষ ও মহিলাদের করমর্দনের বিষয়টি নিয়ে বিস্তর রাজনৈতিক আলোচনা হয়েছিল। সেখানে একজন মুসলমান রাজনীতিবিদ একজন মহিলা সাংবাদিকের সাথে করমর্দন করতে অস্বীকৃতি জানান। এর ফলে তীব্র সমালোচনার মুখে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। পরবর্তীতে এই বিষয়ে সুইডেনের সংসদেও বক্তৃতা হয়। সুইডেনের প্রধাণমন্ত্রী বলেন যে করমর্দন করা আমাদের সাথে একাত্মতা ও সম্মান প্রদর্শনের একটি অংশ।

 

পরবর্তী কয়দিনে এই বিষয়টি নিয়ে এত মাতামাতি হয় যে সফরের পূর্বে সুইডেনের জামাত হুজুরকে এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট পেশ করে। আমি যখন লন্ডন অফিসে হুজুরকে সেই রিপোর্ট দেই হুজুর নির্দেশ দেন “করমর্দন করা কোন বিতর্কিত বিষয় হোক বা না হোক; ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থী কোন বিষয়ের উপরই আমরা আমল করব না। মহিলাদের সাথে পুরুষের করমর্দন করা আমাদের শিক্ষার বিরোধী।” হুজুর আমাকে এই বার্তা সুইডেনের আমীর সাহেবকে পৌঁছে দিতে বলেন।

সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে হুজুর বলেন “আমি মহিলাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য তাদের সাথে করমর্দন করি না, তাদেরকে অসম্মান করার উদ্দেশ্যে নয়। করমর্দন করাই বিশ্বে স্বাগত জানানোর একমাত্র উপায় নয়। উদাহরণস্বরূপ হিন্দুরা দুই হাত জড়ো করে এবং জাপানীরা মাথা একটু ঝুঁকিয়ে অভিবাদন ও সম্মান প্রদর্শন করে। একইভাবে বিভিন্ন দলের সম্মান প্রদর্শনের বিভিন্ন বিশ্বাস ও প্রথা রয়েছে। এটি বলা ভুল যে কেবল একটি দলের প্রথাই সম্মান প্রদর্শনের জন্য এবং অন্যান্য প্রথা অসম্মান প্রদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়।”

 

“আমি মহিলাদের সাথে করমর্দন করি বা নাই করি; আমি মনে করি আমার হৃদয়ে অন্যান্যদের থেকে মহিলাদের জন্য বেশী সম্মান রয়েছে।”

সফরের পরবর্তী অংশে সুইডেনেও হুজুরকে এই প্রশ্নের সম্মুক্ষীণ হতে হয়েছিল। হুজুর সাংবাদিকদের একইরকম উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছেন “করমর্দনের বিষয়টিকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে; যেখানে বর্তমান বিশ্বে এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা নিয়ে চিন্তা করা দরকার ছিল। উদাহরণস্বরূপ বিশ্বের বিভিন্ন অংশে নিরপরাধ মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতি ঝুঁকির সম্মুক্ষীণ, লক্ষ লক্ষ মানুষ খাবারের জন্য মৃত্যুবরণ করছে। শান্তিপূর্ণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত না দিয়ে এবং সামান্য বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে আমাদের উচিৎ এসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা করা।”

সাংবাদিক হুজুরকে অন্যান্য মুসলমান ও আহমদীদের ধর্মবিশ্বাস এবং বিশ্বে বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অবস্হা নিয়ে প্রশ্ন করেন। আলহামদুলিল্লাহ, হুজুর প্রতিটি প্রশ্নেরই অত্যন্ত সুন্দর ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন উত্তর দিয়ে থাকেন।

 

ইসলামের সত্য শিক্ষার উপর অবিচলতা

কোপেনহেগেনে সম্প্রতি একটি মসজিদ উদ্বোধন হয়েছে যেটি নিয়ে মিডিয়াতে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এই মসজিদের দাবি হচ্ছে এটি মহিলাদের একমাত্র মসজিদ যেখানে মসজিদের ইমাম হলেন মহিলা। সংবাদিক এই মসজিদ নিয়ে হুজুরকে মহিলা ইমাম নিয়ে প্রশ্ন করেন। হুজুর বলেন “প্রশ্ন হল মানুষ কি নতুন কোন ধর্ম তৈরী করতে চায়; না মহানবী(সাঃ) যে ইসলামিক শিক্ষা প্রচার করেছেন তা অনুসরণ করতে চায়। আহমদী মুসলমান হিসেবে আমরা মহানবী(সাঃ) এর শিক্ষা অনুসরণ করি। আর যারা এরকম মসজিদ বানাচ্ছে তারা অমুসলমানদের খুশি করার জন্য এরকম কাজ করছে। প্রকৃত মুসলমান হিসেবে আমরা সবসময় মহানবী(সাঃ) এর শিক্ষা অনুসরণ করব।”

পরের দিন সাংবাদিক তার রেডিও অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারের প্রায় পুরোটাই সম্প্রচার করেন। এর ফলে খলীফাতুল মসীহর বাণী হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌছে যায়। সাক্ষাৎকারের পর হুজুর আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন ও বলেন “সাক্ষাৎকারে আমাকে সাধারণত যেরকম প্রশ্ন করা হয় আজকে তার থেকে কিছু ভিন্ন প্রশ্ন ছিল। ”

আমি হুজুরকে বললাম যে হুজুর অত্যন্ত পরিস্কারভাবে করমর্দন ও মহিলা ইমামের ব্যাপরটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। হুজুর বলেন “আমরা যেন আমাদের বিশ্বাসের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকি এ ব্যাপারে সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হবে। আমরা আল্লাহর আইন মেনে চলি। অমুসলমানদের চাপের মুখে যদি আমরা আমাদের বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকি তাহলে পরিশেষে তারাও আমাদের সম্মান করবে।”

হুজুরের বক্তব্য অত্যন্ত শক্তিশালী ও অনুপ্রেরণাদায়ক ছিল। হুজুর তার বক্তব্যে অবিচল ছিলেন যে একমাত্র খোদার প্রকৃত বান্দার মধ্যেই থাকা সম্ভব। যে কোন পরিস্হিতিতেই খলীফাতুল মসীহ ইসলামিক শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে এটিই স্বাভাবিক।

 

বর্তমান পাশ্চাত্য ধ্যানধারণার সাথে ইসলামিক কিছু বিষয়ের অমিল রয়েছে। আমরা শত বছর ধরে পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশে অত্যাচারের স্বীকার হয়ে এসেছি। কিন্তু আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি যে আহমদীরা অত্যাচারের মুখে কখনো তাদের বিশ্বাসের সাথে আপোষ করেনি। বরং আহমদীদের উপর প্রতিটি আক্রমণ, প্রতিটি শাহাদাত আমদের ঈমানকে আরো দৃঢ় করেছে। এখানেও আমাদের বিশ্বাসের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে চিন্তা করা বা ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। বরং এতে আমাদের ঈমান আরো দৃঢ় হবে।

 

একজন ভীত অতিথি

হুজুরের অফিসে আমি কিছুক্ষণ থাকি এবং গতদিনের অনুষ্ঠানের পর আমি যেসব অতিথিদের সাথে দেখা করেছি তাদের সম্বন্ধে হুজুরকে বলি। আমি সেই মহিলার কথা বলি যার স্বামী মুসলমানদের অনুষ্ঠানে আসতে ভয় পাচ্ছিলেন। হুজুর হাসেন ও বলেন “তার স্বামী শেষ পর্যন্ত আমাদের অনুষ্ঠানে আসার সাহস করতে পেরেছে। একবার এক দেশে এক ব্যক্তি আমাদের অনুষ্ঠানের পুরো সময় তার গাড়ীতে বসে ছিলেন। কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে সেখানে কোন সন্ত্রাসী হামলা হবে।”

 

ডেনমার্কের ন্যাশনাল মজলিস আমেলার সাথে মিটিং

সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাতের পর হুজুর ডেনমার্কের ন্যাশনাল মজলিস আমেলার সাথে মিটিং করেন। জায়েদাদ সেক্রেটারীকে হুজুর জিজ্ঞেস করেন “এখানে আপনার কত সম্পত্তি রয়েছে?”

জায়েদাদ সেক্রেটারী ভাবেন হুজুর তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির হিসেব জানতে চাচ্ছেন; তাই তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির হিসেব দেয়া শুরু করেন। সৌভাগ্যবশত তিনি কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য দেবার পূর্বেই হুজুর বলেন “আসলে আমি আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় বরং জামাতের এখানে কিরকম সম্পত্তি রয়েছে তা জানতে চাচ্ছিলাম।”

হুজুর এরপর সেক্রেটারী তরবিয়তকে উদ্দেশ্য করে বলেন “আমি লক্ষ্য করেছি গত দিনের চেয়ে আজ ফযরের ওয়াক্তে নামাযীর সংখ্যা কম ছিল। ডেনমার্কের বাইরে থেকে আসা আহমদীর সংখ্যাই বেশি ছিল। আমি যখন জার্মানী যাই তখন ৩০-৪০ কি:মি: দূর থেকে আহমদীগণ ফযরের ওয়াক্তের নামায আদায় করতে মসজিদে আসেন। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি এখানে পরিস্হিতি সম্পূর্ণ আলাদা। আমার উপস্হিতিতেই নামাযীদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। তাহলে আমি যখন চলে যাব তখন কেমন অবস্হা হবে? আপনাকে মসজিদে নামায আদায়ের ব্যাপারে অনেক মনোযোগ দিতে হবে। আমেলা সদস্যদের এ ব্যাপারে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।”

“মসজিদের সাথে সম্পর্ক তৈরী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভব হলে খোদ্দাম, আনসার ও লাজনাদের অনুষ্ঠানসমূহ একই দিনে আয়োজন করা উচিৎ। তাহলে পুরো পরিবার একত্রে মসজিদে আসার জন্য অনুপ্রাণিত হবে।”

জিয়াফত সেক্রেটারী বলেন যে এরকমভাবে একত্রে অনুষ্ঠান করা হলে খাবার ও অন্যান্য খরচ কে বহন করবে। হুজুর বলেন “যদি খাবার ও পানীয়ের অর্থাভাবের জন্যই লোকজন মসজিদে না আসতে পারে তাহলে আমি আনন্দের সাথে নিজেই জিয়াফতের খরচ দিয়ে দিব। এটি অনুষ্ঠান আয়োজন করার ক্ষেত্রে কোন বাধা হতে পারে না।”

হুজুর সেক্রেটারী তরবিয়তকে পরামর্শ দেন যেসব আহমদী জামাত থেকে দূরে সরে গিয়েছেন তাদের বাসায় যাবার। সেক্রেটারী তরবিয়ত বলেন যে কিছু আহমদী এভাবে তাদের বাসায় যাওয়া পছন্দ করেন না। হুজুর বলেন “তারপরও আপনার তাদের বাসায় যেয়ে তাদের খোঁজ খবর নেয়া উচিৎ। তাদের কোন সমস্যা বা  প্রয়োজন আছে কিনা তা জানা উচিৎ। তাদের দরজা পর্যন্ত যাবে; যদি তারা তাদের ঘরের ভিতরে আমন্ত্রণ না জানায় তাহলেও কোন অসুবিধা নেই। তাদের সালাম জানাও এবং কোনরকম মনোঃকষ্ট না নিয়ে ফিরে চলে আস। এভাবেই তোমরা তাদের বিশ্বাস ও ভালবাসা লাভ করতে সক্ষম হবে। যদি তোমাদের প্রচেষ্টায় তাদের কোন উন্নতি নাও হয়; তাহলেও আল্লাহ তোমাদের সালাম ও নেক উদ্দেশ্যের জন্য তোমাদের পুরস্কৃত করবেন।”

 

হুজুরের আবেগপ্রবণ নসিহত

একজন আমেলা সদস্য হুজুরের কাছে বেনামে পাঠানো পত্র সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেন। যেমন কেউ যদি নিজের নাম না লিখে কারো সম্বন্ধে অভিযোগ জানিয়ে হুজুরকে চিঠি দেয়। হুজুর বলেন “সাধারণত এরকম চিঠির জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় না। কিন্তু সেই চিঠির একটি কপি অভিযুক্ত ব্যক্তির স্হানীয় জামাতকে পাঠানো হয়। এর কারণ হল স্হানীয় জামাত সেই বিষয়ের ব্যাপারে জেনে থাকবে। তারা বুঝবে যে অভিযোগটি সঠিক না ভুল এবং সেই ব্যাপারে পদক্ষেপ নিবে।”

সেই আমেলা সদস্য বলেন “একবার ডেনমার্ক জামাত থেকে একজন বেনামে হুজুরকে অভিযোগ জানিয়ে একটি চিঠি লিখে। স্হানীয় জামাত মনে করে যে আমার ছেলে চিঠিটি লিখেছে। তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলে যে সে চিঠি লিখেছে কিন্তু হুজুরের কাছ থেকে কোন উত্তর পায়নি। কিছু সময় পর সে লন্ডনে হুজুরের সাথে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করতে যায়। আমি তাকে উপদেশ দেই সে যেন সাক্ষাতের সময় সেই বিষয়ে কোন কথা না বলে। আমার মনে হল এতে হুজুর কষ্ট পেতে পারেন এবং জামাত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নিতে পারে বা জামাত থেকে তাকে বহিস্কার করে দিতে পারে।”

হুজুর আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন “আমি সব চিঠিরই উত্তর দিয়ে থাকি। তাই হতে পারে সেই চিঠিটি আমার কাছে পৌঁছেনি বা আমার উত্তর তার কাছে পৌঁছেনি।”

“আমার সাথে সাক্ষাতের সময় আপনার ছেলেকে সেই বিষয়ে কথা বলতে মানা করা অত্যন্ত ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এভাবেই ক্ষোভ সৃষ্টি হয়ে থাকে। আপনারা মনে কর খলীফায়ে ওয়াক্ত বিনা কারণে কাউকে শাস্তি দিয়ে থাকেন। কাউকে জামাত থেকে বহিস্কার করা হল একদম চূড়ান্ত পদক্ষেপ। খলীফায়ে ওয়াক্ত কোন কারণ ও পূর্ণ তদন্ত ছাড়া কখনো এরকম পদক্ষেপ নিবেন না।”

“সত্যের বিজয়ের জন্য সবসময় আল্লাহর কাছে দয়া ও করুণা ভিক্ষা করা উচিৎ। সবারই ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে। তাই আমদের উচিৎ আল্লাহর কাছে বিচার চাওয়ার পরিবর্তে নিজেদের ভুল ভ্রান্তির জন্য দয়া ও ক্ষমা চাওয়া। আপনাদের সন্তানদের কখনো প্রশ্ন করতে বাধা দিবেন না। এর ফলেই ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়। মনে রাখবেন কোন আহমদী বা মানুষের বিরুদ্ধেই আমার ব্যক্তিগত কোন শত্রুতা নেই।”

হুজুরের এই কথাগুলো শুনে আমার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। আমি দেখলাম রুমের অন্যান্যরাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। এই ঘটনা দেখে আমি চিন্তা করলাম যে একজন আহমদীও জামাত থেকে দূরে সরে যাক; এটি হুজুর চান না। তারপরও কিছু মানুষ মনে করে হুজুর সামান্য কারণে কাউকে জামাত থেকে বহিস্কার করে দিতে পারেন।

 

হুজুরের দয়ার একটি উদাহরণ

সেদিন মির্যা মাসূদ আহমদ(৫০ বছর) আমার কাছে আসেন। তার নাম শুনে আমি ভাবলাম যে তিনি মসীহ মাউদ(আঃ) এর পরিবারের একজন সদস্য। কিন্তু আমার ধারণা সঠিক ছিল না।

তিনি আমাকে কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা বলেন। হুজুর তখন জার্মানী সফরে ছিলেন। তিনি সাক্ষাতের জন্য পুরো পরিবারসহ জার্মানীতে এসেছিলেন। যখন তার বোন হুজুরের সাথে সাক্ষাত করেন; তিনি হুজুরকে পুরো পরিবারের সাথে একটি ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করেন। পরিবারের সদস্য অনেক বেশি হবার জন্য হুজুরের অফিসে ছবি না তুলে বাইরের করিডোরে ছবি তোলা হয়। হুজুরের বসার জন্য তার পরিবারের সদস্যরা একটি চেয়ার এনেছিলেন। পরিকল্পনা ছিল হুজুর চেয়ারে বসবেন এবং পরিবারের সদস্যরা হুজুরের দুই পাশে দাড়িয়ে থাকবেন। হুজুর এসে মাসূদ সাহেবের বৃদ্ধ মা কে দেখলেন এবং সাথেসাথেই তার মায়ের বসার জন্য একটি চেয়ার আনতে বললেন।

আমার সাথে এসব কথা বলার সময় তিনি কাঁদছিলেন। তিনি আরো বলেন “প্রত্যেক আহমদীরই নিজ নিজ ঘটনা রয়েছে; যে কিভাবে খলীফায়ে ওয়াক্ত তার জীবনে প্রভাব ফেলেছে। আমি সেই ঘটনাকে আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে মনে করি। হুজুর আমার মায়ের জন্য যে ভালবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন আমি তা কখনো ভুলতে পারব না। সেই ঘটনা মনে হলেই আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। ”

 

ডেনমার্ক থেকে বিদায়

হুজুরের ডেনমার্ক সফর শেষ হল এবং আলহামদুলিল্লাহ এটি অনেক বরকতময় সফর বলে প্রমাণিত হয়েছে। মাত্র ৬ দিনের সফরেই হুজুর ডেনমার্কের উপর বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। তার বক্তব্য শুধু স্হানীয় আহমদীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং মিডিয়ার সাহায্যে একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে গেছে।

এখন আমাদের কাফেলা সুইডেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। যদিও এটি একটি নতুন দেশ কিন্তু গাড়ীতে করে সেখানে যেতে এক ঘন্টারও কম সময় লাগবে। আমাদের কাফেলা বিকেল ৫.১০ মিনিটে নুসরাত জাহান মসজিদ থেকে সুইডেনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। হুজুর ডেনমার্কের আহমদীদের বিদায় জানান। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখি যে আহমদীদের চেহারা অত্যন্ত মলিন। তাদের খলীফা তাদের থেকে চলে যাচ্ছে এবং তারা ভাবছে যে আবার কবে তারা খলীফাকে দেখতে পাবে।

 

সুইডেনে আগমন

আমরা ডেনমার্ক ও সুইডেনের সংযোগকারী ব্রীজ পার হয়ে বিকেল ৫.৪৫ মিনিটে সুইডেনের সীমান্তে পৌঁছাই। সেখান থেকে সুইডিশ পুলিশ পূর্ণ নিরাপত্তা প্রহরায় আমাদের কাফেলাকে মাহমুদ মসজিদে নিয়ে যায়। এই সফরে হুজুর মাহমুদ মসজিদ উদ্বোধন করবেন। মাহমুদ মসজিদ আমি যেরকম ভেবেছিলাম তার চেয়ে বড়। এটি অত্যন্ত সুন্দর। আমি আমাদের সফরের সামনে দিনগুলোর অপেক্ষায় আছি। হুজুর এখানে কেবল মাহমুদ মসজিদ উদ্বোধনই করবেন না; তিনি স্টকহোম ও গুটেনবার্গ শহরেও সফর করবেন।